কলেজিয়েট স্কুলে

কলেজিয়েট স্কুলে

১৯৩৫-এ আমরা পিরোজপুর থেকে চলে আসি ঢাকায়। বাবার বদলির কারণে। বাবা বদলি হয়ে এসেছেন ঢাকা সদর দক্ষিণের মহকুমা হাকিম হয়ে। বাসা নেয়া হলো শরৎ চক্রবর্তী রোডে, মাহুতটুলিতে। আর্মানিটোলা স্কুলের কাছে। নতুন তৈরি সুন্দর দোতলা বাড়ি। নাম জোবেদা মহল। বেশ ক’বছর ছিলাম আমরা ওই বাড়িতে। আর্মানিটোলা স্কুল বাড়ির কাছেও হলেও আমরা দু’ভাই, আমি ও মুনীর, ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে।

বাসা থেকে স্কুলে বেশিরভাগ সময় হেঁটে যেতাম, মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়িতে, ভাড়া দিতে হতো দু’আনা। তখন ঘোড়ার গাড়ি ছিল ঢাকার প্রধান যানবাহন। গাড়োয়ানরা ছিল, যাদের বলা হতো, কুট্টি সম্প্রদায়ের লোক। তারা বাংলা, উর্দু, হিন্দি মিশিয়ে এক বিচিত্র ভাষায় কথা বলত, অসামান্য ছিল তাদের চটজলদি মন্তব্য করার ক্ষমতা ও রসবোধ। ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীরা বাইরে আসতেন ঘোড়ার গাড়ির খোঁজে, গন্তব্যে যাবার জন্য। এ প্রসঙ্গে সুপরিচিত একটি রসিকতা আছে। জনৈক যাত্রী ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করছে—কি হে, মাহুতটুলি যাবে নাকি? গাড়োয়ান জানালো, যামু না কেন, ছাব, যাওয়ানের লাইগাই তো আছি। তো, কত ভাড়া নেবে? আপনিই কন, ছাব। চলো তাহলে, দু’আনা পাবে। গাড়োয়ান প্রথমে নিজের মুখ ও তারপর নিজের কান চেপে ধরে, তারপর ঈষৎ নিচু গলায় বলে, কন কি ছাব, ঘোড়া ভি হাসবো!

পূর্ব বাংলার স্কুলগুলোর মধ্যে তার খুব নামডাক তখন। আর্মানিটোলা, পোগোজ, মুসলিম হাই, সেন্ট গ্রেগরিজ প্রভৃতিও তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে কলেজিয়েট স্কুলে পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। সাধারণত হেঁটেই স্কুলে যেতাম। দূরত্ব খুব কম ছিল না। বাসা থেকে বেরিয়ে গলিপথ ধরে শর্টকাট করে গেলেও প্রায় মাইলখানেক হাঁটতে হতো; কিন্তু কোনো কষ্ট বোধ করতাম না। কালেভদ্রে, বিশেষ করে বৃষ্টিবাদলার দিনে, ঘোড়ার গাড়িতে যেতাম। দু’ঘোড়ায় টানা বাক্সের মতো গাড়িই তখন ঢাকার প্রধান যানবাহন। সামনে উঁচুতে কোচোয়ানের বসার জায়গা, গাড়ির ভেতরে মুখোমুখি দু’জন করে চারজন বসতে পারে, পেছনের পা-দানিতে একজন দাঁড়াতে পারে, আর প্রয়োজনবোধে কোচোয়ানের পাশে ঠাসাঠাসি করে একজন বসতেও পারে। ছাদে দড়ি দিয়ে বেঁধে ট্রাঙ্ক-বিছানা ইত্যাদি নেয়া যায়। এই ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া ছিল অবিশ্বাস্যরকম কম। আমরা মাহুতটুলি থেকে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে আমাদের স্কুলে যেতাম তিন আনা দিয়ে, অর্থাৎ আজকের দিনের বিশ পয়সার মতো। ভিক্টোরিয়া পার্ককে তখন স্থানীয় লোক বা সাধারণ মানুষ অনেক অনেক সময় বলত আণ্ডাগোড়ার ময়দান। পরে প্রশ্ন করে এই নামের একটা সম্ভাব্য কারণ আবিষ্কার করেছি, তবে তা সত্য নাও হতে পারে। ওখানে নাকি সাহেবেরা ঘোড়ায় চড়ে ডিমের মতো ছোট শাদা বল দিয়ে পোলোর ক্ষুদ্র সংস্করণের খেলা খেলতেন। সেই জন্যই ঘোড়ার অপভ্রংশ হয়ে আণ্ডাগোড়ার ময়দান। ওই পার্কেরই বর্তমান নাম বাহাদুর শাহ পার্ক, সিপাহি বিপ্লবের স্মৃতি ধারণ করে আছে তা।

এই ময়দানের মুখের সামনেই ছিল কলেজিয়েট স্কুলের ঐতিহ্যবাহী বিশাল দোতলা ভবনটি। এখন আর তা আগের খান্দানী ভারিক্কি রূপ নিয়ে সে অবস্থায় নেই।

ঢাকায় কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ভবন, তার বড় বড় স্তম্ভ, দোতলায় উঠে যাবার জন্য চওড়া কাঠের সিঁড়ি, ঘোরানো বারান্দা, শ্রেণী কক্ষের আকার ইত্যাদি দেখে মনের মধ্যে একটা চমক লাগে।

আমাদের স্কুলের অসম্ভব মোটা থামগুলো প্রথম দিনই আমার কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দোতলায় উঠবার সিঁড়ি ছিল খুব প্রশস্ত, আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনে মধুর ক্যান্টিনের দিক থেকে দোতলায় উঠবার যে সিঁড়ি তার অন্তত চারগুণ বেশি চওড়া ছিল আমাদের স্কুলের ওই সিঁড়ি। আর সিঁড়ি ছিল কাঠের।

আমাদের স্কুলের নাতিদূরেই ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। বেশ বড় নদী, চমৎকার টলটলে প্রবহমান স্রোত দিনমান কত ধরনের নৌকা তার ওপর দিয়ে দু’দিকে বয়ে চলে ছোট পানসি নৌকা, ছইওয়ালা বড় বজরা নৌকা, কোনো কোনো বজরার নিচের তলায় বসবার জন্য জানালার পাশের বেঞ্চি ছাড়াও চেয়ার টেবিল আছে, আর দোতলায়ও ঘেরদেয়া জায়গায় চেয়ার টেবিল আরামকেদারাসহ আছে আরাম করার বিবিধ সুব্যবস্থা। বুড়িগঙ্গার এপারে হলো ঢাকার নবাববাড়ি, আহসান মঞ্জিল, আর ওপারে বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য এলাকা, যার নাম জিঞ্জিরা। এপারে, অর্থাৎ ঢাকার দিকে, নদীতীর ছিল চমৎকার ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা, নাম ছিল বাকল্যান্ড বাঁধ, একটু পর পরই বসবার জন্য পাকা বেঞ্চ, পেছনে হেলান দেবার ব্যবস্থা আছে, দু’পাশে হাতলেরও। বুড়িগঙ্গার তীর ছিল সেদিনের ঢাকাবাসীর অন্যতম বেড়াবার জায়গা। তারা সকালে- বিকালে প্রভাতী ও সান্ধ্যভ্রমণের জন্য দলে দলে বুড়িগঙ্গার তীরে আসতেন, সব বয়সের মানুষ, কিশোররা থেকে যুবক-প্রৌঢ়-বৃদ্ধরা পর্যন্ত। তবে মেয়েদের দেখা যেত না, গেলেও কদাচিৎ। বুড়িগঙ্গায় আমার কৈশোরকালে আমি যে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা দেখেছি তার কথা কখনো ভুলব না। লম্বা লম্বা নৌকা, বিশ-বাইশ জন করে মাল্লা, অপূর্ব ছন্দে তারা বলিষ্ঠ হাতে তাদের বৈঠা চালায়, বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ জল কেটে নৌকা ছুটে চলে তীরের বেগে, কূলে দাঁড়িয়ে যার যার নৌকার সমর্থকরা চিৎকার করে, নানা রকম ধ্বনি তুলে, ঢোল বাজিয়ে তাদের নৌকার মাল্লাদের উৎসাহ দিতে থাকেন। কোথায় গেল সেই নৌকা বাইচ। আজ কী হাল হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদীর। বুড়িগঙ্গার এই করুন হাল দেখেই “চারশো বছরের ঢাকা” উৎসব উদযাপনের জন্য গঠিত নাগরিক কমিটি তাদের স্লোগান নির্বাচন করেছে “বুড়িগঙ্গা ঢাকার প্রাণ, বুড়িগঙ্গাকে আমরা বাঁচাবোই।”

অষ্টম শ্রেণী ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল আমাকে। জনাবিশেক ছিলাম আমরা। ভর্তি করা হবে মাত্র চারজনকে। লিখিত পরীক্ষা অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা ও সাধারণ জ্ঞান। ভয়ে বুক দুরু দুরু করছিল। মফস্বল থেকে এসেছি আমি। ঢাকা শহরের স্মার্ট ছেলেদের চালচলনই আলাদা, যেন চোখেমুখে কথা বলছে। ভর্তি হতে যদি না পারি? শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কানের পাশ ঘেঁষে গুলি চলে গেছে। ভর্তি পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছি। নার্ভাসনেসের জন্য ঠিকমতো উত্তর লিখতে পারিনি, নইলে সব প্রশ্নের উত্তরই জানতাম। পরে পড়াশোনার পদ্ধতিটা ঠিকমতো রপ্ত হয়ে যাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বার্ষিক পরীক্ষা দিই, আজ যে পরীক্ষার নাম এসএসসি পরীক্ষা। ঢাকা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা হয়। তখন সারা পূর্ব বাংলায় একটা বোর্ডই ছিল। ম্যাট্রিকে আমি মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করি। এর পেছনে স্কুলের শিক্ষকদের অবদান ছিল অনেকখানি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *