2 of 3

“ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”

“ডাক ডাক ডাক্তার ডাক”

হাঁ কেশব, তোমাদের কলকাতার বাবুরা নাকি বলে ‘ঈশ্বর নাই”? বাবু সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, এক পা ফেলে আরেক পা ফেলতেই ‘উঃ পাশে কি হলো’ বলে অজ্ঞান। ডাক ডাক ডাক্তার ডাক! ডাক্তার আসতে আসতে হয়ে গেছে। অ্যাঁ- এরা বলেন ঈশ্বর নাই!

প্রতিটি জীবনের খোপে একটি করে মৃত্যুর মটরদানা ভরা আছে। জীবনও বাড়ছে মৃত্যুও বাড়ছে। সঙ্গের দোসর। যেন যমজ! তুমি তাকে ভুলে থাকলেও, সে তোমাকে ভুলে নেই। সেকালের ধনী বা সম্পন্ন বাড়ির মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে যখন প্রথম শ্বশুরবাড়িতে আসত তখন বাপের বাড়ির এক দাসী আসত সঙ্গে। মৃত্যুকেও আমরা সেইভাবে ডুলিতে চাপিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসি। অদৃশ্য এক অন্তঃপুরচারিণী। মৃত্যুর স্বভাবই হলো, জীবনকে না জড়িয়ে থাকতে পারে না। মৃত্যুই এক অর্থে জীবন। কি রকম! মৃত্যু যেন কাউন্টার খুলে বসে আছে। প্রতিদিন একটি করে দিনের পরমায়ু-রূপ কারেন্সি নোট নিয়ে জগতের বাজারে ভাঙাতে বেরোচ্ছি। একদিন হঠাৎ সেই ব্যাঙ্কার বলবেন, তোমার অ্যাকাউন্টে আর কিছু নেই। সব শেষ। এইবার তোমাকে প্রবাস থেকে নিজ বাসে ফিরতে হবে। “মন চল নিজ নিকেতনে!” আরেকভাবে বলা যায়, পৃথিবীতে আসার পাসপোর্ট দেবেন পিতা-মাতা। ভিসা দেওয়ার মালিক মৃত্যু।

একটি লোক সারাজীবন ধরে অনেক খেটেখুটে অনেক অর্থ সঞ্চয় করে ভাবলে, আর কেন, এইবার একটু আরাম করা যাক, এইবার একটু ভোগ করা যাক। মৃত্যু এসে হাজির—চল বাছা, ডাক এসেছে। লোকটি বলল, সে কী! সারা জীবন ছোটাছুটির পর এই তো আমি বসছি। এতকাল শুধু সঞ্চয় করেছি, এইবার তো আমি ভোগ করব!

মৃত্যু বললেন, ভায়া, সে তো আমি জানি না। দেখা যাচ্ছে, তোমার অ্যাকাউন্টে আর জীবনের দিন নেই।

লোকটি তখন ঘুষ দেবার চেষ্টা করছে—তোমাকে তিন লাখ দিচ্ছি, তিনটে দিন আমাকে দাও।

মৃত্যু বললেন, অসম্ভব।

বেশ, আমি একটা দিনের জন্য এক কোটি দিচ্ছি।

মৃত্যু দুহাত বাড়িয়ে বললেন, ভাই! জগতের সমস্ত সম্পদের বিনিময়েও তোমাকে এক মিনিট সময় দেওয়া যাবে না। চলে এস। জেনে রাখ, পৃথিবীর সবকিছু কেনা যায়, কেনা যায় না সময়।

“কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরিক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল-
তুলি নিল দ্রুত রথে …।”

এই মৃত্যু আমাদের অন্তরস্থ মৃত্যু। সহজাত। আমাদের দম। আমাদের জীবন পেণ্ডুলামের দোলনকাল। আমাদের আয়ু-প্রদীপের তেল। এর সঙ্গে পরিবেশগত মনুষ্যসৃষ্ট জৈব মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। ভাইরাসে মারবে, কি বুলেটে মরব, কি চাকার তলায় থেঁতলে যাব—সে যাওয়ার কল মানুষের তৈরি। প্রজাপতিকে বাঁচতে দিলে, কোন কোন প্রজাতির একমাস পর্যন্ত বেঁচে থাকার কথা; কিন্তু যদি পাখিতে খেয়ে ফেলে, মানুষ যদি অ্যালবামে আটকাবার জন্য মেরে ফেলে, তখন তো কোন উপায় নেই! প্রাণিবিদ্রা একে বলেছেন—Nature’s wastage। এক চৌবাচ্চা জলে একটি পরিবারের একটি দিন চলে যাওয়ার কথা। কেউ যদি জল বেরিয়ে যাওয়ার ফুটোটি খুলে রাখে! ঋষিরা বলছেন, দিন, মাস, বছর দিয়ে আয়ুর হিসাব হবে না। হিসাব হবে শ্বাস আর প্রশ্বাস দিয়ে। বুকের হাপর যদি ভসভস চলে, অনিয়ন্ত্রিত, অনবরত; তাহলে অকালেই তোমার দম ফুরোবে।

আহা! গোঁসাই গোপালের কেমন কথা! লালনের পরে কুষ্টিয়া অঞ্চলে বাউল-মতাবলম্বী এই রসিক বৈষ্ণব সাধকের উদ্ভব। শিলাইদহের গোঁসাই গোপাল। গৃহস্থাশ্রমের নাম—রামগোপাল জোয়ারদার। তিনি গাইছেন—

“দমের মানুষ দমে চলে,
আলেক মানুষ আলের উপর।
আর এক মানুষ গোপনে রয়,
জেনে শুনে সাধন কর।।
তিন মানুষের খেলা রে মন,
কারে বা কর অন্বেষণ,
তিন মানুষের তিন রূপ করণ,
সদ্‌গুরু মন আগে ধর।।
জন্মদ্বার আর মৃত্যুর দ্বারে
আর এক দ্বার আর কইব কারে,
মৃত্যুর দ্বারে যে জন্মাইতে পারে,
তার সাধন হবে অমর।।
তিন রতিতে তিন জনে রয়,
আধরতি ‘মা’ গোপনে বয়,
গোঁসাই রামলাল যথাৰ্থ কয়,
গোপাল, মরার আগে জীয়ন্তে মর।।”

‘আলেক মানুষ’ মানে হৃদয়বিহারী পরমাত্মা। ‘দমের মানুষ’ কি? মানবদেহ- সরোবরে বায়ুরূপ হংস। তিনি আবার কে! গুরু, অন্তর্যামী। দেহ-সরোবরে তাঁর বিহার; কিন্তু তিনি থাকেন কোথায়! আল বা সীমানার পরপারে। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়ি কেমন করে! এই যে বলছেন—

“জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।।
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে।
গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে
তাহার পানে চাই দু-বাহু বাড়ায়ে।।”

তাহলে, ঠাকুর বারে বারে বলছেন, মৃত্যুকে চেন। বৌদ্ধ সাধকদেরও একই কথা—মৃত্যুর দর্পণে জীবনকে দেখ—”Life and death are seen as one whole, where death is the beginning of another chapter of life. Death is a mirror in which the entire meaning of life is reflected. “

ঠাকুর বলছেন, ঘটাকাশ আর চিদাকাশ। কালরূপী অনন্ত সমুদ্রে উপুড় করা একটা ঘট। ভিতরেও জল, বাইরেও জল। আমি, আমার—এই অহং-ঘটটি ভেঙে গেলেই আমিও নেই তুমিও নেই। কে আছেন? ঠাকুর নিজেই বলছেন, কে বলবে?

“ন তদ্ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *