2 of 3

সোনামণির অশ্রু

সোনামণির অশ্রু

লোকটিকে ভালো করে লক্ষ্য করুন!

রোগা-পাতলা, লম্বাটে চেহারা, বছর চল্লিশেক বয়েস। মাথার চুল বেশ ঘন, তার মধ্যে দু-চারটে সাদা। তুলনা দিয়ে বোঝাতে গেলে বলতে হয়, লোকটির মুখখানা অনেকটা ঘোড়ার মতো। তা বলে খারাপ দেখতে বা হাস্যকর কিছুনয়, অনেক মানুষের মুখই এরকম হয়। ধুতির ওপর সাদা হাফ শার্ট পরা, তার পোশাক মোটামুটি পরিচ্ছন্ন, বাঁ-হাতে একটা সোনার আংটি।

লোকটি জগুবাবুর বাজারের বাইরের ফুটপাত থেকে দুপুর দেড়টার সময় তালশাঁস কিনছে। দুপুর দেড়টা।

রাস্তার অনেক মানুষের মধ্যে সাধারণ একটি মানুষ। ওকে দেখে বোঝবার কোনও উপায় নেই যে ওই লোকটি একটি খুনি।

খুনিরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে তালশাঁস কেনে? টাকায় সাতটা দেবে না আটটা, তাই নিয়ে দরাদরি করে?

দু-টাকায় পনেরোটিতে রফা হল। লোকটি কাগজের ঠোঙাটি হাতে নিয়ে হাঁটতে লাগল হাজরার মোড়ের দিকে।

কালিকা সিনেমার এক পাশের একটা তিনতলা বাড়ির দরজায় তিনটে চিঠির বাক্স। লোকটি দেখল মাঝখানের বাক্সটি ফাঁকা!

দোতলায় আলো হাওয়া যুক্ত স্বতন্ত্র তিন কামরার ফ্ল্যাট। পনেরো বছর আগেকার ভাড়া। বেশ শস্তা। সল্টলেকে জমি রয়েছে তার, কিন্তু বাড়ি করার উৎসাহ নেই, দোকান থেকে অনেক দূর পড়ে যায়।

লোকটির স্ত্রী বাংলা-মাসিক পত্রিকা পড়ছিল বিছানায় শুয়ে। মোটার দিকে গড়ন, দুপুরে ব্রা পরে না। এই তো একটু আগে স্নান সেরে এসেছে, দুপুরবেলা এই সময় প্রত্যেকদিন তার স্বামী দোকানে অন্য কর্মচারী বসিয়ে রেখে বাড়িতে ভাত খেতে আসে।

ওদের ছেলেটিই বড়, এই সবে কলেজে ভরতি হয়েছে। আর মেয়ে ছোট, নবছর মাত্র বয়েস, স্কুল বাসে সেও ফিরেছে একটু আগে।

দরজার বেল শুনে মাসিক পত্রিকাটি মুড়ে রেখে স্ত্রী বলল, পুষি দোর খুলে দে, বাবা এসেছে!

এক বুড়ি এ-বাড়িতে রান্নার কাজ করে, তিনদিন ধরে সে দেশে গেছে। গৃহকত্রীকেই আজ খাবার গরম করতে হবে, আর গোটা কয়েক বেগুন ভাজা। একটা কিছু ভাজাভুজি না করলে ওর স্বামীর মুখে ভাত রোচে না।

খাট থেকে নেমে তখুনি সে রান্না ঘরের দিকে না গিয়ে ড্রেসিং টেবলের সামনে দাঁড়াল। গুমোট গরম, দু-চারটি ঘামাচি হয়েছে তার বুকে, বাঁ-হাত দিয়ে নিজের বাম স্তনটি চেপে ধরে সে ডান হাত দিয়ে ঘামাচি মারতে লাগল।

মেয়ে দরজা খুলে বাবাকে জিগ্যেস করল, বাবা, কী এনেছ? কী এনেছ?

ঠোঙাটি মেয়ের হাতে দিয়ে লোকটি তার গাল টিপে একটু আদর করল। তারপর ঢুকল শয়ন ঘরে।

রক্ত মাংসের স্ত্রীর শরীরের চেয়েও আয়নায় আঘো উন্মুক্ত বেশ বড় একটি বর্তুল স্তন তাকে মুগ্ধ করল বেশি। সে মৃদু-মৃদু হাসতে লাগল। দেওয়ালে কালী ঠাকুরের ছবি, তাতে কাগজের লাল ফুলের মালা। ড্রেসিং টেবলের দু-পাশেদুটি বাঁকুড়ার ঘোড়া। জানলায় একটি পুরোনো বিলিতি মদের বোতলে মানি প্ল্যান্ট।

খুনির বাড়ি!

সেলিমপুরের এ পাশটা থেকে বড় রাস্তা পেরুলেই যোধপুর পার্ক। খানিকটা ভেতরে ঢুকলেই সোনামণির মাসির বাড়ি।

সোনামণির মা আর বাবা দুজনেই অফিসে যান, ফিরতে সন্ধে হয়ে যায় বলে সোনামণি ইস্কুল থেকে ফিরেই মাসির বাড়িতে চলে যায়! বাড়ির ঝি তাকে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে!

সোনামণির বয়েস এগারো। গল্পের বই-এর জগত ছেড়ে সে এখনও বাস্তব পৃথিবীতে পা দেয়নি। এইবার দেবে-দেবে করছে। তার গায়ের রং বেশ ফরসা, সারশের সৌন্দর্যে তার মুখখানা অপরূপ, খুব বাচ্চা বয়েস থেকেই লোকে তাকে দেখলে বলত, ইস, একেবারে পুতুলের মতন দেখতে হয়েছে মেয়েটা। এক-এক সময় এই কথা শুনলে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতো। সবাই এক কথা বলে, তার মোটেই পুতুল হতে ইচ্ছে করে না।

এখন সোনামণিকে কেউ-কেউ আদর করে বলে আকাশের পরী। সে সবে মাত্র লম্বা হতে শুরু করেছে, মাথা ভরতি কোঁকড়া চুল, চোখ দুটো দেখলেই মনে হয় কাজল টানা। পড়াশুনোতে সোনামণির তীক্ষ্ণমেধা।

সন্ধে সাড়ে ছটা বাজে, সোনামণি মাসির বাড়ির থেকে নিজের বাড়িতে ফিরছে। খানিক আগেই লোডশেডিং হয়েছে, রাস্তাঘাট একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিকেলে প্রবল তোড়ে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় এখানে-সেখানে জমে আছে কালো জল।

বাড়ির দাসী বিমলা সোনামণির হাত ধরে হাঁটছিল, কিন্তু সোনামণি নিজেই মাঝে-মাঝে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে। সে আর অত ছোট নেই। আর দু-দিন বাদেই তার জন্মদিন। তখন সে বারোতে পা দিয়ে বড়দের জগতেও পা দেবে।

এত অন্ধকারেও রাস্তায় মানুষজন কম নেই। হেড লাইট জ্বালিয়ে যাচ্ছে গাড়ি, তারই মধ্যে সাইকেল রিকশা, একটা গোরু…।

ফুটপাত থেকে বড় রাস্তায় নামতেই খানিকটা জল। সোনামণি সেখানে পা দেওয়া মাত্র কেউ যেন। তাকে নীচে টানল হুস করে। সোনামণি হাত বাড়িয়ে বিমলাকে ধরতে গেল, পারল না।

রাস্তায় হাঁটু ডোবার চেয়েও কম জলে সোনামণি ডুবে গেল।

বিমলা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। কোনও গাড়ির হেডলাইটে সে এক পলকের জন্য সোনামণির গায়ের সাদা ফ্রকটাকে দুমড়ে নীচে পড়ে যেতে দেখল।

ও খুকু কোথায় গেলে? ও খুকু! কী হল গো? ও খুকু!

বিমলা হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে নিজেও পড়ে গেল জলে, কিন্তু সে ডুবল না। এবং সে জানতেও পারল না তারই গোড়ালির ধাক্কায় সোনামণি আবার ডুবে গেল খোলা হাইড্রান্টের মধ্যে। একবার সে কোনওক্রমে ভেসে ওঠার চেষ্টা করেছিল।

বিমলার চ্যাঁচামেচির কারণটা রাস্তার লোকদের বুঝতেই অনেকটা সময় লাগল। সবাই তিতিবিরক্ত, কে আর অন্যের ব্যাপারে মাথা গলাতে চায়?

আড়াই ঘণ্টা বাদে নরকের পাঁক মাখা সোনামণির মৃতদেহ উদ্ধার করা হল। তখনও মিশমিশে অন্ধকার রাস্তায়, কেউ তার বিকৃত বীভৎস মুখ দেখতে পায়নি।

রাত পৌনে একটা। এ সময় শহর প্রায় ঘুমন্ত হলেও কেউ-কেউ জেগে থাকে।

পঞ্চাননতলা বস্তির পাশে রেল লাইনের ওপরেই জনা পাঁচেক যুবক আড্ডা জমিয়েছে। এদের মধ্যে দু-জনের এখনও গোঁফ গজায়নি, তবু তারা টেনেটুনে যুবকদের দলে ঢুকতে চাইছে।

সামনে বাংলা মদের বোতল, আর ঝাল-ঝাল কিমার চাট। চারজনের মুখে সিগারেট, একজন গাঁজা পাকাচ্ছে।

রাতের দিকে দু-একটা মালগাড়ি চলে মাঝে-মাঝে। তাও ইদানীং বেশকমে গেছে। মালগাড়ি এলে ওদের কাজ কারবার ভালো হয়। কিছুদিন ধরে বাজার মন্দা যাচ্ছে তাই ছ্যাঁচড়া কাজ। করতে হচ্ছে।

হঠাৎ একজন ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ভূ-ভূ-ভূ-ভূত!

আর-একজন তার উরুতে একটা থাবড়া মেরে বলল, চুপ বে! চেল্লাসনি! রং চড়ে গেছে?

প্রথম ছেলেটি তবু আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওই-ওই-ওই, ওই যে দ্যাখ! ভূ-ভূ-ভূত!

এবারে পাঁচজনেই দেখতে পেল। ধপধপে সাদা ফ্রক পরা, ফুটফুটে ফরসা, এগারো-বারো বছরের একটি পরী তাদের সামনে শূন্যে ভাসছে।

পাঁচজনে একেবারে থ। চোখের ভুল নয়, সত্যি দেখছে।

পরীটি খুব মিনতিপূর্ণ গলায় জিগ্যেস করল, ওগো, তোমরা আমায় মারলে কেন? আমি কী দোষ করেছি তোমাদের কাছে?

পাঁচ যুবকের শরীরে কাঁপুনি ধরল এবার। যেন পুলিশ তাদের অ্যারেস্ট করে ফলস কেস চাপিয়ে দিয়েছে। এবারে ফাঁসি দেবে। এরা তো ছুরি-ছোরা বা পেটো-পিস্তলের কারবার করে না। সেজন্য অন্য দল আছে। ওরা তো সবে মাত্র ছোটখাটো মাল সরাবার কাজে হাত পাকাচ্ছে।

বিনা নির্বাচনেই ওদের যে দলপতি, সেই গণা বলল, তোমায় কে মেরেছে? আমরা তো কোনও মেয়েছেলের গায়ে হাত দিই না? তুমি ভুল জায়গায় এসেছে!

কিশোরী পরী বলল, হ্যাঁ, তোমরাই মেরেছ। কেন মারলে, বলো, কেন মারলে? আমি কী দোষ করেছি? আমার বাবা-মা কি তোমাদের কাছে কোনও দোষ করেছে?

গণা বলল, আরে কী মুস্কিল, সত্যি বলছি, আমরা ওসব কাজ করি না। তোমাকে আমরা মারিনি!

কিশোরী পরী বলল, আর দু-দিন বাদে আমার জন্মদিন। আর হল না। আমার আর ইস্কুলে যাওয়া হবে না! মা-বাবা আমায় আর দেখতে পাবে না। ওগো, তোমরা কেন আমায় এই শাস্তি দিলে। তোমরা যোধপুর পার্কের সামনে রাস্তার তিনটে হাইড্রান্টের লোহার ঢাকা খুলে নিয়েছ…

গণা এবারে চোখ বুজল। পুলিশ যেন চোরাই মাল তুলে ধরে তার চোখের সামনে দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, ও কাজটা তাদেরই বটে।

এবারে দ্বিতীয় নেতা নেবু খানিকটা সাহস সঞ্চয় করেছে। সে বলল, হ্যাঁ, নিয়েছি। পেটের দায়ে। তুমি যোধপুরে থাকতে, তোমরা বড়লোক, গাড়ি করে যাও, তোমাদের নর্দমায় পা দেওয়ার কথা নয়!

সোনামণি বলল, আমাদের গাড়ি নেই। আমি বিমলার সঙ্গে যাচ্ছিলুম, নর্দমায় পড়ে গিয়ে ডুবে গেছি, বিমলার পা ভেঙে গেল…ওগো, তোমাদের কি একটুও দয়া নেই?

গণা বলল, আজ শালা সন্ধেবেলা হেভি বৃষ্টি হয়েছে!

নেবু বলল, বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় জল জমেছে সে তো শালা ভগবানের দোষ!

গণা সোনামণির উদ্দেশ্যে বলল, তুমি দয়ার কথা বলছো; আমরা যখন খেতে পাইনা, তখন কেউ দয়া করে? তোমার বাপ-মা কি আমাদের খেতে দেবে? কোনও শালা খেতে দেয় না। কিছু চাইতে গেলে দূর-দূর করে খেদিয়ে দেয়!

—তোমরা অন্য কাজ করতে পারো না? বড়দা যেমন অফিসে কাজ করে—

—হাঃ! তুমি কোথাকার পরী গো? কিছু জানোনা। শুধুমুধু আমাদের দোষ দিতে এসেছ? অন্য কাজ, হেঃ! নন্টেদা বেহালায় কারখানায় কাজ করত, তার চাকরি গেছে! এখন সেও আমাদের লাইনে ঢুকেছে।

ছিঃ, তা বলে তোমরা খারাপ কাজ করবে? যাতে মানুষ মরে?

—আবার ওই কথা বলছ? তুমি যে মরেছ, সে জন্য যদি কেউ দায়ী হয়, তাহলে সে হল জগুবাবুর বাজারের শিববাবু!

—সে কে?

—তার লোহার দোকান। সে আমাদের কাছ থেকে মাল কেনে। পার্কের রেলিং ভেঙে নিয়ে গেলে কম দর দেয়। নর্দমার ঢাকনা নিয়ে গেলে ভালো পয়সা। একখানা নিয়ে গেলে বলে, আর মাল। নেই?

—হ্যাঁ গো পরী, তোমার মৃত্যুর জন্য শিববাবু দায়ী! ও মাল যদি সে না কিনত, তাহলে কি আমরা এমনি-এমনি খুলতুম? সেই শিববাবু শালা আবার খুব কালী ভক্ত! দোকানে অ্যাও বড় ফটো!

সোনামণির আত্মা সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কালিকা সিনেমার পাশে দোতলার ফ্ল্যাটে শিববাবুর ঘুম ভেঙে গেল।

স্বামী-স্ত্রীর ডবল খাট, ছেলে মেয়েদের আলাদা-আলাদা ঘরে বিছানা। কিন্তু মেয়েটা বড় বাবার ভক্ত, প্রায়ই নিজের বিছানা ছেড়ে বাবা-মায়ের মাঝখানে শুয়ে পড়ে।

শিববাবু চোখ মেলে আঁতকে উঠল প্রথমটা। জানলা দিয়ে ধোঁয়ার মতন কী যেন ঢুকছে। তারপর সেই ধোঁয়া একটি মূর্তি নিল। একটি অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী মেয়ে, গায়ে সাদা ফ্রক, সে হাওয়ায় ভাসছে!

শিববাবু ভাবলেন, কোনও দেবতা বুঝি এসেছে তার ঘরে। লক্ষ্মী ঠাকরুণ? একটা লটারির টিকিট কিনেছে সে, যদি দু-কোটি দু-লাখ টাকার ফাস্ট-প্রাইজটা লেগে যায়…

ভাসমান পরী দুঃখের সুরে বলল, ওগো, তুমি আমায় মারলে কেন? আমি কী দোষ করেছি তোমার কাছে?

—অ্যাঁ?

শিববাবু আঁতকে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে কুলকুল করে ঘাম বইতে লাগল তার শরীরে। এই মেয়েটা খুন হয়েছে? বাপরে বাপ, কী সাংঘাতিক কথা! এমন একটা ফুটফুটে মেয়েকে যারা মারে, তারা কি মানুষ না শয়তান?

কিন্তু মেয়েটি তার কাছে এসেছে কেন? তার নামে অভিযোগ করছে? এ কী আশ্চর্য কথা!

—ওগো, তুমি কেন আমার মারলে?

—আর দু-দিন পরে আমার জন্মদিন।

—এ কী কথা বলছ, মা? আমি কেন তোমায় মারব? আমি বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করি, আমি তো খুন-জখমের ব্যাপারে থাকি না। তোমারই বয়েসি মেয়ে আছে আমার

—কেন, রেললাইনের কাছে লোকগুলো যে বলল, তুমি আমাকে মেরেছো?

রেল লাইনের পাশের লোক? তারা কারা? আমি তো চিনি না। তোমার কী হয়েছিল, খুলে বলো তো?

—আমি যোধপুর পার্ক থেকে আসছিলুম, সন্ধেবেলা লোডশেডিং ছিল, রাস্তায় জল ছিল।

–ও হ্যাঁ, রেডিওর রাত্তিরের খবরে শুনলাম বটে, ওদিকে একটি মেয়ে রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আহা গো! এমন কাঁচা বয়েসের মেয়ে, ছি-ছি-ছি-ছি, গাড়ি চাপা দিয়েছিল?

–রাস্তার নীচে পাতাল থাকে, আমি সেখানে ডুবে গেছি। পাতালের ঢাকনা ছিল না।

—কী বললে, পাতাল?

–রেল লাইনের লোকেরা বললে, তুমি সেই পাতালের ঢাকনা কেননা, তাই ওরা সেগুলো তুলে আনে। তুমি না কিনলে ওরা আনতো না।

ও, এবার বুঝেছি! ওরা বাজে কথা বলেছে। আমি না কিনলে ওরা অন্য কারুর কাছে বেচতে। আমি দোকান খুলেছি, কেউ পুরোনো লোহা আনলেই কিনি। সে কোথা থেকে এনেছে তা আমার দেখার দরকার কী?

—তুমি জানো না, ওগুলো খুলে নিলে মানুষ মরে যেতে পারে? যেমন আমি মরে গেলাম? আমি কি দোষ করেছি যে এমনি করে আমাকে মরতে হবে?

তুমি শুধু-শুধু আমায় দোষ দিচ্ছ মা। জানো, ওই লোহার ঢাকনাগুলো আমার কাছ থেকে কে। কেনে? কর্পোরেশনেরই অফিসার। আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় বসায়, গণা-নেবুরা সেগুলো আবার তুলে আনে কর্পোরেশনের অফিসার আবার কিনতে আসে আমার কাছে। এর মধ্যে আমি কে, আমি তো নিমিত্ত মাত্র। কর্পোরেশনের মিঃ দাস, তার কাছে যাও। সে তো জেনে শুনেই এসব করাচ্ছে!

—তুমিও তো জানতে?

—আমি অত শত চিন্তা করি না। আমি মাল কিনি, মাল বেচি রাস্তা রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমার নয়। পুলিশ এই চুরি বন্ধ করতে পারে না? পুলিশ ইচ্ছে করে ওদের ধরে না, বুঝলে? ওখানকার থানার ও সি-কে গিয়ে বলো, সে তোমাকে মেরেছে। আর যারা রোজ সন্ধেবেলা লোডশেডিং করে? তারা জানে নে যে রাস্তায় এত গর্ত, কত নর্দমার ঢাকনা নেই, সারা সন্ধে অন্ধকার থাকলে কত লোকের অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। হচ্ছেও তো রোজই। তারা দোষ স্বীকার করেছে কখনও, তুমি তাদের কাছে যাও। দ্যাখো গিয়ে, তারা সবাই এখন আরাম করে ঘুমোচ্ছে! তুমি একলা। আমাকে দুষতে এসেছ কেন, মা? আহা, তোমার মতন একটা মেয়ে…

সোনামণি আবার ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে।

শিববাবুর বুক কাঁপছে। হাত জোড় করে সে প্রমাণ জানাল ঠাকুরের উদ্দেশ্যে।

তারপর পাশের ঘুমন্ত মেয়ের গায়ে স্নেহের হাত রাখল।

তখুনি সে ঠিক করল, পুষিকে সে কোনওদিন সন্ধের পর রাস্তায় বেরুতে দেবে না।

রাত্রির তৃতীয় প্রহরের আকাশে দুলতে লাগল সোনামণির আত্মা।

শিববাবু নামের লোকটি কতগুলো লোকের নাম বলল। সে এখন কোথায় যাবে, কার কাছে তার দুঃখের কথা জানাবে। তার জন্মদিন আর হবে না। সে আর এই পৃথিবীতে বড়দের জগতে পা দিতে পারবে না।

এত বড় শহরের তো কিছুই চেনে না সোনামণি। শিববাবু যাদের নাম বলল, তাদেরকে এখন কোথায় খুঁজে পাবে? ঢেউ-এর মতন অভিমান ঝাপটা দিতে লাগল তার বুকে। রাত্রির শিশিরের মতন টুপ-টুপ করে ঝরে পড়তে লাগল তার চোখের জল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *