ছাব্বিশটি কান ও বধির বিচারক
আমি হরি ঘোষ স্ট্রিট পেরিয়ে সদ্য বিডন স্ট্রিটে এসে দাঁড়িয়েছি। একটা লাল ডবল ডেকার—
আমাকে আগে রাস্তা পার হতে দেবে অথবা নিজেই আগে পার হবে, এইরকম দ্বিধাময় গতিতে আসছে। আমিও রাস্তা পার হওয়ার আগে একটা সিগারেট ধরানো মনস্থ করে ফেলেছি, কিন্তু তখনও বিকেল, সন্ধে নামার কোনও লক্ষণই নেই—অথচ ডবল ডেকারের হেড লাইট দুটো জ্বলছে—এতেই আমি খুব বিরক্তি বোধ করি এবং ডবল ডেকারটিকে অপমান করার জন্যই প্রায় তার নাকের সামনে দিয়ে হেঁটে রাস্তার ওপারে চলে যাই।
ঠিক সেই সময়, এইমাত্র পরিত্যক্ত রাস্তার ওপার থেকেই একটা লোক আমাকে চেঁচিয়ে ডাকল, সুনীলবাবু, সুনীলবাবু, আপনার টেলিফোন।
খুব ছেলেবেলার সংস্কার, পথে ঘাটে কেউ আমার নাম ধরে অন্তত তিনবার না ডাকলে সাড়া দিই না। কারণ, আমার নামটা খুব সাধারণ, কলকাতা শহরের প্রতি পঁচিশজন যুবকের মধ্যেই একজন সুনীল—একবার একটা ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যানের নাম ছিল সুনীল, সুনীল দে মজুমদার—আমার নাম শুনেই তিন অসীম বিরক্তি ও ঘৃণায় চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন বলাই বাহুল্য সেখানে আমার চাকরি হয়নি, পরিবর্তে আমিও, ছোটমামার বাড়িতে নতুন চাকরের নাম যেই শুনলাম সুনীল, বেশ শক্ত সমর্থ—প্রায় নীলবর্ণের এক ছোঁড়া, আমিও ছোটমামাকে। বলেছিলাম, একটু হাসতে-হাসতেই, ও-নামের চাকর তোমাদের বাড়িতে থাকলে আমি আর আসছি না এখানে, হয় ওকে ছাড়িয়ে দাও, নইলে নাম বদলাও।
যাই হোক, মুখ ফিরিয়ে আমি অপেক্ষায় রইলাম। অন্য লোককে ডাকছে, আমি সাড়া দিয়ে বহুবার ভুল করেছি জীবনে। ওপারের লোকটি আমার অচেনা, ধুতির ওপর শার্ট পরে আছে, সোজাসুজি আমারই দিকে পুনশ্চ ব্যস্তভাবে বলল, সুনীলবাবু, আপনাকে টেলিফোনে ডাকছে। লোকটি ডানহাত মুঠো করে কানের কাছে নিয়ে টেলিফোন ধরার একটা ভঙ্গিও করল।
টেবিলের ওপর শোওয়ানো টেলিফোনের মধ্যে সবসময় ব্যস্ততা, প্রতিটি মুহূর্ত প্রতীক্ষায় দীর্ঘ– সুতরাং আমি বিচলিত দ্রুততায়—তখন রাস্তা ফাঁকা, এপারে এসে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায়? লোকটি বলল, এই যে, এই চায়ের দোকানে!
এ-দোকানে আমি কোনওদিন চা খাইনি। বস্তুত গত পাঁচ-ছবছরের মধ্যে কোনও দোকানেই চা খেতে ঢুকিনি। কিন্তু দোকানটায় পা দিতেই যে-কোনও ছোট চায়ের দোকানের পরিচিত আঁশটে ডিম-ডিম গন্ধ নাকে এল। এই গন্ধটা ভুলিনি। রেলিং ঘেরা উঁচু কাউন্টারে মালিক বসে আছে। মালিকের মুখটি অপরিচিত নয়, কিন্তু কোথায় দেখেছি, কি নাম—কিছুই মনে নেই। কাঠের বাক্সের মধ্যে সযত্নে টেলিফোনটা রাখা, ডায়ালের সঙ্গে ছোট্ট একটা তালা লাগানো—অর্থাৎ বাইরে থেকে ডাক আসতে পারে কিন্তু এখান থেকে কারুকে ডাকতে হলে মালিকের পৈতের সঙ্গে বাঁধা চাবি ছাড়া গতি নেই। রিসিভারটা আপাতত কাউন্টারে শোওয়ানো—মালিক আমার দিকে স্মিত হেসে বললেন, নিন স্যার, আপনার–
সেই মুহূর্তে আমার অতি স্বাভাবিক ব্যাপারটা খেয়াল হল। আমার টেলিফোন ডাক হতেই পারে না। এই চায়ের দোকানে আমি কোনওদিন পা দিইনি, এখানে এসময় আমার থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সুতরাং এখানে আমাকে কে ডাকবে? তা ছাড়া বিকেল ঠিক পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটে আমি এই চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে বিডন স্ট্রিট পার হব—একথা তো কারুর জানার কথা নয়। আমি নিজেও তো জানতাম না—আমি হরি ঘোষ স্ট্রিট দিয়ে এসে নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটেও বেঁকতে পারতুম, বিডন স্ট্রিটে না এলে আমার কোনও ক্ষতি ছিল না—তাহলে?
আমি মালিককে বিস্মিত অবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, আমার? না, না, আমার কী করে হবে?
মালিক সেই যে প্রথম আমাকে দেখে স্মিত হেসেছিলেন, সেই হাসি এখনও ঠোঁট থেকে মোছেনি, নতুন করে তাঁকে হাসতে হল না—এমনকি হাসির বদলে অন্য কোনও অভিব্যক্তি ফোঁটাবার পরিশ্রমটুকুও না করে তিনি বললেন, হ্যাঁ, মশাই, আপনার নাম করেই তো ডাকতে বলল। আপনি দমদমেই আছেন? আচ্ছা, আপনি আগে টেলিফোনটা সেরে নিন, তারপর কথা হবে।
লোকটা আমাকে চেনে ঠিকই, আমি ওর নাম মনে করতে পারছিনা যদিও। যদিও অবিশ্বাস আমার কাটেনি, তবু পড়ে থাকা টেলিফোনের মধ্যে সেই যে এক ব্যস্ততা, প্রতিটি মুহূর্ত প্রতীক্ষায় দীর্ঘ—আমি খপ করে রিসিভারটা তুলে নিলাম।
-হ্যালো?
—আমার একটুও সময় নেই। তুমি এক্ষুনি চলে এসো।
ইয়ার্কি কিংবা মস্করা ভাবা যেতে পারত। কেন না, একটি বাক্যের পরই কড়-ডু-ডু শব্দ, লাইন ছেড়ে দিয়েছে। বহুদূর থেকে, খুব আলতো গলা, কেউ একজন আমাকে ওই কথাটা শুধু বলে রেখে দিয়েছে টেলিফোন। রিসিভার হাতে রেখে আমি সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। পাঁচটা টেবিলের মধ্যে দুটো টেবিল ফাঁকা, একটাতে চার-পাঁচজন ছোকরা ধোঁয়া ওড়াচ্ছে, আর। একটাতে সেই একই রকম চেহারার আরও তিনজন যুবা, আর একটায়, আমার সবচেয়ে কাছের টেবিলে দুজন বয়স্ক পুরুষ মুখোমুখি স্থির হয়ে বসে আছে, একটিও কথা বলছে না, তাদের টেবিলের ওপরেও কিছুই নেই। কটা কান? এগারো দু-গুণে বাইশ, মালিকের দুই, চব্বিশ কয়েকটিকে অন্যমনস্ক বলে বাদ দিলেও পনেরো মোলোটা অনায়াসেই ধরা যায়।
বিনা প্রস্তুতিতে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। অদ্ভুত ধরনের একটা দুঃখ বোধ করলুম। কার সময় নেই? কোথায় আমি এক্ষুণি চলে আসব? কিংবা আমিই কি? আমাকেই কি ডেকেছে? শুধু হ্যালো শুনেই আমার কণ্ঠস্বর চিনেছে? আমি চিনতে পারিনি। বহুদূর থেকে ভেসে আসা আলতো গলার স্বর, একটু ব্যাকুল ঠিকই, কিন্তু আর একটা কথাও কি বলা যেত না? কে? কোথায়?
চব্বিশটা উৎকর্ণ কান ও কয়েকটা ফোলানোনাকের আঁচ আমি আমার পিঠে টের পেলুম। দুঃখের বদলে রাগের সময়ই আমার বুদ্ধি খোলে। কিন্তু ঠিক রাগ করতে পারছিনা। উদাসীনভাবে আমি হেঁটে যাচ্ছিলুম, তবু কে আমাকে হঠাৎ ডেকে এমন দুঃখ দিল! কে? কে? কে? কে? বারবার এই প্রশ্ন করে আমার রাগ ক্রমশ সঞ্চারিত হতে লাগল, তখন, বেশি সময় না—মাত্র কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করেই আমি খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ফেললুম। এমন হতে পারে, এই রাস্তারই কোনও বাড়ি থেকে কেউ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, তাই চিৎকার করে না ডেকে টেলিফোনের সাহায্যে ডেকেছে। কিন্তু কে? বিডন স্ট্রিটের একজনকেও আমি চিনি না না, কোনওদিন এ-রাস্তায় কোনও বাড়িতে আমি ঢুকিনি, আমার স্পষ্ট মনে আছে। তবু কে আমাকে ডাকল? যদি ডাকলই, কেন তার সময় নেই?
রিসিভারটা হাতে ধরাই ছিল, সেটার সামনে মুখ নিয়ে বললুম, দাঁড়াও, একটু ধরো, এক সেকেন্ড।—সেটায় হাত চাপা দিয়ে আমি মালিকের দিকে ফিরে বললুম, আশ্চর্য তো, আপনি মশাই কী করে বুঝতে পারলেন, আমারই ফোন। আমি এসময়…
এর মধ্যে আর একজনও খদ্দের ঢোকেনি বা বেরোয়নি, মালিক তবু বাক্সের পয়সা গুনছিলেন। মুখ তুলে বললেন, আশ্চর্যই বটে! আপনি এ-দোকানে কোনওদিন আসেন না—তবু আপনাকেই ডাকল যখন–
—কে ডাকল?
—প্রথমে একজন জিগ্যেস করল, বোধহয় অপারেটর, এটা কি থ্রি ফাইভ টু জিরো সেভেন? আমি যেই বললুম, তারপর একজন মেয়েছেলে বলল, আপনার ওখানে সুনীল গাঙ্গুলী বলে একজন। বসে আছেন, তাকে ডেকে দিন দয়া করে! আমি বললুম, সেরকম তো কেউ নেই—তখন। মেয়েছেলেটি বলল, তাহলে কি এসে চলে গেছে? লম্বা রোগা মতন, জুলপিতে কটা পাকা চুল, কপালে কাটা দাগ—হাঁপাচ্ছিল মশাই মেয়েছেলেটি—আমি তো তখন আপনাকে দেখতে। পেয়েছি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছেন—ভাবলুম বুঝি আপনার এখানে আসবার কথা ছিল আজ–আপনার কাকার সঙ্গে সেই সেবার দেওঘরে…
—খুব উপকার করেছেন। খুব জরুরি কল—আমি এখানেই…রিসিভারের কাছে আবার মুখ নিয়ে এলাম। কানে তখনও অনবরত কড় কড়-ডু-ডু বাজছে, ক্রমাগত সেই একঘেঁয়ে সেই অর্থহীন। শব্দ, ক্রমশ আরও দুর্বোধ্যতার দিকে নিয়ে যায় আমাকে। ক্রোধ থেকে ফের দুঃখে ফিরে আসি আমি। তোমার সময় নেই? আমার অফুরন্ত সময়।
প্রভূত আবেগের সঙ্গে আমি টেলিফোনকে বলি, তুমি এখন কেমন আছ? তুমি ভালো আছ?
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—আমি? আমি খুবই ভালো আছি। না, সেসব কিছুই আমার সেরে গেছে। না, না, ব্যস্ত নই, অ্যাঁ? কী বলছ? জোরে বলো!
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। আমি থানায় ধরা পড়েছিলুম। দোষ আমার নয়, না, আমি কোনও দোষ করিনি, আমি সেই লোকটাকে মেরেছিলুম, আমি তার চোখ অন্ধ করে দিতে চেয়েছিলুম, কিন্তু অন্যায় করিনি। বিচারক আমাকে নিদোষ বলে মুক্তি দিয়েছিলেন। না, না, আমি কোনও মুরুব্বিকে ধরে সুপারিশ করাইনি, সত্যি বিশ্বাস করো।
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—মাতাল ছিলাম? হ্যাঁ, অস্বীকার করব না, পেঁচি মাতালদের মতন সামান্য একটু খেয়েই আমার পা টলছিল, কিন্তু মাথা পরিষ্কার ছিল ছেলেটি ট্যাক্সির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমাকে। বলেছিল বাস্টার্ড—কিন্তু সেজন্য আমি তাকে মারিনি—গালাগালি আমার গায়ে লাগে না কিন্তু যে চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল, হিংস্র, ঘৃণিত চোখ—আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওই চোখ পৃথিবীকে দেখার যোগ্য নয়—আমি ওকে…
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—ওর সঙ্গে কী করে দেখা হল?
আমি ট্যাক্সি খুঁজছিলাম, একটাও ট্যাক্সি ছিল না—বৃষ্টি পড়ছিল, আমি ট্যাক্সি থামিয়ে হাত জোড় করে বলেছিলাম—আমি একটা লিফট চেয়েছিলাম—এমনকি পুরো ভাড়া দিতেও রাজি ছিলাম, কিন্তু সে আমায় চিনতে পারে সে বলে, আপনি? বরানগরে মনীষাদের বাড়িতে
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—না, মনীষাদের বাড়িতে আমি ওকে কখনও দেখিনি। মনীষাদের বাড়িতে আমি মনীষা ছাড়া আর কারুকেই কোনওদিন তাকিয়ে দেখিনি কী বলছ? আমি মনীষাকে অপমান করেছি? তাকে আমি খুন করিনি—এই তার পরম সৌভাগ্য, আমার সঙ্গে মনীষা একদিন ট্যাক্সি করে যাচ্ছিল,। ভিক্টোরিয়ার সামনে গাড়ি থামিয়ে আমরা কোকোকোলা খাচ্ছিলাম, একটা ভিখিরি মেয়ে ভেতরে হাত বাড়িয়ে ছিল, দরজা বন্ধ করার সময় তার হাত চিপটে যায়, না, না, মনীষা নয়, আমিই। দরজাটা বন্ধ করেছিলাম মেয়েটার পুরো হাতটাই ঘেঁচে গিয়েছিল—গোলমাল হতেই ট্যাক্সি। ছেড়ে দেয়, লোকজন চেঁচায়, আমাদের ট্যাক্সি পালিয়ে গিয়েছিল, একটু দূরে যেতেই আমি ভুল বুঝতে পারি, আমি ফিরে যাওয়ার কথা বলতে মনীষা বলেছিল, বেশি-বেশি ন্যাকামি করো না! হঠাৎ মনে হয়েছিল, আমি ন্যাকামিই করছি হাতটা ছেচে গেছে, নুলো হয়ে গেলে মেয়েটা। ভিক্ষে আরও বেশি পাবে।
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—অ্যাঁ?
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—হ্যাঁ বলেছিলাম। মনীষাকে বলেছিলাম, তোমাকে খুন করলেও তোমার কঙ্কালটা মেডিক্যাল কলেজের ছেলেরা দুশো টাকায় কিনে নেবে। তুমি এতই দামি!…কিন্তু ট্যাক্সির সেই ছেলেটাকে আমি কিছুই বলিনি, তার কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করেছিলাম—মানুষের কাছে মানুষ যেভাবে দয়া চায়, কিন্তু সে আমাকে ধাক্কা মেরে বলেছিল, বাস্টার্ড, তাও কিছু না, কিন্তু চোখ— ওই চোখ পৃথিবীকে দেখার যোগ্য নয়—ওইসব দৃষ্টির জন্যই তো পৃথিবী প্রতিদিন অপবিত্র হচ্ছে–বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কুঁকড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, দয়া করে একটু জায়গা দিন— আমরা তো একই দিকে যাচ্ছি—তবু শোনেনি, আমি তখন তার চোখ উপড়ে নেওয়ার জন্য আঙুল বাড়িয়েছিলাম।
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—না, আমি অনুতাপ করব না। আমি যা করেছি, আবার ওইরকম করব! থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমি হেড কনস্টেবলের গায় বমি করেছিলাম, আমাকে ওরা মাটিতে ফেলে বুটজুতোসুদ্ধ পায়ে লাথি মারে—একজন পাশে দাঁড়িয়ে হাসছিল, এক গেলাস অর্ধেকটা খেয়ে সেই এঁটো জলের বাকি অর্ধেকটা ছুড়ে দিয়েছিল আমার মুখে, আমি চিৎকার করেছিলাম, বেশ করেছি, আমি আবার ওকে মারব, আবার মদ খাব, আবার আমি ট্রাম-বাস জ্বালাব, আবার আমি পুলিশের গাড়িতে বোমা ফেলব, বেশ করব, বেশ করব!
–কড়-ড়-ড়-ড়-ড়…
—জানি, তুমি আমার জন্য চিন্তা করবে না। তোমার সময় নেই। তুমি খুব ব্যস্ত। ঠিক আছে— তোমার কথামতন আর এ-রাস্তা দিয়ে হাঁটব না, কিন্তু দিনের বেলা যদি ডবল ডেকার তার হেড লাইট জ্বালে—আমি আগে রাস্তা পার হবই—হ্যাঁ, ফের আমি বৃষ্টির দিনে জোর করে ট্যাক্সি থামাব, অপবিত্র চোখ দেখলে…দূর ছাই কেটে গেল? হ্যালো, হ্যালো
দোকানের মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি জিগ্যেস করলুম, পয়সা লাগবে? লোকটি কথা না বলে নঞর্থক ঘাড় নাড়ল। আমি বললুম, আপনাকে আমারও চেনা-চেনা লাগছে, কিন্তু আমার কোনও কাকা নেই। দেওঘরে আমরা কোনওদিন যাইনি। আপনি আমাকে কী করে চিনলেন বলুন তো!
লোকটির উত্তর না শুনেই আমি বেরিয়ে এলুম। এ-রাস্তায় অনেক বাড়ির দরজা বন্ধ, জানলা খোলা, জানলা বন্ধ, দরজা খোলা। কোথাও কোনও চোখ আমাকে লক্ষ্য করল না। আমি যতক্ষণ টেলিফোনে কথা বলছিলুম, ততক্ষণ রেস্তোরাঁর সবকটি লোক চুপ করেছিল, চব্বিশটি কান উত্তর্ণ! এবারে, আমি চলে আসার পর সবাই আবার এক সঙ্গে কথা বলবে, সবাই মতামত জানাবে। আসলে ওর বিশ্রী চায়ের স্বাদ নিতে-নিতে, একটা গোলোক ধাঁধায় ঘুরপাক খাবে। ঘুরুক! কে আমায় টেলিফোনে ডেকেছিল তা আমি জানতে চাই না, আমার কিছু আসে যায় না! আমি কোথায় যাচ্ছিলাম ভুলে গেছি, এবার কোনদিকে যাব—তাই ভাবতে লাগলুম। যে কোনও দিকেই যাওয়া যায়, বিডন স্ট্রিট ধরে সোজা অথবা ডানদিকে। দিক ও মন স্থির করার জন্য আমি পকেট থেকে একটা আধুলি বার করে টস করতে চাইলাম। অশোকস্তম্ভ সোজা, গমের শীষ–ডানদিকে।
আধুলিটায় টুসকি দিয়ে শূন্যে ছুড়ে কিন্তু সেটাকে ফের হাতের তালুতে ফিরিয়ে আনতে পারলুম। হাত ফসকে সেটা পড়ে গড়িয়ে নর্দমার দিকে যেতেই আমি অতি ব্যস্ত হয়ে সেটাকে ধরার
জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।