অন্য আয়না
ব্যারাকপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন ছিল, সেখান থেকে রাত্তিরে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। পরদিন সকালে ফিরতে-ফিরতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। দরজা খুলেই বউদি বললেন, একজন ভদ্রমহিলা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, প্রায় আধঘণ্টা ধরে বসে আছেন।
অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়েছে, ভালো করে ঘুম হয়নি। তা ছাড়া অফিসে দরকারি কাজ আছে, ছুটি নেওয়ারও উপায় নেই, এক্ষুনি চান খাওয়া সেরে ছুটতে হবে। এই সময় ভিজিটর এলে। কারুর ভালো লাগে? তবু, মহিলা বলে কথা, কিছুটা সময় দিতেই হবে।
বসবার ঘরে ঢুকে দেখি ঠিক মাঝখানের চেয়ারটিতে একজন মহিলা বেশ রাজেন্দ্রাণীর ভঙ্গিতে বসে আছেন। পরনে দামি শাড়ি, গায়ের শালটিও বেশ কারুকার্য করা। মেয়েদের বয়েস আমি ঠিক ধরতে পারি না, তবে এই মহিলার বয়েস যে অন্তত পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, ফর্সা টুকটুকে রং বলে তা স্পষ্ট বোঝা যায়, মাথার ঈষৎ কোঁকড়া চুল কিন্তু সম্পূর্ণ কালো, মনে হয় রং করা। ভদ্রমহিলা তার যৌবনকালে যে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমি খানিকটা অভদ্রের মতন বেশি ব্যস্ততা দেখিয়ে বললুম, নমস্কার, কী ব্যাপার বলুন তো?
ভদ্রমহিলা একটি পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিলেন, মুখ তুলে হাসিমুখে আমার দিকে মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ভাঙা গলায় বললেন, তুমিই সুনীল? আমি তোমার জন্য কতদুর থেকে এসেছি বলো তো? তুমি তো রাত্তিরে বাড়িতে ফেরোনি। যাও, মুখ-টুক ধুয়ে এসো, তারপর কথা হবে। আমি বসছি, আমার তাড়া নেই।
কিন্তু আমার যে তাড়া আছে! সেটা তক্ষুনি মুখের ওপর বলা যায় না। ভদ্রমহিলার চেহারা ও ব্যক্তিত্বে একটা সম্ভান্ত ভাব আছে। ভদ্রমহিলার বয়েস আমার থেকে যথেষ্ট বেশি হলেও আমিও তো আর ছেলেমানুষ নই, প্রথম আলাপে আমাকে কেউ চট করে তুমি বলে না!
বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বউদিকে জিগ্যেস করলুম, কে ইনি?
বউদি মুচকি হেসে বললেন, উনি দিল্লিতে থাকেন, শুধু তোমার সঙ্গেই দেখা করার জন্য কলকাতায় এসেছেন। আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। দিল্লিতে ওঁর স্বামীর কীসের যেন বড় ব্যবসা। তিনটি ছেলেমেয়ে আছে। কাল রাত্তিরে কলকাতায় পৌঁছেছেন। আজ সক্কালেই ঠিকানা খুঁজে-খুঁজে এসেছেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে।
বাথরুমে গিয়ে টুথব্রাশটা খুঁজতে-খুঁজতে বললুম, বউদি, দু-কাপ চা করে দাও। গেল আজ অফিসের দেরি হয়ে! কেন যে উইকডেতে সকালবেলা এরা আসে! কোনও সেন্স নেই!
বউদি বললেন, লোকে ভাবে কবি-টবিদের কোনও অফিস থাকে না, তারা চাকরি-বাকরি করে! তারা বসন্তের বাতাস খেয়ে থাকে। তা বলে ভদ্রমহিলার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কোরো না। অতদূর থেকে এসেছেন।
খানিকবাদে আবার বসবার ঘরে এসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললুম, হ্যাঁ বলুন। আপনি দিল্লিতে থাকেন?
ভদ্রমহিলা সে কথার উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, দাঁড়াও, আগে তোমাকে দেখি ভালো করে। কত তোমার কথা শুনেছি, তোমার কত লেখা পড়েছি। এর আগে তোমাকে চোখে না দেখলেও তুমি যে আমার অনেক দিনের চেনা গো!
মনে-মনে ভাবলুম, এই রে! এইরকম ধানাই-পানাই শুরু করলে কত সময় লাগিয়ে দেবে, তার কোনও ঠিক আছে! এরা ভাবে, নিজেদের কোনও কাজ না থাকলে অন্যদেরও কোনও কাজ থাকতে পারে না।
আমি চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাবার পর তিনি বললেন, তুমি কেমন আছ, সুনীল? তোমার শরীর ভালো আছে তো?
আমি অধৈর্যের সঙ্গে বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার শরীর খুব ভালো আছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, ওমা, তুমি আমার সঙ্গে আপনি, আজ্ঞে করে কথা বলছ কেন? আমি যে তোমার অনেক দিনের বন্ধু। আমাকে তুমি-তুমি বলবে!
এসব সিনেমা-সিনেমা সংলাপ, আমার পছন্দ হয় না। অবশ্য ভদ্রমহিলার বয়েস যদি অর্ধেক হত, তাহলে আমার মরেন ভাব কী হত তা বলা যায় না। উনিই বা এই বয়েসে এভাবে কথা বলছেন। কেন? যে বয়েসে যা মানায়!
—আপনি কি কলকাতায় কিছুদিন থাকবেন? পরে যদি আর-একদিন আসেন, কোনও রবিবার টবিবার, আজ আমাকে অফিসে যেতে হবে।
—তোমাকে আজ অফিসে যেতে হবে না! আমি কতদূর থেকে এসেছি তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য!
তিনি হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা নতুন কলম বার করে বললেন, এই নাও, এটা তোমার জন্য এনেছি।
লেখকদের নাকি কলম সম্পর্কে দুর্বলতা থাকে। কোনও-কোনও লেখকের একশো-দুশো কলম আছে শুনেছি। আমার ওসব বাতিক নেই। আমি সাধারণ ডট পেনে লিখি। হাতের কাছে যখন। যেটা পাই। ভদ্রমহিলার কলমটা বেশ দামিই মনে হচ্ছে। দামি কলম নিয়ে আমি কী করব? দামি কলমের জন্য দামি কাগজ দরকার, সেরকম আজকাল পাওয়াই যায় না। কিন্তু কেউ কিছু উপহার দিলে সেটা ফিরিয়ে দেওয়া অভদ্রতা। আমি শুকনোভাবে বললুম, ধন্যবাদ!
—তুমি এই কলমটা দিয়ে আমার নামে একটা সুন্দর কবিতা লিখবে, কেমন?
আমি মুখ নীচু করে হাসি গোপন করলুম। ভদ্রমহিলা আবার বললেন, তুমি কাল রাত্তিরে বাড়ি ফেরোনি। কবিরা খুব বোহেমিয়ান হয়! আমারও খুব রাত জাগতে ভালো লাগে। এক-একদিন ইচ্ছে করে সারারাত রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াই!
এবারে আমার অন্যরকম একটা সন্দেহ হল। ভদ্রমহিলার কি নিজের বয়েসটা একদম খেয়াল নেই? উনি অনায়াসেই আমার কাকিমা বা পিসিমা হতে পারতেন। উনি এসব কী বলছেন?
—আপনার নাম কী?
—ও, এই দ্যাখো, আমার নামটাই বলা হয়নি এখনও। আমার নাম রত্না রায়চৌধুরী। আমাদের বাড়ি ছিল বহরমপুরে। বিয়ের পর থেকে দিল্লিতেই আছি। সে অনেকদিন হয়ে গেল। প্রায় চল্লিশ বছর। কলকাতাতে খুব কম আসা হয়। কাল রাত্রে পৌঁছেই ফোন করলুম রবিশঙ্করকে। ওকে খবর না দিলে রাগ করবে তো। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা হল না।
–কাকে ফোন করেছিলেন?
—রবিশঙ্করকে। তুমি চেনোনা?
শুধু রবিশঙ্কর নামটা শুনলে একজনের কথাই মনে পড়ে। তাকে প্রায় সারা পৃথিবীর লোকই এখন চেনে। কিন্তু মহিলাটি এমনভাবে কথাটা বললেন যেন রবিশঙ্কর আমার কোনও বন্ধুর নাম।
সন্দেহ কাটাবার জন্য আমি বললুম, রবিশঙ্কর মানে…যিনি সেতারে…
—হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কজন রবিশঙ্কর আছে? তুমি জানো, অত বিখ্যাত হলে কি হয়, মানুষটা বড় দুঃখী! বড় একা!
রবিশঙ্করের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। অফিসের দেরি করে সে কথা আলোচনা করাও কি আমার পক্ষে সঙ্গত?
আমি ভুরু কুঁচকে তাকাতেই তিনি আমার দিকে বালিকার মতন ভঙ্গি করে রহস্যময় হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, আমাকে কথা বলতে দিল না। ওর বউ ফোনটা ধরেছিল, আমার গলা শুনেই চিনতে পেরেছে। হিংসে করে তো খুব আমাকে!
রবিশঙ্করের বউ! তাও আবার কলকাতায়? এসব কি উলটোপালটা বলছেন মহিলা। আমার কেমন যেন খটকা লাগল। আর রবিশঙ্কর যতই বিখ্যাত হোন, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে কেউ রবিশঙ্কর সম্পর্কে গল্প করে যাবেন, এটাও ঠিক মানা যায় না বোধহয়।
আমি খানিকটা কঠোরভাবেই এবার জিগ্যেস করলুম, আপনি কি আমার কাছে কোনও দরকারে এসেছেন?
আমার কণ্ঠস্বরের উত্মা গায়ে না মেখে রত্না রায়চৌধুরী আবার হাসলেন। আবার তার দামি চামড়ার হাতব্যাগটা খুলে একটি ছোট্ট লাল রঙের নোট বই বার করে বললেন, তোমার কাছে
তো বিশেষ দরকারে এসেছি। তোমার সাহায্য ছাড়া চলবে না। আমি কবিতা লিখেছি, তুমি দেখে দেবে।
আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলুম। এরকম উপদ্রব আমাকে প্রায়ই সহ্য করতে হয়। তবে এরকম বেশি বয়েসি কোনও মহিলা আগে আসেননি। ভদ্রমহিলার বিয়ে হয়েছে চল্লিশ বছর আগে, তাহলে এর বয়েস ষাটের আশেপাশে হবেই। তবে ওর মুখের হাসিটি অল্প বয়েসি মেয়েদের মতন।
ছোট খাতাটি হাতে নিয়ে দেখলুম, সেটা প্রায় ভরতি কবিতায়। প্রথম কবিতাটির নাম তুমি। খুবই আবেগময় প্রেমের উচ্ছ্বাস, ভাষা খুবই কাঁচা, কোনও মতেই কবিতা পদবাচ্য নয়। পরের পাতাগুলোতেও এ একই ব্যাপার, বিশেষ কোনও একজনকে উদ্দেশ্য করেই এগুলি লেখা হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
সব কবিতাগুলো পড়বার দরকার নেই। তবু আমি খাতাটা হাতে নিয়ে খানিকটা সময় নিলুম। অন্যদের যা বলি তা কি একেও বলা যাবে? অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের বলি ছন্দের চর্চা করতে, অনেক লিখে আগে হাত পাকাতে। ষাট বছরের এক মহিলা কবে আর হাত পাকাবেন?
রত্না রায়চৌধুরী বললেন, এই আমার জীবনের প্রথম কবিতা, বুঝলে সুনীল। আমাদের বয়সে কেউ কোনওদিন কবিতা লেখেননি, আমি নিজেও তো জীবনে কখনও কবিতা লেখার কথা ভাবিনি। দেখতেই তো পাচ্ছ, বাংলা বানান ভালো জানি না। এখন বাংলার থেকে হিন্দি ভালো বলতে পারি।
—তাহলে হঠাৎ বাংলায় কবিতা লেখার কথা মনে হল কেন আপনার?
—ঠিক বলেছ, হঠাৎ! একদম হঠাৎ! কেন যে লিখলুম তা আমি নিজেই জানি না। হঠাৎ একদিন মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম, তারপর আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে
এল, ভুল করেছি, তোমার কথা শুনিনি, তুমি ভুল বুঝো না আমায়, ওগো, কান্না আমার ঝর্ণা হয়ে হারিয়ে গেল কোথায়! আমি নিজেই একেবারে অবাক। এর মানে কী? এরকম কবিতার মতন কথা কী করে বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে? শুধু একটা নয়, আরও বলতে লাগলুম, বুঝলে! আমার স্বামী পাশের খাটে ঘুমিয়ে আছে, আজকাল ও আমার সঙ্গে শোয় না, আমি জোরে এইসব বলে যাচ্ছি, তাও জাগল না। রোজ ড্রিংক করে তো, সহজে ঘুম ভাঙে না!
আমি মুখ নীচু করে হাসতে লাগলুম। এ যে দেখছি বাল্মীকির মতন ব্যাপার। হঠাৎ একদিন মুখ দিয়ে ঝরঝর করে বেরিয়ে এল কবিতা!
মুখ তুলে দেখি রত্না রায়চৌধুরী স্থিরভাবে তাকিয়ে আছেন, তাঁর দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
এই অবস্থায় কঠোর কথা বলা যায় না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, খাতাটা রেখে যান, আমি পরে ভালো করে পড়ে রাখব। আজ আমায় এখন বেরুতেই হবে।
উনি হাত তুলে বললেন, আর একটু বসো, প্লিজ! আমি অনেকদূর থেকে এসেছি! আমার আর একটু কথা আছে।
হতাশভাবে বসে পড়ে বললুম, বলুন!
—যেদিন রাত্তিরে এরকম হল, তার পরদিন সকালে ভাবলুম, ওসব বোধহয় স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু লাইনগুলো সব মনে আছে। এইসব লাইন কে বানাল? লিখে রাখলুম এই খাতাটায়। তারপর দু তিনদিন আর কিছু হল না। খাতা নিয়ে কিন্তু লেখার চেষ্টা করলুম, কিছু মাথাতেই আসে না ছাই! একটা লাইনও বানাতে পারি না। তারপর আবার একদিন মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল, কে যেন জোর করে আমায় টেনে তুলল, আবার আমি গড়গড় করে কবিতা বলতে লাগলুম, খুব ভালো কবিতা, এসব আগে কেউ লেখেনি, কোনও বইতে নেই, আমার নিজেরই বানানো।
—এসব কবিতা অন্য কারুকে দেখিয়েছেন?
—প্রথমে ভেবেছিলুম, শুধু একজনকেই দেখাব। কিন্তু তাকে যে পাওয়া যায় না। কখন কোথায় থাকে তার ঠিক নেই, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। তাই একদিন আমার স্বামীকে দেখলুম। ও কী বলল জানো?
–কী?
–কী বল তো? আন্দাজ করো!
—দেখুন আপনার স্বামীকে তো আমি চিনি না, কী করে আন্দাজ করব তিনি কী বলবেন?
–ও বলল, আবার তুমি পাগলমি শুরু করেছ? এসব কবিতা না তোমার মুণ্ডু। ও খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দাও আস্তাকুড়ে! ভাবতে পারো, কেউ বলতে পারে এরকম কথা?
আমার মনে হল, ভদ্রমহিলার স্বামী খুব একটা ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু আমি কৃত্রিম সমবেদনা দেখিয়ে বললুম, তাই নাকি?
—হ্যাঁ, ও তো এই রকমই কথা বলে। সারা জীবনই তো আমার কোনও ব্যাপারে ওর উৎসাহ নেই। আমি বিয়ের আগে নাচ শিখেছিলুম জানো, ও নাচ বন্ধ করে দিয়েছে। গানের গলা ছিল, বাপের বাড়ি থেকে হারমোনিয়াম নিয়ে গিয়েছিলুম, সেটাকে সারাবার নাম করে একটা দোকানে। দিয়ে এল, আর কোনওদিন নিয়ে এল না! তার মানে বুঝলে? ও চায় না, আমি নাচি, গান করি। কারুর সঙ্গে মিশতেও দিত না। সবসময় আগলে-আগলে রাখত। আমি সুন্দরী ছিলাম তো, তাই ভয় ছিল আমাকে যদি অন্য কেউ নিয়ে যায়!
এবার আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলুম, ভদ্রমহিলা যে কিছুদিন আগেও যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। উনি তখন আমার কাছে আসেননি কেন?
রত্না রায়চৌধুরী আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, গান-বাজনা, নাচ সব ছেড়ে দিলুম কেন জানো? ওর জন্য। ওকে আমি সত্যি ভালোবাসতুম যে। ও তার কোনও মূল্য দেয়নি। বাড়িতে পুতুল বানিয়ে রেখেছিল। এখন তাকিয়েও দেখে না আমার দিকে। একসময় একজন আমার মূল্য বুঝেছিল, আমাকে ভালোবেসেছিল, তখন বুঝিনি, তখন তার ডাকে সাড়া দিইনি।
ভদ্রমহিলাকে এখন কথার নেশায় পেয়ে বসেছে। আমি আর-একটি সিগারেট ধরিয়ে জিগ্যেস করলুম, আপনি আমার ঠিকানা পেলেন কোথায়?
হঠাৎ যেন ঘোর ভেঙে গেল। কথা থামিয়ে ভদ্রমহিলা আমার দিকে আবার তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে। বাইরে কেউ দরজার বেল দিতেই আমাকে উঠে যেতে হল। সেরকম কেউ নয়, একজন ফেরিওয়ালা।
ফিরে এসে দাঁড়িয়েই বললুম, তাহলে এই পর্যন্ত আজ থাক। আপনি এই রবিবার সকালে আসুন না।
মিনতি-মাখা চোখ হলেও খানিকটা আদেশের সুরে তিনি বললেন, আর একটু বসো। আমি একা চলাফেরা করতে পারি না। আমার ভাসুরের বাড়িতে এসে উঠেছি। আজ ওঁদের একটা গাড়ি পেয়েছি। রোজ তো পাব না।
আমি আবার বসলুম।
—তোমার লেখাটেখা আমি আগে বিশেষ পড়িনি। বই পাই না তো ওখানে। আমার এক দেওরের মেয়ে কবিতা-টবিতা লেখে। তাকে আমার এই খাতাটা একদিন পড়ালুম। ও বললে, জ্যাঠাইমা, তুমি এগুলো সুনীলবাবুকে দেখাও, উনি ঠিকঠাক করে ছাপার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি সঙ্গে-সঙ্গে বিমর্ষ মুখ করে বললুম, কিন্তু আমার তো ছাপিয়ে দেওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই। আমি পড়ে মতামত দিতে পারি।
একটু আগে কাঁদছিলেন মহিলা, এখন মুখে ঝিকমিক করছে হাসি। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তুমি ইচ্ছে করলে নিশ্চয়ই পারো। তোমার কত জায়গায় চেনাশুনো। তুমি আমার কবিতাগুলো একটু ছাপিয়ে দাও, সুনীল আমার বিশেষ দরকার আছে। কী দরকার বলো তো?
—আপনিই বলুন!
—ওকে তো আমি নিজে গিয়ে এই কবিতাগুলো দেখাতে পারব না। ওর বউ যে আমাকে হিংসে করে। টেলিফোন করলে টেলিফোন দেয় না, এখন ও কলকাতায় আছে আমি জানি, কাগজে। দেখেছি, তবু ওর বউ বলল, আমরা সঙ্গে এখন দেখা করা সম্ভব নয়। আমার গলা শুনেই চিনে ফেলেছে তো।
–আপনি কার কথা বলছেন?
–রবিশঙ্কর। ও যে আমায় ভালোবাসে। ওর জন্যই তো এই কবিতাগুলো বেরিয়ে এল আমার মন থেকে। কতদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি জানো? কুড়ি বছর!
এবারে আমার আবার খটকা লাগল। রবিশঙ্করের এখন কোনও বউ আছে বলে তো শুনিনি! কুড়ি বছর রবিশঙ্করের সঙ্গে দেখা হয়নি, তবু এঁর গলা শুনেই রবিশঙ্করের তথাকথিত স্ত্রী চিনে ফেলেছেন এঁকে!
–রবিশঙ্করের সঙ্গে আপনার কোথায় আলাপ?
—আমাদের বাড়িতে এসেছিল একদিন। বাজনা বাজিয়েছিল। ছবি আছে, দেখবে?
হাত ব্যাগ থেকে তিনি একখানা ছবি বার করলেন। অনেক পুরোনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি, এখন হলদেটে হয়ে আসছে। কোনও জায়গায় বসে রবিশঙ্কর সেতার বাজাচ্ছেন। তবলচির পাশে একজন সুন্দরী যুবতী। হ্যাঁ, সুন্দরী ঠিকই। তার পাশে আর-একজন পুরুষ।
রত্না রায়চৌধুরী ঝুঁকে পড়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এই দ্যাখো, আমার ছবি। চিনতে পারছ? আর এই আমার স্বামী।
আমি ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলুম।
—সেদিন আমি একটা গান গেয়েছিলুম, রবিশঙ্কর আমাকে দেখেই বলল, তোমাকে দেখলেই মনে হয় তুমি গান জানো। গান করো না একটা। আমি তাকালুম আমার স্বামীর দিকে। রবিশঙ্কর নিজে অনুরোধ করেছে তো, তাই আপত্তি করল না। বলল, গাও। গাইলুম। মাত্র একখানা। চর্চা ছিল না তো। সেই গান শুনে রবিশঙ্কর বলল, বাঃ! সুন্দর! তুমি চর্চা করো, তোমার হবে!
—আর দেখা হয়নি?
—হ্যাঁ। আর একদিন দেখা হয়েছিল। ওই দিল্লিতেই। আমার পরিচয় দিলুম। রবিশঙ্কর খুব দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, তুমি গান গাও না? কি ভীষণ দুঃখ ছিল সেই গলায় আওয়াজে, তা তুমি বুঝবে না। তখনও বুঝিনি যে ও আমায় ভালোবেসে ফেলেছে। আমি ঘরের বউ, ঘরের বউ হয়েই থাকতে চেয়েছিলুম।
-তারপর?
—তারপর অতিকষ্টে দু-বার ওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি। ওর বউ জানতে পারলেই লাইন কেটে দেয়। কিন্তু জানি, ও এখনও আমার জন্য প্রতীক্ষা করে আছে।
আমি একবার ভাবলুম, পাশের ঘর থেকে একটা আয়না এনে ভদ্রমহিলার মুখের সামনে ধরি। ষাট বছর বয়েস, রীতিমতো গিন্নিবান্নি, উনি এসব কী প্রেমের কথা বলছেন! রবিশঙ্করের জীবনী আমি পড়েছি। কোনও একদিন গান-বাজনার আসরে রত্না রায়চৌধুরীর মতন একজন সুন্দরী যুবতীর গান শুনে উনি উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, বাঃ তোমার গানের গলা তো বেশ ভালো, তুমি চর্চা করো! এরকম কথা উনি হয়তো আরও শত-শত মেয়েকে বলেছেন!
রত্না রায়চৌধুরী বললেন, তুমি আর-একটা কথা শুনবে? কয়েক মাস ধরেই আমার মনটা খুব খারাপ। খালি মনে হচ্ছিল বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। কী হবে এই জীবনটা নিয়ে। কতই তো করে দেখলাম অন্যদের জন্য। তারপর একদিন মনে পড়ল রবিশঙ্করের কথা। ও আমায় ভালোবেসেছিল, ও চেয়েছিল আমি বড় হই। সেই দিনই রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল ওই কবিতা! আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলাম।
এতক্ষণ ঠাট্টা ইয়ার্কির ভাব নিয়ে ভদ্রমহিলার কথা শুনছিলাম, এবারে রত্না রায়চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সর্বশরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। যেন আমি একটা অলৌকিক দৃশ্য দেখছি। রত্না রায়চৌধুরীর বয়েস কমে গেছে কুড়ি বছর, মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। জীবনের ব্যর্থতাবোধের মধ্যে একটা ভালোবাসার স্মৃতি যেন তাকে এই মুহূর্তে নতুন রূপ দিয়েছে। সেই ভালোবাসার স্মৃতি থেকে উৎসারিত হয়েছে কবিতা। শুধু ছন্দ, মিল, শব্দ দিয়ে এ-কবিতার বিচার হয় না। এ-রচনা একজন মানুষের জীবনে, কবিতার চেয়ে অনেক বড়।
আমি বললুম, আপনার কবিতা কিন্তু চমৎকার হয়েছে। কারেকশন করার কিছুই নেই। আপনি যদি চান, আমি নিজে গিয়ে এই কবিতা রবিশঙ্করকে দেখাতে পারি। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।
আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরে ব্যাকুলভাবে মহিলা বলতে লাগলেন, সত্যি তুমি দেখাবে? সত্যি? তুমি ওকে বলো, আমি আজও ওকে ভুলিনি। বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখে দিয়েছি!