নিউ থিয়েটার্সে ম্যাটিনি শো,

নিউ থিয়েটার্সে ম্যাটিনি শো

কৈশোর-যৌবনের বয়ঃসন্ধিতে দেখা নায়িকা শীলা দেশাইয়ের কথা ভুলতেই পারছি না। একদিন টিফিনের গোটা সময়জুড়ে সুশীলের মুখে শুধু দিদি চলচ্চিত্রের গল্প। কয়েকদিন পর আমি দিদি দেখলাম।

সিনেমা আমরা সেসময় খুব সহজে নিরুদ্বেগ চিত্তে দেখার সুযোগ পেতাম না। বাড়িতে ব্যাপারটা মোটেই উৎসাহিত করা হতো না। এ ব্যাপারে বাবা ছিলেন বেশ কড়া। তবে তাঁর অজান্তে মায়ের কাছ থেকে কাকুতি-মিনতি করে অনুমতি আদায় করে কিছু-কিছু ছবি তখন দেখেছি দুপুরে, ম্যাটিনি শো’তে। নিউ থিয়েটার্সের স্বর্ণযুগের সেসব ছবির কথা আজও ভুলতে পারি না। আর কী প্রতিভাদীপ্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীর সমারোহ। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ছায়াদেবী, চন্দ্রাবতী, জীবন গাঙ্গুলী, পাহাড়ী সান্যাল, প্রমথেশ বড়ুয়া, যমুনা, মলিনা, কানন দেবী, অমর মল্লিক, জহর গাঙ্গুলী, মেনকা। বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার আগেই ছাত্রজীবনের দেখা যেসব চলচ্চিত্রের স্মৃতি এখনো পুরোপুরি না হলেও অনেকটা মনে আছে তার মধ্যে রয়েছে দিদি, মানময়ী গার্লস স্কুল, বিদ্যাপতি, মুক্তি, দেশের মাটি, সাপুড়ে, গৃহদাহ, দেবদাস, অধিকার, সাথী, রজতজয়ন্তী প্রভৃতি। বিদ্যাপতি আর সাপুড়ে এ দুটি চলচ্চিত্রের কাহিনী রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাছাড়া তিনি গানও লিখেছিলেন, সুর দিয়েছিলেন, শিল্পীদের গান শিখিয়েছিলেন পরম যত্ন নিয়ে। ওই দুটি ছবির পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবকীকুমার বসু। অভিনয় প্রসঙ্গে আজও মনে আছে বিদ্যাপতিতে নাম ভূমিকায় পাহাড়ী স্যানাল, রানী লছমির ভূমিকার ছায়া দেবী ও অনুরাধার ভূমিকায় কানন দেবীর মন-মাতানো অভিনয়ের কথা। সাপুড়েতেও নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন কাননদেবী আর সাপুড়েসর্দারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অসামান্য শক্তিশালী শিল্পী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। বিদ্যাপতির গাওয়া তাঁর অঙ্গনে আওভ যব রসিয়া গানটিতে তিনি যে আবহ সৃষ্টি করেছিলেন তা ভোলবার নয়। সাপুড়েতে গাওয়া আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই সম্পর্কেও একই কথা বলতে হয়। শেষের গানটি নজরুল যখন কানন দেবীকে শেখান সে-কথা বলতে গিয়ে বহুদিন পর কাননবালা লিখেছেন :

“শেখাতে শেখাতে বলতেন, মনে মনে ছবি এঁকে নাও নীল আকাশ দিগন্তে ছড়িয়ে আছে। তার কোনো সীমা নেই, দু’দিকে ছড়ানো তো ছড়ানোই। পাহাড় যেন নিশ্চিন্ত মনে তারই গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আকাশের উদারতার বুকে এই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোনোটা প্রকাশ করতে হলে সুরের মধ্যেও একটা আয়েশ আনতে হবে। তাই একটু ভাটিয়ালির ভাব দিয়েছি। আবার ঐ পাহাড় ফেটে যে ঝরনা বেরিয়ে আসতে তার চঞ্চল আনন্দ কেমন করে ফোটাবে? সেখানে সাদামাটা সুর চলবে না। একটা গীটকিরী গানের ছোঁয়া চাই। তাই ও-ও-অই বলে ছুটলো ঝরনার আত্মহারা আনন্দে। এমনই করে তিনি এই মেলানোর আনন্দ আমাদের হৃদয়েও যেন ছড়িয়ে দিতেন।”

এই যে উপরে যেসব কথা লিখলাম এসব কিন্তু সেদিন ত্রিশের দশকের শেষ দিকে জানতাম না এতসব সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতামও না। তবু একেবারে কিছুই যে বুঝতাম না তাও ঠিক নয়। বেশ মনে আছে যে প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি রজতজয়ন্তী সে সময় হাসির ছবির ক্ষেত্রে একটা বুদ্ধিদীপ্ত পরিশীলিত দিক-নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। ছবির নাম দেখে ভেবেছিলাম রজতজয়ন্তী বুঝি ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের শাসনকালের জয়ন্তী নিয়ে কোনো ছবি। কিন্তু বড়ুয়া সাহেব কি ওরকম ছবি করবেন? ছবিটি দেখার পর বুঝলাম যে ছবির সঙ্গে পঞ্চম জর্জের কোনো সম্পর্ক নেই। নায়ক-নায়িকার নামে ছবির নাম রাখা হয়েছে। রজত ও জয়ন্তী। অনাবিল সুন্দর আনন্দদায়ক হাসির ছবি। পরবর্তী সময়ে আরো বাংলা হাসির ছবি দেখেছি কিন্তু রজতজয়ন্তীর ব্যতিক্রমী চরিত্রের কথা আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্কুলজীবনে সিনেমা দেখা প্রসঙ্গে আরেকটা মজার ঘটনার উল্লেখ করি। ব্যাপারটা ছিল একদিক থেকে করুণও। আমি আর মুনীর ম্যাটিনি শো দেখতে গিয়েছি মুকুল সিনেমায়। ঢাকাতে তখন যতদূর মনে পড়ছে মাত্র পাঁচটি সিনেমা হলো ছিল। ‘মুকুল’, ‘রূপমহল’, ‘লায়ন সিনেমা’, ‘পিকচার প্যালেস’! আর রমনা অঞ্চলে ছিল ‘ব্রিটানিয়া’।

ওই হলেই আমি ও আমার ছোট ভাই মুনীর অনেক ইংরেজি ছবি দেখেছি। বহু প্রসিদ্ধ তারকার অভিনয় দেখে চমৎকৃত হয়েছি : রবার্ট টেইলর, ক্লার্ক গেবল, স্পেন্সার ট্রেসি, এরল ফ্লিন, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, মার্লিন ডিয়েট্রিচ, বেটি ডেভিস, গ্রেটা গার্বো, মেরিলিন মুনরো, জোন ফন্টেইন, এবং আরো কত কত অভিনেতা-অভিনেত্রী। ওই সিনেমা হলটির নাম ছিল ‘ব্রিটানিকা’। এখনই ওই রকম নাম খুব হাস্যকর মনে হয়। তখন কিন্তু কোনো কিছুই মনে হয়নি।

ব্রিটানিকায় দর্শক সংখ্যা খুব অল্প হতো। এখন ভাবি কেমন করে মালিক তার ব্যবসা চালাতেন। নিশ্চয়ই তার আয়ের অন্য উৎস ছিল। এটা ছিল তার একান্ত শখের কারবার। ব্রিটানিকাতে সিনেমা দেখতে গিয়ে একদিন একটা মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেদিন আবহাওয়া ভালো ছিল না। আকাশে ঘন মেঘ, মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সিনেমা দেখতে এসেছি আমি ও মুনীরসহ সর্বসাকল্যে পাঁচজন। ছবি শুরু হবার নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে মালিকের প্রতিনিধি আমাদের সামনে এসে করজোড়ে বললেন, আজ শো হবে না, আমরা যেন তাদের ক্ষমা করে দিই, পাঁচজন দর্শক খুবই কম সংখ্যক, এই টিকিট দিয়েই আমরা পরবর্তী যে কোনো দিন যে কোনো শো দেখতে পারব। কী আর করা, আমরা হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিলাম। সেদিন কী সিনেমা ছিল মনে নেই কিন্তু নাম করা একটা ফিল্ম যে ছিল, সে কথা বেশ মনে আছে।

সেখানে শুধু ইংরেজি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। যাই হোক আমি আর মুনীর মুকুলে মুক্তি ছবি দেখতে গিয়েছি। নিউ থিয়েটার্সের নতুন সাড়া জাগানো ছবি। আমাদের টিকিট কাটতে হয়নি। বাবা ঢাকা সদরের মহকুমা হাকিম হওয়ার সুবাদে পাস নিয়ে ছবি দেখতে ঢুকেছি। ভারি ভালো লেগেছিল। প্রমথেশ বড়ুয়া নায়ক, একজন চিত্রশিল্পী। নায়িকা কানন দেবী, বড়লোকের মেয়ে। কাহিনী, উপস্থাপনভঙ্গি, সংলাপ, ক্যামেরার কাজ, গান, পটভূমি নির্মাণ, অভিনয়, সবকিছুতে প্রমথেশ বড়ুয়ার সুরুচি, নিরীক্ষাপ্রবণতা ও কারিগরি নৈপুণ্যের সুস্পষ্ট ছাপ ছিল। সুন্দরভাবে ওই ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হয়েছিল। শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ি অরণ্য অঞ্চলে বাস করা এক সাধারণ মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। দিনের শেষে ঘুমের দেশের সেই বিখ্যাত গানটি পঙ্কজ মল্লিক অত্যন্ত আবেদনময়ভাবে পরিবেশন করেছিলেন ওই ছবিতে। মুনীর আর আমি তন্ময় হয়ে ছবি দেখেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝেই একটা দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা ও ভয় সব আনন্দ চুরমার করে ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের অস্থির করে তুলছিল। মুক্তি বেশ বড় ছবি। বোধহয় পাকা তিন ঘণ্টার। তখন ছিল শীতকাল। দিন ছোট। ছবি শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নেমে যাবে। আমাদের বাসা সেই মাহুতটুলিতে। সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় পৌছতেই হবে। এ আইনের কোনো ব্যতিক্রম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে পর্যন্ত আমাদের ছোটবেলার এই নিয়ম ছিল অলঙ্ঘনীয়। তাই ছবির শেষার্ধে আনুমানিক সাত আট মিনিট পরপরই হয় আমি নয় মুনীর আসন ছেড়ে বাইরে এসে হলের প্রবেশ পথের ওপর দিকে দেয়ালে টানানো ঘড়ি দেখছিলাম। তখন আমাদের নিজের হাতঘড়ি থাকার প্রশ্নই ছিল না। সেটা অবাঞ্ছিত বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ত। আমাদেরকে ওইভাবে একটু পরপর হলো ছেড়ে বাইরে বেরুতে দেখে গেটকিপার ব্যাপার কী জানতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা জরুরি কাজ আছে। একটা বিশেষ সময়ের মধ্যে বাসায় অবশ্যই পৌঁছতে হবে। সেদিন শেষ পর্যন্ত মুক্তি আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ দেখা সম্ভব হয়নি। মিনিট দশেকের মতো বাকি থাকতেই আমরা দু’ভাই হলো থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে সেই জনসন রোড থেকে মাহুতটুলির শরৎ চক্রবর্তী রোডে এসে পৌছাই। ভাগ্য প্রসন্ন। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও বাবা তখনো মাগরেবের নামাজ শেষ করে কাছে পরীবাগের শাহ সাহেবের মসজিদ থেকে বাসায় ফিরে আসেননি। আমরা ঝটপট কাপড়জামা বদলে বইপত্র নিয়ে যে যার পড়ার জায়গায় বসে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *