ভুবনঘরের নানাবাড়ি

ভুবনঘরের নানাবাড়ি

আমরা যখন নানাকে দেখি তখন তার অনেক বয়স হয়ে গেছে। তখন আইন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন ঐ ব্যবসায়। অনেক জমিজামা করা ছাড়াও তিনি ভুবনঘরের মতো অজপাড়াগায়ে নিজেদের থাকার জন্য চকমিলানো বিশাল এক অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। নানার কথা আমার খুব বেশি মনে নেই। ফরসা টকটকে রঙ ছিল তার। খুবই শান্ত প্রকৃতির, কোমল স্বভাবের, দয়ালু। খুব কম কথা বলতেন। সে তুলনায় নানী ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী, আলাপচারিতায় নিপুণ, স্নেহময়ী, প্রয়োজনে কঠোর শাসক। ভুবনঘরের নানাবাড়িতে অনেক আনন্দময় দিন কেটেছে আমাদের। বিশাল দোতলা বাড়ি, সে আমলের কথা অনুযায়ী বড় বড় উঁচু ছাদওয়ালা ঘর, চওড়া বারান্দা। দোতলার ঘরগুলোর সামনের দিকে বেশ খানিকটা ছাদহীন খোলা জায়গা, গোলাকার ভারী কলাম। দোতলায় উঠবার জন্য একটি সিঁড়ি বাইরের দিকে, এক পাশে, সে সিঁড়িটা একটু সরু। সেটা দিয়ে দোতলার বাইরের দিকের প্রথম ঘরটিতে উঠতে পারা যায়। আরেকটা সিঁড়ি অন্দরমহলের দিকে, অন্য পাশে চৌকি পাতা, ছোটদের খাবার ব্যবস্থা ওখানেই হতো। প্রায় ছ’ফুট উঁচু একটা মিটসেফ ছিল, তিন পাশে কাঠ, সামনে জাল, তারের। সকালে নাস্তা হতো এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, তার ওপর মামী কিংবা খালা কিংবা পরিবেশনকারী বুয়া ঢেলে দিতেন সোনালি রঙের টলটলে এক চামচ বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি। সঙ্গে পেতাম ডিম ভাজা, কখনো আলু ভাজি। রান্নাঘর সংলগ্ন চৌবাচ্চাটি ব্যবহৃত হতো মাছ জিইয়ে রাখার জন্য। তার মধ্যে মাছ ছাড়া বা রান্না করার জন্য তার মধ্য থেকে মাছ তুলবার দৃশ্য আমরা ছোটরা দেখতাম পরম কৌতূহলের সঙ্গে, নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে। রান্নাঘরের উল্টো দিকে, আঙ্গিনার অন্য প্রান্তে, একটা টিনের চাল দেয়া লম্বা ঘর ছিল। তার সামনে ছিল টানা বারান্দা। এখনো মনে আছে বারান্দায় একটা পাল্কী পড়ে থাকতে। বেশ ভালো অবস্থায়। নিশ্চয়ই কিছু দিন আগেও ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু আমরা কাউকে চড়তে দেখিনি। অন্দরমহলে বাড়ির চারপাশে কত গাছপালা। একটি বাতাবি লেবুর গাছ, এখনো যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। রান্না ঘরের উল্টো দিকে আঙ্গিনার এক প্রান্তে যে টানা ঘরটির কথা বললাম সেখানে বিশালাকার ডোল, মটকা ও অন্যান্য আধারে, মাটির ও বেতের, সঞ্চিত থাকত নানা প্রকার শস্য, প্রধানত ধান ও চাউল। বছরের খোরাকি। এক একটা ডোল এত বড় ছিল যে, তার মধ্য থেকে শস্য তোলার জন্য একটি ছোট ছেলেকে ঝুড়ি হাতে নিচে নামিয়ে দেয়া হতো। তার হাত থেকে বাইরে দাঁড়ানো একজন ঝুড়ি তুলে নিত। উঠোন পেরিয়ে একটুখানি ছায়া ঘেরা জায়গা ছাড়িয়ে ছোট্ট বাঁক নিতেই পুকুরঘাট। ঘাটের প্রবেশ পথে ছোট একটা দরজা। ঘাট ডান দিকে রেখে আরেকটু এগিয়ে গেলে বাড়ির পেছনের দিকের প্রবেশ পথ। এটা ছিল মূল ভবন থেকে অনেকটা দূরে। এর দরজা সাধারণত তালাবদ্ধ থাকত। আর সমস্ত বাড়ি ঘিরে ছিল উঁচু ইটের পাঁচিল। পুকুরটি ছিল বিশাল এবং গভীর। স্বচ্ছ টলটলে পানি, বাঁধানো ঘাট, চওড়া, পানির নিচে অনেক দূর পর্যন্ত সিঁড়ি নেমে গেছে। পুকুরের একটা ব্যবস্থা দেখে বেশ মজা পেতাম আমরা ছোটরা। ঘাটের এক পাশ দিয়ে মস্ত বড় একটা পাকা দেয়াল, থেকে অনেক দূর পর্যন্ত, পানির ভেতর নেমে গেছে ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়ে। উদ্দেশ্য পর্দার কাজ করা। পুকুরের বাঁ পাড় ও এই ঘাটের উল্টো দিকে ছিল গাছপালা, তার ওপাশেও বোধ হয় একটা প্রাচীর ছিল, ঠিক মনে পড়ছে না। তবে ডান পাড়ে ছিল পুরুষদের তথা বার বাড়ির ঘাট। ওই ঘাট থেকে ভেতর বাড়ির ঘাটকে আড়াল করে রাখার জন্যই ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়ে যাওয়া দেয়ালটি নির্মিত হয়। দেয়ালে শ্যাওলা পড়ে পড়ে একটা কোমল সুন্দর সবুজের প্রলেপ পড়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে নিচের দিকে। আমরা অনেক সময় ওই দেয়ালের উপরে চড়ে বসে ওপাশে পুরুষদের ঘাটে তাদের স্নান ও সাঁতার কাটার দৃশ্য দেখতাম। অলিখিত আইন মেনে তারা কেউ একটা বিশেষ সীমানার বাইরে সাঁতার কেটে এগিয়ে আসতেন না, যার ফলে স্নানরত মেয়েরা সর্বদা তাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকত। আমরা আট-দশ বছরের কয়েকটি ছেলেমেয়ে, মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরা, বেশির ভাগ সময় অন্দরমহলের এই ঘাটে প্রচণ্ড হৈ-হুল্লোড় করে স্নান করতাম। আমাদের মধ্যে দু’একজন ছিল আরো কম বয়েসের। ছোটরা যেন কখনো একা ঘাটে না আসে তা সুনিশ্চিত করার জন্য বাড়ির একজন বয়স্কা কাজের মহিলা আমাদের একটা সাংঘাতিক কাহিনী শুনিয়েছিলেন। কণ্ঠস্বর উঠিয়ে নামিয়ে, চোখ ছোট-বড় করে, কখনো দ্রুত লয়ে, কখনো দীর্ঘ বিরতি দিয়ে খুব নাটকীয়ভাবে তিনি কাহিনীটা বলেছিলেন। এই পুকুরে নাকি একটা অস্বাভিক জীব বাস করে। সিন্দুকের মতো দেখতে, উপরের দিকে একটা ডালা জাতীয় জিনিস আছে, যেন অতিকায় কাছিমের খোলস, মোটা শিকলের মতো হাত- পা, সাধারণত পুকুরের গভীর তলায় দিকে থাকে। তবে মাঝে মাঝে ভুস করে মাঝ পুকুরে ভেসে ওঠে, তখন উপরের ডালাটা একটু খুলে যায়। পানির জীব হলেও তার হয়ত কখনো-সখনো খাওয়ার দরকার হয়। অনেক দিন আগে ওই সিন্দুক প্রাণীটি একটি বছর ছয়েকের বাচ্চা ছেলেকে ডালা ফাঁক করে তার শিকল হাত দিয়ে নিজের ভেতরে টেনে নিয়েছিল। ছেলেটি অভিভাবকদের চোখে ধুলো দিয়ে এক নির্জন অপরাহ্ণে একা একা পুকুরের পানিতে নেমে দুষ্টুমি করছিল। ঘাটের সিঁড়িতে শুধু একটা শার্ট পাওয়া যায়, এছাড়া তার আর নাম- নিশানা কিচ্ছু কোথাও পাওয়া যায়নি। লোকজন নামিয়ে সারা পুকুর তোলপাড় করা হয়, কয়েকবার জাল টানা হয়, খোঁজ পাওয়া গেল না—সিন্দুক প্রাণীটিরও না। একটু বড় হয়ে অবশ্য বুঝতে পারি যে ওই সিন্দুক প্রাণীর বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তা ছিল নেহাৎই আজগুবি কল্পনার ফসল, ছোটরা যেন একা একা পুকুরে না আসে তা সুনিশ্চিত করার জন্য একটা বাজে কৌশল। কিন্তু তখন, ওই ছেলেবেলায়, সে কাহিনী শুনে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল, হাত-পা যেন সেঁধিয়ে গিয়েছিল পেটের ভেতর, নড়তে পারতাম না একটুও। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, সাধারণত গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটিতেই আমরা ভুবনঘর যেতাম, ওই পুকুরের গাছগাছালির ছায়া ফেলা শীতল জলের হাতছানি মনে যত আলোড়নই তুলতো না কেন, একা একা আমরা কেউ তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতাম না।

সেই সময় আমরা কত অসম্ভব কাহিনীই না শুনেছি, বেশির ভাগই বয়স্কা কাজের মহিলাদের কাছ থেকে। এর একটি কাহিনী আমার নানীকে নিয়ে। কিন্তু কাহিনীটা বলার আগে নানী সম্পর্কে দু’একটা কথা বলেই নিই। তখন নানীর বয়স ষাটের মতো। সামান্য বেশিও হতে পারে। দেহের বাঁধুনি শক্ত, গায়ের রঙ শ্যামলা, লম্বা নন, মুখশ্রীর বিবেচনাতেও সুন্দরী বলা যাবে না। কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, অসামান্য সাধারণ জ্ঞান, বিদ্যানুরাগ, যুক্তিবাদী মন এবং গরিব অসহায় মানুষের প্রতি গভীর মমতার জন্য তিনি ছোট-বড়, আত্মীয়-অনাত্মীয়, কাছের ও দূরের অজস্র মানুষের পরম শ্রদ্ধা ও অনুরাগের পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। বাংলা, আরবি ও উর্দু খুব ভালো জানতেন। ফারসিও কিছু কিছু। আমার মা-খালারা তাঁর কাছেই পড়াশোনা করেছেন নিজেদের ছোটবেলায়। সেই আধা-সামন্ত যুগের মানুষ হয়েও নানী কখনো কাউকে বিত্ত বা পেশা বংশমর্যাদার ভিত্তিতে উঁচু-নিচু জ্ঞান করতেন না। তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিল বিদ্বান ব্যক্তি। আমরা যখন নানীকে দেখি, যে সময়ের কথা আমার মনে আছে, তখন তিনি হজ্ব করে এসেছেন। ওই গণ্ডগ্রামে বসেও তখন তিনি কাজকর্ম ও হাঁটাচলার সুবিধার জন্য ষাটোর্ধ্ব বয়সে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ ওড়না পরতে শুরু করেছিলেন। এর ফলে কারো ভ্রূ উত্তোলিত হলো কিনা সেটা তাঁর জন্য কোনো বিবেচনা বিষয়ই ছিল না। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির অধিকারী, নারী শিক্ষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ, অত্যন্ত ধার্মিক কিন্তু সম্পূর্ণ গোঁড়ামিহীন ও অসাম্প্রদায়িক। রোজ সকালে নামাজ পড়ার পর তিনি অনেকক্ষণ ধরে কোরআন শরীফ পড়তেন। ভারি সুরেলা কণ্ঠ ছিল তাঁর।

ভুবনঘরে আমাদের নানাবাড়ির ছাদটা ছিল একটা ছোটখাটো ফুটবল মাঠের মতো। দোতলা থেকে ছাদে ওঠার সিঁড়িটা ছিল ভেতর বাড়ির দিক দিয়ে। ছাদের চারপাশের দেয়াল ছিল বেশ উঁচু। ছাদের কোনায় ছিল একটা মাঝারি আকারের চিলেকোঠা। সেখানেও ঢুকতে হতো দু’তিনটা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে, একটু উপরে উঠে। চিলেকোঠাটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো ছিল। ঘরের এক পাশে তাকের ওপর নানীর আরবি-ফারসি কেতাব ইত্যাদি, আত্মসমাহিত হয়ে আরাধনা করার জন্য সুনির্দিষ্ট স্থানে একটা জায়নামাজ পাতা, দু’চারটা মখমলের ঢাকনা দেয়া বালিশ। সব মিলে আমাদের ছোটদের কাছে মনে হতো এক রহস্যময় অপার্থিব পরিমণ্ডল। বিশেষ বিশেষ তারিখে নানী তাঁর ওই চিলেকোঠায় একা কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। তখন আমাদর ছাদে যাওয়ার বারণ থাকত।

আমার ছোটমামা, নানা-নানীর কনিষ্ঠতম, সন্তান, কী সুন্দর ছিলেন দেখতে। কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় মাত্র বিশ বছর বয়সে হঠাৎ রোগে পড়ে মারা যান। তাঁর বৃদ্ধ মা বাবার মনে সেই শোক যে কতখানি কঠিন আঘাত হেনেছিল তা সহজেই কল্পনা করা যায়। নানী ওই দুঃসময়ে মনের গভীর থেকে প্রচণ্ড অধ্যাত্মশক্তি তুলে এনে আশ্চর্যভাবে আত্মসংবরণ করেছিলন। তবু মাঝে মাঝে নির্জনে অবাধ্য অশ্রু তাঁর নিয়ন্ত্রণ মানত না। ওই রকম এক মুহূর্তে নানা নাকি নানীকে লক্ষ করে বলেছিলেন, এটা আমার মায়ের কাছে শোনা, নানা বলেছিলেন—আচ্ছা, আপনি কাঁদেন কেন, বিশ বছর তো ছেলেকে দেখেছেন। কত মা বাবা যে এই ভাগ্যটুকু থেকেও বঞ্চিত হয়। নানা-নানী পরস্পরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। বিয়ের প্রথম দিন থেকে শেষ পর্যন্ত।

কিন্তু নানীকে নিয়ে যে বিচিত্র কাহিনীটি শুনেছিলাম এবার তার কথা বলা যাক। বাড়ির এক পুরানো বৃদ্ধা পরিচারিকা আমাদের বলেছিলেন যে নানীর অনেক অলৌকিক ক্ষমতা আছে। ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ এনে তিনি বলেছিলেন, নানীর দুটি অনুগত জ্বিন আছে। নানী যখন চিলেকোঠায় বসে এবাদত- বন্দেগী করেন তখন মাঝে মাঝে ওরা তাঁর কাছে আসে।

আমরা প্রায়ই দুটি বিরাট আকারের দাঁড়-কাককে নানীর চিলেকোঠার ছাদের ওপর বসে থাকতে দেখতাম। ওই কাক দুটিই নাকি জ্বিন। কাকের রূপ ধরে আসে। কত সহজে কত কথাই যে তখন বিশ্বাস করতাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *