2 of 3

সাধন দুর্গ

সাধন দুর্গ

“আমার (শ্রীশ্রীমা) পায়ে হাত বুলায়ে দেয়। তারপর আমি আবার নমস্কার করি।” কী অসাধারণ সম্পর্ক। কত সালের কথা? ১৮৮৪ সাল। সেইসময়ে সমাজে নারীর সামাজিক মর্যাদা কি ছিল? কিছুই নয়। পর্দানসীনা। সংসারের জোয়াল টানা আর সন্তান ধারণ করা—এই ছিল নারীর ভূমিকা।

আমার গভীর বিশ্বাস, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মতো কাম-কাঞ্চন জয়ী অবতারপুরুষ একটিমাত্র কারণেই বিবাহ করেছিলেন, সেই কারণটি হলো আগামীকালকে নারীর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করা। কৃষ্ণাবতার শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, উপদেশ নয়, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও। ঠাকুর সেই কাজটি করেছিলেন। শুধু বিবাহ নয়, সব ব্যাপারেই ঠাকুর করে দেখিয়ে গেছেন। “যত মত তত পথ”-বলার আগে সর্বমতের সাধন করে দেখেছেন, দেখিয়েছেন, সব পথেই তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করার কথা বলতে গিয়ে, নিজে ত্যাগ করে দেখিয়ে দিলেন। প্রমাণ করলেন সব ছাড়লে তবেই সব পাওয়া যায়। তবেই তিনি বলতে পেরেছিলেন—”পান খাওয়া, মাছ খাওয়া, তামাক খাওয়া, তেল মাখা—এসব তাতে দোষ নেই। এসব শুধু ত্যাগ করলে কি হবে? কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগই দরকার। সেই ত্যাগই ত্যাগ। গৃহীরা মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে সাধন-ভজন করে, ভক্তিলাভ করে মনে ত্যাগ করবে।”

মহা সংশয়! সংসারী যদি সব ত্যাগ করে, সংসার কে চালাবে? না খেয়ে মরতে হবে তো! ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন : “ঘরে ঘটিবাটিও আছে, হরে প্যালাদের খাইয়ে দিই, আবার যখন হাবীর মা এরা আসে এদের জন্যও ভাবি। রহস্যটা কি?

রহস্য হলো সমর্পণ। এই নাও আমার হাত। মা, আমি জানি না কিছু। তুমিই আমার সব। আমি যদি জ্ঞানী সাধক হই বলব, আমি তোমার বাঁদরের ছানা ঠাকুর বলছেন : “বাঁদরের ছানা আগে তার মাকে ধরে, পরে তার মা তাকে সঙ্গে করে যেখানে সেখানে নিয়ে বেড়ায়।” আর আমি যদি ভক্ত সাধক হ‍ই তাহলে বলব, মা আমি তোমার বেড়ালের ছানা। ঠাকুর বলছেন : “বেড়ালের ছানা কেবল এক জায়গায় বসে মিউ মিউ করতে থাকে; তার মা যখন যেখানে ইচ্ছা হয় ঘাড়ে ধরে নিয়ে যায়। ভক্ত সাধকেরা ঈশ্বরকে সকলের কর্তা জ্ঞান করে, তাঁর চরণে বিড়াল-ছানার ন্যায় নির্ভর করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকে।

এ কি তবে আলস্য? কর্মে বিমুখতা? না কর্ম তোমাকে করতে হবে। পড়ে পড়ে ঘুমোলে চলবে না। কিন্তু মনে মনে জানি, যা করেন কালী। কর্ম আমার ফল তোমার। তাহলে কি হবে? ঠাকুর বলছেন : “যে ঠিক ভক্ত সে চেষ্টা না করলেও ঈশ্বর তার সব জুটিয়ে দেন। যে ঠিক রাজার বেটা, সে মাসোহারা পায়। উকিল-ফুকিলের কথা বলছি না—যারা কষ্ট করে, লোকের দাসত্ব করে টাকা আনে। আমি বলছি, ঠিক রাজার বেটা। যার কোন কামনা নেই, সে টাকাকড়ি চায় না, আপনি আসে। গীতায় আছে—’যদৃচ্ছালাভ।’

কোন্ শ্লোকটির কথা বলছেন? চতুর্থ অধ্যায়ের বাইশতম শ্লোক

“যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীত বিমৎসরঃ।
সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে…।।” (৪।২২)

যদৃচ্ছালাভে পরিতুষ্ট। যা জুটল জুটল। নিজের কোন আগ্রহ নেই। শীত- গ্রীষ্মে কষ্ট পেলেও গ্রাহ্য করি না। বিষণ্ণ হই না। মাৎসর্যহীন। অর্থাৎ নির্বের। কারোর সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই। লাভালাভে হর্ষবিষাদরহিত।

কিন্তু ত্যাগ বললেই কি আর ত্যাগ হবে? ঠাকুর বলছেন প্রারব্ধ সংস্কার। মনে করলেই ত্যাগ করা যায় না। ঠাকুর একটা গল্প বলছেন—”একজন রাজাকে এক যোগী বললে, তুমি আমার কাছে বসে থেকে ভগবানের চিন্তা কর। রাজা বলে, সে বড় হবে না, আমি থাকতে পারি। কিন্তু আমার এখনো ভোগ আছে। এ-বনে যদি থাকি, হয়তো বনেতে একটি রাজ্য হয়ে যাবে। আমার এখনো ভোগ আছে।”

শ্রীশ্রীমাকে ঠাকুর বিবাহ করেছিলেন, বিদ্যার সংসার কাকে বলে তা দেখাবার জন্য। “ঈশ্বরলাভের পর যে সংসার সে বিদ্যার সংসার। কামিনী- কাঞ্চন তাতে নেই। কেবল ভক্তি, ভক্ত আর ভগবান।” সেই জীবনে স্ত্রীর কি রূপ। ঠাকুর বলছেন : “একদিন ভাবে রয়েছি (পরিবার) জিজ্ঞাসা করলে- আমি তোমার কে? আমি বললুম, ‘আনন্দময়ী।”

স্ত্রীকে আনন্দময়ী দেখতে হলে জিতেন্দ্রিয় হতে হবে। ঠাকুর বলছেন : “তা নাহলে পরিবারকে আটমাস কাছে এনে রেখেছিলাম কেমন করে?” জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় কিরকম করে? সেও তো এক কঠিন সাধনা। ঠাকুর করেছিলেন। “আপনাতে মেয়ের ভাব আরোপ করতে হয়। আমি অনেকদিন সখীভাবে ছিলাম। মেয়েমানুষের কাপড়, গয়না পরতুম, ওড়না গায়ে দিতুম। ওড়না গায়ে দিয়ে আরতি করতুম।”

ঠাকুর জানতেন সবাই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হবে না। কিন্তু গৃহী হবে। সংসারী হবে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘর করবে। তাদের সামনে জ্বলন্ত একটা উদাহরণ রেখে যেতে হয়। তাই আমাদের ঠাকুরও গৃহী। তাঁর বাইশ বছর বয়সে ছয় বছরের সারদাকে বিবাহ করলেন। তাঁর তখন কি অবস্থা? সকলে বললে, পাগল হলো। তাই তো এর বিবাহ দিলে। উম্মাদ অবস্থা। প্রথম চিন্তা হলো— পরিবারও এইরূপ থাকবে খাবে-দাবে।”

গিরিশ একদিন কথায় কথায় বলে বসলেন—”আপনারও তো বিয়ে আছে?” ঠাকুর হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিলেন—”সংস্কারের জন্য বিয়ে করতে হয়। কিন্তু সংসার আর কেমন করে হবে? গলায় পৈতে পরিয়ে দেয়, আবার খুলে পড়ে যায়। সামলাতে পারি নাই। একমতে আছে, শুকদেবের বিয়ে হয়েছিল সংস্কারের জন্যে। একটি কন্যাও নাকি হয়েছিল।”

শ্রীশ্রীমাকে না পেলে ঠাকুর সম্পূর্ণ হতেন না। পুরুষ শক্তিকে আশ্রয় করবে। হরের পাশে গৌরী, রাধার পাশে কৃষ্ণ। শ্রীশ্রীমাও দেখিয়ে দিলেন, আদর্শ নারী, আদর্শ স্ত্রীর স্বরূপ কি? নহবতে আছেন কি নেই ভক্তরাও জানতে পারতেন না। শ্রীম লিখেছেন : “শ্রীশ্রীমা ঠাকুরের সেবা করিবার জন্য আসিয়াছেন ও অতি নিভৃতে নবতে বাস করেন। নবতে তিনি যে আছেন, ভক্তেরা প্রায় কেহ জানিতেন না।” জানা যেত তখনই, যখন শ্রীশ্রীমা রুটি আর ছোলার ডাল প্রস্তুত করে ভক্তদের পাঠাচ্ছেন।

ঠাকুর তাঁর ওপর নির্ভর করতেন তার প্রমাণ, ঠাকুর বলছেন : “উঃ আমার কি অবস্থা গেছে। মন অখণ্ডে লয় হয়ে যেত। এমন কতদিন! সব ভক্তি-ভক্ত ত্যাগ করলুম! জড় হলুম। দেখলুম মাথাটা নিরাকার, প্রাণ যায় যায়! রামলালের খুড়িকে ডাকব মনে করলুম।” ঐ অবস্থায় যাঁকে মনে পড়ল তিনি শ্ৰীশ্ৰীমা।

ঠাকুর আবার মায়ের বাধ্য; কারণ ঠাকুরের সস্তান ভাব। বলেছেন : “আমি এক জায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। রামলালের খুড়িকে জিজ্ঞাসা করাতে বারণ করলে। আর যাওয়া হলো না। খানিক পরে ভাবলুম—উঃ সংসার করি নাই, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগী, তাতেই এই! সংসারীরা না জানি পরিবারদের কাছে কিরকম বশ!”

এই বশ্যতার কথা ঠাকুর জানতেন। বিদ্যার সংসারে শক্তিকে আশ্রয় করে তৈরি কর সাধন দুর্গ ঘরে ঘরে। এই ছিল আমার ঠাকুরের বার্তা সর্বকালের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *