কাঁকড়া
ষষ্ঠ শাখার পোকা-মাকড়দের মধ্যে যাহারা কঠিন আবরণে শরীর ঢাকিয়া রাখে, তাহাদের মধ্যে চিংড়ি মাছের পরিচয় দিলাম। এখন ইহাদের জাত-ভাই আর একটি কঠিন-আবরণের প্রাণীর কথা বলিয়া এই শ্রেণীর প্রাণীদের কথা শেষ করিব।
কাঁকড়া তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ, হয় ত তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ ইহা খাইয়াছ। কাঁকড়া কঠিনবর্ম্মী চিংড়ির জাত-ভাই এবং প্রজাপতি আরসুলার ন্যায় ষষ্ঠ শাখার প্রাণী।
তোমরা হয় ত এই কথাটা শুনিয়া আশ্চর্য্য হইতেছ। ষষ্ঠ শাখার প্রাণীর দেহে যে আংটির মত কঠিন অংশ জোড়া থাকে, তাহা কাঁকড়ার দেহে কোথায়?
তোমরা যদি একটা মরা কাঁকড়া চিৎ করাইয়া তাহার দেহের তলাকার অবস্থাটা পরীক্ষা করিয়া দেখ, তবে স্পষ্ট জানিতে পারিবে যে, চিংড়ির মত ইহারও শরীর অনেক ছোট অংশ দিয়া প্রস্তুত। কেবল ইহাই নয়; চিংড়ির শরীর যেমন মাথা ও লেজ এই দুই মোটামুটি ভাগে ভাগ করা থাকে, ইহাদের দেহও ঠিক সেই রকম দুই ভাগে ভাগ করা আছে।
আমরা যাহাকে কাঁকড়ার দেহ বলিয়া জানি, তাহা উহার মাথা। কাঁকড়ার লেজ খুব ছোট এবং পাত্লা। ইহা কাঁকড়ারা বেশ ভালো করিয়া গুটাইয়া শরীরের তলায় রাথিয়া দেয়। তোমরা মরা কাঁকড়া লইয়া পরীক্ষা করিয়ো, দেখিবে, একটা পাত্লা চওড়া পাতের মত জিনিস দেহের তলাকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে। ইহাই কাঁকড়াদের লেজ। চিংড়ির লেজে অনেক মাংস থাকে, কাঁকড়ার লেজে তাহা থাকে না। এই জন্য খাবার জন্য কাঁকড়া কুটিবার সময়ে পেটের তলায় লুকানো লেজটা ফেলিয়া দেওয়া হয়।
কাঁকড়ার মাথা বাদামি রঙের বেশ মোটা খোলার ভিতরে লুকানো থাকে। ইহাদের দশখানি করিয়া পা থাকে, কিন্তু সেগুলির মধ্যে সম্মুখের পা দুখানিই খুব মোটা ও তাহার আগায় সাঁড়াশির মত ধারালো ও শক্ত আঙুলের মত অংশ থাকে।
এখানে কাঁকড়ার একখানি ছবি দিলাম। দেখ,—অন্য পায়ের তুলনায় সম্মুখের পা দুখানি কত মোটা। ইহাই কাঁকড়াদের আহার-সংগ্রহ ও আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্র।
মাছ, শামুক, গুগ্লি, পোকা-মাকড় সকলি কাঁকড়াদের খাদ্য, সম্মুখের দুটা পা অর্থাৎ দাড়া দিয়া ইহারা শিকারকে এমন আক্রমণ করে যে, তাহারা কোনোক্রমে পালাইতে পারে না। শামুকের গায়ের খোলা উহারা দাড়া দিয়া মড়্মড়্ করিয়া ভাঙিয়া ফেলিতে পারে।
নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধাইয়া পরস্পর খাওয়া-খায়ি করার স্বভাব ইহাদের আছে। লড়াইয়ে যদি দুচারখানি পা ভাঙিয়া যায়, তবে ইহারা তাহা গ্রাহ্যই করে না। পা খসিয়া গেলে শূন্য স্থানে আপনা হইতেই নূতন পা গজাইয়া উঠে।
জলের বাতাস হইতে অক্সিজেন টানিয়া লইবার জন্য চিংড়িদের শরীরে যেমন কান্কো থাকে, ইহাদের দেহেও ঠিক সেই রকমের কান্কো আছে। ইহার সাহায্যেই তাহারা রক্তের সহিত অক্সিজেন মিশায়।
কাঁকড়া যে কেবল জলেই থাকে, তাহা নয়। খাবারের সন্ধানে কয়েক জাতি কাঁকড়া জল হইতে উঠিয়া ডাঙায় ঘুরিয়া বেড়ায়। আমাদের দেশে বর্ষাকালে মাঠে-ঘাটে এই রকম কাঁকড়া অনেক দেখা যায়। ডাঙায় বেড়াইবার সময়েও উহারা কান্কো দিয়া অক্সিজেন মিশায়। যে-রকমে এই কাজটি করে, তাহা বড় মজার। ইহারা ফন্দি করিয়া গায়ের খোলার ভিতরে অনেকটা জল আট্কাইয়া ডাঙায় উঠে। ডাঙায় বেড়াইবার সময়ে ঐ জলে যে অক্সিজেন মিশানো থাকে, তাহা টানিয়াই ইহারা বেশ আরামে থাকে। জলের অক্সিজেন যখন ফুরাইয়া যায়, তখন তাড়াতাড়ি জলে নামিয়া ইহারা খারাপ জল ফেলিয়া দিয়া নূতন ভালো জল খোলার ভিতরে আটক করে। এই রকমে জলে এবং স্থলে ইহার বেশ সুখেই চলা-ফেরা করে।
কাঁকড়াদের স্নায়ুমণ্ডলী চোখ মুখ কান সকলি চিংড়িদের মত। ইহারা যে মুখে খায় তাহা দেহের নীচে থাকে, হঠাৎ দেখিলে যেন মনে হয়, পেটের নীচেই মুখের গর্ত্ত রহিয়াছে। কিন্তু তাহা নয়। কাঁকড়ার যে অংশ খোলায় ঢাকা থাকে, তাহা উহাদের মাথা। চিংড়িদের মত ইহাদের মথোর নীচে মুখ আছে।
কাঁকড়ারা যে-সকল খাবার খায়, তাহা চোয়াল দিয়া ভালো করিয়া চিবানো যায় না। এইজহ্য ইহাদের পেটের ভিতরে এক জোড়া ধারালো দাঁত থাকে। ঐ দাঁতে খাবার যেমন পিষিয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে উহা তেমনি হজমও হইয়া যায়। যাহার পেটের ভিতরে দাঁত, সে কি রকম রাক্ষুসে প্রাণী একবার ভাবিয়া দেখ!
ডিম হইতে বাহির হইয়া কাঁকড়ার বাচ্চা ক্রমে যে-রকমে সম্পূর্ণ কাঁকড়ার আকার পায় তাহা বড় মজার। ডিম হইতে বাহির হওয়ার পর ইহারা যে-রকমে চেহারা বদ্লায় পর-পৃষ্ঠায় তাহার ছবি দিলাম। প্রথম ছবিটিতে তোমরা কাঁকড়ার ডিম হইতে বাহির হওয়ায় ঠিক পরের অবস্থা দেখিতে পাইবে। এই অবস্থায় চিংড়ির মত কাঁকড়ার লেজ থাকে। তখন ইহারা মাছের মত জলে সাঁতার দিয়া বেড়ায় এবং এই সময়ে ইহারা তাড়াতাড়ি এত বড় হয় যে, সাত আট দিনের মধ্যে তিন চারিবার খোলা বদ্লাইতে হয়। কিন্তু বেশ বড় হইলে কাঁকড়ার চেহারা আর আর প্রথম ছবির মত থাকে না। এই সময়ে উহাদিগকে দ্বিতীয় ছবির মত দেখিতে পাইবে। তখন উহাদের গায়ে বেশ শক্ত খোলা হয়, দাড়া ও পা কয়েকটিও গজাইয়া উঠে; কিন্তু লেজ লুকাইয়া রাখিতে পারে না। এই অবস্থাতেও উহারা জলে সাঁতার কাটিয়া বেড়ায় এবং বেশি পরিশ্রম হইলে কখনো কখনো জলের ভিতরকার শেওলাতে স্থির হইয়া থাকিয়া বিশ্রাম করে। ইহার পরে তিন চারিবার খোলা বদ্লাইয়া তাহারা ১৩৭ পৃষ্ঠার ছবির মত কাঁকড়ার প্রকৃত চেহারা পায়। এই সময়ে লেজটাকে গুটাইয়া এমনি করিয়া পেটের তলায় লুকাইয়া রাখে যে, কোনো কালে যে উহাদের লেজ ছিল তাহা বুঝাই যায় না।
এই রকমের নিজেদের ঠিক চেহারাখানা পাইলে, কাঁকড়ারা আর জলে ভাসিয়া বেড়াইতে পারে না। তখন ইহারা জলের তলায় বা জলের ধারে গর্ত্ত করিয়া বাস করিতে আরম্ভ করে।
এই অবস্থাতেও কাঁকড়া বৎসরে তিন-চারি বার গায়ের খোলা বদ্লায়। শেষে যখন খুব বড় হইয়া পড়ে, তখন তাহাদের বৎসরে এক বারের বেশি খোলা ছাড়া দরকার হয় না।
কাঁকড়ারা যেমন মাছ গুগ্লি প্রভৃতি দুর্ব্বল ও ছোট প্রাণীর শত্রু, তেমনি কাঁকড়াদেরও শত্রুর অভাব নাই। আমাদের খাল বিল পুকুরের ধারে গর্ত্তে যে সকল কাঁকড়া থাকে শেয়াল তাহাদের পরম শত্রু। সম্মুখে পাইলে ইহারা খোলা সুদ্ধ কাঁকড়া চিবাইয়া খাইয়া ফেলে। শেয়ালেরা ভারি ধূর্ত্ত প্রাণী; ইহাদের মত ফন্দি করিয়া কোনো প্রাণীই চলিতে পারে না। গর্ত্তের উপরে কাঁকড়া না পাইলে ইহারা গর্ত্তের ভিতরে নিজেদের লেজ ধীরে ধীরে প্রবেশ করাইয়া দেয়। কাঁকড়ারা বিরক্ত হইয়া দাঁড়া দিয়া শেয়ালের লেজ চাপিয়া ধরে। তার পরে শেয়াল তাড়াতাড়ি গর্ত্ত হইতে লেজ টানিয়া লইয়া লেজের গায়ের কাঁকড়াগুলিকে আনন্দে খাইতে আরম্ভ করে।