জেটিঘাট
তিনখানা খড়ের নৌকো লিজ নিয়েছে দানসা, আর ফেরিঘাটের টিকিট কাটে ওমর। দুজনে এক ছাউনির নীচে বসে।
দানসার খাটুনি বেশি, কারণ কারবারটা তার নিজের। এক সিজনের জন্য নৌকোগুলো সে লিজ নিয়েছে, এবার থেকে ওপারে খড় বোঝাই করে চালান দেয়। কখনও ইট কিংবা আলুর বস্তাও। যায়। পাঁচজন মজুর খাটাতে হয়। নৌকোগুলোতে খড় কিংবা অন্য মাল বোঝাই করার সময় সে নিজেও হাত লাগায়, জোয়ারের সময় কোমরজলে নামতে হয়। নৌকোগুলো ছেড়ে গেলে সে ছাউনিতে বসে একটু জিরোয়।
ওমরের কাজ খুবই হালকা। নদী শান্ত থাকলে দিনে বড়জোর দুবার করে ফেরি যায়। তাও প্যাসেঞ্জার লঞ্চ নয়, বার্জ। গাড়ি, লরি, টেম্পো পারাপার করে। সরকারি ব্যবস্থা। কাছেই সমুদ্র, জোরে বাতাস বইলে এখানকার জলেও সমুদ্রের মতন ঢেউ ওঠে, তখন জেটির কাছে বার্জ ভিড়তে পারে না। সেই সময় পারাপার বন্ধ। ওমরের কাজ চুপচাপ বসে বিড়ি টানা। সেই ঢেউয়ের মধ্যেও দানসার নৌকোগুলো ঠিক চলে যায়, কাজ বন্ধ হলে তার ক্ষতি।
যখন বাতাস থাকে না, মেঘ থাকে না, তখন ঠাটা-পোড়া রোদ। সেইজন্য দানসা একটা ছাউনি বানিয়ে নিয়েছে। আলগা ইটের দেয়াল, ওপরে একটা তেরপল বেছানো, মেঝেতে খড় পাতা। রাত্তিরে এখানে শুয়ে থাকাও যায়।
একবার বার্জ ছেড়ে গেলে ফিরতে-ফিরতে দু-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। তখন ওমর পা ছড়িয়ে নদীর দিকে চেয়ে বসে থাকে। মোহনার কাছাকাছিনদী, তাই সারা বছরই অতি জীবন্ত। ভাটার সময় নেমে যায় অনেকখানি, আর জোয়ারের সময় ছলাৎছলাৎ করে ঢেউ একটু-একটু এগিয়ে আসে। কাদার ওপর গেঁথে যাওয়া নৌকোগুলোকে জিভ দিয়ে চাটে। জেটির ওপর জল লাফিয়ে উঠে আসে অনেকখানি।
নদী ছাড়া কিছু মানুষজনও দেখা যায়। কাছাকাছি দশ-বারোজন সকাল থেকে জাল পাতা আর জাল তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে। আজকাল বাগদা চিংড়ির পোনার খুব চাহিদা। দামও ভালো। পাওয়া যায়। প্রায় আলপিনের মতো সাইজ, তাও স্বচ্ছ, খালি চোখে বলতে গেলে দেখাই যায় না, সেই চারা-চিংড়িও এরা আজকাল ধরতে শিখেছে। অন্য মাছ ধরার আগ্রহ নেই কারুর।
নতুন জেটি হয়েছে। তাই নতুন বসতি, অন্য জায়গা থেকে জেলেরা এসে ঝুপড়ি বেঁধেছে। এখানে। জলে নেমে যারা-যারা জাল পাতে, তাদের মধ্যে জনা-পাঁচেক স্ত্রীলোকও আছে। নামেই স্ত্রীলোক, বুক নেই, পাছা নেই, যেন শিল-নোড়ায় বাটা চেহারা, চাবুক খাওয়া মুখ। ওদের মধ্যে একমাত্র আমিনাই খানিকটা চলনসই, তাও আহামরি কিছু নয়। চোখ দুটো কুতকুতে, তবু মুখে একটা তেলতেলে ভাব আছে, আর উরুর গোছটা ভালো। সকালবেলা যখন কাদার মধ্যে নেমে নাইলনের লম্বা, বেড়াজালের খুঁটিগুলো বাঁধে আমিনা, তখন সে তার কস্তা ডুরে শাড়িটা গাছ কোমর করে পরে থাকে। জোয়ার আসার পর জল একটু-একটু করে বাড়তে থাকে, আমিনাও তার শাড়িটা একটু-একটু উঁচুতে গুটিয়ে নেয়। পায়ের ডিম ছাড়ায়, হাঁটু ছাড়ায়, উরুর মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠে যায়। তারপর সে শাড়িটা আবার নামায়, একসময় তার বুক-জল হয়ে যায়। শাড়ি তার ভিজবেই, নদীতে নেমে জাল পাতবে অথচ পরনের কাপড় ভিজবে না, এ কখনও হয়? তা বলে। প্রথম থেকেই সে শাড়ি না ভিজিয়ে উরু পর্যন্ত তোলে কেন? ওমর এ রহস্যটা বুঝতে পারে না।
প্যাসেঞ্জার লঞ্চের জেটি আলাদা, সেখানে লোকজন বেশি, কিছু দোকান পাটও আছে। লঞ্চ চালায় প্রাইভেট কোম্পানি, তারা যাত্রীবোঝাই করে লঞ্চ ছাড়ে, বেশি প্যাসেঞ্জার হয়ে গেলে এক্সট্রা ট্রিপ দেয়। আর এই বার্জের জেটিতে আসে শুধু কিছু লরি আর টেম্পো, কদাচিৎ দু একখানা প্রাইভেট লরি। দশ-বারোজন জেলে-জেলেনী ছাড়া অন্য মানুষজন প্রায় দেখাই যায় না।
একখানা মারুতি ভ্যান গাড়ি জোরে চালিয়ে এসে সোজা চলে গেল জেটির শেষ প্রান্তে। গাড়ি থেকে নামল লাল গেঞ্জিপরা এক ছোকরা। জেটির গায়ে যাতে বার্জ বা লঞ্চের সরাসরি ধাক্কা না লাগে সেই জন্য কয়েকটা টায়ার বাঁধা আছে। সেইরকম একটা টায়ার ধরে লাফিয়ে বার্জটায় উঠে গেল ছোকরাটি। দূরের ছাউনিতে পা ছড়িয়ে বসে ওমর দেখছে। দানসা একটু আগে একটা খড়ের নৌকো বোঝাই করে ছেড়েছে, পরিশ্রম হয়েছে খুব, সে একপাশে এলিয়ে শুয়ে আছে। খড়ের গাদায়।
লাল গেঞ্জিপরা ছোকরাটি আবার লাফিয়ে জেটিতে নেমে জোরকদমে এদিকে ফিরে এল। টিকিটঘর বলে কিছু লেখা নেই, ওদিককার প্যাসেঞ্জার ফেরির মতন এদিকে টিকিটঘরও নেই, সরকারি ব্যবস্থায় ওমরের শুধু একটা টুল পেতে বসে থাকার কথা, সেটাই অফিস।
ছোকরাটি এসে একশো টাকার একটা নোট বার করে বলল, গাড়ির জন্য কত লাগে, ষাট না আশি?
ওমর টাকার প্রতি কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, আজ আর যাবে না।
ছোকরাটি রীতিমতন চমকে গিয়ে বলল, যাবে না? কেন?
ওমর বলল, যাবে না, যাবে না!
ছোকরাটি এবার গর্জন করে উঠে বলল, ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো! বার্জ জেটিতে লেগে আছে, অথচ তুমি বলছ যাবে না, তার মানে?
গর্জন শুনে একটুও বিচলিত হল না ওমর। অবজ্ঞার সঙ্গে গাল চুলকোতে-চুলকোতে বলল, জাহাজ থাকলেই যেতে হবে? সাড়ে বারোটায় বান আসবে। তখন ওপারের জেটি পুরো ডুবে যাবে। আপনার গাড়ি ওপারে গিয়ে নামাবেন কোথায়? মাঝ গঙ্গায়?
ছোকরাটির ক্রোধের সঙ্গে এবার মিশল বিস্ময়। হাতঘড়ি দেখে বলল, এখন এগারোটা দশ। ওপারে যেতে কতক্ষণ লাগে আমি জানি না? বড়জোর পঁয়তিরিশ মিনিট। বান আসার সঙ্গে কী সম্পর্ক আছে? আমায় টিকিট দাও!
—হবে না!
–তার মানে? টিকিট দেবে না?
—একখানা গাড়ি পার হয় না। পেছনে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আরও অন্তত দুখানা গাড়ি না এলে জাহাজ ছাড়বে না।
—যদি আর গাড়ি না আসে?
—তাহলে যাবে না!
—অন্য গাড়ি আসতে-আসতে যদি বান এসে যায়?
–বলেছি তো যাবে না!
ছোকরাটি এবার অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকাল। তার অদম্য ইচ্ছে হচ্ছে এই শুকনো, ঢ্যাঙা লোকটার মুখে দুখানা ঘুসি কষাতে। কিন্তু তাতে তার সমস্যার সমাধান হবে না। সারেং-এর সঙ্গে সে কথা বলে এসেছে। সারেং-এর যেতে আপত্তি নেই, কিন্তু টিকিটবাবু টিকিট না দিলে সে বার্জ ছাড়তে পারবে না।
ছোকরাটি এবার মেজাজ সামলে বলল, অন্য গাড়ি যদি না আসে…আমার খুব বিপদ হয়ে যাবে। আমাকে আজ ওপারে যেতেই হবে। ওমর পিচ করে একপাশে থুতু ফেলে বলল, একখানা গাড়ি নিয়ে জাহাজ ছাড়ার নিয়ম নেই, বললাম তো!
ছোকরাটি আরও অনুনয় করে বলল, একটু ব্যবস্থা করো। আমার বিশেষ দরকার। একজনের অসুখ। তুমি না হয় পুরো একশো টাকাই রাখো!
ওমর এবার খেঁকিয়ে উঠে বলল, কেন জ্বালাতন করছেন? অন্তত তিনখানা গাড়ি না হলে আমি টিকিট দেব না, ব্যাস!
ওমর পেছন ফিরে বসে বিড়ির বান্ডিল খুঁজতে লাগল।
ছোকরাটি সরে গেল এবার। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল জেটিতে। মাঝেমাঝেই রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। আর কোনও গাড়ির চিহ্ন নেই।
ওমর বিড়ি ধরিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
দানসা সব শুনছিল। এবার সে জিগ্যেস করল, ভদ্রলোককে টিকিট দিলি না কেন রে? ওমর বলল, একখানা গাড়ির জন্য জাহাজ ছাড়বে? মোটে আশিটাকা এক গাড়ি, আর কত টাকার ডিজেল পুড়বে তা জানিস?
দানসা বলল, ডিজেল পুড়বে তো গভর্নমেন্টের।
—আমি জেনেশুনে গভর্নমেন্টের ক্ষতি করব? কোম্পানিকা মাল দরিয়ামে ডাল?
—আরে, গভর্নমেন্ট কি লাভের জন্য ফেরি চালাচ্ছে? চালাচ্ছে মানুষের উপকারের জন্য। রেল নেই, বাস নেই, ব্রিজ নেই, মানুষ ওপারে যাবে কী করে? মালপত্তর নিয়ে গাড়ি যাবে কী করে? তাই গভর্নমেন্ট বিনালাভে এই ব্যবস্থা করেছে। পাঁচখানা গাড়িও যদি যায়, পাঁচ আশি হল গে চারশো, তাতেও কি এক ট্রিপের খরচ ওঠে? ডিজেল খরচ, সারেং, সাতজন হেল্পর…
—তবু গভর্নমেন্টের আইন আছে, মোটে একখানা গাড়ি হলে জাহাজ যাবে না।
—পরশুদিন তুই ব্রজেন সাহার লরি পার করালি। সেও তো মোটে একখানাই ছিল। ব্রজেনের সঙ্গে তোর খাতির আছে।
—বেশ করেছি। আমার ইচ্ছে। গভর্নমেন্ট আমাকে এখানে রেখেছে, আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করব।
—সে তো ঠিক। এই বাবুটা বলল, ওর বড় বিপদ। দ্যাখ না কেমন ছটফট করছে।
—আরে রাখ! ঠেলায় পড়লে অমন বিপদের কথা সবাই বলে।
—শেষকালে তোর কাছে কাকুতি-মিনতি করল, দিয়ে দে না টিকিট। মানুষের উপকার হবে।
–দ্যাখ দানসা, এই লোকটার সঙ্গে যদি হাটে-বাজারে আমার দেখা হত, ভালো করে কথা বলত আমার সঙ্গে, আমাকে মানুষ বলে গ্রাহ্য করত; ভাবভঙ্গি দেখে বুঝলি না? প্রথমেই কেমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছিল!
এবার দানসা হেসে ফেলল।
সত্যি কথাই তো, এই জেটিঘাট থেকে উঠে গেলে, রাস্তায়, হাটে-বাজারে ওমর একজন অতিসাধারণ নিরীহ মানুষ। লম্বা, সিঁড়িঙ্গে চেহারা, একজন এলেবেলে গরিব। শুধু এই জেটিঘাটে বসে টিকিট দেওয়ার সময়েই তার যত তেজ। গাড়িওয়ালা বাবুদেরও সে ফিরিয়ে দিতে পারে। ওমর এই ক্ষমতাটা উপভোগ করে। ওই লাল গেঞ্জি পরা ছোকরা ওকে কুড়ি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিল, অমর তাও নিল না, ওকে নিরাশ অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে ওমর কুড়ি টাকার চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছে।
দানসা তবু আবার বলল, আজ হাট বন্ধ। আজ আর গাড়ি আসবে না। বান ডাকার আগে লোকটাকে পার করে দেনা, ওমর। মানুষের উপকার করলে নিজেরও উপকার হয়। মনটা ঠান্ডা হয়।
ওমর বলল, আছে। এই শালারা নিমকহারাম হয়। আজ উপকার করব, কাল দেখবি এসে আবার চোখ রাঙাবে।
দানসা বলল, আহারে, দ্যাখ দ্যাখ, লোকটা বোধহয় এবার ভিরমি খেয়ে পড়বে। খুব দরকার না হলে…দে দে, একটা টিকিট দে।
ওমর এবার হাতছানি দিয়ে ছোকরাটিকে ডাকল। সে আগে থেকেই একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে রেখেছিল, ঘুষের জন্য নয়, বিনা কারণে লোকটির উপকার করছে, এটা বুঝিয়ে দিয়ে। টিকিটটা বাড়িয়ে বলল, যান যান, দৌড়ে চলে যান।
লোকটা যে এতক্ষণ অনিশ্চয়তায় কষ্ট পেয়েছে, তাতেও ওমরের কম আনন্দ হয়নি। ছাউনির মধ্যে রান্নার কোনও ব্যবস্থা নেই, দুপুরের দিকে ওরা অন্য জেটিঘাটের হোটেলে খেতে যায়। একটা মুসলমানের হোটেল, অন্য হোটেলটায় সেরকম কিছু লেখা নেই। রাত্তিরের দিকে। নিরিবিলি থাকে, তখন ওমর আর দানসা অন্য হোটেলটায় খায়, ওখানে রান্না ভালো, ম্যানেজারটা মজলিসি ধরনের। দিনেরবেলা যাত্রীদের খুব ভিড় থাকে, তাই ওখানে না গিয়ে ওরা মুসলমান হোটেলেই ঢোকে। এখানে খাবার একটু সস্তা, কিন্তু মালিকটা তিরিক্ষি মেজাজের, কোনও রান্না নিয়ে অভিযোগ করলেই সে দাঁত খিচিয়ে বলে ওঠে, না পোষায়, এসো না! কাছাকাছি আর কোনও মুসলমানের হোটেল নেই। ব্যাটা সেই সুযোগটা নেয়।
আটখানা করে রুটি, এক প্লেট শুকনো গোস্ত আর পেঁয়াজ দিয়ে ওরা খাওয়া সেরে নিল। ওমর দই নিল, দানসা দই খায় না।
দাম দিয়ে বেরিয়ে আসার পর পাশের দোকানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে দানসা বলল, তোর আর আমার কাছ থেকে সমান পয়সা নিল কেন রে? তুই দই খেলি।
ওমর একগাল হেসে বলল, চেপে যা। ও শালা মালিকটা ভুলে গেছে। আমার আজ একটা টাকা লাভ।
দানসা বলল, ভুল করে দাম নেয়নি। এঃ হে, ওর ক্ষতি হয়ে গেল। দই তো ও বাজার থেকে কিনেছে। যা, ওমর, টাকাটা দিয়ে আয়। ওমর চোখ কপালে তুলে বলল, ফেরত দিতে যাব? তোর মাথা খারাপ?
—দিবি না? দই খেয়েছিস, তার দাম দিবি না?
—ও নেয়নি কেন? সেটা আমার দোষ নয়। একদিন আমি সাতখানা রুটি খেয়েছিলুম, ও হিসেবে ধরেছিল ন-খানা। তোর মনে নেই? কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করল না? চল্লিশ পয়সা বেশি নিয়ে নিল!
—ও ভুল করেছিল। তা বলে তুই জেনেশুনে ওকে ঠকাবি? একটা টাকার জন্য পাপ করবি?
–দ্যাখ দানসা, তুই শালা আমার বিবেক নাকি? সবসময় আমার পেছনে টিকটিক করিস কেন বল তো?
—তুই যদি নিজের থেকে টাকা ফেরত দিতে যাস, দেখবি ও যেমন অবাক হবে, তেমনি খুশি হবে। মানুষকে খুশি করার মতন পুণ্যি কি আর কিছুতে হয়? যা, যা। একটা টাকার তো মোটে মামলা।
ওমর আরও কিছুক্ষণ তর্ক করে। বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে যায়। তবু সে একসময় দানসার কাছে হার মানে, হোটেলের কাউন্টারে গিয়ে একটা টাকা ছুড়ে দিয়ে আসে।
পান খেয়ে গল্প করতে-করতে হাঁটে দুজন। সরকারি জায়গায় অনেক ঝুপড়ি উঠে গেছে। আরও নিত্যনতুন গজাচ্ছে। কিছুদিন আগেও জায়গাটা ছিল ফাঁকা। শিগগিরই এটা একটা গঞ্জ হয়ে যাবে। দূর-দূর গ্রাম থেকে যে যেমন পারে জায়গা দখল করে নিচ্ছে। ওমর আর দানসারও দুটো জায়গা নেওয়া আছে, কিন্তু ঘর তোলেনি। এখানে সংসার পাতার কথা এখনও ভাবেনি। ওমরের নতুন চাকরি, আর দানসা তার কারবারে এখনও বিশেষ লাভের মুখ দেখেনি।
একটা ঝুপড়ির বাইরে আমিনা এঁটো-কাঁটা খাওয়াচ্ছে কুকুরকে। এখন একটা শুকনো শাড়ি পরেছে, চুল আঁচড়াচ্ছে। সকালবেলা যখন জলে-জলে থাকে, তখন একে অন্যরকম দেখায়। ডিজেল হাঁড়ির মতন গায়ের রং, নাকটা বোঁজা, তবু মেয়েটার একটা কিছু চটক আছে।
সবাই এখানে নতুন এসেছে, কেউ কারুকে ভালো করে চেনে না। আমিনাদের ঝুপড়িতে থাকে এক বুড়ো আর একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে। ছেলেটা ওর ভাই আর বুড়োটা ওর স্বামী। একটা পিঠ-ব্যাঁকা বুড়োর সঙ্গে কেন ওর বিয়ে হল কে জানে! বুড়োটা মাঝেমাঝেই খকখক করে কাশে। তবু তার তেজ আছে, আমিনাকে বকে প্রায়ই, ভাইটাকেও বকে।
ওমর ভাবল, এই আমিনাকে সুযোগ বুঝে একদিন অন্য কেউ খাবে। বিয়ে হয়ে গেলেই যে সে স্ত্রীলোককে অন্য কেউ খাবে না, তার কোনও মানে নেই। অন্তত এখানে ওসব নিয়ম খাটে না। বুড়োর যুবতী স্ত্রী, তার ওপর কেউ না কেউ ভাগ বসাতে চাইবেই। এখন কথা হচ্ছে, কে আগে খাবে!
ওমরের শরীরটা চনমন করে ওঠে।
দানসা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ওই আমিনার দিকে নজর দিস না যেন!
ওমর দারুণ চমকে গিয়ে বন্ধুর দিকে তাকাল।
দানসা আবার বলল, ওর ভাইটাকে দেখেছিস তো, খুব গোঁয়ার। বয়েস কম হলে যা হয়, শরীরে তাগদ আছে। আর বুড়োটার নজরও খুব সরু। দেখিস না, আমিনাকে কারুর সঙ্গে কথা বলতে দেয় না!
ওমর বলল, আমার নজর দিতে ভারী বয়ে গেছে।
দানসা বলল, গভর্নমেন্টের চাকরি পেয়েছিস, তোর আর চিন্তা কী? এবার বিয়ে-শাদী কর।
ওমর ঠোঁট ওলটাল। মাইনে তিনশো চল্লিশ টাকা। ওই টাকায় সংসার হয়? আগে কিছু জমুক।
দানসা বলল, ডাগর ডোগর দেখে বউ আনবি, তাকে দিয়ে কাজ করাবি। পানিতে নেমে মাছ। ধরতে শিখলেই টাকা আসবে। মেয়েছেলেরা এই কাজ ভালো পারে। তারপর কাচ্চা-বাচ্চা হবে। আল্লা দোয়া করবেন। নিজের ছেলেপুলে না হলে পুরুষমানুষের মন শান্ত হয় না।
ওমর বলল, রাখ, ও কথা রাখ!
আমিনা মেয়েটি সত্যিই কম কথা বলে। কারুর সঙ্গে মেশে না। সামনাসামনি চোখাচুখি হলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু শাড়ি ভেজাতেই হবে, তবু কেন সে অল্প জলে উরু পর্যন্ত শাড়ি গুটিয়ে রাখে, এটাই ওমর বুঝতে পারে না।
কয়েকটা দিন একঘেয়ে যাওয়ার পর ওমর ছটফটিয়ে উঠল। কারুর ওপর সে ব্যক্তিত্ব ফলাতে পারছে না, কারুর কাকুতি-মিনতি অগ্রাহ্য করার আনন্দ পাচ্ছে না। আজ আবার বনধ। ডায়মন্ডহারবারে কী যেন গণ্ডগোল হয়েছিল কাল, তার জন্য সারা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বনধ। এই ফেরিঘাটের সঙ্গে ডায়মন্ডহারবারের ঝঞ্চাটের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু ভয়েই আজকাল সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। প্রাইভেট কোম্পানির প্যাসেঞ্চার লঞ্চ চলবে না, হোটেলেও ঝাঁপ ফেলা।
শুধু বার্জ সার্ভিস চালু রাখার কথা, কারণ সেটা সরকারি। যদি গাড়ি আসে পারাপারের জন্য। সে সম্ভাবনা খুবই কম।
জেলেরা বনধ-হরতাল মানে না। তারা সবাই জলে নেমেছে। ওমর জেটিঘাটের মাঝখান পর্যন্ত হেঁটে গেল। আমিনা আর অন্য দুটি স্ত্রীলোক সেখানে জাল ছড়াচ্ছে। সবাই জালের একটা দিক জেটির সঙ্গে বাঁধে।
ওমর গম্ভীরভাবে বলল, এই এখানে থেকে জাল সরাও! জাল সরাও!
মেয়েরা অবাক হয়ে তাকাল। প্রতিদিন জাল বাঁধা হচ্ছে, এরকম কথা কখনও শোনেনি। ওমর বলল, জাল সরাও! হাঁ করে দেখছ কী?
একটি স্ত্রীলোক বলল, কেন? জাল খাটাব না কেন?
ওমর বলল, এটা সরকারের সম্পত্তি। এখানে জাল বাঁধার কে হুকুম দিয়েছে?
স্ত্রীলোকটি ঠিক বুঝতে না পেরে বলল, নদীর পানি সরকারের সম্পত্তি? মাছ ধরা যাবে না?
ওমর ধমক দিয়ে বলল, কোথাকার উজবুক হে! নদীর পানি সরকারের, তা কি আমি বলেছি? এত বড় নদী যেখানে ইচ্ছে মাছ ধরো গে, কে বারণ করেছে? এই জেটির সঙ্গে বাঁধা চলবে না। আমার জাহাজ যাওয়া-আসার অসুবিধে হয়। খোলো, খোলো!
সবাই জেটির সঙ্গে জালের একটা দিক বাঁধে। তারপর পরপর খুঁটি চলে যায় অনেকদূর পর্যন্ত। জেটির মতন একটা মজবুত খুঁটি তো আর হয় না। এখন সব খুলে আবার বাঁধতে হবে? স্ত্রীলোকেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এ ওর চোখের দিকে তাকায়। আমি শুধু জলের দিকে চেয়ে থাকে।
অন্য জেলেরা কাছাকাছি চলে আসে। আমিনার স্বামী আর ভাইও আসে। কেউ-কেউ তর্ক জুড়ে দেয়। কিন্তু ওমর অনড়। সে সরকারের প্রতিনিধি, সরকারের সম্পত্তি সে অন্যদের ব্যবহার করতে দেবে না।
খানিকক্ষণ তর্কের পর বেশ মেজাজ দেখিয়ে ওমর বলল, অত কথা কীসের? নিজেরা খুলবে, না আমি খুলে দেব?
সত্যিই সে একটা জালের দড়ি খোলার জন্য টান মারে।
দানসা একটা নৌকোয় খড় বোঝাই করছিল। সেও বনধ মানেনি। একটা নৌকো তো ওপারে যাক। ওদিকের বাবুরা যদি আটকায়, তাহলে সে আর অন্য নৌকো ছাড়বে না আজ।
গোলমাল শুনে কোমরজল ঠেলে-ঠেলে জেটির কাছে এসে সে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে?
আমিনার স্বামী বলল, জেটিতে জাল বাঁধা যাবে না বলছে।
দানসা ওমরের দিকে তাকাল।
ওমর যুক্তি দেখিয়ে বলল, এরা সব জাল বেঁধে রাখে। আমার জাহাজ যাওয়া-আসার অসুবিধে হয়।
একজন জেলে বলল, জাহাজ লাগার সময় তো আমরা জাল খুলে দিই। জাহাজের চাকা লাগলে জাল ছিঁড়ে যাবে।
ওমর বলল, হ্যাঁ, জাল খুলে নাও, কিন্তু কখন খোলো? জাহাজ কাছে এসে ভেঁপু মারে। তার আগে তোমাদের হুশ হয় না। ভেঁপু শুনে তারপর তোমরা জাল খুলতে শুরু করো। তাতে আমাদের টাইম নষ্ট হয়। গভর্নমেন্টের টাইমের বুঝি দাম নেই? অ্যাঁ?
দানসা বলল, হ্যাঁ, সেটা ঠিক কথা। সরকারের টাইমের দাম আছে। কিন্তু জেলেদের যাতে সুবিধে হয়, সেটাও তো দরকার দেখবে। জাহাজ তো দুবার মাত্তর আসে যায়। সারাদিন জেটি খালি পড়ে থাকে। জেটিতে জাল বাঁধলে জেলেদের সুবিধে হয়, ঠিক কিনা? সরকার তো সেটাও দেখবে?
—তবে ওরা জাহাজ আসবার আগে-আগে জাল খুলে নেয় না কেন?
—সেটাও ঠিক। ওগো, জাহাজ যখন ওপার থেকে মাঝ নদী পেরুবে, তখন জাল খুলতে শুরু করবে। হিসেব করে। পারবে না?
অনেকেরই এই সমাধান মনোমতন হল।
ওমর এবার সবার মুখের দিকে তাকাল। মুখের ভঙ্গিটা উদার হয়ে গেল। বিচারের রায় দেওয়ার সুরে সে বলল, ঠিক আছে, তাহলে আমি পারমিশান দিতে পারি। কিন্তু মনে থাকে যেন, ঠিক সময়ে…।
এই খুদে সাম্রাজ্যের সম্রাটের মতন ধীর পা ফেলে ওমর ফিরে যায় নিজের ছাউনিতে। পরম তৃপ্তির সঙ্গে বিড়ি ধরায়।
দুপুরবেলা একটা কাণ্ড ঘটল।
চতুর্দিক নিস্তব্ধ, নদীর ওপর হা-হা করছে বাতাস, একটাও নৌকো চলছে না। খড়ের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আছে দানসা আর ওমর। একজনের ঘুমঘুম ভাব, অন্যজন বিড়ি টেনে যাচ্ছে। এমন। সময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল আমিনা। কলাপাতা চাপা দেওয়া একটা ডেকচি নামিয়ে রাখল মেঝেতে।
ওমর তড়াক করে উঠে বসে বলল, ওটা কী? কলাপাতাটা উঠিয়ে দিল আমিনা। এক ডেকচি ভরতি ভাত, তার ওপরেই একপাশে লটকা মাছের চচ্চড়ি।
মৃদুস্বরে আমিনা বলল, আজ তো হোটেল বন্ধ।
দানসার গ্রামের বাড়ি সতেরো মাইল দূরে, আর ওমরের বাড়ি বসিরহাট। একদিনের ছুটিতে ওমরের বাড়ি যাওয়ার চাড় অনুভব করে না। আর ওমরের তো ঠিক ছুটিও নয়। কিন্তু তারা। হোটেলে খায়, বনদের দিনে তাদের আহার জুটবে কী করে? সে কথা কেউ ভাবে না। দানসা একছড়া কলা কিনে রেখেছে, তাই খেয়ে খিদে মেটাবে। ওমর কিছু ভাবেইনি।
দানসা বলল, হোটেল বন্ধ বলে তুমি আমাদের জন্য ভাত নিয়ে এসেছ? তোমায় কে পাঠাল?
আমিনা কোনও উত্তর দিল না।
দানসা আবার বলল, তুমি কী ভালো মেয়ে গো! আমরা দুটো মদ্দ এখানে না খেড়ে পড়ে আছি, তুমি ঠিক নজর করেছ?
ওমর ভাবল, কার কথা বেশি ভেবে খাবার এনেছে আমিনা? দানসাটা কি মনে করছে ওর জন্য? দানসা আজ ওদের হয়ে ওকালতি করছিল, সেইজন্য? গাধা আর কাকে বলে! উকিল বড়, না। হকিম বড়? আমিনারা বুঝেছে যে ওমরকে খাতির না করলে এই জেটির ধারে মাছ ধরা যাবে না।
আমিনা বলল, আমি পরে এসে বাসনটা নিয়ে যাব।
দানসা বলল, আমি ধুয়ে পৌঁছে দেব। তোমাকে আসতে হবে না।
ওমর ফস করে বলল, তোমরা তো রোজ রান্না করো, আমরা চাল কিনে দিলে দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবে?
দানসা অবাক হয়ে ওমরের দিকে তাকাল। ওমর বলল, ওরা বেঁধে দিলে আমাদের আর রোজ রোজ হোটেলে খেতে হয় না। আমরা পয়সা দেব। চাল-ডাল কিনে দেব।
দুজনেই তাকাল আমিনার দিকে। আমিনা মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, দেব না কেন?
এরপর থেকে ভালো ব্যবস্থা হয়ে গেল। দানসা আর ওমরকে হোটেলে যেতে হয় না। আমিনা। কিংবা তার ছোটভাই এসে খাবার দিয়ে যায়। ওমর আর দানসা পালা করে বাজার করে আনে।
আমিনার স্বামীও খুশি, কারণ ওমর ওদের দই খাওয়ায়। বুড়ো দই খেতে খুব ভালোবাসে।
আমিনা এখনও বেশি কথা বলে না বটে, কিন্তু মাঝে-মাঝে স্থির দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টির সঠিক ভাষা ওমর বোঝে না, কিন্তু তার শরীর ঝনঝন করে। তার তুলনায় দানসা। ওদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাতিয়েছে বেশি। দানসা মাঝে-মাঝে আমিনাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। মজার কথা বলে। আমিনার ভাইটা তার বেশ ন্যাওটা।
এক-একদিন আমিনা বিকেলের দিকে কোথায় যেন যায়। একটু সেজেগুঁজে। ওমরের পছন্দ হয় না। এখান থেকে বাজার সাত মাইল দূরে। ওমর আর দানসার একটা ভাগাভাগির সাইকেল। আছে। আমি কি বাজারে যায়? ভাইটাকে পাঠালেই তো পারে। ওমরের সন্দেহ হয়, আমিনা যেন অন্য কারুর মুখগহ্বরের দিকে এগোচ্ছে! তাহলে ওমর নয় কেন?
দানসা অবশ্য প্রশংসা করে খুব আমিনার। মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র ভালো, এদিক-ওদিক চায় না। যাত্রী ফেরিঘাটের লোকজনের সঙ্গে ফচকেমি করে না। মাছের পাইকারদের সঙ্গে দরাদরিতে সে ওস্তাদ, কিন্তু ওরা অন্য কোনওরকম সুবিধে নিতে পারে না।
সকালবেলা পুরো জোয়ার আসার আগে আমিনা প্রতিদিন উরু দেখায়। ওমর এক-একদিন। জেটির মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আমিনা তবু লজ্জা পায় না। ওমরের মাথায় আগুন জ্বলে। দানসার কথা মতন যদি ভালো মেয়েই হয়, তাহলে ঊরু ঢেকে রাখে না কেন?
একদিন বিকেলবেলা আমিনার স্বামী হঠাৎ খুব বমি করতে লাগল। প্রথম কয়েকবার কেউ তেমন খেয়াল করেনি। একসময় জেটির ওপর উঠে এসে নেতিয়ে পড়ল একেবারে। মনে হল চোখ। উলটে যাচ্ছে। নির্ঘাত কলেরা। প্যাসেঞ্জার লঞ্চ চলে গেল এইমাত্র। ফিরতে ফিরতে অন্তত আরও দেড় ঘণ্টা। ওদের একটা লঞ্চ আজ খারাপ। নদীর জলে খুব টান আছে। নৌকোয় যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। অথচ বুড়োকে এক্ষুনি ওপারে নিয়ে যাওয়া দরকার। সাগরদ্বীপে চালু হেলথ সেন্টার আছে। সেখানে ওর চিকিৎসা হতে পারবে।
বার্জে দুটো লরি আর তিনটে ভ্যান চেপেছে। ছাড়বে এক্ষুনি। আমিনার ভাই সারেংকে অনুরোধ করেছিল তার দুলাভাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সারেং কলেরা-রোগী তুলতে রাজি নয়।
এগিয়ে এল ওমর। সারেংকে ডাকল। গম্ভীরভাবে বলল, মনে করো, আমার বাপের কলেরা হয়েছে, তুমি তাকে নিতে না?
সারেং তো-তো করতে লাগল।
ওমর একজন খালাসিকে ডেকে বলল, গণেশ, ওপারে নিয়ে গেলেই শুধু চলবে না, ওরা হেলথ সেন্টার চেনে না। ওখানে পৌঁছে দিবি।
গণেশ জিজ্ঞেসা করল, ওনার সঙ্গে আর কে যাবে?
আমিনাই যেতে চায়। সে বুড়োর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু ওমর বলল, তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। তোমার ভাই যাক। একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে থাকলে সুবিধে হয়।
ভাই-বোন দুজনেই চলে গেলে আমিনাদের ঘর কে দেখবে? এখানে চোরের খুব উৎপাত। বুড়োর সঙ্গে আমিনার ভাইটাকে পাঠানো ঠিক হল। বার্জে উঠে ওমর নিজে বুড়োকে শুইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল।
বার্জ এবার ছাড়বে। সারেং ওমরকে চুপিচুপি জিগ্যেস করল, আজ কি আবার ফিরতে হবে? একেবারে কাল সকালে ওদিককার গাড়ি নিয়ে চলে আসতাম? রাত্রে ওখানে আমার একটা কাজ ছিল।
ওমর কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। ভোরবেলা এখান থেকেই প্রথম গাড়ির ফেরি ছাড়ার কথা। কিন্তু একদিন দেরি হলে ক্ষতি কী? সন্ধের পর প্যাসেঞ্জার লঞ্চ বন্ধ। বুড়োকে হেলথ সেন্টারে ভরতি। করে আমিনার ভাইটা যদি ফিরতে চায়, কিসে ফিরবে? ফেরার কী দরকার? ওপারে এই জাহাজেই রাত্রে শুয়ে থাকতে পারবে। খালাসিরা ওকে খাইয়ে দেবে।
ওমর সারেংকে বলল, ঠিক আছে, ফিরতে হবে না।
তার মানে, আজ রাতে আমি একা থাকবে। আজ সেই রাত। আজই বুঝতে হবে আমিনার উরু খুলে রাখার রহস্য।
এর মধ্যেই অন্ধকার হয়ে গেছে। জেটি পার হয়ে এসে একটা দৃশ্য দেখে ওমর থমকে গেল। আমিনার কাঁধে হাত দিয়ে, প্রায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দানসা। ঢুকে গেল। আমিনাদের ঝুপড়ির মধ্যে।
দাঁতে দাঁত ঘষে ওমর বলল, শালা হারামি। কিন্তু এখন ওমর ওখানে যেতে পারে না। সে নিজেদের ছাউনিতে বসে গরজাতে লাগল। ধ্বংস করতে লাগল বিড়ির-পর-বিড়ি। হারামজাদা দানসাটার সঙ্গে আজ থেকে সম্পর্ক শেষ। কাল থেকেই ওমর নিজের জায়গাটায় একটা ঘর। তুলতে শুরু করবে।
এক-একটা মিনিট যেন এক-এক ঘণ্টা। ওমর মাঝে-মাঝে বাইরে এসে উঁকি মারছে। চাঁদ ওঠেনি। আকাশ অন্ধকার। কোথাও মানুষজন নেই। আমিনাদের ঝুপড়িতেও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ওখানে কী করছে দানসা?
কতক্ষণ কাটল, এখন কত রাত?
এক সময় আমিনাদের ঝুপড়ির ঝাঁপ ঠেলে দানসা বেরুতেই ওমর সেদিকে ছুটে গেল। দানসার হাতে হাত চেপে ধরে টানতে-টানতে নিয়ে এল নিজেদের ছাউনির দিকে।
দানসা বলল, ব্যবস্থা করে এলুম, ফতি এসে রাত্তিরে আমিনার ঘরে শোবে।
রাগের চোটে তোতলাতে লাগল ওমর। সে বলল, শালা…আমি ওদের পাঠিয়ে দিলাম, তুই, তুই আমার আগে, তুই আমিনাকে, তুই ওকে…
দানসা একগাল হেসে বলল, আমি যে তোর বিবেক!