1 of 3

তিনু ও তিন্নি

তিনু ও তিন্নি

উঠোনে পা দিয়েই বলরাম উগ্র গলায় জিগ্যেস করল, তিনু কোথা? তিনু? কোথায় গেল সেই ছোঁড়াটা?

তিনু এ-বাড়ির যেখানে সেখানে থাকে। তার নিজস্ব কোনও জায়গা নেই, রাত্তিরে শোয় রান্নাঘরের বারান্দায়, অন্য সময় সে চতুর্দিকে ঘুরঘুর করে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এসময় সে বাড়ির বাইরে যায় না।

দু-তিনবার হাঁক দিয়েও তার সাড়া পাওয়া গেল না।

বাইরের ঘরে তক্তাপোষের ওপর হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসছে শিবু আর গৌর, এই একটা ছুতো পেয়ে তারা পড়া ছেড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গিয়ে তিনু-তিনু বলে চিৎকার করতে লাগল।

তিনু গোয়ালঘরে, নেই, রান্নাঘরের কাছাকাছি নেই, পুকুর ধারেও নেই। একটু আগেও সে ছিল! গৌর আর শিবু তাকে দেখেছে। কত্তা বাড়ি ফেরার সময় সে গেল কোথায়? নিশ্চয়ই আজ কিছু একটা কাণ্ড করেছে সে।

বলরাম বারান্দায় এসে চটি খুলল, ঘাড় ঘুরিয়ে বলতে লাগল, কোথায় সে? কোথায়?

তাকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে জিগ্যেস করল, গরু বেঁধেছে? বাড়ি ফিরেছিল?

হ্যাঁ, বাড়িতে সে ফিরেছে ঠিকই। গরুটাকে গোয়ালে তুলেছে, জাবনা দিয়েছে, নিজেও ঢকঢক করে এক ঘটি জল খেল, তারপর কোথায় গেল?

বলরাম নিজের ঘরে গিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে লুঙ্গি পরল, তারপর পুকুরে গেল হাত-পা ধুতে। জল শুকিয়ে গেছে অনেকখানি, পুকুর এখন প্রায় একটা ডোবা। ঝিঝি ডাকছে তেঁতুল গাছে। ওপারে মেজো জ্যাঠার বাড়িতে হ্যাজাক জ্বেলেছে, দুরে ঘেউঘেউ করছে কয়েকটা কুকুর।

ফিরে এসে বলরাম একটা ট্রানজিস্টার রেডিও খুলে বিড়ি ধরাল। হুঁকো তামাকের পাট তুলে। দিতে হয়েছে কিছুদিন আগে, বিড়িতে কম খরচ পড়ে। সন্ধের পর বাড়িতে ফিরে রেডিও শোনাই বলরামের অবসর বিনোদন। বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে সে কথাবার্তা বিশেষ বলে। গাম্ভীর্যই তার ব্যক্তিত্ব।

এমনই কপাল যে চার ছেলেমেয়ের মধ্যে মেয়ে দুটোই জন্মেছে আগে। অর্থাৎ শুধু খরচ আর খরচ, পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। এর মধ্যে আবার বড় মেয়েটি ফিরে এসেছে বিধবা হয়ে। তার বিয়ের জন্য যে জমি বিক্রি করতে হয়েছিল, তা আর ফিরে এল না।

শুধু জমির চাষে আর সংসার চালানো যাবে না। এখন সকলেরই ঝোঁক পঞ্চায়েতের দিকে। ভোটে জিতে পঞ্চায়েতের মেম্বার হতে পারলে অনেক কিছুর সুরাহা হয়। বলরাম তাই কিছুদিন ধরে পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্টের কাছ ঘেঁষবার চেষ্টা করছে। সে রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করে। রেডিও শুনে-শুনে! সে বুঝে গেছে যে রেডিওতে যা বলে, পঞ্চায়েত প্রেসিডেন্ট হারানবাবুর কাছে উলটো সুর গাইতে হয়। ও শালারা সব মিথ্যে কথা বলে, এ কথাটা হারানবাবুর মুখে প্রায়ই। শোনা যায়।

খানিকবাদে দামিনী এসে জিগ্যেস করল, তিনু কী করেছে?

বলরাম স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল শুধু একবার। সে কোনওরকম ব্যাখ্যা কিংবা কৈফিয়ৎ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। হারানবাবুর বাগানে আম পাড়তে গিয়ে ধরা পড়েছিল তিনু। সেখানে। প্রচণ্ড মার খেয়েছে। হারানবাবুর শখের কলমের গাছের আম। তিনি নিজে শাস্তি দিয়েছেন। তিনুকে। তাতে বলরামের কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু হারানবাবু জেনে গেছেন যে তিনু বলরামের বাড়িতে রাখালের কাজ করে।

এতে বলরামের ওপরেই তো সব দোষ পড়বে!

বলরাম বলল, সেটাকে পাওয়া গেল না? পালিয়েছে?

দামিনী বলল, এতক্ষণ তো ছিল না, এখন তো দেখলাম রান্নাঘরে বসে খাচ্ছে।

বলরাম সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। লুঙ্গির কষিতে শক্ত করে গিঁট বেঁধে ঘরের কোণ থেকে তুলে নিল একটা লাঠি। মজা দেখার জন্য শিবু আর গৌর আবার পড়া ছেড়ে ছুটল বাবার পেছনে।

বিধবা মেয়ে নীতার ওপরেই এখন রান্নাবান্নার ভার। রাত্তিরে সে তিনুকেই সবচেয়ে আগে খেতে দেয়। ওকে সব কিছুনা দিলেও চলে। সন্ধের পর থেকেই তিনুর পেট জ্বলে খিদেয়। নীতার কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করে রোজ। এক কাঁড়ি ভাতের সঙ্গে একটু ডাল ও তরকারি দিলেই চলে, তরকারি না হলেও ক্ষতি নেই, তিনু ডাল-ভাতই চেটেপুটে খেয়ে নেবে।

রান্নাঘরের বারান্দায় বসে কলাইকরা থালায় ভাতের অর্ধেকটা তখন সবে শেষ করেছে তিনু। বলরামকে সদলবলে আসতে দেখেই সে কেঁপে উঠল। ভয়ে আমসি হয়ে গেল মুখ, অবশ হয়ে গেল হাত।

বলরাম কাছে এসে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে বুঝিয়ে দিল নিজের মেজাজ। তারপর ধীরস্বরে বলল, খাওয়া শেষ কর!

দ্বিতীয়বার ধমকে তিনু আবার খাওয়া শুরু করল এবং চার্লি চ্যাপলিনের ভঙ্গিতে নিমেষের মধ্যে ভাত শেষ করে ফেলল।

বলরাম বলল, হাত ধুয়ে আয়!

উঠোনের এক কোণে বড়-বড় মাটির গামলায় তিনুই জল ভরে রাখে। চটপট আঁচিয়ে সে শরীর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিনে গলায় বলল, আর করব না। কোনওদিনও।

বলরাম লাঠি দিয়ে ঠিক এক ঘা মারল তার পিঠে। খুব জোরে নয়। তার নিজের হাতে শাস্তি দেওয়া দরকার, তাই সে মেরেছে। তারপর বলল, এই দণ্ডে দূর হয়ে যা! যা, বেরিয়ে যা! কোনওদিন আর এমুখো আসবি না!

গোয়ালঘরের মধ্যে থাকে তিনুর জামা-কাপড়ের একটা পুঁটলি। ঘরটা এতই ছোট যে তার ভেতরে দাঁড়াবার জায়গাও বিশেষ নেই। গরুটার নাম তিন্নি। এ নাম তিনুই রেখেছে। অনেকে বলে তিনু আর তিন্নি ভাই-বোন। শিবুরা বলে, তিনুটা আগের জন্মে গরু ছিল।

গোয়ালের মধ্যে ভনভন করছে মশা আর ডাঁশ। তিন্নি কান লটপট করে ডাঁশ তাড়াচ্ছে। তার মাথায় হাত দিয়ে তিনু ফিসফিস করে কী যেন বলতে গেল। দরজার কাছ থেকে বলরাম ধমক দিয়ে বলল, আদিখ্যেতা করতে হবে না। বেরিয়ে আয়!

পুঁটুলিটা বুকে চেপে বেরিয়ে আসতেই বলরাম লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে বলল, দূর হয়ে যা! আর কোনওদিন যেন তোর মুখ দেখতে না হয়! তিনু একবার শুধু শিবুর মুখের দিকে তাকাল। শিবুর কাছে সে দুটো টাকা পায়। কিন্তু সে কথা এখন উচ্চারণ করলে সে বলরামের হাতে তোমার খাবেই, পরে শিবুও তাকে মারবে।

বলরাম সকলের দিকে এমনভাবে চোখ ঘোরাল যে তাতেই বুঝিয়ে দিল, এই নিয়ে আর কোনও আলোচনার দরকার নেই।

মানুষের চরিত্র বোঝা বড় দুষ্কর। হারানবাবুকে খুশি করবার জন্য বলরাম তাড়িয়ে দিল তিনুকে, অথচ সেই হারানবাবুই দুদিন বাদে বললেন, ওহে বলরাম, তুমি নাকি তোমার বাড়ির রাখাল ছোঁড়াটাকে বিদেয় করে দিয়েছ? আরে, না, না! আমার গাছ থেকে সে দুটো আম ছিঁড়েছিল, সেজন্য আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। সে-ই তো যথেষ্ট! তুমি তাকে তাড়ালে, এখন সে খাবে কী? শুনলাম তো ছোঁড়াটার বাপ নেই, মামারা খেতে দেয় না। এদের আমরা যদি একটুআধটু না। দেখি, তা হলে আর কে দেখবে!

একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ছোটবেলায় আমরাও কি অন্যের গাছ থেকে ফল-পাকড় চুরি করিনি দু-একবার? আসলে জানো কী ভায়া, দুরন্ত ডানপিটে ছেলেদের আমি পছন্দই করি। সেদিন হঠাৎ মাথায় রাগ চড়ে গিয়েছিল, আমগুলো এখনও পাকেনি, এ বছরেই প্রথম ফল এসেছে…

সুতরাং আবার ফিরিয়ে আনতে হল তিনুকে। বাড়ি ফিরে বলরাম ব্যাজার মুখে বড় ছেলেকে বলল, যা, ছোঁড়াটাকে ডেকে নিয়ে আয়। শিবু মুচকি হাসল। আসল মজার ব্যাপারটা বাবা জানে না। কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলেও তিনু এই কদিন রোজই মাঠে গিয়ে তিন্নির কাছে বসে থেকেছে। শিবু মাঠে গিয়ে গরুটাকে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত। তিনু বিনে মাইনের, বিনে খোরাকির রাখালি করতেও রাজি। বলরামের ভয়ে সে এ-বাড়িতে আর ঢোকে না, কিন্তু সন্ধের আগে সে-ই তিন্নিকে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। তিন্নিকে ছেড়ে সে একদিনও থাকতে পারে না, ভাই-বোন যে!

খবর পেতেই তিনু তার পুঁটুলিটা বগলে নিয়ে লাফাতে-লাফাতে চলে এল। রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে বলল, ও নীতাদি, ভাত দাও, ভাত দাও!

যেন কিছুই হয়নি এই কটা দিন!

রাত্তিরবেলা শিবু একবার পেচ্ছাপ করতে বেরিয়ে এসে শুনতে পায়, তিনু গোয়ালঘরের মধ্যে বসে গরুটার সঙ্গে কী সব বকবক করে চলেছে।

অনেকেই জানে, তিনু মাঠে সারাদিন তার গরুর সঙ্গে কথা বলে। বাছুরটা মারা যাওয়ায় ইদানিং দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে তিন্নি, রোগাও হয়ে গেছে বেশ। বলরাম এক একবার গরুটা বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবে। তাতে অবশ্য দামিনীর খুবই আপত্তি। কিন্তু গরু পোশার খরচও তো কম নয়। শুধু ঘাস খাওয়ালে চলে না, তেমন ঘাসই বা কোথায়? রাখালের দু-বেলার খোরাকি আর পনেরো টাকা মাইনেও তো আছে। তিনু এখন তিন্নিকে অনেকটা দূরে নদীর ধার পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখানে কিছু বিন্নি ঘাস আছে। অন্যের জমি থেকে চুপিচুপি ছিঁড়ে আনে কচি ধান। তিন্নির মুখের কাছে এনে বলে, খা, খা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে!

তিন্নি মুখ দিয়ে ফ-র-র-র শব্দ করতেই তিনু তার গলকম্বলে আদর করতে-করতে বলে, ধানের মধ্যে দুধ আছে। খুব মিষ্টি না?

তিনু কখনও দূরে চলে গেলে গরুটা মুখ তুলে হাম্বা রব তোলে। সত্যিই যেন সে তিনুকে ডাকে। এক-এক সময় গাছের ছায়ায় গরুটার পাশে চিত হয়ে শুয়ে থাকে তিনু, গল্প শোনাতে-শোনাতে হঠাৎ-হঠাৎ জিগ্যেস করে, বুঝলি তো? গরুটা কান লটপটিয়ে জানিয়ে দেয়, বুঝেছি।

প্রতিদিনের জীবন থেকে অনেক গল্প খুঁজে পায় তিনু, কিন্তু শোনবার জন্য শুধু রয়েছে তিন্নি।

হারানবাবু একদিন মটোর সাইকেলে আসতে-আসতে নদীর ধারে থেমে গেলেন। সদ্য মটোর সাইকেল কিনেছেন তিনি! প্রায়ই এটা নিয়ে দাবড়ে বেড়ান। গোটা পঞ্চায়েত এলাকায় ঘুরতে তিনি যেন জমিদারি পরিদর্শনের সুখ পান। আগে ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের কেরানি, এখন সে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। পার্টি তাঁকে মদত দিচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এম এল এ হওয়ার আশা আছে।

পাকুড় গাছের নীচে বসে-বসে জাবর কাটছে একটা গরু আর তার পাশে আছে একটি কিশোর। ছেলেটিকে চিনতে পারলেন তিনি। তাঁর সাধের গাছের দুটো আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বলে খুবই রেগে গিয়েছিলেন সেদিন। বিশেষ করে কাঁচা আম ছিঁড়েছিল বলেই অত রাগ। কলমের গাছের প্রথম ফল, গোটা আষ্টেক মোটে ফলেছিল। মারতে-মারতে ছেলেটাকে তিনি মাটিতে শুইয়ে ফেলেছিলেন।

সেজন্য আজ হারানবাবুর অনুতাপ হল। ছেলেটার জন্য কিছু একটা করা দরকার। তিনি ডাকলন, এই, এদিকে শোন।

বছর সতেরো বয়েস। চেহারাটা মন্দ না। হারানবাবু তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দেখে বুঝলেন যে হাত পায়ের গড়ন ভালো, মুখেও একটু শ্ৰী আছে, ভালো করে খাওয়ালে-দাওয়ালে তরতরিয়ে জোয়ান হয়ে যাবে। পড়ন্ত চাষি পরিবারে রাখালের কাজ করে। এ দেশের ভবিষ্যৎ কী? এরপর বড় জোর খেত মজুর হবে! বাবা নেই, ওর মা থাকে মামাদের কাছে, তারও নাকি শরীরে কী অসুখ বাসা বেঁধেছে, কোনও কাজ করতে পারে না, সুতরাং মামারাই বা ওকে শুধু-শুধু খেতে পরতে দেবে কেন? আজকাল কেউ দেয়?

ছেলেটার জন্য কিছু একটা করা দরকার। হাত-পাগুলো আর একটু শক্ত হলে এ ছেলে একদিন লাঠি ধরতে পারবে। লাঠি ধরতে না শিখলে কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

তিনুর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে তিনি আবার মটোর সাইকেল হাঁকিয়ে রওনা দিলেন। বলরামকে ডেকে পাঠালেন পরের দিন।

প্রস্তাব শুনে বলরাম সঙ্গে-সঙ্গে রাজি।

হারানবাবুর মেয়ে-জামাই থাকে বর্ধমানে। জামাই সর্বক্ষণ রাজনীতি করে, রীতিমতন একজন পাণ্ডা। বিরোধীপক্ষের ছেলেরা তাকে একবার মারার চেষ্টা করেছিল। তাই সে সবসময় দলবল নিয়ে ঘোরে।

সেই মেয়ে-জামাইয়ের কাছে তিনুকে পাঠাতে চান হারানবাবু। আজকাল কাজের লোক পাওয়া খুব মুশকিল। গ্রাম থেকে একটা ছেলেকে পাঠাবার জন্য মেয়ে অনেকবার অনুরোধ জানিয়েছে বাবাকে। এ ছেলেটা বর্ধমানে গিয়ে কিছুদিন ফাই-ফরমাস খাটুক। তারপর আর একটু বয়েস বাড়লে জামাই ওকে বডিগার্ড করে নিতে পারবে! বর্ধমানে গেলে ওর রোজগার হবে অনেক বেশি, অসুস্থ মায়ের জন্য টাকা পাঠাতে পারবে নিয়মিত, নিজেরও একটা সুরাহা হবে। শুধু-শুধু এখানে রাখালি করে মরতে যাবে কেন?

হারানবাবু এ প্রস্তাবটা শোনালেন আরও পাঁচজনের সামনে। প্রত্যেকেই বলল, ওই রাখাল ছোঁড়ার জন্য এমন ভালো ব্যবস্থা আর হতে পারে না। হারানবাবুর দয়াতেই ছেলেটার একটা হিল্লে হবে।

বলরাম বলল, আমিও গরুটাকে বেচে দেওয়ার কথাই ভাবছিলাম। তখন আর ওকে রাখতামই বা কী করে?

মার খেয়েও কক্ষনও কাঁদে না তিনু। কিন্তু এবার সে বলরামের পা জড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। বলরামের কাছ থেকে সে দামিনীর পায়ে মাথা কোটে। দামিনীর মনটা একটু নরম, অভাবের সংসারে নিজেদের যেমন চলে যাচ্ছে, কোনওক্রমে, এ ছেলেটারও একটা পেট চলে যেত। গরু দেখা ছাড়াও আরও অনেক কাজ করে। এরপর তিন্নিকে দেখবে কে?

বলরাম অনড়। হারানবাবুকে সে খুশি করতে চায় তো বটেই, তা ছাড়াও আর গরু পোষার দম তার নেই। পঞ্চায়েতে ঢুকতে পারলে যদি কিছু অবস্থা ফেরে, তখন না হয় আবার গরু কেনা যাবে!

দামিনী বলল, ছেলেটা তিন্নিকে বড় ভালোবাসে!

বলরাম ধমক দিয়ে বলল, ন্যাকামি কোরো না! মানুষের ভালোবাসারই এখন কোনো দাম নেই তো গরু!

পালিয়ে গিয়েও নিষ্কৃতি পেল না তিনু। হারনবাবুর প্রচুর লোকবল, তারা বেড়াজালের মতন ঘিরে তিনুকে হেঁকে তুলল। তিনুকে যেতেই হবে।

তিনু দুঃখের কথা আর কাকেই বা বলবে, তিন্নিকে ছাড়া? তার মা, তার মামারা, এ বাড়ির লোকেরা সবাই চায় সে কোন অচেনা দূর জায়গায় চলে যাক। সে এখানে বেশ ছিল, তার তো কোনও অভাব ছিল না! সে আর কারুর বাগান থেকে ফলও চুরি করেনি, তবু কেন তার এই শাস্তি!

গভীর রাতে গোয়ালঘরে ঢুকে তিন্নির গায়ে হাত বুলোতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগল ওরে তিন্নি, আমি চলে যাচ্ছি! তুই একা থাকতে পারবি?

আজ আর তিন্নি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে না, কানও লটপট করছে না। মুখ ফিরিয়ে তাকালও না একবার। একটু বাদে তিনু খেয়াল করল যে তিন্নি তার কথা শুনছে না, ঘুমিয়ে পড়েছে!

পরদিন সকালে শিবু মাঠে নিয়ে গেল তিন্নিকে, তিন্নি একটুও আপত্তি করল না। তা হলে সে কি কিছুই বুঝতে পারছেনা। তিনু তার পিছু পিছু গেল খানিকটা, শিবু তাড়া দিয়ে বলল, এই, তুই আসছিস যে! তোকে তৈরি হতে হবে না?

সকাল নটার মধ্যে হারানবাবুর ভাই সনাতন এসে হাজির হল। সে তিনুকে পৌঁছে দেবে বর্ধমান। এখান থেকে মাইলতিনেক হাঁটা পথ, তারপর বাস রাস্তা। হারানবাবু এক সেট জামা-প্যান্ট পাঠিয়েছেন ওর জন্য।

গ্রামের প্রান্ত ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে তিনু আর বারবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছে। তিন্নি কি কিছুই বলল না। এতদিন ধরে সে এত গল্প বলছে, তাও শোনেনি? এর আগে তিন্নি কতবার তাকে ডেকেছে, তার গায়ে মাথা ঘষে আদর করেছে।

একটু পরে তিন্নির নিশ্চয়ই খেয়াল হবে। তার বদলে শিবু। তিনুকে ছেড়ে তিন্নি একদিনও থাকেনি।

হঠাৎ মনে পড়ল, তিন্নি ছুটে আসছে তার দিকে। দূরের রাস্তায় ধুলো উড়ছে। তার মধ্যে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে কে? আসছে, আসছে, তিন্নিই আসছে তার জন্য।

তিনু দাঁড়িয়ে পড়তেই সনাতন তার হাত চেপে ধরল। জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তিনু চেঁচিয়ে উঠল, তিন্নি!

ধুলোর ঝড়ের মধ্যে বিরাট আওয়াজ তুলে ছুটে এল একটা লরি। তার ওপরে গাদাগাদি করা দশ-বারোটা গরু বাঁধা। ওদের মধ্যে তিন্নি আছে কি না তা চেনবার আগেই লরিটা তিনুকে। ছাড়িয়ে পার হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *