মাছি
মাছি কত রকমের আছে, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়। কোনোটার চোখ লাল, কোনোটার চোখ মেটে রঙের। কাহারো গায়ের রঙ্ সবুজ, কাহারো বা নীল। কেহ খাবারের উপরে বসিয়া খাবার শুষিয়া খায়, কেহ গোরু ঘোড়া ও কুকুরের গায়ে বসিয়া রক্ত টানিয়া লয়। এত রকম মাছির সবগুলিরই যদি পরিচয় দিতে হয়, তবে মাছির বিবরণ দিয়াই একখানা প্রকাণ্ড বই লেখার দরকার হইয়া পড়ে। আমরা তোমাদিগকে কেবল কয়েক জাতি সাধারণ মাছির জীবনের কথা বলিব।
গ্রীষ্মকালে ক্রমাগত ভন্ ভন্ শব্দ করিয়া যে মাছিরা আমাদের জ্বালাতন করে, তাহাদিগকে তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। তাড়াইলে একটু দূরে পালায়, কিন্তু আবার তখনি ফিরিয়া গায়ের ঘাম চাটিয়া খাইতে সুরু করে।
এখানে একটা মাছির মুখের ছবি দিলাম। দেখ, মাথার দুই ধারে চোখ দুটা কত বড়। একএকটা চোখে দুই হাজার ছোট চোখ আছে। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, এই মাছিদের প্রত্যেকটিরই চারি হাজারটা চোখ আছে। কোন্ মাছি স্ত্রী এবং কোন্ মাছি পুরুষ তাহা চোখ দেখিয়া বুঝা যায়। স্ত্রী-মাছির চোখ দুটি প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো থাকে। কিন্তু পুরুষদের তাহা থাকে না, ইহাদের চোখ দুটার মধ্যে বেশ একটু ফাঁক্ দেখা যায়।
মাছিদের ডানা কেমন পাত্লা, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। উড়িবার সময়ে ইহারা ডানাগুলিকে এমন ঘন ঘন নাড়া দেয় যে, তাহাতে ভন্ ভন্ শব্দ বাহির হয়। মাছির মুখ দিয়া শব্দ করে না। ইহাদের পা কয়েকটি বড় মজার। বিড়ালের পায়ের তলায় যেমন উঁচু মাংসপিণ্ড থাকে, ইহাদের পায়ের নীচে সেই রকম দুটি উঁচু অংশ দেখা যায়। সেগুলি ছোট ছোট লোমে ঢাকা থাকে। মাছিরা যখন দেওয়ালের গায়ে পা লাগাইয়া হাঁটিয়া বেড়ায়, তখন ঐ-সকল লোম হইতে আঠার মত এক রকম জিনিস বাহির হইতে আরম্ভ করে। ইহা পা-গুলিকে দেওয়ালের গায়ে আট্কাইয়া রাখে।
মাছির ডিম বোধ হয় তোমরা দেখ নাই, ডিমের রঙ্ প্রায় সাদা হয়। মাছিরা সাধারণত পচা গোবর, আবর্জ্জনা বা মরা প্রাণীর পচা দেহে ডিম পাড়ে। এই-সকল ডিম হইতে দুই এক দিনের মধ্যে, কখনো-বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুঁয়ো-পোকার মত বাচ্চা বাহির হয়। পায়খানার ময়লা বা মরা ইঁদুর-বেড়ালের গায়ে তোমরা হয় ত এই রকম মুড়ি-মুড়ি পোকা দেখিয়া থাকিবে। ইহাদের চোখ কান ও পা কিছুই থাকে না, এবং গায়ে শুঁয়োও থাকে না। কেঁচোদের মত বুকে হাঁটিয়া ইহারা চলা-ফেরা করে। যে-সকল বিশ্রী জিনিসের মধ্যে মাছির বাচ্চারা জন্মে সেই-সকল জিনিস খাইয়াই উহারা বড় হয়। কাজেই দেখা যাইতেছে, মাছিরা সংসারের কোনো উপকার না করিলেও, তাহাদের বাচ্চারা দুর্গন্ধ ও ময়লা জিনিস খাইয়া আমাদের কতকটা উপকার করে।
যাহা হউক, পচা জিনিস খাইয়া মাছির বাচ্চারা বড় হইলে ইহারা পুত্তলি-অবস্থায় মাটির তলায় চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে। আগেই বলিয়াছি, পুত্তলি-অবস্থায় থাকিবার জন্য ইহারা গায়ের উপরে বিশেষ কোনো আবরণ উৎপন্ন করে না। তখন গায়ের চামড়াই শক্ত হইয়া দাঁড়ায়। ডানা চোখ ইত্যাদি গজাইয়া উঠিলেই বাচ্চারা সেই আবরণ ছিঁড়িয়া সম্পূর্ণ মাছির আকারে বাহির হইয়া পড়ে। তার পরে ইহারা যে কি উৎপাতটাই করে, তাহা তোমরা সকলেই জান।
মাছিদের সকল উৎপাত সহ্য করা যায়, কিন্তু ইহারা আমাদের রান্নাঘরে ও খাবারের ঘরে ঢুকিয়া সময়ে সময়ে যে অনিষ্ট করে, তাহা অতি ভয়ানক। নোংরা জায়গায় ঘুরিয়া বেড়ানো এবং নোংরা জিনিস খাওয়াই ইহাদের কাজ। গায়ে ও শুঁয়োতে ইহাদের যে-সকল লোম থাকে, তাহাতে নানা নোংরা জিনিস মাখাইয়া ইহারা যখন খাবারের উপরে বা গায়ের উপরে বেড়াইতে আরম্ভ করে, তখন বিশেষ ভয়ের কারণ হয়। জ্বরাতিসার, কলেরা, ডিপ্থেরিয়া ইত্যাদি অনেক রোগের বীজ পচা নর্দ্দামা ইত্যাদিতে জন্মে। মাছিরাও এই সব পচা জায়গায় বাস করে এবং ঐ-সকল রোগের বীজ পায়ে ও গায়ে মাখিয়া আমাদের খাবারের সঙ্গে মিশাইয়া দেয়। তার পরে রোগের বীজ-মিশানো খাবার খাইলেই লোকে প্রায়ই ঐ-সকল রোগে আক্রান্ত হয়।
রান্নাঘরে যাহাতে মাছি না যাইতে পারে এবং তৈয়ারি খাবারের উপরে যাহাতে তাহার না বসিতে পারে, তোমরা তাহার উপরে নজর রাখিয়ো। দোকানের খাবারের উপরে যে কত রকম-বেরকম মাছি বসে, তাহার হিসাবই হয় না। এই সকল খাবার খাওয়া কখনই উচিত নয়।
কাঁটালে-মাছি
আষাঢ় মাসে কাঁটাল ভাঙ্গিলে ভন্ ভন্ শব্দ করিয়া যে, বড় বড় নীল রঙের মাছি আসিয়া জমা হয়, তাহা বোধ হয়, তোমরা দেখিয়াছ। কাঁটাল যদি পচা হয়, তাহা হইলে আর রক্ষা থাকে না। এই রকম মাছি তখন ঝাঁকে ঝাঁকে আসিয়া পচা কাঁটাল প্রায় ঢাকিয়া ফেলে। আমরা এই মাছিদেরই কাঁটালে-মাছি বলিতেছি। ইংরাজিতে ইহাদিগকে (Blue Bottles) বলে।
কাঁটালে-মাছির জীবনের ইতিহাস সাধারণ মাছিদের তুলনায় কিছু স্বতন্ত্র। সাধারণ মাছিরা প্রথমে ডিম পাড়ে। তার পরে সেই ডিম ফুটিয়া বাচ্চা বাহির হয়। কিন্তু কাঁটালে-মাছিরা ডিম পাড়ে না; একবারে ছোট ছোট শুঁয়ো-পোকার আকারের বাচ্চা প্রসব করে। পতঙ্গমাত্রেই ডিম প্রসব করে, কিন্তু ইহারা পতঙ্গ হইয়াও ডিম পাড়ে না,—ইহা খুব অদ্ভুত নয় কি? এই অদ্ভুত ব্যাপার সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা যাহা বলেন তাহাও আশ্চর্য্যজনক। তাঁহারা বলেন, এই মাছিদের ডিম পেটের ভিতরে ফুটিয়া যায়। তার পরে পেটে থাকিয়া বাচ্চারা যখন একটু বড় হয়, তখন মাছিরা সেই বাচ্চা প্রসব করে। অর্থাৎ পেটের ভিতরেই ডিম ফুটাইয়া হাঁসেরা যদি প্রতিদিনই এক একটা ছানা প্রসব করিত, তাহা হইলে ব্যাপারটা যেমন অদ্ভুত হইত, কাঁটালে-মাছির বাচ্চা প্রসব করা কতকটা সেই রকমই আশ্চর্য্য ব্যাপার। এই মাছিরা এক-একবারে পাঁচ-ছয় শত বাচ্চা প্রসব করে, কিন্তু সাধারণ মাছিরা দেড়-শত বা দুই-শতের বেশি ডিম পাড়ে না।
কেবল কাঁটালে-মাছিই যে এই রকমে বাচ্চা প্রসব করে, তাহা নয়। সাধারণ মাছিদের চেয়ে বড় একটু লম্বা আকারের কয়েক জাতি মাছিকেও বাচ্চা প্রসব করিতে দেখা যায়। কসাইখানার মাংসের উপরে বা পায়খানার ময়লায় যে বড় মাছিরা ভন্ ভন্ করিয়া উড়িয়া বেড়ায়, তাহাদের মধ্যেও অনেকে একবারে গোটা গোটা বাচ্চা প্রসব করে।
কুকুরে-মাছি
কুকুরের গায়ের মাছি তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। ইহাদের চেহারা যেন গোলাকার, কতকটা কাঁক্ড়ার আকৃতির মত। গোরুর গায়েও এই রকম মাছি অনেক বসিয়া থাকিতে দেখা যায়।
কুকুরে-মাছির জীবন বড়ই অদ্ভুত। ইহারা ডিম পাড়ে না এবং বাচ্চাও প্রসব করে না। পেটের ভিতরেই ডিম ফোটে। তার পরে মায়ের পেটের খাদ্য খাইয়া বাচ্চারা পেটের ভিতরেই বড় হয় এবং সেখানেই পুত্তলি-অবস্থা পায়। কুকুরে-মাছিরা এই পুত্তলি-সন্তানদিগকেই প্রসব করে। সাধারণ মাছিরা পচা জায়গায় ডিম পাড়ে, কারণ ডিম ফুটিলে যে বাচ্চা হয়, তাহা পচা জিনিসই খায়। কুকুরে-মাছিরা পুত্তলি বাচ্চা প্রসব করে; পুত্তলিরা কিছুই খায় না; খোলসের ভিতরে মড়ার মত পড়িয়া থাকে। এজন্য কুকুরে-মাছিরা পুত্তলি বাচ্চা পচা জায়গায় প্রসব করে না। প্রায়ই শুক্নো ধূলামাটির বা আবর্জ্জনার মধ্যে ইহাদিগকে দেখা যায়। গোরু কুকুর প্রভৃতির রক্তই এই মাছিদের প্রধান খাদ্য।
কেবল কুকুরে-মাছিই যে গোরুর উপরে অত্যাচার করে, তাহা নয়। একজাতীয় মাছি গোরুর গায়ে ঘা করিয়া ভয়ানক উৎপাত করে। কেবল গোরু নয়, ঘোড়া ভেড়া ইত্যাদিও ইহাদের হাত হইতে উদ্ধার পায় না।
এই মাছিরা গোরু বা ঘোড়ার গায়ে ডিম পাড়ে। সেগুলি কয়েক দিন গায়ের লোমে জড়াইয়া থাকিয়া ফুটিয়া উঠিলে ছোট বাচ্চা বাহির হয়। গোরুরা কি-রকমে নিজেদের গা চাটে তাহা তোমরা দেখিয়াছ। গায়ে মাছির বাচ্চা বেড়াইতে আরম্ভ করিলে, তাহারা বাচ্চাগুলিকে গা হইতে চাটিয়া গিলিয়া ফেলে। মাছির বাচ্চার মুখে যে বাঁকানো বঁড়শি থাকে, তাহার কথা তোমরা আগেই শুনিয়াছ। গোরুর মুখের ভিতরে গেলেও এই বাচ্চাদের সকলগুলি পেটে গিয়া পৌঁছে না; তাহাদের মধ্যে অনেকগুলিই বাঁকানো বঁড়শি দিয়া গোরুর গলার নালী কাম্ড়াইয়া পড়িয়া থাকে এবং ক্রমে গলার মাংস কাটিয়া সেখানে বাসা বাঁধে। এই রকমে আশ্রয় পাইয়া বেশ বড় হইয়া দাঁড়াইলে, বাচ্চারা গলার নালীর মধ্যে থাকিতে চায় না। তখন তাহারা বাহিরে আসে এবং গোরুর পিঠের চামড়া কাটিয়া নূতন ঘর বনায়। এই রকমে পোকারা চামড়ার নীচে প্রবেশ করিলে, গোরুর গায়ের সেই জায়গাটা ফুলিয়া উঠে এবং তাহার অসুখ করে।
বাতাসের অক্সিজেন্ না পাইলে কোনো প্রাণীই বাঁচে না। মাছির বাচ্চারা যখন গোরুর পিঠের ঘায়ে বাস করে, তখন তাহাদেরো বাতাসের দরকার হয়। এই জন্য ইহারা কখনই ঘায়ের মুখ বন্ধ হইতে দেয় না। গোরুর গায়ের চাম্ড়া গোলাকারে কাটিয়া ঘা খোলা রাখে এবং বাতাস হইতে অক্সিজেন টানিতে থাকে।
যাহা হউক, ঘায়ে থাকিয়া বেশ বড় হইয়া পড়িলে, পোকাগুলি আর সেখানে থাকিতে চায় না। তখন ধীরে ধীরে ঘা হইতে বাহির হইয়া কোনো নিরিবিলি জায়গায় পুত্তলি-অবস্থায় পড়িয়া থাকে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডানাওয়ালা মাছির আকারে উড়িতে আরম্ভ করে। এই মাছিরা গোরুদের কি-প্রকার শত্রু একবার ভাবিয়া দেখ! ইহাদের উৎপাতে আমাদের দেশের গোরুগুলা জখম হইয়া যায়।
কাঁটালে-মাছিরাও গোরুর কম শত্রু নয়। গায়ের কোনো জায়গায় একটু ঘা দেখিলেই তাহারা ঘায়ে বসিয়া বাচ্চা প্রসব করিতে থাকে। পরে সেই সকল বাচ্চা ঘায়ের পচা মাংস খাইয়া বড় হইলে ঘা বাড়িয়া উঠে এবং শেষে গোরু মারা পড়ে।
ডাঁশ-মাছি
ডাঁশ মাছি তোমরা দেখ নাই কি? ইহাদের আকৃতি সাধারণ মাছিদেরই মত, কেবল আকারে একটু বড়। গোরু ঘোড়া ছাগল, এমন কি মানুষের গায়ে বসিয়াও ইহারা রক্ত শুষিয়া খায়। গোয়ালের গোরুদের উপরে ইহাদের উৎপাত বড়ই বেশি। তাই দুই বেলা খড় জ্বালাইয়া গোয়ালে ধোঁয়া দিতে হয়, ইহাতে ডাঁশ পালাইয়া যায়। স্ত্রী-ডাঁশেরাই রক্ত খায়। পুরুষেরা গাছে ফুল-ফলের রস খাইয়া বেড়ায়।
কোনো রোগীর রক্ত সুস্থ লোকের রক্তের সহিত মিশিলে, সুস্থ ব্যক্তি রোগী হইয়া দাঁড়ায়। ডাঁশেরা রোগা গোরুর রক্তের বিষ সুস্থ গোরুর রক্তে মিশাইয়া বড়ই অনিষ্ট করে। ইহাতে অনেক সুস্থ গোরুর দেহে রোগ দেখা দেয়। আমাদের যেমন বসন্ত, হাম, প্লেগ প্রভৃতি ছোঁয়াচে ব্যারাম আছে, গোরুদেরও সেই রকম অনেক ব্যারাম আছে। ডাঁশেরাই এই সব ব্যারাম গোরুদের মধ্যে ছড়ায়।
ডাঁশ-মাছিরা কখনই শুক্নো জায়গায় ডিম পাড়ে না। পুকুর বা ডোবার ধারে লতাপাতার গায়ে ইহাদের ডিম দেখা যায়। তার পরে সেই সকল ডিম হইতে শুঁয়ো-পোকার আকারের বাচ্চা বাহির হইলে, সেগুলি পুকুরের ধারের ভিজা মাটি বা কাদায় আশ্রয় লয়। পুকুরের পচা কাদায় ছোট পোকা-মাকড়ের অভাব নাই ডাঁশের বাচ্চারা সেই সকল পোকা-মাকড় খাইয়া বড় হয়। শেষে পুত্তলি-অবস্থায় থাকিবার সময় হইলে উহারা আর কাদায় থাকে না। তখন বুকে হাঁটিয়া পুকুর হইতে একটু দূরে কোনো শুক্নো জায়গায় মাটির তলায় আশ্রয় লয়, এবং সেখানে বেশ নিশ্চিন্ত হইয়া গা ঢাকা দিয়া ঘুমায়। তার পরে ডানা পা ইত্যাদি গজাইলে, ইহারা ভোঁ করিয়া উড়িয়া রক্ত খাইবার চেষ্টায় বাহির হইয়া পড়ে।