জোনাক পোকা
জোনাক পোকা তোমরা সকলেই দেখিয়াছ। খুব শুক্নো জায়গায় ইহাদিগকে বেশি দেখা যায় না। বর্ষার শেষে জলা জায়গায় ইহারা এক-এক সময়ে গাছপালায় এত বেশি জমা হয় যে, অন্ধকার রাত্রিতে দেখিলে মনে হয়, যেন গাছে আগুন লাগিয়াছে।
জোনাক পোকার চেহারা কি-রকম, তাহা বোধ হয় তোমরা সকলে ভালো করিয়া দেখ নাই। রাত্রিতে একটা পোকা ধরিয়া গ্লাস্ বা বাটি চাপা দিয়া রাখিয়ো এবং প্রাতে তাহার চেহারাটা দেখিয়ো।
জোনাক পোকা নানা রকমের দেখা যায় এবং প্রত্যেক রকম পোকার গায়ের রঙ্ পৃথক্। হল্দে, বাদামী, লাল প্রভৃতি নানা রঙের জোনাক পোকা আছে। আকারেও এগুলির মধ্যে কেহ বড় এবং কেহ বা ছোট। আমরা যে সব জোনাক পোকাকে বাগানের গাছে বা ঘরের ভিতরে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখি, এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম।
ইহাদের শরীর কতকটা লম্বা ধরণের। ছবি দেখিলেই তাহা বুঝিতে পারিবে। কঠিন-পক্ষ পতঙ্গদের শরীর যেমন হাড়ের মত শক্ত, ইহাদের দেহ কিন্তু সে-রকম নয়; দেহের আবরণ কতকটা নরম। দিনের বেলায় জোনাক পোকারা লুকাইয়া থাকে এবং সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিলে আনন্দে চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে আরম্ভ করে। গাছের নরম পাতা, ডাল ইত্যাদিই অধিকাংশ জোনাক পোকার প্রধান খাদ্য। আবার ছোট পোকা-মাকড় ধরিয়া খায়, এমন জোনাক পোকাও আছে।
জোনাক পোকাদের আলো তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। ইহা বাতির আলো, উনুনের আলো বা সূর্য্যের আলোর মত নয়। এই আলোতে যেন একটু নীল রঙ্ থাকে। আমরা বাতি জ্বালিয়া যে আলো পাই, তাহা কেবলি আলো নয়, উহার সঙ্গে তাপও মিশানো থাকে। সূর্য্যের আলো ও বিদ্যুতের আলোতেও তাপ থাকে। কিন্তু জোনাক পোকারা যে আলো দেয়, তাহা কেবলি আলো, তাহাতে একটুও তাপ মিশানো থাকে না। লেজের যে-অংশটা দপ্ দপ্ করিয়া আলো দেয়, তোমরা নির্ভয়ে তাহাতে হাত দিয়া দেখিয়ো—একটুও গরম বোধ করিতে পারিবে না।
লাল দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে এক রকম জিনিস মাখানো থাকে, তাহাকে ফস্ফরস্ বলে। ফস্ফরসের গায়ে বাতাস লাগিলেই উহা জ্বলিয়া উঠে। দেওয়ালের গায়ে লাল দিয়াশলাইয়ের কাঠি ঘসিলে দেওয়াল কি-রকম উজ্জ্বল হয়, তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ হয় ত তাহা দেখিয়াছ। জোনাক পোকার আলো কতকটা ফস্ফরসের আলোরি মত। তফাতের মধ্যে ফস্ফরসের আলোতে তাপ থাকে, জোনাকের আলোতে মোটেই তাপ থাকে না। অনেকে বলেন, জোনাক পোকার গায়ে ফস্ফরস্ আছে, তাহাই আলো দেয়। কিন্তু এই কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। ফস্ফরসের সঙ্গে জোনাক পোকার আলোর একটুও সম্বন্ধ নাই। তাপ না জন্মাইয়া ইহারা কি রকমে ঠাণ্ডা আলো জন্মায় তাহা আজো ঠিক করা যায় নাই। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদ্পিণ্ডের উঠা-নামা যেমন তালে তালে চলে, জোনাক পোকার আলোও ঠিক সেই রকমে তালে তালে দপ্ দপ্ করিয়া জ্বলিতে থাকে। ইহা দেখিয়া মনে হয়, আমরা যেমন শরীরের শক্তি ক্ষয় করিয়া শ্বাস-প্রশ্বাস ও চলা-ফেরার কাজ চালাই, জোনাক পোকারা ঠিক সেই রকমেই আলো উৎপন্ন করে। কিন্তু কোন্ প্রণালীতে দেহের শক্তি দিয়া আলো উৎপন্ন হয়, তাহা আজও জানা যায় নাই।
আমরা যখন কেরোসিন বা অন্য কোনো তেল পুড়াইয়া আলো উৎপন্ন করি, তখন তেলের সকল শক্তিই আলোর আকার পায় না; ঐ শক্তির বেশির ভাগই অনাবশ্যক তাপ জন্মাইয়া নষ্ট হইয়া যায়। জোনাক পোকারা কি-রকমে তাপ উৎপন্ন না করিয়া কেবলমাত্র আলো উৎপন্ন করে, তাহা জানা গেলে আমাদের অনেক লাভ হইবে। তখন আমরা ল্যাম্প হইতে কেবল তাপহীন আলো পাইব। কাজেই আলোর সঙ্গে সঙ্গে তাপ জন্মিয়া এখন তেলের যে বাজে খরচ করে, তখন তাহা বন্ধ হইয়া যাইবে।
জোনাক পোকা কেন শরীর হইতে আলো বাহির করে, তাহা লইয়া বড় বড় পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হইয়া গিয়াছে, কিন্তু আজও সকলে এ-সম্বন্ধে একমত হইতে পারেন নাই। আগুনকে ভয় করে। কেহ কেহ বলেন, আগুনের মত আলো বাহির করিয়া জোনাক পোকারা নিশাচর পাখী প্রভৃতি শত্রুদের ভয় দেখায়। শত্রুরা জোনাক পোকাকে আগুন মনে করিয়া কাছে ঘেঁসে না। আবার কেহ কেহ বলেন, জোনাক পোকার আলো শিকার ধরিবার ফাঁদ ভিন্ন আর কিছুই নয়। আলো দেখিলেই ছোট পোকা-মাকড় তাহা লক্ষ্য করিয়া ছুটিয়া আসে। ঘরের দরজা জানালা খুলিয়া আলো জ্বালিলে, কত পোকা আলোর কাছে জড় হয়, তোমরা তাহা দেখ নাই কি? জোনাক পোকার আলো যখন আগুনের মত দপ্ দপ্ করিয়া জ্বলিতে থাকে, তখন ছোট পোকারা আগুন মনে করিয়া কাছে ছুটিয়া আসে। জোনাক পোকারা এই সুযোগে গণ্ডায় গণ্ডায় ছোট পোকা ধরিয়া আহার করিয়া লয়। আবার এক দল লোক বলেন, এই সব কথার কোনোটাই ঠিক্ নয়। দিনের বেলায় জোনাক পোকারা যে যেখানে পারে দূরে দূরে লুকাইয়া থাকে এবং রাত্রিকালেই তাহারা এক সঙ্গে বাস করিবার সুযোগ পায়। তাই রাত্রি আসিলেই তাহারা শরীর হইতে আলো বাহির করিয়া সঙ্গীদিগকে কাছে আসিবার জন্য সঙ্কেত করে।
যাহা হউক, জোনাক পোকা বড়ই অদ্ভুত পতঙ্গ, ইহাদের জীবনের কাজ ও চলা-ফেরা বড়ই আশ্চর্য্যজনক।