গোরোংগোরো
নামটা খুবই মজার৷ তাই না? কিন্তু বানানটা বড়ই গড়বড়ে৷ NGORO-NGORO৷ আফ্রিকায় সোয়াহিলি ভাষাটাই ওরকম৷ বেশির ভাগ কথার ইংরাজি বানানের আগেই একটা করে ‘N’৷
গোরোংগোরো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো আগ্নেয়গিরি ছিল৷ এই আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা ছিটকে গড়িয়ে গিয়েছিল দিকে-দিকে কত হাজার বা কোটি বছর আগে, তা একমাত্র ভৌগোলিকরাই বলতে পারেন৷
সেই বিরাট গহ্বর, যা আগে আগ্নেয়গিরির ভিতরে নানা ধাতু আর পাথরগলা ধোঁয়া-ওঠা লাল তরল পদার্থে টগবগ করত, তা এখন ঘন সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে৷ গহ্বরের মধ্যেই উঁচু-নীচু জমি, নদী-হ্রদ, গাছ-গাছালি এবং কত যে জানোয়ার এবং পাখি, তা কী বলব!
এই নিভে যাওয়া আগ্নেয়গিরির গহ্বরের পরিধি দু’শো চৌষট্টি কিলোমিটার৷ বেশ বিরাটই ব্যাপার৷ গহ্বরের চারদিকে মাথা-উঁচু জঙ্গলাবৃত পাহাড়৷ সেরেঙ্গেটির দিক থেকে দেখলে গোরোং গোরোকে একটা মেঘে ঢাকা অদ্ভুত আকারের গোল পাহাড় বলে মনে হয়৷ খুব বড়ো ফোড়ার মতো একটা বিরাট পাহাড় যদি হঠাৎ ফেটে যায়, এবং তার মধ্যিখানটা ফাঁকা হয়ে গিয়ে যেমন দেখায়, গোরোং গোরোর গহ্বরটি দেখতে ঠিক সেইরকম৷
লেক মানিয়ারা থেকে লাঞ্চ খেয়ে সন্ধেবেলায় এসে পৌঁছেছিলাম এখানে৷ ভীষণ ঠান্ডা৷ এ-জায়গাটা দার্জিলিংয়ের চেয়েও উঁচু৷ রাতে লজের ডাইনিং রুমে গমেওয়ার্ডেনের শিকার করা ওয়াইল্ড বিস্টের স্টেক খেলাম৷ অনেকটা আমাদের দেশের শম্বরের মাংসের মতো৷ অন্ধকার থাকতে-থাকতে চান করে তৈরি হয়ে নিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম৷ গোরোংগোরোর গহ্বরে নামতে হলে তানজানিয়ার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ল্যান্ড-রোভার নিয়ে নামতে হয়৷ ভাড়া নেয় পাঁচশো টাকা৷ সকাল থেকে লাঞ্চের সময় অবধি ঘোরা যায়৷
একটি ছিপছিপে কালো ছেলে, নাম ডিক্সন, আমার ল্যান্ড-রোভারের ড্রাইভার৷ কুয়াশায় চারদিক ঢাকা৷ দার্জিলিং থেকে টাইগার হিলে যেতে ভোরে যেমন কুয়াশা থাকে তেমন৷ আমি বললাম, আস্তে চালাও ডিক্সন৷
ও ফগলাইট জ্বালিয়ে বলল, ‘‘আঁক-বাঁক আমার সব মুখস্থ, ভয় শুধু মাসাইদের গরু-মোষের জন্যে৷ কুয়াশার মধ্যে কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলেই ঝামেলা আর কী৷’’
লাল পোশাক পরে দীর্ঘদেহী মাসাইরা অদ্ভুত সব গয়না-গাঁটি পরে হাতে বল্লম নিয়ে পথের এদিক-ওদিকে দাঁড়িয়ে ছিল৷
একটু গিয়েই নামতে লাগল ল্যান্ড-রোভারটা৷ তারপর দেখতে দেখতে দেড় হাজার মিটার মতো নেমে গিয়ে গহ্বরের বুকের মধ্যে নেমে এল৷ এখন কুয়াশা কেটে গেছে৷ একদল গিনিফাউল গাড়ি চাপা পড়তে-পড়তে বেঁচে গেল৷ হায়নারা দলে-দলে সভা করছে বলে মনে হল৷ রাতে এরা ডাকে হাঃ-হাঃ করে৷ শুনলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠবে তোমাদের৷ ডোরাকাটা আফ্রিকান শেয়ালও দেখলাম অনেক৷ ডিক্সন ওয়াইল্ড বিস্টের দলকে তাড়িয়ে গাড়ি চালাচ্ছে৷ অদ্ভুত জানোয়ারগুলো৷ গোল হয়ে নাচ দেখায় ছেলেগুলো মেয়েদের৷ দাড়ি আছে৷ ভারী মজার দেখতে৷ সার্কাসে যেমন ক্লাউন থাকে, এরাও হচ্ছে তেমনই আফ্রিকান ক্লাউন৷ আমি বললাম, ডিক্সন, সিংহ দেখাও, সিংহ অথবা লেপার্ড কী গন্ডার, কী আফ্রিকান চিতা৷
ডিক্সন বলল, ডোন্ট বা ইমপেশেন্ট স্যার৷ উইথ আ লিটল বিট অব লাক উই উইল সি অল৷ লেটস সি…
বলেই, গাড়িটা দাঁড় করিয়ে একটা সিগারেট মুখে দিল৷ লাইটারটা জ্বালাল৷ আমার পাইপটা নিভে গিয়েছিল, ওর লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিল৷ হিন্দিতে বললাম, জিতা রহো বেটা!
ও বুঝতে না পেরে ভাবল গালাগালি করছি বুঝি৷ তারপর বোকা-চালাকের মতো বলল, থ্যাঙ্কয়্যু৷
জানলা দিয়ে দূরে তাকিয়ে দেখলাম, অনেক দূরে গাছহীন একটা বড় টিলার গায়ে কালো একটা বিন্দু, যা সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই বেমানান৷ কিন্তু জিনিসটা কী যে, তা দূর থেকে বুঝতে পারলাম না৷ ডিক্সনকে আঙুল দিয়ে দেখালাম৷
ডিক্সন একগাল হেসে আমাকে বলল, তুমি দেখছি পাকা লোক৷ বলেই সিগারেটটাতে দুটো বড়-বড় টান লাগিয়ে অ্যাশট্রের মধ্যে গুঁজে দিয়েই তাড়াতাড়ি গাড়ি ছোটাল ওইদিকে৷
পাকামির কী করলাম, না বুঝতে পেরে আমি ওইদিকে তাকিয়ে রইলাম৷ গাড়িটা যতই এগোতে লাগল, কালো বিন্দুটাও ততই বড় হতে লাগল৷ তারপর স্পেশ্যাল গিয়ার চড়িয়ে গাড়িটা যেই মসৃণ, ঘাসভরা পাহাড়ে উঠে পড়ল, তখনই প্রথমে বুঝতে পারলাম জিনিসটা কী! একটা বিরাট কালোরঙা জংলি মোষ শুয়ে আছে৷ আর একটু এগোতেই দেখলাম, একটা প্রকাণ্ড সিংহের কেশর সমেত মাথা উঁকি মারছে৷ দেখতে-দেখতে গাড়িটা একেবারে কাছে চলে গেল৷
একটা নয়, সবসুদ্ধ দশটা সিংহ ও সিংহী৷ মোষটাকে বোধহয় আধঘণ্টাখানেক আগে মেরেছে৷ পেছন থেকে কুরে খেয়ে-খেয়ে একটা বিরাট লাল গর্ত করে ফেলেছে ওরা৷ দুটো বড় সিংহ, দুটো সিংহী, আর ছটা বাচ্চা৷ রক্তেমাংসে মুখ গুঁজে-গুঁজে খেয়ে প্রত্যেকের মুখ লাল৷ মনে হচ্ছে মুখে, কপালে, থুতনিতে, নাকে সিঁদুর মেখেছে বুঝি ওরা সকলে৷
ডিক্সন গাড়িটা নিয়ে একেবারে কাছে ভিড়িয়ে দিল৷ ছাদের পাটাতন সরিয়ে আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম দশ হাত দূর থেকে৷ গরর-গ-রর, গরর-গর-র আওয়াজ হতে লাগল৷ আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল বড় সিংহ ও সিংহী দুটো৷ কিন্তু গ্রাহ্য করল না৷ আমিও গ্রাহ্য করলাম না৷ কারণ আমি বাঘের দেশের লোক৷ ফাঁকতালে বনের রাজা হওয়া সিংহ কী ভয় দেখাবে আমাকে৷
দেখতে-দেখতে আমাদের গাড়িটাকে লক্ষ করে আরো তিনটে গাড়ি চলে এল৷ ফোটো উঠতে লাগল ক্লিক-ক্লিক করে৷ মুভি ক্যামেরা চলতে লাগল কিরর-কিরর করে! আমি জানি, এঁদের মধ্যে অনেকেই যখন এই ছবিগুলো দেখাবেন যাঁর-যাঁর নিজের দেশে ফিরে, তখন বলবেন যে, পায়ে হেঁটে গিয়ে সামনে থেকে ছবিগুলো তুলেছেন৷
প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে দেখার পর সিংহ জাতটার উপরই অভক্তি হয়ে গেল যখন, তখন দাঁড়ানো অবস্থাতেই ডিক্সনকে হাতের ইশারায় চলতে বললাম৷
বাচ্চাগুলো খুব মজা করছিল৷ উলটোচ্ছিল, পালটাচ্ছিল৷ মাঝে-মাঝে থাপ্পড়ও খাচ্ছিল বড়দের কাছে৷ পাহাড়ের যে-ঢালে সিংহরা মোষটাকে খাচ্ছিল, সেই ঢালের উপরে উঠেই দেখলাম, সিংহগুলোর থেকে পাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে বুনো মোষের একটা বড় দল আপনমনে চরে বেড়াচ্ছে৷ জীবন এবং মৃত্যু প্রকৃতির মধ্যে এমনি স্বাভাবিক হয়েই থাকে৷ জন্মালে মরতেই হয়৷ কখন, কীভাবে মরবে কে; তা নিয়ে জংলি জানোয়ারদের কোনো মাথাব্যথাই নেই৷ পাহাড় থেকে নীচে তাকিয়ে দেখি, গহ্বরের মধ্যে যে হ্রদটা আছে, সেটা ফ্লেমিংগো পাখিদের কমলা-রঙা ডানায় একেবারে কমলা হয়ে গেছে৷ মুগ্ধ হয়ে গেলাম সেইদিকে চেয়ে৷
ডিক্সন গাড়িটাকে পাহাড় থেকে নামাতে লাগল আস্তে-আস্তে৷ পাহাড় থেকে, হাঁটুসমান ঘাসে ভরা বালি-বালি আশ্চর্য আগ্নেয়গিরির কোলের মাটিতে নামতে না-নামতেই গাড়ির সঙ্গে একটা দু-খড়্গর প্রকাণ্ড গন্ডারের ধাক্কাই লাগছিল একটু হলে৷ ডিক্সন ব্রেক কষতেই গন্ডারটাও ব্রেক কষল৷ ভেজা মাটি ছিটকে উঠল গাড়ির চাকার আর গন্ডারের ক্ষুরে৷ গন্ডারটার আমাকে পছন্দ হল না মোটেই৷ তাড়াতাড়ি ট্যাংকের মতো শরীরটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ফোঁত-ফোঁত করতে করতে দৌড়তে লাগল৷
এবারে আমরা লেকের কাছে গিয়ে ফ্লেমিংগোদের দেখলাম ভালো করে৷ কিন্তু হঠাৎ লেকের পাশের জলাজমিতে চোখ পড়ায় চমকে উঠলাম৷ দুটো শিকারি চিতা (চিতা বাঘ নয়) একটা থমসনস গ্যাজেলকে মেরে খাচ্ছে৷ তাদেরও মুখ রক্তে লাল৷ আমাদের দেখেই একজনে গ্যাজেলটার একটা রক্তাক্ত ধ্যাং নিয়ে দৌড় লাগাল ঘাসবনে৷ অন্যজনে অর্ধেক ধড় ও আরেকটা ঠ্যাং নিয়ে৷ থমসনস গ্যাজেলের সঙ্গীটি অল্প দূরে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে সঙ্গীর সঙ্গীন অবস্থা দেখতে লাগল৷ ও ইচ্ছে করেই দাঁড়িয়েছিল, না ভয়ে স্থাণু হয়ে গিয়েছিল, তা বলতে পারব না৷ আরও অনেক জানোয়ার দেখলাম৷ জেব্রা, ওয়ার্টাহগ, বুনো কুকুর, থমসনস গ্যাজেল, গ্রান্টস গ্যাজেল, এলান্ড, বুশ বাক, ওয়াটার বাক, খরগোশ এবং আরও কত কী!
ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছিলাম গোরোংগোরো ক্র্যাস্টার লজ থেকে৷ সূর্যের তাপ নেই৷ তবে রোদ উঠেছে৷ আমার মনে হল, বোধহয় আটটা বেজেছে৷ হঠাৎ ডিক্সন বলল, ডু য়্যু ফিল হাংগ্রি, স্যার?
হাংগ্রি? ও নো অ্যট অল৷ আমি বললাম৷ তারপর বললাম, হোয়াটস দ্য টাইম নাউ?
ডিক্সন বলল, কোয়ার্টার টু ওয়ান৷
হোয়াট!
আমি অবাক হয়ে ওর কথা বিশ্বাস না করে আমার ঘড়ি দেখলাম জার্কিনের হাতার তলা থেকে বের করে৷ সত্যিই পৌনে একটা বাজে৷
ডিক্সন আবার বলল, আড়াইটার পর লজে পৌঁছলে লাঞ্চ পাব না৷ বলেই গাড়ি ঘোরাল৷ কী করে যে এই সাতটি ঘণ্টা কেটে গেল, তা বুঝতেই পারলাম না৷ এমনিই হয়৷ যারা জানে তারাই জানে৷ ডিক্সনকে বললাম, ডিক্সন, কাল তোমার সঙ্গে আবার আসব৷
ডিক্সন কাঁধ শ্রাগ করে বলল, ইট উইল বি মাই প্লেজার, স্যার৷
—