2 of 3

‘সা-রে-মা’তে

‘সা-রে-মা’তে

কথাটা হলো—জীবনের সঙ্গে ধর্ম মেলাব, না ধর্মের সঙ্গে জীবন মেলাব! যদি ধর্মের সঙ্গে জীবন মেলাতে হয় তাহলে সংসার ছাড়তে হবে, সন্ন্যাস নিতে হবে। এদিক ওদিক দু-দিক রাখা চলবে না। সে পেরেছিলেন জনকরাজা। ঠাকুর বলছেন :

“জনক রাজা মহাতেজা তার বা কিসে ছিল ত্রুটি।
সে যে এদিক ওদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি।।”

সংসারে থেকে ঈশ্বরকে পাওয়ার বাধাটা কোথায়! ঠাকুরঘর যদি নাও থাকে একটা কুলঙ্গি তো আছে। সেখানে দেব-দেবীর চিত্রপট। ধূপের সমারোহ। অনেকে আবার স্টিলের আলমারির ওপরের তাকে মূর্তি রাখেন, গণেশ অথবা বাণলিঙ্গ শিব। পুঁচকে ঘণ্টা, হোমিওপ্যাথিক ঘটি, ছোট্ট রেকাবি, মিনি গেলাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চটজলদি পুজো সারেন। টিংটিং ঘণ্টাবাদন, দোপাটির পাপড়ি বর্ষণ, গোটা চারেক নকুলদানার নৈবেদ্য। রাজধানীর স্পিডে স্তোত্রপাঠ, ধূপের ঘূর্ণন, আড়ে আড়ে ঘড়ির দিকে তাকানো, চার্টার্ড বাস ছেড়ে না যায়! পাশের ঘরে ছেলে মানুষ হচ্ছে। ছেলের মা উত্তম-মধ্যম দিচ্ছেন। কচি শিশু জি-তে আটকে আছে, কিছুতেই এইচ-এ যেতে চাইছে না। কেবলই লাফ মেরে চলে যাচ্ছে—এলো, মেলো, পি। এরই মাঝে ‘জবাকুসুমসঙ্কাশং’, ‘তাড়াতাড়ি খেতে দাও’, ‘কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং’, ‘ওকে এইবার ছাড় না, এবার দুজনেই উন্মাদাশ্রমে যাবে’, ‘ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং’, ‘আজ আর বাসটা পেলুম না!’ …

এবপ্রকার ভজনায় ঈশ্বরলাভ কি সম্ভব! মনবিযুক্ত মননে তিনি কি আসবেন! ঠাকুর বলছেন : “সংসারে হবে না কেন? তবে বড় কঠিন। জনকাদি জ্ঞানলাভ করে সংসারে এসেছিলেন। তবুও ভয়! নিষ্কাম সংসারীরও ভয়। ভৈরবীকে দেখে জনক মুখ হেঁট করেছিল, স্ত্রীদর্শনে সঙ্কোচ হয়েছে! ভৈরবী বললে, ‘জনক! তোমার দেখছি এখনো জ্ঞান হয় নাই; তোমার এখনো স্ত্রী-পুরুষ বোধ রয়েছে।’ কাজলের ঘরে যতই সেয়ানা হও না কেন, একটু না একটু কালো দাগ গায়ে লাগবে।”

বলেই বলছেন : “দেখেছি, সংসারী ভক্ত যখন পুজো করছে গরদ পরে তখন বেশ ভাবটি। এমনকি জলযোগ পর্যন্ত এক ভাব। তারপর নিজ মূর্তি, আবার রজঃ তমঃ।”

সংসারে সমস্যাটা কি? ঠাকুর বোঝাচ্ছেন : “সংসার জল আর মনটি যেন দুধ। যদি জলে ফেলে রাখ, তাহলে দুধে-জলে মিশে এক হয়ে যায়, খাঁটি দুধ খুঁজে পাওয়া যায় না।” তারপর বলছেন : “সংসার যেন বিশালাক্ষীর দ, নৌকা দহে একবার পড়লে আর রক্ষা নাই। সেঁকুলকাটার মতো এক ছাড়ে তো আরেকটি জড়ায়। গোলকধান্দায় একবার ঢুকলে বেরুনো মুশকিল। মানুষ যেন ঝলসা পোড়া হয়ে যায়।’

কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। ওর ভিতর অনেকদিন থাকলে হুঁশ চলে যায়—মনে হয় বেশ আছি। মেথর গুয়ের ভাঁড় বয়-বইতে বইতে আর ঘেন্না থাকে না। গুটিপোকার উপমা দিচ্ছেন—কেটে বেরিয়ে আসতে পারে, বেরুবে না, ঐ আবরণেই মৃত্যু হবে। আবার যেন ঘুনির মধ্যে মাছ; যে-পথে ঢুকেছে সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু বেরুবে না। কেমন জলের মিষ্টি শব্দ, অন্য অন্য মাছের সঙ্গে খেলা! একেবারে মশগুল অবস্থা। ছেলেমেয়ের আধ আধ কথাবার্তা যেন জলকল্লোলের মধুর শব্দ! মাছ অর্থাৎ জীব, পরিবারবর্গ। তবে দু-একটা দৌড়ে পালায়, তাদের বলে মুক্ত জীব।

ঠাকুর গান গেয়ে বলছেন :

“এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে।
ব্ৰহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি জানিতে পারে।।
বিল করে ঘুনি পাতে মীন প্রবেশ করে তাতে।
গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে।।”

এই সত্যের ওপর ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের অধিষ্ঠান। জীব চিরটাকাল ধরে সংসারে আসবেই। এছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। সন্ন্যাসীর সংসার থাকে না। সংসারীরই সংসার হয়। মহামায়ার মায়ায় তার বিচরণ। জীবের জৈবধর্ম পালন করতেই তার আসা। অতএব ধর্মের সঙ্গে সব ত্যাগ করে জীবন যোগ করা সকলের পক্ষে সম্ভব হবে না। সে হলো লক্ষে একটি দুটি ঘুড়ি কাটার মতো।

ঠাকুরের কথা হলো, জীবনের সঙ্গে ধর্ম যোগ কর। একের পরে শূন্য বসাও তখন তার মূল্য বাড়বে। এক সরালে শূন্য শূন্যই। খুঁটি ধরে থাকার কথা বলছেন। সব ত্যাগ, বাহ্য ত্যাগ। সে তো উত্তম কথা। “উখার দো মকান, লাগা দো তম্বু, নিয়ে কৌপিন-ঝোলা শ্মশানে চলে গেল ভোলা।” ঠাকুর বলছেন, বহুত আচ্ছা, লেকিন এক বাত, তোমার মন! তার কাছ থেকে পালাবে কেমনে! সেখানে তো একটাই কথা, তিক্ত কথা—

“মনে বাসনা থাকিতে কি হবে বল না জপিলে তুলসীমালা।

চিতে কামনা থাকিলে নাকে তিলক কাটিলে ভোলে কি চিকন কালা।।” গলার কাছে পায়রার মটরদানার মতো সংসার গজগজ করছে, তুমি সন্ন্যাসী হয়ে আত্মপ্রবঞ্চনা করছ! যদি এই তোমার সন্ন্যাস হয় তাহলে তুমি যাও, তোমার মতো সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার কোন প্রসঙ্গ নেই। সংসারী! তুমি এস, “সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছ এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা নাহলে হবে না। এক হাতে কর্ম কর, আরেক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাক। কর্ম শেষ হলে দুই হাতে ঈশ্বরকে ধরবে। মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত।” “তোমাদের সব ত্যাগ করতে হবে কেন? তোমরা রসে-বসে আছ। সা-রে-মাতে। তোমরা বেশ আছ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *