মায়ের কাছে শোনা গল্প
মায়ের কাছে শোনা আমার খুব ছোটবেলার দু’একটি গল্প বলি। আমি নাকি বেশ বেশি বয়স অবধি মাতৃদুগ্ধ পান করি। কিছুতেই অভ্যাসটা ছাড়ানো যাচ্ছিল না। একদিন বাবা অনেক আদর করে আমার কাছ থেকে সম্মতি ও প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন যে কাল থেকে আমি আর বুকের দুধ খাব না। তারপর যথাসময়ে প্রচণ্ড ক্ষুধায় আমি খাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। গরুর দুধ দেয়া হলো বোতলে করে, মুখেই তুললাম না। কান্না, জেদ, অস্থিরতা। শেষে মা নিরুপায় হয়ে বুকের দুধ দিয়েই আমার ক্ষুধা মিটাতে এগিয়ে এলেন কিন্তু তাও আমি মুখে নেব না। জেদ আর কান্না সমানে চলল কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় নাকি কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুম থেকে ওঠার পর গরুর দুধ দিতেই নির্বিবাদে তা খেয়ে নিই। এরপর আর কোনোদিন আমি মাতৃদুগ্ধ পান করিনি। মা নাকি দু’একবার কৌতূহলী হয়ে পরখ করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি মুখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। সেই নাকি আমার ভেতরকার জেদি চরিত্রের প্রথম প্রকাশ। এরই সূত্র ধরে মা আরেকটা গল্প বলেন। তখন আমার বয়স খুব সম্ভব সাড়ে তিন কি চার বছর। আমি মায়ের সঙ্গে কুমিল্লায় মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। মেজ মামা শহরের নামকরা উকিল। খুব রাশ- ভারি, আবার খুব শৌখিনও। ছাত্রাবস্থায় গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’—ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয় গান। এসব গল্প অবশ্য আমি বড় হওয়ার পর শুনেছি। মামার বাসায় ছিল সুন্দর গোলাপ বাগান। এক ছুটির দিনে মামা বারান্দায় বসে কি সব মামলার কাগজপত্র দেখছেন, আমার মা ওপাশে রান্নাঘরে তাঁর ভাবির সঙ্গে গল্প করছেন, আর আমি গুটি গুটি পায়ে বারান্দা থেকে নেমে বাগানের মধ্যে গিয়ে ফুল দেখে বেড়াচ্ছি। একটা ঝলেমলে প্রস্ফুটিত গোলাপের দিকে সবে হাত বাড়িয়েছি, এমন সময় হঠাৎ বারান্দা থেকে মামার অনুচ্চ কিন্তু গম্ভীর গলা ভেসে এল, ‘উঁহু, হাত দেয় না।’ আমি চমকে হাত সরিয়ে নিলাম; কিন্তু বাগান থেকে না উঠে এসে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর খুব ধীরে ধীরে আবার ফুলটির দিকে হাত বাড়াতেই আবারো মামার গলা, ‘আঃ!’ এবং এবার একটু জোরে। কখন দেখেন মামা? কিভাবে দেখেন? তাঁর কি তিনটে চোখ নাকি? নাকের ওপর চশমা এঁটে তো নিচু মুখে কাগজপত্রই দেখে যাচ্ছেন। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর আমি আবার ওই একই গোলাপ ফুলটির দিকে হাত প্রসারিত করেছি, আর অমনি মামা দ্রুত পায়ে বারান্দা থেকে নেমে এসে ‘কি হচ্ছে? বারণ করলাম না!’ বলেই আমার হাতটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে আমি তারস্বরে এমন চিৎকার করে উঠেছিলাম যে রান্নাঘর থেকে আমার মা মামি পড়ি কি মরি করে ছুটে এসেছিলেন, অন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন আমার নানি। তারপর আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে শান্ত করার কত চেষ্টা; কিন্তু আমার নাকি কাঁদতে কাঁদতে প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সে কি দুঃখে, ক্ষোভে, রাগে, অপমানবোধে? মার ধারণা, আর কিছু নয়, জেদ।
আমার প্রায় এই বয়সেরই আরেকটা গল্প। দুপুরবেলা। খাওয়া-দাওয়ার পর মা একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে শুয়েছেন। আমি বাড়ির শান বাঁধানো উঠানে বসে খেলছি। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে। মা দু’বার ডেকে বলেছেন, আমি যেন রোদ্দুর থেকে বারান্দার ছায়াতে কিংবা ঘরের মধ্যে চলে আসি। আমি কান দিইনি। মা বিছানা থেকে উঠে হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে এসেছেন। খানিকক্ষণ পর আমি আবার বাইরে চলে গেছি। বাইরে খেলতে খেলতে আপন মনে একটা শব্দ করার পর মা টের পেলেন আমি কোথায়। হঠাৎ খুব রেগে যান তিনি। দ্রুত বাইরে এসে আমার গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বললেন, “যা, এক্ষুনি ভেতরে যা। আমি মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মায়ের রাগ আরো বেড়ে গেল। তিনি আমার দু’কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে থাক এই রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, কক্ষনো ভেতরে যাবে না।’ এই কথা বলে তিনি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। তারপর বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েন কিংবা ভুলেই যান আমার কথা। বেশ কিছুক্ষণ পর ফের বাইরে এসে আমাকে দেখে মায়ের চক্ষু স্থির। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, মা আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে যেখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গায়। মুখ লাল, প্রায় অগ্নিবর্ণ, কপাল-গাল-চুল সব ঘামে ভিজে গেছে। পায়ের নিচে ফোস্কা পড়ে গেছে। মা আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে আমি বলেছিলাম, ‘কেন? তুমিই তো বলেছিলে এখানে যেন দাঁড়িয়ে থাকি, কক্ষনো যেন ভেতরে না যাই।
এসব ঘটনার কথা আমার কিছু মনে নেই।
আমার ছেলেবেলার টুকরো টুকরো, কিন্তু মোটামুটি স্পষ্ট, যেসব স্মৃতি আমার মনে আছে তা আমার সাত ও সাত-পরবর্তী বয়সের।