কুমরে-পোকা
ইহারাও বোল্তা ও ভীমরুলের মত প্রাণী। আকারে ছোট হইলেও ইহাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক বোল্তাদেরি মত। এখানে কুমরে-পোকার একটা ছবি দিলাম। দেখ, বোল্তার চেয়ে ইহার মাজা কত সরু এবং পা-কয়েকখানি কত লম্বা।
বোল্তার মত ইহারা দল বাঁধিয়া চাকে বাস করে না। এক একটা পোকা নিজেদের বাচ্চাদের জন্য পৃথক্ পৃথক্ ঘর তৈয়ারি করে।
কুমরে-পোকার ঘর তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। দেওয়ালের গায়ে, দরজা, জানালা ও কপাটের উপরে, ইহারা মাটি দিয়া ঘর তৈয়ার করে। আলমারিতে বই সাজাইয়া রাখিলে কখনো কখনো বইয়ের গায়ে বা কাগজের উপরেও ইহারা মাটির ঘর প্রস্তুত করে।
বোল্তাদের মত ইহাদের কতকগুলি স্ত্রী এবং কতকগুলি পুরুষ হইয়া জন্মে। কিন্তু স্ত্রী-পোকারাই ঘর তৈয়ার করে। তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, বাস করিবার জন্য ইহারা ঘর বানায়। কিন্তু তাহা নয়; বাচ্চাদের জন্যই ইহারা ঘর তৈয়ার করে।
গ্রীষ্মের সময়ে কুমরে-পোকা বেশি দেখা যায়। এই সময়ে একটু নজর রাখিলেই তোমরা ঘরের কোণে, ছাদের কড়ি-কাঠের কাছে বা টেবিলের নীচে ইহাদিগকে ভন্-ভন্ করিয়া উড়িতে দেখিবে। ইহারা সময়ে সময়ে মুখের কাছে বার বার ঘুরিয়া বড়ই বিরক্ত করে। আমরা ঘর-বাড়ী প্রস্তুত করিবার সময়ে যেমন খুঁজিয়া পাতিয়া ভালো জায়গা বাছিয়া লই, ইহারাও এই রকমে উড়িয়া উড়িয়া বাসার উপযুক্ত জায়গা ঠিক্ করে।
সকল কুমরে-পোকা এক রকম নয়; নানা রকমের কুমরে-পোকা দেখা যায়। ইহাদের প্রত্যেকের দেহের আকৃতি ও ঘরের আকৃতি পৃথক্। আমাদের ঘরে দুয়ারে সর্ব্বদা যে পোকা বাস করে, তাহাদের অনেকেরই সর্ব্বাঙ্গের রঙ্ গাঢ় বাদামী এবং কেবল মুখখানি হল্দে দেখা যায়।
যাহা হউক, বাসা করিবার জায়গা ঠিক্ হইলেই, ইহারা বিলম্ব না করিয়া কাজে লাগিয়া যায়। কাদাই ইহাদের ঘরের একমাত্র মাল-মসলা। কাছাকাছি কোনো জায়গায় ইহারা মুখের লালা দিয়া কাদা তৈয়ারি করে। তার পরে তাহা সম্মুখের দুখানি পায়ে আট্কাইয়া বাসার জায়গায় বহিয়া আনে। আমরা ঘর প্রস্তুত করিবার সময়ে কত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি। কুমরে-পোকাদের কেবল পা ও মুখই যন্ত্রের কাজ করে। পিছনের চারিখানি লম্বা পা ও মুখের শক্ত ধারালো দাঁত দিয়া তাহারা কাদা বিছাইয়া শীঘ্রই ঘরের ভিত পত্তন করে। তার পরে, ক্রমাগত কাদা বহিয়া আনিয়া চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে একটা গোলাকার গলা-সরু ঘর তৈয়ার করিয়া ফেলে। কুমরে-পোকার ছবিতে উহাদের গলা-সরু ঘরের ছবিও দেখিতে পাইবে।
ঘর প্রস্তুতের কাজে একবার লাগিয়া গেলে, যতক্ষণ কাজ শেষ না হয় ততক্ষণ ইহারা একটুও বিশ্রাম করে না। আমাদের ঘর প্রস্তুতের সময়ে কুলি-মজুরেরা ছাদ পিটাইতে পিটাইতে কত গান করে, তাহা তোমরা শুনিয়াছ। কুমরে-পোকারাও ঘর বানাইবার সময়ে অবিরাম ভন্-ভন্ শব্দ করে। ইহা দেখিয়া মনে হয়, এত পরিশ্রমের মধ্যেও তাদের যেন আনন্দ আছে।
যাহা হউক, বাসা প্রস্তুত হইলে কুমরে-পোকাদের ডিম-পাড়ার সময় উপস্থিত হয়। কিন্তু ডিম-পাড়ার সময়ে ইহারা কখনই বাসার ভিতরে যায় না; বাসার সরু গলার ফাঁকে লেজ প্রবেশ করাইয়া ডিম পাড়ার কাজ শেষ করে।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, বাসা প্রস্তুত ও ডিম-পাড়ার কাজ শেষ করিয়াই কুমরে-পোকারা মুক্তি পায়। কিন্তু তাহা নয়। বাচ্চারা ডিম হইতে বাহির হইয়া কি খাইবে, তাহার যোগাড় করিবার জন্য পোকারা এই সময়ে ব্যস্ত হইয়া পড়ে। ছোট ছোট নরম শুঁয়ো-পোকা ইহাদের প্রিয় খাদ্য। তাই কুমরে-পোকারা ডিম পাড়িয়া শুঁয়ো-পোকার সন্ধানে ভোঁ ভোঁ করিয়া নিকটের বন-জঙ্গলে বা বাগানের ঝোপ্-ঝাপে ঘুরিয়া বেড়ায়। সবুজ রঙের শুঁয়ো-পোকাগুলিকেই পাখী ও বোল্তারা পছন্দ করে; ইহা তাহাদের উপাদেয় খাদ্য। যে-সকল শুঁয়ো-পোকার গায়ে নানা রকম রঙ্ থাকে বা লম্বা লম্বা শুঁয়ো লাগানো থাকে, সেগুলি বড়ই বিস্বাদ ও বিষাক্ত। কোনো প্রাণীই এইগুলিকে ছোঁয় না। এইজন্য সবুজ পোকা খুঁজিয়া বাহির করিতে কুমরে-পোকাদের অনেকটা সময় কাটিয়া যায়। কিন্তু ভালো পোকা পাইলে, তাহারা তখনি উহা বুকের তলায় লুকাইয়া রাখিয়া বাসায় হাজির হয় এবং পোকাটিকে জীবন্ত অবস্থায় বাসার মধ্যে রাখিয়া দেয়।
জীবন্ত পোকাকে কোনো জায়গায় আট্কাইয়া রাখা বড় দায়। সুবিধা পাইলেই তাহারা পলাইয়া যায়। কুমরে-পোকারা যে উপায়ে তাহাদের ঐ শিকারগুলিকে জীবন্ত অবস্থায় বাসায় আট্কাইয়া রাখে, তাহা বড় আশ্চর্য্যজনক। প্রাণিদেহে যে স্নায়ু-মণ্ডলী থাকে তাহা দিয়া কি কাজ হয়, সে কথা তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি। স্নায়ু-মণ্ডলী দিয়াই প্রাণীরা ইচ্ছামত হাত, পা, মুখ, চোখ নড়াইতে পারে এবং আরাম ও বেদনা বোধ করিতে পারে। পতঙ্গদের দেহের তলা দিয়া এক জোড়া স্নায়ুর সূতা মাথা হইতে লেজ পর্য্যন্ত বিস্তৃত থাকে এবং প্রত্যেক সূতা হইতে কয়েকটি শাখা বাহির হইয়া দেহের ডাইনে ও বামে গাঁইটের মত জটলা পাকায়। এই গাঁটগুলি ছোট ছোট স্নায়ু-কেন্দ্র। ইহা প্রাণীর মস্তিষ্কের মত ভিন্ন ভিন্ন অংশে হুকুম চালায়। কুমরে-পোকারা এমন দুষ্ট যে, বাচ্চাদের জন্য শুঁয়ো-পোকা ধরিয়া উহাদের স্নায়ু-কেন্দ্রে হুল ফুটাইয়া দেয়। ইহাতে স্নায়ু-কেন্দ্রগুলি বিকল হইয়া পড়ে মাত্র, কিন্তু পোকারা প্রাণে মরে না। পক্ষাঘাত ব্যারামের রোগী ইচ্ছা করিলেও হাত-পা নাড়াইতে পারে না। পোকাদের অবস্থা ঠিক্ পক্ষাঘাতের রোগীর মত হয়। তাহারা কোনোক্রমে ঘরের গর্ত্ত ছাড়িয়া নড়িতে পারে না। এই রকমে কুমরে-পোকারা নিজেদের বাসার মধ্যে শুঁয়ো-পোকা রাখিয়া বেশ নিশ্চিন্ত থাকে এবং একটা পোকাকে বাসায় রাখিয়া আবার নূতন পোকা ধরিবার জন্য ছুটিয়া বাহির হয়। এই রকমে পাঁচ-ছয়টা পোকা বাসার গর্ত্তে জমা হইলে, তাহারা বাসার সেই সরু মুখটা কাদা দিয়া বন্ধ করিয়া ফেলে। এই রকমে একটা ঘরের কাজ শেষ হইয়া যায়। দরকার হইলে কুমরে-পোকারা ইহারি উপরে বা পাশে আরো ঘর প্রস্তুত করিয়া তাহাতে ঐ রকমে ডিম ও বাচ্চার খাবার বোঝাই করিতে থাকে; কিন্তু ইহারা এক ঘরে একটির বেশি ডিম পাড়ে না।
বোল্তারা বাচ্চাদিগকে কত যত্ন করিয়া পালন করে তাহা তোমরা আগে শুনিয়াছ। কিন্তু কুমরে-পোকারা ডিমের পাশে বাচ্চাদের খাইবার পোকা রাখিয়াই কর্ত্তব্য শেষ করে। ডিম ফুটিয়া বাচ্চা বাহির হইল কি না এবং তাহারা রীতিমত খাওয়া-দাওয়া করিতেছে কি না, কুমরে-পােকারা তাহার একটুও খবর হয় না।
যাহা হউক, সাত-আট দিনের মধ্যে ডিম ফুটিয়া বােল্তার বাচ্চার মত কুমরে-পােকার বাচ্চা বাহির হয়। সম্মুখে পাঁচ-সাতটা তাজা পােকা আট্কানো থাকে, জন্মিয়াই তাহারা সেই পােকা খাইতে আরম্ভ করে এবং কয়েক দিনের মধ্যে খুব মােটা হইয়া উঠে। তার পরে সাত-আট দিন পুত্তলির অবস্থায় মড়ার মত থাকিয়া তাহারা পা, ডানা ও মুখওয়ালা সম্পূর্ণ পতঙ্গ হইয়া দাঁড়ায়।
সম্পূর্ণ আকার পাইলে কুমরে-পােকারা আর সেই ছােট ঘরের অন্ধকারে আটক্ থাকিতে চায় না। দাঁত ও পা দিয়া বাসার দেওয়ালে ছিদ্র করিয়া বাহির হইয়া পড়ে। ইহাই সাধারণ কুমরে-পােকাদের ঘর-বাড়ীর ও জীবনের কথা।