বগুড়া থেকে পিরোজপুর
১৯৩০ সালের কথা। বাবা তখন বগুড়ায় মহকুমা হাকিম। আমি পড়ালেখা করতে শুরু করেছি, কিন্তু তখন পর্যন্ত স্কুলে ভর্তি হইনি। বাড়িতেই পড়ি। বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই পড়া নেন, হাতের লেখার উন্নতি হচ্ছে কিনা দেখেন। হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য তিনি একটা চমৎকার কাঠের ফ্রেমে অ আ ক খ সুন্দর হস্তাক্ষরে খোদাই করে দিয়েছিলেন, তার ওপর পেনসিল বুলিয়ে অভ্যাস করতাম আমি। খুব জোর দেয়া হতো শুদ্ধভাবে চেঁচিয়ে পড়ার ওপর, যতি এবং ঝোঁক এমনভাবে দিতে হবে যেন অর্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বানান যেন ভুল না হয়, আর হাতের লেখা শুধু যেন পরিচ্ছন্নই হয় না, রীতিমতো আকর্ষণীয় হয়। জোর দেয়া হতো কবিতা মুখস্থ করার ওপরও। ছোট পাখি ছোট পাখি কোথা যাও নাচি নাচি কিংবা সকালে উঠিয়া মনে মনে বলি-র মতো কবিতা প্রায়ই আবৃত্তি করে শোনাতে হতো বয়স্ক অতিথি অভ্যাগতদের। অনেক সময় খুব খারাপ লাগত। এখন সচেতনভাবে নাতি-নাতনিদের এরকম পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে না দিতে চেষ্টা করি আমি।
বগুড়ায় আমার সাত-আট বছর বয়সের জীবনের কিছু কৌতূহলোদ্দীপক স্মৃতি আছে। এক বানরওয়ালা আসত, ডুগডুগি বাজিয়ে সে তার বানরের খেলা দেখাতো। বানরের পরনে থাকত লাল জামা, মাথায় ছোট একটা টুপি। প্রভুর নির্দেশ অনুযায়ী বানরটি ঘুরে ঘুরে নাচতো, হাততালি দিত, ডিগবাজি খেত, সালাম করত এবং শেষে হাত পেতে পয়সা চাইত।
আমাদের বাড়ির সামনে একটা মাঠ ছিল। মাঠের একধারে একটা ঘরে কিছু তরুণ একটা ক্লাব করেছিল। কলেজের ছেলেরা। এক পাশে কাঠের আলমারিতে গল্পের বই, টেবিলের ওপর কয়েকটা পত্রপত্রিকা, আর ঘরের অন্য এক পাশে ব্যায়ামের কিছু সরঞ্জাম। আমার মনে আছে আমার বয়সী চার-পাঁচটি ছেলেমেয়েসহ আমি ওই ক্লাবে যেতাম। ঘরের বাইরে মাঠে একটি তরুণ অধিনায়কের নির্দেশে পায়ের তাল মিলিয়ে মার্চ করতাম কিছুক্ষণ, তারপর ঘরের ভেতরে কাঠের ছোরা দিয়ে চলত ছোরা খেলার অনুশীলন।
বাবা কোনোদিন এ কাজে বাধা দেননি। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ রাজের প্রভুভক্ত আমলা। ওই ক্লাবের পেছনে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে যাদের যোগ ছিল তারা যে কংগ্রেসের বামঘেঁষা ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী গোষ্ঠী, এ তথ্য নিশ্চয়ই তাঁর অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন যে সাত-আট বছরের একটি বালককে এসব সম্পর্কে সচেতন করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সত্য বলতে কি ওই ক্লাবের রাজনৈতিক মাত্রিকতা সম্পর্কে সে সময় আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে কিছু না বুঝেও, ওই বাল্যকালেই মনের অবচেতনায় একটা প্রতিবাদী সত্তার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল কিনা কে জানে। বগুড়ার ওই ক্লাবের সান্নিধ্য আমি অবশ্য খুব বেশি দিন পাইনি।
১৯৩২-এ বাবা বদলি হয়ে গেলেন পিরোজপুরে। সেখানেই আমি প্রথমবারের মতো স্কুলে ভর্তি হই। ১৯৩৩ সালের কথা প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণীর পাঠ বাড়িতে শেষ করে স্কুলে এলাম একবারে পঞ্চম শ্রেণীতে।
এতদিন নিজের পোশাকি নাম ব্যবহার হতো না, এবার স্কুলের খাতায় সেই নাম উঠে এল। আমার নামকরণ হয়ে যায় আমার জন্মের বহু আগে, বস্তুতপক্ষে আমার মায়ের জন্মের অল্পকালের মধ্যেই। আকিকার সময় আমার মায়ের নাম রাখা হয় উম্মে কবীর আফিয়া বেগম। অর্থাৎ কবীরের মাতা আফিয়া বেগম। যথাসময়ে তাঁর পুত্রসন্তান হওয়ার পর আমার নাম হলো কবীর। তখনকার দিনের প্রথা অনুযায়ী পুরো নামটি বেশ বড় রাখা হলো আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর। ইংরেজিতে সংক্ষেপ করে আমি লিখতাম এ. কে. এম. কবীর। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরির সময় সব নথিপত্রে ওই নামই বহাল আছে। পঞ্চাশের দশকে যখন লেখালেখি শুরু করি তখন থেকে আমি বাবার পদবি নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করে কবীর চৌধুরী লিখতে শুরু করি। মুনীর অবশ্য গোড়া থেকেই নিজের নাম মুনীর চৌধুরী লিখতো, যদিও তার সম্পূর্ণ নামটিও ছিল বেশ বড়: আবু নঈম মোহাম্মদ মুনীর।
স্কুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কবীর বলে আমাকে প্রায় কেউ-ই ডাকত না। আমার ডাকনাম মানিক। জন্মাবার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে থাকার সময়ই ভালো নাম রাখা হয়ে যায়; কিন্তু তখন অবধি ডাকনাম কিছুই পাকাপাকিভাবে ঠিক হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বাবা বদলি হয়ে আসেন মানিকগঞ্জে। এবার ডাকনাম ঠিক হয়ে গেল মানিক। বাবা আমাকে বুকে নিয়ে গান গাইতেন, আয়রে চাঁদের কণা, আয়রে আয় আমার সাত রাজার ধন মানিক। খুব সম্ভব দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের কলির সঙ্গে নিজের কিছু কথা মিলিয়ে নিয়েছিলেন।
বলছিলাম পিরোজপুর স্কুলের কথা। স্কুলে একেবারে নতুন পরিবেশ, রুটিন বাঁধা পড়াশোনা, বাড়ির কাজ, পরীক্ষা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। খাপ খাইয়ে নিতে কিচ্ছু অসুবিধা হলো না। বাড়িতে যতদূর পড়েছিলাম তার মান ক্লাস ফাইভের চাইতে বেশি বই কম ছিল না। ইংরেজিতে খুব ভাল ছিলাম। বাংলা, ইতিহাস, সাধারণ বিজ্ঞান প্রভৃতিতেও খারাপ ছিলাম না। শুধু অংকতেই একটু দুর্বলতা ছিল। আসলে ওই বিষয়টির প্রতি কোনো উৎসাহই বোধ করতাম না। এখনো করি না। অথচ বুদ্ধি দিয়ে বুঝি যে অংক একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ডিসিপ্লিন এবং ঠিকভাবে পরিবেশন করতে পারলে খুব আকর্ষণীয়ও।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ ভীষণ বেড়ে গেল। এর আগে মার্বেল খেলেছি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলেছি, ডাংগুটি খেলেছি। এবার নেশার মতো পেয়ে বসলো ফুটবল খেলা। মার্বেল যে সম্পূর্ণ বাদ গেল তাও নয়। বিশেষ করে দুপুরে টিফিনের বিরতির সময় মার্বেল খেলা নিয়ে মেতে উঠতাম। যেদিন অন্যকে হারিয়ে প্রতিপক্ষের মার্বেল জিতে নিতাম সেদিন খুশির অন্ত থাকত না। উল্টোটা ঘটলে বেজায় মন খারাপ হয়ে যেত।
এসব খেলা ছাড়াও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য বেশ সময় নিয়ে অনুশীলন করতাম। প্রাথমিক ও চূড়ান্ত বাছাইয়ে আমি একশো গজ দৌড়, লং জাম্প ও হাই জাম্পে টিকে যেতাম; কিন্তু প্রতিযোগিতার সময় প্রথম বা দ্বিতীয় হতাম শুধু একশো গজ দৌড়ে।
স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দের ব্যাপার। আবৃত্তিতে অংশ নিতাম, ইংরেজি ও বাংলা দু’টোতেই। ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তিন শ্রেণীতেই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছি, কিছুতেই প্রথম হতে পারিনি। একই সহপাঠী আগাগোড়া প্রথম হয়েছে। তার সঙ্গে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আমার কিন্তু একটুও অসদ্ভাব ছিল না বরং বন্ধুত্বই ছিল। আমরা দু’জনেই ছিলাম ছোটখাটো দেখতে, রোগা, ধর্মের দিক থেকে আলাদা, আমি মুসলমান আর ও হিন্দু। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে আমার অবস্থান ঈষৎ ওপরে; কিন্তু তবু একটা সহজ অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল আমাদের দু’জনের মধ্যে। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আজ তার নামটাও মনে পড়ছে না।
পিরোজপুরে যে ছেলেটির সঙ্গে আমার সবচাইতে বেশি ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সে আমারই ক্লাসের আরেক সহপাঠী। লেখাপড়ায় ছিল মাঝারি কিন্তু খুব চটপটে আর খেলাধুলায় পারদর্শী। আমার চাইতে লম্বা, শক্ত-সমর্থও। তার সঙ্গেও ১৯৩৫ সালের পর আর দেখা হয়নি কিন্তু ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পত্রের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ ছিল নাম অরুণেশ লাহিড়ী। ১৯৪১-এ বি.এ পাস করার আগেই অরুণেশ ভাইসরয়’স কমিশন নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। ষাটের দশকে যখন ওর চিঠি পাই তখন সে ভারতের মধ্যপ্রদেশে ক্যাপ্টেন পদে একটি রেজিমেন্টে রয়েছে।
আমার পিরোজপুর স্কুলের সহপাঠীদের আর কারো সঙ্গে পরবর্তী সময়ে দেখা না হলেও ওপরের ক্লাসে পড়তেন এমন তিনজনের সঙ্গে পরে মোটামুটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছে। এরা তিনজনই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। একজনের নাম আবদুল করিম। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি তখন খুব সম্ভব নবম শ্রেণীতে। পরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হয়ে পুলিশ সুপিরিয়র সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি যখন একটি জেলা শহরে এস.পি. হিসেবে কর্মরত তখন তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। আমারও তখন কর্মজীবন চলছে। অনেক দিন তাঁর কোনো খবর জানি না। আরেকজন ছিলেন আহসান হাবীব। তিনি আজ বেঁচে নেই; কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই আমাদের কবিতার ভুবনে তাঁর অবদান ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, একুশে পদকসহ নানা সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তাঁর রাত্রিশেষ, ছায়া হরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দুই হাতে দুই আদিম পাথর প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তিনি যে সৃষ্টিসম্ভার রেখে গেছেন তা তাঁকে বাংলা কবিতা, যা আমি পড়েছিলাম অনেক দিন আগে, আমার স্মৃতিতে আজও অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘কোনো এক বাদশাজাদীর প্রতি’ আর ‘রেডরোডে রাত্রিশেষে’। শেষের কবিতাটি পরেও পড়েছি, কিন্তু প্রথম কবিতাটি নয়। আর তৃতীয় ব্যক্তি হলেন আমাদের চিত্রকলা জগতের প্রথমদিকের প্রথম সারির একজন মানুষ। জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমদ, আনওয়ারুল হক, কামরুল হাসান প্রমুখের সঙ্গে বাংলাদেশের চিত্রকলার ভিত গড়ে তোলার কাজে রত ছিলেন। তাঁর নাম শফিকুল আমীন। পিরোজপুর স্কুলে তিনি যখন ক্লাস নাইন কিংবা টেনে পড়েন তখন তাঁর আঁকা একটা ছবি দেখেছিলাম। একটি গাছের ডালে দুটি পাখি বসে আছে। ছবিটিতে উজ্জ্বল রঙের কাজ কী ভালো যে লেগেছিল বলতে পারব না। ওঁর সঙ্গে পরে একাধিকবার দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। বাংলাদেশের বহু টেলিভিশন দর্শক তাঁকে অন্য একটি ভূমিকায়ও জানে। শরীর কিভাবে ভালো রাখতে হয় সে সম্পর্কে তিনি বেশ কিছুদিন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, চমৎকারভাবে মৌল বিষয়গুলো দর্শক-শ্রোতাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। সত্তর বেশ আগে পেছনে ফেলে এসেও তার নিজের স্বাস্থ্য তখনও ঈর্ষণীয়। চিত্রকলা ও শরীরচর্চার মতো দুটি বিষয়কে একই সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে তিনি মিলিয়েছেন নিজের জীবনে। পরিণত বয়সেও। এ প্রসঙ্গে কামরুল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে আমার। কৈশোর ও যৌবনে কামরুল হাসান শরীরচর্চায় বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, মেতে উঠেছিলেন গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন নিয়ে। তাঁর ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটার সঙ্গে দেশপ্রেম, মাটি ও ঐতিহ্য ইত্যাদিরও একটা সম্পর্ক ছিল। পরবর্তী সময়ে কামরুল ভাই প্রত্যক্ষভাবে শরীরচর্চা আন্দোলনের সঙ্গে আর যুক্ত থাকেননি; কিন্তু সুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব তিনি সর্বদা উপলব্ধি করতেন এবং তরুণদের মধ্যে এ বিষয়ে ঔদাসীন্য তাঁকে ব্যথা দিতে।