পিরোজপুরের মজার অভিজ্ঞতা

পিরোজপুরের মজার অভিজ্ঞতা

তিরিশের দশকের প্রথমার্ধে পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার কিছু কিছু স্মৃতি আজও মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। অমিয় বলে একটি ছেলে ছিল। গৌরবর্ণ, একহারা চেহারা। চমৎকার কাবাডি খেলত। বাইরে থেকে তাকে দেখে মনে হতো না যে তার গায়ে খুব জোর আছে। কিন্তু বেশ শক্তিশালী ছিল সে। তার চাইতেও বড় কথা, অমিয় ছিল খুব ক্ষিপ্রগতি ও কুশলী। চোখের পলকে প্রতিপক্ষের অঙ্গনে গিয়ে একজনকে ছুঁয়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে এঁকেবেঁকে পিছলে নিজের এলাকায় ফিরে আসত। আর একটি ছেলে ছিল, নাম হীরালাল। দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হতো। দেহের তুলনায় মাথাটা ছিল মস্ত বড়ো। পড়ালেখায় ভালো ছিল না। তাকে আমরা ডাকতাম মোটামাথা বলে। দুই অর্থে। সাধারণত রাগ করত না, তবে মাঝে মাঝে খুব ক্ষেপে যেত।

পিরোজপুরের স্কুলজীবনের একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা আমি কখনো ভুলব না। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। সামনেই স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান হবে, পরীক্ষায় যারা প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হয়েছে তারা পুরস্কার পাবে, ছেলেরা আবৃত্তি করবে, দু’একজন গান গাইবে। আমি আবৃত্তিতে অংশ নেয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছি। যে ছেলেটি স্কুলের পরীক্ষায় আমার ক্লাসে প্রথম হতো সে, আর আমি, আমরা দু’জনে গলা মিলিয়ে এক সঙ্গে দ্বৈত আবৃত্তি করব। একটা ইংরেজি কবিতা। প্রার্থনা জাতীয়, ধর্মীয় অনুভূতিপূর্ণ। খুব সম্ভব প্রথম চরণটি ছিল : এ্যাবাইড বাই মি, লর্ড। জোর মহড়া চলছে। এই উপলক্ষে বরিশাল থেকে প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন বাখরগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, একজন বাঙালি হিন্দু আই.সি.এস. অফিসার।

আমাদের ক্লাসের ইংরেজির শিক্ষক আমার সঙ্গী আর আমাকে খুব যত্নের সঙ্গে তালিম দিয়েছেন। কিভাবে দাঁড়াতে হবে, কোথায় একটু থামতে হবে, আবৃত্তির সময় কোথায় একটু ঝোঁক পড়বে, সব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমরা মঞ্চে উঠে শ্রোতৃমণ্ডলীর দিকে মুখ করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুক্তকর বুকের কাছে ঠেকিয়ে নম্র উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করব। খুব ভালো করে শিখলাম আমরা। আমাদের আবৃত্তি যে ভালো হবে স্যার সে বিষয়ে নিশ্চিত হলেন

কিন্তু অনুষ্ঠানের মাত্র দু’দিন আগে হঠাৎ ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। তার জন্য আমি, আমার সহপাঠী ও সহআবৃত্তিকার, আমাদের স্যার, কেউ-ই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বাবা মহকুমা হাকিম হিসেবে পদাধিকারবলে ছিলেন স্কুলের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট। মঞ্চে প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসকের পাশেই বসবেন তিনি। তাঁর বোধহয় মনে হলো, আমি তাঁর পুত্র, আমি কেমন আবৃত্তি করব সেটা তাঁর একটু পরীক্ষা করে দেখা উচিত। তিনি আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন কেমন তৈরি হয়েছি আমি। যেন আমি সত্যি অনুষ্ঠানে সবার সামনে পরিবেশন করছি এমনভাবে আমাকে গোটা কবিতাটি আবৃত্তি করতে বললেন তিনি। আমি সঙ্গে সঙ্গে সপ্রতিভভাবে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে দুটি হাত জড়ো করে কোথাও একটু হোঁচট না খেয়ে সুন্দরভাবে টানা আবৃত্তি করে গেলাম। একেবারে গোড়াতেই আধেক আঁখির কোণ দিয়ে আমি চকিতে একবার লক্ষ করেছিলাম যে বাবার ভ্রূ দুটি কুঁচকে গেছে কিন্তু তারপর আর সেদিকে নজর দিইনি, তিনিও কোনোরকম বাধা দেননি। কিন্তু আবৃত্তি শেষ হওয়ার পর যা ঘটলো তা চমকপ্রদ।

বাবা আবৃত্তি শেষ হলে আমাকে জিগ্যেস করলেন আমি কবিতাটির অর্থ বুঝেছি কিনা এবং বুঝে থাকলে তা ব্যাখ্যা করে তাঁকে বলতে বললেন। আমি বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে বললাম যে কবিতাটিতে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে আবেদন জানাচ্ছি তিনি যেন সর্বদা আমাদের সঙ্গে থাকেন, আমাদের শুভ ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন, সবসময় যেন আমাদের দিকে তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আমি যে কবিতাটি ঠিকমতো বুঝেছি, ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছি সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না; কিন্তু তবু বাবার মুখ গম্ভীর কেন? খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম আমি।

বাবার পরের প্রশ্ন : এটা কি রকম কবিতা? আমি উত্তর দিলাম, প্রার্থনাজাতীয় কবিতা। ধর্মীয় কবিতা।

আমাদের পরবর্তী সংলাপ এই রকম।

বাবা : তোমার ধর্ম কী? তুমি কোন্ ধর্মাবলম্বী?

আমি : বারে, আমার ধর্ম তো ইসলাম। আমি মুসলমান।

বাবা : তবে? কোনো মুসলমান ওইভাবে প্রার্থনা করে? বুকের কাছে হাত জড়ো করে, পাতায় পাতায় হাত মিলিয়ে, আঙুলগুলো একটার ওপর আরেকটা চেপে ধরে? নামাজের পর একজন মুসলমান যখন আল্লাহর কাছে কিছু চায় তখন সে কিভাবে মোনাজাত করে, কিভাবে হাত রাখে, তুমি তা জান না?

আমি সরু গলায় মিনমিন করে জবাব দিয়েছিলাম যে মহড়ার সময় আমাদের শিক্ষক এইভাবেই শিখিয়েছেন। বাবা গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিলেন যে একজন মুসলমান যেভাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে আমিও ঠিক সেইভাবে হাত রাখব, এতে যেন কোনো ভুল না হয়। তারপর তিনি যা বললেন, তার হাস্যকর দিকটি কিন্তু ওই অল্প বয়সেও আমাকে চমৎকৃত করেছিল। তিনি কঠোর মুখ করে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘আরে, বোকা, তুই তো সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চাইছিস, তাই না? তা হাত দুটি যদি ওইভাবে জুড়ে রাখিস তাহলে সৃষ্টিকর্তা যদি তোকে কিছু দেনও তুই তো তা হাতে নিতে পারবি না। কিছু হাত পেতে নিতে চাইলে হাত মেলে ধরতে হবে না? যেমন আমরা নামাজ-শেষে মোনাজাত করার সময় করি। ঠিক?’

আমি ওই সময় বাবাকে কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারিনি যে আমরা অনেকেই সাধারণত যেভাবে মোনাজাত করি তাতেও দু’হাতের মাঝে যে ফাঁক থাকে তা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার দেয়া দ্রব্যসামগ্রীর প্রায় সবটুকুই গলে পড়ে যাবে। কিন্তু বাবার নির্দেশ অমান্য করার কথা আমরা ভাইবোনেরা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না।

এবার ওই আবৃত্তি অনুষ্ঠানের অবস্থা শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল সে কথা বলি। অনুষ্ঠানের আগের দিন চূড়ান্ত মহড়া হচ্ছে। স্যার আমাকে এতদিন ধরে শেখানো ভঙ্গি বাদ দিয়ে হঠাৎ মোনাজাতের মতো দু’হাত তুলে আবৃত্তি করতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আমি যখন কারণটা বললাম তখন তিনি চুপ করে গেলেন। তাঁর চোখে বোধহয় একটা দৃশ্য ভেসে উঠেছিল। দুটি ছেলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একটা ইংরেজি কবিতার দ্বৈত আবৃত্তি পরিবেশন করছে। একটি ছেলের হাত বন্দনার মতো বুকের কাছে একত্রে জড়ো করা, আরেকটি ছেলের হাত সামনে মোনাজাতের ভঙ্গিতে প্রসারিত। কী রকম দেখাবে দৃশ্যটা? শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন যে কাউকেই হাত তুলতে হবে না। দু’জন আবৃত্তিকারই দু’পাশে দু’হাত লম্বা করে ঝুলিয়ে দিয়ে গলা মিলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যথোপযুক্ত আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করবে। তাই করেছিলাম আমরা। খুব ভালো হয়েছিল আবৃত্তি। প্ৰধান অতিথি প্রশংসা করেছিলেন আমাদের উচ্চারণের ও সার্বিক পরিবেশন ভঙ্গির। আজ মনে হচ্ছে বাবা যদি মহকুমা হাকিম না হতেন তাহলে হিন্দু-মুসলমানের কোনো কোনো আচরণ বিধিতে যে বহিরঙ্গের ভিন্নতা, যা প্রকৃত বিচারে তুচ্ছ—তাকে কেন্দ্র করেই হয়তো একটা জট পেকে উঠতো এবং ব্যাপারটার এত সহজ নিষ্পত্তি হতো না।

যে সময়টার কথা বলছি সেটা ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর সময় পেছনে পড়ে থাকা মুসলমান সমাজ তখন তাদের প্রতি নানাক্ষেত্রে অবিচার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তার স্বাতন্ত্র্যবোধ উদ্দীপ্ত হচ্ছে, নিজের অধিকার অর্জনের জন্য তার মধ্যে একটা সংগ্রামী অনুভূতিও জেগে উঠেছে। কেউ কেউ এটাকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন, আবার কেউ কেউ এর মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবোধের স্ফুরণ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের ইতিবাচক বোধগম্য ছিল না; কিন্তু পরে বড় হয়ে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

আমার বাবার মধ্যে আমি কখনো সাম্প্রদায়িকতা দেখিনি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। ঠিক সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, প্রতিদিন ভোরে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতেন, সারাজীবন আচকান-পাজামা পরেছেন, মাথায় দিতেন লাল তুর্কি ফেজ, যাকে আমরা রুমী টুপি বলতাম, কেন তা আজও জানি না। দপ্তরে, সায়েব- সুবোদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সভা-সমিতিতে, কলকাতায় লাটভবনে সরকারি সম্মেলনে, সর্বত্রই তাঁর ছিল ওই এক পোশাক। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পরও। আবার অন্যদিকে বেদ গীতা উপনিষদ ও রামায়ণ মহাভারত সম্পর্ক তিনি ভালোরকম অবহিত ছিলেন। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের অনেক মানবতাবাদী চমৎকার বক্তব্য তাঁর মুখস্থ ছিল। শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় তিনি তা উচ্চারণ করতে পারতেন। বাইবেলও তাঁর পড়া ছিল ভালো করে। সংস্কৃত ভাষায় বাবার উচ্চারিত কিছু কিছু প্রবাদবাক্য আজও আমার কানে বাজে। ‘পুঁটিমাছের মতো ফরফর করা’, ‘শতবার ধুলেও কয়লার ময়লা মুছে না যাওয়া’, ‘পিতা ধর্ম পিতা স্বর্গ পিতাই পরম তপস্যার বস্তু’, ‘মা আর মাতৃভূমি স্বর্গের চাইতেও বড়’—এসব তিনি ঘরোয়া আলাপ-আলোচনার সময় এমন যুতসইভাবে প্রয়োগ করতেন যে তা মনের মধ্যে গভীরভাবে গেঁথে যেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *