সাধের গাডোয়াল

সাধের গাডোয়াল

সাধের গাডোয়াল! তবে শুরু থেকেই বলি৷ আজ থেকে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেকার কথা৷ কলকাতার আশেপাশে তখন অনেক জলাজমি, বাদা, আবাদ ও জঙ্গল ছিল৷ কলকাতা তখন এমন বহুধা-বিস্তৃত মানুষ কিলবিল করা হতকুৎসিত জায়গা মোটেই ছিল না৷

সাইকেলে চড়ে বেহালা, টালিগঞ্জ বা গ্যালিফ স্ট্রিট ট্রাম ডিপো থেকে একটু গেলেই বাঁশঝাড়, ডোবা, পুকুর, পাখি দেখতে পাওয়া যেত৷ অনেক সুন্দর ছিল তখন কলকাতা৷ এত মানুষও ছিল না, এমন অশান্তিও ছিল না৷

ডাঃ বিধান রায় যখন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী, তখন সোনারপুরের বিরাট অঞ্চলকে শুকিয়ে ফেলা হয়৷ তার আগে ওই আদিগন্ত জলাতে পাখি শিকারের বড় সুবিধে ছিল৷ দেশ-বিদেশ থেকে কতরকম হাঁস যে উড়ে আসত ওখানে শীতকালে তা বলার নয়৷ গাডোয়াল, পিন-টেইল, পোচার্ড, অনেক রকমের টীল, নাকটা, রাজহাঁস আরও কত কী জলের পাখি৷

স্কুলে পড়ি৷ শীতকালে প্রতি রবিবারে সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া সেরে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম বন্দুক আর গুলির থলে, জলের বোতল, সামান্য কিছু কমলালেবু, কাজুবাদাম ইত্যাদি নিয়ে৷ এখন ক্যানিয়ের রাস্তায় যেখানে মালঞ্চ ফাঁড়ি আছে পুলিশের, তার উলটো দিকে একটা কাঁচা পথ ছিল একবারে জলার মুখ অবধি৷ এক চেনা ভদ্রলোকের বাড়ির পাশে বাবা গাড়িটা রাখতেন৷ সেই বাড়ির বাইরের ঘরে একজন ভদ্রলোক টেবিল-চেয়ারে বসে ফুলসক্যেপ কাগজে পাতার পর পাতা অংক করতেন৷ প্রত্যেক রবিবারই ওঁকে দেখতাম আর ভদ্রলোকের উপর ভক্তি বেড়ে যেত৷ পরে বাবার কাছে শুনেছিলাম যে, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় বসতে হলে নাকি ওইরকম রিম রিম পাতায়, মাথা-ঝিমঝিম অংক কষতে হয় সামনে টাইমপিস রেখে ঘড়ির কাঁটার উপর এক চোখ সেঁটে৷

যাই হোক, বাবার এক বন্ধু মনোরঞ্জন কাকু শনিবার বিকালে ফোন করে বাবাকে বললেন, ‘‘দাদা, খবর পেলাম যে গাডোয়াল পড়েছে৷ আপনার সোনারপুরে৷ সাধের গাডোয়াল৷ আমি কোনোদিনও সোনারপুরে যাইনি৷ আমাকে নিয়ে চলুন, শিকার করে আসি৷’’

বাবা বললেন, ‘‘কাল সকালে ফেনাভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়া যাবে৷ তুমিও চলে এসো আমাদের এখানেই৷ একসঙ্গেই বেরোব৷’’

আমার মাসতুতো ভাই গজেন বেড়াতে এসেছিল শনিবারে পাইকপাড়া থেকে৷ গাডোয়াল শিকারের কথা শুনে ও বলল, আমিও যাব৷ আমি বাবাকে ওর হয়ে ভয়ে-ভয়ে রিকোয়েস্ট করলাম৷ যাই হোক বাবা রাজি হয়ে গেলেন৷ সেই রবিবার সকাল থেকে মায়ের প্রচুর টেনশান৷ সকাল-সকাল ফেনাভাত, ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ সবকিছু বন্দোবস্ত করা৷ তার উপর বর্মনকাকুও খেয়ে যাবেন৷ সকালে আমরা যখন খাওয়ার টেবিলে ফেনাভাত খাচ্ছি, মা বললেন বর্মনকাকুকে, ‘‘কী যে নিরপরাধ পাখিগুলোকে মারেন৷’’

বর্মনকাকু রাইট-ইনে ফুটবল খেলতেন৷ চট করে রাইট-আউটে বাবাকে বলটা পাস করে দিয়ে বললেন, ‘‘দাদার যত হুজুগ৷ আমি ও বৌদি এসব পছন্দ করি না৷’’

বাবার মুখে ডিমসেদ্ধ থাকায় বাবা প্রতিবাদও করতে পারলেন না৷

গজেন বলল, ‘‘তুমি এসব বুঝবে না মাসি, শিকার—সে পাখি শিকারই হোক আর বাঘ শিকারই হোক, কী যে উত্তেজনা তোমাকে কী বলব৷’’

মা বললেন, ‘‘তুই চুপ কর তো! তুই বন্দুক ছুড়েছিস কখনও৷ দাঁড়া, তোর মাকে ফোন করছি৷’’

গজেন পাইকপাড়ার ছেলে৷ সহজে দমবার পাত্র নয়৷ সে বলল, ‘‘আমি কখনও ছুড়িনি, কিন্তু কালই প্রথম ছুড়ব৷’’ মা বললেন, ‘‘কখনও ছুড়িসনি তো যাওয়ার দরকার কী৷ জলে পড়ে-টড়ে গেলে কী হবে?’’

গজেন বলল, ‘‘হেদোতে সাঁতার কাটি না আমি? ঠিক পাড়ে আসব৷ তা ছাড়া আমি তো চামচা—শিকারি তো ওই বসে৷’’

বলেই আমাকে দেখাল৷ গজেনটা একেবারে বখে গেছে৷ মা-বাবা, বর্মনকাকুর সামনেই এমন করে কথা বলছে! কোনো মান্যি-গণ্যিই নেই৷

বাবা একবার মায়ের দিকে তাকালেন; মা বাবার দিকে৷ আমি ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম—পাছে গজেনের বখামির অপরাধে আমার শাস্তি হয়৷

এমন সময় ফোনটা বাজল৷ মা ফোনটা ধরে কথা বলতে লাগলেন মাসির সঙ্গে৷ তারপর ‘‘আচ্ছা’’ বলে রেখে দিলেন৷ ফোন ছাড়ার আগে বললেন, ‘‘না-না, তোমার কোনো ভয় নেই দিদি৷ তোমার ভগ্নীপতি সঙ্গে থাকবেন’’৷ আবারও বললেন, ‘‘না-না নৌকোয়—যাবেই না৷’’

তারপর ফোন রেখেই বাবাকে বললেন, ‘‘দিদি বিশেষ করে মানা করছেন গজেনকে যেন নৌকায় না নেওয়া হয়৷’’

বাবা বললেন, ‘‘তাহলে গজেন গিয়ে কী করবে?’’

গজেন বলল, ‘‘মেসোমশায়, নৌকায় যেতে যদি মা মানা করে থাকেন, তাহলে ডাঙা থেকেই শিকার দেখব৷ ডাঙায় বসে ফড়িং দেখব, পাখি-ওড়া দেখব—তোমার বাইনাকুলারটা আমাকে দিয়ে যাবে৷’’

বাবা বললেন, ‘‘তা মন্দ বলিসনি৷ তারপর মাকে বললেন, ‘‘শুনছ, ও সারাদিন ডাঙায় থাকবে, ওর জন্যে বেশি করে খাবার-টাবার দিয়ে দাও৷’’

মা বললেন, ‘‘বুঝেছি৷ দোষ হল আমার বোনপোর আর খাবে সকলে৷ অনেক খাবারই দিয়েছি৷ ডালমুট, সন্দেশ, স্যান্ডউইচ, পাটিসাপটা আর কাজুবাদাম৷ কমলালেবুও আছে৷ ফ্লাস্কে তোমার জন্যে চা আর ওদের জন্যে দুধ৷’’

বাবা বললেন, ‘‘ও মা! কাল যে ফ্লুরি থেকে অত কেক আনালাম৷’’

মা বললেন, ‘‘তাও দিয়েছি যথেষ্ট পরিমাণে৷’’

বর্মনকাকু ঠাকুরকে ডেকে গাডোয়ালের রোস্টটা কেমন করে করবে, তার ডিরেকশান দিচ্ছেলেন৷ বাবা কটা গাডোয়াল পাওয়া যাবে শিকারে, তারই এস্টিমেট তার আগেই করে ফেলেছিলেন এবং বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যাঁদের গাডোয়ালের রোস্ট খেতে নেমন্তন্ন করবেন তাঁদেরও ফোনে বলে দিচ্ছিলেন৷ প্রত্যেককে বলছিলেন, আসিস কিন্তু নিশ্চয়ই৷

মা বললেন, ‘‘অতজনকে খেতে বলবে যখন, তখন ঠাকুর কেন, আমি নিজেই করব এখন রোস্ট৷ তোমরা কটা নাগাদ ফিরবে বলো?’’

বর্মনকাকু বললেন, ‘‘দেরি কিসের৷ মেরেছি আর ফিরছি৷’’ বাবা বললেন, ‘‘না-না, এখানে ফিরতে-ফিরতে ধরো সন্ধে সাতটা হয়ে যাবে৷’’

মা বললেন, ‘‘অত অল্প সময়ের মধ্যে কাটাকুটি, ছাল ছাড়ানো, তোমার বন্ধুদের কাল খেতে বলো না?’’

বর্মনকাকু বললেন, ‘‘কিছু ভয় পাবেন না বৌদি৷ মশলা-টশলা রেডি রাখুন, আমি নিজে তৈরি করে দেব—কাটাকুটির জন্যে ভাববেন না একটুও৷ খাওয়া-দাওয়া কি সোমবারে ভালো জমে? আজই ভালো, আমার দাদার তো জানেনই, উঠল বাই তো কটক যাই৷’’

* * *

আমরা যখন সোনারপুরে গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন যথারীতি সি-এ পরীক্ষার ছাত্র ভদ্রলোক মুখ গুঁজে অঙ্ক কষছিলেন৷ হঠাৎ আমার খেয়াল হল ওঁকে অনেক বছর ধরে ওইরকম দেখছি প্রতি শীতে৷ বর্মনকাকুকে জিজ্ঞেস করতে বাবা বললেন, ‘‘এ পরীক্ষা দিয়ে যাওয়াটাই ছাত্রদের কর্তব্য৷ পাশ করা, ফেল করা নাকি তাদের নিজেদের ইচ্ছাধীন বা হাতের নয়৷’’

গাড়ি পার্ক করিয়ে রাইফেল-বন্দুক কাঁধে হেঁটে এলাম আমরা জলের ধার অবধি৷ গজেন উত্তেজিত৷ আমার কাঁধে ঝোলানো পয়েন্ট টু-টু রাইফেলটার বাঁটে কেবলই হাত ছোঁয়ায় আর বলে, ‘‘আমাকে ছুড়তে দিবি বলেছিস, দিবি তো? না দিলে কিন্তু পাইকপাড়ায় ঢুকতে পারবি না৷’’

আমি যতই ইশারা করে ওকে চুপ করে থাকতে বলি ততই ও গ্রাহ্য করে না৷ জলের ধারে এসে দেখা গেল মাত্র একটা তালের ডোঙা জলের কিনারায় বাঁধা আছে৷ তালের ডোঙা কাকে বলে তোমরা অনেকে হয়তো জানো না৷ তালগাছের শরীর কুরে নিয়ে তার আধখানা খোল দিয়ে ক্যানোর মতো নৌকো৷ এই নৌকোগুলো ছোট-ছোট হয় এবং এতে চড়তে আর সার্কাসের ছাতা হাতে তারের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে প্রায় একই রকম ব্যালান্স লাগে! একটু এদিক-ওদিক হলেই সর্বনাশ৷ বাবা ও বর্মনকাকু দুজনে মিলে এক কুইন্টাল নব্বই কেজি! আমার ওজন চল্লিশ কেজি৷ গজেন যাবে না৷ কিন্তু নৌকো যে বাইবে, তারও ওজন আছে৷ সবসুদ্ধ চারমণ৷

তালের ডোঙাতে মাত্র একজন শিকারি ওঠেন আর যে চালায় সে৷ কিন্তু একটার বেশি ডোঙা নেই৷ কিন্তু যে চালাবে সেও নেই৷

এমন সময় বর্মনকাকু দূরবিন থেকে চোখ নামিয়ে বললেন, ‘‘দাদা দেখুন! গাডোয়াল!’’ দূরে আমি দেখলাম এক ঝাঁক হাঁস পূর্ব থেকে পশ্চিমে উড়ে যাচ্ছে জলার উপর দিয়ে৷ যে-কোনো পাখির মেলে দেওয়া ডানা ও উড্ডীন ঝাঁকের ফরমেশান এবং ওড়ার ছন্দ দেখে সহজেই বোঝা যায় কী পাখি, বহু দূর থেকেই৷ বাবা খুশি হয়ে বললেন গাডোয়ালের ঝাঁক দূরবিনে দেখার পর, ‘‘বর্মন, এই প্রথম তুমি আমাকে ফলো করোনি!’’

বর্মনকাকু হাসছিলেন৷ হঠাৎ বললেন, ‘‘আমার বড় ভয় করছে৷’’

‘‘কেন? কীসের ভয়?’’ বাবা শুধোলেন৷

‘‘না৷ যা হাই-ভোল্টেজ রেজিস্টেন্স৷’’

‘‘কী ব্যাপার?’’ বাবা অবাক হয়ে শুধোলেন আবার৷

বর্মনকাকু বললেন, ‘‘বৌদি বাড়িতে৷’’

বলেই, দুজনে হো-হো করে হেসে উঠলেন৷

এমন সময় ঘাটের কাছেই একটা পানকৌড়ি উড়ে এসে বসল আর একটা বাঁশের খোঁটার উপর৷ গজেন তখন একটা কাটা তালগাছের গুঁড়িতে বসে ছিল৷ পায়ের উপর পা তুলে বিজ্ঞর মতো, যেন জ্যাঠামশাই৷

পানকৌড়িটাকে বসতে দেখেই ও আমার দিকে তাকাল৷ তাকানোটা বাবার চোখে পড়ল৷ বাবা বললেন, ‘‘কী রে, গুলি ছুড়বি?’’

গজেন নালিশের গলায় বলল, ‘‘দেখ না মেসো, কখন থেকে বলছি৷’’

বাবা বললেন, ‘‘মার দেখি পানকৌড়িটাকে৷’’

আমি বললাম, ‘‘শব্দে জলার ভিতরের হাঁস উড়বে না?’’

বর্মনকাকু বললেন, ‘‘আজ রবিবার কত শিকারি নেমে গেছে৷ দুমদাম শব্দ হচ্ছেই৷ তা ছাড়া এত দূরের শব্দে কিছুই হবে না৷’’

আমি পয়েন্ট টু-টু রাইফেলটা গজেনকে এগিয়ে দিচ্ছিলাম৷ বাবা বললেন, ‘‘না-না, বন্দুকই ছুড়তে দে ওকে৷ টুয়েলভ বোর৷’’

আমি বললাম, ‘‘ধাক্কা?’’

গজেন বলল, ‘‘ইয়ার্কি মারিসনি৷ তুই ছুড়তে পারিস আর আমি পারি না? আমিও হেদোয় ব্যায়ামও করি৷’’

বাঁ ব্যারেলে একটা চার নম্বর ছররা পুরে বাবার বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের গ্রিনার বন্দুকটা গজেনের হাতে তুলে দিলাম৷ ওকে ডিরেকশান দেবার আগেই ওই পায়ের উপর পা-তুলে বসে থাকা অবস্থাতেই আসীন থেকে, আমরা কেউ কিছু বোঝার আগেই গজেনবাবু বন্দুকটা তুলেই দুম করে মেরে দিল৷ একটুর জন্যে আমার কান মিস করে ঝর ঝর করে ছররাগুলো গিয়ে দূরে জলে পড়ল৷ পানকৌড়িটা ভীষণ ভয় পেয়ে খোঁটা হড়কে জলে ডিগবাজি খেয়ে পড়তে-পড়তে মনে-মনে গজেন ঘোষের শ্রাদ্ধ করতে-করতে উড়ে চলে গেল৷ শব্দে ভয় পেয়ে একদল জলপিপি আর ডুবডুবা জল ছাড়া দিয়ে এদিকে-ওদিকে চলে গেল৷ দূরের হুইসলিং টীলের ঝাঁক শিস দিতে-দিতে গুলির শব্দে কিছুক্ষণ ওড়াউড়ি করে আবার স্থির হয়ে বসল৷

এসব ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে৷ এবং পরমুহূর্তেই গজেন প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল, ‘‘মরে গেলাম রুদ্র, একেবারে মরে গেলাম…ওঁ বাঁবাঁ গো—মাঁ রেঁ…’’

আমি পানকৌড়ি ছেড়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি বন্দুকটার নল মাটিতে, হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে যাবে এক্ষুনি৷ বাবা ও বর্মনকাকুও দৌড়ে গেলেন ওর দিকে৷ বললেন, ‘‘কী হল, হল কী?’’

গজেন বলল, ‘‘ন্যাজ খসে গেছে, ন্যাজ খসে গেছে…৷’’

বর্মনকাকু হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘‘বলিস কী? তোর ন্যাজ?’’

গজেন মুখবিকৃতি করে বলল, ‘‘আমার পায়ের শিরায় টান লেগেছে, পাখির ন্যাজ খসেছে৷’’

ততক্ষণে আমি কাছে গেছি ওর৷ ও পায়ের উপর পা দিয়ে বসে ছিল৷ বন্দুকের ট্রিগার তো আর পা দিয়ে টানেনি, কিন্তু পড়েছে পায়ের শিরায়৷ বন্দুকটা ওর হাত থেকে নিতেই ও এক পায়ে লাফাতে-লাফাতে বলতে লাগল, ‘‘ন্যাজ খসে গেছে, টান লেগে গেছে, টান লেগে গেছে, ন্যাজ খসে গেছে৷’’ তখন ওকে সামলাবেন না শিকারযাত্রা করবেন, বাবা এবং বর্মনকাকুর তাই নিয়েই সমস্যা দেখা গেল৷ ইতিমধ্যে দূর থেকে পনেরো কেজি ওজনের ছিপছিপে চকচকে বাঁশের মতো চেহারার পলান, হাতে লগি নিয়ে হাজির! বলল, ‘‘চলুন বাবু, পাখিরা সব বিলি মেরে রইয়েছেন৷ আজ খাদ্যখাদক কিছু করা যেতে পারে৷ দেরি করলে ওদিকের শিকারিরা সব সাবড়ে দিবে৷’’

বলেই, বর্মনকাকুর দিকে তাকাল পলান৷ মনে হল বর্মনকাকুর সিগারমুখে চেহারাটা বিশেষ পছন্দ হল না পলানের৷

পরক্ষণে পলান গজেনের দিকে চেয়ে বলল, ‘‘খোকার হলটা কী?’’

পাইকপাড়ার মস্তানকে ‘খোকা’ বলায় গজেন বিস্তর চটল৷ বলল, ‘‘শির-টান৷’’ পলান থুক করে শ্লেষ্মা-শ্লেষ্মা মেশানো একতাল থুতু ফেলে বলল, ‘‘নিশীথকুয়ারি লতার সঙ্গে হেড়োভাঙ্গা নদীর জল মিশিয়ে একরত্তি গরান ফুলের মধু দে খলনোড়ায় নেড়ে খেয়ে লাও দিকিন খোকা—তোমার টান-টান শির পলক ফেলার আগেই বে-টান হইয়ে যাবে৷’’

গজেনের তখন শরীরের দুঃখ গিয়ে শিকারের দুঃখ চেগে উঠেছে৷

বলল, ‘‘ন্যাজ খসে গেছে৷’’

পলান বলল, ‘‘বলো কী গো খোকা? তুমি বাঁদর নাকি?’’

গজেন কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘‘তোমরা যাও মেসোমশাই—আমি গাছতলায় শতরঞ্জি পেতে থাকব—দূরবিন নিয়ে৷’’

আমাকে গজগজ করে বলল নীচু গলায়, যাতে বাবা শুনতে না পান, ‘‘এর চেয়ে টারজানের ছবি দেখতে গেলে অনেক ভালো হত৷’’

পলান নৌকোয় গিয়ে উঠেছে৷ ধুতিটাকে ভালো করে মালকোঁচা মেরে বেঁধেছে৷ চোখ কুঁচকে পলান বলল, ‘‘যাবে কে?’’

বাবা বললেন, ‘‘সকলেই৷’’

গজেন বলল, ‘‘আমি ছাড়া৷’’

পলান বলল, ‘‘আম্মো নাই-ই সাংঘাতিক কম্মে৷’’

বাবা বললেন, ‘‘কী পলান, হবে না?’’

পলান বলল, ‘‘হবে না কোন কথা? একেবার এই ডোঙাতে একটা ল্যাংড়া মোষকে নিয়ে গেছিনু না৷ মাঝ বাদায় ডোঙা উলটিলে? সাঁতার জানেন?’’

বাবা ও বর্মনকাকু নিশ্চয় সাঁতার জানেন৷ আমাকে সাঁতার ক্লাবের মেম্বার করে দিয়েছিলেন বাবা৷ কিন্তু যে পরিমাণ জল তোলপাড় করে যে হাঁকুপাঁকু প্রক্রিয়ায় যতটুকু এগোতাম আমি, তার নাম সাঁতার নয়৷ কিন্তু বাবা জানেন যে, আমি সকালে সাঁতারে যাই৷ আসলে একা-একা লেকের বেঞ্চে বসে প্রায়ই ফুচকা কি আলুর দম খাই৷ কিন্তু প্রাণ গেলেও এখন বলা যাবে না যে, সাঁতার জানি না৷

বাবা বললেন, ‘‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, সকলেই জানে৷ ভালোই জানে৷’’

আমি দেখলাম পলানের চোখের কোনায় অনুকম্পার ঝিলিক চমকে উঠল৷ বাবা বললেন, ‘‘কী করবি রুদ্র? তুই থেকে যা গজেনের সঙ্গে৷’’

বর্মনকাকু বললেন, ‘‘আহা ছেলেমানুষ৷ কাল বিকেল থেকে গাডোয়াল-গাডোয়াল করে নাচছে—আসলে আমার ফোনটা তো ও-ই ধরেছিল৷’’

আসলে সেটা কোনো ব্যাপার নয়৷ মনে-মনে আমি ভাবছিলাম৷ হাত দিয়ে বন্দুক ছুড়ে যে পায়ের শিরায় টান ধরায়, তার মতো অনপড় আদমির সঙ্গে এক শতরঞ্জিতে বসে থাকতে আমি আসিনি৷ তা ছাড়া আমি চেয়েছিলাম, গজেন জানুক, দেখুক, আমার হাতের নিশানা, শিকারে আমার অভিজ্ঞতা৷ ও সঙ্গে গেলে আরও ভালো হত৷

তবু আমি মুখে কিছু না বলে, মুখটা বেজার করে রইলাম৷

স্নেহপ্রবণ বাবা, আমার মুখের দিকে তাকালেন একবার দেখলাম৷ তারপর বললেন, ‘‘চল পলান৷ এগোই৷’’

আমরা একে-একে তিনজনে সাবধানে সেই টল-টলায়মান ডোঙায় উঠে বসলাম৷ গজেন ততক্ষণে ফ্লুরির প্যাকেট খুলে মনোযোগ দিয়ে কেক খেতে লেগেছে৷ এমন সময় মাথার উপর দিয়ে একটা কাক উড়ে গেল কাক-কাঁওয়াক করে ডাকতে-ডাকতে, লম্বা ঠ্যাং দুটো দোলাতে-দোলাতে৷

আমি আমার বিদ্যা জাহির করার জন্যে বললাম, ‘‘দ্যাখ গজেন কাঁক-কাঁক৷’’ আর অমনি পক-পক আওয়াজ করে ডোঙাটা দুলে উঠেই ডুবতে-ডুবতে বেঁচে গেল৷ আমি যেই গজেনের দিকে ফিরেছি, হাত তুলে ওকে কাক দেখাতে গেছি, তাতেই এই বিপত্তি৷

বাবা বললেন, ‘‘খুব সাবধানে বসো৷ একদম নড়াচড়া নয়৷’’

গজেনকে নিঃশব্দে বাঁ হাত তুলে টা-টা করলাম৷ আমি সবচেয়ে পিছনে রয়েছি৷ আমার সামনে বাবা, তাঁর সামনে বর্মনকাকু৷ আর একেবারে সামনে পলান, দাঁড়িয়ে ডোঙা বাইছে৷ আমরা প্রায় গায়ে-গায়ে লেগেই বসেছি৷ বাবা ও বর্মনকাকুর হাতে ডাবল ব্যারেল বন্দুক৷ আমার হাতে পয়েন্ট টু-টু রাইফেল৷ চেকোস্লোভাকিয়ান৷ ব্যারেলের নীচে লম্বা ম্যাগাজিন—আরেকটা ব্যারেলের মতো৷ বাবার ফুরিয়ে-যাওয়া সিগারেটের টিনে রাইফেলের গুলি৷ ভালো চান্স পেলে বড়রা সিটিং পজিশনে মারবেন ঝাঁক দেখে৷ তারপর হাঁস উড়লে, তখন অন্য ব্যারেলের গুলি দিয়ে তাঁরা ফ্লাইং মারবেন৷ তখন আমিও পটাপট রাইফেলের ম্যাগাজিন খালি করব উড়ো হাঁসের উদ্দেশে৷ উড়ন্ত হাঁসের সঙ্গে আমার রাইফেলের গুলির যোগাযোগ যদি ঘটে যায়, তবে তা নেহাতই দুর্ঘটনা বলতে হবে৷

আমি না পারলেও বাবা খুব ভালো ফ্লাইং মারতেন৷ বর্মনকাকুর কথা জানি না৷ কারণ এর আগে ওঁর সঙ্গে শিকারে যাইনি আমি কখনও৷

জলের একটা আলাদা গন্ধ আছে৷ গন্ধ আছে এই বাদার৷ মাঝে-মাঝে হোগলা, শর, নানা ধরনের লতাপাতা জলের উপর৷ উড়ে-যাওয়া পাখির খসে-যাওয়া পালক ভাসছে৷ দূরে জলের উপর সাঁতরে যাচ্ছে সাপ, লম্বা একটা সরল চিকন রেখার মতো৷ জলের মসৃণ নিস্তরঙ্গ আয়নাকে তীক্ষ্ম ছুরির মতো কেটে দু’ফালা করেছে যেন৷ স্নাইপ, স্নিপেট লেজ নাচিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে অথবা ছোট্ট-ছোট্ট তিরের মতো উড়ে যাচ্ছে দল বেঁধে৷ দ্রুত ধাবমান পাখির ঝাঁক যখন উড়তে-উড়তে দিক অথবা উচ্চতা পরিবর্তন করে, তখন মনে হয় একদল ছোট-ছোট মেয়ে যেন যুগযুগান্তর ধরে রিহার্সাল দিয়ে কোনো নাচ দেখিয়ে গেল৷ এমনি অনবধানের, অবহেলার নাচ চারদিকে, গান৷ এমন কী ব্যাক ড্রপ পর্যন্ত৷ কত যে ছবি, কত যে গান, যারই চোখ আছে, সেই-ই দেখতে পায়৷ যারই কান আছে, সেও পায় শুনতে৷

আমরা র‍্যাপট অ্যাটেনশানে বসে আছি৷ ডানদিকে-বাঁদিকে হুইসলিং ঢীলস, কটন টীলসের ঝাঁক পেয়েছিলাম আমরা৷ শীতের ভর-দুপুরের সূর্য মাথার উপরে৷ তবে চোখে লাগছে না; টুপি আছে৷ বাদার উপর দিয়ে উত্তুরে হাওয়া বইছে৷ শীত করছে ছায়ায় গেলেই৷

কচুরিপানার মধ্যে-মধ্যে লম্বা-লম্বা পা নিয়ে দারুণ ময়ূরপঙ্খী নীল শরীর আর লাল ঠোঁটের কান পাখিরা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কঁক, কঁওক করে ডাকছে৷ কচুরিপানার গন্ধ, ওদের গায়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে এই জলজ আবহাওয়াকে এক ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে৷

একজোড়া রাজহাঁস সোঁ-সোঁ করে উত্তর থেকে দক্ষিণে উড়ে গেল বন্দুকের পাল্লার মধ্যে দিয়েই, কিন্তু আমাদের একেবারে চমকে দিয়ে৷ কেউই বন্দুক তোলেনি৷ আচমকা মুখ তুলে একসঙ্গে যে ওদের দিকে তাকিয়েছি, তাতেই ডোঙাটা টলমল করে উঠেছে৷

আজ আমাদের কোনো দিকে তাকাবার অবসর, ইচ্ছা বা সময় নেই৷ আমরা গাডোয়ালের ঝাঁকটার দিকে এগিয়ে চলেছি৷ সাধের গাডোয়াল৷ এবার হাঁসগুলোকে দেখা যাচ্ছে৷ পরিষ্কার৷ পশ্চিমে কিছুটা জঙ্গল আছে জলে৷ বাবা বললেন, ‘‘পলান, ওই জঙ্গলের আড়ালে ডোঙা নিয়ে ভেড়াও বাবা৷ বাঁদিকে গুলি করব—তাই নৌকাটা উত্তর-দক্ষিণে মুখ করে দিবি—যাতে পশ্চিমে গুলি করতে পারি সহজে৷ যতখানি পারিস স্থির রাখিস—শেষবার দাঁড় বেয়ে তুই বসে পড়বি৷ ডোঙা যখন আস্তে এগোবে, তখন গুলি করব আমরা, যাতে গুলি উপরে-নীচে না চলে যায়৷’’

পলানও খুব উত্তেজিত আজ৷ প্রথমত আড়াই কুইনটাল ওজন নিয়ে নৌকা ভাসিয়ে রাখা সহজ কথা নয়, দ্বিতীয়ত গাডোয়ালের নেশা৷ বাবা বলেছিলেন, এক-একটা গাডোয়ালের জন্যে এক-এক টাকা বকশিশ দেবেন৷

পলান একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিতে লাগল৷ আমি সূর্যের দিকে চেয়ে ভাবলাম যে, এতক্ষণ মা খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করে উঠে ঠাকুরকে দিয়ে মশলা-টশলা বাটিয়ে রাখছেন৷ আরও ভাবলাম, গজেনের চোখে-মুখে আমার প্রতি ভক্তি কীরকম উপচে পড়বে, যখন গাডোয়াল ও অন্যান্য হাঁসগুলো নিয়ে ডোঙা থেকে নামব আমরা৷ গাডোয়াল শিকারের পরে, বাবা বলেছেন, আর কোনোই রেস্ট্রিকশান নেই৷ ফেরার পথে অন্য সব পাখিই মারব আমরা৷

পলান বিড়িটা শেষ করে ছুড়ে নৌকার মুখ ঘোরাল ওই জঙ্গলের দিকে৷ আমরা সকলে টেন্স৷ আস্তে-আস্তে এক লগি, দু-লগি করে আমরা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছি৷ এক-একটা মিনিটকে মনে হচ্ছে এক-এক ঘণ্টা! অবশেষে শেষ মুহূর্ত এল৷ ঝাঁকের মধ্যে কিছু-কিছু হাঁস উড়ে-উড়ে বসছে৷ তাদের জল ছেড়ে ওঠার সময় যে জলবিন্দু ওদের ডানা আর গা থেকে ঝরছে, তাতে সূর্যের আলো পড়ে লক্ষ-লক্ষ হিরের মতো ঝকমক করছে৷

বাবা বললেন, ‘‘ওয়ান, টু, থ্রি৷’’

সঙ্গে-সঙ্গে আমরা তিনজনে বাঁদিকে রাইফেল ও বন্দুক একসঙ্গে সুইং করলাম৷ আমাদের গাডোয়াল-স্বপ্নাতুর চোখে শেষবারের মতো হাজার খানেক গাডোয়ালের ঘনসন্নিবিষ্ট ঝিলিক মেরে গেল৷ পরমুহূর্তেই একটা বিচ্ছিরি ও অতর্কিত আওয়াজ হল—পকাত৷ তারপর ডেঞ্জারাস ডোঙা, ডেয়ার-ডেভিল তিন শিকারি এবং ঝাঁঝি ভরা অথৈ জলে সমাধিস্থ হল৷

জলে ডোবার আগে প্রথমেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠল; তারপরই গজেনের৷ জলের নীচেটা কী সুন্দর! নীলচে সবুজ আলোয় ভরে গেছে জলজ অন্ধকার৷ লতাপাতার শিকড় ঝুলছে উড়ন্ত পাখির পায়ের মতো চারদিকে৷ নীচের সবুজ ঝাঁঝি কী নরম কার্পেটের মতো৷ পা পড়তে স্প্রিংয়ের মতো পা উপরে উঠে এল৷ আরও অনেকক্ষণ নীচে থাকতে পারলে খুশি হতাম৷ থাকলে হয়তো জলপরি আর পাতালপুরীর রাজকন্যার সঙ্গে দেখাও হয়ে যেতে পারত৷ কিন্তু দম বন্ধ হয়ে এল৷ প্রাণপণ চেষ্টায় হাত-পা ছোঁড়া-ছুঁড়ি করে অক্সিজেনের আকুতিতে যখন জলের উপর মাথা তুললাম মাটিতে পা রেখে তখন ভাগ্যক্রমে দেখলাম যে, আমি মরিনি৷ সেখানে ডুবজল ছিল না ভগবানের দয়ায়৷ জল আমার কানের নীচে ছিল৷

এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে দেখলাম, পাশেই বাবা৷ জল বাবার কাঁধ অবধি৷ বাবা ছ’ ফুট দু’ ইঞ্চি লম্বা৷ কিন্তু সেই জোলো নাটকের আর দুজন অ্যানিমেট এবং একজন ইন-অ্যানিমেট পাত্র মঞ্চে অনুপস্থিত ছিল৷ অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে, গুলির কৌটো হারিয়ে গেলেও, রাইফেলটা হাতছাড়া করিনি৷

কয়েক মুহূর্ত পরেই পলানের মাথাটা আমার পাশে ভিজে পানকৌড়ির মতো জল থেকে উঠেই এক ঝাঁকুনিতে জল ছিটিয়ে আবার দ্বিগুণ বেগে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল! পলানের ডুবে মরার কোনো কথাই ছিল না৷ কিন্তু পলানই কি শেষে ডুবে মরবে?

এমন সময় আমাদের সামনে জলের নীচে তোলপাড় শুরু হল৷

এখানে কুমির আছে বলে শুনিনি৷ থাকলে, আগে অনেক বার কোমর জলে সামনে কচুরিপানার বান্ডিল রেখে তার উপর বন্দুক রেখে হেঁটে হেঁটে এখানে হাঁস মারতাম না৷ জলহস্তী ভারতবর্ষে নেই জানতাম৷ তবে এ কোন জানোয়ার এমন জলে তুফান তুলে ঝাঁঝি ও কাদায় হাঁচোর-পাঁচোর করছে? কিছুক্ষণ পর পলানের মাথা আবার উঠে এল৷ মাথা তুলেই পলান দোখনো ভাষায় অশ্রাব্য গালাগালি করতে লাগল৷ বাবা বললেন, ‘‘হল কী?’’ পলান বলল, ‘‘আপনার বন্ধু৷ আমাকে এমন জাপটিয়ে ধরল যে, আমিসুদ্ধু জলে ডুবে মরতাম৷ কিছুতেই যখন ছাড়ে না তখন তার নাকে লাথি মেরে উপরে আসতে বাধ্য হলাম৷ আমার দম ফুইরি যেতেছিল৷’’

বাবা আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘‘বন্ধু কি মরে গেছে?’’

পলান বলল, ‘‘মরলে বাঁচি৷’’

তখন বাবা আমাকে বন্দুকটা ধরতে বলে ডুব দিলেন৷ বাবা আর ওঠেন না৷ আমার যে কী ভয় করতে লাগল কী বলব৷ বাবা ডুবে গেল নাকি?

অনেকক্ষণ পরে বাবা বর্মনকাকুকে ধরে উঠলেন৷ দেখলাম বর্মনকাকুর মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ তাঁর নাক ফেটে গেছে৷ রক্তে জল লাল হয়ে উঠল৷ এখন ডোঙা ওঠানো যায় কী করে? চারজনের অনেকক্ষণের চেষ্টায় তো ডোঙাটাকে উপরে তোলা হল৷ হাত দিয়ে তারপর সকলে মিলে ডোঙার জল ছেঁচা হল৷

যখন আমরা জল ছেঁচে বের করছি, তখন গাডোয়ালের ঝাঁকটা আস্তে-আস্তে উড়তে-উড়তে আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল৷ খুব নীচে দিয়ে৷ যেন মজা দেখার জন্যেই৷

ডোঙাটাকে জলমুক্ত করার পরে আসল সমস্যা দেখা দিল৷ বুক-সমান ডোঙায় জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাতে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়৷ বাবা প্রথমে উঠতে যেতেই ডোঙাটা আবার ডুবে গেল৷ আবার তাকে তোলা হল৷

এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে৷ ডিসেম্বর মাস৷ হু-হু করে উত্তর থেকে হাওয়া আসছে হাড়ের মধ্যে কনকনানি তুলে৷ এতক্ষণ জলের মধ্যে থেকে প্রত্যেকেই গুড়ের হাঁড়িতে পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো হয়ে গেছি৷ শেষে পলান আগে উঠল৷ মানে, তাকে ঠেলে-ঠুলে ওঠানো হল৷ তারপর আমাকে৷ আমরা দুজনে উঠে ডোঙার দু’দিকে ব্যালান্স করে বসলাম৷ বাবা ও বর্মনকাকু আরও আধঘণ্টা সার্কাস করার পর উঠলেন৷ সকলে নৌকোবোঝাই হয়ে দেখা গেল ততক্ষণে লগি ভেসে গেছে৷ সকলে মিলে হাত দিয়ে জল কেটে অভিমানী লগির কাছে গিয়ে তাকে উদ্ধার করা হল৷ তারপর পাছে ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয় সেই ভয়ে সকলেই হাত দিয়ে জল কেটে-কেটে গা গরম করতে লাগলাম৷ পাড়ের দিকে ফিরে আসছি, ফিরে এসেছি প্রায়, এমন সময় বর্মনকাকু বললেন, ‘‘দাদা, ওয়াইল্ড ডাকস৷’’

আমি পড়ন্ত রোদে হোগলা বাদার কাছে তাকিয়ে দেখলাম, কালো ও ছাইরঙের একদল পাতিহাঁস৷ বাবা বললেন, ‘‘যাঃ! পোষা৷’’

বর্মনকাকু কাঁপছিলেন৷ রেগে বললেন, ‘‘কাশ্মীরে, ভরতপুরে কত শিকার করেছি আমি৷ আমাকে শেখাচ্ছেন আপনি? পোষা না, ওয়াইল্ড৷’’

পলান বলল, ‘‘আলো নাই, ঠাহর হয় না ভালো৷ দাঁড়ান, ঠাহর করি৷’’

কিন্তু গাডোয়ালের শোকে কাণ্ডজ্ঞানহীন অধৈর্য অবস্থায় পলান ঠাহর করার আগেই বাবা ও বর্মনকাকু যুগপৎ বন্দুক দেগে দিলেন পনের-কুড়ি হাত দূর থেকে৷ চার-পাঁচটা হাঁস উলটে গেল৷

আমরা ডাঙার কাছে এসে গেছিলাম৷ পাড় থেকে কে যেন বলল, ‘‘অ কালিদাসী, তোর হাঁসিগুলোকে গুলিতে যে ভেনে দিল৷’’

কালিদাসী নামী অদৃশ্য মহিলা বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘সুধীর, নেতাই, হরবিলাস, লাঠি নে আয়, সড়কি নে আয়, আজ ব্যাটাদের ছেরাদ্দ করব৷’’ বর্মনকাকু ও বাবা ততক্ষণে ভুল বুঝতে পেরেছেন৷ কিন্তু দেরি হয়ে গেছে৷

আমরা দেখলাম, পাড়ে লাঠি-সোঁটা নিয়ে অনেক লোক জমায়েত হয়েছে৷ আর অফ অল পার্সনস গজেন, যে শিকারের ‘শ’ জানে না, সেই-ই দূরবিন দিয়ে আমাদের নিরীক্ষণ করছে৷

বিপদ দেখে পলান ডোঙা নিয়ে নিরুদ্দেশ-যাত্রায় যাবে বলে ডোঙার মুখ ঘোরাচ্ছিল৷ সেই সময় আমরা অবাক হয়ে দেখলাম গজেন ফ্লুরির প্যাকেট থেকে মারমুখী সকলকে কেক বিতরণ করছে, খাওয়াচ্ছে৷

ও একটু পরই চিৎকার করে বলল, ‘‘মে SSO-ম SAI-ই ফিরে ESSO, আমি আছি, এরা কিছু বলবে না৷ রুদ্র ফিরে আয়, ফিরে আ…য়৷’’

এরকম বার-বার ডাকতে লাগল গজেন৷ সাহসে ভর করে ফিরে আসবার সময় পাতিহাঁসগুলোকেও তুলে নিয়ে এলাম আমরা৷ ডাঙার কাছে আসতেই দেখি, গজেন কালিদাসীর সঙ্গে মরা হাঁসদের দর কষাকষি করছে, ক্যাজুয়ালি৷ যেন কিছুই হয়নি৷ পাঁচ টাকা করে প্রতিটি রফা করল ও৷ মাইনাস ধোলাই৷

গজেন বাবার দিকে চেয়ে বলল, ‘‘ফেয়ার এনাফ৷ কী মেসো?’’

বাবা বললেন, ‘‘হাঁসগুলো ফেলে দে রুদ্র৷’’

গজেন বলল, ‘‘মে SSO, মাসির কথা একবার ভাবো; আর তোমার বন্ধুর…, নেমন্তন্ন…৷’’



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *