এন্ট্রান্স শেষে কলেজ
আমি ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা দিই ১৯৩৮ সালে কলেজিয়েট স্কুল থেকে। আমাদের সময় ম্যাট্রিকই বলা হতো, তখন সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার নামটি চালু হয়নি। ম্যাট্রিক পাস করা ব্যক্তিকে বলা হতো ম্যাট্রিকুলেট, যেমন বি.এ. পাসকে বলা হতো গ্র্যাজুয়েট। আমাদেরও আগে, আমাদের বাবা-কাকা-জেঠাদের সময়, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাকে বলা হতো এন্ট্রান্স পরীক্ষা। এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা নামটা বেশ অর্থবহ ছিল। এই স্তর অতিক্রম করার পরই শিক্ষার্থী প্রবেশ করত আসল জায়গায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে। মান্নান সৈয়দ তার একাধিক গ্রন্থে, ভূমিকা বা উপক্রমণিকার জায়গায়, প্রবেশিকা লিখেছে। আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে। প্রবেশিকার পরে পাঠক পৌঁছবেন আসল জায়গায়।
ম্যাট্রিকুলেট গ্র্যাজুয়েট ইত্যাদি প্রসঙ্গে আরেকটি কথা মনে আসছে। আমি কাউকে কাউকে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে শুনেছি ম্যাট্রিক বা বি.এ. পাকড অর্থাৎ ফেল। এরকম উত্তর দেয়া যে নিজের জন্য অগৌরবের, তার চাইতে এটা বলাই যে শ্রেয় আমি ম্যাট্রিক বা বি.এ. পর্যন্ত পড়েছি, এ জ্ঞানটুকু কেন হয় না মানুষের?
যাই হোক, আমি ম্যাট্রিক পাস করি ঢাকা বোর্ডের অধীনে। তখন সমগ্র পূর্ববঙ্গের জন্য একটি বোর্ডই ছিল। ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোর এই রকম চারটি বোর্ড ছিল না। আর ইন্টারমিডিয়েট স্তরও বোর্ডের অধীনে ছিল। তখন এই রকম চারটি বোর্ড ছিল না। আর ইন্টারমিডিয়েট স্তরও বোর্ডের অধীনে ছিল। তখন ওই নামই ছিল, হায়ার সেকেন্ডারি তথা উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি নাম প্রবর্তিত হয়নি।
ম্যাট্রিকে আমি মোটামুটি ভালো ফল করি। অঙ্ক ও আরবিতে লেটার মার্কস পেয়েছিলাম। ইংরেজি ও ভূগোলেও তার কাছাকাছি। মেধা তালিকায় ছিল সপ্তম স্থান। ইংরেজিতে বরাবরই ভালো ছিলাম। এর পেছনে আমার বাবার অবদান ছিল খুব বেশি। তিনি গ্রামের স্কুলে পড়েছেন কিন্তু ভালো শিক্ষক পেয়েছিলেন। শব্দ সম্ভার ও ব্যাকরণের দিক দিয়ে ভিতটা পাকা হয়েছিল। তারপর ইন্টারমিডিয়েট ও বি.এ. পড়েন আলীগড়ে। সেখানে ইংরেজি ভাষী দক্ষ অধ্যাপকের কাছ থেকে যে সৃজনশীল তালিম পান তাই ইংরেজি ভাষার ওপর তার দখলকে উঁচু স্তরে নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে অবশ্য যুক্ত হয়েছিল নিজের ধীশক্তি ও অধ্যবসায়। আমাদের মধ্যে বাবা ওই সব গুণ সঞ্চারিত করতে আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। আমার মনে আছে আমাদের ছাত্রজীবনে বাবা যখন অন্যত্র থাকতেন তখন তাঁর কাছে ইংরেজিতে চিঠি লিখতে হতো। তিনি আবার সেই সব চিঠিতে ভুল বা অপপ্রয়োগের জায়গাগুলো লাল পেনসিলে চিহ্নিত করে সংশোধনের পর আবার আমাদের ফেরত পাঠাতেন। আমাকে আর মুনীরকে। মুনীর সম্ভবত এই কারণেই বাবার কাছে খুব কম চিঠি লিখত
স্কুলজীবনে টেস্ট পরীক্ষার পরে, আর ফাইনাল পরীক্ষার আগে, দু’মাস ছাড়া আর কখনো আমার কোনো গৃহশিক্ষক বা প্রাইভেট টিউটর ছিল না। ওই দু’মাসের জন্য বাবা দু’জন গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করে দেন। অঙ্ক আর ভূগোলের জন্য। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে ওই দুটি বিষয় আমি নিজে থেকে পড়তে চাই না। ওই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার কেমন একটা ভীতি বা বীতরাগ আছে। তাই শিক্ষকের সামনে বসে দু’ঘণ্টা পড়ব, তাঁরা দেখে দেবেন, সাহায্য করবেন, পড়া ধরবেন, লেখার কাজ শুদ্ধ করে দেবেন, ব্যস। অঙ্কের শিক্ষক আসতেন সপ্তাহে চার দিন, ভূগোলের দু’দিন। কিছু দিনের মধ্যেই বিষয় দুটি সম্পর্কে আমার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেল। ওই দু’মাসে কত যে অঙ্ক, বীজগণিত আর জ্যামিতির কাজ করেছি তার মনে হয় ইয়ত্তা নেই। অঙ্ক পড়াতেন সুদর্শন তরুণ এক এমএসসি’র ছাত্র। বাবার স্কুলজীবনের জনৈক মাস্টার মশাইয়ের আত্মীয়। চমৎকার বুঝিয়ে দিতে পারতেন, আমাকে কাজ দিয়ে নিজে অন্য বই পড়তেন, মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইতেন। একদিন শুমি সুর ভাঁজছেন ঢাকায় নতুন আসা ছায়াছবি নিউ থিয়েটার্স-এর দিদির গান—স্বপন দেখি রাজার কুমার। ছবিতে সায়গল গেয়েছিলেন। আমিও ফিল্মটা দেখে এসেছিলাম কয়েকদিন আগে। অঙ্ক কষা থামিয়ে মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকাতেই তিনি সচেতন হয়ে গেলেন। তাঁর নাম আজ আর মনে নেই। পদবি ছিল খুব সম্ভব রায়। যেদিন তিনি পড়ানো শেষ করলেন বাবা একটা খামে একশো টাকা পুরে তাঁর হাতে দিলেন। সে সময় খুব একটা খারাপ সম্মানী ছিল না ওই অঙ্ক। কিন্তু তিনি কিছুতেই নিলেন না। বললেন, আমার বাবার মাস্টার মশায়ের সূত্র ধরে তিনি এই কাজটা করেছেন। তাছাড়া তিনি তো পেশাদার গৃহশিক্ষক নন, টিউশনি করেন না আর কোথাও, একটা প্রীতির সম্পর্কের জন্য আমাকেই পড়িয়েছেন শুধু। এরপর আর কথা চলে না। ওঁর কাছে আমার ওই দু’মাসের পড়া খুব কাজে এসেছিল।
ভূগোলের স্যারও খুব দক্ষ ছিলেন, তবে তিনি ছিলেন মাঝবয়সী, পেশাদার গৃহশিক্ষক, রাশভারি। কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতার গুণে কী ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে এবং কী ধরনের উত্তর লিখলে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে অতি উত্তম পরামর্শদাতা। তাঁর পড়াবার গুণেই আমি ম্যাট্রিকে ভূগোলে খুব উঁচু নম্বর পেয়েছিলাম।
ম্যাট্রিক পাস করার পর আই.এ. পড়বার জন্য ভর্তি হলাম ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। স্কুলজীবনে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের বিশাল সাদা স্তম্ভগুলো ও চওড়া কাঠের সিঁড়ি যেমন আমার মনে বিশেষ দাগ কেটেছিল, তেমনি এবার ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট কলেজের চওড়া গেট, বিশাল প্রাঙ্গণ, সাদা বিরাট দোতলা প্রাসাদের মতো বাড়ি, লম্বা করিডোর আর স্বপ্নের আমেজমাখানো গম্বুজ আমাকে মুগ্ধ করল। দু’বছর পড়ি ওই কলেজে। ওই সুন্দর বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর, এই অঞ্চলের লাটভবনের জন্য। পরে যখন চালু হওয়ার আগেই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত রদ হয়ে যায় তখন ওই ভবনের বিকল্প ব্যবহারের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে এক সময় এটি শিক্ষাঙ্গনে রূপান্তরিত হয়।
স্কুলজীবনের মতো কলেজ জীবনেও পড়াশোনার পাশাপাশি খেলা, আবৃত্তি, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে আমার প্রচুর উৎসাহ ছিল। পিংপং তথা টেবিল টেনিসে মশিহুর রহমানের কাছে হেরে যাই। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা আজও মনে আছে।