যমদুয়ারের ছোকরা বাঘ
জায়গার নাম যমদুয়ার৷ তার নৈসর্গিক দৃশ্যের তুলনা হয় না৷ একপাশে ভুটান পাহাড় অর্থাৎ হিমালয় পর্বতমালা, অন্যদিকে পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ি জেলার সবুজ সীমারেখা, আর এদিকে আসাম—সেখানে আমরা আছি৷ বনবিভাগের দোতলা বাংলোটি একেবারে সংকোশ নদীর দিকে মুখ-চাওয়া৷ সংকোশ নদীই বাংলা আর আসামের সীমানা দেখিয়ে বয়ে চলেছে এখানে৷ বড়ো সুন্দর নদী৷ নদীময় বড়ো বড়ো পাথর৷ স্বচ্ছ জলে কালো ছায়া ফেলে মাছের দল সাঁতরে চলেছে৷ সারাক্ষণ কুলকুল কুলকুল করে গান গাইছে সংকোশ৷
সঙ্গে আছে স্থানীয় শিকারি সাত্তার, পুরো গোয়ালপাড়া জেলার লোকেরা একে জানে ‘ছাত্তার ভাই’ বলে৷ নাম আবু সাত্তার৷ সত্যিই বড়ো ভালো শিকারি৷ এ পর্যন্ত ও কত যে বাঘ, চিতা, কুমির ইত্যাদি মেরেছে তার আর লেখাজোখা নেই৷
দু-বেলা খাই-দাই, রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়াই—বাঘের পায়ের দাগের খোঁজ করি৷ এ পর্যন্ত বাঘের হদিশ পাওয়া গেল না৷ দু-একদিনের মধ্যে মোষ বেঁধে বসব ভাবছি জঙ্গলে৷ বাঘের হদিশ পাওয়া না গেলেও, বাঘ যে পথে মাঝে মাঝে সংকোশে জল খেতে যায় সে পথটা সাত্তার আর আমি খুঁজে বের করলাম একদিন৷ তারপর ঠিক করলাম, একদিন বিকেলবেলা গিয়ে সেই পথের ধারের কোনো গাছে বসব, যদি বরাতে বাঘের দেখা মেলে৷
বসলাম গিয়ে একদিন৷ বাংলো থেকে পাহাড়ি সুঁড়িপথে প্রায় মাইল তিনেক৷ নদীর ধার দিয়ে রাস্তা৷ রাস্তায় দুটো বড়ো বড়ো খাদ থাকাতে জিপ যাওয়া মুশকিল৷ তা ছাড়া জিপ নিয়ে যেখানে বসব সেখান অবধি যাওয়াটা ঠিক হবে না৷ হেঁটে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ সাত্তার বলল, ‘কপালে থাকলে এখনই আসবে বাঘ৷’
উঠে বসলাম একটা খয়ের গাছে৷ দেখতে দেখতে আমাদের পিছনে সংকোশের দুধলি-বালি আর স্বচ্ছ জল পেরিয়ে ভুটান পাহাড়ের আড়ালে সূর্যটা ডুবে গেল৷
আস্তে আস্তে রাত নামল৷ রাত বাড়তে লাগল৷ এখন চারদিকে ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না৷ গরমের সময় জঙ্গলে ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে৷ কিছু দূরে ভুটানের পর্বতমালা পূর্ণিমার রাতে আলোর ওড়না মুড়ে ঘুমোচ্ছে৷ আমাদের পেছন দিয়ে সংকোশের স্রোত বয়ে চলেছে একটানা, কলকল শব্দ করে৷
রাত প্রায় নটা বাজে৷ জ্যোৎস্নামাখা বন-পাহাড়ের যে একটা মিষ্টি ঠান্ডা আমেজ আছে সেটা একেবারে বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে৷ এমন সময় আমাদের সামনে প্রায় দুশো গজ দূরে একদল ভারী জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ পেলাম৷ আমরা যে গাছে বসে ছিলাম ঠিক তারই তলা দিয়ে জানোয়ারদের চলার সুঁড়িপথ গেছে৷ শব্দ শুনে মনে হল, যাদের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, তারা এই পথেই আসবে৷ সাত্তার ফিসফিসিয়ে কানে কানে বললে, ‘সেই জংলি মোষের দল, যাদের কথা আপনাকে বলেছি৷ সংকোশে জল খেতে চলেছে৷’
সাত্তারের কাছে শুনেছিলাম যে, এই রাস্তা ব্লক, যে ব্লকে আমরা বাঘ মারার জন্যে বনবিভাগের অনুমতি নিয়েছি, তাতে নাকি একদল দেখবার মতো জংলি মোষ আছে৷ ভেবেছিলাম পূর্ণিমা রাতে যদি বাঘ গাছের নীচে একবার চেহারা দেখায়, তাহলে গুলি করতে বিশেষ অসুবিধা হবে না৷ কিন্তু বাঘের আশায় এসে জংলি মোষের দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷
ততক্ষণে শব্দটা এগিয়ে আসছে৷ শক্ত ভারী পায়ের ইতস্তত আওয়াজ৷ কখনো থামছে, কখনো এগোচ্ছে৷ আমাদের গাছের বাঁ দিকে প্রায় পঁচিশ গজ দূরে, সেই সুঁড়িপথে একটা বাঁক ছিল৷ দেখতে দেখতে সেই বাঁকের মুখে এসে দাঁড়াল এক অতিকায় প্রাণী৷ বনের পটভূমিকায় চাঁদের রুপোলি আলোয় বলিষ্ঠতার প্রতিমূর্তির মতো এসে দাঁড়াল দলপতি৷ দলপতি হবার যোগ্যই বটে৷ মাথার শিং দুটো দুখানা অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক হাতের মতো, সামনের সমস্ত কিছুকে আঁকড়ে ধরার জন্য যেন হাত বাড়িয়ে আছে৷ গায়ের রং লাল-কালোর মাঝামাঝি, একটা প্রকাণ্ড মাথা৷
মোষের দলের আমাদের দেখতে পাবার কোনো কথা ছিল না, দেখেওনি৷ পুরো দলটা নিজেদের মনে নীচের শুকনো পাতা-পড়া পথে, খচমচ আওয়াজ তুলে সংকোশের দিকে চলে গেল৷ মারতে চাইলে অতি সহজে মারা যেত৷ কত বড়ো মাথা, এবং অত ধীরে ধীরে চলন৷ কিন্তু জংলি মোষ মারতে আমরা যাইনি সেবারে৷ তা ছাড়া মোষ মারার অনুমতিও ছিল না৷ তবু দেখা তো হল৷ সেই বা কম কী?
মোষের দল যখন এখনই জলে গেল তখন বাঘের এখনই এদিকে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই মনে করে সে রাতের মতো আমরা গাছ থেকে নেমে হেঁটে যমদুয়ারে বাংলোয় এসে পৌঁছলাম৷
সকালে দরজায় ধাক্কা দিয়ে চৌকিদার ঘুম ভাঙাল৷ দরজা খুলে কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে সে বাংলোর নীচে, রান্নাঘরের পাশে, মাটিতে গোল হয়ে বসে থাকা চার-পাঁচজন লোকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল৷ নীচে নামতেই ওরা বললে, ‘সাহেব, এক্ষুনি একবার যেতে হবে আমাদের সঙ্গে!’ জঙ্গলের মধ্যে ভুটানের সীমানার একেবারে পাশেই ওদের মোষের বাগানটা৷ সেখানে কুড়ি-বাইশটা মোষ থাকে৷ ওরা মোষ চরায়, দুধ থেকে ঘি করে সংকোশের ওপারে ভুটানের হাটে বিক্রি করে৷ ওরা বললে, কাল শেষ রাতে একটা বাঘ এসে বাগানের চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে—আর ডাকাডাকি করতে থাকে৷ কিন্তু মোষগুলো সব একসঙ্গে থাকাতে প্রথম কিছু করতে সাহস পায় না৷ কিন্তু একটা মোষের অসুখ হওয়াতে, অন্য মোষেদের থেকে আলাদা করে, বাগানের বাইরে, ঘরের পাশে একটা শাল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল৷ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, বাঘ মুহূর্তের মধ্যে সেই মোষটাকে মেরে দড়ি ছিঁড়ে ওদের ঘর থেকে মোটে পচিশ-তিরিশ গজ দূরে কতগুলো জার্মান-জঙ্গলের মধ্যে (বিহারে যাকে বলে পুটুস) নিয়ে গিয়ে খেতে আরম্ভ করল৷ ওরা বললে, ওদের জীবনে ওরা এরকম দুঃসাহসী বাঘ দেখেনি৷ ঘরের মধ্যে থেকে ওরা কড়মড় করে হাড় চিবনোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল৷ প্রতিকারে কী যে করবে তা ভেবেই ঠিক করতে পারছিল না৷ শেষে ওরা সবাই মিলে সাহসে ভর করে ঘরের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কেরোসিনের টিন বাজাল ও চেঁচামেচি করার পর তিন-চারটে মশাল জ্বেলে, হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে জ্বলন্ত মশালগুলো বাঘের দিকে ছুড়ে দিয়ে আবার দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল৷ তারপর সে কী কাণ্ড! একে বাঘ খিদের মুখে খাচ্ছিল, তায় জ্বলন্ত মশাল গিয়ে পড়েছে তার ঘাড়ে৷ পনেরো মিনিট সে এক প্রচণ্ড অবস্থা৷ বাঘের বিকট গর্জন, বাগানের মোষেদের গলায় ভারী ঘণ্টার সঙ্গে মেলা সমবেত ভয়ার্ত চিৎকার৷ সব মিলে বেচারাদের প্রাণ উড়ে যাবার অবস্থা৷
তাদের জিজ্ঞেস করলাম যে, মোষটার অবশিষ্টাংশ ওখানেই আছে না বাঘ খাবার আগে অন্য জায়গায় টেনে নিয়ে গেছে? ওরা বলল, মোষটাকে বাঘ ওখান থেকে আরো একশো গজ দূরে নিয়ে গিয়ে একটা বেতের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে৷ বোধহয় সবটা খেতে পারেনি৷
তক্ষুনি আমি আর সাত্তার জিপে উঠে বসলাম৷ প্রায় সাত-আট মাইল পথ গিয়ে জঙ্গলের প্রধান সড়কে জিপ রেখে আমরা প্রায় মাইলখানেক হেঁটে সেই গোয়ালে এসে পৌঁছলাম৷ ওখানে আগে একজন ঠিকাদারের ঘর ছিল৷ ঘন শালের জঙ্গলের মধ্যে, প্রায় ২৫০ বর্গগজ জায়গার গাছ নির্মূল করে পরিষ্কার করা হয়েছে৷ তারই একপাশে শক্ত শক্ত শালের খুঁটি দিয়ে ঘেরা বাগান, আর অন্যপাশে গোয়ালাদের দুটি থাকার ঘর৷
আমরা ভাবলাম যে রাতে বাঘ নিশ্চয়ই আসাবে৷ অতএব মড়ির কাছে কোনো গাছে মাচা বেঁধে বসব৷ মোষের মড়িটা কোথায় আছে শুধোতে গোয়ালাদের মধ্যে একজন আমাদের সেদিকে নিয়ে চলল৷ ওদের ঘর থেকে প্রায় পঁচাত্তর গজ উত্তরে একটা সরু শুকনো নালা গেছে৷ সেই পাহাড়ি নালার একপাশে একটা বড় বেতের ঝোপ দেখিয়ে গোয়ালা বলল, বোধহয় এখানে রেখেছে মোষটাকে৷ আমরা বেত ঝোপটাকে প্রদক্ষিণ করে ঝোপের ওপাশে গিয়ে সবে পৌঁছেছি, হঠাৎ সাত্তার লোকটাকে বলল, তুই পালা, শিগগির পালা৷ আমার হাতে রাইফেল ছিল, আর সাত্তারের হাতে বন্দুক৷ কিন্তু এই সকালবেলায় ঝকঝক করা রোদের মধ্যে ঝোপের কাছে ভয়ের কী কারণ থাকতে পারে বুঝলাম না৷ সে যাই হোক গোয়ালাটি কিন্তু ততক্ষণে খালের দিকে বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেছে৷ আমরা যেখানে দাড়িয়েছিলাম সেখান থেকে মোষের মড়ি দেখা যাচ্ছিল৷ সাত্তার ঝোপের দিকে আঙুল দেখিয়ে আমাকে ফিসফিস করে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ঝোপের মধ্যে থেকে একটা সংক্ষিপ্ত চাপা আওয়াজ শোনা গেল৷ আশ্চর্য কথা, বাঘ এখনো মড়ির ওপরে আছে?
আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজনে দু-দিকে গিয়ে ভালো জায়গা বেছে দাঁড়ালাম—আর প্রায় তক্ষুনি বাঘ মোষ ছেড়ে এক প্রকাণ্ড গর্জন করে একলাফে আমাদের দিকে প্রায় উড়ে এল৷ সকালের রোদে থাবাতে-মুখে রক্তমাখা ক্রুদ্ধ বাঘের সেই প্রলয়ংকর মূর্তি বহুদিন মনে থাকবে৷ সাত্তার আর আমি বোধহয় একসঙ্গেই গুলি করেছিলাম৷ গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে বাঘ শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়ে একেবারে সটান লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল৷ আমরা আশ্বস্ত হলাম যে বাঘটা সত্যি মরেছে৷ কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের ভীষণভাবে চমকে দিয়ে বাঘটা প্রায় পেটে ভর করে আমি যেদিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম (নালার দিকে) সেদিকে তেড়ে এল৷ এখন সেটা আমাকে শেষ-আক্রমণ করার জন্যই, কি আহত অবস্থায় নালায় আশ্রয় নেবার জন্য, তা বুঝলাম না৷ তা ছাড়া তখন তো বোঝাবুঝির সময়ও ছিল না৷ আর বেশি ঝুঁকি নেওয়া কোনোমতেই বুদ্ধির কাজ হত না—তাই বাঘের তেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তুলে একেবারে বাঘের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করলাম৷ আর কাছ থেকে ছোড়া রাইফেলের গুলি বাঘের মগজ থেঁতলে দিল সঙ্গে সঙ্গে৷ তারপর কতকগুলো শালের চারার উপর কিছুক্ষণ থরথরিয়ে কেঁপে বাঘটা একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল৷
বাঘটা খুব যে একটা প্রকাণ্ড, তা ছিল না৷ বয়সেও একেবারে ছেলেমানুষ৷ সবে বড়ো হয়ে, মাকে ছেড়ে, শিকার করতে আরম্ভ করেছে একা একা৷ সে কারণেই হয়তো এমন বোকার মতো দিনের বেলাতেও মড়িতে বসে খাচ্ছিল আর ছেলেমানুষি করেছিল রাত্তিরে৷ সাত্তার বলল, ছোকরা না হলে এত বোকা হত না৷
গোয়ালারা খুব খুশি হল৷ আমাদের খাওয়ার জন্য জোর করে একভাঁড় ঘি দিল৷ কিন্তু সেই ছেলেমানুষ সুন্দর বাঘটাকে মেরে সত্যি বলতে কি আমাদের একটু কষ্টই হল৷
—