তাজমহলে এক কাপ চা
রাম রাম ওস্তাদজি! কুছ খুস খবর শুনাইয়ে!
ওস্তাদজির পরনে একটা আলখাল্লার মতন পোশাক, নানান জায়গায় তাপ্পি মারা, মাথায় একটা ফেট্টি বাঁধা। গালে পাঁচ-সাতদিনের রুখু দাড়ি। বয়েস হবে পঞ্চাশের ধারে কাছে। কোথায় তার বাড়ি ঘর কিংবা তার নিজের বউ-বাচ্চা আছে কি না তা কেউ জানে না। জিগ্যেস করলে মৃদুমৃদু হাসে।
মাঝে-মাঝে সে এসে উদয় হয়। খাঁটিয়ায় বসে গ্রামের মানুষের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে। আপদ-বিপদে শলা-পরামর্শ দেয়। দু-একদিন এর তার বাড়িতে থাকে, ছাতু কিংবা রুটি আর ভেণ্ডির তরকারি যা দেওয়া হয় তাই-ই আরাম করে খায়, আবার উধাও হয়ে যায়।
গত বছর খরার সময় ও গাঁওয়ের ঠিকাদার বড় বে-শরম, কঠিন-হৃদয়ের মতন ব্যবহার করেছিল। ওই সময় বাঁধ বাঁধার কাজ কি বন্ধ রাখা ঠিক? জমিতে ধান নেই, হাতে পয়সা নেই, তখন সরকারি মজুরি না পেলে মানুষ বাঁচবে কী করে? সেই সময় ওস্তাদজি এসে ঠিকাদার ব্যাটাকে ভারী জব্দ করেছিল। সবাই এক কাট্টা হয়ে তাকে এক খেজুর গাছের নীচে ঘিরে রেখে চব্বিশ ঘণ্টা দানা পানি ছুঁতে দেয়নি!
ওস্তাদজি এসে যে দু-একদিন থাকে তখন নানারকম মজা হয়। সারাদিন খাটা খাটনি তো আছেই, একেবারে শেষবার চোখ বোজার আগে পর্যন্ত বাঁচার জন্য খেটে যেতে হবে, এটাই নিয়তি। কিন্তু খাটতে-খাটতে আনন্দ ফুর্তির কথা মনে থাকে না। ওস্তাদজি সেটাই মনে করিয়ে দেয়। পিঠে চাপড় মেরে বলে, আরে কাজ-কাম তো আছেই লেকিন তা বলে হাসবি না! দ্যাখনা জঙ্গলের জানবার আর আকাশের পংখী, তারাও নাচা-গানা করে।
ওস্তাদজি এসে প্রতি সন্ধেবেলা সবাইকে জড়ো করে মজলিশ বসায়। সে নিজেই গান ধরে। গলায় বিশেষ সুর নেই কিন্তু চ্যাঁচামেচির জোর আছে, একটা হাত কানে দিয়ে আর একটা হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে। ওই গানের জন্যই তার নাম ওস্তাদজি!
ওস্তাদজির আলখাল্লার পকেটে একটা খবরের কাগজ। ওস্তাদজি পড়েলিখে আদমি, এই গ্রামের বাইরে যে দেশ, যে পৃথিবী, তার খবর সে রাখে। এমনকী একদিন আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, ও আশমানে, অনেক-অনেক উঁচুতে, যেখানে দৃষ্টি পৌঁছয় না, সেখানেও নাকি মানুষ লড়াই-এর জন্য তৈয়ার হচ্ছে। কে জানে, ওস্তাদজি মজাক করার জন্য গপ বানায় কি না!
ওস্তাদজির গলা শুনে আরও দু-চারজন এসে জমায়েত হল সেখানে। বুড়ো রামখেলাওনের খাঁটিয়া ঘিরে তারা মাটিতে উবু হয়ে বসে। সবাই এক-এক করে রাম-রাম জানিয়ে অনুরোধ করে, বলো ওস্তাদজি, তোমার আখবরে কী খুশ খবর আছে?
ওস্তাদজি খাঁটিয়ার এক পাশে বসে বলে, আরে দূর। আখবরে তো তোর-আমার মতন গরিব। মানুষের কথা লেখেনা। শুধু বড়-বড় শেঠ আর মিনিস্টারদের কথা থাকে। তা শুনে কী করবি?
বুড়ো রামখেলাওন ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, ওস্তাদজি, গরিবের জীবনে আছেটা কী যে আখবরে লিখবে? গরিবের খবর আমরাও শুনতে চাই না। তুমি শেঠ আর মিনিস্টারজিদের কিস্যাই শুনাও।
ফুলসরিয়া নামে একটি বউ বলল, গতবারে তুমি আফ্রিকা নামে একটা কোন গাঁওয়ের খুব মজাদার একটা কাহিনি শুনিয়েছিলে, সেরকম আর একটা বলো।
তার স্বামী ধনিয়া বলল, আচ্ছা ওস্তাদজি, ইন্দিরাজির লেড়কা রাজীবজি তো এখন গদিতে বসেছে, ঠিক কি না? তা রাজীবজির কটা লেড়কা আছে? কত বড়? ধরো যদি, ভগোয়ান না করে, রাজীবজি আচানাক খতম হয়ে যায়…
কয়েকজন হাসতে থাকে, কয়েকজন চোখ বড়-বড় করে উদ্বেগের সঙ্গে তাকায়। এটা মোটেই হাসির ব্যাপার নয়, ওস্তাদজির একটা মতামত এই বিষয়ে শুনতে চায় তারা।
আজ কোনও কাজ নেই। আকাশ খরখরে, তাই চাষের কাজ শুরু হয়নি, এখন শুধু বৃষ্টির প্রতীক্ষা। অলস সময় বয়ে যায়।
নানারকম গল্প করতে-করতে ওস্তাদজি হঠাৎ বলল, কেউ এক কাপ চা খাওয়াতে পার?
সবাই সবার মুখের দিকে তাকায়। নিঃশব্দে হায়-হায় করে ওঠে। ছি-ছি, কী লজ্জার কথা, মানুষটা নিজের মুখে কথাটা বললে, সামান্য এক কাপ চা, কিন্তু কী করে তা খাওয়ান যায়? এখানে তো কোনও বাড়িতে চায়ের চল নেই।
ওদের মুখের ভাব দেখেই ওস্তাদজি ব্যাপারটা বুঝল। শহরে গিয়ে-গিয়ে ওস্তাদজির চায়ের নেশা হয়েছে। সে হাত তুলে বলল, থাক, থাক। চায়ের দরকার নেই। এক গিলাস পানি দাও কেউ। তারপর আমি শুনাব এক শেঠজির কিস্যা।
এক নওজোয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, পাক্কীতে এক সর্দারজির হোটেল আছে, সেখান থেকে আমি নিয়ে আসছি চা। কেউ একটা বর্তন দাও!
পাক্কী মানে পাকা সড়কি, হাইওয়ে। এখান থেকে আড়াই মাইল দূরে। যুবকটি ছুটে যাবে আর আসবে।
ধনিয়া বলল, অতদূর থেকে চা আনবি, তাতে তোর ঘাম গরম হবে কিন্তু চা যে ঠান্ডা জল হয়ে যাবে। ঠান্ডা চা খেতে একেবারে বিল্লির প্রসাবের মতন।
যেন সে সত্যিই কখনও বিড়ালের পেচ্ছাপ পান করেছে, সেইরকম একটা বিকৃত মুখভঙ্গি করে, হেসে ওঠে সবাই।
ফুলসরিয়া মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, কেন, আমরা চা গরম করে দিতে পারি না? যা, যা, ছুটে যা!
রামখেলাওন বলল, একটা বড় বর্তন নিয়ে যা। বেশি করে আনিস!
ওস্তাদজি নওজোয়ানের দিকে হাত তুলে বলে, দাঁড়া।
তারপর সে চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। তার কপালে কী যেন একটা মতলবের রেখা ছোটাছুটি করছে।
একটু পরে খাঁটিয়া ছেড়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুই কেন একলা যাবি? চল, আমরা সবাই মিলে যাই। এখানে বসে থেকে কী হবে? পাক্কী দিয়ে কত গাড়ি যায়, কত ট্রাক এক হাজার, দু-হাজার মাইল যায়, ওসব দেখলেও ভালো লাগে। ঠিক কি না!
অনেকে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে হইহই করে বলল, চলো, চলো, চলো!
তিরিশ-পঁয়তিরিশজন জুটে গেল। খবর পেয়ে আরও দু-চারজন ছুটে আসে।
রামখেলাওন বলল, আরে-আরে, এত আদেখলার দল নিয়ে যাওয়া হবে কোথায়? এত চায়ের পয়সা দেবে কে?
ওস্তাদজি হাত তুলে বলল, চলুক, সবাই চলুক, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ফুলসরিয়া বলল, ওস্তাদজি যেতে বলেছে, তবু তুমি বখেড়া করছ? ওস্তাদজির কথার দাম নেই?
একটি অকারণের মিছিল। অলস জীবনে একটা আকস্মিক পিকনিক। পাক্কীতে গিয়ে দাঁড়ালেই। টের পাওয়া যায় এদিকে একটা দূরের দেশ আছে, ওদিকে আর-একটা দূরের দেশ। এর মধ্যে। একটা দিকে এদেশের রাজধানী। মাইলের হিসেবে পঁচিশ-তিরিশ মাইল হলেও আসলে অনেক দূর।
পাক্কীতে পৌঁছে আরও আধ মাইল ডান দিকে হেঁটে সর্দারজির দোকান পাওয়া গেল। কিন্তু সে দোকানের ঝাঁপ ফেলা। দেখলে মনে হয় সে দোকানে বেশ কিছুদিন কেনাবেচা বন্ধ আছে।
ধনিয়া কপাল চাপড়ে বলল, হায় রাম! এই কথাটা আমার মনে ছিল না? অমৃতসরে কী যেন গোলমাল হয়েছে, সর্দারজিরা খুব রেগে আছে, অনেক সর্দার ভাগলবা হয়েছে। ইন্দিরাজির। দেহান্ত হওয়ার পর এই সর্দারজীকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না!
আর দু-একজন বলল, ঠিক, ঠিক। দোকানটা তো বেশ কিছুদিনের বন্ধ!
সবার মুখে শোকের ছায়া। পিকনিকটা ব্যর্থ হয়ে গেল! ওস্তাদজি আজ নিজে সবাইকে চা খাওয়াতে চাইলেন!
ওস্তাদজি বলল, কই ফিকর নেই। এ দোকান বন্ধ তাতে কী হয়েছে, আরও তো দোকান আছে। চল, সামনে চল!
রামখেলাওন বলল, আর কোথায় যাবে ওস্তাদজি? যত সামনে যাবে তত শহর এসে যাবে। সেখানের দোকানে দাম বেশি। তা ছাড়া আমরা কুর্তা পরে আসিনি, পায়ে জুতা নেই, আমাদের ঢুকতেই দেবে না!
আরও কয়েকজন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের মনেও এই চিন্তা এসেছে। রাস্তার ধারের দোকানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তবু চা খাওয়া হয়। ভালো দোকানে তাদের ঢুকতে দেবে কেন?
ওস্তাদজি বলল, আরে কুর্তা-জুতা কি চা খাবে, না মানুষ চা খাবে!
মুখে তার এক পলক হাসি ফুটে উঠল। যেন একটা নতুন দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় এসেছে।
পকেট থেকে খবরের কাগজটা বার করে গোল করে মুখের সামনে এনে সে তাতে দুবার চুমু খেল। তারপর বলল, চল, তোদের আজ আমি তাজমহলে চাপিলাববা!
ওস্তাদজি মাঝে-মাঝে এমন কথা বলে যার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না! তাজমহলটা আবার কী জিনিস! এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল।
ধনিয়ার মধ্যে একটা সবজান্তা ভাব আছে। সে বলল, তাজমহল হচ্ছে বাদশাদের এক বহুৎ ভারী মোকান! আমি ফটো দেখেছি! ঠিকাদারবাবুর বাড়িতে ক্যালেন্ডারে ছিল।
ওস্তাদজি বলল, ঠিক বলেছিস। তোরা আকবর বাদশার নাম শুনেছিস? শুনিসনি! সেই আকবর বাদশার নাতি তার বেগমের জন্য একটা মস্ত বড় কুঠি বানিয়েছিল। এই রোদ্দুরের মতন। শফেদ। বহুৎ চমকদার!
একজন ফক্কুড়ি করে বলল, সেখানে আমরা যাব কেন? বাদশা কি আমাদের দাওয়াত দিয়েছে?
ধনিয়া বলল, আরে, বাদশা-বেগমের জমানা খতম। তারা আর নেই। তাও জানিস না? একজন বলল, তাহলে নিশ্চয় সেখানে এখন মন্ত্রীজিরা তাদের বিবিদের নিয়ে থাকে?
ওস্তাদজি বলল, না রে, সে কুঠি এখন পাবলিকের জিনিস। তোর আমার মতন বেহুদা আদমিরাও সেখানে যেতে পারে!
তবু অনেকের সংশয় ঘোচে না। সে জায়গা কত দূর? সেখানে চা খেতে কত পয়সা লাগবে? ফেরা হবে কখন?
ওস্তাদজির মুখে মিটিমিটি হাসি। সে ফস করে একটা একশো টাকার নোট বার করে তার নাকের সামনে নাচাতে লাগল।
আরে, কেয়া তাজ্জব! ওস্তাদজির তাপ্পি মারা আলখাল্লার জেব থেকে বেরুলো একশো টাকার নোট? লোকটা ভানুমতীর খেল জানে নাকি?
—এটা কী দেখালে, ওস্তাদ? কোথায় পেলে?
—তোরা আমাকে কী ভাবিস? আমি একেবার ফালতু? এটা আমি গান গেয়ে ইনাম পেয়েছি।
আবহাওয়া আবার হালকা হয়ে যায়। অনেকেই হাসতে শুরু করে। ওস্তাদজির গান শুনে কেউ টাকা দিয়েছে, এটা সত্যি বলে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু একশো টাকার নোটটা সত্যি। এখনও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি!
ধনিয়া বলল, ওস্তাদজি, তুমি ওই টাকাটা আমাদের জন্য খরচ করবে!
—আমি টাকা জমাই না। আচানক পেয়েছি। একদিনেই ফুঁকে দিতে রাজি আছি!
—তা হলে এক কাজ করো না! এত টাকা, চা খেয়ে কী হবে? মন্দিরে পূজা দাও!
—দূর পাগলা! আমি শুধু পেট পূজার কথা জানি, আর অন্য কোনও পূজা মানি না।
—শোনোই না কথাটা! দেওতার কাছে একটা খাঁসি কিংবা একটা ভৈস মানত করো! তারপর আমরা সবাই মিলে সেই মাংস খাব!
—একশো টাকায় খাঁসি কিংবা ভৈস হয়? একটা-দুটো ছুছুন্দুর হতে পারে!
ফুলসরিয়া বলল, আমার মরদটা সবসময় ফালতু কথা বলে। ওসব মাংস-টাংসর কথা থাক। বেঁচে থাকলে একদিন দু-দিন মাংস ঠিকই খাওয়া যাবে। ওস্তাদজি ওই যে হাওয়া মহল না কোন মহলের কথা বলল, আমি সেখানেই গিয়ে চা খেতে চাই!
অনেকেরই সেই মত হল। বাড়ি ফেরার তাড়া তো নেই, তাই সামনের দিকে এগিয়ে চলল এই গ্রাম্য বাহিনী। রাজধানীর দিকে।
খানিকদূর যাওয়ার পর তারা দেখল রাস্তা দিয়ে একটা লোক ডুগডুগি বাজিয়ে চলেছে। তার সঙ্গে একটা লোম ওঠা, রোগাটে ভাল্লুক আর দুটো বাঁদর। ওস্তাদজি এগিয়ে গিয়ে লোকটার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কেয়া দোস্ত কোথায় যাচ্ছ?
লোকটি ওস্তাদজির মুখ চেনে বোঝা গেল। সে বলল, আমার কি দিকের ঠিক আছে। যখন যেদিকে খুশি যাই। তুমি এই দলবদল নিয়ে চললে কোথায়?
ওস্তাদজি বলল, আমরা এক জায়গায় চা খেতে যাচ্ছি। তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে। তোমাকে পেয়ে খুব ভালো হয়েছে।
ভাল্লুকওয়ালা বলল, এত লোক যাচ্ছে শুধু চা খেতে?
—চলেই না। ভালো চা খাওয়াব। সেরকম চা বাপের জন্মে খাওনি!
একজন কেউ চেঁচিয়ে বলল, আমরা তাজমহলে চা খেতে যাচ্ছি।
লোকটি থমকে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে ওস্তাদজির হাতটা নামিয়ে দিয়ে চেয়ে রইল তার চোখের দিকে। সে বহুদর্শী মানুষ। সে চট করে মানুষের মুখের কথায় ভুলে যায় না।
সে জিগ্যেস করল, ওই লোকটা তাজমহলের কথা কী বলল? কোথায় চা খেতে যাওয়া হচ্ছে?
ওস্তাদজি মুচকি হেসে বলল, তাজমহলে। লোকটি বলল, আমাকে কি বুঢ়বাক পেয়েছো? আমি তাজমহল চিনি না? আমি সব চিনি। তাজমহল তো অনেক দূরে? এদিকে তো রাজধানী!
ওস্তাদজি বলল, আরে দোস্ত, চলোই না। তুমিই তো বললে তোমার দিকের ঠিক নেই। না হয় রাজধানীতেই গেলে।
—কিন্তু রাজধানী পর্যন্ত তুমি পয়দলে যাবে নাকি! মানুষ তো ছার, আমার ভাল্লুক-বান্দররাও থকে যাবে।
—তা হলে একটা ব্যবস্থা করতে হয়।
উলটোদিক থেকে তিনটে ট্রাক আসছে। ওস্তাদজি দু-হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার মাঝখানে। তার দেখাদেখি আরও অনেকে।
এই সব রাস্তায় এক-আধজন মানুষ সামনে পড়লে ট্রাক থামে না, চাপা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এখানে প্রায় চল্লিশ জন নারী-পুরুষ। বিকট শব্দে ব্রেক কষে থেমে গেল তিনটে ট্রাক।
তিনটিতেই ভরতি আছে ছাগল। ট্রাক ড্রাইভাররা নেমে দাঁড়িয়ে ভাবছে এটা আবার কোন পার্টির চাঁদার ব্যাপার!
ফুলসরিয়া জিগ্যেস করল, ওস্তাদজি এরা এত খাঁসি নিয়ে যাচ্ছে কোথায়?
ওস্তাদজি বলল, রাজধানীতে। সেখানকার মানুষের এই অ্যাও বড় খিদে? গাঁও-গাঁও থেকে চুন চুন করে সেইজন্য ওরা খাঁসি, মুরগি, গোরু, মাছ, দুধ সব নিয়ে যায়। মেয়েমানুষও নিয়ে যায়।
—তাদেরও খায় নাকি!
—হা-হা-হা-হা! তুমহার ডর নেই, ফুলসরিয়া, আমরা এতজন আছি, তুমহাকে কেউ খেতে পারবে না!
এগিয়ে গিয়ে ওস্তাদজি ট্রাক ড্রাইভারদের সামনে হাত জোড় করে বলল, ভাই সাহাব, মেরে দোস্ত, মেহেরবানি করে আমাদের একটু রাজধানী পৌঁছে দেবে।
এই উৎকট প্রস্তাব শুনে কিন্তু ট্রাক ড্রাইভাররা খুশিই হল। এই হারামজাদাগুলো রাস্তা আটকে বসে থাকলে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। পুলিশ এসে রাস্তা পরিষ্কার করতে-করতে অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা, তাতে অনেক খরচের ধাক্কা। তা ছাড়া এরা চাঁদাও চায়নি।
প্রথমে জায়গা নেই বলে খানিকটা গাঁইগুই করল তারা। তারপর কিছু ভাড়া পাওয়া যাবে কি না। তার ইঙ্গিত করল। ওস্তাদজি বলল, তার লোকজন ছাগল কোলে করে বসতে পারে, তাতে জায়গা হয়ে যাবে। ভাড়ার কোনও প্রশ্ন নেই, তবে রাজধানীতে পৌঁছে সে ট্রাক ড্রাইভারদের চা খাওয়াতে পারে।
শেষপর্যন্ত তারা রাজি হলেও আপত্তি হল ভাল্লুক আর বাঁদর দুটিকে নিয়ে। ওস্তাদজি বলল, বেচারা ভাল্লুকটার চেহারা দেখছো। তোমার এক একটা খাঁসি ওর চেয়ে বড়। ওকে দেখে কেউ ভয় পাবে না। চলো, চলো, আর দেরি নয়।
ফুলসরিয়া আর কয়েকটি মেয়ে দারুণ খুশি। প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনে এ একটা দারুণ মজা। ওস্তাদজি না হলে এরকম বুদ্ধি আর কে দেবে। কোথায় যাওয়া হচ্ছে কে জানে। কুছ। পরোয়া নেই।
দু-একজন চেঁচিয়ে গান গেয়ে ওঠে। অন্যরা সঙ্গে হাততালি দেয়। কত মজা, কত ফুর্তি? কী যে চা-খাওয়ার একটা ভেলকি তুললে ওস্তাদজি, তাতেই আজকের দিনটা বদলে গেল।
দূর থেকে রাজধানীর হৰ্য্যরেখা দেখে সবার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। যেন স্বর্গপুরী। এখানে আকাশও যেন নীচু।
এই দলের দু-দশ জন অবশ্য আগেও কয়েকবার রাজধানীতে এসেছে জনমজুরের কাজ করতে। কিন্তু সে অন্যরকম আসা। আজ যেন তারা রাজধানী জয় করতে যাচ্ছে।
ফুলসরিয়া জিগ্যেস করল, ওস্তাদজি, তাজমহল তো সবসে বড়া কোঠী। সেটা এখান থেকে দেখা যাবে না!
—দেখবে, দেখবে। ঠিক সময়ে দেখবে। তখন তুমহার আঁখ ঠিকরে যাবে, ফুলসরিয়া।
রাজধানীর উপকণ্ঠে ট্রাক ড্রাইভার তাদের নামিয়ে দিল। আর যেতে তাদের মানা আছে। ওস্তাদজির চা খাওয়ান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল তারা।
সেই মায়াপুরীর মধ্য দিয়ে হেঁটে চলল ওস্তাদজির দলবল। বাপরে-বাপ কত কিসিমের হাওয়া গাড়ি আর কত পুলিশ! ইস, ওস্তাদজি যদি আগে বলত তবে যার-যার ভালো পোশাক পরে আসতো। ফুলসরিয়ার একটা গোলাপ ফুল-ছাপা শাড়ি ছিল। তার বদলে সে পরে এসেছে একটা মামুলি হলদে শাড়ি। তাও আবার ছেড়া, কোনও মানে হয়?
ওস্তাদজি মাঝে-মাঝে রাস্তার লোকদের কী যেন জিগ্যেস করছে। তার খুব সাহস, সে পুলিশদের সঙ্গেও কথা বলতে দ্বিধা করে না। কত রাস্তায় যে ঘোরা হল তার ঠিক নেই। ঘুরতে-ঘুরতে একটা বড় মোকামের সামনে এসে ওস্তাদজি বলল, থামো! এহি হ্যায় তাজমহল!
অনেকেই হতাশ হল। তারা ভেবেছিল, বাদশা বেগমের ব্যাপার, নিশ্চয়ই সাঙ্তিক অন্যরকম কিছু হবে। কোথায় সেই রাজপ্রাসাদ? এই বাড়িটা বেশ বড় বটে কিন্তু এরকম বড় বাড়ি তো তারা আসতে-আসতে বেশ কয়েকটা দেখেছে। এর থেকেও বড় বাড়ি দেখেছে। রোদ্দুরের মতন শফেদও তো না এটা?
ধনিয়া বলল, এহি?
ভালুকওয়ালা ওস্তাদজিকে বলল, কেন দিল্লাগী করছো, ওস্তাদ? এই তোমার তাজমহল? এ তো একটা হোটেল?
ওস্তাদজি বলল, হ্যাঁ, হোটেলই তো। হোটেল ছাড়া চা আর কোথায় পাওয়া যাবে?
—সে কথা আগে বলনি কেন?
—আগে বললে এইসব আমার সাথীরা ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু আমি কিছু ঝুট বলিনি। এই হোটেলের নাম তাজমহল। বিশওয়াস না করো তো তুমি ওই দারোয়ানকে পুছকে দেখো!
হোটেলের কথা শুনে অনেকেই ঘাবড়ে গেছে। এতবড় হোটেলে ঢোকার সাহস তাদের নেই। ওস্তাদজি একশো টাকার নোট দেখিয়েছে বটে, একশো টাকা কম কিছুনয়, আবার বেশিও নয়। এই টাকায় একটা ভৈস বা খাঁসিও পাওয়া যায় না। এতবড় সাহেবদের হোটেলে কি এই টাকায় চা পাওয়া যায়? পাওয়া গেলেও তাদের ঢুকতে দেবে?
হোটেলের হেড-দারোয়ানের চেহারা আগেকার কোনও নবাব-বাদশার মতনই। নাকের নীচে প্রকাণ্ড মোছ, মাথায় নিভাঁজ পাগড়ি, গায়ে মখমলের জামা। হাতে একটা ছোট লাঠি, তার মুণ্ডিটা পেতলের হলেও সোনার মতন চকচকে। এতগুলো নোংরা-ছেড়া পোশাক পরা, খালি-পা ভিখিরি দেখে সে হুংকার দিয়ে উঠল, আরে রে-রে-রে-রে, ভাগ হিয়াসে।
সেই বজ্র গর্জন শুনে চুপসে গেল অনেকের মুখ। একজন অন্যের পেছনে লুকোবার চেষ্টা করল, সবাই পেছন চায়।
ওস্তাদজি কিন্তু এগিয়ে গেল সামনে, একেবারে হেড-দারোয়ানের মুখোমুখি। বিনা দ্বিধায় সেই মখমলের জামা পরা বুকে হাত রেখে মিষ্টি হেসে বলল, হামলোগ কাস্টোমার হ্যায়, কাস্টোমার! প্যায়সা দেব, খানাপিনা করব। তুমি ফিরিয়ে দিচ্ছ কী?
হেড-দারোয়ান তবু বলল, ভাগো, ভাগো! গেট কিলিয়ার করো! ওস্তাদজি বলল, আরে দাদা, তুমি কাস্টোমারকে ফিরিয়ে দিচ্ছ কী? ডাকো তোমার মালিককে। তার সঙ্গে বাৎচিৎ হবে!
হোটলের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে ততক্ষণে। স্টুয়ার্ড, ছোট ম্যানেজার, বড় ম্যানেজার সব। সন্ত্রস্ত মুখে শলা-পরামর্শ করছে, এ কীসের হামলা? কীভাবে এই উৎপাত রোখা যায়। হোটেলের নিজস্ব গার্ড আছে, তবু ফোন করা হল পুলিশকে। হোটেলে কত সাহেব-মেম আছে, কত শেঠ
আমির আছে, তাদের নিরাপত্তা চাই। এই হোটেল কী এমন দোষ করল যে গাঁ থেকে গুণ্ডা বদমাশরা এল হোটেল ঘেরাও করতে?
হোটেলের ছোট ম্যানেজার দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গার্ড ও পুলিশদের উদ্দেশে বলল, রিমুভ দেম! ক্লিয়ার দা গেটস!
ওস্তাদজি চেঁচিয়ে বলল, কী বলছেন ম্যানিজার সাব? ইংলিশমে খ্যাচ-ম্যাচ করছেন কেন? কোনও সাহেব কি আপনাকে পয়দা করেছে? আপনার গায়ের রংটি তো আমারই মতন!
ছোট ম্যানেজার বলল, টুম লোক ইধার সে চলে যাও! হল্লা মাট করো! নেহি তো পুলিশ তুম লোগকো পুশ করে গা!
ওস্তাদজি বলল, ইয়ে ক্যা আজিব বাত বলছেন, ম্যানিজার সাব? আপনি কাস্টোমারদের ভাগিয়ে দিচ্ছেন? আমি কানস্টিটিউশান পড়ে নিয়েছি, তাতে কোথাও লিখা নেই হোটেলে ঘুষতে গেলে পায়ে জুতা পরে আসতে হবে। পয়সা দিব, খাব, ব্যাস!
–হোটেলে তুমলোগ খেতে পারবে না, দুসরা হোটেলে যাও!
—কেন খেতে পারব না? সব কাস্টোমারকে কি তোমরা বলো, আগে রূপিয়া দেখাও? কনস্টিটিউশানে এ কথাও লিখা নেই।
ছোট ম্যানেজার তাড়াতাড়ি সরে গেল আরও বড় থানায় ফোন করতে।
চোখের নিমেষে এসে গেল গাড়ি-গাড়ি পুলিশ। আর তাদের জাঁদরেল চেহারার কর্তারা।
এত পুলিশের সমারোহ দেখে গাঁও-এর লোকেরা একেবারে ঘাবড়ে-টাবড়ে অস্থির। তারা আর্ত চিৎকার করে বলছে, এ তুমি কী করলে ওস্তাদজি? তোমার কথায় বিশ্বাস করে আমরা এতদূর
এলাম। চা পিলাবার নাম করে তুমি কি আমাদের মার খাওয়াবে? পুলিশ আমাদের ফাটকে ভরে দিলে খেতির কাজ কাম কী করে হবে? বালবাচ্চারা কী খাবে?
ভাল্লুকওয়ালার হাত থেকে ডুগডুগিটা নিয়ে ডুগা-ডুগ, ডুগা-ডুগ করে বাজিয়ে এক হাত তুলে ওস্তাদজি বলল, শুনো ভাইয়ো আর বহেনো, মরদকা বাৎ হাঁতিকা দাঁত! আমি তুমাদের জবান দিয়েছি কি তাজমেহেল হোটেলমে চা পিলাব। এমন বঢ়িয়া চা জীবনে খাওনি। যারা ডরপুক তারা পিছে হঠে যাও! যারা আমায় বিশওয়াস করো, তারা আমার সঙ্গে থাকো।
একটা গুঞ্জন উঠে আবার থেমে গেল। একজনও পিছিয়ে গেল না। ডরপুক বদনাম কে নিতে চায়? ওস্তাদজি তাদের ভালো দেখে, সে ইচ্ছে করে তাদের বিপদে ফেলবে না। এও যেন সেই ঠিকাদারকে ঘেরাও করার মতন একটা মজাদার ব্যাপার!
পুলিশের এক কর্তা এগিয়ে এসে ওস্তাদজিকে বলল, তুমি এদের লিডার? তুমি এ পাশে এসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ওস্তাদজি বলল, তোমার মতন ছোটামোটা দারোগার সঙ্গে কী কথা বলব? কমিশনার সাহেবকো বোলাও, নেহিতো প্রাইম মিনিস্টারজি কো বোলাও। যে-লোক কানস্টিটিউশান পড়েছে, তাদের সঙ্গে কথা হবে!
ছোট লোকের এই স্পর্ধা দেখে রাগে টকটকে হয়ে গেল পুলিশ কর্তার মুখ। একটু বাইরের দিকে হলে এদের পিটিয়ে শায়েস্তা করে দেওয়া যেত। দু-চারটে লাশ পড়লেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু এটা রাজধানী, এখানে শত-শত বিদেশি দূতাবাস, কত খবরের কাগজের লোক, কী থেকে কী হয়ে যায় তার ঠিক নেই। হোম মিনিস্টার খচাখচ সাসপেণ্ড করে দেবে!
পুলিশের কর্তার সঙ্গে হোটেলের ম্যানেজারদের আবার পরামর্শ হল। এই ঝঞ্চাট চুকিয়ে দেওয়ার একটাই উপায় আছে। ভিখিরিগুলো বাগানের শোভা নষ্ট করছে, যত তাড়াতাড়ি ওদের বিদায় করা যায়, ততই মঙ্গল।
বড় ম্যানেজার এবারে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক হ্যায়, তুম লোগ চা খেতে এসেছো, এই হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যাজ এ গুড উইল জেসচার তোমাদের চা খাওয়াবে। ফ্রি অফ কস্ট। তোমরা গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, চা পাঠানো হচ্ছে।
গাঁয়ের লোকেদের মুখে হাসি ফুটল। ওস্তাদজির জয় হয়েছে। সত্যিই তাদের চা খাওয়া হবে।
ওস্তাদজি হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিয়ে বিদ্রুপের সুরে ম্যানেজারকে বলল, আরে ছছাঃ! আমরা কি ভিখারি নাকি যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাব? স্বাধীন নাগরিক, পয়সা দিয়ে খেতে এসেছি, ভিতরে কুর্শিতে বসব, টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে আরাম করব, তবে না!
দলবলের উদ্দেশে ডাক দিয়ে সে বলল, চল, চল, অন্দর চল!
সবাই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওস্তাদজির নেতৃত্বে।
ভেতরে টেবিলে-টেবিলে বসে ছিল দেশ বিদেশের ফরসা রং সাহেব মেমরা, আর পাক্কা সাহেবি পোশাক পরা কালো রঙের দিশি সাহেবরা। সবাই আঁতকে উঠল, হুড়োহুড়ি ঠ্যালাঠেলি পড়ে। গেল। গাঁওয়ের মানুষ দখল করে নিল সব টেবিল চেয়ার।
ওস্তাদজি বলল, দে ধনিয়া, একটো বিড়ি ছাড়! দেখলি তো!
সবাই বলল, ওস্তাদজিকা জয়!
গলায় কালো বো বাঁধা একজন স্টুয়ার্ড ওস্তাদজির সামনে এসে ভদ্রকঠিন গলায় বলল, দেখুন, আপনারা চা খেতে চান, ঠিক আছে, চা দিচ্ছি। কিন্তু একটা ভাল্লুক আর বাঁদর নিয়ে হোটেলে। ঢোকার তো নিয়ম নেই। ওদের বাইরে রেখে আসুন!
ওস্তাদজি আলখাল্লার পকেট থেকে ফস করে খবরের কাগজটা বার করে সেই কর্মচারীর চোখের সামনে প্রথম পৃষ্ঠাটা মেলে ধরে বলল, এটা কীসের তসবির আছে? দেখো, আচ্ছা সে দেখো! চিনতে পারো না!
কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ভাল্লুকের ছবি!
ওস্তাদজি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শুনো, ভাইয়ো আর বহেনো, এই ভালকোর ছবি দেখছ, এটার মালিক এই হোটেল! হ্যাঁ, আমি ঠিক কথা বলছি। আখবরে সব লিখা আছে। এই হোটেল এই ভালকোটাকে পাঠিয়েছে ফরাসি সাহাবদের মুলুকে। সেখানে হোটেলে-হোটেলে এই ভালকো খেল দেখাবে! আমি ঝুট বলি না, সাচ বাৎ বলি, এখানে সব লিখা আছে। এই হোটেল যদি আন্যকুনো হোটেলে ভালকো পাঠায়, তবে আমরা কেন এখানে আমাদের ভালকো আনতে পারব না? আলবাৎ আনব?
সবাই হা-হা হো-হো করে হেসে সমর্থন জানাল ওস্তাদজিকে। সাহেবদের হোটেলে যদি ভাল্লুক যায়, তবে দিশি হোটেলে কেন আসবে না?
পুলিশ চেষ্টা করছে টেলিফোনে হোম মিনিস্টারকে ধরতে। কিন্তু তিনি বেপাত্তা। লাঠি, টিয়ার গ্যাস, না গুলি—কোনটা চালানো হবে, সে নির্দেশ কেউ দিতে পারছে না। তার থেকে এদের চা খাইয়ে দেওয়াই ভালো।
টেবিলে-টেবিলে দামি-দামি অ্যাস্ট্রে আর ফুলদানি। এ ব্যাটারা নির্ঘাৎ ওগুলো চুরি করবে। ম্যানেজারের নির্দেশে বেয়ারারা সেগুলো সরিয়ে নিতে এল।
ওস্তাদজি একজন বেয়ারার হাত চেপে ধরে বলল, আরে নোকর! তুই বড় লোকের নোকর। হয়েছিস বলে কি তোর জাত পালটে গেছে? তোর বাপ-দাদা কোনদিন খেতি-মজুরি করেনি? তুই আমাদের পছানতে পারছিস না? কানস্টিটিউশানের কোথায় লিখা আছে যে হোটেলে এসে সিগ্রেটের ছাই ঝাড়া চলবে লেকিন বিড়ির ছাই ঝাড়া চলবে না? রাখ ওসব!
তারপর তুড়ি মেরে সে স্টুয়ার্ডকে ডেকে বলল, ওহি কাগজ লাও, যে কাগজে সব চিজের নাম আর দাম লিখা থাকে!
টেবিলে-টেবিলে মেনু কার্ড পড়ে আছে, তার একখানা তুলে দেওয়া হল ওস্তাদজির হাতে। সে মনোযোগ দিয়ে পড়ার ভান করে বিড়বিড় করে বলল, শালা ডাকু! একটা শুখা মুৰ্গা, তার কিমমৎ দেড়শো রূপেয়া। এক পিলেট বাদাম, পচ্চিশ রূপেয়া! ডাকু! হারামখোর! নাঃ, আমরা শুধু চা খাব। চা আনো চাল্লিশ কাপ।
দু-তিনটি সাহেব সাহস করে ভেতরের দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। তাদের হাতে ক্যামেরা। ওস্তাদজি তাদের ডেকে বলল, আও, আও, তসবির খিঁচো।
রোগা প্যাংলা দুখীরাম নামের একজনকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, ইনকা তসবির লেও! রাজীবজি ফরাসি মুলুক আর আফ্রিকায় গেছে ফাংকশান করনে কে লিয়ে। জাদুঘর থেকে সব পাথরের মূর্তি নিয়ে গিয়ে সাহেবদের ভারত দেখাচ্ছেন। উয়ো তো পুরানা জামানার ভারত হ্যায়! ইয়ে দুখীরামকো দেখো। ইয়ে হ্যায় নয়া জমানাকা ভারত!
পুলিশ এসে সাহেবদের সরিয়ে দিল। বিদেশিদের যখন-তখন ছবি তোলার নিয়ম নেই। তা ছাড়া কখন ভায়োলেন্স শুরু হয়ে যায়, তার ঠিক কী! ওই লোকগুলো টেবিল চাপড়ে হাসি মস্করা করছে। ওদের চা দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
বড়-বড় পটে করে চা এল। বেয়ারা সেই চা কাপে-কাপে ঢালতে যেতেই ওস্তাদজি বলল, রোখো! তুম যাও!
তারপর সে ফুলসরিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, দেবী ফুলসরিয়া, আজ তুমিই এই তাজমহলের বেগম। তুমি নিজের হাতে সবাইকে চা বেঁটে দাও!
সকলেই এক একটা কাপ পাওয়ার পর সুরুৎ সারাৎ শব্দে চাটানতে লাগল। কেউ-কেউ বলল,
আঃ! মজা আ গিয়া! কী সুন্দর বাস, এমন চা বাপের জন্মে খাইনি। ধন্য তুমি, ওস্তাদজি!
শুধু ফুলসরিয়ার চোখে জল।
ওস্তাদজি তাকে জিগ্যেস করল, এ কী ফুলসরিয়া, তুম রোতে কিউ? কীসের দুঃখ হয়েছে তুমহার?
ফুলসরিয়া ধরা গলায় বলল, বড় আনন্দ হচ্ছে, ওস্তাদজি! আমি একটা বেহুদা কামিন। আমায় এত সম্মান কেউ কখনও দেয়নি।
—তুমি নিজে হাতে দিলে তাই চায়ে এত বেশি সুবাস, আরও যেন মিঠা লাগল! ঠিক কি না!
সবাই বলল, ঠিক ঠিক?
ভালুকওয়ালা বলল, আরে, তোমরা সব চা খেয়ে নিলে, আমার ভাল্লুক আর বান্দর দুটোকে একটু দিলে না?
তাই তো, তাই তো, বড় ভুল হয়ে গেছে। সবাই তাদের কাপ থেকে একটু-একটু ঢেলে দিল প্লেটে। সেই চা ভাল্লুক আর বাঁদর দুটোকে খাওয়ানো হল।
চা খেতে-খেতে চকচক করতে লাগল নির্জীব ভাল্লুকটার চোখ। এরকম ভালো জিনিস তো সে কখনও খায়নি! আবার যেন সে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
ওস্তাদজি ভালুকটার সামনে হাততালি দিয়ে বলে উঠল, নাচ ভালকো, নাচ! নাচ রে মুন্না নাচ!
সবাই মিলে হাততালি দিতে লাগল ভাল্লুকটাকে ঘিরে।