মহম্মদ নাজিম
মহম্মদ নাজিমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়, তা আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে৷ হাজারিবাগের বড়া মসজিদের গলিতে তার একটি ছোট্ট দোকান ছিল, জুতোর এবং মুঙ্গেরি বন্দুক, গুলি ইত্যাদির৷ দোকানের নাম ছিল ‘বেঙ্গল ফ্যান্সি স্টোর্স’৷ রোগা ছিপছিপে নাজিম সাহেব সবসময় পান-জর্দা খেতেন, সিগারেটও খেতেন এবং দোকানের ক্যাশবাক্সের সামনে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকতেন এবং রাস্তা দিয়ে যে ক্বচিৎ গাড়ি বা জিপ যেত তার উদ্দেশে সেলাম বাজাতেন৷ একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কার গাড়ি?
উনি বলেছিলেন, কৌন জানে?
—তবে সেলাম করলেন যে?
—গাড়িতে যখন চেপে যাচ্ছেন তখন নিশ্চয়ই কেউ কেষ্টবিষ্টু হবে৷
—অচেনা কেষ্টবিষ্টুকে সেলাম করে আপনার লাভ?
—লাভ মানে পরে যদি কখনো তার জুতো ছিঁড়ে যায় অথবা ব্যাগ, বেল্ট বা অন্য কোনো চামড়ার জিনিসের প্রয়োজন ঘটে, তখন তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমার দোকানেই কিনতে আসবেন৷
নাজিম মিঞার এই দূরদৃষ্টিতে আমি অবাক হয়েছিলাম৷ নাজিম সাহেব ইংরেজি জানতেন না৷ বিউটিফুলকে বলতেন বিটিফুল৷ তবে উর্দুতে তাঁর গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল৷ এবং কথায় কথায় উর্দু শায়রি আওড়াতেন৷ খুব রসিক এবং প্রেমিক মানুষ ছিলেন৷ চেহারা ছিল অতি কুদর্শন৷ পানের ছোপ লাগা বড়ো বড়ো দাঁত, মাজা গায়ের রং, কিন্তু তাঁর মুখের মধ্যে প্রথমেই যা নজরে পড়ত তা তাঁর দুটি চোখ৷ গাড়ির হেডলাইটে যেমন ট্রিপার ডিমার হয়—তেমনই তাঁর চোখেও ট্রিপার ডিমার হত৷ উত্তেজিত বা উৎসাহিত হলেই তাঁর চোখ দুটো উজ্জ্বল এবং বড়ো হয়ে উঠত এবং অন্যসময় স্তিমিত এবং স্বাভাবিক থাকত৷
আমার বন্ধু মিহির সেন যাঁর ডাকনাম ছিল গোপাল, হাজারিবাগে তাঁদের গয়া রোডের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম৷ বাড়ির নাম ছিল ‘পূর্বাচল’৷ ছবির মতো সুন্দর বাড়ি, সঙ্গে বাগান এবং সারি দেওয়া প্রাচীন ইউক্যালিপটাস গাছ৷ গোপালের বাবাও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন৷ মা-বাবা ছিলেন অত্যন্ত সুরুচিসম্পন্ন৷ গোপাল কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আমারই মতো পড়ত৷ তবে আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে৷ ওর শিকারের শখ ছিল৷ সেজন্য হাজারিবাগ গেলে ওর বন্দুকটি সঙ্গে নিয়ে যেত৷ হাজারিবাগে ওর শিকারের গুরু ছিলেন মহম্মদ নাজিম৷ আমরা যাকে বলতাম নাজিম সাব৷ গোপালই আমাকে নাজিম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়৷ কারণ আমিও ছেলেবেলা থেকে শিকারে উৎসাহী ছিলাম বলে সুযোগ হলেই হাজারিবাগে চলে যেতাম৷ তখন হাজারিবাগে রেল সংযোগ ছিল না৷ হাজারিবাগ শহরে আসতে হলে হয় হাজারিবাগ রোড স্টেশনে নেমে বগোদর, তাটিঝারিয়া ইত্যাদি জায়গা হয়ে হাজারিবাগ শহরে আসতে হত৷ কোডারমা স্টেশনে নেমেও আসা যেত তিলাইয়া বাঁধের উপর দিয়ে হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্ক বা রাজডেরোয়ার পাশ দিয়ে, বড়াহি রোড ধরে বাসে বা গাড়িতে৷ কোডারমা হয়ে এলে রাস্তা কম পড়ত কিন্তু অধিকাংশ মানুষই হাজারিবাগে আসতেন হাজারিবাগ রোড স্টেশন দিয়ে৷ তা ছাড়া গাঙ্গুলিদের লাল কোম্পানির বাস তখন চলত বিহারের প্রায় সর্বত্র৷ লাল কোম্পানি ছাড়াও আরও একটি বাঙালির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল যাদের বাসের ব্যবসা ছিল৷ সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল পার্ল মোটর কোম্পানি৷ লাল কোম্পানির সব বাস ছিল লাল এবং পার্ল কোম্পানিরগুলি সাদা৷ তবে লাল কোম্পানির তুলনায় পার্ল কোম্পানি অনেক ছোট ছিল৷ বিরাট ধনী গাঙ্গুলিদের বাড়ি ছিল রাঁচিতে৷
কোডারমা এবং ঝুমরি তিলাইয়া হয়ে এলে হাজারিবাগ শহরে পৌঁছোতে অনেক কম সময় লাগত৷ কিন্তু অধিকাংশ মানুষই আসতেন হাজারিবাগ রোড স্টেশনে নেমে বগোদর এবং তাটিঝারিয়া হয়ে৷ এই হাজারিবাগ শহরে তো বটেই, হাজারিবাগ রোড স্টেশনের চারপাশেও অনেক বাঙালিদের বাড়ি ছিল৷ কলকাতার বহু অবস্থাপন্ন বাঙালি পশ্চিমের হাওয়া লাগাতে সেসময় হাজারিবাগ রোড এবং হাজারিবাগ শহরে যেতেন৷ বিখ্যাত সাহিত্যিক বিমল করেরও একটি আস্তানা ছিল এই হাজারিবাগ রোড স্টেশনের পাশে৷ জায়গাটির স্থানীয় নাম ছিল সারিয়া৷ তাঁর বহু উপন্যাস এবং ছোট গল্পের পটভূমি ছিল এই অঞ্চল৷
নাজিম সাহেবের কথা বলতে বসে হাজারিবাগের কথা এতখানি বললাম কারণ নাজিম সাহেবের স্মৃতির সঙ্গে হাজারিবাগের স্মৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে৷ সেখানে শীতকালে যেমন শীত পড়ত, তেমনই গরম পড়ত গরমকালে৷ একবার গরমের সময়ে নাজিম সাহেবের সঙ্গে চাতরার জঙ্গলে শিকারে গিয়ে গোপাল প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে ‘লু’ লেগে৷ চাতরাতে নাজিম সাহেবের এক স্যাঙাত ছিলেন যাঁর নাম ছিল সফর আলি৷ সেখানে তাঁরও একটি মুঙ্গেরি বন্দুকের দোকান ছিল৷ তিনিই শিকারের বন্দোবস্ত করেছিলেন৷ গোপাল হিট স্ট্রোকে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে তাকে গাড়ি করে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসতে হয়েছিল৷
আমি ও গোপাল দুজনেই তখন ছাত্র৷ সি এ পড়ি৷ কারওই নিজস্ব গাড়ি বা জিপ ছিল না৷ তাই হাজারিবাগে শিকারে গিয়ে আমাদের খুবই অসুবিধায় পড়তে হত বাহনের অভাবে৷ বন্দুক কাঁধে নিয়ে নানা জায়গায় আমরা শিকারে যেতাম সাইকেল অথবা সাইকেল রিকশায়৷ ছাড়োয়া ড্যাম, এবং আরও নানা জায়গাতে আমরা শুয়োর মারতে যেতাম ওইভাবেই৷ হাজারিবাগ শহরটির তিনদিকে তিনটি পাহাড় ছিল, যাদের নাম ছিল কানহারি, সিলওয়াড় এবং সীতাগাঢ়া৷ এই সীতাগাঢ়াতে আমরা একটি মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছিলাম পঞ্চাশের দশকেই৷ সীতাগাঢ়াতেও আমরা গিয়েছিলাম সাইকেল রিকশা চড়ে আর নাজিম সাহেব গিয়েছিলেন তাঁর সাইকেলে৷
নাজিম সাহেব ছিলেন খাদ্যবিলাসী এবং তাঁর বিবিরা প্রত্যেকেই ছিলেন রন্ধনপটু৷ ইদের অনেকদিন আগে থেকেই একটা বড়ো সাদা খাসিকে যত্ন করা হত, সাবান দিয়ে চান করানো হত৷ সেটি আমাদের চোখের সামনে ‘শশীকলার ন্যায়’ বৃদ্ধি পেত৷ তারপর ইদের দিনে সেই খাসিটির প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে যেসব উমদা পদ রান্না হত তা আমরা সোৎসাহে কব্জি ডুবিয়ে খেতাম৷ এক এক কোর্স খাওয়ার পরে হামদর্দ কোম্পানির পাচনল ট্যাবলেট এবং নিম্বুপানি খেয়ে আমাদের খিদেকে চনমনে করা হত৷ খাসির বিরিয়ানি, চাঁপ, চৌরি, বিভিন্নরকম কাবাব, সিনাভাজা, মগজের কারি, কবুরার তরকারি সবকিছুই রান্না হত আলাদা আলাদা করে৷ তারপর থাকত ফিরনি এবং আন্ডে কা রোশন হালুয়া৷ দুপুরের খাওয়া আরম্ভ হত সকাল দশটায়৷ মাঝে মাঝে শিকারের এবং নানান বিষয়ে রসালাপ হত এবং সেই খানা শেষ হত বিকেল পাঁচটা নাগাদ৷ নানা ইদের অনুষ্ঠান ছাড়াও নাজিম সাহেব অতিকায় টিফিন কেরিয়ারে করে বিবিদের দিয়ে রান্না করিয়ে আমাদের জন্য সাইকেলে করে নিয়ে আসতেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবেশন করিয়ে খাওয়াতেন৷ মুসলমানি খানার যেমন বৈশিষ্ট্য তেমনি তার পরিবেশনও ছিল এক উঁচুদরের আর্ট৷
আমাদের কারও গাড়ি নেই—জিপ নেই শিকারে যাওয়ার জন্য৷ নাজিম সাহেবের তো সাইকেল ছিল৷ একবার গোপালের অনুচর ভূতনাথ, আমরা যাকে ভুতো ডাকতাম, খবর দিল যে সে জানতে পেরেছে নাজিম সাহেব একটা গাড়ি কিনেছেন আমাদের শিকারের জন্য৷ সেকথা আমাদের বিশ্বাস না হওয়ায় আমরা চাঁদা তুলে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ভুতোকে পাঠালাম সরেজমিনে তদন্ত করে আসতে৷ ভুতো তিনদিন পর ফিরে এসে যা বলল তা শুনে আমাদের রোমাঞ্চ হল৷ শুনলাম যে পাটনার এক বাইজির কাছ থেকে ৫০০ টাকায় নাজিম সাহেব একটি T.8 ফোর্ড গাড়ি কিনেছেন ড্রাইভার সমেত৷ ড্রাইভারের পরনে ৩২ মডেলের একটি পাজামা, কালের প্রহারে তা ছিঁড়তে ছিঁড়তে আন্ডারওয়ার হয়ে গেছে৷ ভুতো বলল, আমরা গেলে গাড়ির উপর খুব ধকল হবে তাই নাজিম সাহেবের গাড়ি এখন রেস্টে আছে৷ থাক করা ইটের উপরে গাড়ি বসানো আছে৷ গাড়ির টায়ার সলিড রাবারের৷ আমরা গেলে নীচ থেকে ইট সরিয়ে নামিয়ে রাখা ব্যাটারি লাগিয়ে গাড়িকে প্রাণ দেওয়া হবে৷ এবং আমাদের অনতিবিলম্বে হাজারিবাগে পৌঁছানো দরকার৷ না হলে গাড়ি ও ড্রাইভার উভয়েই দেহ রাখতে পারে৷ অতএব কালবিলম্ব না করে আমরা বন্দুক কাঁধে নিয়ে বিকেলের বম্বে মেল-এ চড়ে পড়লাম এবং হাড় হিম করা ঠান্ডাতে ভোর চারটের সময় অন্ধকার হাজারিবাগ স্টেশনে নেমে পড়ে ধুঁয়ো ওঠা বড়ো মাটির ভাঁড়ে এক কাপ করে চা খেয়ে লঝঝড়ে বাসে চড়ে পড়লাম৷
সূর্য যখন উঠল পুব আকাশে, তখন বাস এসে দাঁড়াল তাটিঝারিয়ায়৷ সেখানে পণ্ডিতের দোকানে গরম গরম কালাজামুন এবং স্বাদু কুচো নিমকি এবং চা খেয়ে আমরা সজীব হলাম৷
পূর্বাচলে না গিয়ে প্রথমেই আমরা বাসস্ট্যান্ড থেকে সাইকেল রিকশা নিয়ে নাজিম সাহেবের ডেরায় পৌঁছোলাম এবং স্বচক্ষে দেখলাম তাঁর গাড্ডি লাজোয়ার-কে৷ তাঁর বিবিরা আমাদের গরম গরম পরোটা এবং আন্ডার ভুজিয়া আর ইদরখ দেওয়া চা দিয়ে প্রাতরাশ করালেন৷
নাজিম সাহেব বললেন, ঠিক সন্ধে ছ-টার সময় আমি গাড়ি নিয়ে পৌঁছাবো পূর্বাচলে৷ আপনারা ছোঁড়পুত্তুনরা যেন একদম রেডি হয়ে থাকেন৷ কারণ গাড্ডি লাজোয়ার এই প্রথমবার শিকারে আমাদের বাহন হবে৷
অতএব আমরা নাস্তা করে সাইকেল রিকশা করে পূর্বাচলের দিকে চলে গেলাম৷
* * *
গোপালের খিদমতকার চমনলালের রাঁধা মুগের ডালের খিচুড়ি আর আলুভাজা খেয়ে রাতজাগা আমরা দুপুরে ঘুমিয়ে নিলাম এবং তারপর বন্দুক, গুলি নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে নিলাম৷ ঠিক ছ-টার সময়ে যখন অন্ধকার হয়ে গেছে এবং তখনই প্রচণ্ড শীত, আমরা বন্ধ গেটের ওপাশ থেকে এক অদ্ভুত প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর আওয়াজ পেলাম৷ নাজিম সাহেবের লাজোয়ার গাড়ির হর্ন থেকে উদ্গত তীব্র ধাতব আওয়াজে আমাদের কান প্রায় বিদীর্ণ হওয়ার অবস্থা৷ তাড়াতাড়ি বারান্দায় পৌঁছেই দেখলাম একটি আজব হুডখোলা গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ আর ধক ধক করে তার ইঞ্জিন চলছে৷ সাইলেন্সার পাইপ থেকে দুর্বাসা মুনির চোখের মতো আগুন উগরাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে আরও দুবার সেই গাড়ির হর্ন বেজে উঠল অতিকায় বনমোরগের ডাকের মতো কঁকর ক র র করে৷
দেখলাম নাজিম সাহেব হুডখোলা গাড়ির সিটে বসে আছেন৷ আমি ও গোপাল বন্দুক নিয়ে উঠে বসলাম পিছনের সিটে৷ ভুতো বসল সামনে৷
কিন্তু উঠে বসামাত্র কোনো অদৃশ্য জানোয়ার প্রচণ্ড জোরে আমার পেছনে কামড় বসাল৷ আমি বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই বুঝলাম আমার গ্যাবার্ডিন ট্রাউজার থেকে দেড় গিরে কাপড় কে যেন খামচে নিল৷
বহুদিনের শখ ছিল আমেরিকান আর্মি অফিসারদের শীতকালীন পোশাক যে কাপড় দিয়ে তৈরি হত সেই গরম কাপড় দিয়ে শীতকালীন একটি সাফারি স্যুট বানাব এবং সেই স্যুটটি পরেই আমি শিকারযাত্রায় বেরিয়েছিলাম৷
এই দুর্ঘটনাটি অনুধাবন করতে গিয়ে নাজিম সাহেবকে ঊষ্মার সঙ্গে প্রশ্ন করলাম—ই ক্যায়া হুয়া?
নাজিম সাহেব হেসে বললেন, ম্যঁয় ক্যায়া করু?
পিছনের সিটে গদি ছিল না, গাড়ির কয়েল স্প্রিং-এর উপরে উর্দু খবরের কাগজ গঁদের আঠা দিয়ে সাঁটা ছিল৷ সেখানে বসা মাত্রই সেই কয়েল স্প্রিং আমার পশ্চাদদেশ খিমচে ধরে আমার ট্রাউজারের দেড় গিরে কাপড় খেয়ে নিল৷ একে ওই শীত তারপর পিছনখোলা আমি—ঠান্ডায় মরে যাওয়ার উপক্রম হল৷
নাজিম সাহেব বললেন, শিকার কী গাড্ডি এইস্যা হি হোতাই হ্যায়৷ ই গাড্ডি লা জবাব হ্যায়৷
গাড়ি তো চলতে লাগল সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে আগুন ছেটাতে ছেটাতে৷ একটু চলার পর লক্ষ করলাম, হেডলাইটের আলো একবার ডানদিকে পড়ছে একবার বাঁদিকে পড়ছে৷
গোপাল বলল, ই ক্যায়া হো রহা হ্যায়?
নাজিম সাহেব বললেন, ই মামুলি গাড্ডি নেহি হ্যায়৷ ই শিকার কা গাড্ডি হ্যায়৷ উসি লিয়ে ইক দফে রাস্তা আউর এক দফে জঙ্গল দিখাতা হ্যায়৷
আমরা কিছুদূর গিয়ে শহর ছেড়ে টুটিলাওয়ার দিকে চলতে লাগলাম৷ মাঝে মাঝেই শীতের রাতের ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের হার্টফেল করিয়ে নাজিম সাহেবের গাড়ির হর্ন ঘরন ঘরন করে আর্তনাদ করে উঠতে লাগল৷ তার একটু পরে দেখলাম ছোট-বড়ো নানা সাইজের ছুঁচো গাড়িময় দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে আমাদের গা-মাথা টপকে৷ আমি ও গোপাল সমস্বরে বললাম—আভভি ক্যায়া হো রহা যায়৷
নাজিম সাহেব ভূতোকে বললেন, অ্যাই ভুচু, তু বতলা রে সাব লোগোকো৷
ভুতো বলল, চিন্তার কিছু নেই৷ গাড়ি তো এতদিন রেস্টে ছিল৷ তাই গাড়ির বনেটের নীচে ছুঁচোরা সংসার পেতেছিল৷
তখন গোপাল বলল, এত জায়গা থাকতে বনেটের নীচে কেন?
ভুতো বলল, আহা, এই গাড়ির টায়ার তো সলিড রাবারের৷ দেশি ছুঁচোরা কি কখনো বিদেশি রাবার খেয়েছে? সেই রাবার খাওয়ার লোভেই এরা বনেটের নীচে সংসার পেতেছে৷ নেমে দেখলে দেখতে পাবেন যে টায়ারের মধ্যে অনেক গর্ত৷ ছুঁচোরা খাবলা, খাবলা করে রাবার খাওয়াতেই এই অবস্থা৷ চিন্তার কিছু নেই৷
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল যে সামনে বসা ভুতোর মাথাটা একবার উঁচু হচ্ছে, একবার নীচু হচ্ছে৷ রাতের জঙ্গলে অনেক সময় ভূতপ্রেতের উপদ্রব ঘটে থাকে, তাই আমরা আশ্চর্য হয়ে ভুতোর মাথা কেন উঠছে নামছে এ নিয়ে যখন চিন্তা করছি তখন গোপাল ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি রুখিয়ে৷
গাড়ি থামতেই ভুতো বলল, কই, আমার মাথা তো ঠিকই আছে, উঁচু-নীচু তো হয়নি৷ তারপরই ভুতো তার হিপপকেট থেকে এক ব্যাটারির টর্চ বের করে গাড়ির চাকা পরিদর্শন করেই হেসে উঠল৷ বলল, যেখানে যেখানে ছুঁচোরা বেশি বেশি করে রাবার খেয়েছে, সেখানে সেখানে অন্য গাড়ির চাকার রাবার কেটে গ্যাটিস লাগানো হয়েছে৷ গাড়ির চাকা যখন সেই গ্যাটিসের উপর চলছে তখন উঁচু হচ্ছে, আর তার পরই নীচু হচ্ছে৷ তাই আপনাদের মনে হয়েছে যে আমার মাথা উঠছে নামছে৷ চিন্তার কিছু নেই৷
আমরা তখন বাক্রুদ্ধ হয়ে গেছি৷ একটু পরেই সামনে একটি ছোট নদী পড়ল৷ নদীর উপরে কজওয়ে৷ এইসব পাহাড়ি জায়গায় হঠাৎ হড়পা বান আসায় নদীতে প্রচণ্ড জলের তোড় হয় এবং সেই জল যাতে কজওয়ের উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে সেজন্য পাহাড়ি নদী ও খালে এরকম কজওয়ে বানানো হয় ব্রিজের বদলে৷
নাজিম সাহেবের গাড়ি যখন সেই কজওয়ের উপর উঠল তখন হঠাৎ ড্রাইভার ইয়া আল্লাহ বলে চিৎকার করে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিল এবং গাড়ি কজওয়ে থেকে শীতকালের নদীর শুকনো বালিতে আছড়ে পড়ল এবং আমরা যাত্রীরা চারদিকে ছিটকে গেলাম৷
নাজিম সাহেব ড্রাইভারকে বললেন, হারামজাদে, হামরা লাজোয়ার গাড্ডিকো এহি হাল কিয়া তুমনে!
ড্রাইভার জবাবে অত্যন্ত রাগত গলায় বলল, হামারা জান সামালে গা ম্যঁয়, কী আপকা গাড্ডি সামালে গা?
কজওয়েটি সামান্য নীচু ছিল৷ তাই আমাদের কারও তেমন আঘাত লাগেনি৷ ভুতো বালির ওপর শায়িত অবস্থাতেই চেঁচিয়ে বলল, ড্রাইভার সাহেবের দোষ নেই৷ ওর পাজামা, থুড়ি, ছিঁড়ে যাওয়া আন্ডারওয়ারের মধ্যে একটা ছুঁচো ঢুকে গিয়েছিল৷ সে নিজের প্রাণ বাঁচাবে, না গাড়ি বাঁচাবে! গাড়িটি আরও এগোতে দেখা গেছে, চিন্তার কিছু নেই৷
—