1 of 3

দেখা না দেখা

দেখা না দেখা

কোথাও বেড়াতে গেলে অনেক কিছুই দেখা হয়, কিন্তু একটা কিছু বাকি থেকে যায়। সেই না দেখা একটা কিছুর জন্য মন কেমন করে।

শেষরাত্রে নেমেছিলাম জলগাঁও স্টেশনে। ভোর পর্যন্ত বাসে সেখানেই কাটিয়ে তারপর চলে এলাম ঔরঙ্গাবাদ। আগে থেকে হোটেল ঠিক করা ছিল না, বাসেই কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সস্তা গোছের হোটেলের নাম জেনে নিয়েছিলাম। দু-জায়গা ঘুরে শেষপর্যন্ত একটা গুজরাটি হোটেলে জায়গা পাওয়া গেল। আর সবই ভালো, শুধু নিরামিষ খেতে হবে। যাক গে, মোটে তো তিনটে দিন।

তার বেশি আর সময় হাতে নেই। আগামী সোমবার আমাকে বম্বে পৌঁছোতেই হবে। একটা চাকরির ইন্টারভিউয়ের ব্যাপার। মাঝখানে এই ফাঁকে অজন্তা-ইলোরা ঘুরে যাওয়া।

চা খেয়েই গেলাম বাস-ডিপোয়। অজন্তা-ইলোরা দুটো দু-দিকে, বেশ দূরে-দূরে। ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়ার অনেক খরচ। ট্যুরিস্ট বাসেও সেদিন কোনও জায়গা নেই। এর মধ্যেই সব ভরতি।

তবে পরের দু-দিনের টিকিট আছে।

সেই টিকিটই কেটে নিয়ে যেই আবার রাস্তায় এসেছি, অমনি রাহুলদার সঙ্গে দেখা।

দুজনেই অবাক।

রাহুলদা বললেন, তুই?

আমি বললাম, আপনি?

রাহুলদা আমার কাঁধে একটা প্রকাণ্ড চাপড় মেরে বললেন, কবে এসেছিস এখানে? আমাকে খবর দিসনি কেন?

—আমি কী করে জানব যে আপনি এখানে থাকেন?

—তোকে দেবু কিছু বলেনি?

দেবু আমার ছোটকাকা। রাহুলদা তাঁর বন্ধু। কাকার বন্ধুকে কাকাই বলা উচিত। কিন্তু রাহুলদাই আমাদের বারণ করে দিয়েছিলেন। উনি কাকা, জ্যাঠা, পিসেমশাই হওয়া একদম পছন্দ করেন না। বলে দিয়েছিলেন দাদা বলে ডাকতে। ওর বয়েস এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি।

রাহুলদা ইনকাম ট্যাক্স বিভাগে কাজ করেন। কিছুদিন আগে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন।

—কোথায় উঠেছিস? চল, আমার ওখানে চল!

আমি বললাম, আমি যে হোটেলে বুক করে ফেলেছি?

—কোন হোটেল? চল, আমি দেখছি।

রাহুলদা হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কীসব কথা বললেন, অমনি সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, আমাকে আর টাকা দিতে হল না। একটা গাড়ি ডাকিয়ে সুটকেসটা তুলে রাহুলদা বললেন, আয় আমার সঙ্গে।

রাহুলদা কোয়ার্টার পেয়েছেন চমৎকার। একতলা একটি বাংলো ধরনের বাড়ি। সামনে-পেছনে বাগান। বড়-বড় চারখানা ঘর। রাহুলদার বদলির চাকরি বলে ছেলেমেয়েরা বরাবর হোস্টেলে থাকে। ছেলে শিবপুরে, মেয়ে শান্তিনিকেতনে। বাড়িতে শুধু স্বামী-স্ত্রী থাকবার কথা, কিন্তু আর একজন আছে। রাহুলদার স্ত্রীর ছোটবোন যশোধারা। মাসদেড়েক হল, সে এখানে এসে আছে। রাহুলদার স্ত্রীর হাঁপানি আছে, মাঝে-মাঝে একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এখন সেইরকম অবস্থা।

যশোধারার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েই রাহুলদা বললেন, শোন সুনীল, এর সঙ্গে কিন্তু প্রেম ট্রেম করার চেষ্টা করিস না। এর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আর একুশ দিন পরেই ওর বিয়ে।

যশোধারা ভুরু কুঁচকে রাহুলদাকে ছোট্ট বকুনি দিল।

রাহুলদার এইরকম আলগা রসিকতা করার অভ্যেস বরাবরই। আমি বললাম, তোমার সাবধান করে দেওয়ার দরকার ছিল না। তোমার সুন্দরী শ্যালিকা, তার সঙ্গে কি আমি প্রেম করার সাহস দেখাতে পারি? তুমি থাকতে!

রাহুলদা হা-হা করে হেসে উঠলেন, বউদি উঠে এসে একটা বেতের চেয়ারে বসেছেন বারান্দায়। তাঁর সামনেই বললেন, সত্যি, নিজের বউ অসুস্থ, শয্যাশায়ী, এই সময় সুন্দরী শ্যালিকার সঙ্গে প্রেম করাই উচিত ছিল আমার। ঠিক গল্পে এরকম হয়। রবীন্দ্রনাথের কী একটা উপন্যাস আছে না এরকম?

বউদি ক্ষীণভাবে হেসে বললেন, তা একটু করে নিলেই পারতে। খুকু আপত্তি করত না।

রাহুলদা বললেন, করতাম। কিন্তু মুশকিল হল কী জানেনা? ওই যে বিয়ে ঠিক করে ফেলল! কুমারী মেয়ের সঙ্গেও প্রেম করা যায়, বিবাহিতা মেয়েদের সঙ্গেও প্রেম করা যায়। কিন্তু যে মেয়ের আর মাত্র মাসখানেকের মধ্যেই বিয়ে হবে, নিজেই সে-বিয়ে ঠিক করেছে, সে-মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে নেই। সেটা আন-এথিক্যাল।

যশোধারা বলল, রাহুলদা, আপনারা বুঝি কোনও মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার কথা। ভাবেন? সেই মেয়েটি রাজি হবে কি না, সেকথা ভাবেন না? প্রেমে পড়া ছাড়া আর বুঝি কোনও কাজ নেই মেয়েদের?

রাহুলদা বললেন, যতই কাজ থাক, তা বলে কি প্রেমটা বাদ দিলে চলে? এই যে সুনীলদাকে দেখছ, এ যে কত মেয়ের সঙ্গে–

আমি বললাম, রাহুলদা, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি বেকার। বেকারকে কোনও মেয়েই পাত্তা দেয় না।

বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা জমানো গেল। আমি মাত্র তিনদিন থাকব জেনে ওরা সবাই বেশ আপোশ করতে লাগলেন। রাহুলদা বললেন, তুই যদি আর কয়েকদিন আগে আসতিস! আমার অফিসের গাড়িতে আমি যশোধারাকে অজন্তা আর ইলোরা সব ঘুরিয়ে দেখালাম। তখন এলে একসঙ্গে হয়ে যেত।

আমি বললাম, তাতে কোনও ক্ষতি নেই। আমি ট্যুরিস্ট বাসের টিকিট কেটে এনেছি।

রাহুলদা বললেন, অবশ্য ওরা ভালোই দেখায়। অনেকটা সময় দেয়। দু-জায়গা ঘুরতে তোর দু দিন পুরো লেগে যাবে।

যশোধারা জিগ্যেস করল, আপনি ঔরঙ্গাবাদ কেভস দেখতে যাবেন না?

আমি অবাক হয়ে বললাম, এখানেও কেভস আছে নাকি? জানতাম না তো! রাহুলদা বললেন, এখান থেকে খুব কাছেই পাঁচ-সাতমাইল দূরে পাহাড়ের ওপর কেভস আছে, অজন্তার মতনই, তার দেওয়ালে ছবি আঁকা। অনেকেই এর খবর রাখে না।

যশোধারা বলল, খুব সুন্দর কিন্তু।…কয়েকটা ছবি…আমার খুব ভালো লেগেছে, বিশেষ করে সেই নর্তকী…

রাহুলদা বললেন, ঔরঙ্গাবাদের কেভস আমরা আজ বিকেলেই সুনীলকে দেখিয়ে আনতে পারি। ঘণ্টাদুয়েক লাগবে। আমি অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি চলে আসব। সেই রকমই ঠিক হয়ে রইল। রাহুলদা অফিসে চলে গেলেন। আমি খেয়েদেয়ে একটা ঘুম দিলাম।

চারটের সময় রাহুলদার অফিস থেকে গাড়ি এল। কিন্তু রাহুলদা এলেন না। ড্রাইভারের হাতে দু খানা চিঠি। একটা আমার জন্য, একটা যশোধারার। আমার চিঠিতে রাহুলদা লিখেছেন, উনি। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারছেন না, বম্বে থেকে কয়েকজন অফিসার এসেছেন, তাই একটু বেশিক্ষণ থাকতে হবে, ফিরতে-ফিরতে ছটা হয়ে যাবে। অন্ধকার হয়ে গেলে আর ওই গুহাচিত্র দেখতে গিয়ে লাভ নেই। সুতরাং আমি যেন তখুনি ওই গাড়িতে বেরিয়ে পড়ি।

যশোধারা তার নিজের চিঠিটা পড়ে বলল, একলা-একলা আপনার যেতে ভালো লাগবে না। রাহুলদা লিখেছেন আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে।

আমি ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম, আপনি তো কদিন আগেই ঘুরে এসেছেন, আবার যাবেন কেন? আমি একলাই দেখতে পারব।

যশোধারা বললেন, ওসব জিনিস বারবার দেখা যায়। আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

বেরুতে-বেরুতে আরও আধঘণ্টা সময় লেগে গেল। তারই মধ্যে আকাশে ঘনিয়ে এল মেঘ। একটুবাদেই আলো কমে আসবে।

যশোধারা নিজের ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে বলল, ইস, দেরি করে ফেললাম। চলুন-চলুন এরপর আর ভালো করে দেখা যাবে না।

ড্রাইভার লম্বা সেলাম করে আমাদের দরজা খুলে দিল। আমরা উঠে বসলাম। গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল।

প্রথম পাঁচ মিনিট আমরা কোনও কথা বললাম না। তাতে আমার নিজেরই খুব অশ্বস্তি লাগল।

যশোধারা নিজের ইচ্ছেতেই যাচ্ছে আমার সঙ্গে।

আমি বললাম, আপনি এখানে আর কদিন থাকবেন?

যশোধারা বলল, আর দিনসাতেক। দিদির শরীরটা একটু ভালো হলে দিদিকে একেবারে সঙ্গে নিয়ে যাব।

আমি হেসে বললাম, বিয়ের জন্য কেনা-কাটা তো করতে হবে। তারজন্য মাত্র এই কটা দিন। সময়?

আজকালকার মেয়েরা বিয়ের কথায় লজ্জা পায় না। যশোধারা অম্লান মুখে বলল সে সব হয়ে গেছে।

—আপনার বিয়ে হবে কোথায়? কলকাতায়?

আমাকে চমকে দিয়ে যশোধরা বলল, না, বিলেতে।

—বিলেতে?

—হ্যাঁ। ও, মানে কৌশিক, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে তার আসবার কথা ছিল, কিন্তু এই মাসেই ও চাকরি বদলাচ্ছে। নতুন চাকরিতে এখন বেশ কিছুদিন ছুটি পাওয়া যাবে না, তাই আমিই চলে যাব ওখানে।

দারুণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। বিয়ের কনে যাবে বরের কাছে। একা-একা?

জিগ্যেস করলাম, আপনার সঙ্গে কেউ যাবে?

—না।

—আপনার বাবা-মায়ের কষ্ট হবে না? আপনার বিয়ের সময় কেউ উপস্থিত থাকবেন না।

—আমার বাবা থাকেন স্বর্গে। তিনি এমনিতেই উপস্থিত থাকতে পারবেন না।

—ও!

গাড়িটা যাচ্ছে খুব জোরে। সামনে দেখা যাচ্ছে পাহাড়। হঠাৎ বেশ জোরে একটা শব্দ হল গাড়ির নীচ থেকে তার পরই সেটা টালমাটাল হয়ে গড়াতে লাগল বিপজ্জনকভাবে। মনে হল, গাড়িটা যে-কোনও সময় রাস্তার ধার দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাবে।

আমার নিজের জন্য কোনও চিন্তা হল না। কিন্তু ভাবলাম যদি যশোধারার কিছু হয়? যদি কোনও আঘাত লাগে? আর কদিন পরই তার বিয়ে, তার জন্য বিলেতে একজন প্রতীক্ষা করে আছে। দরকার হলে আমার জীবন দিয়েও ওকে বাঁচাব।

গাড়িটা থেমে গেল রাস্তার এক পাশে।

—কী হল?

ড্রাইভারের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। সে কোনও উত্তর না দিয়ে নেমে গেল। আমিও নেমে পড়লাম। ড্রাইভার উঁকি মারল গাড়ির নীচে। একটু বাদে সে উঠে দাঁড়িয়ে বিবর্ণ মুখ করে বলল, আমরা খুব জোর বেঁচে গেছি। গাড়ির অ্যাক্সেল ভেঙে গেছে।

এই রে!

যশোধারা মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে?

আমি বললাম, আমাদের লাক খারাপ। অ্যাক্সেল ভেঙে গেছে।

গাড়িটার চেহারা বেশ চকচকে। নতুনের মতন। কিন্তু এইসব দিশি গাড়ি কখন যে খারাপ হবে, তার কোনও ঠিক নেই।

যশোধারা নেমে এসে বলল, গাড়িটা ঠিক করতে কতক্ষণ লাগবে?

ড্রাইভারের বদলে আমিই উত্তর দিলাম, তোক ডেকে আনতে হবে। আজ তো হবেই না—

যশোধারা কিন্তু একটুও ঘাবড়াল না। সে বলল, আর বেশিদূর নয়, ওই তো সামনেই দেখা যাচ্ছে, বড়জোর এক মাইল হবে, চলুন হেঁটেই যাই।

হেঁটে যাব? তারপর ফিরব কী করে?

সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে কিছু। ওখানে নিশ্চয়ই অন্য লোকদের গাড়ি কিংবা ট্যাক্সি থাকবে। কারুর কাছে লিফট চাইলেই হবে।

যশোধারা নিজে দেখেছে ওই গুহাচিত্র। তবু আমাকে দেখাবার জন্য ও হেঁটে যেতে চাইছে। মনে-মনে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।

কিন্তু বেশিক্ষণ হাঁটা গেল না। বৃষ্টিটা একটু থেমেছিল, আবার হঠাৎ এসে পড়ল হুড়মুড় করে। এমন জোরালো বৃষ্টি যে কিছু চিন্তা করারও সময় দিল না।

কাছাকাছি আশ্রয় নেওয়ার মতন কোনও জায়গা নেই। এদিকে বাড়ি-ঘর নেই একটাও। খানিকটা দুরে একটা একলা গুলমোর গাছ রয়েছে।

যশোধারাকে বললাম, চলুন, ওই গাছটার নীচে দাঁড়াই।

আমি বলতে-না-বলতেই যশোধারা ছুটতে শুরু করেছে। শাড়ি পরেও ও বেশ ভালো দৌড়োতে পারে।

কিন্তু গাছতলায় পৌঁছবার আগেই আমরা দুজনে বেশ ভিজে গেলাম। গাছতলায় দাঁড়িয়ে যশোধরা আঁচল দিয়ে মুখ মুছল।

আমি বললাম, ইস, শুধু-শুধু আমার জন্য আপনি এলেন, আর এইরকম ভিজতে হল!

যশোধারা হেসে বলল, একটু ভিজলে কী হয়েছে? বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হল আজ। বৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে প্রবল ঝড়ো বাতাস। শুকনো পাতা আর ফুল ঝরে পড়ছে গাছটা থেকে। একটু বাদেই গাছটা আর আমাদের আশ্রয় দিতে পারল না। গাছের পাতা চুইয়ে বৃষ্টির চেয়েও জোরে জল পড়তে লাগল আমাদের ওপরে।

দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভেজা ছাড়া উপায় নেই। আমরা আমাদের গাড়িতে ফিরে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারতাম। কিন্তু গাড়িটা থেকে প্রায় আধমাইল দূরে চলে এসেছি। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এতখানি রাস্তা হেঁটে যাওয়া সহজ নয়।

আধঘন্টার মধ্যেও বৃষ্টি থামল না একটুও। দুজনেই ভিজে চুপচুপে। যশোধারা একটুও ঘাবড়ায়নি। সে বেশ হাসিমুখেই বলল, আপনার আর ঔরঙ্গাবাদ কেভস দেখা হল না। এরপর একদম অন্ধকার হয়ে যাবে।

ভিজে শাড়িতে যশোধারার সুন্দর শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাকে দেখাচ্ছে কোনও শিল্পীর গড়া মূর্তির মতন কিংবা হেমেন মজুমদারের আঁকা ছবি। আমি দু-একবার গোপনে ওর দিকে তাকাতে লাগলাম।

ঠিক গল্পের মতন রোমান্টিক পরিবেশ। ফাঁকা রাস্তায় একটি মাত্র গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজনে। বৃষ্টিতে ভিজছি। একটু একটু শীত করছে। এই সময় যশোধারার গলা জড়িয়ে ধরে…

না, না, একুশ দিন পরে যে-মেয়ের বিয়ে হবে, তার সঙ্গে প্রেম করতে নেই। শাস্ত্রে নিষেধ আছে। কিন্তু তার দিকে মাঝে-মাঝে তাকানোও কি অপরাধ? সুন্দর কোনও দৃশ্য দেখায় তো পাপ নেই। তাই যশোধারাকে আমি চোখ ভরে দেখতে লাগলাম।

খানিকটা পরে উলটো দিকের রাস্তা দিয়ে পরপর দুটো গাড়ি এল। আমরা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে। হাত নেড়ে ওদের থামতে বললাম। যশোধারা একটা গাড়ির একেবারে সামনে এগিয়ে গেল।

দুটো গাড়িতেই লোক ভরতি ছিল। তবু কোনরকমে জায়গা হয়ে গেল। আমরা গাড়িতে ওঠবার পর একজন লোক ইংরেজিতে বলল, আপনার স্ত্রী গাড়িটার দিকে অমন বিপজ্জনক ভাবে ছুটে আসছিলেন…বৃষ্টির সময়…একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারত…

যশোধারাও শুনেছে কথাটা। সে মুচকি হাসল। আমি আর প্রতিবাদ করবার প্রয়োজন বোধ করলাম না।

এর পরের দুদিন আর একটুও সময় পেলাম না আমি। অজন্তা ইলোরা দেখায় কেটে গেল। তারপর রাত্তিরের বাসে চেপে বম্বে। ঔরঙ্গাবাদ কেভস আর দেখা হয়নি।

কিছুদিন আগে একটি ইতিহাসের বইতে ছবি দেখছিলাম সেই কেভসের সেই বিখ্যাত নর্তকী। আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। অত কাছে গিয়েও দেখা হয়নি। আর কি কোনওদিন দেখা হবে?

ঔরঙ্গাবাদ কেভসের নর্তকীকে আমি দেখিনি। তার বদলে দেখেছিলাম এক জীবন্ত ছবি। সেই গুলমোর গাছের নীচে, বৃষ্টির মধ্যে, যশোধারা সুঠাম শরীর, হাসিতে উজ্জ্বল মুখ। যশোধারা এখন বিলেতে, তার সঙ্গে হয়তো জীবনে আর কখনও দেখা হবে না। কিন্তু তার বৃষ্টিভেজা ছবিটা। বহুদিন বাঁধানো থাকবে আমার বুকের মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *