প্রিয় হিমাংশু
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে আমার সবচাইতে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল হিমাংশু নারায়ণ দত্ত নামক একটি হিন্দু ছেলের সঙ্গে। আমার বাবা ছিলেন আচারনিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। পাঁচ ওয়াক্ত ঠিক সময়ে নামাজ পড়তেন, যখনই সম্ভব হতো মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করতেন, চিরজীবন আচকান-পাজামা পরেছেন, মাথায় টুপি দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। তাঁর ছেলেবেলায় অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী ও বিদ্যানুরাগী কতিপয় হিন্দু প্রতিবেশী ভদ্রলোকের কাছ থেকে তিনি তাঁর ছাত্রজীবনে যে সাহায্য ও উৎসাহ লাভ করেছিলেন সেকথা বাবার মুখে বহুবার শুনেছি। হিমাংশু যখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে, আমাদের বাসায় প্রায় প্রতিদিনই আসছে, আমিও যাচ্ছি তার বাসায়, ওর মা-বাবা-ভাইবোনের কাছে একজন অতি পরিচিতজন হয়ে উঠেছি আমি, তখন তা নিয়ে আমার বাবা কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন হননি। আমার মা অবশ্য হিমাংশুর সামনে খুব আসতেন না। পর্দা করতেন তিনি। তবে হিমাংশু এসেছে শুনলেই তার জন্য ভেতর থেকে মা খাবার পাঠিয়ে দিতেন। আর আমি হিমাংশুর বাড়িতে খেয়েছি খুবই অন্তরঙ্গ পরিবেশে। ওর মা, মাথায় ঘোমটা, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ, নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করেছেন আমাকে।
হিমাংশুদের বাসা ছিল নবাবপুরে। এক সময় ওদের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল; কিন্তু ত্রিশের দশকের শেষদিকে পড়তির মুখে। বাবা কবিরাজ, তখনও কবিরাজি করেন, কিন্তু আর তা থেকে বিশেষ কিছু রোজগার হয় না। অর্থনৈতিক কারণেই হিমাংশু ইন্টারমিডিয়েটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। অথচ ও ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, মেধাবী, কষ্টসহিষ্ণু, পরিশ্রমী, আর প্রচণ্ড আত্মমর্যাদার অধিকারী। দারিদ্র্যের সঙ্গে সারা জীবন সংগ্রাম করেছে, একটার পর একটা ঝড় এসেছে জীবনে; কিন্তু কখনো ভেঙ্গে পড়েনি, কারো কাছে মাথা নত করেনি, সামান্যতম অবজ্ঞা বা অপমানের তীব্র প্রতিবাদ করেছে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুর দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে হারিয়ে দিল। কুষ্ঠ হয়েছিল তার। কয়েক বছর আগে কলকাতায় হিমাংশুর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি যখন কলকাতায় যাই তখন ওর ওখানে গিয়েছিলাম। ও তখন শয্যাশায়ী, মৃত্যুপথযাত্রী। আমার স্ত্রীও ছিলেন আমার সঙ্গে।
হিমাংশুর সঙ্গে আমার স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব কলেজ জীবন পেরিয়ে আমার কর্মজীবন ও সংসারজীবনকেও আলিঙ্গন করে। যতদিন ও বেঁচেছিল ততদিন পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অম্লান ছিল।
হিমাংশু চমৎকার ছবি তুলতে পারত। সুযোগ-সুবিধা থাকলে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে, সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা যদি সে লাভ করত, তাহলে সে যে এই উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রশিল্পী হতে পারত সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ওদের বাড়ির কাছেই ছিল সে সময়কার একটা নামকরা ক্যামেরা ও ফটোগ্রাফির বিভিন্ন সরঞ্জামের দোকান। ফটো তোলাও হতো সেখানে। নাম ছিল, খুব সম্ভব, ইংরেজিতে Dass অথবা Doss স্টুডিও। প্রথমদিকে এই স্টুডিওর কিছু সহযোগিতা পেয়েছিল হিমাংশু। তাও ছিল অনুদার এবং স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু ওইটুকুই হিমাংশু তার নিষ্ঠা ও প্রতিভা দিয়ে কাজে লাগিয়েছিল। ওর ঝোঁক ছিল নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে। আজ এসব কাজ খুব সাধারণ মনে হয়, নিত্য দেখি, কিন্তু চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় তা অভিনব ছিল। নানারকম আলোছায়ার খেলা, সিলুয়েট, ফুলের মধ্যে মানুষের মুখ, সুপার ইম্পোজ করা মন্তাজ ধরনের ছবি, সাবজেক্টের অসতর্ক মুহূর্তের ঘরোয়া ছবির পাশাপাশি যত্ন সহকারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী মহড়া দিয়ে কম্পোজ করা আনুষ্ঠানিক ছবি প্রভৃতি সব ধরনের কাজে হিমাংশুর ছিল যেমন উৎসাহ তেমনি দক্ষতা। জীবিকা অর্জনের তাগিদে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সে ছবি তোলাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পুরানা পল্টনে একটা রাস্তার মোড়ে এক ভদ্রলোকের অব্যবহৃত মোটর গ্যারেজকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে হিমাংশু সেখানে দোকান খুলেছিল। নাম দিয়েছিল ‘মাই স্টুডিও’। আমার বয়সী কারো কারো হয়তো আজও মাই স্টুডিওর কথা মনে আছে। ওই ছোট টিনের ঘরেই ছিল তার ডার্করুম, যাবতীয় আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম, নিজের তোলা চমৎকার কিছু ছবির ডিসপ্লে। কোনো পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল না সে। সাংবাদিক হিসেবে ছিল অজ্ঞাতপরিচয়। সম্পূর্ণত ফ্রিলান্সার। লোন উলফ। কিন্তু গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী, নিপুণ আলাপচারী হিমাংশু ছিল খুবই আত্মপ্রত্যয়ী। ওই অল্প বয়সে শুধু নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে সে সকল প্রোটোকল ভেঙ্গে কঠিন জায়গায় গিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলে আনতো। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে আলাপ করে অনেক সময় একটা ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও সক্ষম হতো। এইভাবে সে কী রকম করে হকির যাদুকর ধ্যান চাঁদ, আমাদের উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরোজিনী নাইডু, শেরে বাংলা ফজলুল হক প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, তাদের ছবি তুলেছিল, প্রদীপ্ত চোখে সে তার গল্প করেছে আমার কাছে। হিমাংশু আমাকে একদিন নিয়েও গিয়েছিল ধ্যান চাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়ার জন্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ধ্যান চাঁদ ছিলেন ঢাকাতে মোতায়েন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সদস্য। সেদিনের কুর্মিটোলায় সেনাবাহিনীর একটি খেলার মাঠের পাশে আমার দেখা হয়েছিল ধ্যান চাঁদের সঙ্গে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হকি খেলোয়াড় হিসেবে তখন তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। কিন্তু ধ্যান চাঁদকে দেখে বা তাঁর সঙ্গে কথা বলে সেটা বোঝার উপায় ছিল না। সরোজিনী নাইডুর সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি কংগ্রেস আয়োজিত একটি রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ প্রাঙ্গণে স্বাধীনতা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে একটি চমৎকার উদ্দীপনাময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। এসব প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। শেরে বাংলার ছবি তোলা প্রসঙ্গে হিমাংশু আমাকে একটি মজার কাহিনী শুনিয়েছিল। সে একদিন শেরে বাংলার বাসায় গিয়েছে। আগে থেকে দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল। হমাংশু বসবার ঘরে আসন গ্রহণ করে খবর পাঠাতেই ফজলুল হক এসে হাজির হলেন। দু’এক কথা বলার পর হিমাংশু তার ক্যামেরা ঠিক করে ছবি তুলতে উদ্যত হলো। তক্ষুনি শেরে বাংলা হাত তুলে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আগে একটু সেন্ট মেখে আসি, কী বলো? বলেই সেই পুরোনো রসিকতাতে তাঁর বিখ্যাত ছাদ ফাটানো হাসি।
যে সময়ের কথা বলছি তখন আমরা থাকি মাহুতটুলির শরৎ চক্রবর্তী রোডে। তখন হিমাংশু প্রায় প্রতি বিকেলেই হেঁটে কিংবা সাইকেলে ওদের নবাবপুরের বাসা থেকে আমাদের বাসায় চলে আসত। ও না এলে আমি যেতাম। ছুটির দিনে ও চলে আসত। সকাল ন’টার মধ্যে। তারপর কত গল্প যে আমরা করতাম। কিসের গল্প তা আজ মনেও নেই। সম্ভবত স্কুলের গল্প, বন্ধু-বান্ধবদের কথা, নতুন পড়া বইয়ের আলোচনা, খেলার হারজিত ইত্যাদি। তবে সময় যে কিভাবে গড়িয়ে যেত দু’জনের কেউ-ই তা টের পেতাম না। শেষে যখন দুপুরের খাওয়ার সময় এগিয়ে আসত তখন হিমাংশু উঠে পড়ত, আমি তাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের বিশাল বটগাছটার কাছে গিয়ে থামতাম, তখন ও বলত, তুই এতটা পথ একা যাবি? চল, তোকে বাসায় পৌঁছে দিই। কতদিন এইভাবে যে আমরা আসা-যাওয়া করেছি তার ইয়ত্তা নেই। এখনো কি দুই কিশোরের মধ্যে এরকম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে? নিশ্চয়ই ওঠে, শুধু আমরা জানতে পারি না।