2 of 3

শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু

শ্রীরামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু

পবিত্র গঙ্গাজল অপবিত্র কোন পাত্রে রাখা যায় না। রাখার জন্য মার্জিত, ঝকঝকে একটি কমণ্ডলুর প্রয়োজন হয়। মা সারদা সেই কমণ্ডলু; পবিত্র রামকৃষ্ণতত্ত্ব-বারি ধারণ ও সিঞ্চনের জন্য এসেছিলেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে নির্বাচন করেছিলেন, নিজের জীবনবৃত্তে টেনে এনেছিলেন এবং ভেঙে গড়েছিলেন তাঁর লৌকিক জীবন। রামকৃষ্ণ-পূতাগ্নির জীবন্ত সমিধ তিনি। সারাটি জীবন ধরে নীরবে তিনি একটি কথাই বলে গেলেন—যেন রবীন্দ্রনাথের গানের সেই লাইনটি

“তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি।”

কত বড় ত্যাগ! সাধে স্বামীজী বলেছিলেন : “রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা-ঠাকুরানী গেলে সর্বনাশ!” স্ত্রী স্বামীর সংসার করবেন, সেবা করবেন, স্বামীর পরিবার-পরিজনদের দেখাশোনা করবেন। সাতসকালে উঠে সংসারকর্ম করতে করতে মধ্যরাত্রে অসীম ক্লান্তিতে দেহভার ফেলে দেবেন শয্যায়। এইভাবে চলে যাবে জীবনের বসন্ত, আসবে শীতের বার্ধক্য! সংসার একটা সার্টিফিকেট দিয়ে চিতায় তুলে দেবে—’মায়ের মতো মা’।

কিন্তু ত্যাগের চিতায় যৌবন তুলে দিয়ে কোন্ ‘ষোড়শী’ বলতে পারেন— “না, আমি তোমাকে সংসারপথে কেন টানতে যাব? তোমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি।”

কেমন করে একথা বলা সম্ভব হলো, সংসারপথের স্বাভাবিক পরিণতিই যখন জননী হওয়া! নিজের মায়ের পরিতাপের কথা তো তাঁর স্মরণে ছিল, শ্যামাসুন্দরী দেবীর সেই আক্ষেপ—এমন পাগলা জামাইয়ের সঙ্গে আমার সারদার বিয়ে হলো যে কখনো ‘মা’ ডাক শুনে হৃদয় জুড়োতে পারবে না! শুনে ঠাকুর বলেছিলেন, আপনার মেয়ের এত ছেলেমেয়ে হবে যে, ‘মা’ ডাক শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা হয়ে যাবে।

দক্ষিণেশ্বরে মা সারদা ও ঠাকুরের অগ্নিপরীক্ষা। সারদা তখন বালিকা নন, দস্তুরমতো যুবতী। একই শয্যায় স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি। কামজয়ী কি হতে পেরেছেন ঠাকুর! প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার পরীক্ষক তিনি নিজেই। মা ভবতারিণীকে বলেছিলেন, আমার ভেতর কামভাব এলে গলায় ছুরি দেব। সারদা নিদ্রিতা, ঠাকুর সমাহিত। তবু ঠাকুর বলছেন, সারদাদেবীও যদি সম্পূর্ণ কামনাশূন্য না হতেন তাহলে আমার দেহবুদ্ধি আসত কিনা, কে বলতে পারে!

অষ্টাদশী পত্নীকে ঠাকুর বলছেন, আমি সমস্ত স্ত্রীলোককে মার ন্যায় জ্ঞান করি, তোমার ভেতরেও আমি সেই জগন্মাতাকে দেখছি। তবে তুমি যদি ইচ্ছা কর, আমি তোমাকে পত্নীর দাবি থেকে বঞ্চিত করতে চাই না, এই বিষয়ে তোমার কি মত?

সারদা কি বললেন?

একই বাদ্যযন্ত্রের দুটি তার একই সুরে বাঁধা। একটি বাজলে অন্যটি একই সুরে ঝঙ্কার দেয়। চরম আধ্যাত্মিকতার দোতারার একটি শ্রীরামকৃষ্ণ, অন্যটি জননী সারদা।

সারদা বললেন, আমি তোমাকে সংসারের মলিনতায় কলুষিত করতে চাই না। তোমার ধর্মপথের কণ্টক হওয়ার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আমি কেবলমাত্র তোমার সেবার অধিকার চাই। আর তুমি যদি আমাকে ধর্মবিষয়ে উপদেশ দাও তবে আমি কৃতার্থ হব।

পরস্পর পরস্পরের দর্পণ। আমার প্রতিফলন তোমাতে, তোমার প্রতিফলন আমাতে। একই আলোয় আলোকিত দুজনে। রামকৃষ্ণের ঘরণী তুমি, কিন্তু রামকৃষ্ণের ঘর কোন্‌টি! কেমন গৃহী তিনি! মানুষের প্রধান দুটো বাঁধন তিনি সবার আগে কর্তন করেছেন—কাম আর কাঞ্চন। তাহলে আর রইলটা কি! ঘর আর ঘরণী দুটোই তো গেল। তিনি নিজেই বলছেন : “কাম-কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। বস্তু বিচার করবে। মানুষের শরীরে কি আছে—রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়ীভুঁড়ি, কৃমি, মুত, বিষ্ঠা—এইসব। সেই শরীরের ওপর ভালবাসা কেন? “ আবার বলছেন : “কাম-কাঞ্চনই মায়া। ওর ভিতর অনেকদিন থাকলে হুঁশ চলে যায়—মনে হয় বেশ আছি। মেথর গুয়ের ভাঁড় বয়, বইতে বইতে তার ঘেন্না থাকে না।”

পরে এমন একটি গোপন কথা তিনি বললেন যা ভয়ঙ্কর, নিজের সাধন- শরীরের অন্তরঙ্গ কথা। স্থূলশরীর নয়, ভাবশরীরের ভাবের কথা। “বটতলায় একটি ছেলে দেখেছিলাম। হৃদে বললে, ‘তবে তোমার একটি ছেলে হবে।’ আমি বললাম, ‘আমার যে মাতৃযোনি! আমার ছেলে কেমন করে হবে?’”

ঠাকুর তাঁর ভাব সম্পর্কে দ্বিতীয় কথা কি বলছেন! “আমার কি ভাব জান? আমি খাই-দাই থাকি, আর সব মা জানেন। আমার তিন কথাতে গায়ে কাঁটা বেঁধে। গুরু, কর্তা আর বাবা।”

সাধনায় যখন ছিলেন, তখন বিশেষ একটি ভাব অবলম্বন করেছিলেন— “আমি মার দাসীভাবে, সখীভাবে দুই বৎসর ছিলাম। আমার কিন্তু সন্তানভাব, স্ত্রীলোকের স্তন মাতৃস্তন মনে করি। মেয়েরা এক-একটি শক্তির রূপ। পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে, বাংলাদেশে জাঁতি থাকে—অর্থাৎ ঐ শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। এটি বীরভাব। আমি বীরভাবে পূজা করি নাই। আমার সন্তানভাব।” পরবর্তী কালে তিনি বলেছেন : “এখন প্রকৃতিভাব কম পড়ছে। বেটাছেলের ভাব আসছে।” তিনি স্পষ্ট জানালেন প্রকৃত পুরুষ কে। যার স্তনবৃন্ত আছে সে প্রকৃত পুরুষ নয়। একমাত্র পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ।

জননী সারদা স্বামীর পদসংবাহন করতে করতে জিজ্ঞেস করছেন : “আমাকে তোমার কি বলে বোধ হয়?” ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বলছেন : “যে-মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও সম্প্রতি নহবতে বাস করছেন (স্বীয় জননী) এবং তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলে তোমাকে সত্য দেখতে পাই।”

ঠাকুরের সমস্ত কথা একত্রে বিচার করলে এই দাঁড়ায়—বালকাবস্থাপ্রাপ্ত বা বালকভাবাপন্ন ঠাকুরের খুব আনন্দ—এক শুদ্ধ, সাত্ত্বিক, দেবীভাবাপন্না বালিকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে। কেমন মজা, বাদ্যবাজনা! সেই সময়টায় তিনি সাধনাবস্থায়। এক-এক ভাব আরোপ করেন। জগন্মাতার সঙ্গে খেলা করেন। সারদা তাঁর খেলার সঙ্গী। পঁচিশ, ছয়ের ব্যবধান কিছুই নয়। নিদ্রিতা সারদার অঙ্গ থেকে তিনি স্বর্ণালঙ্কার খুলে নিচ্ছেন, পরে অন্য অলঙ্কার পরাবেন বলে।

পরবর্তী সাক্ষাৎকারে ঠাকুর গুরু, ষোড়শী সারদার শিক্ষক। ‘মা’ তৈরি করছেন। সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি শেখাচ্ছেন। সংসার কোথায়! কেন, বিশ্বজুড়ে যাঁর কোল পাতা তিনি তো সাত সহস্র সন্তানের জননী। তাঁকেই তো বলে যেতে হবে—যাচ্ছি আমি। তুমি রইলে, ওদের দেখো।

শেষ পর্যায়ে ব্রহ্মজ্ঞানী অবতার শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তুমি সমর্পণ করেছ, এইবার আমি অর্পণ করি। বস আমার পূজার আসনে। ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে’, এই নাও আমার সাধনা, আমার সিদ্ধি, আমার জপের মালা। তৈরি করে রেখে গেলাম শাশ্বত সেই যুগল মূর্তি—হরগৌরী, রাধাকৃষ্ণ

আসলে আমাদের কোন লিঙ্গ নেই। আত্মায় আত্মায় মিলন। লীলা অভিরাম।

সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর কি পড়ে থাকে! দণ্ড-কমণ্ডলু। স্বামীজী সেই রামকৃষ্ণ- দণ্ড। জননী সারদা সেই রামকৃষ্ণ-কমণ্ডলু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *