2 of 3

অরূপরতন

অরূপরতন

প্রিয়ের প্রিয় অধিক প্রিয়। এইকথা বোধহয় ভাগবত বলছেন। আমার প্রিয় তুমি। তোমার প্রিয় সে। সে তাহলে আমার আরো বেশি প্রিয়। সেই যুক্তিতেই আমি মা সারদাকে ধরেছি।

মা! ঠাকুরের কাছে সরাসরি যেতে আমার ভয় করে। ভীষণ ভয়। চাপা একটা অভিমানও আছে বইকি! তিনি স্বামীজীকে বেশি ভালবাসেন। তিনি ব্রহ্মানন্দে, যোগানন্দে, প্রেমানন্দে, নিরঞ্জনানন্দে, শিবানন্দে, সারদানন্দে, রামকৃষ্ণানন্দে, অভেদানন্দে, অদ্ভুতানন্দে, তুরীয়ানন্দে, অদ্বৈতানন্দে বিভোর হয়ে আছেন। সেখানে আমার প্রবেশাধিকার কোথায়! সেখানে ত্যাগ-বৈরাগ্য হোমাগ্নির মতো অবিরত জ্বলছে। তিনি ত্রিগুণাতীতানন্দে, অখণ্ডানন্দে, সুবোধানন্দে, বিজ্ঞানানন্দে বিভোর। গৃহিভক্তরা ঘর আলো করে আছেন— পূর্ণচন্দ্র, শম্ভুচরণ, নাগমশাই, বলরাম বসু, মাস্টারমশাই, অধরলাল, গিরিশচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ, রামচন্দ্র, মনোমোহন, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ।

সেখানে আমার স্থান কোথায়? সেখানে কত তত্ত্বকথা, তথ্যকথা, কীর্তনানন্দ, ভজনানন্দ, মুহুর্মুহু সমাধি। এই ক্ষুদ্র, দুর্বল মানুষটির সেখানে প্রবেশাধিকার আছে কি? একটা কিছু হচ্ছে বটে। কলকাতার ঘ্যাঁচোর ম্যাচোর জীবনস্রোত বাইরে প্রবাহিত। উদর আর শিশ্নের মহা সংগ্রাম সেখানে। ঠাসাঠাসি প্রতিযোগিতা। সেই জগতের প্রতিনিধি আমি। কবে কোথায় সামান্য একটু বিজ্ঞানের ABC পড়েছিলুম। তাইতেই ঈশ্বর আমার মনে সমাধিলাভ করেছেন। একালের সংবাদপত্রে জেনেছি, ধর্ম কুসংস্কার, মহাপুরুষের মহাকথা জীবনবিমুখ মহাপ্রলাপ। মানুষ হলো আয়ারাম আর গয়ারাম মাত্র। ওকে ঠেলে ফেলে দিয়ে তুমি এগোও। ইউ অ্যান্ড ইউ অ্যান্ড ওনলি ইউ! প্রেম আবার কি! মধ্যযুগীয় দুর্বলতা। মানুষ যখন চারবেহারার পালকি চেপে অরণ্যের পথ ধরে যেত, রাতের অন্ধকারে তারার খইফোটা আলোই দিশার ভরসা। বাঘ, ভাল্লুক, ঠ্যাঙাড়ে, ডাকাত। বাহুবল আর লাঠির বলই বল। তখন হয়তো ঈশ্বর ছিলেন। ইষ্টনাম স্মরণ। মা আছেন আর আমি আছি। একালে কোথায় অরণ্য, কোথায় তারার আলো! টাকার ঝনৎকারে সব ‘জো হুজুর’ বলে হাজির! ঈশ্বরের কথা একবার হয়তো মনে পড়তে পারে, সেই ষাট পেরলে। যখন দাঁত আর হাড় ভাঙতে পারে না। হার্ট নামক টুলুপাম্পটি আর তেমন শক্তিতে রক্ত পাম্প করতে পারে না, যখন নিজেই একটি আমহদপুর সুগারমিল। যখন নেক্সট জেনারেশন ঘুরতে ফিরতে বুঝিয়ে দেবে—বুড়ো, তোমার দিন শেষ, এখন আমাদের জমানা। যদি অসুবিধা হয় ভাই, পিতা তুমি স্বর্গ হলেও, বৃদ্ধদের জন্য যে-খোঁয়াড় তৈরি হয়েছে সেইখানেই না হয় ব্যবস্থা করি। আর পাঁচটা ট্রাবলসাম বুড়োর সঙ্গে ভালই থাকবে। অতীতের কথা বলবে। এই জেনারেশন তোমাদের জ্ঞানের হাত থেকে বাঁচবে।

সেই জগতের আমি এক প্রতিনিধি। দ্বিচারী। দরজাটি খুলে উঁকি মারলেই, ঠাকুরের শীতল দৃষ্টি—কোল্ড স্টেয়ার। নীরব প্রশ্ন—’কে তুই! কি চাস! তুই তো এখানকার লোক নোস! যা, যা, রাসমণির বাগান এখন তোদের উপযোগী করে মডার্ন করা হয়েছে। সেইখানে যা। সেখানে গেলে তোর আর মনেই হবে না—আমি এখানে একদিন সাধনা করেছিলাম, নরেন পঞ্চবটীর তলায় ধ্যানে পাথর হয়ে যেত—অনাবৃত পিঠে মশার কার্পেট! এখন সব তোদের মতো করে ফেলেছে। যা, যা মজা কর। এখানে কি করতে এসেছিস! চোখ দুটো যতই ঢুলু ঢুলু কর, মুখটা যতই নিষ্পাপ শিশুর মতো করার চেষ্টা কর, ওরে, আমি যে তোর ভিতরটা দেখতে পাচ্ছি। সে-জায়গাটা যে অঙ্কট-বঙ্কট হয়ে আছে!’

ঐ শীতল দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারি না। আমি প্রথামত একটি বিশ্বাসশূন্য, ভক্তিহীন প্রণাম করে ফিরে আসায় সন্তুষ্ট হতে পারব না। আমি যে তাঁর একটু প্রশ্রয় চাই। তাঁর নক্ষত্র-সভার একপাশে একটু স্থান চাই। আমি নরেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ হতে পারব না। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও হতে পারব না। জীবনের বদহজম ‘আমি’র উদ্গার তুলবে। তবু তিনি আমাকে গ্রহণ করবেন—এইটাই আমি চাই।

এসেছ কি আসনি, এই উপেক্ষা আমার সহ্য হবে না। তাই দরজা বন্ধ করে নহবতের দিকেই যাই। সেখানে তুমি রয়েছ, নরেন্দ্রাদি ভক্তের জন্যে আজও রুটির আটা ঠাসছ। উনোনে ফুটছে অড়হর ডাল। রাখাল খাবেন। মুখ তুলে তাকালে। একপাশ আগুনের আভায় আলোকিত। অপর পাশ অন্ধকার। মুখে মৃদু হাসি। ঠাকুরের ঘর থেকে ভেসে আসছে গানের সুর। ‘গাওরে আনন্দময়ীর নাম।’ বসন্তের অকৃপণ বাতাস।

তুমি বললে, কি মনে করে! খোদ মালিক তো ঐ ঘরে!

যাই, আবার ফিরে ফিরে আসি।

কেন!

ভয় করে। ঠাকুর যে এক মন চান। একটু কম বেশি হলে চলবে না। তিনি বলেছেন, কাম-কাঞ্চনে মন থাকলে চলবে না। তিনি যে বলেছেন, নিক্তির নিচের কাঁটা আর ওপরের কাঁটা যেন এক হয়ে থাকে। মা! ঠাকুরের কথাবার্তায় আমি ঘাবড়ে যাই। মনমরা হয়ে যাই।

কী এমন কথা বললেন তিনি?

ঐ যে সেদিন, ঘরে অনেকেই ছিলেন, মাস্টারমশাইও ছিলেন। তখন বলছিলেন : “শরীরের লক্ষণ দেখে অনেকটা বুঝা যায়, তার হবে কিনা। খল হলে হাত ভারি হয়। নাক টেপা হওয়া ভাল না। শম্ভুর নাকটি টেপা ছিল। তাই অত জ্ঞান থেকেও তত সরল ছিল না। উনপাঁজুরে লক্ষণ ভাল নয়। আর হাড়পেকে—কনুইয়ের গাঁট মোটা, হাত ছিনে। আর বিড়ালচক্ষু-বিড়ালের মতো কটা চোখ। ঠোঁট ডোমের মতো হলে নীচবুদ্ধি হয়। বিষ্ণুঘরের পুরুত কয়মাস এক্টিং কর্মে এসেছিল! তার হাতে খেতুম না—হঠাৎ মুখ দিয়ে বলে ফেলেছিলুম, ‘ও ডোম।’ তারপর সে একদিন বললে, ‘হ্যাঁ, আমাদের ঘর ডোমপাড়ায়। আমি ডোমের বাসন চাঙারি বুনতে জানি।’ আরো খারাপ লক্ষণ— এক চক্ষু আর ট্যারা। বরং এক চক্ষু কানা ভাল, তো ট্যারা ভাল নয়। ভারী দুষ্ট ও খল হয়।… আবার চলনেতে লক্ষণ ভাল মন্দ টের পাওয়া যায়।” আরেক দিন বলছেন : “যদুর বাড়িতে—মল্লিক এসেছিল! বড় চতুর আর শঠ, চক্ষু দেখে বুঝতে পারলুম। চক্ষুর দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘চতুর হওয়া ভাল নয়। কাক বড় সেয়ানা, চতুর কিন্তু পরের গু খেয়ে মরে। আর দেখলাম লক্ষ্মীছাড়া।’”

এইসব শুনে আমি ভয়ে মরি, মা। তিনি যে অন্তর্যামী। আমাকে কোন্ থাকে ফেলছেন, তা তো জানি না, মা! তুমি আমার হয়ে একটু দরবার করে দাও, মা।

–শোন, আমি সকলের জন্যেই বলি, তোমার জন্যেও বলব। মন বসুক না বসুক, জপ করবে। সকাল-সন্ধ্যায় বসবে। আর মাথা ঠাণ্ডা রেখে জপধ্যান করবে। মনে হবে, এর চেয়ে মাটি কোপানো সহজ কাজ। ধ্যানজপের একটা নিয়মিত সময় রাখা খুব দরকার। কারণ, কখন যে কি ক্ষণ বয়, বলা যায় না। ও হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়—টের পাওয়া যায় না। সেজন্য যতই গোলমাল হোক, নিয়ম রাখা খুব দরকার। আবার এই কথাটাও বলি, গৃহীদের বহিসন্ন্যাসের দরকার নেই। তাদের অন্তসন্ন্যাস আপনা হতে হবে। তোমাদের আর ভয় কি? তাঁর শরণাগত হয়ে থাকবে। আর সর্বদা জানবে যে, ঠাকুর তোমাদের পিছনে আছেন। যে একবার ঠাকুরকে ডেকেছে তার আর ভয় নেই।

মা, তুমি দরজাটা একটু ফাঁক করে একবার শুধু বলে দাও, শুনছ! এই যে, আমার ছেলে তোমার কাছে যাচ্ছে, অঙ্কট-বঙ্কট যদিও কিছু থাকে, তুমি কৃপা কর। বিষয়সুখ চাইতে আসেনি, রূপসাগরে ডুবতে চায় অরূপরতন আশা করি। মা গানটা শুনবে? এখানে গাই, ওখানে বসে ঠাকুরও শুনবেন –

“রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি।
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *