2 of 3

প্ৰণাম

প্ৰণাম

ঠাকুর, আমি আপনার নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করি। ভীরু, দুর্বল, অক্ষম, অপদার্থ বলে নয়। গৃহ ছেড়ে সন্ন্যাসী হব বলেও নয়। মানুষ হব বলে আমি আপনার শরণার্থী। গৃহে থেকেও আমি আপনার অনুগামী, আর সেইটাই আমার গর্ব। এত বিক্ষিপ্ততা, এত চঞ্চলতা, এত প্রলোভন, কিন্তু সেই আপনারই নির্দেশ—দেখিস, নিক্তির নিচের কাঁটা আর ওপরের কাঁটা, কাঁটায় কাঁটায় যেন এক হয়ে থাকে। ওপরের কাঁটা হলেন আপনি আর নিচের কাঁটা হলো আমার মন। অনুক্ষণ রামকৃষ্ণলগ্ন। তার অর্থ? রামকৃষ্ণ তো শুধু একটা নাম নয়— বেঁচে থাকার বিজ্ঞান। ষড় রিপুকে বাগে রাখার বল্গা। আর যেই বলেছি, আপনি আমার অহঙ্কার, সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছে—বাপকা বেটা সিপাহীকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। আপনি যার পিতা, তার কি বেচাল সাজে! ঠাকুর, চীন দেশে অনুপম একটা কথা আছে—ছেলে তার পিতাকে কতটা শ্রদ্ধা করে তা বোঝা যাবে পিতার দেহাবসানের পরে। কিভাবে? সন্তান তার পিতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে কিনা! পিতার আদর্শে সে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে কিনা। পিতার জীবনধারা সে বজায় রাখতে পেরেছে কিনা! যদি পেরে থাকে তবেই সে সুসন্তান। নয় তো সে ভ্রষ্ট। যতই সে ছবিতে মালা ঝোলাক আর জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন করুক। কিছুই কিছু নয়।

ঠাকুর আমি আপনার প্রকৃত অনুগামী হতে চাই। ভড়ং দেখিয়ে নয়। কাজে, স্বভাবে, আমার আচরণে। লজ্জাই হলো আমার দর্পণ! যেমন? লজ্জা দৰ্পণ হয় কি করে? যদি কেউ বলে—আরে ছি ছি—এই নাকি রামকৃষ্ণ-সন্তান? এই তার কাজ, এই তার কথা! লজ্জা। সেই দর্পণে আমার মলিন, ভণ্ডমুখের প্রতিফলন। আমার আচরণে আপনি যেন অপমানিত না হন। আপনি বলতেন—”সাধু সাবধান।” আমি নিজেকে বলি—রামকৃষ্ণ সন্তান অতিশয় সাবধান। লজ্জা পেতে পেতে লজ্জা আর লজ্জা থাকে না, হয় অঙ্গভূষণ। অপমানিত হতে হতে অপমান আর থাকে না, হয় গলার পদক। লজ্জার দর্পণটি ভেঙে যায়। কথায় আছে এককান কাটা গ্রামের বাইরে দিয়ে যায়, দুকান কাটা যায় ভিতর দিয়ে। তার তো আর কোন লজ্জা থাকে না তখন।

আমি আপনার সম্মান বাড়াতে পারব না, অপমানের কারণ হব—এই আমার ভয়। এই ভয়ই আমার ব্রেক। যদি কেউ বলেন, আরে মুছে ফেল না তোমার পরিচয়। খুলে ফেলে দাও তোমার অনুগামীর পোশাক। অনুসরণের পথ ছেড়ে বিস্মরণের দিকে যাও না। সে উপায় যে নেই। যে জানে সে জানে।

ঠাকুর একদিন সকালে ঝাউতলার দিক দিয়ে গাড়ু হাতে ফিরছেন। অদ্ভুত একটা শব্দ কানে এল তাঁর। উঁকি মেরে দেখলেন। দেখেন কি, একটা ঢোঁড়া সাপ একটা কোলা ব্যাঙ ধরেছে। ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, ঢোঁড়ায় ধরেছে কিনা, তাই এই অবস্থা। গিলতেও পারছে না, ওগরাতেও পারছে না। জাতসাপে ধরলে এই অবস্থা হতো না। ঠাকুর যে আমার সেই জাতসাপ! অ্যায়সা ধরেছেন যে একেবারে বিষে নীল—জর্জর। এই যখন আমার অবস্থা তখন ফেরার আর পথ কোথায়! এই জীবনটা আমাকে তাঁর হাত ধরেই কাটাতে হবে।

কোন্ হাত? অপবিত্র হাত হলে তো চলবে না। পবিত্র হাত হওয়া চাই। সাবান দিলেই তো হলো না। সাফা হলো বটে। পবিত্র হতে হলে, সৎকর্ম আর সৎচিন্তার সাবান ঘসতে হবে। সৎকর্ম কি। দান-ধ্যান, গঙ্গাস্নান, তিলকসেবা, ঘণ্টা নাড়া, স্তোত্রপাঠ, নিরামিষ ভক্ষণ, তীর্থভ্রমণ? না। ঠাকুর এক চড় মেরে বললেন, ওসব নয়, নয় নয়। নিজেকে ঠকিও না। তোমার ধারণা হবে—খুব হচ্ছে, খুব বুঝি এগুচ্ছি! আসলে হচ্ছে না কিছুই। ও তোমার নিত্যকৃত্যের তালিকায় ঢুকে ভক্তিহীন, মনঃসংযোগহীন, যান্ত্রিক অভ্যাসের মতো হয়ে যাবে। কিরকম জান? আমার সেই ‘লাগ ভেলকি’ গল্পটা তোমাকে বলেছিলুম, মনে আছে?

আছে ঠাকুর। লাগ ভেলকি লাগ ভেলকি করছিল এক মাদারিওয়ালা, হঠাৎ জিভ উলটে সমাধি লেগে গেল। যেই তার সমাধি ছুটে গেল, অমনি আবার সে, লাগ ভেলকি শুরু করে দিল। এর অর্থ কি ঠাকুর? এই প্রসঙ্গ এল কেন?

তুমি ভাব, ভেবে বল।

তাহলে কি এইরকম? প্রবল নামসঙ্কীর্তন করছি, কি তারস্বরে বিশুদ্ধ সংস্কৃত স্তোত্র আওড়াচ্ছি, ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে প্রবল আরতি করছি। হঠাৎ একদিন ঘোর লেগে গেল। কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইলুম। তার অর্থ এই নয় যে, আমার সিদ্ধিলাভ হয়ে গেল।

ঠিক। ওটা সিদ্ধি নয়, ঘোর। নিতাই আমার মাতা হাতি বলে ধেই ধেই নাচতে নাচতে শেষে আর বলতে পারি না, বলি, মা হা। ঘোর লেগেছে। সেকরার ধর সমাধি হলো। সমাধি যেই ভাঙল, সে অমনি আবার হাতুড়ি ঠুকতে শুরু করল। একটু-আধটু সোনাও সরাতে লাগল। সেই তার আগের স্বভাব। স্বভাব বদলাচ্ছে কিনা দেখতে হবে। কাম, ক্রোধ, মদ, মাৎসর্য কমছে কিনা। বাজে কথা শুনতে ভাল লাগে না, কইতেও ভাল লাগে না। কেবল তাঁর কথাই শুনতে ভাল লাগে। দিবারাত্র তাঁর প্রসঙ্গেই রুচি অন্য প্রসঙ্গে অরুচি। তোমার হচ্ছে কিনা বোঝার শ্রেষ্ঠ উপায়, তাঁকে মনে পড়ামাত্রই তোমার চোখে জল আসবে। ইষ্ট তোমাকে দর্শন দেবেন। দর্পণটি পরিষ্কার রাখ, দর্শন যদি পেতে চাও। সৎচিন্তা আর সৎপ্রসঙ্গ, অনুক্ষণ তাঁতে মগ্ন থাকা। কিন্তু কর্ম তো থাকবেই। গৃহী যখন, তখন বিষয়কর্ম তো থাকবেই। কর্তব্য কর্ম। আমার ঠাকুর বলছেন, অবশ্যই থাকবে। স্ত্রীপুত্র পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তোমাকে করতেই হবে। সৎপথে জীবিকার্জন। কারো কাছে হাত পাতবে না। আর দুখচেটে সংসারী হবে না। সন্ধ্যায় সব ঘর যেন আলোকিত হয়। সিঁড়িতে প্রবেশদ্বারে অবশ্যই যেন আলো থাকে। ঠাকুর কেশব সেনের বাড়িতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছেন : “এইসব জায়গায় আলো দেবে, আলো দিতে হয়।” নিজের মনে বলেছিলেন, তদগত ভাবে। সামান্য নির্দেশ। যৎকিঞ্চিৎ উপদেশ। গভীর কোন তত্ত্বকথা নয় কিন্তু। অথচ এই একটি নির্দেশেই ঠাকুর, আমি আপনাকে আমার পরম পিতা হিসাবে ধরে ফেলেছি। গৃহীর প্রতি আপনার কি অসীম করুণা! সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে আলো দেবে। কেন? অন্ধকার, দারিদ্র্যের লক্ষণ, আলস্যের লক্ষণ, তামসিকতার লক্ষণ, উদাসীনতার লক্ষণ, অবহেলার লক্ষণ, অসচেতনতার লক্ষণ, মনের জড়তার লক্ষণ। আলো মানে আনন্দের প্রকাশ। চিদানন্দেরই প্রতিফলন। এই আলোর জন্য গৃহী তুমি আলস্য ত্যাগ কর। দৈহিক এবং মানসিক আলস্য। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন—”ক্লৈবং মাস্ম গমঃ পার্থ।” ক্লীব হয়ে যেও না। গৃহীর ক্লীবতা কি? বাহ্যক ও আভ্যন্তরীণ অন্ধকারে থাকা। গৃহকে আলোকিত করার জন্য উপার্জন, হৃদয়ের গেহকে আলোকিত করার জন্য সাধনা। অতিথি যেমন গৃহ দেখেন, ঈশ্বর তেমনি মন দেখেন। অন্ধকার গৃহে আলোকিত প্রাণী থাকতে পারে না। মন আলোকিত না হলে প্রাণী আলোকিত হতে পারে না। একটি উপদেশে আমার ঠাকুর প্রাণ আর পরিবেশের শেষ কথা বলে গেছেন। একালের হাজারটা সাইকোলজিস্টের কাছে যাবার প্রয়োজন নেই। আলো করে থাক। বাইরে আলো। ভিতরে আলো।

স্বামীজী ঠাকুরের এই কথাটি তাঁর নিজের মতো করে, কালোপযোগী করে বলেছিলেন : “ওরে ধর্মকর্ম করতে গেলে আগে কূর্মাবতারের পূজা চাই—পেট হচ্ছেন সেই কূর্ম। এঁকে আগে ঠাণ্ডা না করলে তোর ধর্মকর্মের কথা কেউ নেবে না। দেখতে পাচ্ছিস না, পেটের চিন্তাতেই ভারত অস্থির।… ধর্মকথা শোনাতে হলে আগে এদেশের লোকের পেটের চিন্তা দূর করতে হবে। নতুবা শুধু লেকচার-ফেকচারে বিশেষ কোন ফল হবে না।

অর্থাৎ ভাত-কাপড়ের সমস্যা মেটাও। অভাব দূর করে নিজের পরিবারে আলো আনো। দক্ষিণেশ্বরে আমার ঠাকুরের কাছে, বেশ মজার এক মানুষ আসতেন। সংসারে বিষম বিতৃষ্ণা। সংসার ত্যাগই করে ফেলবেন এমন অবস্থা। তিনি ঠাকুরের ঘরে এলেন। ঠাকুরকে সবাই ঘিরে আছেন। ধর্মকথা হচ্ছে। তিনি একপাশে মাদুর পেতে ভোঁস ভোঁস করে খুব খানিক ঘুমিয়ে আবার মাদুরটি গুটিয়ে তুলে রেখে চলে যেতেন। তাঁর কাণ্ড দেখে ঠাকুর হাসতেন। অভাবীর বৈরাগ্য, অলসের বৈরাগ্য, রাজার বৈরাগ্য, লোকদেখানো বৈরাগ্য, ব্যবসায়ীর বৈরাগ্য, চোরের বৈরাগ্য, ভোগীর বৈরাগ্য, প্রকৃত বৈরাগ্য— কতরকমের বৈরাগ্য যে আছে, ঠাকুর সবই লক্ষ্য করেছিলেন। সংসার ফেলে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল। বেশ কিছুদিন বেপাত্তা। বউ ছেলে মেয়ে পড়ে রইল অভাবে, অনাহারে, অসহায় অবস্থায়। মাসতিনেক যেতেই পোস্টকার্ড এল। বেনারসের ছাপ মারা—”আমার একটি কর্ম জুটিয়াছে। শীঘ্রই তোমাদের লইয়া আসিব।” মর্কট বৈরাগ্য অসহ্য ছিল আমার ঠাকুরের। অন্তর্যামী বুঝতে পারতেন। ধর্মকে যাঁরা পলায়নের পথ ভাবতেন তাঁদের ধমক দিতেন—লজ্জা করে না, বিয়ে করেছ, ছেলেপুলেও হয়েছে, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কে নেবে? ভূতে? পাড়াপড়শীরা? আগে কর্তব্য করে এস, তারপর সব হবে।

তাহলে ঠাকুর আমার দুই হাতের পবিত্রতা আসবে কিভাবে?

এইভাবে, একটি হাত সৎ জীবিকায়, আরেকটি হাত আমার চরণে। যেই কর্ম তোমাকে মুক্তি দেবে তখন তোমার দুহাত নিয়ে আমাকে ধরবে। সংসারের প্রতি তোমার কর্তব্য কতদিন? না যতদিন তোমার সন্তান-সন্ততি জীবিকায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

ঠাকুর যে হাতটি আপনি ধরেছেন, সেই হাত বেয়ে যে ভাবতরঙ্গ আপনাতে প্রবাহিত হচ্ছে তার শুদ্ধতা, অশুদ্ধতার বিচার আপনি করবেন। আপনি বলেছিলেন—মন হলো মাছি। এই বিষ্ঠায় বসে, তো এই মধুতে। অনেক চেষ্টা করেছি আপনার নির্দেশে মনকে সেই মাছি করতে যা শুধুই ফুলে বসে। এখনো পারিনি। চেষ্টা করছি, পারছি না। কোন আড়ম্বর রাখিনি, যেমন বলেছিলেন, মনে, বনে, কোণে সেইভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছি। আপনি বলেছিলেন সুতোয় সামান্য একটু ফেঁসো থাকলে ছুঁচের ফুটোয় ঢুকবে না। কামনা-বাসনার সামান্যতম ফেঁসো মনে লেগে থাকলে ঈশ্বররূপী সূচে প্রবেশ করবে না। রামকৃষ্ণ-সূচে মন প্রবিষ্ট করাতে যতটা পবিত্র হওয়া উচিত তা হয়নি। সে আমার মনমাছির অক্ষমতা। আপনার চরণ থেকে মাঝে মাঝে আমার মন টলে যায়।

স্বামীজী আমাদের বলেছিলেন, “সেই নষ্ট সাম্যাবস্থা।” কোন্ সাম্যবস্থা, গীতায় ভগবান যেমন বলেছিলেন, “সুখেদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।” সেই নষ্ট সাম্যাবস্থা ফিরে পেতে গেলে—”আমাদের প্রথমে তমঃকে ব্যর্থ করতে হবে রজঃ দ্বারা, পরে রজঃকে জয় করতে হবে সত্ত্ব দ্বারা। সত্ত্ব অর্থে সেই স্থির ধীর প্রশান্ত অবস্থা, যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, শেষে অন্যান্য ভাব একেবারে চলে যাবে।” স্বামীজী আমাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, “বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে দাও, মুক্ত হও, যথার্থ ঈশ্বরতনয় হও, তবেই যীশুর মতো পিতাকে দেখতে পাবে। ধর্ম ও ঈশ্বর বলতে শক্তি, অনন্ত ‘বীর্য’ বোঝায়। দুর্বলতা-দাসত্ব ত্যাগ কর। যদি তুমি মুক্তস্বভাব হও, তবে তুমি কেবল আত্মা মাত্র। যদি মুক্তস্বভাব হও, তবেই অমৃতত্ব তোমার করতলগত।”

ঠাকুর আমার একটাই ভয়, যে হাত আপনি ধরেছেন, সেই হাত যেন অপবিত্র করে না ফেলি কর্মদোষে, কলুষিত চিন্তায়। আমার কারণে আপনি যেন ছোট না হয়ে যান। আমার এই ভয়ই আমার লাগাম। রামকৃষ্ণানুগতের বেচাল বড় দৃষ্টিগ্রাহী। যে হৃদয়গৃহে আপনি আসবেন সেখানে যেন সৎকর্ম, সম্ভাবনার আলোটি জ্বলে। আরো কথা ছিল, আজ আর হলো না। প্ৰণাম।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *