সেরেঙ্গেটি

সেরেঙ্গেটি

কাল রাতে গোরোং গোরোর গেম ওয়ার্ডেনের শিকার করা ওয়াইল্ড বিস্টের স্টেক খেয়েছিলাম৷ আমাদের দেশের শম্বরের মাংসের মতোই খেতে অনেকটা৷ সকালের আলো ফুটতেই আমার কটেজের কাচের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গোরোং গোরো আগ্নেয়গিরির নিবে-যাওয়া বহু বর্গ মাইল জোড়া গহ্বরের উপর নীল কুয়াশা জমেছে৷ সেই গহ্বরের মধ্যে যে কত জীবজন্তু ও পাখি আছে, তা কী বলব৷

ড্রাইভার-কাম-গাইড টেডি ঘরে এসে আমাকে তাড়া দিয়ে গেল! তার আগেই চান করে চা খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম৷ তারপর আমরা দুজনেই ডাইনিং রুমে গিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম৷ মেরুন-রঙা ভোকসওয়াগেন ট্রাভলার৷ টেডির নিজের গায়েও মেরুন-রঙা গ্যাবার্ডিনের পোশাক৷ ও চালাচ্ছে৷ পাশে বসে আছি আমি৷ জানালায় কাচ তুলে৷ রীতিমতো ঠান্ডা এখন পূর্ব আফ্রিকায়৷ জুলাই-আগস্ট শীতকাল এখানে৷ তা ছাড়া এ জায়গাটা তো বেশ উঁচুও৷

পথের পাশে-পাশে মাসাইরা দাঁড়িয়ে আছে হাতে বল্লম নিয়ে, লাল-রঙা পোশাক পরে৷ ডোরাকাটা জংলি জেব্রা ও ওয়াইল্ড বিস্টের দলের সঙ্গে ওদের গরু-মোষ চরছে নরম রোদের ছোঁয়া-লাগা শিশির-ভেজা, ফড়িং-সবুজ-পাহাড়তলিতে৷

দারুণ লম্বা হয় এই মাসাইরা৷ কানে ইয়াব্বড় বড় ফুটো—তা থেকে নানারকম গয়না ঝুলছে৷ হলুদ-লাল রং দিয়ে গালে-মুখে নানারকম কারিকুরি করেছে৷

আমি জানালা দিয়ে হাত তুলে বললাম, ‘‘জাম্বো!’’

ওরা বল্লম তুলে বলল, ‘‘জাম্বো!’’

জাম্বো একটি সোয়াহিলি কথা৷ জাম্বো মানে কী বলো তো?

জাম্বো মানে হচ্ছে ‘হ্যালো’৷ অথবা, আজকালকার ‘হাই’!

এই মাসাইরা এক অদ্ভুত জাত৷ জানো তো, এরা কখনও জল খায় না৷ জলের বদলে জানোয়ারের রক্ত এবং দুধ খায়৷ বল্লম দিয়ে সিংহ শিকার করে এরা৷ খোলা আকাশের নীচে যুবক মাসাইরা সিংহ ও চিতার আস্তানায় ওদের গরু-ছাগল-মোষ চরিয়ে বেড়িয়ে দিন-রাত কাটিয়ে দেয়৷ ওরা চাষ-বাস করে না৷ ওদের ধারণা মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করলে প্রকৃতিকে অসম্মান করা হয়৷ প্রকৃতি-মা যা দিয়েছেন তাই নিয়েই ওরা খুশি থাকে৷ এরা এক দারুণ জাত৷ যেমন চেহারায়, তেমনই স্বভাবে৷

আস্তে-আস্তে গাছ-গাছালি কমে আসতে লাগল৷ আমরা পাহাড়ি এলাকা থেকে সমতলে নেমে আসতে লাগলাম৷ ঘণ্টা দুয়েক গাড়ি চলার পর একটা উঁচু জায়গায় এসে পৌঁছলাম আমরা৷ জায়গাটার নাম নাবি৷ এখানে একটা গেট আছে—তার নাম নাবি গেট৷ এই গেট পেরিয়েই ‘সেরেঙ্গেটি ন্যাশানাল পার্কে’ ঢুকতে হয়৷ জায়গাটা টিলার মতো৷ এখানকার টিলাগুলো আমাদের টিলার মতো নয়৷ মনে হয়, চতুর্দিকের সমতলের মধ্যে কেউ যেন বড়-বড় বিভিন্নাকৃতি কালো পাথর এনে সাজিয়ে টিলাগুলো তৈরি করেছে৷

ওরা সোয়াহিলিতে বলে কোপি, ইংরেজি বানান ‘KOPJES’৷ নাবি গেটের চারপাশে অনেকগুলো অ্যাকাসিয়া গাছ৷ আমাদের বাবলা এবং কৃষ্ণচূড়া মেলালে যেমন হয়, অনেকটা তেমন৷ ফুল ধরেছে থোকা-থোকা লাল-লাল, ঝোপে-ঝাড়ে৷ একদল নীল-সাদা-বাদামিতে মেশা স্টার্লিং পাখি কিচিরমিচির করে মাথা গরম করে দিচ্ছে৷ এই নির্জন, উদার উন্মুক্ত প্রকৃতিতে ওদের মিষ্টি, চিকন গলার স্বর ছড়িয়ে যাচ্ছে দূর-দূরান্তরে৷

টেডি থার্মোফ্লাস্ক খুলে আমাকে একটু কফি ঢেলে দিল৷

আমি বললাম, ‘‘আশান্তে৷’’ মানে ধন্যবাদ৷

টেডি কাঁধ শ্রাগ করে বলল, ‘‘কারি-বু৷’’ মানে, স্বাগতম৷

আমি কফি খাওয়ার সময় টেডি গেটের কাজ সারল৷ টাকা দিল, রসিদ নিল, রেজিস্টারে নামধাম লিখল৷ তারপর আমাকে ডাকল নাম সই করার জন্যে৷

গেটের কর্মচারীটি খুব হাসিখুশি৷ মোটামুটি ইংরেজি বলেন৷ সবচেয়ে বড় কথা আমাকে ওঁদের দেশে সাদরে আপ্যায়ন করলেন৷

তারপর ভোকসওয়াগেনের এঞ্জিন ঝমঝম করে জেগে উঠল৷ এই গাড়িগুলোর এঞ্জিন পেছন দিকে থাকে, তোমরা অনেকেই জানো৷

নাবি গেট পেরিয়ে কিছুটা সোজা এসেই পথটা নীচে নেমে গেছে৷

আমি একটু থামতে বললাম টেডিকে৷

গাড়িটা থামতেই হঠাৎ সামনে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম৷ তোমরা যারা সমুদ্র দেখেছ তারা প্রথমবার সমুদ্র দেখে যেমন স্তব্ধ হয়েছিলে, ঠিক তেমনই স্তব্ধ এবং অবাক৷ সামনে একটা প্রকাণ্ড, আদিগন্ত শীতের লালচে-হলুদ ঘাসে ভরা মাঠ৷ প্রকাণ্ড মাঠ বলতে তোমরা বা আমিও এতদিন যা বুঝতাম, তার সঙ্গে এই মাঠের বিস্তৃতির কোনো তুলনাই হয় না৷ শুধু চোখেই নয়, মানুষের কল্পনাও যতদূর যেতে পারে, ততদূর সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে সেই লালচে-হলুদ মাঠ গিয়ে মিশেছে নীল আকাশে৷ আকাশটাই মাঠ না মাঠটাই আকাশ বুঝতে ভুল হয়ে যায়৷ স্থলের বিস্তৃতি কথাটা সম্বন্ধে আমার যা ধারণা ছিল এতদিন, মানে যাকে সংজ্ঞা বলা হয়, তা পুরোপুরিই বদলে গেল পূর্ব আফ্রিকার এই সেরেঙ্গেটির দ্বারে দাঁড়িয়ে, আজ রোদ-ঝলমল সকালবেলায় লাল-মখমল মাঠের দিকে চেয়ে৷ এই-ই সাভানা৷ ছোটবেলায় ভূগোলের পাতায় পড়েছিলাম এর বর্ণনা৷ তোমরাও নিশ্চয়ই পড়েছ৷

টেডি এঞ্জিন আবার স্টার্ট করতেই গাড়িটা নেমে এল সেরেঙ্গেটির ভিতরে৷ সেরেঙ্গেটি আসলে একটা মাসাই শব্দ ‘সিরিঙ্গেট’ থেকে এসেছে৷ সিরিঙ্গেট মানে হচ্ছে বিস্তৃত প্রান্তর৷ ইংরেজি ভাষায় এর উচ্চারণ করতে গিয়ে ইংরেজি-ভাষাভাষী লোকেরা ‘i’গুলোকে বদলে ‘e’ করে দিয়েছিলেন৷ তারপরে সোয়াহিলি ভাষার জবরদস্ত ‘i’ লেগেছে শেষে৷ তাই আজকার SERENGETI৷

এখন গাড়ি চলেছে ঘাসের সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে৷ আমি জানি, একটু পরে আমার পিছনে নাবি গেটের ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া অ্যাকাসিয়া গাছগুলোকেও আর দেখা যাবে না৷ তখন সমুদ্রেরই মতো মনে হবে চতুর্দিক৷ পথ ভুলে যাবে তুমি৷ মানুষ নেই, বাড়ি নেই, খেত নেই, গাছ নেই, কিছুই নেই—শুধু ঘাস আর রোদ আর আকাশ আর একটা সিঁথির মতো দিগন্তে মেশা কাঁচা পথ৷ আর সেই পথের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া গুবরে পোকার ধুলোর মেঘ উড়ানো একটা মেরুন-রঙা গাড়ি৷ সেই গাড়ির ভিতরে দুজন নীরব মানুষ, যেন ভুল করে কোনো অভিশপ্ত অথবা আশিস-স্নিগ্ধ রাজ্যে এসে পড়েছে৷

সেরেঙ্গেটির ম্যাপটা খুলে কোলের ওপর রাখলাম৷ এখন আমরা উত্তর-পশ্চিমমুখো চলেছি৷ ঐ দেখা যাচ্ছে ম্যাপে, লেক ভিকটোরিয়ার পাশে মোয়াঞ্জা৷ তোমরা নিশ্চয়ই বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়েছ৷ না পড়ে থাকলে, নিশ্চয়ই পড়বে৷ চাঁদের পাহাড়ের শংকর এই মোয়াঞ্জা থেকেই চলে গেছিল রুয়েঞ্জোরি পর্বতমালার চাঁদের পাহাড়ে৷ সত্যিই কিন্তু ঐ পর্বতমালায় একটি চুড়ো আছে—যার নাম ‘মাউন্টেন অব দ্য মুন’৷

ম্যাপটা দেখতে-দেখতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার৷ এবারে হবে না৷ আরেকবার যখন আসব তখন রুয়েঞ্জোরিতে যাব—তোমাদেরই জন্যে৷ তোমরা যা দেখোনি বা দেখবে না তা তোমাদের হয়ে দেখে আসার জন্যে৷

টেডি বলল, ‘‘ফিলিং বোরড?’’

বললাম, ‘‘নট অ্যাট অল৷’’

ও বলল, ‘‘একটু পরেই জানোয়ারের খেলা দেখবে৷ জানোয়ার দেখে-দেখে তখন ঘেন্না হয়ে যাবে তোমার৷ এখানে এখন সব মিলিয়ে পনেরো লক্ষ জীবজন্তু আছে৷’’

আমি বললাম, ‘‘আমার মানুষ দেখে-দেখেই ঘেন্না হয়ে গেছে৷ নানারকম চরিত্রের মানুষ৷ তাই জানোয়ার দেখে ঘেন্না হবে বলে মনে হয় না৷’’

মিনিট পনেরো পরেই ডানদিকে দেখি দুটো উটপাখি সাঁইসাঁই করে দৌড়ে যাচ্ছে৷ কেমন কোমর ঝাঁকিয়ে দৌড়ায় না ওরা৷ যেন মনে হয় ফরাসি মেয়েরা ক্যান-ক্যান নাচ নাচছে৷ শুধু পাগুলো বড় লম্বা আর বিচ্ছিরি দেখতে পাখিগুলোর৷ নইলে ভালো৷ চার-পাঁচটা জিরাফ দেখলাম৷ এবার মাঝে-মাঝেই কয়েকটি করে অ্যাকাসিয়া গাছ দেখা যাচ্ছে৷ অ্যাকাসিয়ার পাতা খাচ্ছে জিরাফগুলো গলা বাড়িয়ে৷

আমাদের দেখেই দৌড় লাগাল৷ ওদের দৌড়নোর ভঙ্গি দেখে আমার মনে হল, বিধাতা এই জানোয়ার তৈরি করার সময় খুব তাড়াহুড়োতে কাজ সেরেছেন৷ উনি তাড়াতাড়িতে জিরাফের হাঁটু আর গোড়ালির কাছটায় আঠা অথবা বোল্টু আটকাতে নির্ঘাত ভুলে গেছেন৷ এমন বিদঘুটে কায়দার পা দুটো সামনে ফেলে-ফেলে দৌড়ায় জিরাফরা যে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি হুমড়ি খেয়ে দড়াম করে পড়ে যাবে৷

এরপর জেব্রার দল৷ অনেকরকম জেব্রা হয়৷ তা কি তোমরা জানো? গাড়ি চলছে আর পথের দু’পাশে কতরকম জানোয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে, তা কী বলব৷ কোথাও দলে৷ কোথাও দুটো করে৷

যমসলস গ্যাজেল, গ্রান্টস গ্যাজেল, ইম্পালা, বুমবাক, ওয়াটার বাক, ওয়াইল্ড বিস্ট, ওয়ার্টহগ টোপি, এলান্ড৷ এরা সব হরিণ৷ সবচেয়ে ছোট্ট হরিণ হচ্ছে ডিক-ডিক৷ সুন্দর নাম না?

একটা ডিক-ডিক দেখেছিলাম যখন সেরোনারা থেকে ডুটু সাফারি লজের দিকে যাচ্ছিলাম, কয়েকদিন পরে৷ এক ঝাঁক অ্যাকাসিয়া আর কাঁটা-ঝোপের পাশে ছোট্ট হরিণটা দাঁড়িয়ে ছিল৷ আমাদের দেশেও এইরকম ছোট হরিণ আছে৷ মাউস-ডিয়ার৷ এখনও উড়িষ্যাতে দেখা যায় কিছু৷ এদের ওড়িয়া নাম হল ‘‘খুরান্টি’’৷

গাড়ি চলেছে সেরোনারা লজের দিকে৷ তানজানিয়াতে যেটুকু পড়েছে সেরেঙ্গেটির তার এলাকা কত বলো তো? খুব বেশি নয়, মাত্র তেরো হাজার বর্গ-কিলোমিটারের মতো৷ উত্তর-পুবে লোবো-লজ পেরিয়ে গিয়ে এই সেরেঙ্গেটিই আবার কেনিয়াতে চলে গেছে৷

আমরা মাঝে একটা অ্যাকাসিয়া গাছের ছায়ায় বসে প্যাক-লাঞ্চ খেয়ে নিয়েছি৷ টেডি গাড়ি থেকে নিজে নামবে না, আমাকেও নামতে দেবে না৷ সেৎসি ফ্লাইয়ের অত্যাচার৷ গাড়ির কাচ নামালেই ঢুকে পড়ে৷ এই মাছি কামড়ালে মানুষ শুধুই ঘুমোয়৷ তারপর ঘুমোতে-ঘুমোতে মরে যায়৷ টেডি সিংহের চেয়েও বেশি এই মাছিগুলোকে ভয় পায় দেখলাম৷

আমার আপত্তি ছিল না৷ মরতে যদি কখনও হয়ই, এই সুন্দর পৃথিবী যদি ছেড়ে চলে যেতেই হয়, তাহলে ঘুমোতে-ঘুমোতে, স্বপ্ন দেখতে-দেখতে মরার মতো আরাম আর কী আছে?

হঠাৎ টেডি গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘সিম্বা৷’’ তাকিয়ে দেখি, কয়েকটা কোপি৷ আর পাথরে শুয়ে বসে আরামে শীতের রোদ পোয়াচ্ছে গোটা আটেক সিংহ, সিংহী ও বাচ্চারা৷

টেডি বলল, ‘‘এই কোপিগুলোর নামই ‘সিম্বা কোপি’৷’’

সোয়াহিলিতে, ‘সিম্বা’ মানে সিংহ৷ বাচ্চাগুলো লাফালাফি করছে৷ বড়-বড় কান খাড়া করে তাকিয়ে আছে৷ কানের পিছনে রোদ পড়ে কমলালেবুর রঙ ধরেছে৷ সন্ধের মুখে-মুখে সেরোনারা লজের কাছে একদল সিংহ রাস্তা পেরুচ্ছিল দেখলাম৷ একটা বড় সিংহ হুম-হাম করে ডেকে উঠল৷

আমাদের দেশের বাঘের সঙ্গে এই ন্যাড়াগায়ের দল বেঁধে শিকার করা সিংহদের কোনো তুলনাই করতে পারি না আমি৷ বাঘ-বাঘই৷ বাঘের কোনো বিকল্পই নেই পৃথিবীতে জানোয়ারের জগতে৷

আমার মনে হয়, সিংহের কেশরগুলো চিৎপুরের নকল দাড়ি-গোঁফের দোকান থেকে কেউ ভাড়া করে এনে আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে৷ পশুদের রাজ্যে মানুষের রাজ্যের মতোই অনেক অবিচার ও অন্যায় ঘটেছে৷ নইলে, তোমরাই বলো, আমাদের রাজরাজেশ্বর বাঘ থাকতে আফ্রিকার সিংহ কখনো ‘পশুরাজ’ খেতাব পায়?



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *