ঝুটো পাথর
একটু বিপজ্জনকভাবেই রাস্তা পার হয়ে গেল জুয়েল। তার স্বভাবই এইরকম, কখন লাল বাতি জ্বলছে, কখন সব গাড়ি থেমে যাবে, সে পর্যন্ত তার ধৈর্য থাকে না। এদেশে গাড়িতে কেউ হর্ন বাজায় না, তবু ফোর্ড গাড়িটা জুয়েলের একেবারে গা ঘেঁষে এসে খুব জোরে একটা হর্ন বাজাল।
গাড়িটা চালাচ্ছেন একজন মাঝবয়সি কালো মহিলা। রাগে তার মুখখানা গনগনে হয়ে গেছে, কী যেন একটা গালাগালি ছুড়ে দিলেন জুয়েলের দিকে।
জুয়েল আর পেছন ফিরে তাকাল না। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে লাগল হনহন করে। আর পনেরো মিনিট দেরি হলে হাসপাতালে ঢুকতে দেবে না। তার চেয়ে বড় কথা সাতটার সময়। শিরিনের ছুটি হয়ে যাবে। তারপর সে এক মিনিটও অপেক্ষা করতে চায় না। হাসপাতালে একটু মুখ দেখিয়েই জুয়েলকে ছুটতে হবে। হাসপাতালের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে কামাল আর বাবলু। দুজনেরই মুখ শুকনো।
জুয়েল ভুরু নাচিয়ে জিগ্যেস করল, স্যার কেমন আছেন।
বাবলু বলল, ভালো না রে। আর বোধহয় আশা নাই।
কামাল বলল বিকেলে রিপোর্ট এসেছে। দুটো কিডনিই ড্যামেজ। বাদ দিতে হবে! জুয়েল বলল দুটো কিডনি কখনও বাদ দেওয়া যায় নাকি? বাবলু বলল, একটা কিডনি বাদ দিলে মানুষ বাঁচতে পারে। খারাপ দুটো কিডনি বাদ দিয়ে অন্তত একটা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে পারলে কাজ চলে যাবে। জুয়েল বলল, তা হলে আশা নেই বলছিস কেন? কামাল বলল, কিডনি পাওয়া যাবে কোথায়? কিনতে গেলে কত দাম লাগে জানিস, অন্তত তিরিশ হাজার ডলার! বাবলু বলল, চল, উপরে যাবি তো একবার?
তিনজনকে একসঙ্গে যেতে দেবে না। কামাল রয়ে গেল। লিফট দিয়ে উঠতে-উঠতে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল জুয়েল। এখানে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকা যাবে না। কল্পনায় সে শিরিনকে দেখতে পাচ্ছে। গ্রিনিচ ভিলেজে একটা পিৎসার দোকানের সামনে এসে অস্থির ভাবে পা ঠুকছে। রাগলে শিরিনের মুখখানা আরও সুন্দর দেখায়।
একটা ঘরে দুজন করে রোগী। পাশের রোগীটির বয়স বেশ কম, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর হবে, তার শয্যার পাশে একজন দারুণ চেহারার তরুণী। যেন আগুনের ঢেলা।
ডানদিকের শয্যায় আছেন অধ্যাপক জিয়া হায়দার। প্রশান্ত মুখ। এককালে খুব সুপরুষ ছিলেন, বার্ধক্য ও রোগে এখনও পুরোপুরি কাবু হননি। ওদের দেখে হাসবার চেষ্টা করলেন।
তারপর জুয়েলের হাত ধরে বললেন, আমার জন্য চিন্তা কোরো না। সবাইকে তো এক সময় যেতে হয়। তোমরা ভালো থাকো।
এদেশে এই এক অদ্ভুত নিয়ম। রোগীর কাছে কিছুই গোপন করা হয় না। যার ক্যানসার ধরা পড়ে তাকেও জানিয়ে দেওয়া হয় সঙ্গে-সঙ্গে। অধ্যাপক নিজের নিয়তির কথা জেনে গেছেন।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকা থেকে কয়েকটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। অধ্যাপক জিয়া হায়দার। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর তাঁকে ফিরতে দেয়নি কামাল-জুয়েলরা। ১৬ই ডিসেম্বর ব্রুকলিনে তাদের সংস্কৃতি উৎসব। সেখানে সভাপতিত্ব করবার জন্য তারা স্যারকে ধরে
রেখেছে। এর মধ্যে এই কাণ্ড। কিডনির এই অবস্থার কথা তিনি খেয়াল করেননি আগে। কিংবা টের পেলেও গ্রাহ্য করেননি।
এদেশে মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স যদি না থাকে, তা হলে রোগ-ভোগে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ ছিল এক মাসের জন্য, ওই সময়ের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে। বিশ্ববিদ্যালয়ই সব দায়িত্ব নিত। এখন তারা নেবে না! বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যার দুহাজার ডলার পেয়েছিলেন, এ দেশে চিকিৎসার খরচের তুলনায় তা নস্যি। আমেরিকায় স্যারের অসংখ্য ছাত্র ছড়িয়ে আছে। তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে।
অধ্যাপক জিয়া হায়দার এরকম দাতব্য চিকিৎসা একেবারেই চান না,
পাঁচ মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট কেটে গেছে। তবু জুয়েল উঠতে পারছে না। স্যার কী শান্তভাবে কথা বলছেন! সামনে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও কোন মানুষ এমন শান্ত থাকতে পারেন?
এক সময় তিনিই বললেন, তোমরা ব্যস্ত হয়ো না। আমার ফেরার ব্যবস্থা করে দাও। শেষ কটা দিন জন্মস্থানে কাটানোই তো ভালো। আমার টিকিট তো আছেই, যত তাড়াতাড়ি বুকিং পাও।
বাবলু কুণ্ঠিতভাবে বলল, স্যার আপনাকে এখন এই হসপিটাল থেকে রিমুভ করা যাবে না। আমরা দেখছি, যদি একটা কিডনির ব্যবস্থা করা যায়।
স্যার বললেন, না, না, তার দরকার নেই। অনেক খরচ আমি জানি। তোমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে–
জুয়েল ফস করে বলে ফেলল, টাকা লাগবে না স্যার। আমি একটা কিডনি ডোনেট করতে রাজি আছি। যদি মেলে—
স্যার একটু অবাক হয়ে জুয়েলের দিকে তাকিয়ে রইলেন নিঃশব্দে। তারপর বললেন, তুমি। কিডনি দেবে? কেন? না, না, আমি কিছুতেই নিতে পারি না। জুয়েল বললেন, একটা কিডনি নিয়েও মানুষ দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। শরীরের অনেককিছু বেশি থাকে।
স্যার বললেন, তোমার কী-ই বা বয়েস, সামনে তো অনেকখানি জীবন পড়ে আছে। আমি তো ষাট বছর বাঁচলাম, আমাদের দেশে অ্যাভারেজে তাই-ই যথেষ্ট। তুমি যে বললে, এতে আমি খুশি হয়েছি।
জুয়েল এবার জোর দিয়ে বলল, না, স্যার, শুধু মনের কথা নয়। আপনার কাছ থেকে আমার মতন হাজার-হাজার ছেলে কত কিছু শিখবে, যদি এইটুকু প্রতিদান দিতে না পারি—
এতক্ষণ পরে স্যারের দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
শিরিনের কাছে আর যাওয়া হল না। কামাল আর বাবলু তখনই জুয়েলকে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল, জুয়েলের কিডনি স্যারের শরীরে নিখুঁতভাবে লেগে যাবে।
হঠাৎ নিউ ইয়র্কের বাঙালিদের মধ্যে হিরো হয়ে গেল জুয়েল। অনেকেই টেলিফোনে তাকে অভিনন্দন জানায়। দু-একজন অবশ্য বলে, তারাও নিজেদের কিডনি দান করার কথা ভেবেছিল, কিন্তু জুয়েল যখন আগেই বলে ফেলেছে, তাকেই সুযোগ দেওয়া হোক।
অনেকেই তাকে বাড়িতে ডেকে খাওয়াতে চায়। সীমাভাবী শুধু যে নানারকম রান্না করে খাওয়ালেন তাই-ই নয়, একটা খুব দামি জামা উপহার দিলেন। ছলছলে চোখে বললেন, তুমি যা করলে জুয়েল, তুমি আমাদের গর্ব। এখনকার দিনে মাস্টারমশাইদের জন্য কজন এরকম করে।
ঢাকাতেও খবর পৌঁছে গেল। অনেক রাতে ফোন এল জুয়েলের কাছে। স্যারের স্ত্রী ভালো করে কথা বলতে পারছেন না, কাঁদছেন। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে কোনওরকমে বললেন, এজন্য আল্লা তোমাকে অনেক দেবেন…আমি তোমার জন্য দোয়া করব…কোনওরকমে ওনাকে সুস্থ করে। দেশে পাঠিয়ে দাও, সামনের মাসে আমার মেয়ের বিয়ে…
শিরিনের সঙ্গে দেখা হলো তিনদিন পরে। জুয়েল আগে থেকেই টেলিফোন করে ক্ষমা চেয়েছে অনেকবার, কিন্তু এই খবরটা জানায়নি। শিরিন হস্টেলে থাকে, তার সঙ্গে অন্যদের বিশেষ যোগাযোগ নেই।
শাড়ি পরতেই পছন্দ করে শিরিন, কিন্তু ডিসেম্বর মাসে শাড়ি পরে চলাফেরা করা অসম্ভব।
প্যান্টের ওপর ওভারকোট পরে দাঁড়িয়ে আছে শিরিন, দু-হাতে দস্তানা, মাথায় টুপি, ঝিরঝির করে তুষারপাত শুরু হয়েছে। শিরিন একেবারে ঘড়ি ধরে কাঁটায়-কাঁটায় আসে।
বাসটা থামতে-না-থামতেই প্রায় লাফ দিয়ে নেমে দৌড়তে লাগল জুয়েল। তার ঠিক এক মিনিট দেরি হয়েছে।
কলেজে পড়ে আর-একটা পিৎসার দোকানে পার্ট-টাইম কাজ করে শিরিন।
জুয়েল চাকরি করে একটা সুপার মার্কেটে। তা ছাড়া ছবি আঁকার কোর্স নিচ্ছে। তার দারুণ। গড়াপেটা স্বাস্থ্য, সেই তুলনায় শিরিন ছিপছিপে, তীক্ষ্ণ নাক, গায়ের রং একটু চাপা, কিন্তু চোখদুটি খুব সুন্দর। অর্থাৎ যাকে বলে, তন্বী শ্যামা।
জুয়েল এসেই বলল, এক মিনিট, মাত্র এক মিনিট, তার জন্য সরি! ভেরি সরি!
আজ শিরিন রাগেনি। হাসি মুখে বলল, শুধু সরি বললে হবে না। ফাইন দিতে হবে।
—রাজি আছি। কী ফাইন দেব, বলো।
—তোমার অ্যাপার্টমেন্টে আমাকে আজ নিয়ে যেতেই হবে।
—এই তো, এই একটা ব্যাপারই যা আমি পারি না।
—কেন পারো না?
—তোমাকে কতবার বলেছি, আমার রুমমেট আছে হারুন, সেটা আবার খুব নীতিবাগীশ! আমার ওপর যখন তখন লেকচার দেয়।
—অমন রুমমেট রাখো কেন? জুয়েল, এই শীতের মধ্যে কি রাস্তায় ঘোরা যায়?
—তাহলে চলো, কোন রেস্টুরেন্টে বসি।
—আমি চারঘণ্টা পিৎসা হাটে কাজ করি। তারপর কোনও খাবারের জিনিসের গন্ধ নাকে এলেই বমি আসে।
—শিরিন, আমি কথা দিচ্ছি, সামনের মাসেই নিজস্ব একটা অ্যাপার্টমেন্ট নেব।
—তোমার নাকটা লাল হয়ে গেছে। ঠান্ডা লাগিয়েছ?
হাতে দু-তিনঘণ্টা সময়। শিরিন থাকে হোস্টেলে, আর জুয়েলের ঘরে রুমমেট। ঠান্ডার মধ্যে কোথায়-কোথায় আর বেড়াবে? দুজনে ট্রেনে চেপে আপ স্টেট নিউ ইয়র্কের দিকে খানিকটা ঘুরে এল।
অন্যান্য কথার মধ্যে জুয়েল এ কথাটা বলি-বলি করেও শেষপর্যন্ত বলতে পারল না। তার কিডনি দেওয়ার প্রস্তাব শুনে শিরিনের কী প্রতিক্রিয়া হবে! যদি, ঘোরতর আপত্তি তোলে? কিন্তু জুয়েল কথা দিয়ে ফেলেছে। জেনে গেছে অনেকে। এই তো আজই চেনা একজন জুয়েলকে দেখে রাস্তাতেই জড়িয়ে ধরল। টেলিফোন তো অনবরত আসছেই। এখন তো সে আর পেছোতে পারে না।
এই কদিন তার রুমমেট হারুনের সঙ্গে ভালো করে কথা হয়নি। রাত্রে হারুন তাকে ধরল। শুধু রুমমেট নয়। হারুন তার আত্মীয়ও বটে। নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে পি এইচ ডি করছে। বুদ্ধি খুব চোখা।
পালা করে রান্না করে দুজনে। আজ হারুন ইলিশ মাছ বেঁধেছে। মাইক্রোওয়েভে ভাত গরম করতে-করতে সে জিগ্যেস করল তুই নাকি শহীদ হতে চাচ্ছিস? চতুর্দিকে গুজব!
জুয়েল বলল, শহীদ আবার কী? জীবন্ত মানুষ শহীদ হয় নাকি? হারুন তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে, চিবিয়ে-চিবিয়ে উচ্চারণ করে বলল, এখনও জীবন্ত আছিস ঠিকই। হায়দার স্যারের জন্য নিজের একটা কিডনি দিবি। মহান আত্মত্যাগ! সে জন্য অপারেশন টেবিলে শুতে হবে। আগে অজ্ঞান করে এই ধার থেকে ওই ধার পর্যন্ত ফালা করে দেবে। তারপর করাত দিয়ে। ঘ্যাসঘ্যাস করে কাটবে তোর একখান কিডনি। সেটা নিয়ে একজন নাচতে-নাচতে চলে যাবে। তার পরেও যদি তোর জ্ঞান ফেরে, সেটা তোর সাতপুরুষের ভাগ্য। অবশ্য তুই মরলেও কেউ দুঃখ করবে না। বরং সকলে জয়ধ্বনি দেবে। কত বড় মহৎ ছিল জুয়েল মিঞা। তোকে নিয়ে সভা হবে মিলনী ক্লাবে।
জুয়েল বলল, এসব কী বলছ? মরব কেন? কত লোক কিডনি ডোনেট করে। তারা মরে নাকি?
হারুন বলল, কারা ডোনেট করে জানিস? বেশির ভাগই অ্যাকসিডেন্টের ভিকটিম, যাদের বাঁচার আশা নেই…আর আমাদের মতন গরিব দেশের অনেকে সংসার চালানোর জন্য কিডনি বিক্রি করে, তাদের মধ্যে কজন বাঁচে না মরে, কে তার হিসাব রাখে?
জুয়েল বলল, এ দেশে অত সহজে অপারেশনে কেউ মরে না। একটা কিডনিতেও মানুষ দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। মাস্টারমশাইকে বাঁচিয়ে রাখা…এত বড় একজন মানী লোক। আমরা তাঁর কাছে কত ঋণী, তার জন্য একটা কিডনি দেব, এ আর এমন বড় কথা কী?
হারুন ভাতটা নামিয়ে বলল, খা, খেতে শুরু কর। সোমবার অপারেশন হবে। এই কটাদিন। ভালো করে খেয়ে নে। মাস্টারমশাইয়ের বয়স সত্তর বছর। তোর কিডনির জোরে তিনি সেরে উঠলে আর কতদিন বাঁচবেন? বড় জোর পাঁচ-সাত বছর। তোর বয়স তো উনতিরিশ, তোর। সামনে লম্বা জীবন পড়ে আছে। মনে কর, এরপর একটা কিডনিতে যদি চোট লাগে, তখন কী করবি? ওই জন্যই কথায় বলে চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। আর-একটা কথা আছে, আপনে বাঁচলে বাপের নাম। তোর বন্ধুরা, কামাল, বাবলু, রফিকুল, মন্টিরা কেউ নিজের কিডনি দিল না কেন?
জুয়েল কিছু বলার আগেই তাকে বাধা দিয়ে হারুন বলল, তুই আগ বাড়িয়ে কেন বলতে গেছিলি, তা আমি জানি। তোর নেচারটাই ইমপালসিভ। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করা তোর ধাতে নেই। তুই। যেমন চলন্ত বাস থেকে নামিস, রাস্তার ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাস, সেইরকমই হুট করে বলে ফেলেছিস। তোর একটু হিরো সাজার ঝোঁকও আছে। হিরো তো হয়েই গেছিস, এরপর লোকে তোর ফটো ঝুলিয়ে রাখবে। তোর মাকে কিছু জানিয়েছিস?
জুয়েল বলল, তুমি আমাকে বেশি-বেশি ভয় দেখাচ্ছ।
হারুন বলল, আমার কথায় এখন আর কী আসে যায়। তোর তো আর ফেরার পথ নেই। তুই কথা দিয়ে ফেলেছিস, মরদ কা বাৎ, হাতি কা দাঁত!
ঝোল দিয়ে ভাত খাবার পর ইলিশ মাছ জুয়েলের মুখে তেতো লাগল! মাছটা পচা নাকি? হারুন তো দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে।
সারারাত বিছানায় ছটফট করলে জুয়েল।
হারুন তাকে শুধু ভয় দেখায়নি, তার ভেতরের ভয়টাকে উস্কে দিয়েছে।
সেদিন ঝোঁকের মাথায় ওই কথাটা বলে ফেলার পর থেকেই সে মাঝে-মাঝে বুকের মধ্যে একটা ঠান্ডা বরফের স্রোত অনুভব করে। স্যারকে দেখে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল, মনে। হয়েছিল, যেভাবেই হোক স্যারকে বাঁচিয়ে তোলা উচিত। কিন্তু তার নিজের একটা অঙ্গ বাদ যাবে, পেটের মধ্যে একটা জিনিস ছিল, সেটা চলে গেলে ফাঁকা-ফাঁকা লাগবে না?
জুয়েলের স্বাস্থ্য বরাবরই ভালো, কখনও কোনওরকম অপারেশন দূরে থাক, সে জীবনে। একদিনও হাসপাতালে থাকেনি। ইঞ্জেকশান নিতেই তার ভয় লাগে। চোখ বুজে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে। তাকে অজ্ঞান করে পেট কাটবে? পুরো পেটটা? হারুন যেভাবে বলল, সেইরকম করাত দিয়ে কিডনি কাটে?
যদি আর জ্ঞান ফিরে না আসে?
জুয়েলের শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। শীতে নয়, ভয়ে। তারপরেই জ্বর। একটা দিন আর বাড়ি থেকে বেরুল না জুয়েল। দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। বারবার সেদিকে চোখ চলে যায়। সোমবার ১৮ তারিখ অপারেশান। হায়দার সাহেবের ব্লাডসুগার খুব বেশি। সেটা নীচের দিকে না নামিয়ে আনলে অপারেশান করানো যাবে না। তাই কয়েকটা দিন সময় নেওয়া হচ্ছে।
জুয়েলের বার বার মনে হচ্ছে তার কিডনি পেয়ে হায়দার স্যার বেঁচে যাবেন ঠিকই, কিন্তু সে আর বাঁচবে না! অপারেশান সহ্য হবে না তার।
এটা যে একটা যুক্তিহীন ভয়, তা সে নিজেও বোঝে! নিজেকে মনে হয় কাপুরুষ। তবু সে চিৎকার করে বলতে চায়। পারব না, পারব না, আমি কিছুতেই পারব না।
বন্ধুদের ওপর খুব রাগ এসে যায়। কামাল, বাবলু, মন্টু এরা সব প্রাণের বন্ধু। ওরা কেন বারণ করল না জুয়েলকে? হারামজাদারা নিজে কেউ দিতে চায়নি!
শিরিন ঠিক জেনে গেছে। টেলিফোনে প্রথমেই সে জিগ্যেস করল, তুমি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলে, আমাকে আগে জানালে না? তার মানে আমার মতামতের কোনও মূল্য নেই তোমার কাছে?
জুয়েল বলল, না, না, তা নয়। তোমাকে জানাতে লজ্জা করছিল। এমন তো কিছু ব্যাপার নয়। শিরিনি বলল, এমন কিছু ব্যাপার নয়, তা আমি জানি। কিন্তু সেদিন যে আমি রুম হিটার কিনলাম। সেটাও তোমাকে আগে জানাইনি? আমার সবকথা প্রথমেই তোমাকে—
—শিরিন তোমার যদি আপত্তি থাকে।
—আমি আপত্তি করব কেন? তোমার স্যারের জন্য তুমি…কিন্তু কথাটা আমাকে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হল?
শিরিনের অভিমান শুধু ওই একটি কারণে। শিরিন যদি জোর দিয়ে বলত, না তুমি কিডনি দেবে না! তাহলে?
জুয়েল বলল, শিরিন, আমি আজ কাজে যাব না। হারুন এখন নেই, তুমি চলে এসো না আমার আপার্টমেন্টে।
শিরিন বলল, অন্য কোনদিন যেতে বলল, আর আজই…। আজ আমার ডাবল ডিউটি, ডরোথি আসেনি। আমার বেরোবার কোনও উপায় নেই।
চলে এসো, প্লিজ।
—কী করে যাব? আজ ইমপসিবল! আটটার আগে ছুটি নেই। কালও একই অবস্থা হবে মনে হয়। ডরোথি অন্য সময় আমাকে দেখে–
জুয়েলের মনে হল, শিরিনের সঙ্গে তার কোনদিন দেখা হবে না। জুয়েলের যদি এই সময় হঠাৎ কোনও কঠিন রোগ হত, তাহলেও কি তার পেট থেকে কিডনি বাদ দেওয়া হত? কিন্তু ইচ্ছে করে তো সেরকম অসুখ ডেকে আনা যায় না। তার জ্বর সেরে গেল পরের দিনই।
কামাল, বাবলুদের সঙ্গে দেখা হলে রাগে তার গা জ্বলে যায়। ওরা তার প্রশংসা করতে করতে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আর অনেকে দাওয়াত দিতে চাইছে। জুয়েল এড়িয়ে গেল। জ্যাকসন হাইটে একটা বইয়ের দোকানে সে মাঝে-মাঝে আড্ডা দিতে যায়। সেখানেও যেতে আর ইচ্ছে করে না! বাঁচার একমাত্র উপায় পালিয়ে যাওয়া। সব বাঙালিরা তাকে কাপুরুষ, ছোটলোক, কথার খেলাপী এইসব বলবে। বলুক! হারুনই ঠিক বলেছে। চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা! স্যার বুড়ো হয়েছেন। আর কটাদিন বাঁচা-না-বাঁচায় কী আসে যায়! জুয়েল কেন অনর্থক ঝুঁকি নিতে যাবে?
যদি সে রটিয়ে দেয়, তার মা খুব অসুস্থ, একেবারে মুমূর্ষু, তাকে এক্ষুনি দেশে ফিরে যেতে হবে! মাস্টারমশাই বড়, না মা বড়?
আগে একটা টিকিট কাটা দরকার। হাতে অত টাকা নেই। ক্রেডিট কার্ডে ওভারড্র করা যায় যতটা, আর কিছু ধার…। বাঙালি ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। গোপন রাখতে হবে, আগে দেখতে হবে, সোমবারের আগের কোনও টিকিট পাওয়া সম্ভব কি না।
এক সর্দারজির সঙ্গে জুয়েলের আলাপ হয়েছে, তার কাজের জায়গায় প্রায়ই আসে। টুয়েন্টি সেকেন্ড স্ট্রিট ঠিকানা খুঁজে হাজির হল জুয়েল। রবিবার একটা টিকিট আছে। জুয়েল পুরো দাম এখন দিতে পারবে না শুনেও সর্দারজি রাজি হয়ে গেল, টিকিট দিতে। তাকেও অবশ্য মায়ের অসুখের কল্পিত করুণ কাহিনিটি শোনাতে হল।
জুয়েলের মা থাকেন নেত্রকোণার এক গ্রামে। তিনি সত্যিই গুরুতর অসুস্থ কি না অন্যেরা জানবে কী করে? জুয়েল তবু ঠিক করল শনিবার বিকেলে সে কাউকে কিছু জানাবে না। শিরিনকেও না।
সে জিনিসপত্র গুছোতে লাগল গোপনে। হঠাৎ দেশে গেলে অনেকের জন্য টুকিটাকি উপহারও নিতে হয়। এখন সেসব কিনতে গেলে যদি বন্ধুরা কেউ দেখে ফেলে?
শনিবার দুপুরে কামাল তার সুপার মার্কেটে উপস্থিত হল। মুখখানা যেন কালি মাখা। থমথমে গলায় বলল, চল, এক্ষুনি একবার হসপিটালে যেতে হবে। স্যার তোকে দেখতে চেয়েছেন। জুয়েল প্রায় কুঁকড়ে গিয়ে বলল, আজই অপারেশান হবে? কথা ছিল যে সোমবার! কামাল বলল, না রে, স্যার সিংক করেছেন। আজ সকাল পর্যন্ত বেশ ভালো ছিলেন, উঠে বসেছিলেন। হঠাৎ কন্ডিশান এত খারাপ হল। তুই তো দিতে চেয়েছিলি। কিন্তু আর লাগবে না, ডাক্তারেরা বলেছেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আয়ু। তোর নাম বলছেন বারবার।
আজ ক্যাবিনে অন্য পেশেন্ট নেই। অধ্যাপক হায়দারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের অনেক মানুষ। অধ্যাপকের শরীরের সঙ্গে যুক্ত অনেক নল, একজন নার্স বসে আছে পাশে। অধ্যাপকের বাকরোধ হয়ে গেছে, শুয়ে আছেন নিঃস্পন্দভাবে, কিন্তু চক্ষু দুটি খোলা।
জুয়েলকে দেখে সবাই সসম্ভ্রমে জায়গা দিল। প্রত্যেকের চোখের ভাষায় যেন ফুটে উঠল, এই যে এসেছে সেই মহৎপ্রাণ যুবকটি। বাবলু জুয়েলের কাঁধ ধরে নিয়ে এল একেবারে রোগীর শিয়রের কাছে।
তাঁর মুখে মৃত্যুর চিহ্ন স্পষ্ট। তবু যেন তিনি চিনতে পারলেন জুয়েলকে। একটা হাত তুলতে গেলেন, পারলেন না। জুয়েলই তার হাত চেপে ধরল।
সেই হাত যেন কিছু বলতে চাইছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দেখতে এসেছেন, তাই একটু পরেই জুয়েল সরে গেল একপাশে। বাবলু তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল, এইটা স্যারের বালিশের পাশে ছিল, তোকে চিঠি লিখেছিলেন।
জুয়েল দ্রুত চোখ বোলাল :
পরম স্নেহাস্পদ জুয়েল,
আজ অনেকটাই ভালো আছি। আশা করছি, এ যাত্রা বেঁচে যাব। একটি কিডনি বদল করতে পারলেই সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তুমি যে আমাকে স্বেচ্ছায় কিডনি দিতে চাইলে, এর থেকে বড় কিছু পাওয়া কজন মানুষের ভাগ্যে ঘটে? আমার তিনটি কন্যা, পুত্র সন্তান নেই। ছাত্ররাই আমার পুত্রের সমান। আর সকল ছাত্রের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ। তুমি নামেও জুয়েল। তোমার হৃদয়টিও জুয়েল। দু-একটি কাজ বাকি আছে, যদি অন্তত বছরতিনেক আয়ু পাই।
জুয়েল আর একবার স্যারের মুখের দিকে তাকাল।
যাক, স্যার যে শেষপর্যন্ত জেনে গেলেন না যে জুয়েল আসলে ঝুটো পাথর, সেইটুকুই তার তৃপ্তি। সেই শুধু নিজেকে চিনেছে।