রামলগন

রামলগন

ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জঙ্গলে বেতলার কথা সকলেই জানে৷ কারণ সেখানেই পালামৌ ন্যাশনাল পার্কের হেডকোয়ার্টার৷ চাঁদোয়াটোরি থেকে যে পথটি লাতেহার হয়ে ডালটনগঞ্জ শহরের দিকে চলে গেছে, সে পথেই ডালটনগঞ্জের সাত মাইল আগে একটি পথ বাঁদিকে ঢুকে গেছে জঙ্গলে৷ তারপর ঔরঙ্গি নদীর উপরের সাঁকো পেরিয়ে চলে গেছে বেতলার দিকে৷ ঔরঙ্গি সাঁকো থেকে ডানদিকে চাইলে চোখে পড়ে কেচকি বাংলোটি৷ সেই কেচকিতে ঔরঙ্গি আর কোয়েলের সঙ্গমস্থল৷ এই কেচকি বাংলো বিখ্যাত হয়ে গেছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির পটভূমি হিসাবে৷ এখানেই সৌমিত্র, শুভেন্দু, শমিত ভঞ্জ, রবি ঘোষদের দেখা গিয়েছিল বাংলোর ধারের কুয়োতে চান করতে৷

বেতলা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে গেলে চেকনাকা৷ সেই নাকা পেরিয়ে আরও এগিয়ে গেলে পথের ডানদিকে কিছুটা গিয়ে পড়ে বনবিভাগের বাংলো কেঁর৷ এই কেঁর ছাড়িয়ে আরও কিছুটা গেলে পড়ে চিপাদোহার৷ চিপাদোহারে খুব বড়ো রেলের ইয়ার্ড আছে৷ একসময় বাঁশ ও কাঠের ঠিকাদারেরা অগণ্য ট্রাকে করে বাঁশ ও কাঠ নিয়ে এসে ওয়াগনে লাদাই করতেন এবং সেখান থেকে বাঁশ ও কাঠ চলে যেত কলকাতার দিকে৷ অ্যান্ড্রু ইয়ুল অ্যান্ড কোং-এর পেপার মিল ছিল কলকাতার কাছেই৷ সেই সাবসিডিয়ারি কোম্পানির নাম ছিল আই পি পি৷ ইন্ডিয়ান পেপার পাল্প৷ আমাদের মক্কেল এম এল বিসোয়াস অ্যান্ড কোং পালামৌয়ের বাঁশের জঙ্গলের মনোপলি লিজ নিয়েছিলেন৷ এবং তাঁদের সংগৃহীত বাঁশ সবই আই পি পি কোম্পানি নিয়ে নিতেন৷ এই এম এল বি মানে মুকুন্দলাল বিসোয়াসের বড়ো ছেলে আর কে বি যার ডাকনাম ছিল মোহন, সে-ই সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী-র শুটিং-এর পুরো বন্দোবস্ত করেছিল৷ মোহনকে লোকে বলত ‘প্রিন্স অব পালামৌ’৷ সে আমাকে বড়োভাই মানে বড়োদাদা বলে সম্বোধন করত এবং পালামৌ সম্বন্ধে আমার যা কিছু লেখালেখি, সবই ওর দাক্ষিণ্যে সম্ভব হয়েছিল৷ পালামৌয়ের পটভূমিকায় কোয়েলের কাছে, কোজাগর এবং আরও অনেক লেখা সম্ভব হত না মোহনের অদৃশ্য সাহায্য ছাড়া৷ পালামৌ থাকাকালীন বিভিন্ন বাংলো, গাড়ি এবং অন্যান্য সব কিছু দিয়ে সাহায্যের জন্য মোহনের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব৷ সে অবশ্য চলে গেছে আজ বেশ কয়েক বছর হল৷

এ লেখা লিখতে বসেছি রামলগনকে নিয়ে৷ রামলগন ছিল ওই কেঁর বাংলোর চৌকিদার৷ সে ছিল জাতিতে ওঁরাও৷ কিন্তু তার চেহারা ও গড়ন ছিল আফ্রিকানদের মতো৷ পূর্ব আফ্রিকাতে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭৯-তে৷ সেই পটভূমিতে আমার পঞ্চম প্রবাস, গুগুনোগুম্বারের দেশে, রুআহা উপন্যাস রচিত হয়েছিল৷ তখন আফ্রিকা ও পুব আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতিদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছিল৷ সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম রামলগনের টরসো-র সঙ্গে আফ্রিকানদের টরসো-র আশ্চর্য মিল! রামলগন মনোসিলেবল-এ কথা বলত৷ দীর্ঘ বাক্য কখনো ব্যবহার করত না৷ রাইফেল হাতে আমি যখন জঙ্গলের গভীরে একা একা ঘুরে বেড়াতাম, তখন রামলগন অধিকাংশ সময়ে আমার সঙ্গে থাকত৷ বন্য প্রাণী সম্বন্ধে ওর যে কত গভীর জ্ঞান, তা আমি প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারতাম৷ জঙ্গলে পথপ্রদর্শক হিসেবেও ও ছিল অতি চমৎকার৷ শিকারিও ছিল সে সুদক্ষ৷ তবে শিকার আমি করতাম৷ ও থাকত সঙ্গে, আমার ছায়াসঙ্গী হিসাবে৷ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি বই আছে—ব্লু হিলস অব আফ্রিকা৷ সেটিতে ‘ড্রুপি’ বলে একটি চরিত্র ছিল, যে হেমিংওয়ের সঙ্গে পায়ে হেঁটে আফ্রিকাতে শিকার করত৷ এই ড্রুপির বর্ণনার সঙ্গে আমি রামলগনের খুবই মিল খুঁজে পেতাম৷ রামলগন জুতো পরত না৷ খালি পায়ে থাকত এবং বাংলোর সিমেন্ট করা মেঝেতে সে হাঁটলে তার পায়ের তলার পুরু চামড়ার ঘষটানিতে খস খস আওয়াজ শোনা যেত৷ তার ঝুলিতে ছিল অনেক গল্প৷ লণ্ঠনের আলোতে অথবা চাঁদনি রাতে আমি কেঁর বাংলোর বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকতাম আর রামলগন বসে থাকত আমার পায়ের কাছে বাধ্য কুকুরের মতো৷ অনর্গল সে বলে যেত তার জঙ্গলের জীবনের অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা৷ অন্ধকার রাতে ঝিঁ ঝিঁ ডাকত করতালির মতো শব্দ করে৷ পশ্চিম আকাশে লাল-সবুজাভ সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করত৷ বহুদূর অরণ্যের মধ্যে হাইডাল প্রোজেক্টের উজ্জ্বল নীল আলো জ্বলে উঠত৷ বিভিন্ন রাতচরা পাখি ডেকে ফিরত অন্ধকার মথিত করে৷ তার মধ্যে প্রধান ছিল পিউ কাঁহা পাখিদের বুকে চমক তোলা ডাক৷ সেই ডাকের তীব্রতার জন্যই সাহেবরা এর নাম রেখেছিল ‘ব্রেন ফিভার’৷ আরও ছিল রেড এবং ইয়োলো ল্যাপ উইং পাখিদের উদাস করা ‘ডিড ইউ ডু ইট’, ‘ডিড ইউ ডু ইউ’, ‘ডিড ইউ ডু ইট’ ডাক৷ এই পাখিরা পাহাড়ি নদীর নদীখাতের দু-পাশে থাকত আর নিরন্তর প্রশ্ন করত ‘ডিড ইউ ডু ইট’ বলে৷ কাকে যে তাদের জিজ্ঞাসা এবং কীসের জিজ্ঞাসা তা জানার কোনো উপায় ছিল না৷ বনের মধ্যে কোনো নড়াচড়া দেখলেই সে মানুষেরই হোক অথবা কোনো শ্বাপদের, তারা এভাবে ডাকতে ডাকতে, লম্বা লম্বা পা ঝুলিয়ে, মাথার ওপর দিয়ে ক্রমাগত উড়ে যেত৷ তাদের সেই ডাক রাতের বনের রহস্যময়তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিত৷ রামলগন অনেক ভূতের গল্পও বলত৷ এক ধরনের ভূত ছিল যারা নির্জন পথে পথিকের সামনাসামনি হলেই পথিককে কুস্তি লড়ার আহ্বান করত এবং রণপায়ে চড়া মানুষের মতো অত্যন্ত লম্বা হয়ে যেত৷ যদি কোনো পথিক কুস্তি লড়তে রাজি না-থাকত, তবে তারা নাকি তাকে মেরে ফেলত!

পালামৌয়ে গ্রীষ্ম অতি প্রখর এবং এপ্রিলের প্রথমেই জঙ্গলের মধ্যে জলের সব উৎসই প্রায় শুকিয়ে আসত৷ তখন হাতির দল বাংলোতে এসে কুয়ো থেকে জল খেত৷ বাংলোর হাতার মধ্যেই কতগুলো বয়রা গাছ ছিল৷ তার ফল খেতে রাত্রিবেলা আসত কোটরা হরিণেরা৷ শম্বরের দল ‘ধ্বাক, ধ্বাক’ আওয়াজ করে বাংলোর চারপাশে জলের খোঁজে ঘুরে বেড়াত৷ সেই সময় বনবিভাগ তৃষ্ণার্ত প্রাণীদের জল খাওয়ানোর জন্য ট্রাকের ওপর জেনারেটার বসিয়ে কুয়ো বা নদী থেকে জল পাম্প করে তুলে মোটা পাইপে করে ছড়িয়ে দিত আর বন্য প্রাণীরা মানুষের ভয় ত্যাগ করে কাছে এসে সেই জল খেত তৃষ্ণা নিবারণের জন্য৷

একবার আমি একটি উপন্যাস লেখার জন্য এপ্রিলের গোড়াতে কেঁর বাংলোয় গিয়ে কিছুদিন ছিলাম৷ তখন উগ্রবাদীদের খুব দৌরাত্ম্য ছিল ওই অঞ্চলে এবং শেষ বিকেলে উগ্রবাদী ছেলেদের সমবেত সংগীত হাততালির সঙ্গে ভেসে আসত দূরের জঙ্গল থেকে৷ পুরো বাংলোয় আমি থাকতাম একেবারে একা৷ যদিও আমার ভয়ডর বলে কোনো বস্তুই ছিল না কৈশোরকাল থেকে, কিন্তু তবুও অনেকেই সাবধান করে দিতেন আমাকে ওই উগ্রবাদীদের সম্বন্ধে৷ কিন্তু আমাকে কোনোদিন উগ্রবাদীরা উত্ত্যক্ত করেনি৷ বিরাট বাংলোয় একেবারেই একা থাকতাম৷ রামলগন থাকত তার কোয়ার্টারে৷ পুবের আলো ফুটলে সে আসত চা নিয়ে আমার খোলা দরজার মধ্য দিয়ে৷ উগ্রবাদীরা কেন আমার কোনো ক্ষতি করেনি, তার কারণ আমি জানি না৷ উগ্রবাদীদের মধ্যে বাংলা পড়তে জানা এবং শিক্ষিত বহু ছেলেরাও ছিল৷ হয়তো তারা আমার লেখা পড়েছিল বলেই আমাকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখত৷ নইলে কেঁরের অদূরেই একরাতে মুনলাইট পিকনিক করে ফিরে যাওয়া বনবিভাগ এবং পুলিশের কিছু অফিসারের জিপে তারা আক্রমণ চালাত না এবং সে আক্রমণে বি এফ ও সাহেবের নিজের ড্রাইভার ও আরও তিনজন মারা যেতেন না৷

একটা শীর্ণ পাহাড়ি নদীর কালভার্টের নীচের উগ্রবাদীরা মাইন পেতে রেখেছিল৷ এবং যে মুহূর্তে বনবিভাগের জিপ সেই কালভার্টের ওপর ওঠে, সেই মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটে এবং জিপটি প্রায় টুকরো টুকরো হয়ে যায়৷ যে উপন্যাসটি আমি সেবার লিখেছিলাম তার নাম বাসনাকুসুম৷ সে উপন্যাসের পটভূমি ছিল অন্য৷ কেঁর ছিল না৷ ছিল পালামৌয়ের অন্য আর একটি অঞ্চল, যার নাম ছিল মহুয়ামিলন৷

সন্ধের পর আমি বারান্দায় বসে থাকতাম আর রামলগন তার নানা অভিজ্ঞতার কথা বলে যেত৷ দূরের হাইডাল প্রজেক্টের তীব্র নীলাভ আলোর দিকে চেয়ে বসে থাকতাম আমি স্বপ্নাবিষ্টের মতো আর রামলগনের গল্প শুনতাম৷ শেষবার যখন কেঁর-এ যাই তখন গিয়ে দেখি, যে একসার জ্যাকারান্ডা গাছ ছিল বাংলোর ড্রাইভওয়েতে, সেগুলো আর নেই৷ শুনলাম, বনবিভাগের বড়োবাবুর নির্দেশে সেগুলি কেটে ফেলা হয়েছে৷ আমার কাছে কেঁর বাংলোর প্রধান আকর্ষণই ছিল ওই জ্যাকারান্ডা গাছ৷ তাদের ফিকে বেগুনি রঙের ফুলের সমারোহ আমাকে আচ্ছন্ন করত৷ মার্কিন কবি এমারসনের লেখা চারটি পঙ্ক্তির কথা তখন মনে পড়ত৷

Bold as the engineer who fells the wood,

And travelling often in the cut he makes–

Love not the flower they pluck, and know it not,

And all their botany is Latin names.

রামলগন খুবই গরিব ছিল৷ তার স্ত্রী এবং সন্তানেরা পালামৌতেই এক গ্রামে থাকত৷ সে গ্রামের নাম চাহাল চুমরু৷ সেবারই গিয়ে জানতে পাই যে, রামলগন মারা গেছে৷ যদিও কেঁর বাংলোতে আমি কম করে পঁচিশবার গিয়ে থেকেছি বিভিন্ন ঋতুতে, রামলগনের স্ত্রী বা তার সন্তানদের কখনো দেখতে পাইনি৷ আমি জানি না এবং সে সময়েও জানতাম না যে, তারা কেমন আছে আর কী করছে৷ আমাদের দেশের কোটি কোটি গরিব মানুষেরা যারা জঙ্গলেই জন্মায়, জঙ্গলেই জীবন কাটায়, তাদের পরিণতি বোধ হয় এমনই হয়৷ তাও তো রামলগনের একটি সরকারি কাজ ছিল৷ লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের কোনো স্থায়ী চাকরি থাকে না৷ তারা জঙ্গলে কুপ কেটে অথবা গতর খেটে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটায়৷ রামলগন আমাদের অগণিত দেশবাসীর একজন প্রতিভূ৷ আমাদের মধ্যে কমজনই রামলগনদের কথা জানে বা ভাবে৷ এইটাই সবচেয়ে দুঃখের কথা৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *