পিপীলিকা
এইবার আমরা পিঁপ্ড়ের কথা বলিব। ইহারা মৌমাছি ও বোল্তার দলের প্রাণী, কিন্তু তাহাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান্। হাতী ঘোড়া বাঘ ভালুক প্রভৃতি বড় প্রাণীরা বুদ্ধি খরচ করিয়া যাহা করিতে না পারে, পিঁপ্ড়েরা তাহা করে। এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই পিঁপ্ড়ের মত বুদ্ধিমান্ নয়।
পিঁপ্ড়েরা নিজের তৈয়ারি ঘরে দল বাঁধিয়া বাস করে, দলের উন্নতির জন্য প্রাণপণে পরিশ্রম করে, নিজেদের ঘর বাড়ী ও ছেলেপিলেদের রক্ষা করিবার জন্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে। ইহাদের ভাষা নাই বটে, কিন্তু নানা রকমে মনের ভাব পরস্পরকে জানাইতে পারে। আমরা যেমন গোরু পুষিয়া তাহার দুধ খাই, ইহারাও তেমনি এক রকম পোকা পুষিয়া সেগুলির নিকট হইতে মিষ্ট খাদ্য আদায় করিয়া লয়। আবার দুই এক রকম পিঁপ্ড়ে আমাদের মত চাষ-আবাদও করে। ইহার ঘাসের ছোট বীজ মুখে করিয়া বহিয়া আনে এবং তাহা বুনিয়া শস্য উৎপন্ন করে। সুতরাং সাধারণ বুদ্ধিতে পিঁপ্ড়েরা মানুষের চেয়ে খুব কম নয়।
ভালো আতসী-কাচ দিয়া দেখিলে পিঁপ্ড়েকে যে-রকম দেখায় এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম। ছবিতে পিঁপ্ড়ের বুক ও লেজের জোড়ের জায়গায় বলের মত দুইটি পিণ্ড আছে। ইহা পিঁপ্ড়ের দেহের প্রধান চিহ্ন। কোনো কোনো পিঁপ্ড়ের দেহে ঐ-রকম একটি মাত্র পিণ্ড থাকে।
মৌমাছি ও বোল্তার মতই পিঁপ্ড়েদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ ও কর্ম্মী এই তিন জাতি আছে। স্ত্রী ও কর্ম্মী পিঁপ্ড়ের লেজের অংশটা প্রায়ই ছয় থাক্ আংটি জুড়িয়া প্রস্তুত হয়। পুরুষদের লেজে সাত থাক্ আংটি থাকে। কিন্তু ইহাদের সকলেরি ছয়খানা লম্বা পা এবং মাথায় একজোড়া শুঁয়ো থাকে। পিঁপ্ড়ের শুঁয়ো বোল্তা বা মৌমাছির শুঁয়োর মত নয়। আমাদের হাত ও পা যেমন কতকগুলি ছোট ও বড় খণ্ড খণ্ড অংশ জুড়িয়া প্রস্তুত, পিঁপ্ড়ের শুঁয়োও ঠিক সেই রকম দুইটি খণ্ড জুড়িয়া প্রস্তুত হয়। মৌমাছিদের পায়ে চিরুণীর দাঁতের মত যে-সকল কাঁটা লাগানো আছে, ইহাদের পায়েও ঠিক তাহাই দেখা যায়। গায়ে মাথায় বা শুঁয়োতে ধূলা মাটি বা অন্যান্য কোন আবর্জ্জনা লাগিলে, উহারা পায়ের চিরুণী দিয়া তাহা ঝাড়িয়া ফেলে। তোমরা যদি কিছুক্ষণ কোনো পিঁপ্ড়ের চলা-ফেরা লক্ষ্য কর, তবে দেখিবে, সে মাঝে মাঝে দাঁড়াইয়া পা দিয়া শুঁয়ো ঘসিতেছে। শরীরের ময়লা মাটি ছাড়াইবার জন্যই উহারা ঐ-রকম করে। গোরু যেমন জিভ দিয়া বাছুরের গা চাটে ও গায়ের ময়লা ছাড়াইয়া দেয়, পিঁপ্ড়েরা সেই রকমে পরস্পরের গায়ে পা বা শুঁয়ো বুলাইয়া শরীরের ধূলা মাটি পরিষ্কার করে।
এখানে পিঁপ্ড়ের মুখের একটা বড় ছবি দিলাম। দেখ, কি বিশ্রী মুখ! অন্য পতঙ্গের মুখ কতকটা ছুঁচলো, কিন্তু পিঁপ্ড়ের মুখ একবারে চেপ্টা এবং চোখ দু’টা নিতান্ত ছোট। তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, এত ছোট চোখ লইয়া উহারা কি করিয়া চলা-ফেরা করে। মাটির তলায় অন্ধকারে পিঁপ্ড়েরা যখন ঘর-দুয়ার প্রস্তুত করে, তখন চোখের দরকারই হয় না, শুঁয়ো দিয়া সব জিনিসকে ছুঁইয়াই কাজ চালায়। চোখের দরকার হয় না বলিয়াই পিঁপ্ড়েদের চোখ এত ছোট হইয়াছে।
পিঁপ্ড়ের শুঁয়ো বড় আশ্চর্য্য জিনিস। চোখ নাক ও কান দিয়া আমরা যে-সব কাজ করি, সম্ভবত উহারা শুঁয়ো দিয়াই সেই সকল কাজ চালায়। সুতরাং বলিতে হয়, পিঁপ্ড়ের চোখ কান ও নাক এই তিন ইন্দ্রিয়ই শুঁয়োতে আছে। কোথাও এক কণা চিনি পড়িয়া থাকিতে দেখিলে পিঁপ্ড়েরা কি করে তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। সে ছুটিয়া গিয়া বাসায় খবর দেয়। তার পরে দলে দলে পিঁপ্ড়ে গর্ত্ত হইতে বাহির হইয়া মিষ্ট খাইয়া ফেলে বা তাহা বাসায় বহিয়া লইয়া যায়। পিঁপ্ড়েরা আমাদের মত কথা বলিয়া মনের ভাব প্রকাশ করিতে পারে না, সম্ভবত তাহারা শুঁয়ো নাড়িয়া দলের পিঁপ্ড়েদের কাছে খবর দেয়। পথে চলিতে চলিতে দুইটি পিঁপ্ড়ে মুখোমুখি হইলে, তাহারা দাঁড়াইয়া কি রকমে শুঁয়ো নাড়ানাড়ি করে, তোমরা তাহা দেখ নাই কি? সম্ভবত এই রকমে শুঁয়ো নাড়িয়াই, তাহারা পরস্পর আলাপ করে এবং দলের পিঁপ্ড়েদের চিনিয়া লয়।
পিঁপ্ড়ের মুখের চোয়াল দুইটি করাতের মত কি-রকম ধারালো তোমরা হয় ত তাহা দেখিয়াছ। ডেঁয়ো-পিঁপ্ড়েরা এই রকম দাঁত দিয়া কামড়াইয়া ধরিলে রক্তপাত করিয়া দেয়। ছাড়াইতে গেলে প্রায়ই ইহাদের গলা ছিঁড়িয়া যায়, কিন্তু তবুও কামড় ছাড়ে না। মাটি কাটিয়া ঘর প্রস্তুতের সময়ে ইহারা ঐ দাঁত জোড়াটা খুব কাজে লাগায়। যখন পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া বাধে, তখন ইহারা ঐ দাঁত দিয়াই শত্রুকে কামড়াইয়া মারিয়া ফেলে। কিন্তু ইহাই পিঁপ্ড়েদের আত্মরক্ষার একমাত্র অস্ত্র নয়। কোনো কোনো পিঁপ্ড়ের লেজের শেষে হুলও আছে। কাঠ-পিঁপ্ড়ে দাঁত দিয়া কামড়াইয়া শরীরটাকে বাঁকাইয়া ফেলে এবং ক্ষত স্থানে বিষযুক্ত হুল বসাইয়া দেয়। যে-সকল পিঁপ্ড়ের বুক ও লেজের জোড়ের জায়গায় দুইটা করিয়া বলের মত পিণ্ড থাকে প্রায়ই তাহাদের পিছনে হুল দেখা যায়। এই সকল পিঁপ্ড়েই বিষাক্ত; ইহারা কামড়াইলে ভয়ানক জ্বালা যন্ত্রণা হয়।
দাঁত দিয়া আমরা খাবার চিবাইয়া খাই, কিন্তু পিঁপ্ড়েরা সম্মুখের ঐ দু’টা দাঁত দিয়া কখনই খাবার চিবায় না। চিবাইবার জন্য ভিতর দিকে এক জোড়া ছোট দাঁত আছে এবং জিভও আছে। মিষ্ট জিনিস, ফল এবং ছোট পোকা-মাকড় পিঁপ্ড়েদের প্রধান খাদ্য। খাদ্য কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিবার সময়ে উহারা সেই সাঁড়াশির মত দাঁত জোড়াটা ব্যবহার করে; কিন্তু খাদ্য মুখে দিবার পরে তাহারা ভিতরকার দাঁত ও জিভ ছাড়া আর কিছুরই ব্যবহার করে না।
অনেক পতঙ্গেরই ডানা থাকে, কিন্তু সকল পিঁপ্ড়ের ডানা হয় না। ইহাদের মধ্যে যাহারা স্ত্রী এবং পুরুষ, কেবল তাহাদেরই শরীরে ডানা দেখা যায়। কর্ম্মী পিঁপ্ড়েদের ডানা নাই। তোমরা ঘরে বাহিরে যে-সব পিঁপ্ড়েকে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখ, তাহাদের সকলেই কর্ম্মী। তাই ইহাদের ডানা নাই।
কর্ম্মী পিঁপ্ড়েদের মধ্যে অনেক কাজের ভাগ আছে। কেহ বাসায় পাহারা দেয়, কেহ সৈনিকের কাজ করে, কেহ ঘর বানায়, কেহ বাহির হইতে খাবার জোগাড় করিয়া আনে, কেহ-বা শিশু সন্তানদিগকে লালনপালন করে। তোমরা যদি লক্ষ্য কর, তাহা হইলে পিঁপ্ড়ের গাদার অসংখ্য পিঁপ্ড়ের মধ্যে কতকগুলির আকার বড় দেখিতে পাইবে,—ইহাদের মাথাগুলো যেন শরীরের তুলনায় অনেক বড়। ইহারা সৈনিক পিঁপ্ড়ে। অন্য পিঁপ্ড়ের সঙ্গে যখন লড়াই বাধে তখন উহারা মস্ত মাথার ধারালো দাঁত দিয়া লড়াই করে। সাধারণ কর্ম্মীরাই ছোট আকারে জন্মে। স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপ্ড়ের আকার কিছু বড়, কিন্তু ইহারা প্রায়ই গর্ত্ত ছাড়িয়া বাহিরে আসে না।
পিঁপ্ড়েরা কি খাইয়া বাঁচিয়া থাকে, তোমরা জান কি? এক কথায় বলিতে গেলে ইহারা সর্ব্বভুক্। মাছ, মাংস, ফল-মূল, চাল, ডাল, ঘি, তেল, মিষ্টি, টক্ কিছুই ইহাদের অখাদ্য নয়। একবার একটা পুঁটি মাছ মাটিতে ফেলিয়া পরীক্ষা করিয়াছিলাম। পাঁচ মিনিটেই দলে দলে লাল পিঁপ্ড়ে আসিয়া মাছটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খাইয়া শেষ করিয়াছিল। মাছের কেবল কাঁটা কয়েকটি পড়িয়া ছিল। ফড়িং বা অপর পোকা-মাকড় আধ-মরা হইয়া মাটিতে পড়িয়া থাকিলে, পিঁপ্ড়ের দল তাহা কি রকমে খাইয়া ফেলে দেখ নাই কি? কেবল নিজের খাওয়া নয়,—বাচ্চাদের এবং বাসায় থাকিয়া যাহারা কাজ করে তাহাদের খাওয়াইবার জন্যও ইহারা খাদ্য মুখে করিয়া বাসায় লইয়া যায়।
মৌমাছিদের মত পিঁপ্ড়েদেরও গলার নীচে থলি থাকে। নিজের পেট ভরিলে ইহারা খাদ্য চিবাইয়া ঐ থলিতে ভরিয়া রাখে। তার পরে উহা উগ্লাইয়া বাচ্চাদের বা কর্ম্মীদের প্রয়োজন-অনুসারে খাইতে দেয়। ইহা বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার! আমাদের এক-এক সমাজে হয় ত আট-দশ হাজার লোক থাকে। ইহাদের মধ্যে ধনী ও গরিব দুই রকমেরই লোক দেখা যায়। কিন্তু ধনীরা সহজে গরীবদের সাহায্য করে না। তাহারা নিজের ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয় স্বজনকে লইয়া সুখে থাকিতে চেষ্টা করে। কিন্তু পিঁপ্ড়েদের মধ্যে এই ভাবটি একেবারে নাই। বহু কষ্টে কিছু খাবার সংগ্রহ করিয়া পিঁপ্ড়েরা যখন বাসার দিকে ছুটিয়া চলে, তখন পথের মাঝে যদি নিজের দলের কোনো পিঁপ্ড়ে শুঁয়ো নাড়িয়া খাবার চায়, তবে তাহারা তখনি গলার থলি হইতে খাবার উগ্লাইয়া ক্ষুধার্ত্ত পিঁপ্ড়েকে খাওয়াইতে থাকে। এই রকম ব্যবস্থা আছে বলিয়াই, পিঁপ্ড়েদের সমাজের কাজ সুন্দরভাবে চলে। যাহার খাবার সংগ্রহ করে, তাহারা সেই খাবার আবশ্যকমত সকলের মধ্যে ভাগ করিয়া দেয়। যাহারা ঘর তৈয়ারি করে, তাহারা কেবল নিজের জন্য ঘর তৈয়ারি করে না, দলের সকলেই যাহাতে সুখে থাকিতে পারে, সেই দিকে নজর রাখে। যাহারা সিপাহী বা পাহারাওয়ালার কাজ করে, তাহারা দলের প্রত্যেককে রক্ষা করিবার জন্য শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করে। যাহাদের হাতে সন্তানপালনের ভার আছে, তাহারা সব কাজ ফেলিয়া দিবারাত্রি বাসার মধ্যে থাকে এবং সর্ব্বদা ডিম ও বাচ্চাদের খোঁজ-খবর লয়। এমন সুব্যবস্থা এক মানুষের সমাজ ভিন্ন অন্য প্রাণীর সমাজে দেখা যায় না।
পিঁপ্ড়ের বাসা
পিঁপ্ড়েরা মাটির তলায় যে বাসা করে, গর্ত্ত খুঁড়িয়া তাহার ভিতরটা বোধ হয় তোমরা দেখ নাই। বাগানের মধ্যে বা মাঠে পিঁপ্ড়েরা ভিতর হইতে মাটি তুলিয়া যে বাসা প্রস্তুত করে, তাহা খুঁড়িয়া দেখিয়ো। পিঁপ্ড়ের বাসা চিনিয়া লওয়া কঠিন নয়। একটু নজর রাখিলেই তোমরা দেখিতে পাইবে, মাঠের এক-এক জায়গায় কালো বা লাল পিঁপ্ড়েরা গর্ত্ত হইতে দাঁতে করিয়া একটু একটু মাটি উঠাইয়া তাহা গর্ত্তের মুখে গোলাকারে সাজাইয়া রাখিতেছে। পিঁপ্ড়েরা এই রকমে যে কণা কণা মাটি উঠায়, তাহাতে গর্ত্তের মুখের চারিদিক্টা যেন প্রাচীর দিয়া ঘেরা হইয়া পড়ে। তোমরা যদি এই রকম পিঁপ্ড়ের গর্ত্ত খুঁজিয়া পাও, তবে সেখানে খুঁড়িলে মাটির ভিতরে উহাদের বাসা দেখিতে পাইবে।
পিঁপ্ড়ের বাসা বড়ই অদ্ভুত। ঘরের পর ঘর থাকে-থাকে মাটির ভিতরে সাজানো দেখা যায়। যাওয়া-আসা এবং চলাফেরার জন্য অনেক পথও সেই বাসার ভিতরে থাকে। রাজাদের বা বড়লোকদের বাড়ীর ঘরগুলি বেশ সাজানো গুছানো থাকে মাত্র, সেগুলিতে প্রায়ই কেহ বাস করে না। পিঁপ্ড়েদের সকল ঘরই পূর্ণ দেখিতে পাইবে। কোনো ঘরে কর্ম্মী পিঁপ্ড়েরা ডিমগুলিকে যত্নে রাখিয়া পাহারা দেয়। শুঁয়ো-পোকার আকারে যে-সকল বাচ্চা বাসায় থাকে, কোনো ঘরে তাহাদের যত্ন করা হয়। সেখানে অনেক কর্ম্মী-পিঁপ্ড়ে গা চাটিয়া বাচ্চাদের শরীরের ধূলা-মাটি সাফ্ করে এবং গলার খলিতে খাবার বোঝাই করিয়া আনিয়া তাহাদিগকে খাওয়াইতে থাকে। কোনো ঘরে হয় ত, পুত্তলি-অবস্থায় বাচ্চারা নিজের মুখের লালায় প্রস্তুত সূতা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া মড়ার মত পড়িয়া থাকে এবং শত শত কর্ম্মী-পিঁপ্ড়ে পুত্তলিদের গায়ের মলা-মাটি মুছিয়া যত্ন করে।
বাসার উপর ও মাঝের তলার ঘরগুলিতে এই সকল কাজ চলে, এবং সকলেই ব্যস্ত হইয়া নিজেদের কর্ত্তব্য করিয়া যায়। কোনো উপর-ওয়ালার তাগিদের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া সময় নষ্ট করে না।
বাসার নীচের তলাটা অনেকটা নিরিবিলি। ইহাই পিঁপ্ড়েদের রাণীর অন্দর মহল। কর্ম্মীদের মুখ হইতে খাবার লইয়া আহার করা এবং ধারাবাহিক ডিম-পাড়াই রাণীর কাজ। আমাদের রাণীর যেমন অনেক দাস-দাসী ও সহচরী সঙ্গে থাকিয়া রাণীর হুকুম তামিল করে, পিঁপ্ড়েদের রাণীর সঙ্গেও সেই রকম অনেক সঙ্গী ঘুরিয়া বেড়ায়। পিঁপ্ড়েদের রাণী সৌখীন নয়; কাজেই তাহার মন জোগাইবার জন্য সঙ্গীদের বিশেষ খাটিতে হয় না। অন্দর মহলের ঘরে ঘরে বেড়াইয়া রাশি রাশি ডিম পাড়াই রাণীর একমাত্র সখ্। ডিম পাড়িবা-মাত্র রাণীর সঙ্গীরা সেগুলিকে মুখে করিয়া পৃথক্ ঘরে যত্ন করিয়া রাখিয়া দেয়। পাছে ডিম নষ্ট হইয়া যায়, এই ভয়েই অনেক কর্ম্মী পিঁপ্ড়ে সর্ব্বদা রাণীর পিছনে ঘুরিয়া বেড়ায়।
স্ত্রী ও পুরুষ-পিঁপ্ড়ে
রাণী প্রথমে কেবল কর্ম্মী পিঁপ্ড়ের ডিম প্রসব করে। ইহা শেষ হইলে সে কিছুদিন ধরিয়া স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপ্ড়ের ডিম পাড়িতে থাকে। এই ডিমগুলির আকার কিছু বড়। যাহা হউক, সেগুলি হইতে সম্পূর্ণ আকারে পিঁপ্ড়ে বাহির হইলে বাসার সকলেই ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ-পিঁপ্ড়ের ডানা থাকে। তাহারা জন্মিয়াই গর্ত্তের বাহিরে আসিবার চেষ্টা করে। কর্ম্মী পিঁপ্ড়েরা জোর করিয়া তাহাদিগকে গর্ত্তের মধ্যে ধরিয়া রাখে। কিন্তু মৌমাছির চাকে যেমন স্ত্রী-মাছিদের মধ্যে ক্রমাগত ঝগ্ড়াঝাঁটি চলে, ইহাদের মধ্যে তাহা দেখা যায় না। স্ত্রী, পুরুষ এবং কর্ম্মী সকলে মিলিয়া মিশিয়া বাস করে।
যাহা হউক, বাসায় স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপ্ড়ের সংখ্যা যখন বেশি হইয়া পড়ে, তখন কর্ম্মীরা তাহাদিগকে আর আট্কাইয়া রাখিতে পারে না। শেষে হঠাৎ এক দিন গর্ত্ত ছাড়িয়া দলে দলে উপরে উঠিতে আরম্ভ করে। পুরুষ-পিঁপ্ড়েরা একবার উপরে উঠিলে আর গর্ত্তে ফিরিয়া আসে না। কিছুক্ষণ উড়িলেই তাহাদের ডানা খসিয়া যায় এবং অনেকেই মরিয়া যায়; আবার কতকগুলিকে পাখী, ব্যাঙ্ প্রভৃতি কাছে পাইয়া খাইয়া ফেলে। ডানা-ওয়ালা অনেক স্ত্রী-পিঁপ্ড়েরও এই রকমে অপমৃত্যু হয়। কিন্তু কর্ম্মীরা সকলগুলিকে মরিতে দেয় না। তাহারা দলের স্ত্রীদের বিপদ্ দেখিলেই চারিদিক্ হইতে ছুটিয়া আসে এবং সেই সাঁড়াসির মত দাঁত দিয়া ধরিয়া তাহাদিগকে গর্ত্তের ভিতরে লইয়া যায়। ইহার পর স্ত্রীরা আর গর্ত্তের বাহিরে আসে না। গর্ত্তের ভিতরে গিয়া উহাদের প্রত্যেকেই একএকটি রাণী হইয়া দাঁড়ায় এবং ডিম পাড়িতে সুরু করে। যে-সকল স্ত্রী-পিঁপ্ড়ে উড়িতে উড়িতে গর্ত্ত হইতে দূরে আসিয়া পড়ে, কর্ম্মীরা তাহাদের সন্ধান পায় না। ইহারা নিজেই নিজেদের ডানা কাটিয়া ফেলে এবং পরে একটি ছোট গর্ত্ত খুঁড়িয়া সেখানে ডিম পাড়িতে আরম্ভ করে। এই রকমে কখনো কখনো পিঁপ্ড়েদের এক-একটা নূতন বাসার সৃষ্টি হইয়া পড়ে।
পিঁপ্ড়ের বাসা-ত্যাগ
এক জায়গায় বহুকাল বাস করিলে, তাহা ক্রমে বাসের অনুপযুক্ত হয়। তখন হয় ত মড়ক বা অন্য কিছু উৎপাত দেখা দিয়া সেখানকার লোকজনকে দেশ-ছাড়া করে। আমাদের দেশের অনেক পুরানো গ্রাম ও নগর এই রকমে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান রাজাদের রাজধানী গৌড় এক সময়ে খুব বড় সহর ছিল। ইহা বোধ হয় তোমরা ইতিহাসে পড়িয়াছ। কিন্তু এখন তাহা জনশূন্য ঘোর জঙ্গল। গৌড়ের বড় বড় সুন্দর বাড়ী ভাঙিয়া চুরিয়া মাটির সঙ্গে মিশিয়া রহিয়াছে। এক সময়ে ভয়ানক মড়কের ভয়ে লোকজন দেশ ছাড়িয়া পলাইয়াছিল বলিয়াই গৌড়ের এমন দুর্দ্দশা। পিঁপ্ড়েরা মাটির নীচে যে-সকল নগরের মত বাসা বানায়, তাহাতে উহারা চিরকাল থাকিতে পারে না। বাসের একটু অসুবিধা হইলে বা কোনো রকম মড়ক দেখা দিলে, তাহার বাসা ছাড়িয়া নূতন জায়গায় বাসা তৈয়ার করে। তোমরা এই রকম বাসা-ভাঙা পিঁপ্ড়ের দল দেখ নাই কি? বাসা ভাঙার সময়ে অসংখ্য পিঁপ্ড়ে সারি বাঁধিয়া নূতন জায়গার দিকে চলে। বাসায় যে-সকল ডিম, বাচ্চা ও পুত্তলি-পিঁপ্ড়ে থাকে, সেগুলিকে তাহারা ফেলিয়া যায় না। তোমরা যদি লক্ষ্য কর তবে প্রত্যেক কর্ম্মী পিঁপ্ড়েকে তখন একএকটি সাদা জিনিষ মুখে লইয়া চলিতে দেখিবে। ঐ জিনিষগুলি পুত্তলি-পিঁপ্ড়ে। পুত্তলি-অবস্থায় পিঁপ্ড়ের বাচ্চা মড়ার মত পড়িয়া থাকে, এজন্য সেগুলিকে মুখে করিয়া লইয়া যাইতে কর্ম্মীদের কোনো কষ্ট হয় না।
আমরা এ-পর্য্যন্ত মাটির তলাকার পিঁপ্ড়েদের কথা বলিলাম। পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজার রকমের পিঁপ্ড়ে আছে। ইহাদের সকলেই মাটির তলায় বাস করে না। কেহ গাছের শুক্নো পাতা একত্র করিয়া বাসা বাঁধে। আবার কেহ আমাদের ফকির ও সন্ন্যাসীর মত পথে পথে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং যেখানে-খুসি-সেখানে বাস করে,—ইহাদের স্থান বা অস্থানের জ্ঞান নাই। এই তিন হাজার পিঁপ্ড়ের জীবনের কথা মোটামুটি এক রকম হইলেও, তাহাদের চাল-চলনে অনেক পার্থক্য আছে। কাজেই একটু একটু ইহাদের পরিচয় দিতে গেলেও একখানা প্রকাণ্ড বই লেখা দরকার হয়। আমরা এখানে অন্য পিঁপ্ড়েদের কথা না বলিয়া আমাদের বাংলা দেশের কয়েকটি পিঁপ্ড়ের কথা বলিব।
বাংলা দেশের পিঁপ্ড়ে
আমরা যে-সব পিঁপ্ড়ে দেখিতে পাই তাহাদের মধ্যে মোটামুটি,—(১) ডেঁয়ে (২) সুড়সুড়ে বা ধাওয়া (৩) কাঠ-পিঁপ্ড়ে বা মেঝেল (৪) লাল-পিঁপ্ড়ে—এই চারি জাতি দেখা যায়।
ডেঁয়েদের দাঁত খুব বড় ও ধারালো কিন্তু হুল থাকে না। কাঠ-পিঁপ্ড়ের হুল ও দাঁত দুইই আছে,—ইহারা ভয়ানক বিষাক্ত। ধাওয়া বা সুড়সুড়ে পিঁপ্ড়েরা বড় ভালোমানুষ। তাহাদের দাঁত বড় নয় এবং হুলও থাকে না।
তোমরা জিঁয়ে এবং লাল ক্ষুদে পিঁপ্ড়ে নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। ইহারা ভয়ানক রাগী ও বিষাক্ত। ডেঁয়ে, কাঠ-পিঁপ্ড়ে এবং সুড়সুড়ে পিঁপ্ড়েরা প্রায়ই একা একা ঘুরিয়া বেড়ায়, কিন্তু জিঁয়ে ও ক্ষুদে পিঁপ্ড়েরা তাহা করে না। ইহার দল বাঁধিয়া চলা-ফেরা করে। জ্যান্ত কেঁচো বা আধমরা ফড়িং শিকার করিবার জন্য যখন জিঁয়েরাা সার বাঁধিয়া চলে তখন মনে হয় যেন, তাহারা যুদ্ধ করিতে চলিয়াছে। শিকারের সময়ে সত্যই ইহারা যুদ্ধ-সজ্জা করিয়া চলে। সম্মুখে সৈনিক ও দূতেরা থাকে। তাহারা একটু আগাইয়া গিয়া কোথায় শিকার আছে বা কোথায় বিপদের সম্ভাবনা তাহা জানিয়া লয় এবং সেই খবর দলের পিঁপ্ড়েদের জানায়।
রান্নাঘরে ও ভাঁড়ারঘরে জিঁয়েদের উৎপাত বেশি। হাঁড়ির ভিতরকার ভাজা মাছ পর্য্যন্ত ইহারা খাইয়া ফেলে। ইহাদের অত্যাচার হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য বাড়ীর মেয়েরা দুই একটা পিঁপ্ড়েকে আধ্মরা করিয়া মাটিতে ফেলিয়া রাখেন। কয়েক মিনিটেই দলের দুই চারিটি পিঁপ্ড়ে সেখানে আসিয়া দাঁড়ায় এবং শুঁয়ো দিয়া আহত পিঁপ্ড়েকে পরীক্ষা করে। যখন দেখে সঙ্গীরা সত্যই মৃতপ্রায়, তখন তাহারা ভয় পাইয়া গর্ত্তের সকল পিঁপ্ড়েদের বিপদের কথা জানায়। ইহার পরে অনেকক্ষণ কোনো পিঁপ্ড়েই গর্ত্তের বাহিরে আসে না।
রাঙী পিঁপ্ড়ে তোমরা দেখ নাই কি? ইহারা জিঁয়েদের চেয়ে ছোট, কিন্তু কম কামড়ায় না। ইহারাও একা চলে না। বর্ষাকালে দিনের বেলায় যদি একটা কেঁচো গর্ত্তের উপরে উঠে, তবে রাঙীর দল তাহাকে আক্রমণ করিয়া খাইয়া ফেলে বা খণ্ড খণ্ড করিয়া বাসায় টানিয়া লইয়া যায়। ইহারা জিঁয়েদের মত মাটির উপরে চলিতে ভালবাসে না; মাটির তলায় সুড়ঙ্গ করিয়া সারি বাঁধিয়া চলে এবং মাঝে মাঝে উপরে উঠিবার পথ রাখে। বৃষ্টির পরে ইহারা বাসার ভিতর হইতে অনেক মাটি তুলিয়া গর্ত্তের মুখে আল্ বাঁধে।
তোমরা গাছের লাল-পিঁপ্ড়ে নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। এই পিঁপ্ড়েদের কেহ লাসা কেহ-বা নাল্সো বলে। বাগানের কলা পেঁপে আম প্রভৃতি বড় বড় গাছেই ইহাদের প্রধান আড্ডা। সাধারণ পিঁপ্ড়ের চেয়ে ইহারা আকারে বড়, পা ও শুঁয়ো বেশ লম্বা। বুক ও লেজের জোড়ে কেবল একটি ‘বল’ অর্থাৎ পিণ্ড আছে। ইহাদের লেজে হুল্ নাই। কিন্তু দাঁত সাঁড়াসির মত জোরালো। তোমরা যদি কোনো নাল্সো পিঁপ্ড়েকে বিরক্ত কর, তবে সে শুঁয়ো উঁচু করিয়া তোমাকে কামড়াইতে আসিবে। কামড়াইলে মনে হয় যেন কামড়ের জায়গাটা আগুনে পুড়িয়া গেল। ইহারা দাঁত দিয়া কামড়াইয়া কামড়ের জায়গায় একরকম পাত্লা জিনিস ঢালিয়া দেয়। ইহাই তাহাদের বিষ। লেজের দিকে একটা ছিদ্রে বিষ থাকে। কিন্তু ইহা মারাত্মক বিষ নয়। গায়ে লাগিলে কিছুক্ষণ খুব কষ্ট দেয়, তার পরে জ্বালা-যন্ত্রণা কমিয়া যায়।
নাল্সো-পিঁপ্ড়ের বাসা হয় ত তোমরা বাগানের গাছপালায় দেখিয়াছ। গাছের যে-সকল সরু ডালে বেশি পাতা থাকে, তাহারি কতকগুলি তাজা পাতা মাকড়সার জালের মত সূতা দিয়া জড়াইয়া ইহারা বাসা বাঁধে। পাতাগুলি কিছুদিন বেশ তাজা থাকে, কিন্তু পরে শুকাইয়া যায়। এই রকম পাতার ঘরে নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা ডিম, বাচ্চা ও খাবার বোঝাই করিয়া বাস করে। যদি বাসার কাছে কোনো গোলযোগ হয়, তবে তাহারা দলে-দলে ঘর হইতে বাহির হইয়া লড়াই করিবার জন্য প্রস্তুত হয় এবং সারে সারে দাঁড়াইয়া শুঁয়ো নাড়িতে থাকে।
নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা কি রকমে বাসা বাঁধে তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। ইহা বড়ই মজার। দাঁত দিয়া ধরিয়া ইহারা প্রথমে কতকগুলি কচি পাতাকে বাঁকাইয়া ফেলে। কিন্তু তাজা পাতাকে একবার বাঁকাইলে তাহা বেশি ক্ষণ বাঁকিয়া থাকে না; একটু পরেই আবার সোজা হইয়া উঠে। কাজেই এই সকল পাতা দিয়া স্থায়ী রকম ঘর প্রস্তুত করিতে হইলে, সেগুলিকে কিছু দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে হয়। মাকড়সা বা গুঁটিপোকারা যেমন শরীরের লালা দিয়া সূতা প্রস্তুত করিতে পারে, এই পোকারা তাহা পারে না। কিন্তু ইহাদের বাচ্চারা এক রকম সূতা তৈয়ার করিতে পারে। পিঁপ্ড়েরা পুত্তলি-অবস্থায় এই সূতায় সর্ব্ব শরীর ঢাকিয়া ঘুম দেয়। যাহা হউক, নাল্সো পিঁপ্ড়েরা বাসার পাতাগুলিকে সূতা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার জন্য তাহাদের বাচ্চাদের সাহায্য লয়। ঘর বাঁধিবার সময়ে কর্ম্মী পিঁপ্ড়েরা এক-একটা বাচ্চা মুখে করিয়া বাঁকানো পাতার কাছে লইয়া যায়। বাচ্চারা মুখ হইতে লালা বাহির করিয়া যেমন সরু সূতা প্রস্তুত করিতে থাকে, তেমনি অপর কর্ম্মী পিঁপ্ড়েরা সেই সূতা দিয়া পাতাগুলিকে বেশ শক্ত করিয়া জড়াইয়া ফেলে। নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা কেমন ফাঁকি দিয়া ঘর বাঁধে, একবার ভাবিয়া দেখ। এমন ফন্দি মানুষের মাথাতেও হঠাৎ আসে না।
নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা সর্ব্বভুক্ প্রাণী। শুঁয়ো-পোকা, ফড়িং, গোবরে-পোকা, প্রজাপতি প্রভৃতি সকল রকম ছোট প্রাণী শিকার করিয়া ইহারা বাসায় আনে এবং তার পরে পরমানন্দে সেগুলি সকলে ভাগ করিয়া আহার করে। আমাদের বাড়ীতে ভাণ্ডার ঘর আছে। এই ঘরে আমরা কেবল খাবার জিনিস জড় করিয়া রাখি। নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা খাবার রাখিবার জন্য গাছের পাতা দিয়া ভাণ্ডার ঘর তৈয়ার করে। এই ঘরে তাহারা বাস করে না, খাবার জিনিস রাখিয়া ঘরের চারিদিকে পাহারা দেয়।
পিঁপ্ড়েদের গোরু
আমরা গরু পুষি এবং ঘাস খড় খাওয়াইয়া তাহাদিগকে যত্ন করি; তার পরে তাহারা বাচ্চা প্রসব করিয়া আমাদিগকে দুধ দেয়। পিঁপ্ড়েরা দুধ খাইবার জন্য গরুর মত করিয়া এক রকম প্রাণী পোষে—কথাটা আশ্চর্য্য হইলেও সম্পূর্ণ সত্য। নাল্সো ও ডেঁয়ো পিঁপ্ড়েদেরই গরু-পোষা স্বভাব বেশি দেখা যায়।
বর্ষার এবং শীতের শেষে যে সবুজ রঙের ছোট পোকা প্রদীপের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়, তোমরা তাহা বোধ হয় দেখিয়াছ। কপি গোলাপ শশা মূলা প্রভৃতি গাছের পাতাতে এই জাতীয় অনেক পোকা দেখা যায়। ইহাদের সকলেরি রঙ যে সবুজ হয়, তাহা নয়। এই জাতীয় মেটে ও কালো রঙের পোকাও দেখা যায়। অনেক জায়গায় এই পোকাকে জাব-পোকা বলে। নাল্সো পিঁপ্ড়েরা প্রায়ই জাব-পোকার ডিম আানিয়া বাসায় পালন করে। আমরা যেমন গোরু পালন করি, ঠিক সেই রকম যত্নেই উহারা পোকা পালন করে। ডিম যাহাতে নষ্ট না হয়, ডিম ফুটিলে বাচ্চারা যাহাতে প্রচুর খাবার পায় এবং বাহির হইতে শত্রু আসিয়া যাহাতে ডিম নষ্ট না করে—এই সকল বিষয়ে পিঁপ্ড়েদের খুব নজর থাকে। তাহারা কিসের জন্য এত যত্ন ও চেষ্টা করিয়া পোকা পোষে, তাহা বোধ হয় তোমরা এখনো বুঝিতে পার নাই। আমরা গোরুদিগকে খাওয়াইয়া যেমন ভাঁড়ে-ভাঁড়ে দুধ আদায় করিয়া লই, পিঁপ্ড়েরাও ঐ-সব পোকাদের কাছ হইতে মধুর মত মিষ্ট এক রকম রস আদায় করিয়া লয়।
এখানে পিঁপ্ড়েদের গোরুর একটা বড় ছবি দিলাম। কিন্তু ইহাদের প্রকৃত আকার এত ছোট যে, দশ বারোটিকে পর পর না সাজাইলে এক ইঞ্চি জায়গা জোড়া যায় না। ইহাদের সকলের ডানা গজায় না এবং পাগুলিও খুব লম্বা হয় না। এজন্য তাড়াতাড়ি চলা-ফেরা করিতে পারে না। গাছের রসই ইহাদের প্রধান খাদ্য। তাই যে গাছে পিঁপ্ড়ের গোরু বেশি থাকে, সেই গাছ প্রায়ই মরিয়া যায়।
এখানে যে পোকাটির ছবি দিলাম, তাহার পিছনে নলের মত দুইটি অংশ দেখিতে পাইবে। এই দুইটি মধুর নল। গোরুর বাঁটে যেমন আপনা হইতেই অনেক দুধ জন্মে, পিঁপ্ড়েদের গোরুর দেহের ঐ দুইটি নলে সেই রকমে আপনিই অনেক মধু জমা হয়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আমগাছের পাতায় কখনো কখনো এক রকম চক্চকে মধু লাগিয়া থাকিতে দেখা যায়। এই মধুও এক রকম পতঙ্গের শরীরে হইতে বাহির হয়। আমগাছের তলায় গেলে, এক রকম ছোট পোকাকে চড়বড় শব্দ করিয়া এক পাতা হইতে লাফাইয়া অন্য পাতায় যাইতে দেখা যায়। এক-একটি আমগাছে বোধ হয়, লক্ষ লক্ষ পোকা থাকে। এইগুলিই শরীর হইতে মধু বাহির করিয়া গাছের পাতায় লাগায়। ইহারাও পিঁপ্ড়েদের গোরুজাতীয় প্রাণী। তোমরা যদি পরীক্ষা কর, তবে দেখিতে পাইবে,—যে গাছে এই পোকা বেশি থাকে, সেখানে নানাজাতীয় পিঁপ্ড়েও দিবারাত্রি ঘুরিয়া বেড়ায়।
দুধ সংগ্রহ করিতে হইলে আমরা গোরুকে দুহিয়া থাকি। পিঁপ্ড়েরা জাব-পোকার মধু সংগ্রহ করিবার সময়ে বড় মজা করে। মধু খাইবার ইচ্ছা হইলেই তাহারা লম্বা শুঁয়ো দিয়া পোকাদের লেজের কাছে সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করে। ইহাতে পোকাদের শরীর হইতে বিন্দু বিন্দু মধু বাহির হইতে থাকে। পিঁপ্ড়েরা তাহাই পরমানন্দে চাটিয়া খাইতে থাকে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, পিঁপ্ড়েরা যে পোকাগুলিকে গোরুর মত পোষে তাহা নয়, আমরা যেমন গোরুর দুধ দুহিয়া লই, উহারাও সেই রকমে মধু দুহিয়া লয়।
নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা জাব-পোকাগুলিকে অতি যত্নে পালন করে। যাহাতে সেগুলি পলাইতে না পারে, তাহার জন্য জাল বুনিয়া খোঁয়াড় তৈয়ারি করে। কখনো কখনো নিজেদের বাসাতেওে পোকাগুলিকে আট্কাইয়া রাখে। এই গোরু লইয়া এক দল পিঁপ্ড়ের সহিত আর এক দলের প্রায়ই লড়াই বাধিয়া যায়।
পিঁপ্ড়ের লড়াই
তোমরা পিঁপ্ড়ের লড়াই দেখিয়াছ কি? আমরা অনেক দেখিয়াছি। এক রাজার সঙ্গে আর এক রাজার কেন লড়াই বাধে, তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। প্রায়ই স্বার্থ লইয়া লড়াই বাধে। এক রাজা অন্য রাজার রাজ্যের ধন-সম্পত্তিতে লোভ করিয়া সেই রাজ্য আক্রমণ করে। ইহাতে দুই পক্ষে যুদ্ধ বাধিয়া যায়। দুই দল পিঁপ্ড়ের মধ্যেও ঠিক এই কারণে লড়াই বাধে। এক দল যেই আর এক দলের অধিকারে আড্ডা করিতে যায়, অপর দল তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া হাজারে হাজারে গর্ত্ত হইতে বাহির হয় ও লড়াই সুরু করে। কুকুর ও পাখীরা যেমন পায়ে পা বাধাইয়া কামড়াকাম্ড়ি করে এবং সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, পিঁপ্ড়ের লড়াই কতকটা সেই রকমের। দিনের পর দিন, দুই দল পিঁপ্ড়ের মধ্যে এই রকম লড়াই চলে। এই যুদ্ধে সন্ধি হয় না। এক পক্ষ সম্পূর্ণ হারিয়া গেলে যুদ্ধ থামে।
যুদ্ধক্ষেত্রে যে-সব সৈনিক মারা পড়ে, আমরা তাহাদের দেহ আনিয়া গোর দিই বা পুড়াইয়া ফেলি। পিঁপ্ড়েরা মৃত সৈনিকের দেহ টানিয়া গর্ত্তে লইয়া যায়। কিন্তু গোর দেয় না। পিঁপ্ড়েরা মৃত দেহ পাইলে খুব আনন্দ করে এবং সকলে মিলিয়া ভাগ করিয়া খাইয়া ফেলে। কাণা খোঁড়া স্বজাতীয়দের উপরেও তাহাদের দয়ামমতা নাই,—কোনো নিষ্কর্ম্মা লোককে তাহারা দলে থাকিতে দেয় না। কোনো রকমে দলের পিঁপ্ড়ে আহত হইলে, সকলে মিলিয়া তাহাকে বাসায় টানিয়া লইয়া খাইয়া ফেলে।
তোমরা হয় ত ইতিহাসে পড়িয়াছ, অতি প্রাচীনকালে পৃথিবীর সকল দেশেই মানুষ কেনা-বেচা চলিত। লোকে যাহাকে টাকা দিয়া কিনিত, তাহাকে পশুর মত খাটাইত। এক দল লোক এক দেশ হইতে মানুষ ধরিয়া আনিয়া আর এক দেশে বিক্রয় করিত। এখন পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষ-ধরার ব্যবসায় নাই। কিন্তু পিঁপ্ড়েদের মধ্যে এই চুরি-বিদ্যা খুব আছে। পিঁপ্ড়েরা অনেক সৈন্য সংগ্রহ করিয়া হঠাৎ আর এক দলের গর্ত্তে প্রবেশ করে এবং তাহাদের ডিম ও পুত্তলি চুরি করিয়া নিজেদের গর্ত্তে আনিয়া ফেলে। এই চুরি লইয়াও দুই দলে কখনো কখনো লড়াই বাধে। চুরি-করা ডিম হইতে যে পিঁপ্ড়ে জন্মে, সেগুলি চোর পিঁপ্ড়েদেরই দলভুক্ত হয়।
পিঁপ্ড়ের বাসা চেনা
গর্ত্ত ছাড়িয়া পিঁপ্ড়েরা কত দূরে দূরে বেড়ায়, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। আমরা এক রকম পিঁপ্ড়েকে চারি শত বা পাঁচ শত গজ দূরে বেড়াইতে দেখিয়াছি। পিঁপ্ড়েরের দৃষ্টি শক্তি খুব ভালো নয়, কিন্তু তথাপি তাহারা কখনো পথ ভুলে না। এত দূরে গিয়াও তাহারা কি রকমে নিজের গর্ত্তে আসিয়া পৌঁছায়, তাহা বড় আশ্চর্য্যজনক মনে হয়। এ-সম্বন্ধে বড় বড় পণ্ডিতেরা অনেক খোঁজ খবর লইতেছেন, কিন্তু আজও ঠিক কথাটি জানা যায় নাই। অনেকে বলেন, পিঁপ্ড়ের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রবল, তাই গন্ধ শুঁকিয়া শুঁকিয়া ইহারা নিজেদের বাসা বাহির করিতে পারে। হাজার হাজার পিঁপ্ড়ে একত্র থাকিলে, তাহাদের মধ্যে কোন্গুলি নিজের দলের ইহাও পিঁপ্ড়েরা অনায়াসে চিনিয়া লইতে পারে। সম্ভবত, এখানেও গন্ধ শুঁকিয়া পিঁপ্ড়েরা আপন ও পর ঠিক করিতে পারে।
ইংলণ্ডের একজন প্রধান পণ্ডিত লর্ড আভারির নাম বোধ হয় তোমরা শুন নাই। তিনি সমস্ত জীবনই কেবল পোকা-মাকড় লইয়া পরীক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টায় পোকা-মাকড়ের জীবনের অনেক নূতন কথা জানা গিয়াছে। তিনি একবার একটি পিঁপ্ড়েকে দল হইতে ছাড়াইয়া লইয়া বহুকাল পৃথক রাখিয়াছিলেন। এত দিনেও সে নিজের দলের কথা ভুলে নাই, ছাড়িয়া দিবামাত্র সে দলে মিশিয়া গিয়াছিল। ইহাতে মনে হয়, কেবল গন্ধ শুঁকিয়াই পিঁপ্ড়েরা দল চিনিয়া লয় না। কোনো পিঁপ্ড়ে হঠাৎ পরের দলে প্রবেশ করিলে সেখানে জায়গা পায় না। দলের পিঁপ্ড়েরা দুই চারিবার গায়ে শুঁয়ো বুলাইয়াই তাহাকে অন্য দলের পিঁপ্ড়ে বলিয়া চিনিতে পারে এবং শেষে তাহাকে জোর করিয়া দল হইতে তাড়াইয়া দেয়।
পিঁপ্ড়ের আয়ু
লর্ড আভারি একটি পিঁপ্ড়েকে বিশেষ যত্ন করিয়া প্রায় ছয় বৎসর বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন। সুতরাং পিঁপ্ড়েরা বেশি দিন বাঁচে না বলিয়া আমাদের যে ধারণা আছে, তাহা ভুল। নিজের ইচ্ছায় চলা-ফেরা করার সুবিধা পাইলে, ইহারা সাত বৎসর পর্য্যন্ত বাঁচিয়া থাকে।