চেয়ার
আগাগোড়া শ্বেতপাথরে বাঁধানো বিশাল চওড়া সিঁড়ি। দুধের মতন সাদা, কোথাও এক ছিটে ধুলো নেই। এক পাশের রেলিংটা মনে হয় যেন সোনা দিতে তৈরি। এককালে যেসব ছিল রাজা রানিদের বাড়ি, এখন সেগুলিই মিউজিয়াম!
সিঁড়ির মুখে এসে অমিত জিগ্যেস করল, মা, তুমি এতখানি সিঁড়ি উঠতে পারবে?
হৈমন্তী মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, পারব।
অমিত আবার বলল, তোমার পায়ে ব্যথা।
হৈমন্তী বললেন, না, না, ব্যথা নেই, আজ ব্যথা নেই!
রাজা-রানিদের নিশ্চয়ই শরীরে বেশ জোর থাকত। রোজ এতটা সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা, তারপর বারান্দাগুলো কী দারুণ লম্বা, কত যে ঘর তার ইয়ত্তা নেই। রাজা-রানিরা এত হাঁটতে পারতেন? বাড়ির মধ্যে তো আর পালকি চড়া যায় না!
অমিত বলল, মা, আস্তে-আস্তে ওঠো!
হাঁটুতে জোর কমে গেছে, ইদানীং সিঁড়ি ভাঙতে হৈমন্তীর বেশ কষ্ট হয়। সিঁড়ি ভাঙার অভ্যেসটাও চলে গেছে। এদেশে তাঁর ছেলের বাড়িটা দোতলা। হৈমন্তী একতলার একটি ঘরে থাকেন। রেল স্টেশানে কিংবা বিমানবন্দরে এমনকি বড়-বড় দোকানেও এসকেলেটর থাকে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় না।
দু-হাঁটুই বেশ টনটন করছে, তিনতলা পর্যন্ত উঠতে বুকে চাপ লাগছে, তবু হৈমন্তী মুখে কিছুই স্বীকার করবেন না। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রেখেছেন। কষ্ট হচ্ছে বলে কি এত সব ভালো-ভালো জিনিস দেখবেন না? দিনের পর দিন তো বাড়িতেই বসে থাকতে হয়। এসব দেশে এই এক জ্বালা! নিজে নিজে বাড়ি থেকে বেরুনো যায় না। কলকাতায় থাকতে হৈমন্তী একা-একা ট্রামে বাসে চলাফেরা করতেন। এখানে কেউ সঙ্গে নিয়ে না গেলে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। সব কিছুই দূর-দূর। গাড়ি ছাড়া যাওয়া যায় না। হৈমন্তী ফরাসি ভাষাও জানেন না। একা চলাফেরা করতে ভয় হয়। ছেলে আর ছেলের বউ দুজনেই চাকরি করে, সারা সপ্তাহ খুব ব্যস্ত, আর ছুটির দিনে ক্লান্ত হয়ে থাকে।
সবাই জানে, হৈমন্তী এখন ফরাসি দেশে আছেন ছেলের বাড়িতে। কিন্তু আসলে তো থাকেন প্রায় বন্দি অবস্থায় একটা বাড়ির মধ্যে, সে বাড়িও শহর থেকে বেশ দূরে। এইভাবেই কেটে যায় মাসের-পর-মাস।
ভাগ্যিস অমিতের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এসেছে কলকাতা থেকে। তাই অমিত তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। অন্য সময় অমিত যখন বন্ধুদের বাড়িতে পার্টিতে যায়, তখন হৈমন্তীকে দু-একবার। অনুরোধ করলেও তিনি সঙ্গে যেতে চাননি। অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনি কী করবেন? ওদেরই অস্বস্তি হবে।
আজ হৈমন্তী নিজেই ছেলেকে বলেছেন, তোরা মিউজিয়াম দেখতে যাচ্ছিস, আমাকে সঙ্গে নিবি?
অমিতের বন্ধু সত্যেশ ছবি ভালোবাসে, ইতিহাস ভালোবাসে। একতলা, দোতলা ঘুরে-ঘুরে। সবাই চলে গেল তিনতলায়। কতরকম ছবি আর ভাস্কর্য। দোতলাটায় শুধু ইজিপশিয়ান শিল্প। হৈমন্তীর সবই দেখতে ভালো লাগছে। শুধু বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে এইসব মূল্যবান সব শিল্প দেখার আনন্দ কত বেশি। শরীরের কষ্ট হচ্ছে হোক। হৈমন্তীর পুত্রবধূ ফরাসি মেয়ে, সে অবশ্য। আজ আসতে পারেনি, তার অফিস আছে। এলেন মেয়েটি খুবই ভালো, হৈমন্তীর যত্ন করে প্রাণ দিয়ে।
তিনতলায় সব আধুনিক কালের ছবি। এসব ছবি হৈমন্তী ঠিক বুঝতে পারেন না, তবু অমিত আর সত্যেশ কতরকম আলোচনা করছে, তিনি শুনছেন।
একসময় ওরা দুজন খানিকটা দূরে সরে গেল। বোধহয় সিগারেট খাবে। ছেলেকে হৈমন্তী বলেই দিয়েছেন তাঁর সামনে সিগারেট খেতে, কিন্তু সত্যেশ লজ্জা পায়।
ওরা দুজন আড়ালে যেতেই হৈমন্তীর শরীরটা একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। শুধু দুই হাঁটু নয়, কোমরের নীচের সব অংশটা যেন অবশ হয়ে আসছে। একবার একটু না বসলেই নয়।
কিন্তু বসবেন কোথায়? একটার পর একটা ঘরে দেওয়াল ভরতি ছবি। কোনও কোনও ঘরে পুরোনো আমলের সোনা-রুপোর জিনিসপত্র। অনেক জিনিসে যাতে হাত না দেওয়া হয়, সেইজন্য দড়ি দিয়ে ঘেরা।
ঘুরতে-ঘুরতে হৈমন্তী হঠাৎ দেখতে পেলেন, এক জায়গায় একটা চেয়ার। ভেলভেট দিয়ে মোড়া চেয়ারটার হাতল দুটো সোনালি রঙের। অনেকটা যাত্রা দলের রাজা-রানিদের চেয়ারের মতন। এসব জায়গায় প্রত্যেক ঘরে একজন করে গার্ড থাকে। হৈমন্তী ভাবলেন, এটা কোনও গার্ডের চেয়ার। সে কোথাও উঠে গেছে। এখানে একবার বসা যায় না?
শরীর আর বইছে না। পা দুটো বিদ্রোহ করছে। একটু বসলে ক্ষতি কী?
হৈমন্তী আর দ্বিধা না করে বসে পড়লেন। চওড়া কালো পাড়ের শাড়ি পরা, সাদা ব্লাউজ, মাথার সিথি সাদা, চোখে নস্যি রঙের চশমা, হৈমন্তী সেই চেয়ারে বসে একটা আরামের নিশ্বাস ফেললেন।
পা দুটি শান্তি পেয়েছে। হৈমন্তী হাত দুটি চেয়ারের হাতলের ওপর রাখতেই একটা হাতল টুপ করে খসে পড়ে গেল।
এইসব দেশে কেউ জোরে কথা বলে না। মিউজিয়ামে ফিসফিস করে কথা বলাই নিয়ম। ঘরের মধ্যে অন্য অনেক লোক ছিল, কোনও শব্দ ছিল না, চেয়ারের হাতলটা ভেঙে পড়ার একটা শব্দ হল।
হৈমন্তী লজ্জা পেয়ে হাতলটা কুড়োতে যেতেই একজন গার্ড ছুটে এল তাঁর সামনে। মধ্যবয়েসি লম্বা লোকটি কী যে বলতে লাগল, হৈমন্তী কিছুই বুঝতে পারলেন না। লোকটি বেশ উত্তেজিত হয়েছে মনে হচ্ছে। হৈমন্তী ভাবলেন, চেয়ারটা যদি ভেঙেই গিয়ে থাকে, তাঁর ছেলে এসে সারাবার খরচ দিয়ে দেবে। তাঁর ছেলে ভালো চাকরি করে।
গার্ডের চেঁচামেচিতে হৈমন্তী কোনও সাড়া শব্দ করছেন না দেখে আরও দু-তিনজন এল সেখানে। তার মধ্যে একজনের চেহারা মেয়ে পুলিশের মতন। সেই মহিলাটি হৈমন্তীর হাত ধরে টেনে তুলল।
হৈমন্তী ফরাসি ভাষা জানেন না বটে, কিন্তু মোটামুটি কাজ চালানো ইংরিজি জানেন। তিনি বললেন, কী হয়েছে? আমার ছেলে এখানে আছে, তাকে ডাকো।
পুলিশের মতন মহিলাটি সে কথায় কর্ণপাত করল না। হৈমন্তীর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল একটা ছোট ঘরে। তারপর তিন-চারজন নারী পুরুষ এসে তর্জন-গর্জন করতে লাগল তাঁর ওপর।
কিছুই না বুঝতে পেরে হৈমন্তী ভয়ার্ত স্বরে বলতে লাগলেন, আমার ছেলে? আমার ছেলে?
একটুক্ষণের মধ্যেই অমিত আর সত্যেশ সেখানে এসে পৌঁছল অবশ্য। অমিত চোস্ত ফরাসি ভাষায় তর্ক শুরু করে দিল। ক্রমশ একটা ঝগড়া লাগার উপক্রম।
মিনিট পনেরো এইরকম বাদানুবাদ চলার পর অমিত একসময় বলল, মা, ওঠো! চলো এবার।
বেশ রাগত স্বর। ওই লোকগুলোর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে অমিতের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
মিউজিয়ামের বাইরে এসে হৈমন্তী জিগ্যেস করলেন, ওই লোকগুলো কী বলেছিল রে?
অমিতের বদলে তার বন্ধু সত্যেশ হাসতে-হাসতে বলল, মাসিমা, আপনি বেশ ওই চেয়ারটাতে বসে পড়লেন?
হৈমন্তী বললেন, পায়ে ব্যথা করছিল। খালিই তো ছিল চেয়ারটা। তবে বিশ্বাস করো, হাতলটা আমি ভাঙিনি। লাগানো ছিল আলগা করে। আমি হাত রাখতেই মটাং করে ভেঙে গেল!
সত্যেশ হাসতে লাগল।
হৈমন্তী আবার বললেন, একটা হাতল ভেঙে গেছে, তাতে অত রাগারাগি করার কী আছে? হাতলটা আগেই ভাঙা ছিল। সে যাই হোক, হাতলটা কি আমরা সারিয়ে দিতে পারতাম না?
এবার অমিত মায়ের দিকে ফিরে দারুণ ঝাঁঝাল গলায় বলল, ওই চেয়ারটার দাম কত জানো? শুধু আমাকে না, আমার তিন পুরুষকে বিক্রি করলেও ওর দাম উঠবে না!
সব মাকেই মাঝে-মাঝে ছেলের কাছে ধমক খেতে হয়। হৈমন্তী অবিশ্বাসের সুরে, হাসিমুখে বললেন, যাঃ কী বলছিস! ওইরকম একটা ভাঙা চেয়ার, তার দাম…
অমিত একইরকম বদমেজাজে বলল, ওটা কার চেয়ার জানো? মেরি আঁতোয়ানেৎ-এর! সত্যেশ বলল, মাসিমা, মেরি আঁতোয়ানেৎ ছিলেন—
তাকে বাধা দিয়ে হৈমন্তী বললেন, জানি। ফরাসি দেশের রানি। ফরাসি বিপ্লবের সময় তাঁকে মেরে ফেলা হয়!
ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে ভাবে, মায়েরা বুঝি কিছুই জানে না। হৈমন্তী কলেজ জীবনে ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের কথা পড়েছিলেন, এখনও মনে আছে সেসব কথা।
রাস্তা পার হয়ে পার্কিং লটের দিকে যেতে-যেতে অমিত আবার বলল, ওই চেয়ার ছোঁয়াই নিষেধ। ওখানে বসলে ফাইন হয়। আর হাতলটা ভেঙে ফেলার জন্য ওরা তোমাকে জেলে দেবে বলেছিল!
সত্যেশ বলল, ওদেরও দোষ আছে। দড়ি দিয়ে ঘেরা থাকে, দড়িটা যে খুলে গেছে, তা ওরা খেয়াল করেনি কেন?
অমিত বলল, পাশেই তো বোর্ড লাগানো আছে!
গাড়িটা খুঁজে পেয়ে দরজা খুলতে-খুলতে অমিত আবার বলল, আমরা একটুখানির জন্য বাইরে গেছি, তার মধ্যেই এমন একটা কাণ্ড করে ফেললে? মা, তোমাকে কতবার বলেছি, এসব দেশে যেখানে-সেখানে হাত দিতে নেই!
এতক্ষণ বাদে অভিমান হল হৈমন্তীর।
তিনি বললেন, ওরা আমাকে জেলে দিতে চেয়েছিল, ছাড়িয়ে আনলি কেন? ভালোই তো হত! আমার কাছে সবাই সমান!
বাড়িতে আসার পর পুত্রবধূ এলেন, সব শুনে চোখ কপালে তুলল।
সে বলল, আপনি কী করেছিলেন মা? এর আগে একজন লোকের দশ হাজার ফ্রাংক ফাইন হয়েছিল এজন্য।
হৈমন্তী আর কী বলবেন, মুখ নীচু করে রইলেন। এতক্ষণে তিনি গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছেন। একসময় চলে গেলেন নিজের ঘরে।
এসব দেশে ঘটনাবৈচিত্র্য খুব কম। সপ্তাহের-পর-সপ্তাহ, মাসের-পর-মাস, একইরকম জীবন। কিন্তু এটা একটা বলার মতন রোমহর্ষক ঘটনা। এক বিধবা বাঙালি মহিলা আর একটু হলে ফরাসি দেশের জেলে চলে যাচ্ছিলেন! টেলিফোনে-টেলিফোনে চেনাশুনো। সকলের কাছে ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেল।
সন্ধেবেলা দুটি দম্পতির নেমন্তন্ন এ-বাড়িতে, সত্যেশেরও তারা চেনা। অন্য দিন হৈমন্তী সকলের সঙ্গে এসে বসেন, ওরা তাঁর সামনেই মদ খায়, তিনি কিছুই মনে করেন না। এদেশে তো মদ খেয়ে কেউ মাতলামি করে না, অনেকটা চা-কফির মতনই ব্যাপার। আজ কিন্তু হৈমন্তী রয়ে গেলেন রান্নাঘরে। ওখানেও আজকের ঘটনাটাই আলোচনা হচ্ছে। মেরি আঁতোয়ানেৎ-এর চেয়ার ভেঙে ফেলার জন্য অমিতের মায়ের নির্ঘাত জেল হতে পারত, হয়নি যে সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। অমিত চোস্ত ফরাসি ভাষায় মিউজিয়ামের প্রহরীদের নিরস্ত করেছে। প্রহরীদের কী-কী যুক্তিবাদে অমিত বিদ্ধ করেছে, তা সে বন্ধুদের শোনাতে লাগল বারবার।
শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি হতে লাগল।
দু-গেলাস মদ খাবার পর অমিতের মেজাজটা ভালো হয়ে গেছে। রান্নাঘরে বরফ নিতে এসে সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ওঃ আজ কী ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! ওদের ওপর চোটপাট করছিলাম বটে, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ভয়ে কাঁপছিলাম! সত্যি যদি তোমাকে জেলে দিত। মেরি আঁতোয়ানেৎ-এর চেয়ার ভেঙে ফেলা, এটা একটা খবরের কাগজে বেরুবার মতন খবর।
হৈমন্তী মিনমিন করে বললেন, চেয়ারটা ভাঙা ছিল। আমি শুধু একটু হাত রেখেছি।
অমিত বলল, বোধহয় আঠা দিয়ে জুড়ে রেখেছিল। কিন্তু সে কে প্রমাণ করতে যাবে? ওরা বলল, ভেঙে গেছে। যাক গে, তুমি আর মন খারাপ করে থেকো না।
রাত্তিরবেলা হৈমন্তী এক সুন্দরী রমণীকে স্বপ্ন দেখলেন। মাথা ভরতি সোনালি চুল, কিন্তু মুখখানা খুব বিষণ্ণ। মেয়েটি নিজের গলায় হাত বুলোচ্ছে আর হৈমন্তীকে কিছু যেন বলতে চাইছে। মুখখানা চেনা-চেনা লাগছে।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মহিলাটি, সাদা রঙের পোশাক পরা। মাঝে-মাঝে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে।
হৈমন্তী এবার দেখতে পেলেন তার গলায় একটা গোল দাগ, সঙ্গে-সঙ্গে তিনি শিউরে উঠলেন।
এ তো রানি মেরি আঁতোয়ানেৎ!
ফরাসি বিপ্লবের সময় এঁর গিলোটিনে প্রাণ গিয়েছিল। অর্থাৎ গলাটা কেটে ফেলা হয়েছিল! সেই মেরি আঁতোয়ানেৎ স্বপ্নে দেখা দিলেন কেন? হৈমন্তী আজ তাঁর চেয়ারে বসে পড়েছিলেন বলে রেগে গেছেন? রাজা-রানিদের চেয়ারে তাঁর মতন সাধারণ মানুষদের বসতে নেই!
মেরি আঁতোয়ানেৎ যেন হৈমন্তীর মনের কথা বুঝতে পারলেন, সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নাড়লেন খুব জোরে। যেন বলতে চাইছেন, না, না, না, না…
হৈমন্তী বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি ভুল করে বসে ফেলেছি…
মেরি আঁতোয়ানেৎ কিছু বলতে গেলেন, বোঝা গেল না। আর তাঁকে দেখা গেল না। এইসময় হৈমন্তী শুনতে পেলেন নীচের দরজায় কলিং বেল বাজছে।
বেলটা বেজেই চলল, কেউ খুলছেনা। অমিতরা অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। সহজে জাগবে না।
হৈমন্তী নিজেই বেরিয়ে এলেন। এসব দেশে গভীর রাতে কিংবা শেষ রাতে অতিথি আসা আশ্চর্যের কিছু নয়। মাঝরাতে প্লেন আসে। দেশ থেকে হঠাৎ কেউ এসে পড়তে পারে।
দরজা খুলতেই দেখলেন একজন সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।
নীল রঙের একটা লম্বা কোট পরা, বুকে একটা হাত, মাথায় সামান্য টাক। বাইরে আবছা অন্ধকার বলে মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না।
সাহেবটি অনেকটা ঝুঁকে হৈমন্তীকে অভিবাদন জানাল। তারপর ভাঙা-ভাঙা ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, তুমি হৈমন্তী দেবী?
হৈমন্তী বিহুলভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, দাঁড়ান, আমার ছেলেকে ডেকে দিচ্ছি।
সাহেবটি হাত তুলে বলল, কোনও দরকার নেই। তারপর পেছন ফিরে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করল।
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। সেখান থেকে দুটো লোক নেমে, ধরাধরি করে নিয়ে এল একটা চেয়ার।
হৈমন্তীর রক্ত হিম হয়ে গেল। এই তো সেই চেয়ারটা! ওরা এখনও ছাড়েনি? এই চেয়ারের দাম দিতে হবে নাকি? এত রাত্তিরে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছে। তাঁর ছেলে অত টাকা পাবে। কোথায়? নীল কোট পরা সাহেবটি বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানে চেয়ারটা নামিয়ে রাখতে বলল।
হৈমন্তী ব্যাকুলভাবে বললেন, বিশ্বাস করুন, মেরি আঁতোয়ানেৎ-এর চেয়ারটা আমি ভাঙিনি। ভাঙাই ছিল। আমি শুধু ভুল করে বসেছিলাম। সেজন্য আমাকে জেলে দিতে চান নিয়ে চলুন, আমার ছেলেকে কিছু বলবেন না।
নীল কোট পরা সাহেবটি উগ্র স্বরে বলল, কে বলেছে, এটা মেরি আঁতোয়ানেৎ-এর চেয়ার? ওরা কিচ্ছু জানে না। এটা আমার চেয়ার ছিল। আমি এই চেয়ারে বসে জুতো পরতাম!
সাহেবটি চেয়ারে বসে পড়ে একবার দু-পা তুলল। আবার সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার চেয়ার। আমি অনুমতি দিচ্ছি, তুমি এই চেয়ারে যত খুশি বসতে পারো। বসো, এখন বসে দ্যাখো।
হৈমন্তী বললেন, না, না, আমি আর বসতে চাইনা।
সাহেবটি বলল, আমি বলছি, তুমি বসো। তোমার জন্যই আমি নিয়ে এসেছি।
হৈমন্তী বললেন, এটা আপনার চেয়ার? তবে যে ওরা বলল…আপনার নাম কী?
সাহেবটি হাসল, হৈমন্তীর দিকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে বলল, আমাকে নিজের মুখে নাম বলতে হবে? আজকাল লোকে বুঝি আমায় ভুলে গেছে?
এবার হৈমন্তী চিনতে পারলেন। ছবিতে দেখেছেন বহুবার। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট!