2 of 3

কাতরে কর করুণা

কাতরে কর করুণা

ঠাকুর, বড় দ্রুত সবকিছু পালটে যাচ্ছে। আপনি জানেন কি, আমরা যৌথ পরিবার ভেঙে ফেলেছি। একালে সব একক পরিবার। স্বামী, স্ত্রী, একটি-দুটি সন্তান। দয়া করে কেউ কেউ মা-বাবাকে একটু আশ্রয় দেন চক্ষুলজ্জার খাতিরে। সে বড় করুণ দৃশ্য! তাঁরা সংসারে থাকেন পরবাসীর মতো। উদাস হয়ে। পরিবারের ভালমন্দ সম্পর্কে কথা বলার কোন অধিকার তাঁদের থাকে না। সাধ্যমতো তাঁরা শ্রমদান করেন। তাঁদের এই নিরুপায় উপস্থিতির জন্য নিত্য অশান্তি হয়। তাঁরা সহ্য করেন। প্রতি মুহূর্তে ভাবেন কবে ‘ডাক’ আসবে। শিক্ষিত বাঙালী বলবেন, আমরা সব ধীরে ধীরে সাহেব হচ্ছি তো! বিলেতে এইরকমই হয়। সেখানে বুড়ো মা-বাবার খবর শিক্ষিত, উচ্চ উপার্জনকারী, প্রগতিশীল যুবকরা রাখে না। ওসব হলো বাজে ভাবালুতা। যতদিন শক্তি, ততদিন পৃথিবীর ভোগ-সুখাদি তোমার। যখন অথর্ব তখন তুমি জঞ্জাল। যৌথ পরিবার ভাঙা মানে প্রাচীন বিশ্বাস, আদর্শ ও সংস্কারের অন্তর্জলি। একটা ধারা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। আদর্শহীনভাবে বাঁচা মৃত্যুরই সামিল। একালের কজন মানুষ প্রকৃত জীবিত! মানুষ বেঁচে নেই, বেঁচে আছে তার অভ্যাস। একালের মানুষ হলো কতকগুলো অভ্যাসের সমষ্টি। খানিকটা লোভ, খানিকটা হিংসা, কিছুটা মিথ্যা, আলস্য, ফাঁকিবাজি, ধাপ্পা, ধান্দা প্রভৃতির সমাহার। মানুষের ভিতর থেকে হুঁশটা বেরিয়ে চলে গেছে। মানুষের মানটা আছে। আমি মানুষ এই গর্বটুকু ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

ঠাকুর, আপনি ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আপনি জানতেন কৃপা ছাড়া মানুষের স্বভাব পালটাবে না। সেকাল আর একাল, সবকালের মানুষেরই স্বভাব এক। একমাত্র গুরুকৃপায় মানুষের হুঁশ আসতে পারে, নইলে নয়।

ঠাকুর, আপনি তিরস্কার করে বলছেন—স্ত্রী-সন্তানের জন্যে লোকে এক ঘটি কাঁদে; টাকার জন্যে লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষের কান্নার তিনটি বস্তু পাওয়া গেল—স্ত্রী, সন্তান, টাকা। যৌবনের তিনটি প্রবল নেশা—স্ত্রী, সন্তান, অর্থ। কি সেকালে, কি একালে। অতঃপর আপনি স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের স্বরূপও উন্মোচন করেছেন। বলছেন : “বদ্ধজীবেরা সংসারের কামিনী- কাঞ্চনে বদ্ধ হাত-পা বাঁধা। আবার মনে করে যে, সংসারের ঐ কামিনী ও কাঞ্চনেতেই সুখ হবে, আর নির্ভয়ে থাকবে। জানে না যে ওতেই মৃত্যু হবে। বদ্ধজীব যখন মরে তার পরিবার বলে—তুমি চললে, আমার কি করে গেলে?”

তার মানে সর্বকালেই স্বার্থ। একালে একটু বেশি। মানুষের বার্ধক্যের সেই একই চিত্র—তুমি আমার জন্য কি করে গেলে? নিঃস্বার্থ প্রেম বলে কিছু নেই। ছিল না কোনকালে। সংসার মানে একটা রফা। দেওয়া আর নেওয়ার সম্পর্ক গরু যতদিন দুধ দেবে, ততদিনই তাকে দলাই মলাই—কুঁড়ো দেবে, জাবনা দেবে, ভেলি গুড়ের ঢেলা গেলাবে। বুদ্ধিমান সেই কারণে রেস্তোটি ঠিক রাখে। শেষদিন পর্যন্ত সেইটা বাজায়। বাজনা শুনে এগিয়ে আসে সেবা করতে, লোভে লোভে। বুড়ো মরলে সব আমার হবে। আপনার জন কেউ না এলেও পর আসে। তাই তো প্রবাদ—আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়েও বন ভাল।

সময়ের পথ ধরে আরো অতীতে গেলে দেখবে সেই এক হতাশ চিত্র। রামপ্রসাদ গাইছেন—”যার জন্য মরো ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে। সেই প্রেয়সী দেবে ছড়া অমঙ্গল হবে বলে।” “কেউ কারো নয়’ এই বোধ সে-যুগের সমাজও গেঁথে দিতে পেরেছিল অন্তর্মুখী মানুষের মনে। কাম আর কাঞ্চনে মানুষের প্রবল আসক্তি সহজে যাবার নয়। সব যুগের মানুষই ছোঁক ছোঁক করে সারা জীবন। করবেই, কারণ—”আহারনিদ্রাভয়মৈথুনঞ্চ সমানমেতৎ পশুভিনরাণাম্।” পশু আর মানুষে খুব একটা পার্থক্য কোথায়! তাই আপনি বারে বারে আঘাত করেছেন কঠিন কঠোর ভাষায়। বলেছেন, বিচার কর। নিজের সঙ্গে বিচার। বলছেন ‘বস্তুবিচার’। পুরুষভক্তদের কাছে বলছেন তো? তাই প্রথম বিচারের বিষয় কামিনী। বিচার কর। ঠাকুরের বিচার আবার সাঙ্ঘাতিক। বলছেন একেবারে এইভাবে—”মেয়েমানুষের শরীরে কি আছে— রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়িভুঁড়ি, কৃমি, মুত, বিষ্ঠা—এইসব। সেই শরীরের ওপর ভালবাসা কেন?” স্বামীজী হলেন আগুন। তিনি আরো কঠিন ভাষায় বলছেন, শ্রীমকে—”নির্লিপ্ত সংসার বলুন আর যাই বলুন, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে হবে না।… যে স্থানে কৃমি, ক্লেদ, মেদ, দুৰ্গন্ধ’–

“অমেধ্যপূর্ণে কৃমিজালসঙ্কুলে স্বভাবদুর্গন্ধ নিরন্তকান্তরে।

কলেবরে মূত্রপুরীষভাবিতে রমন্তি মুঢ়া বিরমস্তি পণ্ডিতাঃ।।” কী অপূর্ব কথা আচার্য শঙ্কর ‘বিবেকচূড়ামণি’তে বলছেন! কী সুন্দর উপমা!

“লক্ষ্যচ্যুতং চেদ্ যদি চিত্তমীষদ্
বহির্মুখং সন্নিপতেত্ততস্ততঃ।
প্রমাদতঃ প্রচ্যুতকেলিকন্দুকঃ
সেপানপঙক্তৌ পতিত্যে যথা তথা।।”

অসাধারণ চিত্র! আমি একটা বল নিয়ে সিঁড়ির উচ্চধাপে দাঁড়িয়ে আছি। বল হলো আমার মন, আমার চিত্ত। আমি সেই বলটা লোফালুফি করছি। হলো কি, বলটা হঠাৎ আমার হাত ফসকে সিঁড়ির ধাপে পড়ে গেল। আর কি কোন উপায় আছে। সেই বল লাফাতে লাফাতে সোজা চলে যাবে নিচের দিকে। একেবারে সিঁড়ির শেষ ধাপে। আচার্য শঙ্কর বলছেন—বহির্মুখ চিত্তও বিষয় হতে বিষায়ান্তরে এইভাবেই নিম্নগামী হবে। তাকে আর ফেরানো যাবে না।

“বিষয়েম্বাবিশেচ্চেতঃ সঙ্কল্পয়তি তদ্‌গুণান্।
সম্যক্ সঙ্কল্পনাৎ কামঃ কামাৎ পুংসঃ প্রবর্তনম্।।”

ইংরেজীতে যাকে বলে ‘প্রসেস’ বা প্রক্রিয়া, সাইকেল বা চক্র আচার্য শঙ্কর সেইটি দেখিয়ে দিয়েছেন। মনে বিষয়-স্মৃতি জাগল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল চিন্তা, বিষয়টি কেমন, তার গুণ, রমণীয়তা। সঙ্গে সঙ্গে কামোদ্রেক। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই বিষয় লাভের জন্য।

ঠাকুর এইবার কাঞ্চন বিচার করছেন—”টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, কাপড় হয়, থাকবার জায়গা হয়—এই পর্যন্ত। কিন্তু এতে ভগবান লাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না—এর নাম বিচার; বুঝেছ?”

মাস্টারমশাই বলছেন : “আজ্ঞে হ্যাঁ; প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক আমি সম্প্রতি পড়েছি, তাতে আছে বস্তুবিচার।”

ঠাকুর বলছেন : “হ্যাঁ, বস্তুবিচার! এই দেখ টাকাতেই বা কি আছে আর সুন্দর দেহেই বা কি আছে। বিচার কর সুন্দরীর দেহতেও কেবল হাড়, মাংস, চর্বি, মল-মূত্র—এইসব আছে। ঈশ্বরকে ছেড়ে এইসব বস্তুতে মানুষ কেন মন দেয়?”

সেকাল আর একাল, মানুষ আর মানুষের সমাজ কিছুমাত্র বদলায়নি। ঠাকুর সমাজের আরেকটি চিত্র তুলে ধরেছেন। সেটি হলো—অকারণে পরের ব্যাপারে নাক গলানো। ঠাকুর স্বামীজীকে প্রশ্ন করছেন : “নরেন্দ্র তুই কি বলিস? সংসারী লোকেরা কত কি বলে! কিন্তু দেখ, হাতি যখন চলে যায়, পেছনে কত জানোয়ার কতরকম চিৎকার করে। হাতি কিন্তু ফিরেও চায় না। তোকে যদি কেউ নিন্দা করে তুই কি মনে করবি?”

সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজীর উত্তর : “আমি মনে করব, কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।” কি ঠাকুরের কালে, কি আমাদের এই কালে, দেব-মানব ও পশু-মানবের সহ অবস্থান। তারও আগে তুলসীদাসের কালেও সেই একই চিত্র —যব হাতি চলে বাজারমে কুত্তা হুঁকে হাজার। সাত্ত্বিকের ওপর তামসিকের অত্যাচার মানবসমাজের এক বৈশিষ্ট্য। নিরীহ, অক্রোধী মানুষকে মানুষ মারবে। অহিংস মানুষের মৃত্যু হয় সহিংস মানুষের হাতে। মানুষের সমাজ এই নীতিতেই চলে। অভ্যাস করে। যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল এই মানুষ। অহিংসার পূজারী মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। ফ্রয়েডের শিষ্য মনস্তাত্ত্বিক উইলহেল্ম রাইখের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। মানুষের উত্তরাধিকারটি কি – “You are heir to a dreadful past. Your heritage is a burning diamond in your hand.” ভয়ঙ্কর অতীতের আমরা উত্তরাধিকারী। আমাদের ঐতিহ্য একখণ্ড জ্বলন্ত হীরের মতো আমাদের হাতের তালুতে। এই হলো মানুষের সর্বকালের পরিবেশ। রাইখের বর্ণনায় চিত্রটি সুপরিস্ফুট—মানুষের হাতেই মানুষের নির্যাতন। গ্রহান্তরের মানুষ এসে আমাদের নির্যাতন করে না- “He suffers and rebels, he esteems his enemies and murders his friends, wherever he gains power as a representative of the people, he misuses this power and makes it into something more cruel than the power which previously he had to suffer at the hands of individual sadists of the upper class.”

এই প্রসঙ্গেই ঠাকুরের সেই সাপের গল্প। রাখালরা দৌড়ে এসে বললে : “ঠাকুরমশাই! ওদিক দিয়ে যাবেন না। ওদিকে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ আছে।” ব্রহ্মচারী বললেন : “বাবা তা হোক। আমার তাতে ভয় নেই, আমি মন্ত্র জানি।” সাপের গুরু হলেন ব্রহ্মচারী। মন্ত্র দিলেন। বলে গেলেন—”মা হিংসি।” অহিংস হয়ে যাও। দীর্ঘকাল পরে ফিরে এসে দেখেন, সাপ মরো মরো। রাখালেরা প্রথম প্রথম ইট মেরে, ল্যাজ ধরে খুব ঘুরপাক খাইয়ে আছড়ে ফেলে আধমরা করে দিয়েছে। অবস্থা দেখে ব্রহ্মচারী হিংস্র সমাজে অহিংস হয়েও বেঁচে থাকার কৌশলটা বলে গেলেন—”আমি কামড়াতেই বারণ করেছি, ফোঁস করতে নয়।”

ঠাকুর হলেন সর্বকালের গুরু। কাল সেই একই আছে। হিংস্ৰ সমাজ। কাম-কাঞ্চনের দাস মানুষ। তার হাতে জ্বলন্ত হীরকখণ্ডের মতো তার ঐতিহ্য। গণপ্রতিনিধি অতীত সংস্কার করতে গিয়ে গড়ে তুলবে নিষ্ঠুরতম বর্তমান। সংসারের অন্তঃসারশূন্যতা দেখেও উটের মতো কাঁটাগাছ চিবোবে। দু-কষ বেয়ে রক্ত গড়াবে। গেল গেল বলে মানুষ চিৎকার করবে আবার ছুটেও যাবে সেই হাড়িকাঠে মাথা গলাতে। অমলিন আনন্দের উৎস ঠাকুর। বলছেন, বিচার কর। বস্তুবিচার। একটা হাত সংসারে আরেক হাত ঈশ্বরের পায়ে। অনিষ্ট করো না কিন্তু ফেঁাস ছেড়ো না। আর,

“মা ভৈষ্ট বিদ্বংস্তব নাস্ত্যপায়ঃ
সংসার সিন্ধোস্তরণেহস্ত্যপায়ঃ।
যেনৈব যাতা যতয়োঽস্য পারং
তমেব মার্গং তব নিৰ্দিশামি।।”

আচার্য শঙ্করের কথা, আশ্বাসবাণী—ভয় পেও না। তোমার বিনাশ হতে পারে না। সংসার-সাগর উত্তীর্ণ হবার উপায় আছে। বিচারসহায়ে বিষয় ভোগবিমুখ হও। অতঃপর শরণ নাও তত্ত্বজ্ঞ পুরুষের। আত্মানন্দ-বিভোর সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ তখন তোমাকে অবশ্যই করুণা করবেন। কারণ তোমার করুণ অবস্থা দেখে তাঁর করুণা হবে।

ঠাকুর! কাতরে কর করুণা।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *