দ্বিতীয় শাখার প্রাণী
স্পঞ্জ্
তোমরা স্পঞ্জ্ দেখিয়াছ কি? পাঁউরুটীর ভিতরে যেমন অনেক ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, ইহা সেইরকম ছিদ্রযুক্ত একটা জিনিস! ইহার রঙ্ কিন্তু পাঁউরুটির মত সাদা নয়,—কতকটা বাদামী ধরণের। হাতে লইয়া চাপ দিলে রবারের জিনিসের মত ইহা ছোট হইয়া যায়, ছাড়িয়া দিলে আবার আগেকার মত বড় হয়। যদি তোমরা স্পঞ্জ্ না দেখিয়া থাক, তবে তোমাদের পাড়ার ডাক্তারখানায় গিয়া দেখিয়া আসিয়ো। গায়ে জল লাগিলে বা কোনো স্থানে জল পড়িলে, আমরা শুক্নো কাপড় বা গামছা দিয়া জল শুষিয়া লই; স্পঞ্জ্ শুক্নো কাপড়ের চেয়েও তাড়াতাড়ি জল শুষিয়া লইতে পারে। এইজন্য ডাক্তারেরা ইহা নানা কাজে ব্যবহার করেন এবং অনেক দেশের লোকে স্নানের সময়ে গামছার পরিবর্ত্তেও ইহার ব্যবহার করিয়া থাকেন।
আমরা আগে যে আঠার মত প্রাণীদের কথা বলিয়াছি, স্পঞ্জ্ সেই রকমেরই প্রাণী, কিন্তু ইহারা এক-কোষ প্রাণী নয়। মানুষ, গোরু প্রভৃতি জন্তুদের দেহ যেমন অনেক কোষে প্রস্তুত, ইহাদের শরীরও সেইরকম অনেক কোষ দিয়া নির্ম্মিত। কিন্তু বড় বড় জন্তুদের মত ইহাদের হাত পা মুখ চোখ কান নাই, এমন কি খাদ্য হজম করিবার জন্য পেটও নাই। এক-কোষ প্রাণীদের চেয়ে ইহারা একটু উন্নত, এইজন্য স্পঞ্জ-প্রাণীকে দ্বিতীয় শাখায় ফেলা গেল।
এক-কোষ প্রাণীর মধ্যে কয়েক জাতি যেমন হাড়ের মত শক্ত খোলা তৈয়ার করিয়া তাহার মধ্যে নিরাপদে বাস করে, ইহারাও সেই রকম এক ফন্দি করিয়া শত্রুর হাত হইতে উদ্ধার পায়। ইহারা খোলা প্রস্তুত না করিয়া অনেক ছিদ্রযুক্ত স্পঞ্জ্ তৈয়ার করিয়া তাহাতে লুকাইয়া থাকে। তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, যে জিনিষটাকে আমরা স্পঞ্জ্ বলি, তাহা এই প্রাণীদের হাড় বা মাংস নয়;—নিরাপদে বাস করিবার জন্য ঘরবাড়ীর মত একটা জিনিষ। বাহির হইতে ইট্ কাঠ জোগাড় করিয়া আমরা ঘর-বাড়ী প্রস্তুত করি; কিন্তু ইহারা তাহা করে না। নিজেদের শরীর হইতে এক রকম লালার মত জিনিস বাহির করিয়া ইহারা স্পঞ্জ্ প্রস্তুত করে,—ঐ লালাই এই প্রাণীদের ইট্ ও কাঠ। সমুদ্র হইতে যখন সদ্য সদ্য স্পঞ্জ্ উঠানো যায়, তখন সেই আঠার মত প্রাণী স্পঞ্জের সর্ব্বাঙ্গে মাখা থাকে। যে প্রাণীর মুখ নাই, চোখ নাই, পা নাই, বিশেষ আকারও নাই, তাহারা যে কৌশলে ঘরগুলি নির্ম্মাণ করে, তাহা খুব আশ্চর্য্যজনক নয় কি? তোমরা যদি স্পঞ্জের একটু টুক্রা খুব পাতলা করিয়া কাটিয়া অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে, রেশমের সূতার মত অনেক সরু সূতা দিয়া স্পঞ্জ্ প্রস্তুত হইয়াছে। সূতাগুলি গায়ে গায়ে এমন জমাটভাবে লাগানো থাকে যে, খালি-চোখে সেগুলিকে দেখাই যায় না। গুটি-পোকারা যে জিনিস দিয়া রেশমের সূতা প্রস্তুত করে, স্পঞ্জ্ও ঠিক সেই জিনিস দিয়া প্রস্তুত হয়।
এখন স্পঞ্জ্-প্রাণী ও তাহাদের ঘর-বাড়ীর কথা একটু বিশেষভাবে আলোচনা করা যাউক।
তোমর এক টুক্রা স্পঞ্জ্ যদি ভালো করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া পরীক্ষা কর, তবে দেখিবে, তাহাতে কয়েকটি বড় বড় ছিদ্র আছে এবং অনেক ছোট ছিদ্রযুক্ত সুড়ঙ্গ বাহির হইতে আসিয়া সেই বড় ছিদ্রে শেষ হইয়াছে। স্পঞ্জের প্রাণী ঐ সকল ছিদ্রের গায়ে জিউলির আঠার মত লাগিয়া থাকে। বড় ছিদ্রে প্রাণীর দেহের যে অংশ থাকে, তাহা হইতে অনেকগুলি শুঁয়ো বাহির হয়। ইহারা যত দিন জীবিত থাকে, ততদিন ঐ শুঁয়োগুলি নাড়িতে থাকে। যেদিন ভয়ানক গরম এবং একটুও বাতাস নাই, তখন আমরা তালের পাখা নাড়িয়া বাতাস খাই। পাখা নাড়া পাইলেই খানিকটা বাতাস ঠেলিয়া দূরে লইয়া যায়। এই রকমে যে জায়গাটা খালি হয়, পাশের বাতাস জোরে আসিয়া সেই জায়গা জুড়িয়া বসে। বাতাসের এই রকম যাওয়া-আসাতে পাখার কাছে একটা বায়ুর প্রবাহ উৎপন্ন হয়। স্পঞ্জ্ প্রাণীরা যখন ছিদ্রের ভিতরে থাকিয়া তাহাদের শুঁয়ো নাড়িতে থাকে, তখন সেখানেও একটা জলের প্রবাহ হইয়া পড়ে। ইহাতে ছোট সুড়ঙ্গগুলি দিয়া জল প্রবেশ করিয়া, তাহা বড় সুড়ঙ্গ দিয়া বাহির হইতে আরম্ভ করে। স্পঞ্জের প্রাণীরা খুব অধম জীব হইলেও তাহারা প্রাণী। সুতরাং বাঁচিয়া থাকিবার জন্য ইহাদের বাতাসের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, আবার কিছু খাদ্যেরও দরকার হয়। আমরা আগেই বলিয়াছি, জলের সঙ্গে যে বাতাস মিশানো থাকে, তাহা হইতে অক্সিজেন্ টানিয়া লইয়া অনেক জলচর প্রাণী বাঁচিয়া থাকে। স্পঞ্জ্ প্রাণীরাও জলে মিশানো বাতাসের অক্সিজেন্ শুষিয়া বাঁচিয়া থাকে। তাহাদের ঘরের সেই সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়া যখন জলের স্রোত চলিতে থাকে, তখন তাহারা সেই স্রোতের জল হইতে অক্সিজেন্ টানিয়া লয় এবং জলের সঙ্গে সঙ্গে যে ছোট প্রাণী বা উদ্ভিদ্ ছিদ্রে প্রবেশ করে, নিজের আঠালো দেহে আট্কাইয়া সেগুলিকেও খাইয়া ফেলে।
সুতরাং বুঝিতে পারিতেছ, কেবল নিরাপদে থাকার জন্য স্পঞ্জ্ প্রাণীরা সুড়ঙ্গযুক্ত ঘর নির্ম্মাণ করে না, ইহাতে খাদ্যও কাছে আসে।
প্রাণিমাত্রেই সন্তান রাখিয়া মরিয়া যায়। এই ব্যবস্থা না থাকিলে কোনো প্রাণীর বংশ থাকে না। স্পঞ্জ্ প্রাণীরা একটু উন্নত হইলেও, পশুপক্ষীদের মত উন্নত নয়। ইহারা এই জন্য ডিম বা সন্তান প্রসব করে না। বয়স বেশি হইলে ইহাদের শরীর হইতে ডিমের মত কতকগুলি অংশ খসিয়া পড়ে। ইহাই বড় হইয়া নূতন প্রাণী হয় এবং তাহারাই আবার স্পঞ্জের ঘরবাড়ী তৈয়ার করিতে আরম্ভ করে।
আমাদের দেশের খালবিলের বদ্ধ জলে এক রকম স্পঞ্জের মত প্রাণী দেখা যায়। তোমরা ইহা দেখিয়াছ কি না জানি না। জলের মধ্যে যে-সকল গাছের ডালপালা পচিতে থাকে, তাহারি উপরে ইহারা ছোট ছোট মৌ-চাকের মত বা বোল্তার চাকের মত ঘর করে। ইহাদেরও দেহ ঠিক স্পঞ্জ্ প্রাণীদের মত আাঠালো। ইহারা স্পঞ্জের জ্ঞাতি হইলেও ঠিক স্পঞ্জ্ নয়। প্রকৃত স্পঞ্জ্-প্রাণী আমাদের দেশের জলাশয়ে জন্মে না, নিকটের সমুদ্রেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। কাজেই তোমরা এদেশে জীবন্ত স্পঞ্জ্-প্রাণী দেখিতে পাইবে না। এই কারণে এই প্রাণীদের সকল কথা তোমাদিগকে বলিলাম না। সকল স্পঞ্জ্-প্রাণীই যে রবারের মত ঘর প্রস্তুত করে তাহা নয়। সমুদ্রের জল হইতে চূণ টানিয়া লইয়া ইহাদের কয়েক জাতি পাথরের মত শক্ত ঘর নির্ম্মাণ করে। এই সকল ঘরের উপরে ছুঁচের মত কাঁটা বাহির করা থাকে বলিয়া কোনো প্রাণীই কাছে ঘেঁষিতে পারে না।
যাহা হউক, স্পঞ্জ্-প্রাণীদের যে সকল কথা শুনিলে, তাহা হইতে বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ, ইহারা প্রথম শাখার এক-কোষ প্রাণীদের চেয়ে অনেক উন্নত। ইহাদের বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাই সত্য, কিন্তু তথাপি শরীর এক-কোষ প্রাণীদের মত নয়। ইহাদের দেহের কতকগুলি কোষ শুঁয়োর আকার পাইয়া খাদ্য সংগ্রহ করে। আবার কতকগুলি কোষ খাদ্য হজম করে। মানুষ, গোরু, পাখী প্রভৃতি বড় প্রাণীদের শরীরে যেমন কতকগুলি কোষ মিলিয়া পাকযন্ত্র নির্ম্মাণ করে, আবার কতকগুলি দলে দলে ভাগ হইয়া কেহ চোখ, কেহ কান এবং কেহ বা নাকের সৃষ্টি করে—ম্পঞ্জ্-প্রাণীতে আমরা তাহারি সূত্রপাত দেখিতে পাইলাম। এই জন্যই ইহাদিগকে দ্বিতীয় শাখার প্রাণীদের দলে ফেলা হইল।