শিউলি ফুল
আমাদের হাজারিবাগের বাড়ির পাশে মাধব জ্যাঠার বাড়ি ছিল৷ কাণহারি হিলের পায়ের কাছে ঘন সবুজ শালজঙ্গলের মধ্যে ছিল সেই দুটি বাড়ি৷ সেই শালবনের ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ টিয়া হাওয়াতে চাবুক মেরে, নীল আকাশের বুক চিরে উড়ে যেত সীতাগড়া পাহাড়ের দিকে৷ বাড়ির সামনে দিয়ে লাল মাটির রাস্তা চলে গেছিল কোররার মোড়ের দিকে৷ সেখানেই বাস রাস্তা৷ সেটি চলে গেছিল হাজারিবাগ শহরের দিকে৷ সে রাস্তার অন্য মুখ ছিল বগদরের দিকে টাটাঝারিয়া হয়ে৷
মাধব জ্যাঠার ছোটো মেয়ের নাম ছিল শিউলি৷ দেখতে সে ছিল শিউলি ফুলেরই মতো৷ ধবধবে ফর্সা, লাল ঠোঁট, ফ্রক পরা, দু-দিকে দুটি বিনুনি ঝোলানো৷ ভারী উজ্জ্বল, কিন্তু শান্ত এই মেয়েটি ছিল আমার খেলার সাথি৷ তখন আমাদের দুজনেরই বয়স দশ-বারো বছর হবে৷ আমরা দুজনে হাত ধরাধরি করে বনে-পাহাড়ে, কাণহারি পাহাড়ের নীচের তিতির ভরা খোয়াইয়ে ঘুরে বেড়াতাম৷ স্মিথ সাহেবের বাড়ি ছিল সেই খোয়াইয়ের শেষে বরহি রোডের ওপরে৷ তাতে ফিকে গোলাপি রঙের একটা ফুলের গাছ ছিল৷ তার নাম আমি জানতাম না, কিন্তু গাছটাকে আমরা দুজনে বড়ো ভালোবাসতাম৷ স্বপ্নের মতো ছিল সেই ফুলগুলো৷ শিউলির সঙ্গে দেখা হলেই আমি বলতাম, ভাব ভাব শিউলি ফুল আর রবি ঠাকুরের সেই গানটি গাইতাম—
‘‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল৷
রাতের বায় কোন মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল৷
কেন রে তুই উন্মনা! নয়নে তোর হিমকণা৷
কোন ভাষায় চাস বিদায়, গন্ধ তোর কী জানায়—
সঙ্গে হায় পলে পলেই দলে দলে যায় বকুল৷’’
শিউলি রবি ঠাকুরের অনেক গান জানত৷ আর জানত ব্রহ্মসঙ্গীত৷ ওরা ব্রাহ্ম ছিল৷ ওর মামার বাড়ি ছিল গিরিডিতে৷ প্রায়ই গিরিডিতে যেত আর ফিরে এসে আমার কাছে গল্প করত উশ্রী নদী, খাণ্ডুলি পাহাড়, শালবন আর সিরসিয়া ঝিলের৷ গিরিডিতে অনেক বড়ো বড়ো ব্রাহ্মদের বাড়ি ছিল৷
আমাদের গাড়ি ছিল না কিন্তু মাধব জ্যাঠাদের গাড়ি ছিল৷ আমি শিউলির সঙ্গে একবার বরহি রোডের ওপরে ঝুমরি তিলাইয়ার কাছে রাজডেরোয়ার ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলাম৷ এই ন্যাশনাল পার্কেরই আরেক নাম ছিল হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্ক৷ রাজডেরোয়া মানে হল রাজার ডেরা৷ এখানে ঢোকার গেটের পাশে ছিল পদ্মার রাজার বিশাল সাদারঙা প্রাসাদ৷ চাঁদনি রাতে সেই প্রাসাদ কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাত! রাজডেরোয়ার মধ্যে বাঘ ধরবার জন্য একটা বিরাট কুয়ো খোঁড়া ছিল৷ তাতে জল ছিল না৷ সেই কুয়োর ওপরে পাতলা বাঁশের চাটাই পেতে, তার ওপরে হালকা ডালপালা ও পাতার আচ্ছাদন দেওয়া থাকত এবং মধ্যিখানে একটি পাঁঠাকে বেঁধে রাখা হত৷ বাঘ সেই পাঁঠা ধরার জন্য যেই মাচার ওপর উঠত, অমনি মাচা ভেঙে নীচে গর্তে পড়ে যেত এবং সেখান থেকে উঠতে না পেরে তর্জন-গর্জনে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে দিত৷ সেই কুয়ো থেকে একটা সুড়ঙ্গ উঠে এসেছিল ওপরে যার মুখে একটা লোহার খাঁচা পাতা থাকত৷ তিন-চার দিন কিছু খেতে না পেয়ে এবং জলও না খেতে পেয়ে বাঘ কাহিল হয়ে পড়ত৷ তখন সেই খাঁচাটার সামনের দিকে একটি পাঁঠাকে ঢুকিয়ে রাখা হত এবং সুড়ঙ্গের মুখে যে লোহার ফটকটি ছিল সেটি ওপর থেকে তুলে দেওয়া হত৷ বাঘ যখন সেই সুড়ঙ্গ বেয়ে উঠে পাঁঠাটিকে ধরার জন্য খাঁচার ভেতরে ঢুকত, তখনই পাঁঠার কাছে পৌঁছোবার আগেই খাঁচার মধ্যের দরজাটি ওপর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হত এবং বাঘ খাঁচার মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ত৷ তখন রাজার অনেক অনুচর একসঙ্গে মিলে সেই খাঁচাটিকে তুলে টেনে মাটির ওপরে আনত৷ এই সব বাঘ বিক্রি হত নানা চিড়িয়াখানায়৷ তা ছাড়া আগেকার দিনের রাজা-মহারাজাদের অনেকেই বাঘ পুষতেন৷ তাঁদের মধ্যেই কেউ কেউ এই বাঘ কিনে নিতেন পোষার জন্যে৷
রাজডেরোয়াতে আমরা কোনও বাঘ দেখতে পাইনি৷ তবে অনেক নীলগাই, সম্বর, কোটরা, চিতল হরিণ, বুনো শুয়োর, ময়ূর ইত্যাদি দেখেছিলাম৷ শুনেছিলাম, রাতের বেলা এলে নাকি চিতা বাঘও দেখা যায়৷ সেই সময়ে সেখানে বড়ো বাঘ দেখা যেত না৷ পার্কের মধ্যে একটি জলাশয় ছিল, বন-বিভাগের বানানো৷ তার পাশে একটি ক্যান্টিনও ছিল৷ মনে আছে সেখানে আমরা পরোটা আর মুরগির মাংস খেয়েছিলাম৷ রাজডেরোয়ার মধ্যেই একটি ছোটো কিন্তু খরস্রোতা নদী ছিল৷ যার নাম ছিল হারহাদ৷ সেই নদীর উপর একটি ছোটো বাংলোও ছিল৷ বাংলোর লাগোয়া বারান্দায় বসে নীচে নদীর শোভা দেখা যেত এবং গর্জন শোনা যেত৷ বর্ষাকালে সেই নদীর রূপই হত আলাদা৷
একবার আমি কলকাতাতে এসেছি পুজোর সময় আমার মামার বাড়িতে, কলকাতার পুজো দেখার জন্য৷ কালীপুজো এবং ভাইফোঁটারও পর কলকাতা থেকে যখন হাজারিবাগে ফিরে গেলাম, মনে হল হাজারিবাগ আর সেই হাজারিবাগ নেই৷ শিউলি মাধব জ্যাঠাদের সঙ্গে চাইবাসার কাছে কুন্দ্রুনাওটুতে গেছিল মুন্ডাদের একটি উৎসবে৷ সেখানে মশার কামড় খেয়ে, সে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া নিয়ে হাজারিবাগে ফিরে আসে এবং পাঁচদিন অসহ্য মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করে মারা যায়৷ আমি হাজারিবাগে ফেরার আগেই শিউলিকে দাহ করা হয়৷ এরপর আমি ওদের বাড়ি গিয়ে ওর বাবা, মার মুখের দিকে চাইবার সাহস হারিয়ে ফেলি৷ আমার কাছে শেষ আশ্বিনের রোদ ঝলমল হাজারিবাগ অন্ধকার হয়ে যায়৷ আমি কাণহারি পাহাড়ের নীচের জঙ্গলে, একা একা ঘুরে সেই গানটি গাইতাম৷
‘‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল৷
রাতের বায় কোন মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল৷
কেন রে তুই উন্মনা! নয়নে তোর হিমকণা৷
কোন ভাষায় চাস বিদায়, গন্ধ তোর কী জানায়—
সঙ্গে হায় পলে পলেই দলে দলে যায় বকুল৷’’
—