2 of 3

বাক্সটাকে সাজাও

বাক্সটাকে সাজাও

ঠাকুর বললেন, শোন হে কলকাতার ছোকরা, তোমার বিশ্বাস আছে? ভিতরটা হাতড়াতে শুরু করলাম, কি আছে ভিতরে? কে আছ হে! ভিতরটা ফাঁকা। ফাঁকাই বা বলি কি করে! অনেক রকম জিনিস কিলবিল করছে। আবর্জনা বলি কি করে! আধুনিক যুগ এইগুলিকেই তো বস্তু বলছে। বিষয়বাসনা। ভোগ চাই। ঈশ্বরবিশ্বাস কোথায়! ঈশ্বরকে তো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলেছি। এমনভাবে জড়িয়েছি তাঁর দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমি তো এখন তাঁকে হুকুম করি। ভগবান! এক সপ্তাহের মধ্যে একলাখ টাকা দাও। একটা ফ্ল্যাট কিনব, ‘ইনস্টলমেন্ট’। যদি দিতে পার তাহলে আমার বিশ্বাসে তোমার অস্তিত্ব কয়েক দিনের জন্য। এক সপ্তাহ পরেই বলব, আমার ছেলের রেজাল্ট বেরবে। আই.এ.এস. দিয়েছে। ঈশ্বর, সে যেন পাশ করে।

ঠাকুর! আমার বিশ্বাসে ঈশ্বর একজন ‘কম্পাউন্ডার’। ‘কাউন্টার’-এ বসিয়ে রেখেছি—এই কাশির ওষুধ তো পরক্ষণেই বদহজমের। আমার ইচ্ছার বিপরীত কিছু হলেই, কে ঈশ্বর! তিনি কার কি করেছেন! ঐ তো আমার প্রতিবেশী সর্বক্ষণ ভগবান নিয়েই থাকতেন। নিত্য কালীপূজা। দেখে এলাম, সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেছেন। পাড়ার একটি মেয়ে সেবা করছে; কারণ তিনি অবিবাহিত। আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। এই তো ঈশ্বরের বিচার! একটা খুব সত্য কথা অকপটে বলি ঠাকুর—আমি দেনেওয়ালা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, লেনেওয়ালা ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই। তিনি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারকা, প্রাণী, ব্রহ্মাণ্ড যাই রচনা করে থাকুন না কেন, আমাতে তিনি আছেন, কি তাঁতে আমি আছি—এই প্রশ্নেও আমি সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার শুধু চাই। অসংখ্য, অজস্র আমার চাহিদা। আমাকে বিষয়ী মানুষরা বলেছেন—পুরুষকারই সারকথা। একালের এই চড়া আলোর চমকদারি সভ্যতায় মানুষের ভাবালুতা ‘ভেপার’ হয়ে গেছে। ঠাকুর। মা কালী রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধছেন, কি শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণ ভেবে সমুদ্রকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে তলিয়ে যাচ্ছেন—এমনতর কাহিনীতে একালের কেজো মানুষের কোন ভাবান্তর হবে না। এখন সব অমন মানুষ, যাদের কথা আপনি তখনি অনুমান করে গল্পের আকারে বলেছিলেন।

সেই দুই বন্ধুর গল্প। ভাগবত পাঠ হচ্ছে। একজন বললে, আয় ভাই শুনি। অপরজন বললে, কি ভ্যাজর ভ্যাজর করছে, ইচ্ছা হয় তুমি শোন, আমি একটু ফুর্তি করে আসি। যে শুনতে বসল তার মন কিন্তু পড়ে রইল ঐখানে, যেখানে তার বন্ধু গেছে ফুর্তি করতে। একালের অধিকাংশ মানুষের ধর্মবোধ ঐরকম। একটা প্রথা চলে আসছে বহুদিন। তা চলুক। বলা তো যায় না, কিসে কি হয়! একেবারে তো খারিজ করে দেওয়া যাচ্ছে না। নতুন সংস্কার তৈরি না হলে পুরনোটা তো জ্বালাবেই। সাপের ছুঁচো গেলা। না যায় ফেলা, না যায় গেলা। তিনতলায় কীর্তন। বাড়ির বুড়ো কর্তা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে সামাল দিচ্ছেন। আর আধুনিক বাজার-সভ্যতার টনিকে উত্তপ্ত ‘নিউ জেনারেশন’ নিচের বৈঠকখানায় টেলিভিসনে সেঁটে আছে। ক্রিকেট আগে না কীর্তন আগে! প্রেমদাতার ঐ প্রেমে আমাদের রুচি নেই। ‘কৃষ্ণ বলিতে আঁখি না ঝুরে।’ আমরা ‘সলিড’ প্রেমটাই বেশি বুঝি, ‘লিকুইড’ প্রেমে মতি নেই। আমাদের পুরী—’মাইনাস জগন্নাথ’। সমুদ্রটাই আসল—’সি অ্যান্ড স্যান্ড।’

তাহলে কি হবে ঠাকুর!

কি আর হবে? তোমার হবে না, বাবা! তুমি তোমার যুক্তি-তর্ক, আঁষ- চুবড়ি নিয়ে থাক। রসুন খেয়ে রসুনের ঢেঁকুর তোল। কাজলের ঘর থেকে ভূত হয়ে বেরিয়ে এস। কেউ তো তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে বলেনি, তোমাকে চোখ উলটে সমাধিতে চলে যেতে হবে! তোমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, একটুকরো জমি, দুটো খুপরি ঘর, এক চিলতে কার্পেট, একটা সেন্টার টেবিল, একটা ফ্রিজ, একটা টি.ভি., একটা লোমওয়ালা কুকুর—এইসব নিয়ে যেমন আছ থাক না, কেন অশান্তি করছ। ধর্ম তো ‘জিমনাসিয়াম’-এ গিয়ে ডাম্বেল, বারবেল ভাঁজা নয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপে টিপে দেখবে, বাইসেপ, ট্রাইসেপ বাড়ছে কিনা! ফিতে দিয়ে মেপে দেখবে, বুকের ছাতি ছাপান্ন হলো কিনা!

বাবা সারকথাটি শোন—

“নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।২।২৩)

শাস্ত্রে পরিষ্কার কথা। বেদ পড়ে ফর্দাফাই করে ফেল। আইনস্টাইন, হকিং, পেনরোজের মতো মাইলের পর মাইল ‘ইকোয়েশন’ লিখে ফেল, সভার পর সভায় গিয়ে বক্তৃতার পর বক্তৃতা শোন। কিস্যু হবে না। পিঁয়াজের বাটি। তাহলে উপায়—”যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ।” তিনি কৃপা করে এসে তোমাকে না ধরলে তোমার কিছুই হবে না। এ তোমার ইউনিয়ন করে ঝাণ্ডা উড়িয়ে হেডকোয়ার্টারের সামনে চেল্লাচিল্লি করলেও হবে না।

আমার নরেনের কথা শুনেছ তো! খুব ট্যাঁক ট্যাঁক করে বলত। সেই বলেছিল না—”তীর্থে বা মন্দিরে গেলে, তিলক ধারণ করিলে অথবা বস্ত্রবিশেষ পরিলে ধর্ম হয় না। তুমি গায়ে চিত্রবিচিত্র করিয়া চিতাবাঘটি সাজিয়া বসিয়া থাকিতে পার, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত না তোমার হৃদয় খুলিতেছে, যতদিন পর্যন্ত না ভগবানকে উপলব্ধি করিতেছ, ততদিন সব বৃথা।” আমার নরেন কেমন ভাগ করে করে দেখিয়েছে শোন—(১) বিদ্বৎ সন্ন্যাস, (২) বিবিদিষা সন্ন্যাস, (৩) মর্কট সন্ন্যাস, (৪) আতুর সন্ন্যাস। হঠাৎ ঠিক ঠিক বৈরাগ্য হলো, তখনি সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে পড়ল—এটি প্রাকজন্ম সংস্কার না থাকলে হয় না। তা তুমি এইবার দেখ পূর্বজন্মে বিশ্বাস করবে কিনা! তোমার বিজ্ঞান, তোমার ইয়ার-দোস্তরা কি বলে!

তোমাকে আমি হতাশ করছি না। আমার নরেনের কথাতেই তোমাকে সাহস দিই—

“আমাদের মনের একটি প্রবৃত্তি বলে—’এই কাজ কর’; আরেকটি বলে ‘করিও না’। আমাদের ভিতরে কতকগুলি প্রবৃত্তি আছে, সেগুলি ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া বাহিরে যাইবার চেষ্টা করিতেছে; আর তাহার পশ্চাতে, যতই ক্ষীণ হউক না কেন আরেকটি স্বর বলিতেছে—’বাহিরে যাইও না।’ এই দুইটি ব্যাপার দুইটি সুন্দর সংস্কৃত শব্দে ব্যক্ত হইয়াছে—প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি। প্রবৃত্তিই আমাদের সকল কর্মের মূল। নিবৃত্তি হইতেই ধর্মের উদ্ভব। ধর্ম আরম্ভ হয় এই ‘করিও না’ হইতে। আধ্যাত্মিকতাও ঐ ‘করিও না’ হইতেই আরম্ভ হয়। যেখানে এই ‘করিও না’ নাই সেখানে ধর্মের আরম্ভই হয় নাই বুঝিতে হইবে।”

এখন তুমি যখন এইসব ভাবছ, তখন বুঝতে হবে তুমি আমাদের ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছ। এবার ঢুকে পড়। ঐ কোণে গিয়ে বস। বাক্সটাকে সাজাও। বেশ কিছু ফেলে দাও। তারপর যা পাও, তাই ভর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *