ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে এবং ঋজুদা
ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিল৷ ভারত মহাসাগরের স্যোশেলস দ্বীপপুঞ্জে জলদস্যুদের পুঁতে রাখা গুপ্তধনের মালিকানা নিয়ে যে খুনের পর খুন হয়েছিল তারই কিনারা করে আমরা ফিরে আসার পরই এই জমায়েত৷ আমাদের সাকসেস সেলিব্রেট করার জন্যে৷ তিতির যদিও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেনি স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে কারণ সে তখন দিল্লিতে ছিল; ও এসেছিল সেই সন্ধ্যাতে ঋজুদার বাড়িতে বিশেষ অতিথি হিসেবে৷
আজ রাতের মেনুতে গদাধরদার করণীয় কিছুই নেই৷ হাজারিবাগের আজ্জু মহম্মদ তার বাবুর্চিসমেত হাজির৷ আজ মোগলাই খানা৷ মাটন বিরিয়ানি, মধ্যে বটি কাবাবের গোল গোল বটিকা৷ গুলহার কাবাব, চিকেন চাঁব, পাঁঠার তেলের চৌরী, লাব্বা, পায়া আর কবুরার চচ্চড়ি৷ মাটন রেজালা, সিনা ভাজা৷ এক এক পদ খাবার শেষ হতে না হতে হামদর্দ দাবাইয়াঁ কোম্পানির এক এক বটি পাচনল৷ সমস্ত গুরুপাক খাদ্য নিমেষে হজম করানোর জন্যে৷
বিরিয়ানির হান্ডি বসেছে রান্নাঘরে৷ উমদা বিরিয়ানি রান্না করাটাই শুধু আর্ট নয়, সেই বিরিয়ানি হাঁড়ি থেকে পরতে পরতে বের করাও, যাকে বলে ‘‘হান্ডি নিকালনা’’ একটা বিশেষ আর্ট৷
গদাধরদার ওসব অ-হিঁদু রান্নাবান্নাতে ঘোর আপত্তি৷ সে রান্নাঘরের বাইরের দিকে বারান্দাতে হাওড়া স্টেশনের কুলিরা ট্রেন না থাকলে যেমন করে কোমর, আর মাটি থেকে তোলা দু-পায়ে গামছা কষে-বেঁধে বসে আরাম করে—যেমন করে বসাকে শ্রীমান ভটকাই নাম দিয়েছেন ‘‘পোর্টার আসন’’—(যোগাসনের তালিকায় তার নবতম অবদান) তেমন আসনে বসে প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে দু-ঠ্যাং দোলাচ্ছে আর গুন গুন করে রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড সুরে গাইছে এবং তারই মাঝে মাঝে গুন্ডি পানের লাল তরলিমা পাশের পিকদান-এ পিচকিরির রঙের মতনই ছুড়ছে৷
আমরা সবাই ঋজুদাকে ঘিরে বসে গল্প করছি৷ তিতির আফসোস করছে স্যেশেলস-এর সুন্দর দ্বীপপুঞ্জে আমাদের সফল অ্যাডভেঞ্চার এবং রহস্য উদঘাটনের সঙ্গী হতে পারেনি বলে৷
ভটকাই যেন তিতিরের জ্যাঠামশাই, এমনি করে বলল, শুধু কেতাবি বিদ্যেই সব নয় জীবনে, বুঝেছো তিতির দেবী, স্কোয়ার হতে হয়, স্কোয়ার৷ এ স্কোয়ার পেগ ইন এ রাউন্ড হোল৷
আমরা সকলেই ভটকাই-এর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম৷
ভটকাই বোকার মতন বলল, কী হল? তারপর তার দু-কান লাল হয়ে গেল৷ সে বলল, ভুল বললাম?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই৷ কোনো স্কোয়ার খোঁটা কি গোল গর্তে পোঁতা যায়? আর স্কোয়ার হওয়ার সঙ্গে স্কোয়ার পেগ-এরই বা সম্পর্ক কি?
ভটকাই বলল, সরি সরি ভুল হয়ে গেছে৷
ওর ক্ষমা চাওয়ার কায়দাতে আমরা আবারও হেসে উঠলাম৷
তিতির বলল, তা ছাড়া ভটকাই, ইংরেজিতে ‘এ’ বললে যাঁরা ইংরেজ, অথবা যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরা বুঝতেই পারবেন না৷ ‘এ’ হচ্ছে বাঙালি ইংরেজি৷ A’র উচ্চারণ সবসময়েই ‘‘আ’’৷ এটা মনে রাখবে৷
ভটকাই নিজের অপ্রতিভতা কাটিয়ে উঠে বলল, ও ঋজুদা! মোগলাই খানা খাওয়ার নেমন্তন্ন করে এনে স্পোকেন ইংরেজির ক্লাসে ঢুকিয়ে দেবে জানলে আমি আসতামই না৷
আমি বললাম, শেখার আবার স্থল-অকুস্থল কি রে! যার শেখার ইচ্ছে আছে সে চিতাতে উঠতে উঠতেও শেখে৷
ঋজুদা আজ্জু মহম্মদকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের সীমারিয়ার সেই ডাকাত—রবিনহুড পিপ্পাল পান্ডে কেমন আছে? জেল থেকে ছাড়া কি পেয়েছে?
জি হাঁ৷ তিন সাল হো গ্যয়ে৷
কত বছর জেল খাটল যেন?
পঁদরো সাল৷
আমাকে খুন করার কথা কিছু বলেছে না কি? জেলে যাবার আগে তো শাসিয়েছিল৷
তা শাসিয়েছিল৷ কিন্তু ফিরে এসে সে তোমার চেলা হয়ে গেছে৷
ডাকাত হল আমার চেলা! সেটা কি গুরুর পক্ষে খুব আহ্লাদের কথা?
ঋজুদা বলল৷
ভটকাই ফুট কাটল : গুরুর অন্য চেলাদের পক্ষেও আহ্লাদের নয়৷
বললাম, কেন?
বাঃ রে! আমরা সকলেই যে তাহলে দাগি-আসামি বলে গণ্য হব সকলের চোখেই৷
ভটকাই ব্যাখ্যা করে বলল৷
ঋজুদা বলল, তা কেন? একবার অপরাধ করেছে বলে বা কিছু সময় ধরে লাগাতার অপরাধ করেছে বলেই কি সেই মানুষ চিরদিনই অপরাধী বলে গণ্য হবে? পরিবর্তন তো সব মানুষের মধ্যেই আসতে পারে৷ সব মানুষই তো বদলায়৷ বদলানোটা ভালোর দিকে হলেই তো ভালো৷ তা ছাড়া, পিপ্পাল পাঁড়ে মানুষ খুন করে থাকতে পারে অনেক, কিন্তু যাদের সে খুন করেছে তাদের তো কোনোমতেই ভালো মানুষ বলে গণ্য করা যায় না৷ যে-সমাজে খারাপ মানুষদেরই জয়জয়কার, আইন যেখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আমল থেকে আজ অবধিও এমনই এক তামাশা হয়ে আছে যে, শুধুমাত্র বড়লোকদের পক্ষেই তা দেখা সম্ভব, সেই দেখে যদি কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্যই হয় অন্যের উপরে ঘটে-যাওয়া অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্যে, নিজের লাভ বা লোভের জন্যে নয়, সেই মানুষকে আমি তো খারাপ বলতে পারি না৷ রবীন্দ্রনাথ পড়িসনি? তিনি বলেননি কি? ‘‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’’৷ যে মানুষ বা মানুষেরা অন্যায় নির্বিবাদে সহ্য করে তারা সকলেই অন্যায়কারীর সমানই দোষী৷
তিতির এতক্ষণে মুখ খুলল, বলল, ঋজুকাকা, এই পিপ্পাল পাঁড়ে লোকটি কে? এর কথা তো আগে শুনিনি৷
এসব অনেকদিন আগের ঘটনা৷ যখন আমি আর আমার জঙ্গলের বন্ধু গোপাল নিয়মিত হাজারিবাগে যেতাম, তোরা হয়তো তখন জন্মাসইনি, সেই সময়কার ঘটনা৷
ইসস্৷ আমাদের সঙ্গে দেখা হলে কী ভালোই না হত৷
তিতির বলল৷
আজ্জু মহম্মদ, হাজারিবাগের মহম্মদ নাজিমের বড় ছেলে, বলল, ক্যা বোল রহি হ্যা বেটি৷ জানসে বাঁচ গ্যায়ী তুম যো পিপ্পল পাঁড়েসে নেহি ভেটিন৷ ইকদফে হামকো মিলাথা পুরানা চাতরাকি রাস্তেমে৷ ইয়া আল্লা! চার পায়েরসে সাইকিল চালাকর বহুত মুসকিলসে জান বাঁচাকর পিচ রোডমে আকর পৌঁছা৷ অভিভভি ইয়াদ আনেসে জি ঘাবড়াতা হ্যায়৷
তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কখনও ঋজুকাকা?
তিতির শুধোল৷
নেহি ভেটনেসে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েকো পাকড়া কৈইসে ঋজুবাবুনে!
তাহলে আমাদের বলো না ঋজুকাকু ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের সঙ্গে তোমার প্রথম দেখা হওয়ার কথা৷
এমন করে বলছ তিতির যেন ঋজুদার সঙ্গে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের বিয়েই হয়েছে৷ যেন শুভদৃষ্টি!
ভটকাই-এর ইয়ার্কিতে আমরা সকলে তো হেসে উঠলামই, আজ্জু মহম্মদও হেসে উঠল জোরে৷ তার মুখে জর্দাপান ছিল৷ সুগন্ধি পানের রস ছিটকে গিয়ে লাগল ভটকাই-এর কপালে৷ আমরা ওর হেনস্থা দেখে আরেকবার হেসে উঠলাম৷
আজ্জু মহম্মদ লজ্জা পেয়ে বলল, আমি একটু বাওয়ার্চিখানাতে যাচ্ছি৷ আজমল বাবুর্চিকে বলেছিলাম আগে ফিরনিটা বানিয়ে রাখবে, দেখি, গিয়ে কী করল৷
তিনি হিন্না আতরের গন্ধ ঘরে রেখে চলে গেলেন রান্নাঘরে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা চেপে ধরলাম ঋজুদাকে৷
পাইপটা ধরিয়ে ঋজুদা বলল, কী যে বলব! এতে বাহাদুরির কি আছে জানি না৷
আহা! বলোই না৷
আমরা সমস্বরে বললাম৷
ঋজুদা মিনিট দু-তিন ফিল-করা পাইপটাতে টান লাগিয়ে বলল, তখন তো আমরা ছাত্র৷ হাজারিবাগের বরহি রোডে গোপালদের ছবির মতন বাড়িতে আছি৷ পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝির কথা৷ হাজারিবাগ শহর থেকে যে লালমাটির পথটা চলে গেছিল গোরস্থান, বনাদাগ, গোন্দা বাঁধ, টুটিলাওয়া, সীমারিয়া হয়ে বাঘড়া মোড়, সেই পথে তখন ঝুঁন্ডকে-ঝুঁন্ড ময়ূর দেখা যেত৷ তিতির-বটেরের তো দেখাদেখি ছিল না৷ তা ছাড়া ভাল্লুকেরও আড্ডা ছিল সে অঞ্চলে৷ কেন? তা বলতে পারব না৷
ময়ূর না ন্যাশনাল বার্ড! মারা তো বারণ৷
ন্যাশনাল বার্ড ডিক্লেয়ার্ড হয়েছিল ষাটের দশকের গোড়াতে অথবা পঞ্চাশের দশকের শেষে৷ তখন মারাটা বে-আইনি ছিল না৷ ওই পথটা ছিল করোগেটেড টিনের মতো৷ প্রতি দু-ইঞ্চি বাদে বাদে ঢেউ উঠেছিল পথে৷ সাইকেলে বা গাড়িতে সে পথে যাওয়া বিস্তর অসুবিধার ছিল৷ তাই আমরা আগের দিন বিকেলের বাসে বন্দুক-কাঁধে করে চড়ে পড়ে টুটিলাওয়াতে নেমে পড়ে গোপালের বন্ধু ইজাহারুল হক-এর ডেরাতে গিয়ে পৌঁছলাম৷ ইজাহারুল নিজেও খুব শৌখিন মানুষ ছিল এবং ভালো শিকারিও৷ থাকত অবশ্য হাজারিবাগে কিন্তু টুটিলাওয়াতে অনেক জমিজমা ছিল৷ জোতদার যাকে বলে৷ বাস থেকে নামতে নামতে সন্ধে৷ নাজিম সাহেব খিচুড়ির ইন্তেজাম করে ফেললেন৷ ফারস্ট-ক্লাস খিচুড়ি, সঙ্গে ইজাহারের খিদমদগারের জোগাড় করা খাঁটি ঘি, বেগুনের ভাত্তা, কাঁচা লংকা আর পেঁয়াজের কুচি দেওয়া, আলুরও ভাত্তা৷ উপাদেয়৷ এই সব আজমল-ফাজমল নাজিম সাহেবের ধারে-কাছে আসত না রাওয়ার্চি হিসেবে৷ আজ নাজিম সাহেব বেঁচে থাকলে৷
ভটকাই নাকটা উপরে তুলে ল্যাব্রাডার গান-ডগ-এর মতন গন্ধ শুঁকল বার তিনেক৷ তারপর স্বগতোক্তি করল, আমাদের আজমল মিঞাতেই চলবে ঋজুদা৷ বিরিয়ানির যা খুশবু ছেড়েছে না! আহা৷ এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো৷
আমরা সকলেই হেসে উঠলাম ওর কথা শুনে৷
তিতির বলল, ভটকাই বড় ইন্টারাপ্ট করে৷ বলো তো ঋজুদা৷
হ্যাঁ৷ পরদিন অন্ধকার থাকতে থাকতে আমরা আমাদের বন্দুক আর গুলির বেল্ট নিয়ে, মাথায় টুপি চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে তিনদিকে৷ কথা হল যে সকাল আটটাতে যেখানে টুটিলাওয়া থেকে চাতরাতে যাওয়ার পুরোনো পথটা বেরিয়ে গেছে, সেই মোড়ে এসে জমায়েত হব৷ সেখানে নিজামুদ্দিনও উপস্থিত থাকবে তার দলবল নিয়ে৷ শিকার করা পশু ও পাখি, যদি পাওয়া যায়, কুড়িয়ে নিয়ে আসবে বনে গিয়ে৷
নাজিম সাহেব বললেন আমাকে চাতরার পুরোনো পথে যেতে কারণ সেদিকে ভাল্লুক বাবাজির সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ একজোড়া অতিকায় ভাল্লুক নাকি সেই পথে মৌরসি-পাট্টা গেড়ে আছে৷ তবে বহতই খতরনাগ তারা৷ যদিও সে পথ এখন পরিত্যক্ত কিন্তু যদি কেউ কখনও যায় কোনো কাজে, ছোটখাটো ঠিকাদার, ফরেস্ট-গার্ড, জঙ্গলের কূপ-কাটনেওয়ালা তবে তাদের কারো নাক, কারো কান, কারো চোখ খুবলে নেয়৷ কখনও কখনও বিনা নোটিসে ‘‘রে রে’’ করে তেড়ে এসে কুস্তিও লড়ে৷ যতই ‘খেলব না’ ‘খেলব না’ করে কেউ চেঁচাক আদৌ শোনে না৷ যার সঙ্গে কুস্তি লড়ে তাদের সর্বাঙ্গ ফালা ফালা হয়ে যায়৷ প্রাণ থাকে না৷
নাজিম সাহেব বললেন, সামহালকে যাইয়ে গা৷
আরে তখন আমার যা বয়স আর যা শরীর তাতে স্বয়ং যম কুস্তি লড়তে এলেও তাকে কাবু করে দেবার হিম্মত রাখি৷ ভয় ব্যাপারটা শিশুকাল থেকেই আমার চরিত্রানুগ নয়৷ তাই বললাম, বে-ফিক্কর রহিয়ে৷
নাজিম সাহেব তখন বললেন, আপকি বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলকা গ্রিনার বন্দুক হ্যায় ঔর আপকি নিশানা ভি বঁড়িয়া—ভাল কি লিয়ে কুছভি ফিক্কর নেহি মগর ইস রাস্তাহি কি আসপাস ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে আভভি ছিপা হুয়া হ্যায়৷
সে আবার কে? পিপ্পাল পাঁড়ে?
ইয়া আল্লা! দশদিন হল হাজারিবাগে এসেছেন অথচ ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ের নাম শোনেননি?
না তো!
আমি আকাশ থেকে পড়ে বললাম৷
অজীব বাত৷
তারপরই বললেন, যোভভি হো৷ সামহালকে রহিয়ে গা৷ বহতই খতরনাগ হ্যায় উঁ ডাক্কু৷ পুলিশ কুছ নেহি কর পায়া হ্যায়৷ বহতই আদমিকো জানসে মার ডালা৷
নাজিম মিঞার মুখে সে কথা শোনার পর আমার ভাল্লুক শিকারের শখ ঢিমে হয়ে গিয়ে পিপ্পাল পাঁড়ে শিকারের সাধটা চেগে উঠল৷
তারপর?
তিতির বলল৷
তখনও অন্ধকার ছিল৷ বেশ ঠান্ডা৷ তখন হাজারিবাগ জেলার ঠান্ডা যে কেমন ছিল তা আজ তোরা বুঝবি না৷ আজ থেকে কত বছর যে আগের কথা৷ বন-জঙ্গল ছিল নিবিড়৷ ভারতে তখন গিনিপিগ-এর মতন মানুষের বংশবৃদ্ধি হয়নি৷
ভটকাই বলল, তোমরা তখন কত বড়?
আমরা তো তখন স্কুলের ছাত্র৷ ক্লাস এইটে না নাইনে পড়ি৷ ঠিক মনে নেই৷
কী দুঃসাহস!
তিতির স্বগতোক্তি করল৷
ভটকাই বলল, কী ওয়ান্ডারফুল বাবা-মা পেয়েছিলে ভাবো একবার৷ দুধের ছেলেদের একে ভাল্লুক তায় ডাকাতের মুখে ছেড়ে দিয়েও তাঁরা নির্বিকার৷ আমাদের আর কী হবে! রবীন্দ্রনাথ সেই বলেছিলেন না? রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি—সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী৷
উল্টো বললি৷
আমি বললাম৷
ওই হল৷ সোজা করে নে তাহলেই তো হল, না কি!
তারপর? বলো ঋজুদা৷
এই ভটকাই, শাট-আপ৷
তিতির ধমক দিল৷
ইয়েস৷ বলল ভটকাই, শাটিং-আপ৷
আলো ফুটছে আস্তে আস্তে পুবের আকাশে৷ তবে তখন কুয়াশা আছে ভারী হয়ে৷ দিনের পাখিরা জাগছে একে একে৷ থ্র্যাশার, ব্যবলার, কপারস্মিথ, টিয়া, টুঁই, মুনিয়া, মিনিভেট৷
বনমোরগের ডাকে চারদিক তো সরগরমই৷ তিতিরের টিটর টিটর, ময়ূরের কেঁয়া-কেঁয়া, কালি তিতিরের টুঙ টুঙ৷ তারও আগে জেগেছে, বনমোরগেরও আগে, র্যাকেট টেইলড ড্রঙ্গোরা—কাচের বাসন ভাঙার মতন স্বর নিয়ে৷ সারারাত বন-পাহারা সেরে রেড-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ টিটিটি-হুট-টিটিটি-হুট-হুট-হুট করে ডাকতে ডাকতে চলে যাচ্ছে পানুয়ানা টাঁড়ের দিকে৷
যদিও খুব শীত, তবু কিছুটা চলতেই শরীর গরম হয়ে উঠল৷ আমার গায়ে একটি ছাই-রঙা ফ্ল্যানেলের জার্কিন৷ আস্তে আস্তে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দু-দিকে নজর রাখতে রাখতে চলেছি কারণ এই সময়েই মাংসাশী প্রাণীরা, যেমন বাঘ, চিতা রাতের টহল সেরে নিজের নিজের ডেরায় ফেরে৷
এমন সময় আমার থেকে বেশ কিছুটা সামনে মানুষের গলার স্বর পেলাম৷ তবে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই৷ একে আধো-অন্ধকার তায় পথটা কিছুটা সামনে গিয়েই বাঁক নিয়েছে বাঁদিকে৷ এখন বসন্তও নয়, গ্রীষ্মও নয় যে, মেয়ে ও শিশুরা মহুয়া কুড়োতে আসবে জঙ্গলে৷ এই সময়ে, আধো-অন্ধকারে কারোই জঙ্গলের গভীরের এই পরিত্যক্ত, দিনমানেই নির্জন পথে আসার কথা নয়, আমাদের মতন শিকারি অথবা ডাকাত-টাকাত ছাড়া৷ তাই কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পথের বাঁ পাশের একটা ঝাঁকড়া আমলকী গাছের পেছনে আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম, যারা কথা বলছে তাদের গলার স্বর ক্রমশই চড়ছে৷ তারপরই একটা আর্তচিৎকার শুনলাম এবং পরক্ষণেই ধ্বপ ধ্বপ করে মানুষের দৌড়ে আসার আওয়াজ এদিকে৷ আমি বন্দুকে তাড়াতাড়ি ডানদিকের ব্যারেল-এ একটি বল ও বাঁদিকের ব্যারেলে একটা এল. জি. পুরে নিয়ে গাছটার আড়াল নিয়ে স্থাণুর মতন দাঁড়িয়ে পড়লাম বন্দুক রেডি-পজিশানে রেখে৷ পাঁচ সেকেন্ডও কাটেনি এমন সময়ে একটি তীব্র আর্তচিৎকার কানে এল এবং একটি অট্টহাসি৷ মনে হল কেউ কাউকে জোরে লাথি মারল বা ধাক্কা দিল আর মুখে বলল, যা, যা, কামিনা, তুরন্ত ভাগ তেরা জান লেকর৷ আজ স্রিফ তোহর কানই কাট লিয়া, ফিন কভভি বদতমিজি কিয়াতো জানহি লে লুঙ্গা৷
দুটি লোক ধুতি-পরা, গায়ে সাদা-কালো দেহাতি কম্বল জড়ানো, পায়ে নাল-লাগানো নাগরা-জুতো, মাথাতে বাঁদুরে টুপি, তোরা যাকে ইংরেজিতে বলিস ‘ব্যালাক্লাভা’ তাই পরে মরি-কি-পড়ি করে দৌড়ে আসছে৷ তার মধ্যে একজন মাথার টুপিটা খুলে ফেলেছে আর যেখানে তার কান থাকার কথা সেখানে একটি ভয়াবহ সাংঘাতিক রক্তাক্ত ক্ষত৷ পেছনের জন নাকে হাত দিয়ে দৌড়ে আসছে আর ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে তার নাক থেকে৷
ততক্ষণে পথের সেই বাঁকে এসে একটি ছিপছিপে যুবক, তার গায়ে দেহাতি হাতে-বোনা গরম কাপড়ের হাঁটু-অবধি ঝুলের পাঞ্জাবি আর ধুতি, পায়ে নাগরা জুতো, দু-হাত দু-কোমরে রেখে হো হো করে হাসছে ফুলে ফুলে আর বলছে, আজ স্রিফ তু দোনোকো কান ঔর নাকহি কাটকে ছোড় দিয়া৷ যা, মহল্লামে যাকর ঘর-ঘরমে দিখা ঔর বোল যো ডাক্কু পিপ্পাল পাঁড়েনে আজ নাক ঔর কানকি সবজি বানাকে মুঁংগকি ডাল কি সাথ খায়েগা দোপেহরমে৷ যোভি হামে পাক্কাড়নেকি লিয়ে আয়েগা উসলোগোঁকি হাল অ্যাইসিই হোগা৷
লোক দুটোর জামাকাপড় দামি৷ তারা পেছনে না তাকিয়ে প্রাণভয়ে দৌড়ে এসে আমি যেখানে আড়াল নিয়ে ছিলাম তারই সামনে এসে দাঁড়াতে তাদের হেনস্থার রকমটা পুরোপুরি জানা গেল৷
ওরা আমাকে দেখতে পায়নি৷ এ অন্যর রক্তাক্ত মূর্তির দিকে চেয়ে তাকিয়ে আঁতকে উঠছে আর হিক্কা তোলার মতন শব্দ করছে৷ আয়না তো নেই যে নিজের ছিরি নিজে দেখবে! দেখলে অবশ্য ওইখানেই অজ্ঞান হয়ে চিতপটাং হত৷
একজন বলল, আমার বন্দুকটাও কেড়ে নিল৷
নাক-কাটা, নাকি সুরে খোনার মতন বলল, চালানা নেই আতা তো বন্দুক পাক্কড়কে আয়াথা কিঁউ?
ঔর তুমহারা ক্যা চাক্কু চালানা আতা? উওভি তো লে লিয়া৷
হুঁ৷ বলে কেঁদে উঠল খোনা৷ বলল, হামারা আমরিকান চাক্কুয়া৷ আমরিকান৷ হুঁ৷
লোক দুটো চলে গেলে আমি আস্তে আস্তে বেরিয়ে ডাকু যেদিক থেকে এসে বাঁকে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে অট্টহাসি হাসছিল সেই দিকে বন্দুক রেডি-পজিশানে ধরে এগিয়ে চললাম পথের একেবারে বাঁদিক ঘেঁষে৷
বলেই, ঋজুদা নামিয়ে রাখা পাইপটা তুলে নিয়ে পাইপটা ধরাল৷
তুমি কি সেইদিনই ধরলে ডাকু পিপ্পাল পাঁড়েকে?
ভটকাই প্রশ্ন করল৷
ঋজুদা মাথা নাড়িয়ে জানাল, না৷
তবে? কবে ধরলে?
বেশ কিছুদিনের চেষ্টার পরে৷
বল, বল ঋজুদা৷
তিতির বলল৷
ঋজুদা বলল, পুরোটাই যদি আজই শুনে ফেলিস তাহলে বিরিয়ানির হান্ডি যে কাঁদবে৷ এদিকে রান্না তো হয়ে গেছে৷ ওই দ্যাখ পেছনে চেয়ে ভগ্নদূত দাঁড়িয়ে৷
আমরা একই সঙ্গে পেছনে চেয়ে দেখি গদাধরদা এসে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়েছে৷ আমরা মুখ ফেরাতেই বলল, সেই মিঞায় শুদোতিচে যে হাড্ডি নিকলাবে কিনা?
আমরা সকলে সমস্বরে হেসে উঠলাম৷
ঋজুদা আমাদের দিকে নীরব ভর্ৎসনার চোখে চেয়ে গদাধরদাকে বলল, গদাধরদা, কথাটা ‘‘হাড্ডি নিকলানো’’ নয়, ‘‘হান্ডি নিকলানো’’৷
বিরক্ত গদাধরদা বলল, ওই হল্লো৷
গল্পটা এখুনি এখুনি না শুনলে তো রেশ কেটে যাবে ঋজুদা৷
আর এখুনি এখুনি না খেলে যে বিরিয়ানিটাই মাঠে মারা যাবে৷
ভেতর থেকে আজ্জু মহম্মদ বেরিয়ে এসে বলল, বিলকুল ঠিক৷
ঋজুদা বলল, হবে, পরে হবে৷ এখন ছোট্ট করে শুনলে তো৷ পরে পুরোটা শোনাব৷
—