হলদে গোলাপ – ৪০

৪০

আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল অনিকেতের। বিহার থেকে বেরিয়ে আলাদা প্রদেশ হল ঝাড়খণ্ড—২০০০ সালের নভেম্বরে। আকাশে বাজি চমকালো, বাজনা ঝমকালো, বাজারের ব্যবসায়ীরা লন্ডা নাচাল। আবার ‘ক্যালকাটা’-ও হয়ে গেল কলকাতা। বাঙালিরা উচ্চারণ করে ‘কোলকাতা’। কিন্তু টিভিতে অবাঙালিরা বলছে ‘কঅল্‌কাতা’। শুনতে কেমন যেন লাগছে।

অনিকেতের আরও কিছুদিন পেরিয়ে যাওয়া মানে তো দুলালেরও আরও কত কী ঘটে যাওয়া। দুলাল তো নয়, ‘দুলালী’। অনিকেত দুলালীকে নিয়ে লিখছে।

নাগেশ্বরী চাত্তারা-কে বলল—অনেকদিন তো হল, দুলালীর ‘নথ-ভাঙা’ কবে হবে লো? চাত্তারা গত রাতে অনেকটা ‘খিলুয়া’ খেয়েছিল। ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। হাই তুলে বলল—এখনই করে দাও, এধারে তো ‘বাঁধনা পরব’ চলছে।

‘বাঁধনা পরব’ হল সাঁওতাল-কুর্মিদের উৎসব। গরুদের খুব খাতির করা হয় এই সময়, ওদের গায়ে চটের জামা পরানো হয়, ক্ষুরে জল পড়ে, গুড়-ছোলা খাওয়ানো হয়। বাঁধনা পরব- এর মধ্যে যদি কোনও গাই ‘পাল’ খেতে চায়, সেটা ভাবা হয় খুব ভাল লক্ষণ। লক্ষ্মীমন্ত গাই বাঁধনায় পাল খায়।

নাগেশ্বরী বলল, তবে রবিবার করে দে।

রবিবার দিন রোজগারপাতি ভাল হয় না। দুর্গাপুর-পানাগড়ের গেরস্ত পাড়ায় ব্যাটাছেলেগুলো ঘরে বসে থাকে। হুমদো মদ্দা ঘরে থাকলে রোজগার ঢিলে যায়। রোববার-ই ঠিক হল ‘নথ-ভাঙা’ হবে। হাতে দু’দিন।

‘নথ-ভাঙা’ অনেকটা কৌমার্য ভঙ্গের মতো।

অ ছবি… গুরুমা ডাকেন।

—রোববার দুলালীর ‘নথ-ভাঙা’। তোরা পারবি, না কি বাইরে বলাব?

ঝর্না-টর্নারা বলল—ধুর। বাইরে বলবে কেন, নিজেরা করব। বড় খোবরা, কপি ভাজার টাকনি।

মহুয়া বলল, ট্যাংরা মাছ খুব উঠেছে।

নাগেশ্বরী বলল, ছুঁড়িদের শখ কত, ট্যাংরা খাবে। ট্যাংরা পোঁদে দে।

মহুয়া বলল, নথ-ভাঙার দিনে মাছ খেতে হয়। আমার সময় হয়েছিল।

—কী মাছ হয়েছিল যেন?

—তেলাপিয়া।

—ঠিক আছে, দেখা যাবে। চাত্তারা যা বলবে।

চাত্তারা বলল, কত হাতি গেল তল, মশা বলে কত জল। বেড়ালকে মাছ খাওয়ানো শেখানো। দুলালী পাক্কি মাল। বহুত চুয়া খা চুকা বিল্লি।

ওরা সবাই জানে, এসব খোলে যারা আসে, তারা এর আগে ভালমতো পুরুষ-সঙ্গ করেছে। তবু এটা একটা ‘প্রথা’। নথ-ভাঙার নামে একটু নাচা-গানা, খিলুয়া-খোবরা খাওয়া

এখানে আসার পর এখনও পারিক বসায়নি দুলাল। অন্যরা বসায়। দুলাল দেখে। মুখ ফুটে কিছু বলেনি। ও জানে, ‘নথ-ভাঙা’ না-হলে স্বাধীনভাবে পারিক বসাতে পারবে না। মেয়েরা যেমন মা-কে বলতে লজ্জা পায়, ‘মা আমার বিয়ে দিচ্ছো না কেন?’—তেমনই দুলালীও বলেনি—’আমার নথ-ভাঙা কবে হবে মা?”

তবে গুরুমা-র নজর আছে।

তবে এ ক’মাস যে একদম উপোসী ছিল দুলালী, তা নয়। রেল স্টেশনের ডিউটিতে গিয়ে রেল পুলিশ ওকে একবার বসিয়েছিল। খুব লাগছিল। দুলালী দেখছিল, ওর ঘরে ভেন্ডি আছে। ভেন্ডি ছেঁচে, একটু জলে মিশিয়ে নিলে, বেশ একটা হড়হড়ে জিনিস তৈরি হয়। ওতে কাজ হয়েছিল।

এখানে লাল-হলুদ-সবুজ রঙের কাঠের তৈরি বিভিন্ন সাইজের ‘লোলা’ রাখে কেউ-কেউ। ‘লোলা’ হল বাচ্চাদের মুখে দেওয়ার জন্য কাঠের তৈরি একটা জিনিস। একটা ছোট্ট হাতল, সামনের মুখটা গোল। বাচ্চারা যা পায় মুখে দেয়। ফ্রয়েডের চিন্তায় ওটা ‘ওরাল ফেস’। মায়ের স্তন খাওয়ার সময় ওদের মুখে একটা সুখানুভূতি হয়। সেই অনুভূতি পাওয়ার জন্য ওরা আঙুল চোষে, কলম-পেন্সিল—যা পায় মুখে দেয়। বাচ্চাদের জন্যই তৈরি করা হয়ে থাকে ওই ‘লোলা’। গ্রাম্য বাজারে কিংবা মেলায় পাওয়া যায়। ওগুলো রঙিন হয়। হয়তো খুব খারাপ রং। শিশুদের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত রং। কিন্তু এসব দেখছে কে। গ্রাম্য মেলায় বড় মাথাওলা লোলা-ও পাওয়া যায়। বোঝাই যায়, ওগুলো শিশুদের জন্য নয়। মাথাটাও গোল নয়। একটু ডিম্বাকার। ওগুলো তবে কাদের জন্য বিক্রি হয়? যাদের জন্য বিক্রি হয়, ওরা কিনে রাখে। এসব ওদের টুল্স। ভেন্ডি ভেজানো জলে, কিংবা কাঁচা ডিমে ভিজিয়ে ওরা পায়ু- ব্যায়ামটা করে। প্রথম দিকে তো করতেই হয়। বিদেশে ‘গে’-দের জন্য এসব ব্যায়ামের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। ইন্টারনেট-এ দেখেছে অনিকেত। খোজাদের সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখা গিয়েছে, অটোমান সম্রাটরা ওদের হারেমে অন্যান্য রাজার মতোই খোজা রাখতেন। হারেম পাহারা ছাড়াও সম্রাটদের কাম-ক্রিয়ায় সাহায্য করত। বালিশ সেট করে দেওয়া, পা দু’টো ঠিক জায়গায় ‘সেট’ করে দেওয়া ইত্যাদি। কখনও-কখনও সমকামী সম্রাটরা এদের যৌন-সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করতেন। ওদের পৌরুষহীন, যৌনতাহীন বলেই ভাবা হত। অথচ খোজাদেরও একটা যৌন-জীবন ছিল। ওরা নিজেদের মতো করে কামকলা উপভোগ করত। সুতো দিয়ে বাঁধা ডিম সেদ্ধ বা কাঠ বা ধাতব দণ্ড সুতোয় বেঁধে, পায়ুপথে প্রবেশ করিয়ে সুতো ধরে নাড়াত। পায়ুনালীর অপর পাশে প্রস্টে। প্রস্টেটের সঙ্গে ঘর্ষণ হত, কিন্তু ওরা তো জানত না—ওটা প্রস্টেট, ওরা জানত সুখানুভূতি। কেটে ফেলা লিঙ্গের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা এবড়োখেবড়ো মাংসপুঁটুলির মাঝখানে লুকিয়ে থাকা ছিদ্রপথে নেমে আসত সুখরস। যেটা প্রস্টেট থেকে নিঃসৃত। এরকমও গল্প আছে, একে অন্যের সুতোর ওপর ছড় দিয়ে ভায়োলিন জাতীয় বাজনা বাজাত। একটা অদ্ভুত শব্দ তৈরি হত। সেই শব্দঝংকার বা ধাতব কম্পন প্রস্টেটে পৌঁছত। এবং ওই অদ্ভুত শব্দকে বলা হত ‘ক্যাফ্রিয়ান প্যাথোজ’। ওই আওয়াজটা পরে ভায়োলিনে ঢুকে গিয়েছিল।

দুলাল যখন নতুন-নতুন—সিনিয়ররা ওকে একটু-আধটু র‍্যাগিং করত। গুরুমা দুলালকে ডেকে গা-হাত-পা টেপাত। চাত্তারাও মাঝে-মাঝে। দুলালকে বলত, লিক্‌ম ঠেকাতে। কিন্তু দুলাল ওই কাজটা করতে পারত না বলে বকাবকি করেনি। বলেছে, আহা লো…। ওই ডাক শুনে দুলাল আর দুলাল থাকত না, ‘দুলালী’ হয়ে যেত।

ফুলিও ডেকে নিয়ে ঘরে এটা-ওটা করতে বলে। একদিন তেল মাখিয়ে দিতে বলেছিল। ম্যাক্সি খুলে দিয়েছিল ফুলি। বলেছিল, সারা গায়ে মাখা। ফুলির হাতে-পায়ে লোম ছিল, বুকটায় লোম ছিল না, সামান্য উচু। মাঝখানে ছোট-ছোট কিশমিশ। তার দু’উরুর মাঝখানে চুলে ঢাকা একটা ছোট্ট পুটুলি। ‘ছিন্নি’ হলে দুলালীরও ওরকম হবে। ঘাবড়ায় না ও। সবার যা হয়, ওরও হবে। এটাই হল লিক্‌-টার গোড়া। একদম গোড়া থেকে কাটলেও, আধ আঙুল পরিমাণ মাংস রয়েই যায়। ওখানে তেল মাখায় দুলালী, যত্নে। কী আশ্চর্য ওই আধ আঙুল পরিমাণ সমাধি ফলকের মতো মাংসখণ্ড কেমন জেগে ওঠে, কঠিন হয়ে ওঠে, শক্ত হয়ে ওঠে। কাঁপে। মুঠোয় চেপে ধরে দুলালী। ফুলি হাসে। বলে, চড়াই পাখি ডিম পেড়ে গিয়েছিল। বেশি চাপিস না ফেটে যাবে।

দুলালীরও ওটা খসাতে হবে। এটা না-খসালে, কদর নেই। কেটে ফেলাই ভাল। এ শালা মাঝে-মাঝে জ্বালাতন করে। কষ্ট তো একটু পেতেই হবে। সব ধর্মেই কষ্ট আছে। ধর্মরাজের থানে যারা কাঁটা ঝাঁপ দেয়, যাঁরা জিভে লোহার কাঠি ফোঁড়ে, জ্বলন্ত আঙারে হাঁটে—ওদেরও তো কষ্ট হয়।

দুলালীকে দিয়ে শুধু গা-টেপানো তেল-মাখানো নয়, আরও কতরকম রসিকতা করে ওরা। একদিন সকালবেলা ঘুম ভেঙে দেখে, ওর লিক্‌মের মাথায় কী যেন সাদা সাদা। ‘নিরখা’ এত ঘন হয় না কি? মাঝেমধ্যে একটু-আধটু ‘নিরখা’ খসে। কিন্তু এটা অন্য কিছু। হাতে নিয়ে শুঁকে দেখে। ও হরি! টুথ পেস্ট। তখন সবাই হাসাহাসি করে। বলে, তোর খোকা দাঁত মাজবে। তোর ম্যাক্সির তলায় দ্যাখ গে, একটা ব্রাশ রেখে দিইচি। সত্যিই দেখল একটা ব্রাশ আছে।

এসব ঠাট্টা-ইয়ার্কি ছাড়া অন্য ট্রেনিংও হয়েছে। চাত্তারা, ফুলি সবাই কিছু-না-কিছু ট্রেনিং দিয়েছে গুরুমা-র হুকুমে। পুরুষ পারিককে গা টেপার ট্রেনিং দিয়েছে। চাত্তারা বলেছে, টেপাটিপিতে মদ্দারাও খুব আরাম পায়। দোষ দেয় মাগিদের। কানের কাছে গরম ভাপ দেওয়া শিখিয়েছে, কানের লতি আস্তে করে কামড়ানো, পুরুষের বুকে ছোট করে জিভের কাজ করা—সব।

—আর মুখের কাজ কী শেখাব, ওটা না-করলে পারিক ধরে রাখতে পারবিনে। ফুলি বলেছিল—কোনও-কোনও পারিক দেখবি হাবার মতো তোর আদর খেল কিছুক্ষণ, তারপর তোকে আদর করবে। তোর শাড়ির তলায় হাত চালাবে, তোর লিম-টা খুঁজবে। নাড়িয়ে ফড়কে দেবে। ও তোকে উপড় করে যেমন ধুরবে, তোকেও বলবে ‘ধুরে’ দিতে। ওরা হল ডুপ্লি। দেয় আবার নেয়।

দুলাল বলেছিল, অ্যা-মা। ওসব আমি পারব না।

ফুলি বলেছিল, ওসব তো আমারও ভাল লাগত না। ওই জন্যই তো আমি ছিবড়েছি।

.

দুলালের নথ-ভাঙতে আজ আসবে লছমন যাদব। গাড়ি সারাইয়ের কারবারি। ওর নিজের একটা কিংবা দু’টো গ্যারাজ আছে। পানাগড়ে এই ব্যবসাটা খুব ভাল চলে, কারণ মিলিটারি গাড়ি নিলাম হয় এখানে। যারা কেনে, ওরা সারাই করে। বডি তৈরি করে।

লছমনের দেশ বিহারের কোথাও। ওখানে ওর বউ-সংসার, মকাই খেত, গেঁহু খেত, বরি- ভঁইস সব আছে। পানাগড়েও দোতলা বাড়ি, বিলাইতি কুত্তা, জেনানা, নোকর—সব আছে। আজকের ‘বড় খোবরা’ মানে পাঠার মাংস, আর বিলাইতি মালের খরচ যাদবই দেবে। যাদব ঝুমকোরও ‘নথ’ ভেঙেছিল। নাগেশ্বরীকে বলেছে—কীসব মাল আনছ, আকখাট, একটা ‘নাগিন’ আনতে পারো না?

‘নাগিন’ মানে বেশ মিষ্টি-মিষ্টি দেখতে পুতুপুতু পুরুষ। চোখ বড়-বড় হবে, রং ফরসা হবে, ঠোঁট লালচে হবে, পেটে ভুঁড়ি থাকবে না, একটু ন্যাকা ন্যাকা কথা বলবে—মানে মেয়েদের মতো দেখতে মেয়েলি-পুরুষ। নাগেশ্বরী এখনও ‘নাগিন’ জোগাড় করতে পারেনি। নাগেশ্বরী জানে, ‘নাগিন’ পেলে যাদব বহুত খরচ করবে।

‘নথ-ভাঙা’ যাদবের হবি। শুধু হিজড়েদেরই ‘নথ’ ভেঙেছে এমন নয়, বর্ধমানের বেশ্যা পল্লিতে গিয়ে কিশোরী বালিকারও ‘নথ’ ভেঙেছে। ওর লোক ফিট করা আছে। নথ-ভাঙার বরাত পেলে এই শুভকর্মটা করে আসে। এজন্য যাদব খরচাও করে।

খরচা মানে ওখানে আনন্দ-ফূর্তির খরচা ছাড়াও, নিজের শরীরেরও মেনটেনেন্স আছে। ভোরবেলা ছোলা ভেজানো খায়, একটু পর পেস্তা-কাজু বাটার শরবত মধু দিয়ে। কে যেন বলেছিল, পাঁঠার অণ্ডকোষ দুধে সেদ্ধ করে খেলে খুব ‘তাকত’ হয়। সেটাও খায়। শিলাজিৎ দুধে গুলে খেয়েছে। বাজার থেকে পালঙ্কতোড় তেল মালিশ করে পুংদণ্ডে। যদি গন্ডারের শিঙের গুঁড়ো পায়, যত টাকা লাগুক—খরচ করতে রাজি।

সকালবেলা পার্বতী হোটেলের হেড রাঁধুনি এসে বলে গিয়েছে, যাদবজি আসবে। খবর দেওয়া হয়েছে। ওই লোকটার নাম লসুন পাইক। দালালির কাজ করে। হিজড়ে খোলে খদ্দের নিয়ে যায়। অনেক ট্রাক ড্রাইভার কিংবা গাড়ির মিস্ত্রি মেকানিক খেতে আসে হোটেলে, লগন ঠিক বুঝে যায়। কীভাবে বলবে, কখন বলবে—এ ব্যাপারে বাহাদুর। নতুন খদ্দের নিয়ে গেলে কমিশন পায়।

লছমন যাদব এই খোলের নিয়মিত খদ্দের নয়। কমই আসে এখানে। কারণ ঠিকমতো কেউ নেই। কাউকেই খুব একটা পছন্দ নয়। নাগেশ্বরী এখনও একটাও ‘নাগিন’ এনে দিতে পারেনি।

লছমন আসবে সন্ধে নাগাদ। দুপুরে একটু গড়ানো হল। চোখ ফুলো করা হল। ফুলশয্যার দিন নতুন শাশুড়ি-মা আজকাল বলে, একটু ঘুমিয়ে নাও মা। এটাকে মেয়েদের ম্যাগাজিনে বলে ‘বিউটি স্লিপ’। চারটে নাগাদ ওঠা হল। উঠানের বাইরে তিন-চারটে কুকুর বসে আছে। ওরা ছল্লায় বের হল কি না কুকুররা ঠিক খবর পায়। না-বেরলে দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়। কিছু এঁটোকাঁটা পড়ে থাকে। দরজাটা খুললেই কুকুরগুলো সে সবের ওপর হামলে পড়বে।

এবার প্রসাধন। দর্শন দিয়ে দাড়িগোঁফ টেনে-টেনে তোলা। এতদিনে গোঁফ-দাঁড়ি অনেকটাই কমে গিয়েছে। গত ক’মাস ধরে গর্ভনিরোধক বড়ি খাচ্ছে দুলাল। চামড়াও বেশ নরম-নরম হয়েছে। বুকের ওপর অল্প-অল্প মাংসও গজিয়েছে। গুরুমা-র ঘরে নানারকম সাজগোজের জিনিসপত্র আছে। দুলালীর তেমন কিছু নেই। পাউডার, ক্রিম, লিপস্টিক আর কাজল কাঠি। হাসি বেশ সাজাতে জানে। ও গুরুমার ঘর থেকে এটা-ওটা কত কী নিয়ে এসে, মুখে মাখাল। ভ্রু টেনে দিতে-দিতে একবার বলল, মাধুরী দীক্ষিত। চোখের ওপর কী একটা মাখিয়ে গুনগুন করে গাইছিল, আঁখ মার দে। নখে রুপোলি নেলপালিশ লাগাল, সঙ্গে গান, ‘মেহেন্দি লাগাকে রাখ না।’ মেহেন্দি হলে ভালই হত, কিন্তু এখানে মেহেন্দি করবে কে? একটা লাল শাড়ি কিনতে হয়েছিল দুলালীকে। ওটা বার করল। শায়া পরার আগে জাঙ্গিয়া পরে নিল। ওরা বলে, প্যান্টি। দুলালী এখনও প্যান্টি কেনেনি। প্যান্টি আর জাঙ্গিয়ার মধ্যে তফাত কতটুকুই বা? বোধহয় একটু ছোট আর বড়। এরপর শায়া এবং শাড়ি। বেশ সুন্দর করে পরিয়ে দিল ওরা। সুন্দর দু’টো ইলু’ ভরে দিল বুকে। জল ভরা মোটা রবারের বেলুন। এই বেলুন ওজন দরে কিনে আনে, পিচকিরি দিয়ে জল ভরে রাখে। আয়নার সামনে দাঁড়াল দুলালী। চেনাই যাচ্ছে না। ওপাশ থেকে যেন দুলালী শুনল : তুই কে এলি?

দুলাল যখন বিয়ে করতে গিয়েছিল, এরকমই লাল শাড়িতে সেজেছিল ওর বউ। কপালে চন্দনের ফোঁটা ছিল। দু’জনে দুলালীর দু’হাত ধরে গুরুমা-র কাছে নিয়ে গেল। গুরুমা’কে দুলালী প্রণাম করল। গুরুমা দুলালীর থুতনিটা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল—বারেব্বা, একদম গাল-ভাঙা হেমামালিনী।

ঘর থেকে বেরনোর সময় ঢোলে পা লেগে গেল দুলালীর। এ কী করলি—গান্ডুনি, বোকাচুদি—কানা খানকি—এসব খিস্তি করতে লাগল সবাই মিলে। মহা অন্যায় হয়ে গিয়েছে। ঢোলে পা লাগা পাপ। তাও আজকের মতো শুভদিনে?

লাজে মরে যায় দুলালী। দেখতে পায়নি। মাথায় ঘোমটা ছিল যে। যে-ঢোলটা পায়ে লেগেছিল, দু’হাতে স্পর্শ করে নমস্কার করল। গুরুমা বলল—এমন করে পেনাম করলি যেন ‘আয়াম সরি, আয়াম সরি’। এস্টাইলের মাগিরা যেমন পায়ে পা লাগলে করে। লম্বা হ, দণ্ডবৎ হয়ে পেনাম কর।

তাই করল দুলালী। ‘ঢোল’-কে কী বলে সম্বোধন করবে—বুঝতে পারছিল না। এটুকু বুঝেছিল, ওদের এই সমাজে ঢোল খুব পবিত্র। বেস্পতিবার ঢোলের গায়ে সিঁদুরের ফোঁটা পড়ে। ঢোল-ই তো লক্ষ্মী। কিন্তু ঢোল কি দেবী না দেবতা? হে ‘ঢোল বাবা’ বলবে, না কি হে মা ঢোল’ বোঝেনি—দুলালী বলেছিল, হে ঢোল, ক্ষমা করো। ইচ্ছে করে পা ছুঁইনি।

পরে যখন দুলালের অসুখ করেছিল, দুলালের মনে হয়েছিল ওটা সেই ‘নথ-ভাঙা’র দিনে ঢোলে পা লাগার ফল।

উৎসবের আবহাওয়া কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল। এরই মধ্যে লছমন যাদব এসে গেল। টেরিকটের ঘিয়ে পাঞ্জাবি এবং সরু পাজামা পরে এসেছে। গা থেকে আতরের গন্ধ বেরচ্ছে। লোকটার বেশ মোটা গোঁফ আছে। কান থেকে লোম বেরিয়েছে। কাশছে লোকটা।

গুরুমা ওকে নিজের ঘরের চেয়ারে বসাল। হাসি আর ফুলি দুলালীকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। এখন, যাওয়ার আগে বহুচেরা-র ছবিটাকে প্রণাম করার ছলে আড়চোখে পারিক- কে দেখে নেয়। ‘পুরীর স্মৃতি’ লেখা রেকাবিটা থেকে কালো পিঁপড়ে ঝেড়ে একটা নকুল দানা উঠিয়ে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বলল, পাপ খণ্ডন করো মা।

ঘরে আসর বসে গেল। বেচারা দুলালী বাইরে। তবে গুরুমা-র ঘরে সবাই ঢুকতে পারেনি। গুরুমা যাদের বলেছে তারাই এসেছে। সিনিয়রদের মধ্যে চাত্তারা তো আছেই, ফুলি, ঝর্না আর মহুয়া আছে। মহুয়ার নথ-ভাঙার কাজটা যাদব-ই করেছিল, তাই জুনিয়ার হয়েও ও অনুমতি পেয়েছে। তা ছাড়াও, একটু ঝলবনানি আছে। নাচতে পারে। হাসিও থাকছে, কিন্তু ও বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। খাবারদাবারের দিকটা সামলাতে হবে ওকে। লালুকে খবর দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। ও একজন আকখাট মদ্দ। গুরুমা একটা সাইড বিজনেস চালায়। গাঁজার। লালুকে ফোকটে খিলুয়া খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।

কাচের আলমারি খুলে গেলাস বার করল ঝুমকো। বোতল বার করল যাদব। ঝর্না থালায় সাজিয়ে চানাচুর আর আলুভাজা এনে দিল। গেলাসের ঠুংঠাং শব্দ। টু ইন ওয়ান’-এ ক্যাসেট ঢুকিয়ে দেওয়া হল। গান বাজল ‘রূপ তেরা মস্তানা’। ভিতরে হাহা হিহি চলতে লাগল, খিস্তি- খেউড় চলতে লাগল, গালাগালি-মাখা গানও। মাঝখানে হাসি এসে একটু গরম জল চেয়ে নিয়ে গেল। যাদব গরম জল দিয়ে রাম খাবে। ওর খুব কাশি হয়েছে।

একটা ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছে। ওখানে দুলালীর নথ-ভাঙা হবে। চাদরটা পরিষ্কার। চাদরের ওপর কেউ মজা করে কয়েকটা গাঁদা ফুল ছিড়ে ছড়িয়ে রেখেছে।

দুলালীর হাতে একটা গেলাস ধরিয়ে দিল চাত্তারা। বলল, তিনবার ফুঁ মারতে হবে। এক ফুঁয়ে সদা যেন থাকি চনমন, দুই ফুঁয়ে পারিকের সদা টাইট ধন, তিন ফুঁয়ে পারিকের সদা থাকে মন।

খাওয়াদাওয়া হল। দুলালী কনে বউয়ের মতো খাটে বসে আছে। গুরুমা এলেন। ‘অম্বার পাঁচালি’-টা পড়বেন এবার-

জয় জয় নম নম পুণ্য কাশীধাম
কাশী রাজের কন্যা ছিল অম্বা তাঁর নাম।
গুণবতী কন্যা সে, রূপবতী নারী
রূপের বর্ণনা তার দিতে নাই পারি।।
যেমন নাই তার তেমনি মাই
এ মেয়ের তুলনা ত্রিভুবনে নাই।
শাল্ববদেশে এক রাজা সুন্দর চেহারা
বড় মদ্দ জম্মু লিকম সদা থাকে খাড়া
অম্বা রানী তাহাকেই মনটা দিয়াছে
কিন্তু ভীষ্ম রাজা তাকে হরিয়া নিয়াছে।।

কিন্তু শোনো, ভীষ্ম হল ব্রহ্মচারী ন্যাকড়া লিম। ওর নিজের জন্য অস্বাদেবীকে লেয়নি কো। ওর জ্ঞাতি বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বে দেবে বলে হরণ করেছিল। পরে জানতে পারল যে অম্বা অন্য একজনকে মন দিয়ে রেকেচে। ভীষ্ম তখন অম্বাকে ছেড়ে দেয়। অম্বা শাল্ব রাজার কাছে যায়—ওগো রাজা, আমি ফিরে এলাম, আমায় আলিঙ্গন দাও। শাল্ব বলল—আলিঙ্গন? আমি তোকে ছুঁব না। শালা ভীষ্ম তোকে অপবিত্র করেছে। অম্বা বলল মায়ের দিব্বি। ভীষ্ম কিছু করেনি। ও ব্রহ্মচারী।

শাল্ব বলল,
ব্রহ্মচারীর গান্ডি মারি
তুই হলি কুলটা নারী
তোকে আমি ঘিন্না করি
তুই ফুটে যা হতচ্ছাড়ি।
মনোদুখে অম্বা দেবী চলে গেল বনে
শিবঠাকুরের ধ্যান করে ভক্তিমনে।
মনে ভাবে ভীষ্মের জন্য তার এই হাল।
ভীষ্ম যদি মরে তবে মেটে গায়ের ঝাল।
নমো নমো শিব শিব করিছে অম্বা
হেনকালে শোনা গেল ষাঁড়ের হাম্বা
ষাঁড়ে চড়ি মহাদেব অম্বা সকাশে
ষাঁড়ের উপরে বসে মহাদেব কাশে।

অম্বা তখন করল কী, কতগুলো তুলসী পাতা নিয়ে এসে মহাদেবের হাতে দিয়ে বলল, আপনার খুব কাশি হয়েছে, প্রভু, খেয়ে ফেলুন। কমে যাবে। মহাদেব দেখলেন, মেয়েটার ভো তাঁর প্রতি খুব আড়িয়াল আছে, অম্বার হাত থেকে তুলসী পাতা নিয়ে চিবিয়ে খেলেন। মনে হল, গলায় আরাম হয়েছে। এরপর বললেন, কী চাস বল।

অম্বা বলল, আমি ভীষ্মকে শায়েস্তা করতে চাই।

শিব মাখা চুলকে বলল, এ জন্মে হবে না। পরের জন্মে তোকে হাফ-নারী করে পাঠাব দেখতে ব্যাটাছেলের মতো। নইলে রথ চালাবি কী করে, ভেল করবি কী করে। তুই হবি শিখণ্ডী।

অম্বা জন্মালো রাজা দ্রুপদের ঘরে
শিশুকালে তারে সব শিখণ্ডী নাম করে
দেখিতে ছেলের মতোই লিক্‌‍ তাহার
বড় হলে তার হল নারীর বাহার।

হিজড়ে যেমন হয় আর কী, অর্জুন জানত, ভীষ্ম পুরুষ ছাড়া কাউকে যুদ্ধ করে মারে না। অর্জুন ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ মারাতে গিয়ে শিখণ্ডীকে রথের সামনে সেট করে রাখল। তির মারতে গেলেই শিখণ্ডীর গায়ে লেগে যাবে। এদিকে শিখণ্ডী তো আকখাট মদ্দ নয়। হিজড়েই। ভীষ্ম কিছু করতে পারল না, অর্জুন ভীষ্মকে কাত করে ফেলল। শিখণ্ডী পরের জন্মে আবার নারীজন্ম পেয়েছিল।

গুরুমা-র গলা জড়িয়ে এসেছে। ভালই নেশা হয়েছে। বলছে, আমরা হলাম অম্বা, জগদম্বা—কী সে কম-বা।

অল্প ক’দিন শিখণ্ডীর মতো এসেছি। নাচব, গাব, মস্তি করব। আবার ফুল মাগি হয়ে জন্মাব। ব্যস। জয় অম্বা মাইকি।

নথ-ভাঙার দিন এই কাহিনিটা নাকি শুনতে হয়। সবাই শুনল।

দুজনে ধরাধরি করে নথ-ভাঙা ঘরে পৌঁছে দিল দুলালীকে। একটা জগে জল। দু’টো গেলাস, একটু তুলো। একটা ভেজলিন-এর কৌটো।

ফুলি বলল, দিয়ে গেলুম গো। আমাদের মেয়েকে সাবধানে রেখো।

দরজা বন্ধ করল একটু জোরে।

‘লে গয়ি দিল, গুঁড়িয়া জাপান কী।’—’লাভ ইন টোকিও’ বাজছে ক্যাসেটে।

এরই মধ্যে উলু দিল ওরা।

আজকের মস্তির পুরো খরচ ছাড়াও গুরুমাকে পাঁচশো টাকা দিয়েছে যাদব। যাদব এবার উশুল করবে।

যাদব খাটে বসে আছে। ও ডাকল, আ যাও পেয়ারি। দু’হাত মেলে দিল।

দুলালী ওর পাশে বসল।

—নাম দুলালী আছে, হ্যায় না?

—হুঁ।

—আগে দুলাল ছিল? সাচ্ না?

—হুঁ।

—ডান্স আতি হ্যায়? ডান্স?

থোড়া-থোড়া। —শাদিসুদা?

—হুঁ।

—আমি ভি শাদিসুদা। দেশ মে হ্যায়। ইধার ভি এক রাখ দিয়া। বাঁচো মস্তি মে। হামকো সব চলতা হ্যায়। শ বুর গলাকে বন্তা হ্যায় এক গাঁড়। বলতে বলতে কেশে ফেলে।

—থোড়া সা পানি পি লিজিয়ে। দুলালী বলে।

—পানি ক্যায়া হোগা, বোতল মে থোড়া রাম বাচা হুয়া হ্যায়।

ওর মুখ থেকে খুব মদের গন্ধ পাচ্ছিল দুলালী। কথাটাও জড়ানো ছিল।

দুলালী বলল, আর মদ খেয়ো না।

যাদব বলল, থোড়াসা। মুঝে সার্ভ করো।

দুলালী সামান্য একটু ঢেলে দেয়।

যাদব খায়। তারপর সদ্য মদ-খাওয়া জিভ দুলালীর ঠোঁট ছুঁতে যায়, তখন আবার কাশির দমক আসে।

—অত কাশি হল কেন? দুলালীর প্রশ্নে একটা অন্তরঙ্গতা।

—ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। পরসোঁ বাইক লিয়ে বাড়োয়ান গেলাম কিনা।

দাঁড়াও। তোমার কাশি কমিয়ে দিচ্ছি। দরজার ছিটকিনি খুলল, দুলালী। বাইরে তঞ্চ খিলুয়া খাওয়া চলছে। গান বাজছে,

চান্দা হ্যায় তু, মেরা সুরজ হ্যায় তু।

দুলালীকে দেখে ওরা কলকলিয়ে উঠল। কী রে? হয়ে গেল? ধুতে এলি না কি?

—না, তুলসী পাতা।

—তুলসী পাতা কী হবে?

—ওর বড় কাশি হচ্ছে। তুলসী তুলব।

—রাতে তুলসী তুলতে নেই।

—নেই তো নেই। পাপ আমার হবে। ও কাশছে খুব। দুলালী উঠানে নেমে কোে গাছগুলো থেকে কয়েকটা তুলসী পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এল। অম্বাও তো শিব ঠাকুরকে তুলসী পাতা খাইয়েছিল। এরপর রান্না ঘরে গিয়ে একটু আদা থেঁতো করল, সঙ্গে তুলসী পাতা। এর বলল, খুব সোহাগ লো…

যাদবকে বলল, আদা-তুলসী পাতা থেঁতো করে এনেছি। আরাম হো জায়েগা। একটু খেয়ে নাও।

একটু অবাক চোখে দুলালীর দিকে তাকিয়েছিল যাদব।

তারপর হাঁ করে দিল।

দুলালী আদা-তুলসি বাটা একটু-একটু করে খাইয়ে দিয়েছিল। খাওয়ানোর সময় দুলালীর মুখটা কেমন ছুঁচোলো হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাকে খাইয়ে দেওয়ার সময় যেমন হয়, মুনু- বলার সময় যেমন হয়।

যাদব বলেছিল—চিজ বহুত আচ্ছি হ্যায়। তারপর জড়িয়ে ধরে বলেছিল, চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত-মস্ত। যাদবের বুকে জল-ভরা বল লাগছিল। জল-ভরা বল লাগুক। সেটা যখন খুশি লাগতে পারে। কিন্তু ‘চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত-মস্ত’ কী করে হবে? দুলাল-কাহিনি তো ফ্ল্যাশ ব্যাকে বলা হচ্ছে। ১৯৮৭-৮৮ সাল। তখনও তো এই গানটা সৃষ্টিই হয়নি বলিউডে। না হোক গে স্থান-কাল মিশিয়ে দেওয়া হল। আর, একটু ব্রেখ্‌টিয়ান অ্যালিয়েনেশনের কায়দাও করা গেল।

যাদব বলল, ও বল উতার দো। বকোয়াস হ্যায়। খুলে দাও।

দুলালী বলল, তুমিই খোলো।

যাদব বলল, না, তুমি।

দুলালী বলল, না, তুমি-তুমি।

যাদব তখন ব্লাউজের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে, বল দু’টো বের করে আছাড় মারল।

ওরা কেউ ফাটল না। লাফাতে-লাফাতে খাটের তলায় ঢুকে গেল।

যাদব বলল, ওসব ঝুটমুট মাগি সেজে কী লাভ? লেড়কা হল লেড়কা, লেড়কি হল লেড়কি। গাঁড়, বুর, দু’টো দু’রকম। দু’টোই ভাল। বলতে গিয়ে আবার কাশল।

দুলালী যাদবকে শুইয়ে দিল। বুকে হাত বুলিয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ঘুম পাড়াতে লাগল।

যাদব বলল, তুম বহুত প্যায়ারা হ্যায় দুলালী, বহোত।

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকল যাদব। বলল, বহুত পি লিয়া দুলালী। ক্যায়া করু?

দুলালী তলপেটে হাত বুলোতে বুলোতে আরও নীচে নিয়ে গেল। দেখল লিক্‌ম ঘুমিয়ে আছে।

থাক। নাড়াচাড়া করার দরকার নেই।

যাদব গাইল—ক্যায়া করু সজনি…।

এরপর উঠে বসল। বলল, নথ-ভাঙা আছে, তাই না?

দুলালী ছদ্ম-লজ্জায় মাথা নাড়ে। আঁচল দিয়ে ঢাকতেও গিয়েছিল রিফ্লেক্স বশে। কিন্তু ইলু দু’টো তো খাটের নীচে।

যাদবের চোখ লাল। পা জামার দড়ি খোলে। দুলালী বলল, তোমার শরীর খারাপ সোনা, কাশি হয়েছে। কিচ্ছু করতে হবে না। ঘুমু করো। শুধু একবার ঠেকিয়ে দাও, তা হলেই হবে।

দুলালী উপুড় হয়ে শোয়।

অনেক দূর থেকে আসা শঙ্খধ্বনি শুনতে পাচ্ছে দুলাল। খাজাইতলা থেকে। মা বাজাচ্ছে।

আসলে রাতের ইলেকট্রিক ট্রেন পানাগড় স্টেশনে ভোঁ দিল।

৪১

বৈষ্ণব পদাবলি-টা বেশ। ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে’—কী দারুণ শুনতে লাগে। বলতেও কী ভাল লাগে। ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।’ ‘হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে। পরান- পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।’ এই কথাগুলো জ্ঞানদাস কৃষ্ণকে দিয়ে নয়, রাধা-কে দিয়ে বলিয়েছেন। চণ্ডীদাসের রাধা বলছে—’কলঙ্কি বলিয়া ডাকে সব লোকে তাহাতে নাহিক দুখ। তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ।’ নিজেকে কেমন ‘রাধা’-’রাধা’ মনে হয় আমার। ‘প্রেম করেছি বেশ করেছি করবই তো। রাধার মতো মরতে হলে তো মরবই তো।’

আচ্ছা, রাধার কী হয়েছিল? সেই যে কৃষ্ণ মথুরা-বৃন্দাবন ছেড়ে চলে গেল, তারপর তো আর রাধার পাত্তাই নেই। কেউ রাধাকে নিয়ে কিচ্ছু লেখেনি। কৃষ্ণ দ্বারকায় গেলেন, রাজপাট করলেন, পাণ্ডবদের সখা হলেন, কত বিয়ে-টিয়ে করলেন, কিন্তু রাধাকে ভুলেই গেলেন। রাধার নাম পর্যন্ত নিল না লোকটা। পুরো ইরেজ করে দিল…।

অরূপদা-ও তাই করবে? ও কি সত্যিই ফুটে গেল? এখন কীরকম অ্যাভয়েড করে। আমার কবিতা পড়া ছিল, আসতে বলেছিলাম। কই, এল না তো…!

আমার এখন তেমন করে জন্মদিন হয় না। আগে হত। ছোটবেলাটায়। এখন মা নাকি আমার জন্মদিনের দিন কালীমন্দিরের বাক্সে টাকা ফেলে আসে। কতই বা, ম্যাক্সিমাম দশ? অন্য সময় মাঝেমধ্যে কয়েন ছুড়ে দেয়। একটাকার। একটাকা যদি লাল প্লাস্টিকের পার্সে না-থাকে তো পানের দোকান থেকে খুচরো করে নেয়। কী চায় মা ঠাকুরের কাছে? একটাই তো চাওয়া ছিল—ছেলেটাকে ‘ছেলে’ করে দাও মা, ঠিকঠাক ছেলে। এখন বোধহয় ওইসব প্রার্থনাকে শুয়োরের মাংস করে দিয়েছে। ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হতে-হতে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়—জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন। ওই প্রার্থনা শনি-কালী-সত্যনারায়ণ সবাই ‘রিজেক্ট’ করে দিয়েছে। মৌলালির পিরের মাজারেও দু-একবার চাদর চড়িয়েছিল মা, খবর আছে। জন্মদিন যখন হত, তখন লুচি হত, পায়েস হত, বস্তির পাঁচ-সাতজন লুচি-তরকারি পায়েস খেত। মনে পড়ে, একবার জন্মদিনের বিকেলে মা খেলনা কিনতে নিয়ে গিয়েছিল, মা বলেছিল বন্দুক নে, আমি বলেছিলাম পুতুল। তখন আমি ক্লাস ওয়ান। আমার সব বন্ধু ফটাফট বন্দুক ফাটাত। আমি কোনও দিন বন্দুকের জন্য বায়না করিনি। তবু মা নিজে থেকেই বন্দুক কিনে দিয়েছিল। ওটায় ক্যাপের রিল পুরে দেওয়া যেত। বেশিদিন ওটা নিয়ে খেলিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। পরে, অরূপদা বন্দুক দেখাল। বললাম, এত বড়? একদম বন্দুক। সেই চামড়ার বন্দুক নিয়ে খেলতাম।

মা জন্মদিন বন্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু অরূপদা আমাকে জন্মদিনে বেড়াতে নিয়ে যেত। গিফ্ট দিত। কলম, কবিতার বই, একটা সিডি দিয়েছিল—’নো মিল্ক টু ডে’। এটা নাকি বিটল্স-দের গান। ‘গে’-রা গাইত। আমার তো সিডি প্লেয়ার নেই, রোহিতের বাড়ি গিয়ে শুনেছিলাম। এবারের জন্মদিনে অরূপদা শুধু একটা কার্ড পাঠিয়েছে। তা-ও ক্যুরিয়ারে। সেই কার্ডে ‘লাভ’ শব্দটা একবারের জন্যও নেই। একটা ছাপানো কার্ড, আর ওইসব কার্ডে যা-যা লেখা থাকে আর কী। একই লেখা হাজার-হাজার খামে ঢোকে, হাজার-হাজার বাড়ি যায়। নিজের হাতে লিখে দিলে সেটা আলাদা। সেটা নিজের কথা।

অরূপদা তো পড়াত আমাকে। আমার চেয়ে অন্তত ছ’-সাত বছরের বড়। ও যখন আমাকে ভালবাসতে লাগল, তখন জানতাম না—ওর একটা বান্ধবী আছে। বান্ধবী তো থাকতেই পারে, একটা কেন, এক ডজনও থাকতে পারে। কিন্তু ওই মেয়েটা হল অরূপদার বিশেষ বান্ধবী। ‘প্রেমিকা’-ই বলা যায়। ওই মেয়েটার নাম তৃষ্ণা

যখন ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে বলল, ‘ওর নাম তৃষ্ণা, আমার বান্ধবী’—তখন বুঝলাম কেন এত ওই গানটা গাইত অরূপদা—’কণ্ঠে আমার তৃষ্ণা, ও গো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।’ ফুচকা- টুচকা খাওয়া হল, হাঁটছি, বলা-কওয়া নেই হঠাৎ গেয়ে উঠল—কণ্ঠে আমার তৃষ্ণা…।

আগে কক্ষনও বলেনি তৃষ্ণার কথা। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল বলে বলতে হল। দেখা হয়েছিল ফ্যান্সি মার্কেটে। অরূপদা বলেছিল আমাকে কিছু কিনে দেবে। খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটের একটা গলির মধ্যে গিয়েছিলাম আমরা। যেতেই দোকানদারগুলো ফিসফাস শুরু করে দেয়।

সিডু-ডিডু-কিছু…। ‘সিডু’ মানে তো সিডি। বোঝাই যাচ্ছে ওগুলো ব্লু। ‘ডিডু’ মানে ডিডো। কৃত্রিম পেনিস। অরূপদা বলেছিল, এখানে এসব ভাল পাওয়া যায় না। বিদেশে, মানে ইউরোপ-আমেরিকায় এসব খুব ভাল পাওয়া যায়। লেসবিয়ান-রা এসব কেনে। বেল্টের মতো করে কোমরে বাঁধে। অ-লেসবিয়ান, মানে ঠিকঠাক মেয়েরাও কিনতে পারে। ‘গে’ ছেলেরাও যদি প্র্যাকটিসের জন্য কেনে—বাধা কী? কলকাতায় দু-এক জায়গায় পাওয়া যায়। ওখানে ভাইব্রেটার-ও আছে। ওরা দেখাল। একটা রড। রবার-টবারের হবে। ভিতরে ব্যাটারি পোরা। সুইচ আছে টর্চের মতো। সুইচ অন করলে কাঁপতে থাকে। ‘কিছু’ মানে ‘অ্যানাস ডায়ালেটর’। লিপস্টিকের মতো দেখতে, তবে লিপস্টিকের তুলনায় অনেক মোটা। খুব স্মুদ পদার্থ দিয়ে তৈরি। ওরা বলছে, অ্যাবোনাইট। ওটাতে কে ওয়াই জেলি লাগিয়ে পায়ুতে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। পুঁই শাকের ক্যাশমেমো-র মতো পায়ু বলছি কেন? ওটা যা, সেটা বললেই তো হয়। আমি একবার বলেছিলাম, ‘বড্ড লাগছে অরূপদা’—–ও তারপর বলেছিল—’আজ একটু ম্যানেজ কর, আমি কিডু কিনে দেব।’ সেদিন বড্ড বাড়াবাড়ি করছিল অরূপদা। অরূপদা তো টপ। আমি তো তাই জানতাম। আর ‘টপ’-রা তো ওরকম দুষ্টুমি করবেই। ‘প্রবর্তক’ পড়ে জেনেছিলাম- ‘গে’রা নানা ধরনের হয়। টপ, বটম, ভার্সেটাইল। টপ-রা পেছনে দেয়, বটম-রা নেয়। মানে ‘নেওয়া’-টাই পছন্দ করে। টপ-রা নেয় না। এছাড়া ভার্সেটাইল-ও আছে, কখনও দেয়, কখনও নেয়। ওরা ডুপ্লি। দু’টোই ঠিক আছে ওদের ক্ষেত্রে। ‘টপ’-দের মধ্যে আবার একটু ভেদাভেদ আছে। ‘পাওয়ার টপ’ আর ‘সার্ভিস টপ’। ‘পাওয়ার টপ’-রা অ্যাগ্রেসিভ। খুব দুষ্টু। ‘সার্ভিস টপ’- রা ‘বটম’-দের কথা শোনে। কো-অপারেট করে। কোনও-কোনও ‘টপ’ হয়, যারা মূলত দেয়, মাঝে-মধ্যে, একটু-আধটু নেয়ও। ওরা ভার্সেটাইল টপ’। ‘ভার্সেটাইল বটম’-ও হয়। ওরা মূলত নেয়, মাঝেমধ্যে নেয়-টেয়। বই না-পড়লেও ব্যাপারটা ও বোঝে। ও বোঝে, ও নিজে ‘বটম’। ‘পিওর বটম’। আর অরূপদা টপ’। ‘সার্ভিস টপ’ বলা যায়। ও বোঝে। সুবিধে-অসুবিধে বোঝে। খুব ভাল করে আদর করে অরূপদা। ও বোঝে বলেই তো ফ্যান্সি মার্কেটে নিয়ে এসেছিল। দু’রকম সাইজের ‘কিডু’ কিনে দিয়েছিল। একটা লাল, আর একটা সাদা। সাদাটা লালের চেয়ে মোটা। প্রথমে সাদাটা দিয়েই প্র্যাকটিস করতাম। কে ওয়াই জেলি মাখিয়ে ঢুকিয়ে দিতাম। বেশ কিছুক্ষণ রাখতাম। মা জানত না। দুপুরে এসব করতাম। মা তখন অফিসে। তারপর সাদাটা। কে ওয়াই জেলি শেষ হয়ে গেল। অনেক দাম। নতুন কিনিনি। কিনতে পারিনি। নিজেই একটা বুদ্ধি বার করেছিলাম। নারকোল তেল দিয়ে, মায়ের ভেজলিন দিয়ে ট্রাই করতাম। মা বলত, ভেজলিন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। এরপর দেখলাম, ঢ্যাঁড়স টুকরো করে কেটে একটা কাপে ভিজিয়ে রাখলে কিছুক্ষণ পরে বেশ স্লিপারি জেলির মতন কিছু একটা তৈরি হয়ে যায়। ওটাই করেছি। কাপটা লুকিয়ে রাখতাম একটা তাকের পিছনে। মা দেখে অবাক হয়েছিল, বলেছিল, সে কী! এখানে কাপের মধ্যে ট্যাড়সের টুকরো কেন? ভাগ্যিস আমরা বস্তিতে থাকি, বড়-বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকি না, ভাগ্যিস আমাদের বাড়িতে ইঁদুর হয়, মা-কে বলেছিলাম, ইঁদুর মারার বিষ। ইঁদুর ঢ্যাঁড়স খায়।

আমি এত করেছি অরূপদা তোমার জন্য। তোমার জন্য গমনপথ প্রশস্ত করেছি। ক্ৰমশ তৈরি করেছি নিজেকে। শুধু তোমার কথাই ভেবেছি অরূপদা। স্বপ্ন দেখেছি—রিয়েল স্বপ্ন— তোমার। তুমি তখন জাস্ট চাকরি পেয়েছ, তার পরে-পরেই স্বপ্নটা এসেছিল। তোমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে বাড়ি থেকে, তোমাকে মেয়েদের ছবি দেখাচ্ছে তোমার বউদি। তুমি দেখছ না। তুমি বলছ, না বউদি, আমার জন্য মেয়ে দেখো না। কী জোরে মাথা নাড়ছিলে তুমি অরূপদা, তোমার ঝাঁকড়া চুল দুলছিল।

অরূপদা, তুমি সেই কবে থেকে বলতে, সারা পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন হচ্ছে, নরওয়ে- সুইডেনে সমলিঙ্গে বিয়ে ‘লিগ্যাল’ হয়ে গিয়েছে, আমেরিকার কয়েকটা স্টেটেও। আরও কয়েকটা দেশেও হয়ে যাবে। আমাদের দেশেও হবে। ৩৭৭ ধারার এগেস্টে ‘নাজ ফাউন্ডেশন’ মামলা করছে। অ্যাইসা দিন নেই রহেগা… বলতে-বলতে আমার পিঠে হাত বুলোতে… তখন কি বুঝেছি, তুমি ডাব্লডেকার? তুমি ‘বাইসেক্সুয়াল’?

‘বাইসেক্সুয়াল’ কেউ হতেই পারে। আমি কিছু বলব না, কৈফিয়ত চাইব না—তুমি কেন বাইসেক্সুয়াল গো অরূপদা? শুধু দুঃখ থেকে গেল—আগে বললেই তো পারতে! এই অশ্রু কঠিন ছুরিটাই তো গেঁথে আছে আমার চৈতন্যে। অরূপদা, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হচ্ছে না তেমন, কথা হচ্ছে না। জানি, আমাকে নয়, তুমি তৃষ্ণাকে ভালবাসো। চোখের জলের সিঁড়ি বেয়ে তবু হৃদয়ে নেমে আসো। মেঘ হয়ে দূরে গিয়ে তাই জলের আবেগে ফের ভাসো। চোখের জলের সিঁড়ি বেয়ে হৃদয়ের দিকে নেমে আসো।

ফ্যান্সি মার্কেট থেকে “কিছু’ কিনে আমার ব্যাগে রেখেছিলাম। বেরনোর সময় একটা মেয়ে অরূপদাকে বলল, আরে অরূপ, এখানে কী করছ? অরূপদা বলল, একটা ক্যামেরা দেখতে এসেছিলাম, ওর জন্য। আমায় দেখাল। বলল, ওর নাম পরিমল। ওকে পড়াতাম। আমার ভাইয়ের মতো। অরূপদা বলল, ও তৃষ্ণা

তৃষ্ণা বলল, আমার বাড়িতে তুমি একটা জিনিস ফেলে এসেছ।

অরূপদা মাথা চুলকোচ্ছিল।

—তেমন কিছু নয়, একটা রুমাল। ওটা দেব না। থাক, ওটা আমার কাছে থাক।

অরূপদা বলল—ছিঃ, রুমাল রাখে নাকি কেউ? নাক মোছা রুমাল …

—না না, নাক মোছা নয়, ঘাম মোছা।

তখনই বুঝে গিয়েছিলাম। তখনই।

তখনই তৃষ্ণার দিকে তীব্র তাকাই। দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললাম, খা। আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না।

এই অরূপদার জন্য কত মিথ্যে কথা বলেছি মা-কে, কত কলেজ কামাই করে দুপুর দিয়েছি, খুলে দিয়েছি সব। উপুড় হয়েছি।

পরে বুঝেছি শুধু তৃষ্ণা নয়, ওর আরও পুরুষসঙ্গী ছিল। সঙ্গী কেন? সাফ কথা, যৌনসঙ্গী। আরও ঠিক করে বলতে গেলে ‘বাটুধারী’ ছিল। নইলে কেন ওই কে ওয়াই জেলি-টা নিয়ে যেত ফের?

যখন ‘কিডু’ কিনে দিয়েছিল, সঙ্গে জেল-ও, ওটা তো প্র্যাকটিসে লাগত, তাই ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন ছিল না, কিন্তু এর আগে, যখন দুপুরে ওই কম্মো হত, ব্যাগে করে জেলিটা নিয়ে আসত, আবার নিয়ে যেত। বলেছিলাম থাক না এখানে, লুকিয়ে রেখে দেব। অরূপদা বলত দরকার নেই, আমি তো নিয়েই আসছি।

কিছুদিন পরই দেখতাম নতুন টিউব। আমার পিছনে তো এতটা খরচ হয় না। ততদিনে তৃষ্ণাদির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছে। মানে তৃষ্ণাদির কথা জেনে গিয়েছি। বুঝে গিয়েছি আমার একজন কম্পিটিটর আছে। বুঝে গিয়েছি অরূপদা-র চিপ্‌টি-ও ভাল লাগে। লাগুক। কতজনই তো ‘ডাব্লডেকার’ হয়। কিন্তু পরে বুঝলাম, অরূপদা-র আরও বাড়ু-পার্টনার আছে, নইলে টিউব শেষ হয়ে যাচ্ছে কেন? তৃষ্ণাদির জন্য তো এসব লাগে না। তৃষ্ণাদির অঙ্গে তো নিজস্ব জেলি আছে। সেল্ফ লুব্রিকেশন। কিন্তু বাটু-র তো ‘লুব্রিকেশন সিস্টেম’ নেই, লুব্রিক্যান্ট দিতে হয়।

একদিন জিগ্যেসও করেছিলাম—সত্যি করে বলো তো অরূপদা, আমি ছাড়া তোমার আর কে আছে?

অরূপদা বলেছিল, মাইরি বলছি, কেউ নেই। তৃষ্ণা? ওটা খুব একটা ভাল লাগে না। কী আছে ওতে? একটা হিন্দি প্রবাদ আছে জানিস, শ’ বুর জ্বালাকে পয়দা হোতা হ্যায় এক গাঁড়। একশো চিপ্‌টি দিয়ে তৈরি হয় একটা বাট্টু। কী আছে ওদের বল? ওদের দু’পায়ের ফাঁকে হাত দিয়েছিস কখনও!

আমি মাথা নাড়িয়েছিলাম।

অরূপদা বলেছিল—পাবি না, কিচ্ছু পাবি না ওখানে। কী ধরেছিস, না ধরেছিস কিছু বুঝতেই পারবি না। আর ছেলেদেরটা ভাব। হাতের মুঠি ভরে যায়। বড় হয়, ছোট হয়…।

ছেলেদেরটা না, তোমারটা বলো। মনে-মনে বলেছিল। নিজেকে ছেলে ভাবে না তো পরিমল। এখন ওর নিজের লিঙ্গটা দেখলে নিজেরই কেমন খারাপ লাগে। আরও অনেক আগে, বয়ঃসন্ধির প্রথম দিকে দেখত, অবাক হত। নিজেকে অন্য মানুষ ভাবত। এখন মনে হয়, ওটা না-থাকলেই ভাল হত।

দু’পায়ের ফাঁকে ওসব লুকিয়ে ফেলে, পা দু’টো কোনাকুনি করে, কৃষ্ণের কায়দায় দাঁড়িয়ে, ওর পেলভিক অঞ্চলটা দ্যাখে। একদিন অরূপদার সামনে ওই কায়দায় দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেছিল—ও অরূপদা, দ্যাখো তো, তোমার তৃষ্ণার মতো লাগছে?

অরূপদা বলেছিল—তোর মাথায় ফালতু-ফালতু তৃষ্ণা চেপে আছে। বলছি না, ওটা কিছু না। ওটা আমার ওভারটাইম। বলতে পারিস, বাই প্রোডাক্ট। তোকেই ভালবাসি আমি, তোকেই। হ্যাঁ, বলতে পারিস আমার হয়তো একটু-একটু বাই। এটা নিয়ে ভাবিস না। ‘এলজিবিটি’ কথাটা এল কেন তবে? লেসবিয়ান-গে-বাইসেক্সুয়াল-ট্রান্সজেন্ডার মিলে তো একটা শব্দ। আমি তোকেই ভালবাসি রে পরি। একটা মেয়ের চেয়ে একটা ছেলে অনেক ভাল। অনেক পয়েন্ট আছে। আমি একটা শ্লোক পেয়েছিলাম, সংস্কৃতে। ডায়রিতে আছে। দাঁড়া, পরদিন নিয়ে আসব। নিয়ে এসেছিল অরূপদা। বলল, এটা বররুচি-র লেখা। প্রাচীন সংস্কৃত কবি। ‘উভয়সারিকা’ নামের কোনও কাব্যগ্রন্থের শ্লোক। অরূপদা নাকি একটা আর্টিকেল পড়েছিল—ওখানে ছিল বররুচি-র সময়ে উত্তর ভারতে এক ধরনের মানুষ ছিল, ওদের বলা হত ‘ভৃঙ্গুশ’। ওরা মেয়েদের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ পরত। মানে ওরা ‘ট্রান্সভেটাইট’ আর কী। হিন্দিতে এখনও ‘ভুরকুস’ নামে একটা শব্দ চালু আছে। ‘ভুরকুস’ মানে সুন্দর দেখতে ‘লন্ডা’। ওদের ‘নাগিন’-ও বলা হয়। একজন ‘ভুরকুস’-এর একটা প্রেমিক ছিল। সেই প্রেমিক বলছে—তোমায় নিয়েই আমি থাকব। তোমার মাসিক-টাসিক হয় না। গর্ভ হওয়ারও কোনও চান্স নেই। কোনও ঝুট-ঝামেলা নেই। অরূপদার কাছ থেকে শ্লোকটা টুকে রেখেছিল,

ব্যাক্ষেপং কুরুতস্তনৌ ন সুরতে গাঢ়োপগুঢ়স্যতে
রাগঘ্নস্তব মাসি-মাসি সুভগে নৈবার্তবস্যাগমঃ
রূপশ্রী নবযৌবনোদয় রিপুগর্ভোঽপি নৈবাস্তিতে
হ্যেবং ত্বাং সগুনাং বিহাস্যতি স চেদরুত্যুৎসবং ত্যক্ষতি।

পরি এর ‘মানে’ বোঝেনি। অরূপদা যা বলেছে, সেটাই মানে। অনেকদিন পর, এই মাত্ৰ সেদিন, এর আসল মানেটা বুঝেছে পরি। অরূপদা যা বলেছিল ঠিকঠাক বলেনি। না জেনে বলেছিল।

অরূপদা যখন যা বলে, একদম বোল্ডলি বলে। এই বোল্ডনেস-টাই তো ভাল লাগত অরূপের। এর মধ্যে গুল মেশানো থাকতে পারে, না-জানা, হাফ-জানা মেশানো থাকতে পারে, কিন্তু ওর বলাটা খুব ম্যালাইন। ‘স্মার্ট’ বলতে চেয়ে ‘ম্যাস্কুলাইন’ ভাবছে কেন পরি? পরি তো এরকমই ভাবে। অরূপদার বুকে অনেক চুল। চুল না, রোম। তার মানে অরূপদা রোমান। এই রোমান বডি ভাল লাগে পরির। পরির দু-চারজন ঠেকের বন্ধু আছে। ওরাও ‘গে’। ‘বটম গে’। ওদের সঙ্গে মাঝে-মাঝে অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়। পরি সব জানে না। অরূপদা-র সঙ্গে যা হয়, তার কিছুই বলে না প্রায়। অন্যরা যা বলে, সেটাই বেশি শোনে। মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। যে যত ভাল মেয়ে, তার লজ্জা তত বেশি। নয়ন কথা বলবে, মুখ বলবে না। বাংলার বধূ বুকে তার মধু নয়নে নীরব ভাষা। পরি-র কয়েকটা বন্ধু খুব ‘ওয়াবাশ চেস্ট’ ভালবাসে। স্মুদ, কিন্তু প্যাক্ড। ফোর প্যাক, সিক্স প্যাক। প্যাকের সঙ্গে, মাস্ল-এর সঙ্গে রোমের কী বিরোধ কে জানে? রোম থাকলেও তো প্যাক থাকতে পারে। বোধহয় রোম থাকলে প্যাকগুলো, ভাঁজগুলো ঠিকমতো বোঝা যায় না। জানা যায় না।

অরূপদা-কে জামা-প্যান্ট পরা অবস্থায় দেখতে নিপাট ভদ্রলোকের মতো। গায়ে-হাতে কোনও ‘ট্যাটু’ করা নেই—ইউরোপিয়ান-আমেরিকান ‘টপ গে’-দের যেমন থাকে। কোনও কায়দা করা চুলও নয়। চুলে জেল নেই, কানের ওপর পর্যন্ত কামানো নেই—ওদেশে যেমন থাকে। সরু গোঁফ, ছোট চুল-সাড়ে পাঁচ ফুট হাইটের একটা লোক। গলায় পৈতে। নিরীহ চাউনি। বাজার করলে, ট্যাড়সের পোঁদ ফাটিয়ে-ফাটিয়ে কচি বেছে বাজার করবে। যখন পড়াতে এসেছিল—একদম গোবেচারা। সেই লোকটাই একদিন পরির হাতটা টেনে নিয়ে ধরিয়ে দেয়। পরি তখন ক্লাস সেভেন

অথচ এই লোকটার এত পার্টস। তৃষ্ণা ছাড়াও আরও কেউ আছে। সে পরির মতোই কেউ। পরি এখনও সেটা বুঝতে পারেনি।

আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি অরূপদা, তোমাকে ‘ফলো’ করার প্রবৃত্তিও আমার নেই। তৃষ্ণার সঙ্গে আমি শেয়ার করতে পারি তোমায়। কিন্তু অন্য কোনও ‘ধুরানি’র সঙ্গে আমি পারব না। তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে আমি ডুবতে রাজি ছিলাম অরূপদা, কিন্তু তুমি ন্যাকা- ন্যাকা ভাব করে ‘বাটু’-তে ‘চিপ্‌টি’-তে ঘুরে বেড়াবে ভ্রমর? আ মরদ আ মরদ-ছিঃ, না-না-না। বেঁচে থাকো গো অরূপদা। আমি শুধু বঙ্কিম-শরতের নায়িকাদের কায়দায় অভিমান করলাম। তুমি সুখে থাকো অরূপদা, প্রজাপতি হয়ে ফুলে-ফুলে ঢলো—কিন্তু সত্যিটা বলো। তৃষ্ণাদিকে নিয়ে ‘ও কিছু না’ বলেছ, কিন্তু গতবার ‘ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে’-তে তুমি আমার সঙ্গে ঘুরবে কথা দিয়েও আসোনি। মোবাইল অফ করে রেখেছিলে অনেকক্ষণ। পরে বললে, তোমার কোনও রিলেটিভের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি ঠিক বুঝি। তুমি ওখানে রুমাল ফেলে আসো, জাঙ্গিয়া ফেলে আসো, নিরখা ফেলে আসো।

আমি একটু কম কথা বলতাম। অরূপদা এসে মাঝে-মাঝে ঢং করত। কলেজে দাঁড়িয়ে থাকত। ‘চল, কাটলেট খাবি চল’—বলত। আমি বিশেষ পাত্তা দিতাম না। অরূপদা বলত— ‘গালফুলো গোবিন্দের মা চানতাতলায় যেয়ো না’… বলে থুতনি নাড়িয়ে দিত। আমি বলেছিলাম, কলেজে আসবে না।

ফাউ চাই, ফাউ? আসল খাবার কোথায় খাচ্ছো, সেটা কি আমি বুঝি না ভেবেছ? আমি সব বুঝতে পারি। কম ঘাটের জল খেয়েছি না কি?

তোমার তৃষ্ণাও তো আমাকে দেখেছিল অরূপদা, জানি, ও কিছুই সন্দেহ করেনি। ওকে তুমিও কখনও বলোনি যে, তুমি ‘ডাব্লডেকার’। ওকে কখনও বলোনি, তুমি ভারতীয় দণ্ডবিধি- ৩৭৭ ধারার আসামি হতে পারো।

আমি তোমাকে পাত্তা দিইনি, অভিমান করেছি, তুমি এখন আমাকে অ্যাভয়েড করছ। ওকে। ঠিক আছে। আমাকে ঠকালি যদি, নিজেকেও তো এতটা নামালি। তুমি আছো ডালে, আমি আছি জলে, তোমায়-আমায় দেখা হবে মরণের কালে। এটা ভেবো না অরূপদা, আমার কোনও প্রেমিক জুটবে না। আমি যদি ভালবাসতে জানি, আমাকেও কেউ ভালবাসবে। যাদের সঙ্গে আমি মিশি, ওদের অনেকেরই ‘পারিক’ ধরার জন্য ‘খাই-খাই’ ভাব আছে। আমি বেঁচে গিয়েছি। আমার অত কিছু নেই।

কিছুদিন আগে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। কবিতা পড়তে গিয়ে। ও নিজে যেচে আলাপ করেছিল। ওর নাম চয়ন মল্লিক। বলেছিল, খুব ভাল লেগেছে। আমার একটা কবিতার একটা লাইন ছিল—’যদিও বামন, চুম্বন করি চাঁদ’। চয়ন বলেছিল, লাইনটার সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতার খুব মিল—’ঘরে ফেরার রাতে’-তে আছে, ‘বামন চায় চাঁদে খুচরো চুম্বন’।

আমি কিন্তু ওই কবিতাটা পড়িনি। কী-ই বা এমন পড়েছি, আমার কিন্তু খুব আনন্দ হয়েছিল। শঙ্খ ঘোষের মতোই আমি ভেবেছি— ভাবতে পেরেছি? অন্তত একটা লাইনও। অনেক কথা হল এরপর। প্রথম দিনেই বুঝেছিলাম, লোকটা নুনে নুন। কী একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে গিয়ে হাঁটু ধরে ঝাঁকাল।

অনেক কবিই তো ‘গে’ হয়। আমার সঙ্গে চয়নের যদি রিলেশন তৈরি হয়, তবে কি কবিতার জন্য হবে? আমাদের রিলেশনের ব্রিজ-টা কী?

কবিতা না কি টপ-বটম?

এখনই বকমবকম

তবে অস্বীকার করব না, চয়ন-কে বেশ লেগেছে। দু-তিনবার কথাবার্তা হয়েছে। অরূপদা- র সঙ্গে কবিতা-টবিতা নিয়ে বিশেষ কথা হত না। চয়নের সঙ্গে হয়। চয়ন অরূপদারই বয়সি। হয়তো ছোটই হবে। ওকে চয়নবাবু বলে ডেকেছিলাম। ও হাত ধরে বলেছিল, শুধু চয়ন। বয়স কোনও ফ্যাক্টর নয়।

চয়ন এখনও চাকরি পায়নি। খুঁজছে। কে জানে চয়নের কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে কি না। থাকতেই পারে। ‘টপ’-দের মধ্যে ক’জনই বা পরিপূর্ণ ‘গে’ থাকতে পেরেছে? বরং ব-রা ‘গে’ থেকে যায়। মেয়েদের দিকে লোভের দৃষ্টি দেয় না। নিজেকে দিয়েই তো বুঝি।

কলেজে আমার ছেলে-বন্ধু কই? ছেলেরা তো প্যাঁক দেয়, তাচ্ছিল্য করে। কেউ-কেউ ‘হিজু’ বলে ডাকে। এত ভাল রেজাল্ট করেছি, তবুও। মেয়েরাও তেমন বন্ধু হল না। ওরা আমাকে ‘মেয়ে’ বলেও ভাবতে পারে না, ‘ছেলে’ বলেও না। ‘হিসি’ করতে গেলে ছেলেদেরটাতেই যাই। খুব ইচ্ছে করে মেয়েদেরটায় যেতে। দু-একদিন অপেক্ষা করেছি, শুধু মেয়েদের টয়লেটে ঢোকার জন্য। ছুটি হয়ে যাওয়ার পর, ফাঁকা হয়ে গেলে…। একদিন টয়লেটে ঢুকেছি, ভেবেছি কেউ নেই, দরজা খুলেই দেখি আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে। ওর নাম তৃপ্তি। ও একটু ডানপিটে টাইপের। ইউনিয়ন করে, খুব চেঁচিয়ে স্লোগান দেয়। একদিন জিন্স পরে এসেছিল। আমাদের হেড বলেছিলেন, জিন্‌স পরে এসো না কেউ, আমার দেখতে ভাল লাগে না। ও বলেছিল, আমার তো পরতে ভাল লাগে স্যর। এ নিয়ে এরপর আর বেশি কথাবার্তা হয়নি। তৃপ্তি নামটার মধ্যে একটা সাদামাঠা গ্রাম্য-গ্রাম্য সরল-সরল ভাব আছে। আসলে তৃপ্তি কিন্তু সেরকম নয়। একটু কাঠ-স্মার্ট।

তৃপ্তি আমাকে দেখে মুচকি হাসল।

বলল, এখানে কেন? ইচ্ছে হল?

আমি বোকার মতো ঘাড় নাড়িয়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে।

এই যে তৃপ্তি, মেয়ে, কিন্তু ততটা ‘মেয়ে’ নয়, লাজুক লবঙ্গলতা নয়, পুতু-পুতু ভাব নেই, একটু ছেলে-ছেলে—এ নিয়ে কিন্তু ওকে হ্যাটা খেতে হয় না, প্যাঁক খেতে হয় না। মেয়েরাও পাত্তা দেয়, ছেলেরাও।

আমি টয়লেট করে বেরিয়ে এসে দেখি তৃপ্তি দাঁড়িয়ে আছে।

তৃপ্তি বলল, তোকে আমার ইন্টারেস্টিং লাগে।

আমি বলি, কেন?

—স্যর যখন ‘রাধা-ভাব’ জিগ্যেস করল—তুই পুরো রাধার মতোই উত্তর দিলি।

এটা ভাল বলল, না খারাপ বলল—বুঝতে পারলাম না।

—চ’ ফুচকা খাই। আমিই খাওয়াব।

এভাবেই আলাপ হয়েছিল তৃপ্তির সঙ্গে। তখন ফার্স্ট ইয়ার।

তৃপ্তি বলেছিল, তোর এই মেয়েলি ভাবটা খারাপ না, ভালই তো। উদয়শংকরের একটা সিনেমা দেখেছিলাম, ওঁরও তো যেন একটু এরকম ছিল। নাচের কোরিওগ্রাফার, ফ্যাশন ডিজাইনার—এঁর কত ট্যালেন্টেড বল, ওঁরাও তো অনেকটা তোর মতন করে কথা বলেন। ইংরেজিতে এফিমিনেট না কী যেন বলে, যে যা বলুক, ও সব গায়ে মাখিস না। আমাকেও তো মাগি-টাগীরা সব ‘দজ্জাল’, ‘মদ্দা’ এসব বলে। ওগুলো ‘গুণবাচক বিশেষণ’ মনে হয় আমার। তৃপ্তি বলেছিল, ওর বাবাও মাস্টারমশাই। একটা স্কুলের। সংস্কৃত পড়ান। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল সংস্কৃত নিয়েই ওকে পড়ানোর। কিন্তু এই কলেজে সংস্কৃত অনার্স নেই, বাড়ির কাছাকাছি এটাই তো কলেজ। বেশি দূরে যাব না। প্র্যাকটিস আছে তো…।

—কীসের প্র্যাকটিস?

—আমি তো দৌড়ই। অ্যাথলেট। জুনিয়র-এ মেয়েদের মধ্যে বেঙ্গল সেকেন্ড হয়েছিলাম, জানিস না?

—না, জানি না তো…।

—অনেকেই জানে না। কেউ-কেউ জানে। ন্যাশনালে খেলতে যাব। ওইজন্যই তো বেশি ক্লাস করতে পারি না। ভেবেছিলাম, খেলাটাকেই ‘প্রফেশন’ করব। কিন্তু বাবা বলল, খেলাধুলো করে ভাত জুটবে না। চাকরি করতে হবে। যদি স্পোর্টস কোটা-য় চাকরি জুটে যায় তা হলে তো ভালই, নইলে স্কুলে-টুলে পড়াব। এজন্যই বাংলায় ভর্তি হয়েছি। সব স্কুলেই তো বাংলার টিচার লাগে। চাকরি আমায় করতেই হবে। আমার তো বিয়ে হবে না।

—কেন? বিয়ে হবে না কেন? খেলিস বলে?

—হুঁ। মানে, শুধু খেলি বলে নয়, অন্য কারণ আছে। তোকে পরে বলব।

তৃপ্তিই আমার মেয়ে-বন্ধু। ওর সঙ্গেই কথাবার্তা বলি। গল্পগাছা করি। মনের কথাও তৃপ্তি পরিমল বলেই ডাকত। আমি বলেছিলাম—’পরি’ বলে ডাকিস হ্যাঁ? ও ‘পরি’ বলেই ডাকে। একদিন জিগ্যেস করেছিল, তোর লাভার আছে, পরি?

আমি অরূপদার কথা বলেছিলাম।

ও কিচ্ছু মনে করেনি।

জিগ্যেস করেছিল—সব কিছু হয়?

‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম—লজ্জা-লজ্জা সম্মতি।

ও বলেছিল, আমার কেউ নেই। একটু যেন দীর্ঘশ্বাসও ছিল।

একদিন তৃপ্তি বলেছিল, ছুটির পর থাকিস একটু। ছিলাম। ফাঁকা ঘর। ও আমাকে জড়িয়েছিল তিনতলায়।

কলেজ ফাঁকা। ও বলল, পরি প্লাস তৃপ্তি ইকোয়াল টু পরিতৃপ্তি।

ওই মুহূর্তের ওই আলিঙ্গন-টা কী ছিল? কে জানে? ও ‘জিন্‌স’ পরা, আমিও প্যান্ট-পরা। পোশাকে দু’জনই পুরুষ। ‘গে’ কেস? ও এমনিতে মেয়ে, আমি ‘মনে-মনে’ মেয়ে। তবে কি ‘লেবিয়ান’ কেস? ও যদি মেয়ে, আর আমি লিঙ্গ-চিহ্নে ছেলে। তবে কি এটা ‘হেট্রো’ কেস? কোন কিছুই তো স্ট্যাম্প মারা যায় না।

তৃপ্তি আমার শরীরের এখানে-ওখানে কিছু খুঁজছিল। ওকে আমার মেয়ে মনে হচ্ছিল না, ছেলেও না। একটা মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ শুধু।

আমি জিগ্যেস করেছিলাম, তুই আমাকে মেয়ে ভেবে চুমু খেলি, না কি ছেলে ভেবে? ও বলল, পরি-ই-ই ভেবে।

তৃপ্তির বুকটা খারাপ ছিল না। আমার চেয়ে অনেক বেশি ভাল। একবার হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়েছিলাম।

তৃপ্তি বলেছিল—জানিস পরি, আমি ঠিকঠাক মেয়ে না। মেন্‌স হয়নি। ডাক্তার দেখিয়েছিল আমার ১৫/১৬ বছর বয়সেই। অনেক পরীক্ষা-টরীক্ষা করা হল। কাউকে বলিস না, আমার না ইউটেরাস নেই। ওভারি-টোভারিও নেই। মেয়েদের আর একটা জিনিস থাকে ওটা আমার আছে। ছোট্ট। ওটার প্যাসেজ-টা নাকি খুব ন্যারো। প্লাস্টিক সার্জন-রা নাকি অপারেশন করে বাড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু অপারেশন করে তো ইউটেরাস-ওভারি ঢুকিয়ে দিতে পারবে না…।

—তবে কি অপারেশন করাবি?

—কী হবে বাপের টাকার শ্রাদ্ধ করে? যখন কোনও ব্যাটাছেলে জানবে ওসব পেটের ভিতরে নেই, আর এটা অপারেশন করা, কেউ বিয়ে করবে না।

—বিয়েই কেন? বিয়ে ছাড়াও তো হতে পারে। ও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর বেঞ্চে শুয়ে পড়ে। জিন্স-এর জিপারে হাত দিয়ে বলে, তুই একটু ট্রাই করে দেখবি কতখানি ঢোকে?—তোকে বলেই বলছি। কোনও ছেলেকে বলতে পারতাম না, এটা দেখলেই ওরা প্যাক দেবে। তুই তো একটু কম-কম ছেলে, একটু ট্রাই করে দেখবি?

আমিও কিছু বলতে পারলাম না। আদর করে হাত রাখলাম শুধু। সেই হাতে সহানুভূতি ছিল। কিন্তু ও যেটা চেয়েছিল, সেটা পারিনি। উঠলই না। ইচ্ছেই হল না। এক পলকে দেখলাম কষ্টকুঞ্চিত লজ্জাস্থান গোপন আলোয় দংশায়।

তৃপ্তি আমার বন্ধু? না কি বান্ধবী? ও অ্যাথলেট, আমি একদম না। ও জোরে কথা বলে, আমি আস্তে। আমি ওর গোপন জানি, ও আমার।

সেদিন ও বলল—চ’ পঞ্চবটিতে বসি। কলেজের কাছাকাছি একটা জলাশয়ের ধারে কয়েকটা সিমেন্টের বেঞ্চি আছে। একটা বট গাছও। ওই জায়গাটার নাম পঞ্চবটি কীভাবে হল কে জানে? ওখানে বসলাম। ওখানে ছেলেমেয়েরা বসে। পেয়ার। আমরাও পেয়ার, কিন্তু পেয়ার নয়। অথচ পেয়ার—মানে প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়ার ‘প্যায়ার’। ‘প্যায়ার’ তো ভালবাসাই। ওর সঙ্গে আমার ভালবাসারই সম্পর্ক। কিন্তু যৌনতাহীন। ওকে আমি চয়নের কথা একটু-একটু বলেছি। মা-র কথাও বলেছি। মা যে এখন ‘অনিকেতবাবু’ নামে একজনের সঙ্গে একটু মাখামাখি করে, সেটাও বলেছি। এতে আমার কী? বাবাকে তো তেমন করে পাইনি। অনিকেতবাবু অথবা কাকু-র সঙ্গেও আমার তেমন কিছু আঠা নেই, তবে রবীন্দ্রসদনে আমাকে খুব সেভ করেছিল। সবই বলেছি। অরূপদাকে ভুলতে পারছি না, সেটাও।

তৃপ্তি বলেছিল, ওসব সেন্টু ছাড়। পিরিতি কাঁঠালের আঠা—এটা একটা বাজে কথা। পিরিতি-কে চাঁয়ের ভাঁড় ভাব। খেয়ে ফেলে দে।

আমি বলেছিলাম—তা হলে তুই-আমি?

ও বলেছিল—এখানে কোথায় খাওয়ার সম্পর্ক? আমরা দু’জনে মিলে তো ‘পরিতৃপ্তি’।

ও বলেছিল, আজ আর প্র্যাকটিসে গেলাম না। গা-টা একটু ম্যাজম্যাজ করছে। ব্যাগে ডিম আছে, খেয়েনি চ। ওর পিঠে ব্যাগ থাকে। ওখান থেকে কাগজে মোড়ানো দু’টো ডিম সেদ্ধ বার করল। কাগজটা মোড়া। কাগজ থেকে ডিম নিয়ে চুলছে, দেখি ওই কাগজটায় একটা সংস্কৃত শ্লোক। ‘ব্যাক্ষেপং কুরুতস্তনৌ ন সুরতে’…সেই শ্লোকটা না?—যেটা অরূপদা দিয়েছিল…। একটা প্রবন্ধ। বররুচি-র ‘উভয়সারিকা’ নিয়ে লিখেছেন কৃষ্ণচন্দ্ৰ আচার্য।

—কোথায় পেলি এটা?

তৃপ্তি বলল, বাবার কত ম্যাগাজিন আসে। একটার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে মা বোধহয় ডিম মুড়ে দিয়েছে।

উজ্জয়িনী নগরীতে এক স্ত্রী-ভাবাপন্ন পুরুষের এক প্রেমিক কোনও এক নারীর মোহে পুরুষ-বান্ধবটিকে ত্যাগ করে। অতঃপর সেই পুরুষের কোনও বয়স্য তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলে, স্তনহীন বিধায়, বাধাহীন আলিঙ্গনাদি হইতে পারিত। তোমার ঋতুস্রাব হয় না, ফলে প্রতি নিয়ত সঙ্গমে কোনও বাধা ছিল না। তোমার গর্ভ হয় না। ফলে গর্ভপাত ঘটাইবার প্রশ্ন নাই। সে নির্বোধের মতো তোমায় পরিত্যাগ করিল। সে এই ‘পুরুষ-শরীরের মাহাত্ম্য বুঝিল না…।

পরি এই কাগজটা পকেটে রেখে দিল ভাঁজ করে। তৃপ্তি বলল, অরূপ-ফরুপকে ভুলে যা নে, ডিম খা।

পিঠে হাত দেয় তৃপ্তি। সেই উজ্জয়িনীর সুবান্ধবের হস্ত কয়েক সহস্রবর্ষ পথ অতিক্রম করে পরির পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করে এই কংক্রিট বেঞ্চিতে।

৪২

দুলালী উপাখ্যান আরও কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে অনিকেত। ওকে ঢোল বাজানো শিখিয়েছে, একটু-আধটু গানও। গান বলতে ওর ‘জনগণমন অধিনায়ক’ একটু জানা ছিল, আর ‘গুরু দয়া করো প্রভু দীন জনে’। ও এখন নতুন কয়েকটা গান শিখেছে। ‘সখী আমার রসের গাছে গোটা দুই ডালিম আছে। এ ডালিম জ্যান্ত কাছিম কামড়ে যেন না দেয় পাছে। খানিক এসে বসো পাশে হাত দিও না ডালিম গাছে। কাঁচা ডালিম ছিঁড়লে তুমি মজা পাবে না… এইসব গান আর কী। আরও অশ্লীল গান সংগ্রহ করা আছে, কিন্তু লেখার সাহস নেই অনিকেতের। ঢোল পুজো নিয়েও কিছুটা লিখেছে। এখন যে-জায়গাটায় আছে, এখানে গুরুমা ওকে প্রায় রোজই ‘ছিন্নি’ হওয়ার জন্য জপাচ্ছে। ‘ছিন্নি’ মানে ক্যাসট্রেশন। লিক্‌ম-গোর্খা কেটে দেওয়া। ‘গোর্খা’ মানে অণ্ডকোষ। ‘ছিন্নি’ করাকে কয়েক ডিগ্রি মাহাত্ম্য দিয়ে ওরা বলে ‘নির্বাণ’।

যে কোনও হিজড়ে খোলের ডিরেক্টর, তথা গুরুমা, চান যেন নতুন আমদানি ‘কোতি’-টা খোলে পাকাপাকি ভাবে থেকে যায়। একবার ছিবড়ে দিতে পারলে আর আগের সংসারে ফিরে যেতে পারবে না। যারা একটু লিঙ্গ-প্রতিবন্ধী, খুব ছোট লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছে, ওদের ‘ছিন্নি’ হতে মনের ভিতর থেকে খুব একটা বাধা আসে না। যেমন হাসি। হাসির ‘ছিন্নি’ হয়েছিল। অবশ্য খুব ছোটবেলায়। ঝুমকোরও ছোট লি। ওর ক্যারিওটাইপ ৪৬xy পুরুষ। কিন্তু অণ্ডকোষ দেখা যায় না। পেটের ভিতরে আছে। ঝুমকো বলেছে, ‘ছিন্নি’ হবে। ছবিকেও বলেছে গুরুমা। ও কেবল পরে-পরে করছে। কেন চাইছে না, সেটা ছবির চেয়ে ভাল জানে অনিকেত। কারণ অনিকেত ওকে তৈরি করেছে ৪৬xy উইথ এলার্জড ক্লিট। এই ‘ক্লাইটোরিস’ ওকে স্পর্শ-সুখ দেয়। যদিও ওর যোনি-মুখ খুব সরু। সম্মুখ-সঙ্গম হয় না। কেবল পশ্চাৎ, কিন্তু ও ওর মজাদার ইঁদুর ল্যাজটার মায়া ছাড়তে পারে না।

দুলালীকে গুরুমা বলছে—বলি দুলালী, অ দুলালী, কাশী এসে গঙ্গা চ্যান করবিনে? এই সিরিখোলে এলি, ছিবড়ি হয়ে যা, সামনের অঘ্রানের অমাবস্যায় দিন ঠিক করি, কেমন?

দুলালী বলে, এখন থাক না ওটা। অসুবিধে তো করছে না।

নাগেশ্বরী বলে, ‘ছল্লা’ করতে গিয়ে যখন কাপড় উঠাবি মা, তোর ওই ঘণ্টা দেখতে পেয়ে লোকে কী ভাববে বল? মান থাকবে?

দুলালী জানে, নাগেশ্বরী নিজেই ‘ছিবড়ি’ হয়নি। ওর কাছে গালফুলো একটা ভেড়ুয়া আসে। ওর নাগিন। পকেট থেকে তেরঙ্গা বার করে। তেরঙ্গা মানে আমাদের জনগণমন অধিনায়ক নয়, পানপরাগের প্যাকেট। ওর সঙ্গে ধুরপিট্টি করে। তখন গুরুমা নিশ্চয়ই দেয় না, নেয়। কিন্তু গুরুমা নিজে লিম রেখে সবাইকে জোর করছে। এটা কি ঠিক?

আসলে অন্যভাবে ভাবতে গেলে, মা-র লি রাখাটা দরকার। এত বড় একটা সংসার চালাচ্ছে। সবার ওপর হুকুম দিচ্ছে। যাই বলো আর তাই বলো, মেয়েছেলের চেয়ে ব্যাটাছেলের তেজ বেশি। দেহটা ব্যাটাছেলের হলেও, মনটাকে তো মেয়েছেলের করা যায়। গুরুমা-র ওসব থাকুক গে যাক, ও নিয়ে আমাদের চিন্তা করার দরকার কী?

তবে দুলালের নিজের লিমের প্রতি কোনও দরদ নেই। কী হবে ওটা দিয়ে? শুধু কেটে ফেলার সময় ব্যথা লাগবে, এটাই ভয়। তা ছাড়া ‘মায়া’ বলে একটা কথা আছে তো এতদিন নিজের সঙ্গে ছিল…।

গুরুমা একদিন সবাইকে ডেকে ‘খিলুয়া’ টানতে-টানতে বলে দিল, যারা-যারা ‘আকুয়া’ আছে—সবাইকে টাকায় দশ পয়সা বেশি দিতে হবে। ‘ছিন্নি’দের দিতে হবে না।

‘ছিন্নি’ যারা আছে, দুলালী ওদের কাছে শুনেছে, ওরা খদ্দের ভাল পায়। অনেক খদ্দের আছে, যারা আসল হিজড়ে চায়। লিওলা হলে ওদের মন ভরে না।

আবার কিছু ‘নুনে নুন’ খদ্দের আছে। ওরা লিক্‌ম চটকাতে ভালবাসে, কিন্তু দুলালের ওটা তো মরা-ইঁদুর। থেকেও কী, না থেকেই বা কী। ছিবড়াতে শুধু ব্যথা লাগবে। ওটাই ভয়।

নাগেশ্বরী মা বলেছিল, ভয় কি লো? ওটা কেটে ফ্যাল, নাং-সোহাগি হবি। তোদের তো আর কেউ বলবে না পেটের তলায় যে-ধন আছে ভাঙিয়ে-ভাঙিয়ে খাবি, বরং পেটের তলায় যা নেই সেটাই ভাঙিয়ে খেতে হয়। ছ্যাঁচড়া পাবলিককে ভয় দেখাবি কী দিয়ে? অন্ধকার গুহা দিয়ে। ওই ‘কিছু নেই’-কেই ওরা ভয় পায়। পেটের তলায় কিছু নাই মিছা আছে। ওই ‘মিছা টা বাগিয়ে ফ্যাল দুলালী। তুই না মাগি, সোনো-পাউডার মাখিস, বুকে বডিজ বাঁধিস, তোর লজ্জা করে না একটা লিক্‌ম ঝুলিয়ে রাখতে?

—ব্যথাটা…

—ধুর বোকাচুদি, ব্যথা আজকাল আর লাগে নাকি? এখন কি আর আগেকার মতো আছে? ইঞ্জেকশন মেরে দেবে, তুই চোখ বুজে থাকবি, চোখ খুলে দেখবি লংকা-টা নেইকো। ব্যস। তোর মান বেড়ে যাবে। জোরাজোরি নেই বাছা। যারা তারকেশ্বরে সন্ন্যেস নেয়, ওদেরকে কেউ জোর করে? নিজের ইচ্ছেয় নেয়। আমি নিজেই তো ‘ছিবড়ি’ হইনি। সেই কবে থেকে আমার ডাইবিটিস। ওষুধ খাই, দেখিস তো। আর ওই লংকাটা আছে বলেই না তড়পাই, নইলে পুলিশ-গুন্ডারা তোদের বাটু ফাঁক করে দিত। আমি তো তোদের মাথার ওপর আছি, তোদের মুখিয়া। হ্যাঁ কি না?

দুলালী মাথা নাড়ায়।

—করে নে ‘ছিন্নি’ হয়ে যাবি গিন্নি। ব্যাটাছেলের সব বদ-রক্ত বেরিয়ে যাবে। তারপর মেয়েছেলের রক্ত তৈরি হবে।

চাত্তারা, হাসি, ঝর্না, যারা ‘ছিন্নি’ হয়েছে, ওদের জিগ্যেস করল দুলাল —’খুব লাগে গো’।

কেউ বলল, আরাম লাগে। বলে, চোখ মেরে হাসল। কেউ বলল, ধুস। কেউ বলল, কষ্ট না-করলে কেষ্ট মেলে?

দুলাল বলে, আমি ছিন্নি হব মা…।

সুতরাং ক্যাসট্রেশন। “ক্যাসট্রেশন’ এই শব্দটা কেমন একটা শিরশির অনুভূতি তৈরি করে অনিকেতের মনে।

.

জাহাজ চলেছে আটলান্টিকের ওপর দিয়ে। জাহাজ-ভর্তি কালো মানুষ। আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমেরিকায়। জাহাজের খোলের একটা ঘরের ভিতর থেকে তুমুল আর্তনাদ উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে মহাসমুদ্রে। ওই ঘরে ক্যাসট্রেশন-এর কাজ চলছে। খোজা করা হচ্ছে, খোজা।

শুধু ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই আড়াই কোটি আফ্রিকান চালান করা হয়েছিল দাস বানানোর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচেবর্তে পৌঁছতে পেরেছিল এক-চতুর্থাংশ।

জাহাজের খোলে গাদাগাদি করে ঠাসা মানুষ। সেনেগাল-ঘানা-জাম্বিয়া-অ্যাঙ্গোলা এসব পশ্চিম আফ্রিকার মানুষরা আছে, আবার আরব বণিকরা পূর্ব আফ্রিকা থেকেও সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছে কত মানুষ। আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে কী রমরমা। কত পরোটা-মাংসের দোকান, সরাইখানা, মদ, বস্ত্রবিপণি—কাপড়ের দোকান থেকে কাফন-ই বিক্রি হচ্ছে কত। কতজনকে কবর দিতে হয়। সেই সুদান-ইথিওপিয়া-সোমালিয়া থেকে মরুভূমি পার করে এদের নিয়ে আসা হয়েছে। পথে যারা মরেছিল, ওদের তো বালির নীচেই কবর দিয়ে দিয়েছে আরব বণিকরা। বণিকরা নিজেরা তো নয়, ওই কালো মানুষগুলোই বালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। এত লোক মরে গেলে, মালের দাম বাড়াতে হবে তো। খোজা করে দিলে মালের দাম বাড়ে।

আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের আশেপাশে গজিয়ে উঠল খোজা বানানোর তাঁবু। ছুরির দোকান ছুরিতে শান দেওয়ার দোকান। জড়িবুটির দোকান। আলেকজান্দ্রিয়ার কী রমরমা। মানুষগুলো তো বিক্রিই হবে, তার আগে ওদের গুণমান বাড়ানো দরকার। খোজাদের দাম বেশি তো। ষাঁড়কে খোজা করে দিলে হালের বলদ হয়। খুব খাটতে পারে। ঘোড়াদের খোজা করে দিলে ছুটতে পারে বেশি। অণ্ড-কাটা গাধারাও মাল বেশি বয়। খোজা মানুষরাও বেশি পরিশ্রম করবে। ওদের ঘর-সংসার করতে ইচ্ছে করবে না। পৌরুষহীন খোজারা হারেমের জন্যও বড় ভাল। তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে অণ্ডকোষ-সমেত জননেন্দ্রিয় কেটে ফ্যালো তবে।

তাই করতে গিয়ে মরে যেত কত। মরে গেলে একটু কাফন তো দরকার। জানাজা? ধুর? ওরা তো কাফের। তবে কবর কেন? নইলে গন্ধ হবে না? মানুষ-পচা গন্ধের ভিতরে কি পরোটা-কাবাব-সালাদ খাওয়া যায়?

পশ্চিম আফ্রিকার আক্রা, আমুস এসব বন্দর থেকেও জাহাজ যেত সমুদ্র পেরিয়ে। ষোড়শো শতাব্দী পর্যন্ত বহু কালো মানুষ ভরে নিয়ে গিয়েছে জাহাজ। সেইসব জাহাজের খোলে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে নিত আমেরিকান বন্দর-শ্রমিকরা। জাহাজের খোলের কোনও অংশে চলত একের-পর-এক ক্যাসট্রেশন। দশজনের মধ্যে ছ’জনই মরে যেত। সমুদ্রে জাহাজের পিছনে-পিছনে ঘুরত মাংসখেকো হাঙর। সাহেবরা বলত, সি-হায়েনা। খোজা করতে গিয়ে মেরে ফেলা মানুষগুলোকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হত সমুদ্রনীলে। হাঙররা ধেয়ে আসত।

দুলাল। মানে দুলালী। দুলালীও রাজি হয়েছে। ওকে জোর করে খোজা করা হচ্ছে না। ওর ভিতরে, চৈতন্যের নিঃস্তব্ধতার ভিতরে, বিপন্ন বিস্ময়ের মতো লুকিয়ে থাকা নারীসত্তাকে উস্কে দিয়ে ওকে রাজি করানো হয়েছে।

আর পরিমল? মানে পরি? পরি একদিন ফোন করেছিল অনিকেতকে। বলেছিল, খুব দরকার আছে কাকু, কথা বলতে চাই। অনিকেত বলেছিল, কী বলবে বলো।

ও বলেছিল, সামনাসামনি বলব। কবে আসবেন?

—কী ব্যাপার রে? অনিকেতের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন।

—একদম পার্সোনাল। আপনি রবীন্দ্রসদনে আমাকে অনেক হেল্প করেছিলেন। সেদিন বলেছিলেন, কোনও দরকার লাগলে বোলো। মনে আছে?

—আছে। কী দরকার বলে ফ্যালো…

—ফোনে হবে না কাকু। সামনাসামনি….

অনিকেত বলেছিল, কবে সামনাসামনি হতে পারব তার কোনও ঠিক নেই। কী বলবে বলে ফ্যালো। সামান্য বিরক্তিও মিশিয়েছিল।

পরি কিন্তু শান্ত গলায় প্রায় প্রার্থনার মতোই বলেছিল—আমি আর এরকম থাকতে পারছি না, আমাকে ভাল করে দিন।

কথাটা শুনে মনে হয়েছিল এসব কথা ফোনে হয় না। একবার বলেছিল, তোমার এই মনোভাব তোমার মা জানে?

ও বলেছিল, মা-কে বলে লাভ নেই।

অনিকেত বলেছিল, মানে? মা তো তোমাকে সেই কবে থেকে তোমার ওইসব ওরিয়েন্টশন পরিবর্তন করিয়ে তোমাকে ভাল করতে চাইছে। মা-কে বলো…।

—সেইরকম ভাল নয়—আপনি যেরকম ভাবছেন—পরি বলল।

—হেঁয়ালি করছ কেন? কীরকম ভাল হতে চাও তুমি?

—সামনাসামনি বলব। একদিন প্লিজ সময় দিন, কাকু।

একটা রবিবার বসেছিল সামনাসামনি। একটা ছোট কেবিনে। যেখানে এখনও মাংসের ঘুগনি পাওয়া যায় এবং দেওয়ালে মেনু চার্টের তলায় লেখা থাকে ‘আজ নগদ কাল ধার, ধারের পায়ে নমস্কার।’

পরি বলেছিল, কাকু আমি আর কোনও ঝামেলার মধ্যে থাকতে চাই না। আমার সম্পর্কে আপনি সবই জানেননা, সব নয়, অনেকটাই। আমার গায়ে ‘গে’স্ট্যাম্প লেগে থাকুক— এটা ভাল্লাগে না। আমি ‘গে’ না কাকু, আমি মেয়ে। বাইরের খোলসটা ছেলের। রাস্তায় যে- বহুরূপী ঘোরে, কালী সাজে, ও কি কালী? কালীর খোলসের ভিতরে নিমাই কিংবা পাঁচু বা অন্য কেউ। আমি সত্যি-সত্যি মেয়ে…

চুপ করে পরি।

অনিকেত শুনতে পায়, যেন ও বলছে—আমার এখন বিয়ের বয়েস হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না—ও বলছে—সহে না যাতনা। কবেকার পাড়া-গাঁ’র চাল-ধোয়া হাতের নখে চকলেট রং নেলপালিশ—পরির হাত টেবিলে। টেবিলের কাঠের ওপর সাদা রঙের পাথর। পরি কথা বলছে না, অনিকেত শুনতে পাচ্ছে, ‘যখন উঠে যৌবন জ্বালা জড়িয়ে ধরি কলসির গলা পিতলের কলসি তো কথা বলে না। সে তো কথা শুনে না। কথা বলে না।’

কথা বলল, পরি। কাকু, আমি ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, আমি ওসব এলজিবিটি-টেজিবিটি বুঝি না। আমি পুরো মেয়ে। নিজেকে তাই মনে হয়

ও জোরে-জোরে শ্বাস নিচ্ছিল, আর বুকটা ফুলে-ফুলে উঠছিল। ও জিন্স আর গেঞ্জি পরে আছে। ছোট হাতার।

—তো?

অনিকেত কপাল কুঁচকে শব্দটা এমন করে ছুড়ে দিল যেন বিয়ারের বোতলের ছিপিটা খোলা হল হঠাৎ। ‘তো’ শব্দটার পর বিরক্তির অদৃশ্য ফেনা বেরুচ্ছে।

—তো, আমি আমার খোলসটা ফেলে দিতে চাই। আপনি হেল্প করুন।

—শোনো পরিমল, তুমি এসব উল্টোপাল্টা ভেবো না। পড়াশোনা নেই? পরীক্ষা কবে?

—পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে কাকু। পরীক্ষা ভাল হয়েছে। এমএ পড়ব না। মাস্টারি করতে গেলে অপদস্থ হব। যদি মেয়ের শরীর পেতাম, তা হলে দিদিমণি হয়ে যেতাম। সেটা অনেকদিনের ব্যাপার। যদি হতে পারিও, আমার শরীরের ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান ঘুরবে সবার মুখে-মুখে। কেরানিগিরি করলে আরও প্যাঁক খাব কাকু। আমি ফ্যাশন ডিজাইনার হব। অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার আছেন, যাঁরা সো-কল্ড গে। মিনার্ভা মুর কত ফেমাস। আগে তো ছেলের শরীর ছিল। লালি সিং, ছেলে ছিল। আমিও তাই হব কাকু…

.

পরি খোলস পাল্টাবে। তার মানে, কেটে ফেলে দিতে হবে ওর পুরুষচিহ্ন। ক্যাসট্রেশন। পরিকে কেউ জোর করছে না। ওর চৈতন্য-গভীরে পুষে রাখা নারীসত্তার মায়া-পুঁটুলিটাকে বাইরে থেকে খোঁচাচ্ছে না কেউ। ও নিজেই নিজের অভিলাষকে ‘তা’ দিয়ে যাচ্ছে—রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছের মতন।

‘আমাদের জানালায় অনেক মানুষ চেয়ে আছে দিন মান হেঁয়ালির দিকে।’

সেই কবে, কোন আদি-অতীতেও, পুরুষ নারী হতে চেয়েছে বারবার। নারীকেই ভেবেছে সৃষ্টির প্রতীক। নারীই তো জন্ম দেয়। সৃষ্টি বেঁচে থাকে। আফ্রিকার কোনও-কোনও উপজাতি এখনও বিশেষ উৎসব উপলক্ষে নারী সেজে নাচে, লিঙ্গস্থানে লাল কাপড় বাঁধে। যেন ঋতু। শিব তো নিজেকে শক্তির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে অর্ধনারীশ্বর হয়েছিলেন। প্রাচীন মিশরের সূর্যদেবতা নিজের লিঙ্গদণ্ড কেটে ফেলেছিলেন একবার। কর্তিত লিঙ্গরক্ত থেকে জন্ম নিয়েছিল নতুন মানুষরা, একটা নতুন জাতি।

কোনও-কোনও পুরুষের মনে নারী হওয়ার আদিম ইচ্ছের চোরকাঁটা বিঁধে আছে এখনও।

.

দুলালের ‘ছিন্নি’ হওয়ার দিন এসে গিয়েছে। ঘোড়ুই ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার, যদিও পাস করা নয়। অর্শ-ভগন্দর অপারেশন করে। পেট-খসানোর কাজও করে। আগে সাইকেল ছিল। এখন মোটর সাইকেল কিনেছে ঘোড়ুই ডাক্তার।

আগের দিন নিরামিষ খেতে হয়েছে দুলালীকে। যে-ঘরে ছিল, সেই ঘরে ধুপ জ্বলেছে। চাত্তারা ওর সঙ্গে শুয়েছিল। বলেছে, এটা আমাদের পৈতে। বামুনদের পৈতে হয় না? বামুন ঘরের ছোঁড়াদের যদ্দিন পৈতে না-হচ্ছে, তদ্দিন আসলি বামুন হচ্ছে না। তুই এবার আসল হিজড়ে হয়ে যাবি। দুলালী কেন যেন ওর ধোন চেপে ধরে। বহুদিনের আপদ, কিন্তু বহুদিনের সঙ্গী। ওর একটা গান মনে পড়ে—তুই ছাইড়া চইল্যা গেলে সোহাগ করমু কারে। এই না মুখে কইছি কথা খাইছি ক্ষীর ননী। এই না মুখে ঠাইস্যা দিব আগুন, জানি, জানিরে। জীবন জীবন রে…।

হুশ দুর যা… কাক তাড়ানোর মতো চিন্তাগুলো তাড়ায়। গানও তাড়ায় দুলালী।

পাশের ঘরগুলো থেকে হুল্লোড়ের শব্দ আসে। ওরা ‘খিলুয়া’ খেয়েছে। চাত্তারা-ও। ওর মুখেও মদের গন্ধ

দুলালী আবার বলে—খুব ব্যথা লাগে?

চাত্তারা বলল—সেই এক ভ্যানর-ভ্যানর। বলছি তো ইঞ্জেকশন মেরে দেবে। পেটের টিউমার বের করার সময় যে-অপরেশন হয়, তখন কি ব্যথা বোঝা যায়? অথচ পেট তো চিরে দেয়। এটা তো কিছুই না।

পুরনো দিনের হিজড়েরা যদি থাকত তো বলত—সে এক টাইম গিয়েছে আমাদের কালে। আগের দিন রাতে খুব করে মশলা খাইয়ে দেওয়া হত। যদি বলো, সেই মশলায় কী থাকে? বলেই দিচ্ছি গাঁজার দানা বাটা, সিদ্ধিপাতা বাটা আর আফিম। তারপরে ভাল করে বাল কামানো। সকালে পুজো। বহুচেরা মা আর প্রভু হরি। পুজোর পেসাদ মুখে দেওয়ার জন্য হাঁ করাতে হয়। সহজে হাঁ করে না। ঝিমোয় কিনা, তারপর আর একটু আফিম-গোলা জল। পেটে ‘চাপ’ দিয়ে মুতিয়ে নিতে হত। তারপর শুইয়ে দিয়ে হাত দু’টো বেঁধে দিতাম। দুজন দু’পা চেপে ধরত। পোঁদের তলায় একটা পিঁড়ে সেঁধিয়ে দিতুম। গোর্খার গোড়ায় শক্তসুতলির দড়ি দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে বেঁধে দেয়া হ’ত, ধাইমা নিজেই অস্তর নে আসত। দু’বার খ্যাচাৎ হত। বাঁ হাতে লিকমের মাথাটা টেনে ধরে ডান হাতের ছুরিটা দিয়ে খ্যাঁচাৎ। মশলা-খাওয়াটা চিল্লিয়ে উঠলে মুখে হাত চাপা দিতুম কেউ, নইলে কাপড় গুঁজে দিতুম মুখে। বাইরে খুব ঢোল বাজত—’বুডুম ডা বুডুম ডা। ব্যাটাছেল্যার বদরক্ত বুরুম বুরুম বেরয় যা।’ বুরবুর করে রক্ত বেরত। তারপরই বাঁ হাতে থলেটা ধরে ডানহাতে খ্যাঁচাৎ। থলের ভিতর থেকে সাদা-সাদা দু’টো গুটি রক্তমাখা। মাটির হাঁড়িতে ভরে ফেলতুম। এবার গরম জল। ফরফর করে রক্ত বেরুতে কিনা, চোখে সহ্য হতনা, গরম জলের ধারা দিলে রক্ত পাতলা লাগতো। ওসব হাঁড়িতে জমতো। তারপর গ্যাদাপাতা থুপে লাগিয়ে দাও, নইলে দুব্বো। রক্ত কিছুটা বন্ধ হয়ে গেলে ঘুঁটে-পোড়া ছাই। ছাই দিলে রক্ত বন্ধ হবেই। ছাইয়ে রক্তে মিশে গিয়ে জায়গাটা ঘুঁটের মতো শক্ত হয়ে যেত। নিমের ডাল দিয়ে একটা ফুটো করে দিতুম, নইলে শুধরানি হবে কী করে? মোতার ব্যবস্থা রাখতে হবে নে? মুখে দুধ খাইয়ে দিতুম, মাড়। দুধের মধ্যে অল্প-অল্প সিদ্ধি- বাটা চিনি দিয়ে। দশ দিনের মাথায় গরম জলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে আস্তে-আস্তে ওই ঘুঁটের মতো পলেস্তারাটা নরম করে খসিয়ে নিতে হত। তারপর পুরনো ঘি মালিশ করে দিতুম দু’হপ্তা ধরে। তারপর আস্তে-আস্তে ঘা শুকোত, নতুন চামড়া তৈরি হত। কোথাও-কোথাও শুনিচি গরম তেল ঢেলে দিত। যদি বলো ক্যানো? গরম তেলে ফোস্কা পড়ে পুরনো চামড়া উঠে গিয়ে নতুন চামড়া গজাত, তা-ই। এতো তাও ভালো। আরও আগে তো যায়গাটাকে পচিয়ে দিত গো। তেঁতুল-বেগুন-চিংড়িমাছের ঝোল বানিয়ে খাইয়ে দিত। এসব খেলে ঘা বাড়ে, যায়গাটা সেপিটিকি হয়। তবে না ভিতরটা ফাঁক হবে। যখন জায়গাটা পচত, কী কষ্ট না হ’ত। কোনও কোনও কমজোরি কজের কোতি এসব সহ্য করতে পারে না। মরে যায়। সে তো জম্মো নিলে মরতেই হবে। কলেরায় মরাও যা, কুন্ঠে মরাও তা, ছিবড়োতে গিয়ে মরাও তা। আগের দিনে দেড় মাসের মাথায় ধুম করে অভিষেক হত। একুনো হয় কোনও-কোনও খোলে। সেদিন ঘিয়ে ভাজা সেরা বানাতে হত। গজার মতন। সেদিন নতুন নাম হত। আজ-কাল তো দীক্ষের দিনেই নাম হয়ে যায়। সবাই ‘ছিন্নি’-ও হয় না। গুরুমা-রাও কিছু বলে না। ট্যাংট্যাঙে ধোন নিয়ে কত মিনসেই তো শাড়ি পরে ঠোঁটে লিপিস্টিক মেরে হিজড়ে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গো। পাঁচু, পটলা, মদনা—সবাই হিজড়ে হয়ে যাচ্ছে। লুঙ্গি-পাজামা, প্যান্টালুন পরে গা-জোয়ারি মস্তানি না-করে, হিজড়ে হয়ে মস্তানি করছে। সে হিজড়ে আর নেই কো। ঠিকমতো নিয়ম পালন করলে শরীলে ভগমানের দৃষ্টি পড়ত, বাচ্চার গায়ে হাত বুলোলে বাচ্চারা ভাল হয়ে যেত। আর রাগ করে কাউকে শাপান্ত করলেও ফলে যেত সেটা। আগকার দিনে গেরস্ত বাড়িতে বাচ্চা হলে হিজড়ে ডেকে নিত। মিষ্টি দিত। নতুন শাড়ি দিত। এখনকার দিন দূর-দূর করে। এখন সবেতেই ভেজাল। এখনকার দিনে সেই হিজড়ে আর নেইকো….।

.

এটা তো এখনকার দিন। সকালবেলা দুলালকে মায়ের পেসাদ খাওয়ানো হয়েছে। বহুচেরা- র ছবি-ছোঁয়া ফুল লাগানো হয়েছে মাথায়। লিঙ্গস্থানে ফুল নয়, লিঙ্গস্থানে ফুল ছোঁয়ানো যায়? ওখানে দুব্বো। কামানো হয়েছে। ডেটল দিয়ে মোছাও হয়েছে। ঘরে ধূপকাঠি জ্বলছে। ঘোড়ুই ডাক্তার এসে গিয়েছে। ডাক্তারের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারের চুলে ও গোঁফে কলপ। চুলের কলপ উঠে গিয়ে কিছুটা বাদামি। গোঁফ কুচকুচে কালো। দুলালীকে বলল, কোনও ভয় নেই। ঘরে একটা ছোট জানালা ছিল। ওটা একটু ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার ওদিকে একবার তাকাতেই একজন কেউ বন্ধ করে কাঠের ছিটকিনি এঁটে দিল। একটা নতুন ম্যাক্সি পরেছিল দুলালী। ওর হাতটা উঠিয়ে একটা ক্যাম্পোজ ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল। এখন ‘মশলা’ তৈরি করা যায় না। আফিম জোগাড় করা খুব মুশকিল। কেউ-কেউ ‘পাতা’-র ধোঁয়া নিয়ে নেয়। ‘পাতা’ মানে হেরোইন। পাতলা স্টিলের বাটিতে গুঁড়ো রেখে তলায় মোমবাতি ধরলে গুঁড়ো থেকে ধোঁয়া তৈরি হয়। সেই ধোঁয়া টেনে নিতে হয় নাক-মুখ দিয়ে। দুলাল ‘পাতা-র নেশা করেনি কখনও। এই খোলে কেউ করে না। গুরুমা-র আদেশ আছে—’পাতা’ নিবি না কেউ। ‘পাতা’ হল জাঁতা। শরীর পিষে দেয়।

ইঞ্জেকশনটা দেওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা। ঘোড়ুই ডাক্তার ছবি, ঝুমকো, ফুলিদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করতে লাগল।

ডাক্তার বলল, বুঝলে, একটা কুত্তা একটা বিল্লিকে বলছে তোমরা যখন লাগাও, কেন মানুষের আড়ালে গিয়ে লাগাও? আমরা কুত্তারা তো মানুষের সামনেই লাগাই। বিল্লি তখন কী বলল বলো তো?

একজন বলল, বিল্লি কুত্তাকে বলল আমরা কত খোমর-টোমর করি, টাইম লাগে। তাই ফাঁকায় যাই। অন্যজন বলল, মানুষ শালা বড় হারামি। ওরা শান্তি দেয় না। তাই মানুষের সামনে করি না।

ঘোড়ুই বলল—হল না। বিল্লি বলল, তোমাদের কায়দাটা মানুষ শিখে নিয়েছে। আমরা আমাদের কায়দা মানুষকে শেখাতে চাই না।

সবাই হেসে উঠল। ঠিকরি দিল। দুলালী হাসল না।

আর এক কাপ চা খেল ঘোড়ুই।

।বলল, বাতাও তো ফুটবল ক্যায়া হ্যায়? লেড়কা না কি লেড়কি?

একজন বলল, লেড়কা-ই হবে। বড্ড লাফায় কিনা।

আর একজন বলল, লেড়কি। কত ব্যাটাছেলের বুকের হাওয়া ভিতরে এঁটে রেখেছে।

ঘোড়ুই বলল, আরে, জিসকি পিছে এগ্যারা লেড়কা আন্ডারপ্যান্ট পিহিন্দকে দৌড়তা হ্যায়, ও সায়েদ লেড়কিই হোগি।

আবার ঠিকরি। ঢোল-ও।

এবার কাজ শুরু।

তক্তাপোষে এমন করে শোয়ানো হল যেন পা দু’টো ভাঁজ হয়ে নীচে ঝোলে। দুলালীর ম্যাক্সিটা খুলে দেওয়া হল। নাভির তলা থেকে সবটাই পরিষ্কার করে কামানো। দুলালী একবার চোখ খুলে চোখ বুজে ফেলল। ওর পাছার তলায় একটা নীল পলিথিনের চাদর রাখা হয়েছে।

ডাক্তার বলল, লিঙ্গকেনি আনা হয়েছে? হ্যাঁ। এই তো।

একটা ছোট্ট ইঞ্জেকশনের ভাইল দিল চাত্তারা। ওটা একটা অ্যানাসথেসিয়া। ‘লিগ্‌নোকেন’। ঘোড়ুই আসল নামটা নিশ্চয়ই জানেন। তবু এই নামেই ডাকেন হয়তো।

নতুন সিরিঞ্জটা কপালে ছোঁয়ালেন ডাক্তার। চোখ বুজলেন।

ঢোল বাজা শুরু হল।

ডাক্তার হাত দিয়ে নিষেধ করলেন।

কিছুক্ষণ চোখ বুজে কিছু বিড়বিড় করলেন।

তারপর নেতিয়ে থাকা বেচারা লিঙ্গটির গোড়ায় দু’জায়গায়, এবং অণ্ডকোষের চামড়ায় পুশ করলেন। তারপর ম্যাক্সিটা দিয়ে ঢেকে দিলেন। কোমরে আর একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। বোধহয় অ্যান্টিবায়োটিক। হাতে না-দিয়ে কোমরেই দিলেন, ওর ধারণা কাছাকাছি বলে কাজ করবে ভাল।

ক্ষুর ধরনের ছুরি ছিল দু’টো। একটা সাঁড়াশির মতো কিছু। গরম জলে ফোটাতে বলা হয়েছিল। পাত্রসমেত ওগুলো এল। ধোঁয়া বেরচ্ছে। ওই জলে ডেটল ফেলে দিলেন।

ডাক্তার বলল, নাও। এবার ঢোল বাজাও। ঢোল বাজতে শুরু করল। সঙ্গে গানও।

আরে দুলালীরে তুমকো খিলাইগা
তুমকো খিলাইগা রে
তুমকো পিলাই গা।
আরে দুলালীরে খিলুয়া পিলাইগা।
ম্যায়নে বুলাইগা
তুমকো বুলাইগা
ম্যায়নে মালাই খিলাইগা
মালাই খিলাইগা
তুমকো বুলাই করকে ম্যায়নে পারি পিলাইগা
তুমকো বুলাইগা
তুমকো বুলাই করকে ম্যায়নে লাড্ডু খিলাইগা
লাড্ডু খিলাই করকে ম্যায়নে সাবুন মাখাইগা
তুমকো বুলাইগা
সাবুন মাখাই করকে মায়নে পাউডার মালাইগা।
তুমকো বুলাইগা।
তুমকো বুলাই করকে ম্যায়নি সিনেমা যাউঙ্গা
তুমকো বুলাই গা…

ডাক্তার হাত দেখাল। এখন গান নয়। দু’জনকে বলল, দুলালীর দু’হাত চেপে ধরতে। দু’জন দুই থাই চেপে ধরল। ঠোঁটের ওপর লিউকোপ্লাস্ট আটকে দিলেন ডাক্তার। ডাক্তার ছুরিটাকে কপালে ঠেকালেন। নাগেশ্বরী কপালে ঠেকাল হাত। বলল, জয় মা।

দুলালী চোখ বুজে স্থির। উটের গ্রীবার মতোই নিঃস্তব্ধতা ওর শরীর জুড়ে।

ঘোড়ই ডাক্তার কালো শক্ত সুতো দিয়ে অন্তকোষটি বেঁধে ফেলেন। শক্ত গেট দেন। বাঁ হাতে দুলালীর রোগা শালিখের ঠ্যাং-এর মত শিকলিকে লিঙ্গটির শিরোদেশ দু আঙুলে টেনে ধরেন যতটা সম্ভব। ডান হাতে ছুরি। কপালে ছোঁয়ান।

এবার লিঙ্গর গোড়ায় বসিয়ে টেনে দেন। ক্যাম্পোজ এবং লিগনোকেন অ্যানাসথেসিয়া সত্ত্বেও লিউকোপ্লাস্ট ভেদ করে কেমন যেন আওয়াজ বের হয় দুলালীর মুখ থেকে। গল গল রক্ত ঝরে। গুরুমা একটা নতুন মালসা তলায় ধরে। মালসায় পড়তে থাকা রক্তস্রোতে উলুধ্বনি মেলে। উলু দিচ্ছে এয়ো-হিজড়েরা। মালসায় পড়ে থাকে কর্তিত অঙ্গ। দুলালের হাঁটুকাপে থিরথির। ফ্যানের বাতাস শনশন। কবন্ধ ঘোড়ুই ঠেসে ধরেন গজ। ঢোল বেজে ওঠে ধিমিক ধিমিক। তারপর ঘোড়ুই ডাক্তারের বাঁ হাতের মুঠোয় অণ্ডকোষ। দু’পাশে দুজনের হাতে কালো সুতো। টেনে ধরেছে ওরা। ঘোড়ুই ডাক্তার টেনে ধরে অণ্ডকোষ। ছুরিটা ধরেন শক্ত করে। প্রথম ইন্সারসানে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। দুবার। না কি আড়াই পেঁচ দিতে হয় এখানেও, জবাই করার নিয়মেই। এবার মালসায় পড়ে অণ্ডস্থলী। বিচ্ছিন্ন শিশ্নটি তখনও সামান্য কাঁপছে। চামড়ার আবরণের ভিতরের ফ্যাকাসে সাদা বীজক্ষেত্র উঁকি দিচ্ছে। এখন সেটা রক্তময়। ঘোড়ুই এবার আয়োডিন মাখানো গজ ঠেসে ধরেন। চেপে রাখেন। শাঁখ বাজে তিনবার। গুরুমা বলে নিব্বান-নিব্বান-নিব্বান।

নির্বাণ হ’ল দুলালীর।

নাগেশ্বরী বলে—মদ্দা রক্ত চলে গেল

আল্লা বলো হরি বলো
আম্মা বলো কালী বলো
বহুচেরা মা বলো
এবার মেয়েমাইনষের রক্ত হবে
মেয়ে ভাল নাচবে গাবে

ঢোল বেজে ওঠে ডুডুম ডুম ডুডুম ডুডুম ডুম। ডাক্তারবাবু লাল সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। বলেন, বিকেলে আর একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে যাব।

গজ ছুঁয়ে রক্ত পড়ে নীল পলিথিনে রাখা মালসায়। পরদিন সকালে মালসাটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে মাথায় নিয়ে ওরা যাবে দু’মাইল দূরের দামোদরের ক্যানালে। ওখানে জলসেচের খালে ভাসিয়ে দেওয়া হবে মালসাটা। কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে চলে যাবে কোনও সবুজ করুণ ডাঙায়।

হয়তো-বা কাক খাবে। চিল বা শকুন। ওই শিশু খাবে। খাবে জন্মবীজ।

উঃ! আর পারছে না অনিকেত। কলম থামায়।

.

চোখ বুজে থাকে। কোত্থেকে একটা হাবসি খোজা চলে আসে। পাখার বাতাস দেয় অনিকেতের গায়ে। আলখাল্লা গায়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইরানের লুরকি সুফি-সাধক। যিনি, লিঙ্গকর্তন করে ‘ফানাফিল্লাহ’ আর ‘বাকাবিল্লাহ’ বুঝতে চেয়েছেন। নিজেকে নারী না-ভাবলে যে পরম পুরুষকে সর্বস্ব দেওয়া যায় না। ঈশ্বরে সর্বসমর্পণ মানে ‘বাকাবিল্লাহ’-অবস্থা। রাশিয়ান স্কট্সি-রাও আসে। ওরাও ফ্রক পরা। ওদের পুরুষরা লিঙ্গকর্তন করে, মেয়েরা স্তন। এরা অষ্টাদশ শতাব্দীর।

স্কপ্টসিরা বলে, আমাদের আদি পূর্বপুরুষ ঈশ্বরের আদেশ না-মেনে নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিল। সেই নিষিদ্ধ ফল এখন মানবদেহে স্তন ও অণ্ডকোষে পরিণত হয়েছে। আমরা এটা রাখি না। আমরা এসব ফেলে দিয়ে আদি-পাপ থেকে মুক্ত হব। আমরা ম্যাথু-কে মানি। ম্যাথুর ১৯ : ১২ : ‘কতক নপুংসক এমত রহিয়া আছেন যাঁহারা মাতৃগর্ভে এমত জন্মিয়াছে। কতক নপুংসক এমত রহিয়া আছেন যাঁহারা অন্য মানবদ্বারা বলক্রমে নপুংসক হইয়াছেন এবং আরও কিছু লিঙ্গকর্তনকারী নপুংসক রহিয়া আছেন যাঁহারা স্বেচ্ছায় এই পবিত্র কর্ম করিয়াছেন যাহাতে পূর্বপাপ খণ্ডন হয় এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব বর্তাইয়া থাকে।’ স্কসিরা এখন নেই। ওরা ভেবেছিল, এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার লিঙ্গ যদি কাটা যায়—তবেই ঈশ্বরের রাজত্ব নেমে আসবে। সোভিয়েত রাশিয়া হওয়ার পর ওই ‘স্কসি’-মত শেষ হয়।

কিন্তু এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার শিশ্ন কি হয়নি এতদিনে?

এক মহান পুরুষকে দ্যাখে অনিকেত। যাঁর গলায় ঝুলছে বুলেটের মালার মতো শিশু-রাশি। চিনের মিং রাজত্বের একজন সৈনিকও চলে আসেন। যুদ্ধের পোশাক। বিষণ্ণ মুখ। সৈন্যদলে ভর্তি হলে, ওদের শিশ্ন কেটে ফেলা হত। যুদ্ধের আগে নগ্ন নারীর শরীর দেখিয়ে উত্তেজিত করা হত। কিন্তু ওরা শিশ্নহীন। ওদের ভাবানো হত—তোমাদের জীবনের কী দাম আছে? তোমরা শিশ্নহীন। কিছুই পারো না। যুদ্ধটাই পারো। ওরা যুদ্ধে বেপরোয়া হয়ে যেত।

আবার কতগুলো ফ্রক-পরা ছেলেকেও দেখল। সরু গলায় বলল, বুয়ন গিয়োর্নো। কমেস্তাই?

ওরা ষোড়শ শতাব্দীর ইতালির। চার্চে মেয়েদের গান গাইতে দেওয়া হত না। অথচ কয়্যার-গানে উঁচু গলায় সুর দরকার হত। ছেলেদের গলায় ওই আওয়াজ আসে না। তাই বাচ্চা ছেলেদের ক্যাসট্রেশন করা হত। বাচ্চা বয়সে ওসব কেটে ফেললে গলার স্বর ছোটদের মতোই থেকে যায়। ঈশ্বর আরাধনার কয়্যার-গান গাইত মেয়ে-গলায়। ওদের বলা হত কাসত্ৰাতো।

কাসাত্রাতো-দের কয়্যারের সঙ্গে হিজড়ে-ঢোল মিশে যায়। দ্যাখে, দুলালী হাসছে। কত কারণে কত পুরুষ ওদের পুরুষাঙ্গ কাটে। দুলাল কাটে দুলালীর নিজস্ব কারণে।

অনিকেতের কেমন ঘোর লাগে। ওই যত নষ্টের গোড়া একটা y ক্রোমোজম। যেটা ছেলেদেরই আছে। একটা মেয়ের শরীরে y থাকে না। y-থাকা ছেলে যদি ভিতরে-ভিতরে মেয়ে হয়, তখন y-টাই শত্রু। y যেন একটা হাড়িকাঠ। ওই হাড়িকাঠের মাঝখানে লিক্‌‍ গলিয়ে দিচ্ছে কতজন… কত কারণে

—কী খবর দুলালী? কেমন আছ?

দুলালী কাপড় ওঠায়। অনিকেত দেখে একটা কালচে, কর্কশ এবড়োখেবড়ো মাংসপিণ্ড। প্রাচীন নগরীর বিবর্ণ বিদ্ধস্ত ধ্বংসাবশেষের মতো সেই কবেকার ট্রয়, শ্রাবস্তী, বিদিশা…

৪৩

এর আগে কখনও কোনও অপারেশন হয়নি দুলালীর। কী ভয়টাই না পেত। ছোটবেলায় খুব গলা ফুলত, খেতে পারত না। হাসপাতালে নিয়ে যেত মা। একবার ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, অপারেশন করিয়ে দিলেই তো হয়। ভয়ে আর হাসপাতালেই যায়নি ও। অথচ এটায় রাজি হয়ে গেল। কোথা থেকে পেল এই সাহস?

পরের দিন ওকে কিছু খেতে দিল না। জলতেষ্টায় মাথাটা ঝিমঝিম করলে, চামচ করে চিনির জল মুখে দেওয়া হচ্ছিল। জল খাওয়ানো যাবে না, কারণ পেচ্ছাপ পেলে বিপদ। পেচ্ছাপ করে দিলে শুকোতে দেরি হবে।

একটা জায়গা কাটা হয়েছে, কিন্তু সেলাই তো হয়নি। সেলাই করে দিলে জায়গাটা তো বুজে যাবে একদম। রহস্য গুঁজে দেওয়া একটা অন্ধকার গুহা তো রাখা দরকার।

‘প্রস্রাব’-কে এরা বলে ‘শুধরানি’। একটা ‘শুধরানি’-শিঙে রাখা আছে এই বিশেষ কাজে। এটা হল একটা মোষের শিং। শিংগুলো ফাঁপা হয়। গোড়ার দিকটা মোটা, আগার দিকটা সরু এর নাম ‘ফয়রা’। হয়তো ‘ফোয়ারা’ থেকে শব্দটার এসেছে। খুব হিসি-কাতর হলে মূত্রছিদ্রের সামনে ‘ফয়রা’র মাথাটা চেপে ধরে রাখা হয়, এবং মোষের শিং-এর শেষ প্রান্ত দিয়ে মূত্র বেরিয়ে যায়। প্রথম কয়েকদিন বসে, সাধারণ নিয়মে মূত্রত্যাগ সম্ভব হয় না, তাই এই ফয়রা- র ব্যবহার। বয়স্ক ‘ছিন্নি’-হিজড়েরা অনেক সময় হাঁটু মুড়ে বসতে পারে না। হাঁটুতে অস্টিওপোরেসিস হতেই পারে। তাই দাঁড়িয়ে হিসি করার জন্য, ওই ‘ফয়রা’-যন্ত্রের ব্যবহার।

দুলালীকে বলা হল—’শুধরানি’ পেলে বলিস। ব্যান্ডেজের মধ্যে মুতে দিস না আবার। ওটা খুলে ‘ফয়রা’ লাগিয়ে দেব।

দু’দিনের মাথায় ও আর চাপতে পারল না। ব্যান্ডেজ খোলার সময় ভীষণ যন্ত্রণা। গরম জল দিয়ে ব্যান্ডেজ খুলতে হল। জমাট রক্তের সঙ্গে ব্যান্ডেজের গজ-টা চামড়ার সঙ্গে এঁটে ছিল। টানার সময় ভীষণ যন্ত্রণা। কিন্তু ব্যান্ডেজ খোলার আগেই ওর ‘শুধরানি’ হয়ে গেল বলে ওকে বকাবকি করল গুরুমা। ঘোড়ুই ডাক্তার রোজ-রোজ কেন আসবে? ওর অন্য কত কাজ। পাঁচদিন ধরে ‘এ্যান্টিবায়ু’ ইঞ্জেকশন দিতে হচ্ছে এলা-ওব্‌লা। ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে আব্বাস। ও ইঞ্জেকশন দিয়ে যায়। ও আসার আগেই সকালবেলাটায় জোর হিসি পেয়ে গেল বলে নিজেদেরই ব্যান্ডেজ খুলতে হল। আবার রক্ত চুইয়ে পড়ছে। উঠোনের কোণে নিজে নিজে দু’টো গ্যাদাফুলের গাছ গজিয়েছিল। হাসি কয়েকটা পাতা দু’হাতে ডলাডলি করে, কিছুটা গ্যাদাপাতার রস বের করে পাতা-সমেত রক্তমুখে লাগিয়ে দিল। বলল, এসব টোটকা হল ডাক্তারি-ওষুধের বাপ। একটু পরেই আব্বাস এসেছিল। গ্যাদাপাতা নিয়ে কিছু বলল না। একটা মলমের সঙ্গে সাদা রঙের কী একটা গুঁড়ো মাখিয়ে হাল্কা ব্যান্ডেজ করে দিল।

বলল, এই ব্যান্ডেজ খুলতে অসুবিধে হবে না। ‘শুধরানি’র দরকার হলে ব্যান্ডেজ খুলে ‘ফয়রা’ লাগিয়ে ‘শুধরানি’ করিয়ে আবার মলম মাখিয়ে দিতে হবে।

দুলালীর জন্য ‘ছল্লা’ বন্ধ হবে কেন? ওরা সবাই যে যার মতো কাজে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে শুধু নাগেশ্বরী রইল। নাগেশ্বরী বলল, উদোম হয়ে শুয়ে থাক মা, ফ্যান চালিয়ে দে, হাওয়ায় তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।

কিন্তু তখন তো শীতকাল। ফ্যান চালালে শীত করবে যে।

চাপা দে তবে।

দুলালী শুয়ে থাকে। গায়ে চাদর, পায়ে চাদর। মাঝখানে আলোড়িত সুবাতাস—দৃশ্যটা এরকম।

শুয়ে-শুয়ে কত কিছু ভাবে দুলাল। ওর বউয়ের কথা ভাবে। এখন দেখা হলে ওর বউকে বলবে সই। বউ কি আর সই হবে কখনও? সুখ-দুঃখের গল্প করবে? চোখ বুজে দেখে কলসি কাঁখে পুকুরঘাটে চলেছে ওরা দু’জন। পুকুরঘাট থেকে জল আনবে। পুকুরঘাটটা পাল্টে যায়। এখন কি আর পুকুরঘাটে কলসি কাঁখে যায়? টিউকল-এ যায়। টিউকলে কি গল্পগাছা হয়? ওখানে ঝগড়া হয় খালি। কাঁথা নিয়ে বরং পুকুরঘাটে যাওয়া যাক। মন্টুর হিসি করা কাঁথা। গন্ধ নিল দুলালী। শিশুর হিসি—কী ভাল লাগে। ওর গন্ধ শোঁকা দেখে নমু হাসল। পুকুরঘাটে কলমি-শুষনি। কলমি-শুষনি লল্লল্ করে। ওধারে শাপলা ফুটেছে। দুলালী গন্ধকাঁথা জলে ভিজিয়ে, থুপথুপ জল-কাচা করছে। নমু বলল, সরষে নেই ঘরে, বেলেমাছ কী দিয়ে হবে? দুলালী বলল, তবে একটু রসুন ছ্যাঁকা দিয়ে করে নে। দুলালী নমু-র পিঠের দিকে তাকায়। ঘামাচি। বলে, ঘামাচি মেরে দেব দুপুরে। শুয়ে শুয়ে খাজাইতলার দুপুর দেখে দুলালী। বউয়ের পিঠের ঘামাচি মারতে মারতে সন্তোষের গল্প করে। যে-সন্তোষ নমু-র সঙ্গে শোয়। সন্তোষের সব কিছু বলে ওর বউ। সই কিনা….

পানাগড়ের ছোট ঘরে শুয়ে থাকে দুলালী। যন্ত্রণা। সব সময় টনটন ভাব

মা আসে। কেঁদো না মা, আমার কিচ্ছু হয়নি।

মা বলে, তুই ছেলে হয়ে জন্মেছিলি বলে কী আনন্দ হয়েছিল, সবাইকে নারকোল নাড়ু খাইয়েছিলাম। তুই এ কী করলি বাপ আমার।

দুলালী বলে, মা আমার বলো, আমি তোমার মেয়ে তো। আমায় তুমি বিয়ে দেবে? বিয়ের দিন উপোস, তুমি চুপি-চুপি দই-খই মাখা খাইয়ে দেবে, একটা সন্দেশও মেখে দিও, কেমন?

—তুমি কে এলে গো? যাদববাবু? বোসো, বোসো।

যাদব বলল, ক্যায়সা হ্যায় মেরা প্যায়ারি? বহুত আচ্ছা হুয়া। খুব ভাল হয়েছে। তুমায় লিয়ে হামি বিহার যাব। মেরা গোদ মে বৈঠাকে তোমাকে ঘোড়ার গাড়িতে ঘুমাব। ঘোড়ার গাড়িতে ছুটছে দুলালী। গাড়ি গেল বৃন্দাবন। বৃন্দাবনে হোলি। কেষ্টঠাকুর হোলি খেলছে গোপিনীদের সঙ্গে। গোপিনী দলে মিশে গেল দুলালী। কেষ্টঠাকুর রুপোর পিচকিরি দিয়ে দুলালীর গায়ে রং ছিটিয়ে বলল—ছ্যা-রা-রা-রা-রা।

পুরোপুরি সুস্থ হতে সপ্তাহ তিনেক লাগল। কাটা-জায়গাটার রং প্রথমে সদ্য-হওয়া ইঁদুরের বাচ্চার মতো গোলাপি ছিল। আস্তে-আস্তে খোলস পাল্টানো আরশোলার মতো সাদা হল। সাদা যখন হল, তখন নারকোল তেলে রসুন আর নিমপাতা গরম করে আস্তে-আস্তে মাখাতে হত। সাদা রংটা ক্রমশ ধূসর হতে লাগল। তারপর কী আশ্চর্য, ওই নতুন চামড়ার ওপর রোম গজাতে থাকল।

এক মাসের সময় আবার একটা পরব হয়। আসলে বেঁচে ফেরার সেলিব্রেশন। আগেকার দিনে অনেকে মরত। কারও রক্তই বন্ধ হত না। কারও ভয়ঙ্কর রকম ইন্‌ফেকশন হত। খোজা করার আদর্শ জায়গা ছিল বিহারের সীতামারী, সাসারাম, গয়া। ওসব জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হত। যদি মরে যেত, লাশ সরিয়ে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা ওরাই করত। গয়াতে কোনও অসুবিধে নেই, বিশাল ফল্গু নদী, অফুরন্ত বালি। গয়াতে যেসব হিন্দু পিণ্ড দিতে যান, ফল্গু-র বালি সরিয়ে জল বার করে সেই জলে স্নান করার একটা নিয়ম আছে। কিছুটা বালি খুঁড়লেই জল পাওয়া যায়। কেউ-কেউ বালি খুঁড়ে কঙ্কাল পেয়েছেন—এমনও শোনা গিয়েছে। না-পুড়িয়ে পবিত্ৰ ফল্গু-র বালির গভীরে রেখে গিয়েছে এরকম ভাবা হয়। এর মধ্যে লিঙ্গচ্ছেদ করতে গিয়ে ‘যাশ্ শালা বরবাদ হো গিয়া’ লাশ—ক’টা আছে কে জানে? কঙ্কালে পেল্ভিক হাড় থাকে। জেনিটালিয়া থাকে না।

একমাস পর ওইসব কর্তনশালা থেকে ফিরে আসত লিঙ্গচ্ছেদকরা। এটা হল আসলে ফিরে আসার উৎসব। ‘বেটি’ হয়ে শেষ অবদি ফিরল।

এই একমাস দুলালী ওর ‘ফয়রা’ যন্তরটা ব্যবহার করেছে। এবার ফেরত দিয়ে দিতে হবে—কারণ—এখন ও উঠে, বসে-বসে, হিসি-টা করতে পারছে। যতদিন যন্তরটা ছিল, ওটা নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলেছে। শিংটা কিছুটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়। গোড়াটা মুত্রছিদ্রের ওপর ঠেসে ধরে সরু দিকটা ওপরে করলে ঊর্ধ্বগামী তরল, আহা কেমন ফোয়ারা হয়ে যায়। আবার নীচের দিকে ধরলে কল। হিসি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ যন্তরটাকে দ্যাখে। এখানে কিছুদিন আগেও এমনতর কিছু ছিল।

দুলালীর খোলে আজ ‘একমাসি’। একমাস হল কিনা। আজ ও আবার নতুন শাড়ি। গুরুমা বলল—তোর জন্য বহুত খরচ করলাম। রোজগার করে শোধ করে দিবি কিন্তু।

দুলালী জিজ্যেস করেছিল, হিসেব রেখেছ?

—হিসেব? হুঃ। হিসেবে পিসেব। আমি আমার ডিউটি করলাম। তুই তোর ডিউটি করবি। দুলালীর একমাসিতে আবার মস্তি। আবহাওয়াটাও চমৎকার। শীত কমে গিয়েছে, কিন্তু শীত-শীত ভাব রয়েছে। টমেটো দেদার বিকোচ্ছে। কড়াইশুঁটি সস্তা। সকালবেলায় কড়াইশুঁটির কচুরির নাস্তা। দুপুরে ‘খোবরা’ হবে। খাসি-র ‘খোবরা’ আর খাওয়া চলবে না। দিনকে দিন দাম বাড়ছে। মুরগি সস্তা, কিন্তু ঘাস-ঘাস লাগে। দুপুরে ভোজ। জন-হিজড়ে হিরুয়া পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে, রসুন ছাড়াচ্ছে। কুকুরগুলোও বুঝে গিয়েছে আজ খাওয়াদাওয়া আছে। ঘন-ঘন লেজ নাড়ছে। উঠানের কোণের ম্রিয়মাণ গাঁদা গাছটাতেও আজ উজ্জ্বল দু’টো ফুল ফুটে আছে। কাকগুলো খুব ওড়াউড়ি করছে। রান্নার দেখাশোনার ভার ছবির ওপর। দুলালীও বারবার আসছে। আসলে ওকে নিয়েই তো উৎসব। আসানসোলের গুরুমা’কে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। অজয়ের ওপাড়টা ইলামবাজারে পড়ে। ওটা নাগেশ্বরীর এলাকা নয়। ওদের মধ্যে যতই আচকা-আচকি থাক, একমাসি-র দিনে ওদের নেমন্তন্ন দেওয়াটা প্রথা। অথচ ছিন্নি-র সময় কাউকে বলা হল না। ছিন্নি-টা করা হয় গোপনে। ছিন্নি করার সময় যেহেতু মরে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে, সেজন্যই গোপনীয়তা। ব্যাপারটা ঠিকঠাক মিটে গেলেই জানাজানি করানো হয়। এটা এক ধরনের গর্ব-দ্যাখো আর একটা ‘ছিন্নি’ হল আমার দলের—ঠিকঠাক। যেন বিজয়। যেন ইনখিলাপ জিন্দাভাত—বন্দেমাতরম্।

আসানসোল-ইলামবাজারের গুরুমা’কে দ্যাখেনি দুলালী। এসব এলাকার এমএলএ-দেরও দ্যাখেনি। এমএলএ-র নাম জানে না। কিন্তু গুরুমা’দের নাম জানে। আসানসোলের গুরুমা-র নাম ঝুনিয়া মা, ইলামবাজারের বাসন্তী মা।

ওরা এসে দুলালীকে কী বলবে? জন্মদিন হলে তো বলত হ্যাপি বার্থ ডে। টিভিতে গান গাওয়াও দেখেছে। এখানে বলবে নাকি : হ্যাপি ছিন্নি?—নিজের সঙ্গে করা রসিকতায় নিজেই মুচকি হাসে দুলালী।

বাবা মহারাজ একবার সকালে এসে ঘুরে গিয়েছে। বাবা মহারাজ, মানে বাবা বাহাদুর। মানে, নাগি-মায়ের পারিক। এসে একটা সেন্ট দিয়ে গেল। ফস টেপা। মাথায় টিপলে ফস করে বেরয়।

মা বলল, এখন দিও না। খামোকা নষ্ট করছ কেন? ওরা এলে দেব। বাবা বাহাদুর মুখ উঁচু করে বলল, কিপ্পেমি কব্বে না। মত্তি মে রহো

ওর কথাগুলোই ওরকম। মুখে সব সময় পানপরাগ থাকে কিনা। ওদের দলের ছবি-চাত্তারা- হাসি-ঝর্না অনেকেই—পানপরাগ খায়। খৈনিও। সিগারেট-বিড়ি তো সবাই খায়। দুলালী ওসব খায় না। মেয়েদের খৈনি খাওয়াটা কেমন যেন লাগে।

দুলালীকে আজ কাঁচা-হলুদ-বাটা, নিমপাতা বাটা দিয়ে স্নান করানোর কথা। কাঁচা হলুদ পাওয়া যায়নি। তাই নিমপাতা বাটায় হলুদ গুঁড়ো মেশানো হল। হাসি, মহুয়া, ঝর্না—ওরা সব মাখিয়ে দিল। সব জায়গায়। চাত্তারা বলেছিল, ফোঁদলে ভাল করে ঢুকিয়ে আঙুল ঘুরিয়ে দে।

‘ফোঁদল’ মানে ‘কাটা’ জায়গাটা।

বেলা বারোটা নাগাদ ঝুনিয়া মা এল। হিন্দুস্তানিদের কায়দায় শাড়ি পরা। শাড়িতে চুমকি বসানো। চৌকোমতো গাল। পায়ে নুপুর। চোখে কালো চশমা।

নাগেশ্বরী বলল, পাও লাগি।

ঝুনিয়াও বলল, পাও লাগি।

নাগেশ্বরীর গা থেকে খুব সুবাস বেরচ্ছে। বাহাদুরের আনা সেন্ট খুব করে লাগিয়েছে নাগেশ্বরী। নাগেশ্বরী বলল, বহুত দিন বাদ। সব ঠিকঠাক না? ঝুনিয়া বলল। হাঁ। বহুত দিন বাদ। তবিয়ত ঠিক বা?

—হ্যাঁ। চলতা হ্যায়

—ইকরা-বিকরা—সব ঠিক বা?

—ঠিকই আছে।

—’ইকরি-বিকরি’ মানে শিষ্য-টিষ্যদের বোঝানো হচ্ছে।

নাগেশ্বরীও ওর কুশল জিগ্যেস করল,

—চিস্‌স্যা ঠিকঠাক?

খুব ‘ওলো সই’ ভাব। কিন্তু দুলালী তো জানে, নাগেশ্বরী কতবার বলেছে ঝুনিয়ার গাঁড় মেরে ফাঁক করে দেবে। দুর্গাপুর ঝুনিয়ার এলাকা নয়, তবু ঝুনিয়ার লোক দুর্গাপুরে কাজ করছে। ঝুনিয়ার এলাকা হল রানিগঞ্জ, ঝরিয়া, রূপনারাণপুর, কুলটি এসব এলাকা। ওর এলাকায় নাগেশ্বরী কাউকে পাঠায় না। নাগেশ্বরীর দলের দু’টো কচি ছেলেকে টেনে নিয়েছিল ঝুনিয়া অনেক টাকা কামানোর লোভ দেখিয়ে। ঝুনিয়া ওদের বলেছিল, বিহারে হোলির সময় পাঠিয়ে দশ হাজার টাকা কামাই করিয়ে দেবে। ওদের পাঠিয়েছিল, না কি নিলাম করে দিয়েছে কে জানে? নাগেশ্বরী নিলামে পাঠায় না। ওসব লাইনে নেই। নাগেশ্বরীর একটু গাঁজা-চরসের কারবার আছে।

দুলাল শুনেছে, নাগি-মা’র নাকি নিজের বাড়ি আছে। ছোটভাইয়ের সংসারে টাকা দেয়। ছোটভাইয়ের ছেলেকে বেঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায়। শুধু ছল্লা-র টাকায় কি চলে?

যেসব গুরুমা ‘কোতি’ নিলাম করে, ওদের পোষা গুন্ডা আছে। এমনি-এমনি পেতি-গুন্ডা নয়, ইংলিশ-জানা গুন্ডা। ওরা পুলিশের সঙ্গে ঠাট্সে কথা বলতে পারে, অফিসারদের সঙ্গে বসে মাল খায়, পকেটেও থাপ্পু থাকে, চাপ্পুও। চাপ্পু’ মানে ‘ছোট খোকা’। মানে ‘গুডুম’। এসব গুরুমা ‘টোন্যা’ নিয়ে এসে লি বিলা করিয়ে ‘ছিন্নি’ বানিয়ে বাজারে নিয়ে যায়। নিলামের জন্য। গুরুমা সব সময় নিজে যায় না। ওদের হিস্যাদার থাকে। মানে, ওইসব ঠুংঠাং গুন্ডা। দুলাল জেনেছে, পুরনো দিল্লির কোনও-কোনও জায়গায় ‘কোতি’ নিলাম হয়। ওখানে হাতের তালিতে দাম ওঠে। যারা ‘মাল’ নিতে আসে, তারা ‘ঠিকরি’ দেয়। ঠিকরি-র ‘মানে’ বোঝে ওরা। এক-একটা ‘তালি’ মানে এক-এক হাজার। একজন দশ তালি দিল তো অন্যজন বারো তালি, আর একজন পনেরো তালি। নাগিনদের দাম বেশি হয় অনেক। একটা ‘কোতি’ এভাবে এক মায়ের ডেরা থেকে অন্য মায়ের আশ্রয়ে চলে যায়।

দুলালের অবশ্য নিলাম হওয়ার ভয় নেই। ওকে কেউ নিলামে দেবে না। দুলাল তো দেখতে ভাল নয়, ওর গাল-ভাঙা। রংও ফরসা নয়। ওর বুকে এখনও লোম আছে অল্প ক’গাছা। তা ছাড়া ওর নাভির তলা থেকে পিঁপড়ের লাইনের মতো সরু-সরু লোমের সারি রয়েছে এখনও।

ঝুনিয়া সঙ্গে করে এক বাক্সো লাড্ডু এনেছে। একটা লাড্ডু দুলালীকে খাইয়ে দিল। পিঠে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করল—হো যা চমচম মেরা পেয়ারি। চাল চালালে মতবালি—জান মারলি লাগাকে তালি…। আরাম সে রহো। খাও, পিও, মস্তি মারো। ভাল লাগচে?

দুলালী রা কাড়ে না।

—ইখানে ভাল লাগচে তো?

দুলাল ঘাড় নাড়ে।

—আরে অত লোজ্জা কেন? ঠিক সে বলো, ভাল লাগছে? সব ঠিকঠাক কাম করো।

মা-র কথা শুনবে সোব সময়।

তারপর নাগেশ্বরীকে বলে—ঠিকঠাক চুন লিয়া। এরকমও দরকার আছে। বেশি এস্‌মার্ট ভাল হয় না। দুলালের ‘একমাসিয়া’ বেশ ধুমধাম করেই হচ্ছে। সবারই একটা ‘একমাসিয়া’ করতে হয়, কিন্তু সবার ক্ষেত্রে লোক ডেকে ভোজ খাইয়ে হয় না। কে জানে কেন, নাগেশ্বরীর দুলালীতে মন লেগেছে।

মাংসর গন্ধ বেরিয়েছে বেড়ে। ইতিমধ্যে বাসন্তী এসে গিয়েছে।

বাসন্তীর গলায় বেশ মোটা হার। ভিতরে লাল-নীল পাথর ঝলকাচ্ছে। দেখতে বেশ ভাল। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। গোলগাল চেহারা। ব্লাউজের তলায় পেটের দু’টো ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। সাদা। মনে হয় একসময় নাগিন হিজড়ে ছিল। মুখে পান, ঠোঁট পানরসে রাঙা। বাসন্তী আর ঝুনিয়া কোলাকুলি করল।

একটা ট্রে-তে তিনটে গেলাস, ভদ্‌কা-র বোতল, আর একটা বড় লিম্‌ষ্কার বোতল দিয়ে গেল ছবি। হাসি প্লেটে করে নিয়ে এল ধোঁয়া-উগ্‌লোগো মাংস। ঝুনিয়া বলল, আরে, ক্যায়া বাত।

নাগেশ্বরী ঢেলে দিল গেলাসে। ওরা বলছিল—কতদিন পর দেখাসাক্ষাৎ। এসব হলে তবু দেখা হয়।

ওরা হাই লেভেল কথা বলছিল। দুলালী অতটা না-বুঝতে পারলেও, অনিকেত জানে, এই তিনজনের মধ্যে ঝুনিয়ারই ভাট-ফাঁট বেশি। কারণ ওর হাতে কয়লা-মাফিয়া আছে। ঝুনিয়ার ‘বাবু’ নিশ্চয়ই কোনও কয়লা-মাফিয়া। এবং ওর চেলা-চেলিদের খদ্দের যারা, ওদের মধ্যে অনেকেই কয়লার ছুটকো কারবারি। ঝুনিয়ার দলবল বাচ্চা নাচিয়ে যা পয়সা রোজগার করে, তার চেয়ে নিজেরা নেচে বেশি পয়সা পায়। জায়গাটা বিহার সীমান্তে। এখানে ‘মওগা নাচ’ এবং ‘লন্ডা নাচ’-এর খুব চাহিদা। অশ্লীল গানেরও। ওদের কাছে ওইসব গান অশ্লীল নয়, অনিকেতদের কাছে অশ্লীল।

ঝুনিয়া বলল, কী মিটিন-এ যাবে না কি? নাগেশ্বরী বলল, চিঠি তো এসেছে। কিন্তু কী হবে গিয়ে? সব বেকার। কেবল যত বলকিবাজি। হ্যান করো, ত্যান করো। বলছে, সেলাই শেখাও, আরে আমরা কি বাচ্চা বিয়োব নাকি, খোকার ক্যাঁথা সেলাই করব, খুকির জামা সেলাই করব। বলছে, লিক্‌ম পোঁতা বন্ধ করো, এড্‌স হচ্ছে। আবার ‘দুব্বার’ সংগঠন—না কি যেন আছে, ওদের লোক এসেছিল, বলল, লিক্‌ পোঁতাপুঁতি করার আগে কন্ডোম পরো। সবাই চামনাচ্ছে।

বাসন্তী বলল, একটা মিটিন হয়েছিল, ভোটের মিটিন। ওখানে একজন বলেছে, হিজড়ে পেশা উঠিয়ে দেবে। সবাইকে ধরে লিয়ে গিয়ে হাতের কাজ শিখাবে। আচার-মাচার তৈরি শিখাবে। চায়ের দোকান করে দিবে। সব ঢ্যামনা। এটা কি লেফ্-রাইট নাকি? বলবে আ-রাম, অমনি সবাই পিছে হাত দিয়ে ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়ায়, তারপর কী যেন বলে—অমনি সব দু- ঠ্যাং জোড়া করে সাইডে হাত রেখে দাঁড়ায়। হিজড়েগুলোকে যেন লাইন করিয়ে বসিয়ে বলবে, পাঁপড় বানাও, অমনি সব যেন পাঁপড় চামনাতে লাগবে।

সব ভেল, সব ভেল–ঠোঁট উল্টে ঝুনিয়া বলে। তারপর এক ঢোক গেলেন।

কলকাতায় আবার একটা হিজড়ে-সম্মেলন আছে, ওই নিয়েও কথা হয়।

আসলে শিক্ষিতরা যেসব সম্মেলন করে, মানে এলজিবিটি-গ্রুপ, ওরা হিজড়েদেরও চিঠি দেয়। সবাইকে দিতে পারে না। সব ‘ঠেক’ বা ‘খোল’গুলির হদিশ ওরা জানে না। সম্ভবত কোথাও নেই। যেটুকু জানে চিঠিপত্র দেয়, বা লোকজন মারফত যোগাযোগ করে। এসবে হিজড়েদের খুব একটা উৎসাহ নেই। ওখানে সব ঠুংঠাং টোনা-ট্যুনি। ভদ্রঘরের ছেলেমেয়ে তবু কেউ-কেউ যায়। ইজ্জত দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু ওখানে যা সব আলোচনা হয়—তার সব কিছু ওরা বোঝে না। ভালও লাগে না। কিছু কথা অবশ্য ভাল লাগে। যেমন : হিজড়েরা বুড়ি’ হয়ে গেলে ওদের পেনশন দিতে হবে। পুলিশি হামলা বন্ধ করতে হবে, এসব কথা ভালই। ওরা ভোটের কার্ড করাতে বলে। বলে, নিজেদের ‘হিজড়ে’ পরিচয় দিতে লজ্জা কীসের? কিন্তু যাদের ভোটার কার্ড আছে? আগে ভোটের-বাবুরা যা খুশি লিখে দিত। কিন্তু ওরা নিজেদের ‘ফিমেল’ বলেই ভোটের কার্ডে লেখায়। ওসব মিটিংয়ে শুনে এসেছে বাসন্তী, হিজড়ে-রা নাকি আজকাল ভোটে দাঁড়াচ্ছে। পাটনায় নাকি কালী হিজড়ে এমএলএ হয়েছে। আরও কোথাও- কোথাও নাকি হিজড়েরা ভোটে দাঁড়াচ্ছে।

হিজড়েদের বরং এলাকাভিত্তিক মিটিংয়ে উৎসাহ বেশি। বাড়িওলার সমস্যা, স্থানীয় গুন্ডাদের সমস্যা, পুলিশকে কীভাবে চামনাতে হবে।

‘চামনা’ একটা আশ্চর্য শব্দ। কতরকম ভাবে এই শব্দটা ব্যবহার হয়। খিলুয়া চামনাচ্ছে’ মানে মদ খাওয়া। ‘পারিক চামনাচ্ছে’ মানে প্রেমিক জোগাড় করছে। এমনকী ফুল তোলা বোঝাতে ‘ফুল চামানো’। এসব হিজড়ে-মিটিংয়ে ‘চামানো’-টাই আসল। এরই মধ্যে হাসি, মশকরা, কোনও হিজড়ে মরে গেলে তার জন্য একটু নুন ফেলা। এক চিমটে নুন হাতে নিয়ে, ওর নাম করে মাটিতে ফেলে দেওয়া।

কথায়-কথায় ঝুনিয়া জানাল, সামনের বার ও হজ-এ যাবে। ওর বাবা মোমিন মুসলমান ছিল। হজ করার হচ্ছে ছিল, পারেনি ‘হজ’ সেরে এলে, ও আর খোলে থাকবে না। দেশের বাড়ি চলে যাবে। টাকাপয়সা দান-ধ্যান করে দেবে। জীবনে যত পাপ করেছে, সব খণ্ডন হয়ে যাবে। হজ থেকে ফিরলে ও ‘হাজিন’ হয়ে যাবে। ঝুনিয়া মুসলমান নয়। কিন্তু অনেক হিজড়েই একবার হজে যায়। হজ না পারলে আজমীর শরীফ। ‘আসলে ‘হিজড়ে’ শব্দটা এসেছে ‘হিজরত’ শব্দটা থেকে। হিজরত-এর সঙ্গে হজের অবশ্য কোনও সম্পর্ক নেই। ‘হিজরত’ হল সরে যাওয়া। পয়গম্বর হজরত মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনায় সরে গিয়েছিলেন। তাঁকে সরতে হয়েছিল, কারণ মক্কায় প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন। মদিনায় গিয়ে তিনি নিজের সমর্থক তৈরি করেন, আবার মক্কায় ফিরে আসেন। হিজড়েরাও ওদের পুরনো জীবন ছেড়ে অন্য জীবনে যায়, যে-জীবন নিজেরা নির্মাণ করেছে।

অনেক হিজড়েদের কাছে হজে যাওয়া একটা স্বপ্ন। সাধারণ হিজড়েরা এই স্বপ্ন থেকে অনেক দূর থাকে। পয়সাওলা হিজড়েদের পক্ষেই হজে যাওয়া সম্ভব। গুরুমাদেরই পয়সাকড়ি হয়। কোনও-কোনও গুরুমা হজ থেকে ফিরে ‘খোল’ ছেড়ে দেয়। কেউ-বা খোলেই থাকে, কিন্তু খোলের আসল দায়িত্ব অন্য একজনকে দিয়ে, গুরুমা উপদেষ্টার মতন থাকে।

হজের কথা শুনে, এই খোলের সফি-র চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সফি হল সফিউল্লা। রেশন কার্ডে ওর নাম সফিউন্নেসা। সফি জিগ্যেস করে—হজ করে এলে সব গুনাহ, সব কসুর মাপ হয়ে যায়? ঝুনিয়া বলে, তাই তো শুনি। সোজা বেহেস্ত স্বর্গ।

বেহেশতে কি সফি-র হবে? কী করে হবে? ইসলামে সবচেয়ে বড় ‘গুনাহ’ সোডোমি। সেটাই তো করেছে। শরাবও খেয়েছে। নমাজও পড়ে না। কেয়ামত হবেই। কবর থেকে মুর্দাদের উঠিয়ে দেওয়া হবে। আল্লাহ-র কাছে বিচারে যেতে হবে। দোজখ বড় কষ্টের। আর বেহেস্ত? কালার সিনেমা। গাছে-গাছে ফল, পাড়ো আর খাও। সবুজ ঘাসের গালিচা। আ- যা…তু আ্যা…। নদী। পাহাড়। ফুল। দিলরুবা… দিলরুবা। ঝরনা। ঝরনার জল নয়, ডিংক্‌স। যত খুশি পিও। ওখানে কত হুরি। খুব সুন্দর দেখতে, আর অ্যায়সান ফরসা যে, ওদের রক্তের নালি দেখা যায়। ওদের সঙ্গে দিনরাত ‘ধুরপিট্টি’। ওখানে পেচ্ছাব-পায়খানা কিচ্ছু হবে না। কেবল মস্তি।

কিন্তু সফি যদি বেহেশতে যায়, কোন শরীর পাবে ও? এই শরীর? না কি আগের শরীর? এই শরীরে হুরি কী হবে? তবে কি গেলমান নেবে, গেলমান? মেজচাচা খুব বলত। চাচা ছিলেন মুয়াজ্জিন। মসজিদের ছাদে উঠে আজান দিত। মাইক ছিল না। ওঁর গলায় খুব তেজ।

মেজচাচা বলতেন, সাত তবক আসমান, হাসরের ময়দান, জিন-ফরিস্তাদের কথা। দোখ- বেহেশতের কথাও তো বলত। বেহেশতের কত কিসিমের খাওয়ার কথা বলত—যেসব খাবার চোখেও দ্যাখেনি। কাজু-পেস্তা-আখরোট-কিসমিস-খেজুর। এসব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গেলমান। গেলমান-রা সব ষোলো বছরের ব্যাটাছেলে। ফরসা রং। আপেলের মতো গাল। মুক্তোর মতো দাঁত। কমলা-কোয়ার মতো ঠোঁট, ঘোড়ার কেশরের মতো চুল, সিঙ্গাপুরী কলার মতন লিকম্‌… না না, লিমের কথা চাচা বলেননি, এটা এই মুহূর্তে মনে হল সফি-র। মনে পাপ। মনে পাপ। তবে মনের ভিতরের কোন গর্তে বসে থাকা কে যেন বলল—যদি এই শরীরেই বেহেশতে যাও, ঈশ্বর তোমার জন্যও ব্যবস্থা রেখেছেন। গেলমান। গর্তে বসে যে আছে, ও শয়তান। চাচা বলতেন, শয়তানরা নানা রূপ ধরতে পারে। নাকের গর্তেও ঢুকে বসে থাকে, এজন্যই তো ‘ওজু’ করার সময় ভাল করে নাকের গর্ভেও পানি দিতে হয়।

ঝুনিয়া বলল—দালালের সঙ্গে বাতচিত হয়ে গিয়েছে। হজের বেওয়াস্তা করে দেবে। নমাজ-উমাজ তো জানি না। ওখানে নমাজ না-পড়লেও চলে। খালি কাবার চারদিকে ঘুরতে হয়। কাবাঘর ঘুরলে খুব সওয়াব হয়। ভগওয়ান নিজে ওই ঘর বানিয়েছিলেন। দুনিয়ার সবচেয়ে পুরনো ঘর। ওই ঘরের পাখর ছুঁতে হয়। ওই পাখর সব পাপ শুষে লেয়। উত্থান থিকে ফিরে এসে, আমি আর ইসব কাজ করব না। আমি, আমার সব কুছ আমার এক নম্বর ‘চেলি’ সাধনাকে দিয়ে দিছি। তুমরা সব ইখানে আছো, এই মওকায় আমি ডিকলিয়ার করে দিলাম। কাগজও বানিয়েছি, কোর্টের কাগজ। এপিটআপিট না কি যেন বোলে। উটার জেরগ বানিয়ে এনেছি। একটা করে রাখো।

ঝুনিয়া ওর ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা কাগজ নাগেশ্বরী আর বাসন্তীকে দিল। ঝুনিয়া বাসন্তীকে বলল, বাসন্তী মাঈ তো লিখাই পঢ়াই আছে। একবার পঢ়ো। বাসন্তী পড়তে থাকে—

অত্র মিদং ঘোষণাপত্র বরাবর পশ্চিমবঙ্গ সরকার পক্ষে বর্ধমান কালেক্টার বাহাদুর আসানসোল মহকুমা থানা আসানসোল ঘোষণাকারিণী শ্রীমতি ঝুনিয়া হিজরানি পিতা উল্লট রাম জাতি হিন্দু পেশা ডেন্সার—নবজাত শিশুসন্তান-সহ নাচগান সাকিন তাঁতিয়া বস্তি, কলাবাগান, আসানসোল জিলা বর্ধমান কস্য পত্রমিদং কার্য্যা। তাঁতিয়া বস্তি নিবাসী মৃত ধলা হিজরানির এলেকা আসানসোল পৌর এলাকা, কুলটি, বার্নপুর সমেত বিহার বর্ডার চিত্তরঞ্জন রূপনারানপুর সমেত সমস্ত গ্রাম এবং পুর এলাকা। সোনামুখীর ময়না হিজরানির বর্ধমান-ভুক্ত চাঁচর ও আদ্রাহাটি পঞ্চায়েত এলাকা ছাড়া সমগ্র অন্ডাল ব্লক, আউরিয়া হইতে জিটি রোড বরাবর বিহার বর্ডার পর্যন্ত দু পাশের সমস্ত গ্রাম, একুনে যাহা ধলা হিজরানির এলাকাভুক্ত ছিল তাহার সহিত বার্নপুর ও চিত্তরঞ্জন, যাহা আমি পরবর্তীকালে গ্রহণ করিয়াছি। যেখানে আমার শিষ্য ও চেলাগণ নবজাত সন্তান হইলে ডেন্‌স করে, এইসব অঞ্চলের দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডেন্স করার হক আমার একান্ত অনুগতা এবং নিজ-ঘরে পালিতা সাধনা হিজরানিকে দিলাম কারণ ধলা হিজরানির এলাকার মালিক আমি হইতেছি। আমি আমার হক, ঘর, এবং অধিকার সাধনা হিজরানিকে অত্র দলিল বলে দিলাম। কেহ আপত্তি করিতে পারিবে না। নিজ দখলীয় এলাকাতে নবজাত পুত্র ও কন্যাদের কোলে করিয়া নাচগান করা, আদর যত্ন ও আশীর্বাদ করা এবং এই বাবদ নবজাত সন্তানের পিতা-মাতার বখশিস গ্রহণ করা এবং চাউল, ডাইল, সবজি, ফল, কলাদি গ্রহণ করা চলিবে। মান্যবর সরকার বাহাদুরের হিজড়া প্রতিপালন আইন অনুযায়ী আমি এই কার্য গত তেত্রিশ বৎসর যাবৎ করিতেছি এবং গত ষোলো বৎসর যাবৎ ধলা হিজরানির অধিকার ভোগ করিতেছি। অত্র এই দলিল দ্বারা যাহা সাধনা হিজরানিকে অধিকারী করিতেছি, তাহার এলাকায় অন্য কেহ কাজ করিতে পারিবে না। এবং এই ঘোষণাপত্রকে প্রমাণ স্বরূপ গণ্য করিতে হইবে। আমি সুস্থ শরীরে সরল মনে এই ঘোষণাপত্র সম্পাদনা করিলাম।

চাত্তারা এটা শুনল। হাসিও শুনল। ওরা কেউ পরস্পরের দিকে তাকাল না। চাত্তারা-ই নাগেশ্বরীর সব কিছু হয়তো এভাবে পাবে, অথচ হাসি সবচেয়ে পুরনো।

নাগেশ্বরী বলল, শুন ঝুনিয়া দিদি, তুমি ভাল কাজে যাচ্ছো যাও। তোমার যা-ইচ্ছে তাই হবে। আমরা কোনও ঝামেলা করব না। আমার মেয়েরা খুব নক্ষী।

বাসন্তী বলল, আমি তো নদীর ওপারের লোক। বীরভূম জেলা। আমার সঙ্গে কোনও খটরমটর হবেনি।

ঝুরিয়া বলল, সে তো জানি। তবু সোবাইকে জানিয়ে দিলাম। ভাল কি না?

এসব তো হল। এসব ধানাইপানাই তো একমাসি-র মধ্যে হওয়ার কথা ছিল না। ওসব হল বৈষয়িক ব্যাপার। তারপর ‘খিলুয়া’ আর গান। দুলালীকে নাচ করতে বলল। দুলালী এখন এসব বেশ করে। ফুলি হাতে ঠিরি মেরে গান ধরল —

ছিন্নি হুয়ি রে।
পানাগড় বাজার মে ছিন্নি হুয়িরে।
এ ছিন্নি, এ ছিন্নি, ছিন্নি হুয়ি রে।
দুলালি দিব্যি নেচে দেয়।

এরপর অন্যরা নাচে। ‘আঁখ মারকে দেখা দো ফাঁক করকে দেখা, দো লাথ মারকে হাঠা দো—হাথ মারকে দেখা দো’—যা খুশি মদের নেশায় যা খুশি তাই। ওদের মধ্যে হাসি তো ঠিক আকুয়া নয়, অপরিনত লিঙ্গচিহ্নের অর্দ্ধনারী। ওগাইল—

যৌবন পুড়ে আঙার হ’ল মনের জ্বালা মিটল নাই
ডজন মরদ খেলা করল মনের মানুষ মিলল নাই
শরীল খোজে সবার আগে মনটা কেউ খুজে নাই
প্যাটের জন্য ঘুরছি কিন্তু দিলটাকে কেউ বুঝে নাই

চাত্তারা বলে এসব কাঁদন গান থামা হাসি,

মস্তির গান কর।

মস্তির গান চলল—ঠাপ দে ঠাপ দে ঠাপ দে ইয়ার…। মদের নেশায়—যা খুশি তাই।

সন্ধের আগে-আগে অতিথিরা চলে গেল। বাসন্তী ধরল ‘সতী সাবিত্রী’ বাস। ঝুনিয়া ধরল ‘জয় বাবা তারকনাথ’।

সন্ধের পর লি-বসা। ‘ছিন্নি’ হওয়ার একমাস পর, এটা করতে হয়। একটা কাঠের তক্তার মধ্যে সাতটা কাঠের লিঙ্গ-আঁটা আছে। সাতটার সাতরকম ‘সাইজ’। ছোট থেকে বড়। প্রথমটা দু’ইঞ্চি। পরেরটা তিন, এর পরেরটা চার, সপ্তমটা প্রায় সাড়ে সাত ইঞ্চি। সাতটার সাত রং। প্রথমটা সাদা, পরেরটা কমলা, তারপরেরটা লাল, এরকম সবুজ-নীল-বেগুনি। সাত নম্বরটা কালো। এখন আর সেরকম রং নেই। রং মুছে গিয়েছে। নিয়ম ছিল, নির্বাণ হওয়ার একমাস পর থেকে সাতদিনে সাতটা কাঠ-লিম বাড়ুতে ঢোকাতে হবে। এটা হল পায়ুপথ ঠিকঠাক করার প্রক্রিয়া। দুলালীর পায়ু পথ ঠিকঠাকই আছে বলা যায়। তবু নিয়ম হল, নিয়ম। বামুনদের পৈতের পর বারো বছর ব্রহ্মচারী হয়ে থাকতে হত। পরে ওটা এক বছরে দাঁড়ায়। এখন পৈতে হওয়ার তিনদিনের দিন মাছ-মাংস খাইয়ে দেওয়া হয়। অনিকেতের ভাগনের পৈতে হয়েছিল কালীঘাটে। মাথা ন্যাড়া করেনি ভাগনে। পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিয়েছিল। পৈতে হল, ব্রহ্মচারীর দণ্ড হাতে নিল, তারপর কালীঘাটের গঙ্গায় ভাসিয়ে ফেরার সময় চাইনিজ দোকানে চাউমিন-চিলি চিকেন খেয়ে ব্রহ্মচর্য সমাপ্ত করল। নিয়ম হল নিয়ম। তবু লিম-পোঁতা করতে হবে।

তক্তায় বসানো কাষ্ঠ-লিঙ্গগুলিকে ভাল করে দুধ-ঘি মাখানো হল। তারপর দুলালী প্রথম সাদাটার ওপর চেপে বসল। পায়ুপথে ওটা প্রবিষ্ট হল। ঢোল বেজে উঠল। ওরা গান গেয়ে উঠল—এই তো বাবার সাদা গেল রে… এই তো বাবার কমলা গেল রে…। পাঁচ নম্বর পর্যন্ত হয়ে গেল। ছয় আর সাত পারবে না। ভয় করছে। নাগেশ্বরী দুলালীর পিঠে হাত দিয়ে বলল, থাক বাছা। কাল দেখা যাবে।

৪৪

বিকাশ ঠাকুরপো ওর ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। শুক্লা ফোনে জানিয়েছিল।

এটা অবিশ্বাস্য। বিকাশ ওর ছেলেকে অসম্ভব ভালবাসে। ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওকে যোগব্যায়াম শেখায় বেশি মনোযোগ আসবে বলে। সাঁতার শেখায় বডি ‘ফিট’ থাকবে বলে। ফিট না-থাকলে ক্রিকেটটা খেলবে কী করে?

ক্রিকেটের কোচিং সেন্টারে নিয়ে যেত ছোটবেলা থেকে। লেখাপড়ার মাস্টারও ছিল। ল্যাঙ্গোয়েজ আর অঙ্কের জন্য সব আলাদা-আলাদা। বলত, ইংরেজিটা খুব ভাল জানতে হয় একজন ক্রিকেটারকে। ওদের সারা পৃথিবী ঘুরতে হয় তো, কত চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিতে হয়, ম্যাচ জিতলে, “ম্যান অফ দ্য সিরিজ’ হলে রি-অ্যাকশন দিতে হয়। আমাদের সৌরভ গাঙ্গুলি কী সুন্দর ইংরেজি বলে, তাই না? আমাদের বুকুনও ইংলিশ-টা ভালই বলে। ও নিয়ে চিন্তা করছি না—তবে ও সেরকম লম্বা হচ্ছে না। লম্বা না-হলে ভাল ক্রিকেটার হয় নাকি? এ জন্য ওকে রোজ একশোটা করে স্কিপিং করতে বলেছি, ‘টলারেন’ নামে একটা লম্বা হওয়ার ওষুধের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। কিনে দেব? অনিকেত বলেছিল, ওসব আজেবাজে ওষুধ খাওয়াস না। তা ছাড়া বেশি লম্বা না-হলে অসুবিধে কোথায়? শচীন কি লম্বা? গাভাসকর, বিশ্বনাথ কেউ লম্বা নন।

বিকাশ বলেছিল—আরে, শচীন তো ব্যাটসম্যান। আমাদের পুকাই তো মেলি উইকেটকিপার। ও হল উইকেটকিপার কাম ব্যাটম্যান। ফারুক ইঞ্জিনিয়ার যেমন ছিলেন। ওর আইডল হচ্ছে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।

অনিকেত বলেছিল, উইকেটকিপার’রা তো বেশি লম্বা হয় না, বরং বেশি লম্বা হলেই অসুবিধে। ওদের উঠ-বোস করতে হয় কিনা খুব—তাই তো জানি।

বিকাশ বলেছিল, আরে বললাম না, ওর আইডল হচ্ছে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ও তো লম্বা। তা ছাড়া ব্যাটসম্যানদের ফুটওয়ার্ক দরকার। পেস বল খেলতে ব্যাক ফুট, স্পিন খেলতে ফ্রন্ট ফুটওয়ার্ক লাগে। লম্বা পা হলে খেলতে সুবিধে কত… প্যারালাল রিং করলে নাকি লম্বা হয়

অনিকেত বলেছিল, দ্যাখ না, এখন তো ওর টিনএজ, হতেও পারে লম্বা।

বিকাশ বলেছিল, ধুর, আমি তো এভরি উইকে ওর হাইট মাপছি। রেকর্ড রাখছি। ব্যাটা বাড়ছেই না। ওই যে, বিজ্ঞাপনে থাকে না, টলার আর স্ট্রংগার হওয়ার হেল্থ ড্রিংক্স, সেটাও তো দিচ্ছি। জানি, ওগুলো ওদের বাত্তেলা, তবু কিনে খাওয়াই, যদি বাড়ে। তা ছাড়া রেগুলার আখরোট খাওয়াই। আখরোট হল কাশ্মীর, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের ফল। ওরা খুব লম্বা হয়। কে যেন বলেছে আখরোটের মধ্যে এমন একটা পদার্থ আছে, যার মধ্যে লম্বা হওয়ার ‘মাল’ রয়েছে।

ছেলের জন্য এক্কেবারে পাগল, আর ওই পাগলামিতেই ছেলেটা মরল।

.

বাড়ি ফিরছে। মোবাইলে মেসেজ। বেশ লম্বা মেসেজ। রোমান অক্ষরে : Ami Totota Jubati Noi… গোদা বাংলায়—’আমি ততটা যুবতী নই যতটা ছিলাম আগে, কিন্তু তত তো বৃদ্ধ নই যত আমি হব। তোমার পরশে যদি এ শরীর জাগে… শোব।’ এটা তসলিমা নাসরিনের কবিতা। ‘কাঁপন’ সিরিজের। বেশ ক’টা এরকম কবিতা ‘দেশ’-এ বেরিয়েছিল। মঞ্জু আবার ‘দেশ’ পড়ে না কি? কেউ হয়তো দেখিয়েছে এটা, ভাল লেগে গিয়েছে। এটা কি থাকবে? ‘ডিলিট’ করতে গেল। করল না। থাক। শুক্লা মেসেজ বক্স-টক্স খোলে না। জানেও না।

কাঁপন নিয়েই বাড়ি ঢুকল অনিকেত। ফিরতে রাত হয়। মন্টু গেট খুলে দিল। শুকনো মুখ। হাসল না। শুক্লারও শুকনো মুখ। হাসল না।

—কী, মনখারাপ? বিকাশের ছেলেটার জন্য, তাই না?

অনিকেত জিগ্যেস করল।

শুক্লা কোনও কথা বলল না। শুক্লার পিছন-পিছন ঘরে গেল। ঘরের দেওয়ালে একটা সানমাইকার বোর্ড ঝোলানো, ওখানে লেখা—

অ—অন্ধকার

আ—আলো

ই—ইচ্ছে

ঈ-ঈশ্বর

—এসব কী শুক্লা?

—পড়াই না? ঝট করে মাথাটা তুলে বলল, শুক্লা।

কিছুটা অহংকার। হ্যাঁ, কী একটা সংস্থা বানিয়েছে শুক্লা। না, সংস্থা বানানোর ক্যাপাকাইডি নেই ওর, একটা সংস্থা হয়েছে, ওখানে ও যুক্ত হয়েছে—এটা জানা ছিল। ক্লাস করতে যেত। গরিব ছেলেমেয়েরা পড়ে। রিকশাওলাদের, কাগজ-কুড়ুনিদের, কাজের মাসি-পিসিদের ছেলেমেয়েরা। এখন কি ঘরের মধ্যেই ক্লাস নিচ্ছে নাকি শুক্লা? অনিকেতের কেমন যেন মনে হয়, ও কিছুটা বিপদের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। কিছুটা অসহায় লাগে। ‘অ’ দেখলেই তো অজগর মনে পড়ে। একটা অজগর সাপ যেন… ‘অ-য় অজগর আসছে তেড়ে…’

—আচ্ছা শুক্লা, ‘অ’-তে অন্ধকার কেন লিখলে? ‘অ’-তে তো অজগর। ‘আ’-তে আম। তাই তো জানি ছোটবেলা থেকে।

শুক্লা বলল, ওসব পরে হবে। রাত হয়েছে।

তারপর সিঁড়ির পাশের ঘরটায় গিয়ে বলল, অন্ধকার তো সবাই দেখতে পায়। অজগর চোখে দেখা যায় নাকি? ওদের অন্ধকার নিয়ে কিছু বলতে বলি। আলো নিয়েও। তাড়াতাড়ি হাত-পা ধুয়ে নাও। গিজারে গরম জল আছে।

“ই’-তে ইচ্ছে। শুক্লা নিশ্চয়ই ‘ইচ্ছে’-র কথা জিগ্যেস করে ওর ছাত্রছাত্রীদের। ওরা কী বলে? একদিন ওর পড়ার ক্লাসটা দেখতে হয়।

‘অ্যাই, তোর কী ইচ্ছে রে?’ অনিকেতকে বাথরুমের মধ্যে কে যেন বলল। কেউ না। নিজেই। সাবানের ফেনার মধ্যে কতগুলো ইচ্ছে বুজকুড়ি কাটছে। সাবান-ফেনা ফাটছে। ইচ্ছে মরছে। ‘তোমার স্পর্শে যদি এ শরীর জাগে’… তুমি যে হও সে হও কোনও দ্বিধা নেই— ‘শোব’। মোবাইলের অন্ধকারে শুয়ে আছে ইচ্ছে। থাক, এখন শুয়ে থাক। কিন্তু ওই মেসেজের শেষ-শব্দ ‘শোব’ উঠে আসে বারবার। অথচ বিকাশের ছেলেটা…

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে অনিকেত বলে, বিকাশের…

—না, এখন থাক।

শুক্লা একটা হাত সামনের দিকে এগিয়ে দেয়—রাস্তা পার হওয়ার সময় চলন্ত বাসের দিকে যেমন করে আমরা হাত দেখাই।

বলল, খেয়ে নাও আগে। আমি একটা-একটা করে রুটি সেঁকে দিচ্ছি। একদম গরম-গরম। ওলকপির ডালনা, আর চিকেন। তুমি আসবে বলে।

একটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট দৃশ্য। শুক্লা আলো, অনিকেত অন্ধকার। অন্ধকারের মতো অনিকেতও ‘অ’ দিয়ে শুরু।

এখন ওলকপির ডালনা খাবে অনিকেত। মৃত্যু-সম্পর্কিত কোনও কথা নয়। মাংস- সম্পর্কিত কথা বলল।

—আর একটু সেদ্ধ হলে ভাল হত গো। ‘হ্যাঁগো-’ওগো’ তেমন বলে না অনিকেত। বলে ফেলল।

—এবার তা হলে তুমিও বুড়ো হচ্ছ, শুক্লা বলল, তুমি তো বেশি সেদ্ধ হওয়া মাংস পছন্দ করতে না।

—হুঁ। আগে টাইট মাংস পছন্দ করতাম। এরপর ‘এখনও করি’ বলতে গিয়েও চেপে গেল।

এবার মৃত্যুর কথা। বিকাশের ছেলেটির কথা। আদরের ছেলেটার কথা। অনিকেত বলে, বিকাশের ছেলেটার…

আবার হাতটা সামনে রাখল শুক্লা।

বলল—খুব খারাপ লাগে বলতে। এত ভাল ছেলেটা। জানো, বিকাশ ঠাকুরপোর বড্ড লোভ। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

এসব গ্রাম্যপ্রবাদ আজকাল শিক্ষিত মহিলারা বলে না। যেমন, ‘যত হাসি তত কান্না—বলে গেছে রাম সন্না’, কিংবা ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর…’। কিন্তু শুক্লা বলে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে।

ছেলেকে নিয়ে কী না কী ভেবেছে।

—জানো, পুকাই লম্বা হচ্ছিল না বলে ওর গায়ে হাত তুলত। মারত। তা ছাড়া পুকাইয়ের কোচ বলেছিল, ওর ফুটওয়ার্ক না কী বলে, সেটা ভাল নয়, তাতেই কেমন যেন হয়ে গেল বিকাশ ঠাকুরপো। ছেলের সঙ্গে কথা বলত না, পারমিতার সঙ্গেও কথাবার্তা বন্ধ করে দিল। পারমিতা বেহালার কোন চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে মঙ্গলচণ্ডীর ডোর নিয়ে এল কয়েকটা। ছেলের হাতে ডোর বেঁধে দিল। এবার চুপ করল শুক্লা।

মন্টু একবার ওদের ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে একটু কাঁচুমাচু স্বরে বলল, গ্যাস মুছে দিই?

-–না, তোকে কিছু করতে হবে না। শুতে যা

রান্নাঘরের কাজটাজ করে দেয় মাঝে-মাঝে। শুক্লা বলেছিল। ভালই তো। শুক্লা তো ওর সঙ্গে এখন যেভাবে কথা বলল, তার মধ্যে বিরক্তি মিশে আছে—অনিকেত বেশ বুঝতে পারল।

—হ্যাঁ বিকাশ, বিকাশের ছেলে পুকাই… শুক্লার এবারের হাতটা পুলিশের গাড়ি থামানোর মতো নয়, প্রাচীনা পিসিমা টাইপের। পিসিমাদের কাছ থেকে আমসত্ত্ব বা নাড়ু খাওয়ার বায়না করলে হাতটার পাঁচ আঙুল জোড়া করে সামনে রেখে যেমন বলতে চায়—”হ্যাঁ, হবে, হবে’— অনেকটা সেরকম।

একটা মৃত্যুর ধারাবিবরণী শুনতে চাইছে অনিকেত, আর শুক্লা সাসপেন্স দিয়ে যাচ্ছে। শুক্লা বলল, শোব।

‘শোব’ শব্দটা অনিকেতের মোবাইল-গহ্বর থেকে শিয়ালের ডাকের মতো নিঃশব্দ চিৎকার করে।

শোয়া হল। আলো নেভানো হল। পাশাপাশি। ওর উরুতে অনিকেত হাতটা রেখেছে, অনিকেতের মাথায় ওর হাত। এভাবে ভাই-বোনের মতো, টোনা-টুনির মতো, শুক-সারির মতো…। সেই কবে চড়াইপাখির খেলা দেখে, ওদের গায়ে ওঠাউঠি দেখে আমাদের ঠোঁট… পূর্ণিমা দেখে আমাদের হাত… শিমুল তুলো উড়ল বলে আমাদের মন…। আমাদের পূর্বকথা। পূর্ব-স্মৃতি বড় বেশি জ্বালাতন করে প্রতিবার। প্রতিবার ঘরে এসে পাশাপাশি শোয়ার মধ্যে শিমুল তুলো আসে, পদ্মবনের ঢেউ এবং অলি-ভ্রমর ইত্যাদি এসে জ্বালাতন করে।

অনিকেত শুক্লার উরুদেশে হাত রেখে বলে, তারপর?

—তারপর আর কী, ওষুধ খাওয়াচ্ছিল লম্বা হওয়ার জন্য, রিং, স্কিপিং—পারমিতা বলেছে। লম্বা হচ্ছিল না। কী করবে, শরীর কী নিজের ইচ্ছেয় হয়?

বর্ণালী গড়াইয়ের কথা মনে পড়ল অনিকেতের। যে কিশোরীটির স্তন ছিল খুব গরিব। একটা স্তন বাড়ানোর মালিশ কিনতে গিয়ে ধর্ষিতা, পরে খুন। পূজা ঘোষালের কথা মনে পড়ল। মেয়েটা স্বাস্থ্যবতী ছিল। এ জন্য ওর কষ্ট ছিল, দুঃখ ছিল। মেয়েটা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। বিজ্ঞাপনে দেখেছিল রোগা হওয়ার ‘পিল’ পাওয়া যায়। একসঙ্গে অনেকগুলো খেয়ে ফেলেছিল মেয়েটা। বাঁচেনি।

শরীর কি নিজের ইচ্ছেয় হয়? পাঁচ-পাবলিক যা বলে, মিডিয়া। কখনও ‘স্তনভারে ঈষৎ ন্যুব্জ’-দেরই সুন্দরী বলা হত, ভাবা হত। খাজুরাহো-কোনারকের মন্দির গায়ের সুন্দরীরা সবাই পৃথুলা। এখন তো ‘জিরো’ ফিগার। পূজা ঘোষাল ‘জিরো’ ফিগার চেয়ে মরল, আর বর্ণালী?

—পারমিতা অনেক বোঝাত বিকাশকে, আমাকে বলেছিল পারমিতা–ও এজন্য থাপ্পড় খেয়েছে। জ্ঞান দিতে এসো না… এসব বলেছে। পুকাইটা ওদের স্কুল-টিমে চান্স পেল না। ওদের স্কুলের একটা ক্রিকেট টিম আছে। সাউথ পয়েন্ট, নব নালন্দা, ডিপিএস—এসব স্কুলের সঙ্গে খেলা হয়। পুকাই বাড়িতে জানায়নি। ও প্যাড-ট্যাড নিয়ে সকালবেলা বেরিয়ে যেত। বিকাশ ঠাকুরপো জানতে পারল যে…

অনিকেত শুক্লার শরীর থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়।

—তারপর?…

—মোবাইলে ফোন করে জিগ্যেস করেছিল।

—তারপর?

—মেট্রোতে।

—ঝাঁপ!

—অপঘাতে মৃত্যু। তিন দিনে কাজ। আজ হয়ে গেল। —গিয়েছিলে?

—পারমিতার সঙ্গে ছিলাম। ওরা গঙ্গায়…।

তিনদিন আগে শুক্লা জানিয়েছিল। এতটা বলেনি। খালি বলেছিল, বাড়ি এসো, বলব। ফোনে শুনেই অনিকেত জিগ্যেস করেছিল—মেরে ফেলেছে? কী যা-তা বলছ? নিজের ছেলেকে মেরে ফেলেছে?

ঠিকই তো বলছি—শুক্লা বলেছিল।

—তো, বিকাশ কোথায়? পুলিশ ধরেছে?

—শুক্লা বলেছিল, পুলিশ জানতে পারেনি যে বিকাশ ঠাকুরপোই মেরেছে।

—কী করে মারল? খুন?

—না, ছেলেটা সুইসাইড করেছে।

—কোনও সুইসাইড নোট ছিল?

—ওর পকেটে একটা নাকি কাগজ ছিল। ওখানে লেখা ছিল, আই অ্যাম ওয়ার্থলেস। নো রাইট টু লিভ। ব্যস।

—কী করে সুইসাইড করেছিল?

—বলতে ভাল লাগছে না। এলে বলব।

বিকাশের ফোন নম্বর ছিল। মোবাইলে করেছিল। সুইচ অফ ছিল। ল্যান্ডলাইন-এ পারমিতা ধরেছিল। ‘আমি অনিকেতদা বলছি’ বলতেই পারমিতা বলেছিল—’আমার কিচ্ছু বলার নেই।’ ফোন ছেড়ে দিয়েছিল।

চাইবাসায় কলকাতার খবরের কাগজ আসে সন্ধের সময়। সন্ধের সময় গিয়ে কখনও কিনে আনে অনিকেত। দেখেছিল বটে একটা খবর—হেডলাইন ছিল—আবার মেট্রোয় বিভ্রাট।’ ভিতরে আত্মহত্যার ব্যাপারটা হয়তো লেখা ছিল কোথাও। পড়া হয়নি। মেট্রোয় যারা আত্মহত্যা করে, ওদের ওপর একটা বিরক্তিই পোষণ করত অনিকেত। আবার ঘণ্টাখানেক ট্রেন বন্ধ। ট্রেন-বিভ্রাটটাই আসল। যেন মৃত্যুটা কিছু নয়। ওই খবরের ভিতরে পুকাইয়ের নামটাও ছিল কি না, কে জানে? পুকাইয়ের ভাল নাম জানে না অনিকেত।

অনিকেত পাশ ফিরে শোয়। তাল-পাকানো মাংসপিণ্ড। হাত-পা-মাথা-পাকস্থলি সব দলা পাকিয়ে গিয়েছে। মাথা থেকে বেরিয়ে পড়েছে ঘিলু। মস্তিষ্ক। যে-মস্তিষ্কের মধ্যে কিছু উচ্চাশা ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। একটা দলা-পাকানো রক্তফেনা-মাখা বালক—যে সৌরভ গাঙ্গুলি হতে চেয়েছিল। ওর বাঁহাতে তখনও প্যাঁচানো ছিল লাল ইচ্ছের সুতো। মঙ্গলচণ্ডীর ডোর।

কেবল মুহূর্তের মৃত্যু। এই আমাদের জীবন। মৃত-ইচ্ছেরা অলৌকিক জলের তলায় প্রবালের মতো কণায়-কণায় জড়ো হচ্ছে। একদিন জলের ভিতর থেকে, জল ছিঁড়ে, ডুবো- পাহাড়ের মতো জেগে উঠবে মৃত-ইচ্ছের কালোপাহাড়।

তেষ্টা পায়। বিছানায় শুল্কা শুয়ে আছে। জানালার কাচ চুঁইয়ে এক ধরনের ম্যাদামারা আলো এসেছে ঘরে। কম্বল-মোড়া শুক্লা ঘুমোচ্ছে। ঠোঁট সামান্য খোলা। শুক্লা, তুমিও তোমার ইচ্ছে পুষেছ। ইচ্ছে মেরেছ। বোর্ডে ‘ই’-তে ইচ্ছে লিখেছ। ‘ঈ’-তে ঈশ্বর। ‘ঈ’-টা তোমার ই- টাকে প্রশ্রয় দিল না। এ নিয়ে তোমার কোনও ক্ষোভ নেই। তবু তুমি নিত্যনতুন তৈরি করে যাও। ইচ্ছের জন্ম দিয়ে যাও। এটাই জীবন। ক্রমাগত ইচ্ছে বিয়োনো, আর মৃত-ইচ্ছের জন্য সামান্য শোক।

বিছানা থেকে ওঠে। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ছাদে উঠে যায় অনিকেত। সিঁড়ি ক্রমশ উঠে যাচ্ছে। সিঁড়ি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। মহাপ্রস্থানের মতো সিঁড়ি। একসময় সিঁড়ি শেষ হলে হাহা ছাদের দরজা। বাইরে আকাশের এক কোণে গুটিসুটি মারা চাঁদ। কুয়াশা। কুয়াশাকেই তো ‘কুহক’ বলে। আকাশের তলায় শহর। ঘরে-ঘরে পোষা ইচ্ছে, রুগ্‌ণ ইচ্ছে, কোমায়। ইচ্ছের শব। মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায় হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে তাহারাও তোমার মতন… মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই।

দেখা হলেই তো ছেলেটার কথা বলত। ওর বুদ্ধি, ওর দীপ্তি, ওর প্রতিভার কথা। সেই কবে ছোটবেলায় প্রশ্ন করেছিল, মেয়েদের ‘গো গো’ হয় কেন? ছেলেদের কেন হয় না? আবার এমন প্রশ্নও করেছিল : আপেল যদি মাটিতে পড়ে, চাঁদ কেন পড়ে না?

বিকাশ বলেছিল, জানিস অনি, পুকাই ক্যালকুলেটরে গুণ-ভাগ করে না। কুড়ি পর্যন্ত ওর নামতা মুখস্থ। এমনকী সতেরো, উনিশের নামতাও।

পুকাইয়ের জন্মদিনে একটা ‘সুকুমার সমগ্র দিয়েছিল অনিকেত। বিকাশ বলেছিল, ক্যাশ মেমো আছে? পাল্টে আনব। শচীনকে নিয়ে একটা ভাল বই বেরিয়েছে শুনলাম। অনিকেত বলেছিল, তুই কিনে দিস ওটা। আমি সুকুমার রায়ই দেব।

খুব বিচ্ছিরি লাগছে অনিকেতের।

ছেলেটার এই মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধ নিয়ে ইচ্ছে করছে। দাঁতে দাঁত ঘষে। কীভাবে প্রতিশোধ নেবে? শীতের মধ্যে কাঁপে অনিকেত। কাঁপন। কাঁপনের গাঁড় মারি। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে। প্রথমেই মঞ্জুর মেসেজটা ‘ডিলিট’ করে দেয়। মঞ্জুর আরও কিছু মেসেজ ছিল, ‘ডিলিট’ শব্দটার পরে একটা জিজ্ঞাসা-চিহ্ন থাকে। যতটা জোরে বোতাম টেপা উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি জোরে বোতাম টিপে ‘ডিলিট’ করতে থাকে। মেসেজ মুছে যাওয়ার করুণ শব্দ হয়।

এর বেশি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা নেই অনিকেতদের। বড়জোর থুথু ফেলতে পারে। পেচ্ছাপও করতে পারে। ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করল, ভাসিয়ে দেব শালা। মধ্যরাত্রির কোনও গাড়ি হর্ন দিল। হর্ন নয়, প্যাঁক দিল।

পেচ্ছাপ করার পর যেন মনের ভার কিছুটা নেমে গেল। অনিকেত, অনিকেতদের মতো সাধারণ যারা, যারা বেঁচে আছে বলেই মুগ্ধ, ওরা গরমের দিনে সামান্য দখিনা সমীরণেই মুগ্ধ বৈশাখী বৃষ্টির দু-চার দানা শিল পেলেই মুগ্ধ। কোষ্ঠ খোলসা হলে মুগ্ধ। পেচ্ছাপ করলেই মনের ভার নেমে যায়।

অনিকেত বিছানায় ফেরে। একটা ঘুম চাই। প্রগাঢ় ঘুম।

.

বিকাশের বাড়ি গেল। যেতে-যেতে বিকেল। বাড়িতেই ছিল। বউ অন্যথা। বেশ কিছুক্ষণ বেল টেপার পর খুলল। মুখে দাড়ি। অনিকেতের দিকে তাকিয়ে চোখটা নামিয়ে নিল।

বলল, ঘরে চল।

বিছানায় বসল। মদ খেয়ে আছে বিকাশ। অনিকেত বলল, পারমিতা কোথায়?

—বাপের বাড়ি।

—কবে ফিররে?

—ফিরবে না বলেছে। আমি খুন করেছি। খুনির সঙ্গে থাকবে না।

—তুই তো আর ইচ্ছে করে… মানে, তুই কী করে জানবি… মানে তুই তো ভালর জন্যই… কথা গুলিয়ে যায়। কথা এলোমেলো হয়ে যায়।

—ঠিক আছে, ঠিক আছে। হাতটা সামনে তুলে ধরে। যেমন কতকাল শুক্লা করেছিল। অনিকেত চুপ করে যায়।

বিকাশ বলে—পুকাইকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল। না, স্বপ্নদোষ ছিল। ওকে বুঝতে পারিনি। ও কিন্তু আমাদের বুঝেছিল। পকেটে কোনও কিছু লিখে রাখেনি। লিখতেই পারত আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার বাপ। গান্ডু বাপ। লিখতেই পারত বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে আমি…। লিখতেই পারত। ও লেখেনি। ও যদি আমার সত্যিকারের ছেলে হত, যাকে বলে বীর্যজাত সন্তান, তা হলে এরকম করতাম? অ্যাডপটেড বলেই এরকম করেছি। ক্যাচ মিস করেছে— খেলার পরই থাবড়া মেরেছি। স্ট্যাম্প করতে পারেনি—থাবড়া মেরেছি। মায়াটা শরীরে আসেনি। মনের ভিতরে একটা পোকা পুষে রেখেছি। ভেবেছি, একটা অনাথালয় থেকে বাচ্চা তুলে এনেছি, যার বাপের ঠিক নেই। আমি হলাম শালা উদ্ধারকর্তা বোকাচোদা। আমার সব সাধ মেটাতে হবে ওকে। ওকে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট হতে হবে—গিলক্রিস্ট। মাথা থাবড়ায় বিকাশ।

অনিকেত বলে—এভাবে ভাবছিস কেন? ওকে কত ভালবাসতিস, সেটা ভাব, কত খাবার এনে দিতিস।

—আমাকে পচাস না অনি, ভালবাসতাম? আসলে ইনভেস্ট করতাম। পরে সুদে-আসলে তুলে নেব বলে। ছেলে অ্যাডপ্‌ট না-করে যদি মেয়ে করতাম… তা হলে হয়তো এরকম করতাম না। ওকে তো গিলক্রিস্ট বানাতে চাইতাম না…।

—হয়তে পিটি ঊষা বানাতে চাইতিস তখন…

—না। পিটি উষা-ফুসা বানাতে চাইতাম না। ওখানে গ্ল্যামার নেই। পয়সা নেই। মডেল বানাতেও চাইতাম না—ঘরের মেয়ের ‘মডেল’ হওয়া মানতে পারতাম না। হয়তো গানটান শেখাতাম—

—লতা মুঙ্গেশকার করতে চাইলেও তো সমস্যা হত।

—না রে… একটু নরম গলায় বলল, বিকাশ। মেয়ে নিলে পারমিতার ইচ্ছেতেই মানুষ হত ও। ওর আমার মতো স্বপ্নদোষ নেই। মেয়ে নিয়ে অত উচ্চাশা আমারও হত না। মেয়ে তো…। ওই একটু গানটান… ঘরের কাজ… একটু না-হয় কম্পিউটার… ব্যস। বিয়ে দাও ভাল ছেলে দেখেটেখে। পারমিতা মেয়েই চেয়েছিল। আমিই জোর ফলিয়েছি। আমার ‘মত’ চাপিয়ে দিয়েছি।

অনিকেত বলে, তুই তোর ব্যাটাছেলেত্বটা চাপিয়ে দিয়েছিল। মানে, মর্দানিটা।

বিকাশ বলে, এবার তা হলে আমি কী করব বল?

অনিকেত বলে, আগে তুই বল পুলিশের খপ্পর থেকে কীভাবে ছাড়া পেলি?

বিকাশ বলল—পুলিশ ডেকেছিল। একজন বলল, এক সন্তান হওয়ার এই হচ্ছে ব্যাড এফেক্ট। জিজ্ঞাসা করেছিল বকাবকি করেছিলেন? আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম। বলেছিল, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করত? বললাম, মন্দ করত না। একজন বলল, আজকালকার ছেলেপিলেগুলো আজব। কখন যে কী করে বিশ্বাস নেই। কোমরের সার্ভিস রিভলবারটা টেবিলে দু’বার ঠুকে বলল, সবই মায়া। বলল, বাকি জীবনটা ঠাকুরের নাম করে কাটিয়ে দিন। থানা থেকে আমাকে হ্যারাস করেনি। একজন কনস্টেবল কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, হাজার পাঁচেক টাকা রেখে যান—ঝামেলা আছে তো, মর্গে পাঠাতে হবে, রিপোর্ট, তারপর হ্যান্ডওভার…।

পুড়িয়ে এলাম।

একটা বস্তায় কিছু থেঁতলানো ইচ্ছে। মরা ইচ্ছে।

—জানিস অনি, স্কুল টিমে চান্স না-পেয়ে আমার ভয়েই বাড়ি ফেরেনি। আমার জন্য। আচ্ছা, পারমিতা কি সত্যি ফিরবে না? আমার কি ওর কাছে ক্ষমা-টমা… তোর কী মনে হয়?

আমি বলি, ফিরবে। ঠিক ফিরবে। এখন ক’দিন চুপচাপ থাক।

শোক থাকলেও গৃহকর্ম থাকে।

শোক-বাড়ি ছেড়ে বেরতেই মঞ্জুর ফোন। ধরল না। দু’বার। এবার ইলেকট্রনিক্সের দোকান আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন মাঝে। তবুও এসব দোকানে যেতে হয়। অল্প সময়ের জন্য কলকাতা আসা। বাড়ি, অফিস, বাজার, মঞ্জু, সংস্কৃতি—সবই সামলাতে হয়। একটা মাইক্রো আভেন কেনার কথা ভাবছিল অনিকেত। ওর অনেক বন্ধুর বাড়িতে এসে গিয়েছে। গরম করতে খুব সুবিধে হয়। শুক্লা খুশি হবে। একটা মাইক্রো আভেন কিনে নেয়। ভাল করে বুঝে নেয়। শোক-কে আগেই ডিউটিতে রূপান্তরিত করে দিয়ে এসেছিল। এবার ডিউটি-কে রূপান্তরিত করবে সুখে। সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে। ট্যাক্সিতে অনিকেতের কোলে মাইক্রো আভেন দোলে। সঙ্গে একটা স্যান্ডউইচ-মেকার ফ্রি।

—শুক্লা, মাইক্রো আভেন। গরম করার জন্য ঢালাঢালি করতে হবে না। ফ্রিজ থেকে সোজা মাইক্রো আভেন-এ বসিয়ে নব ঘুরিয়ে দাও। গরম হয়ে যাবে। কত কী রান্নাও করতে পারবে মাইক্রো আভেনে। ভাপা, পাতুরি, ডাল। বই দিয়ে দিয়েছে। দেখে নাও। এটা হল হাই, এটা লো, এটা মিডিয়াম। এটা হল টাইমার। যত বেশি জিনিস গরম করবে, তত বেশি টাইম লাগবে। ধরো, এক বাটি ডাল গরম করবে… শুক্লা বলে ওসব আমার দ্বারা হবে না। বরং মন্টুকে বুঝিয়ে দাও।

বলেই বলল—মন্টুও কি বুঝবে? ওর একটু বুদ্ধিসুদ্ধিটা কম। ওকে নিয়ে প্রবলেম আছে। আচ্ছা, আমরা দু’জনেই বোঝার চেষ্টা করি।

অনিকেত ডেমনস্ট্রেট করতে থাকে…। কিছুক্ষণ পর শুক্লা বলে—এসব যন্ত্রপাতি আমাদের কাজ না। মন্টু, বুঝে নে ঠিক করে।

অনিকেত বলে—যন্ত্রপাতি তো কী হয়েছে! এটা তো রান্না। রান্নায় স্টোভ জ্বালাতে না? পাম্প করতে না? ওসব তো যন্ত্রপাতিই ছিল। বাটনা বাটতে। এখন তো মিক্সি চালাও।

—মিক্সি তো চালাই বাটনা বাটার কাজ করতেই হবে বলে। কিন্তু এটায় অনেক অ্যাডজাস্টমেন্ট। তারচে’ বাবা গ্যাসে গরম করে নেওয়াই ভাল।

শুক্লাও ভাবে, মেশিনপত্র মেয়েদের জন্য নয়। তবে রান্নাবান্না, ঘরকন্না সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি হলে সেসব ব্যবহার করতেই হবে। মেয়ে কিনা, তাই। কম্পিউটার বা ক্যামেরা মেয়েদের জন্য নয়। গাড়ি? না-না, ওটা এমনি মেয়েরা চালাতে পারে না। যারা পারে, ওরা হেভি স্মার্ট।

অথচ মেয়েরা কি যন্ত্রপাতি চালায়নি? ঢেঁকি তবে কী? সুতলি ঘুরিয়ে কী আশ্চর্য কায়দায় তুলো থেকে সুতো বার করত—তাঁত বুনত—এখনও বোনে মেয়েরাই। যন্ত্রপাতির ব্যবহারের মধ্যেও লিঙ্গ-বৈষম্য। স্কুটার মেয়েদের, মোটর সাইকেল ছেলেদের। লেদ মেশিন ছেলেদের, সেলাই মেশিন মেয়েদের। পৃথিবীর পোশাক তৈরির কারখানার শ্রমিক অধিকাংশই মেয়ে, পাটকলের শ্রমিক ছেলে। মেয়েরা সব আর্টস পড়ত আগে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া অন্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে মেয়েরা খুব একটা যায় না। অথচ বাড়ির যন্ত্রপাতিগুলি মেয়েরাই চালায়। অনেক বাড়ির ব্যাটাছেলেরা ওয়াশিং মেশিনের কোন বোতাম কী কাজে ব্যবহার করা হয়, জানে না। যন্ত্রপাতির ভিতরে তো হরমোন-টরমোন নেই। লোহা-পেতল-প্লাস্টিক-নাট-বল্টু স্প্রিং। যন্ত্রপাতির মধ্যে তো টেস্টোস্টেরন-ইস্ট্রোজেন নেই, অথচ যন্ত্রপাতিরও লিঙ্গ আছে। কম্পিউটার যেন একটা অর্ধনারীশ্বর। ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই। শুধু যন্ত্রপাতি কেন? একটা ব্যাগেরও লিঙ্গ আছে। নইলে বলে কেন এটা লেডিজ ব্যাগ? লেডিজ ছাতা? লেডিজ ছাতা ‘ছোট’ হয় কেন? বৃষ্টি কি মেয়েদের শরীরে কম পড়ে? লেডিজ পার্স ছোট। বড় রোজগেরে মেয়ে হলেও পার্সটা ছোট। মেয়েদের কি শীত কম লাগে? কিন্তু গরমচাদরটা ছোট।

একটু ‘ছোট-ছোট’ হওয়াটাই কি মেয়েলি নাকি? গড়পড়তা মেয়েরা গড়পড়তা ছেলেদের চেয়ে লম্বায় ইঞ্চি তিনেক ছোট। তাই বলে সব কিছু ছোট হয়ে যাবে? ছাতা কেন ছোট হবে? —কমনীয়তাই হল মেয়েলিত্ব। পেলবতা। যন্ত্রপাতিগুলোও তেমন আর ম্যাসকিউলিন থাকছে না। আগেকার ভারী মোটা-মোটা ফ্রিজ আর আছে? কী সুন্দর স্লিম-ট্রিম। হোঁতকা মিক্সিও কত ছোট হয়ে গিয়েছে। জেনারেটরও। সাবমার্সিবল পাম্প-ও কেমন ফেমিনিন হয়ে যাচ্ছে…।

শুক্লা ইতিমধ্যে গরম করে ফেলেছে ডাল, ডিমের ডালনা।

বলল, না গো, তেমন কঠিন কিছু নেই। শুক্লা খুশিই হয়েছে, নইলে ‘গো’ বলত না এখন। তারপর বলল, স্যান্ডউইচ-মেকার টাও কাজে দেবে। কিছু নয় তো ঝামেলার। পাউরুটি ভরে চেপে দিয়ে সুইচ ‘অন’ করে দাও। হয়ে গেলে নিজেই ‘অফ’ হয়ে যাবে। দেখতে খুব সুন্দর।

অনিকেত বলল, যেন একটা মেয়ে, তাই না?

শুক্লা বলল, ঠিক বলেছ। কিন্তু স্লিম। হ্যান্ডেল দু’টো যেন পা। ভালই হয়েছে। মন্টুকে স্যান্ডউইচ করে দেব। মন্টুটার জন্য এত করি অথচ…

—অথচ কী?

—পরে বলব। বিকাশ ঠাকুরপোকে কেমন দেখলে?

.

একেই ঘরকন্না বলে। সুইসাইড ও স্যান্ডউইচ সব মিশে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *