স্কুলজীবনের প্রিয় শিক্ষক
আমার প্রথম স্কুলজীবনের শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র দু’জনের কথা ভালোভাবে মনে আছে। তাঁদের দু’জনের মধ্যে পরেও দেখা হয়েছে। খুবই স্নেহ করতেন আমাকে। তখন কত বয়স আমার? দশ-এগারো মাত্র। স্বভাবের দিক থেকে লাজুক ছিলাম; কিন্তু একবার পরিবেশটা সহজ হয়ে উঠলে কথাবার্তা ও আচার-আচরণে বুদ্ধিদীপ্ত সপ্রতিভতা ফুটে উঠতে দেরি হতো না। ওই দু’জন শিক্ষক সেই সহজ পরিবেশটা সৃষ্টি করতে পারতেন। একজন অসচেতনভাবে, নিজের সস্নেহ ব্যবহার ও কোমল স্বভাবের গুণে। তিনি ছিলেন ফজলুল করিম স্যার। মৃদুভাষী, শান্ত, ধীরস্থির। একবার তাঁর দীর্ঘস্থায়ী কঠিন অসুখ হয়। তাঁর বাড়িতে সেবা- শুশ্রূষা করার ব্যাপারে কিছু পারিবারিক অসুবিধা ছিল। সেজন্য আমরা স্কুল থেকে একটা ব্রিগেডমতো গঠন করি। আমাদের ক্লাস থেকে আমরা দু’জনের এক একটা টিম তৈরি করে পালাক্রমে তাঁর দেখাশোনা ও সেবা করেছি সেই সময়। স্যারের জন্য তো মায়া ছিলই, কিন্তু ওই বয়সে একটা কাজের মতো কাজ করছি তার জন্য এক ধরনের গর্ব ও আত্মতৃপ্তির ভাবও ছিল মনের মধ্যে। করিম স্যারের সঙ্গে পরেও দেখা হয়েছে। তিনি তখন বৃদ্ধ, চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, আর আমি যুবক, নিজের চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিভা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখার কাজে অধ্যবসায়ের সঙ্গে নিয়োজিত। তখনও স্যারের কাছ থেকে যে স্নেহ-শুভেচ্ছা পেয়েছি তা কখনো ভোলবার নয়। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগটা অন্যদিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইতিহাসে পিএইচ.ডি. ডিগ্রিপ্রাপ্ত ড. করিম আমার সহকর্মী হন ষাটের দশকের শেষদিকে। আমি যখন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ তখন তিনি সেখানে ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। বাবার মতোই ধীরস্থির, শান্ত স্বভাবের, কিন্তু দৃঢ়চেতা, আদর্শনিষ্ঠ ও নীতিবান।
আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল আর যে দ্বিতীয় শিক্ষকের কথা উল্লেখ করছি তিনি হলেন শাহাবুদ্দীন স্যার। তিনি ছিলেন করিম স্যারের বিপরীত প্রকৃতির মানুষ। চটপটে, বুদ্ধিদীপ্ত, কথাবার্তায় প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল, একটু ছটফটে। দ্রুত কথা বলতেন কিন্তু অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে পারতেন অসম্ভব স্বচ্ছ ও আকর্ষণীয় করে। স্যারের সঙ্গে পরেও দেখা হয়েছে। দক্ষ ও প্রতিভাবান শিক্ষক হিসেবে ব্যাপক স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন তিনি।
আমার স্কুলজীবনের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলার সুকুমার স্যারের কথাও বেশ ভালো মনে আছে। লম্বা- চওড়া, বলিষ্ঠ দেহ, মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো, চমৎকার করে ধোয়া সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ভারি সুন্দর করে পড়াতেন। সেকালের প্রথা অনুযায়ী প্রায়ই নোট দিতেন। নতুন কবিতা শুরু করার সময় প্রাথমিক দু’একটা কথা বলার পর বলতেন, হ্যাঁ, এবার লিখে নাও। আমরা তড়িঘড়ি খাতা খুলে লিখে নিতাম। কবি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য, কবিতার পটভূমি, তার সারমর্ম, তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় দিক কী কী ইত্যাদি। একটু বেশি সমাসবদ্ধ শব্দ এবং আলঙ্কারিক বাক্য ব্যবহার করতেন সুকুমার স্যার। পরে মনে হয়েছিল সে-রকম, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় স্যারের গুরুগম্ভীর ধ্বনিসমৃদ্ধ বাংলা আমাকে মুগ্ধ করত। সুকুমার স্যারের একটা ব্যতিক্রমী কাজের কথা মনে পড়লে আমি আজও অবাক হই। সিলেবাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আমাদের একটি বিখ্যাত প্রাচীন, তারপর বাংলা অনুবাদ শোনাতেন। নাটকটি ছিল মৃচ্ছকটিকা।