সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: বাংলা ভাষা ও কাজী নজরুল – অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: বাংলা ভাষা ও কাজী নজরুল – অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘আগ্রাসন’ শব্দটির জন্ম নির্লজ্জ নির্দয় আধিপত্যবাদের প্রকোষ্ঠেই। হানাদারি মানসিকতারই দোসর এই আগ্রাসন। সাধারণ ভাবে যুদ্ধ-হত্যা-রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বিজিত পক্ষের ভূ সম্পত্তি দখলকে আগ্রাসন বলে মনে করাটাই দস্তুর। কিন্তু এর বাইরেও আগ্রাসী চিন্তা-ভাবনার পরিধি আরও বহুদূর বিস্তৃত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাকার নানা স্তরেই আগ্রাসনের নানা রূপ! সবক্ষেত্রেই প্রভাবশালী প্রতিপত্তিবান-ক্ষমতাধরই এই বিশেষ দর্প প্রতিষ্ঠার অপকৌশলের মূল চক্রী। অন্যদিকে নিঃস্ব-হৃতগৌরব-হতশ্রী মানুষের দল যুগে-কালে-প্রতিক্ষণে সেই আগ্রাসনের নির্মম শিকার। বলা বাহুল্য, প্রকৃতিগত ভাবে নির্মম প্রভুত্ববাদী যে মানসিকতা মানুষের মগ্নচৈতন্যে সুপ্ত থাকে— আগ্রাসনের ভয়ানক রূপেই ঘটে তার জাগরণ—উদ্ধত প্রকাশ। তখন বলের বন্যা ধর্মকে ভাসাতে চায়, কর্ম হারায় মূল্য, দ্যুতচ্ছলে দানবের উৎকট দাপাদাপিতে রক্তস্নান করে পৃথিবী। স্বাধীনতার পরিবর্তে স্বেচ্ছাচার, দমন, পীড়ন, মুক্ত উদার চিন্তার বদলে সংকীর্ণ-একদেশদর্শী ভাবনার আস্ফালন, নিলাজ স্তাবকতা-তোষণ এসবই লেখে জনজীবনের ইতিহাস। মানুষ নিত্য নতুন ভাবনা উদ্ভাবনের কারিগর। আগ্রাসন সেই ভাবনার মূলেই মোক্ষম আঘাতটি করে। পরিণামে প্রগতির পথে মানুষের যাত্রা বাধা পায়। দিকভ্রান্ত মানুষ বিপথেও বাঁক নেয় অনেকসময় কিংবা আগ্রাসী শক্তিকেই প্রভু মেনে তার পায়েই সর্ব অস্তিত্ব জলাঞ্জলি দেয়। তবে আগ্রাসনের এই নানা রূপের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’। কারণ যে মনন আর মস্তিষ্কে মানুষ সতত উজ্জীবিত, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠিক ওই দুই ক্ষেত্রেই সরাসরি আক্রমণ সানায়। ফলত মানব চৈতন্যের ভিতটাই টলে যায়। নিদারুণ বিপন্ন হয় মানুষের ভাষা। সংস্কৃতিও দুর্বিপাকে পড়ে। পৃথিবীর ভাষা সংস্কৃতির ইতিহাসে এই আগ্রাসনের ভয়াল চিত্রের সংখ্যা বিপুল। বাংলার প্রজ্ঞাপ্রাঙ্গণেও এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন উপর্যুপরি হানা দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সে আগ্রাসনের ছক সাজিয়েছে বিদেশি থেকে দেশীয় শাসক কিংবা একেবারেই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ। লেখক-কবি-নাট্যকার-ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক কেউই বাদ যাননি সেই আগ্রাসনের অত্যাচার থেকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও রয়েছেন সেই তালিকায়। এমনকি স্বদেশীয় শাসনে ‘জরুরী অবস্থার’ অজুহাতে কোপেও পড়েছেন তিনি। কোনও গোষ্ঠী আবার একেবারেই সীমাহীন আগ্রাসী ঔদ্ধত্বে কবির গায়ে ‘বুর্জোয়া’ তকমা সেঁটে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছে। এবংবিধ কর্মকান্ডের সমর্থনে শত যুক্তির ফর্দ ফাঁদা হয়, কিন্তু সব ছাপিয়ে প্রকট হয় সেই আগ্রাসী অহং:

“চুপ করে থাক, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভালো না,

এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা

এরই মধ্যে হাই তুলিস যে? পুঁতে ফেলব এখনি,

ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু, ফাঁদ তো বাবা দেখনি!

আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধ্যি নেইকো পেরোবার,…”(১)

বাংলায় এই ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’-এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পাঠালোচনায় অনিবার্যভাবেই উঠে আসে কাজী নজরুল ইসলামের কথা; ব্যক্তিজীবন শত প্রতিবন্ধকতায় কন্টকিত হলেও চির উন্নত শির এই মানুষটি কোনোদিন কোথাও মানেননি আগ্রাসনের কর্তৃত্বকে। ‘যুগবানী’তে স্পষ্ট বলেছেন: ‘অধীনতা মানুষের জীবনীশক্তিকে কাঁচা বাঁশে ঘুন ধরার মতো ভুয়া করিয়া দেয়। ইহার আবার বিশেষ বিশেষত্ব আছে, ইহা আমাদিগকে একদমে হত্যা করিয়া ফেলে না, তিল তিল করিয়া আমাদের জীবনী,… মনুষ্যত্ব, বিবেক সমস্ত কিছু জোঁকের মতো শোষন করিতে থাকে।’(২) বাংলা ভাষার বৈচিত্রের সাধক কবি নজরুলকে বারে বারে ঘিরেছে আগ্রাসনের পীড়ন। ‘যুগবানী’র মতো প্রবন্ধ সংকলন থেকে শুরু করে ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো কাব্যগ্রন্থ সরাসরি নিষিদ্ধ করেছিল তদানীন্তন শাসক ব্রিটিশ। জানা যায় ‘অগ্নিবীনা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘ফণীমনসা’, ‘সর্বহারা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’-ও তাদের বিষনজরে ছিল। ‘যুগবানী’তে নজরুল লিখেছিলেন: ‘রাজ্যতন্ত্র, স্বেচ্ছাতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মজাই হইতেছে এই যে, কর্তারা কেবল নিজের দিকটাই দেখেন। নিজেদের সুখ-সুবিধাটাই তাঁহাদের লক্ষ্য, বাকি সব চুলোয় যাক, তাঁহাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নাই!’(৩) —এমন কথায় শাসকের গাত্রদাহ হবেই; এরকম হাজারো স্পষ্টবাক্যে সমুজ্জ্বল নজরুলের ‘যুগবানী’ তাই তো পছন্দ হল না ব্রিটিশের। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলো ১৯২২ এর অক্টোবরে আর সেই বছরের নভেম্বর মাসেই ৯৯ ক’ ধারায় সেটি বাজেয়াপ্ত করা হলো। আগ্রাসন যে করে সে তো আসলে ভয় পায় বিরোধী কন্ঠস্বরকে, স্পষ্ট – অপ্রিয় কথা তার কানে সয় না, সন্ত্রস্ত আগ্রাসী তাই কোনভাবেই মুষ্টি আলগা করতে চায় না, পাছে কর্তৃত্বটাই হারাতে হয়। সেই কারণেই তো দেখি, কাজীসাহেবের ‘যুগবানী’কে নিষিদ্ধ ঘোষনার আঠারো বছর পরেও সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা উঠলে ব্রিটিশ সরকারের আধিকারিক সরাসরি তা নস্যাৎ করে জানাচ্ছেন: “I don’t think it would be advisable to remove the ban on this book in the present crisis. On the whole it is a dangerous book forceful and vindictive.”(৪)। ১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয় নজরুলের ‘বিষের বাঁশী’। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন দীনেশ দাশ। কবির বিদ্রোহী বাণী সেখানে সত্যিই শিহরণ তুললো:

“আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!

এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি—মরব শেষ!”(৫)

—কবির এ গ্রন্থও রাজরোষে পড়লো; ১৯২৪ এর ২২ অক্টোবর বাজেয়াপ্ত হলো ‘বিষের বাঁশী’। কি অদ্ভুত ব্যাপার— গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসায় পঞ্চমুখ ‘প্রবাসী’ যেখানে লিখলো “কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচন্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মৃত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।”(৬) সেখানে ১৯২৪ এর ২১ আগস্ট এই ‘বিষের বাঁশী’ বেঙ্গল লাইব্রেরীতে নথিভুক্ত হবার পর পরই তদানীন্তন গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত নিজে বাঙালি হয়েও একজন বাঙালি কবির গ্রন্থ সম্পর্কে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে লিখলেন: “…that the publication is of a most objectionable nature, the writer revelling in revolutionary sentiments and inciting young men to rebellion and to law breaking. The ideas, though often extremely vague, have clearly a dangerous intent…”(৭) সন্দেহ নেই, এই স্বজাতীয়ের শত্রুতায় আর ব্রিটিশের প্রতি মোসায়েবিতে শাসক ব্রিটিশের আগ্রাসী মনোভাব অনেকটাই অক্সিজেন পেয়েছিল। তার ফলশ্রুতিতেই ১৯২৪-এর আগস্টে প্রকাশিত ‘ভাঙার গান’ ওই বছরেই নভেম্বর মাসে নিষিদ্ধ হলো। সেখানে কাজী নজরুল লিখেছিলেন:

      
“ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি

লাথি মার      
ভাঙ রে তালা!

যত সব      
বন্দিশালায়

আগুন জ্বালা

আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।”(৮)

আর এই গ্রন্থের বিরুদ্ধে সরকারি তরফে বলা হলো “…said book contains words which bring or attempt to bring into hatred or contempt, and excite or attempt to excite disaffection towards the government established by law in British India, the publication of which is punishable under section 124A Indian Penal Code.”(৯)। নজরুল ইসলামের ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০) ১২৪ক ও ১৫৩ক ধারায় ফৌজদারি অপরাধে ১৯৩১-এ বাজেয়াপ্ত হয়। এ’জন্য কবিকে ছ’মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। ১৯৩১ এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশ পায় নজরুলের ‘চন্দ্রবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থ। একমাসের মধ্যে (১৪ অক্টোবর) তাও রাজরোষে বাজেয়াপ্ত হয়।

বুঝতে অসুবিধে হয় না, কাজী নজরুল ব্রিটিশ সরকারের কতখানি আতঙ্কের কারণ ছিলেন। তাই কেবল বই বাজেয়াপ্ত করাতেই তারা থামলো না, ‘প্রলয় শিখার’ জন্য ছ’মাসের জেলেও মন উঠলো না, সুযোগ খুঁজতে লাগলো আরও কড়া দাওয়াই এর। অন্যদিকে জাত বোহেমিয়ান নজরুলও নাছোড়। ‘ধূমকেতু’ তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা। সেখানে প্রকাশ পেল তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ (১৯২২, ২৬ সেপ্টেম্বর)। দেশের পরাধীন পরিবেশে অস্থির কবি লিখলেনঃ

“পুরুষগুলোর ঝুঁটি ধরে বুরুশ করায় দানব-জুতো

মুখে ভজে আল্লা-হরি, পূজে কিন্তু ডাণ্ডা গুঁতো।

দাড়ি নাড়ে, ফতোয়া ঝাড়ে, মসজিদে যায় নামাজ পড়ে

নাইক খেয়াল গোলামগুলোর হারাম এ সব বন্দী গড়ে।

‘লানত’ গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলুমবাজে

ধর্ম-ধ্বজা উড়ায় দাড়ি ‘গলিজ’ মুখে কোরাণ ভাঁজে।”(১০)

কিন্তু আগ্রাসী শাসক তো গোলামিকেই পছন্দ করে। সে পছন্দ করে তাঁবেদারি। নজরুল সে পথে হাঁটেননি। সুতরাং এবার সরাসরি গ্রেপ্তার। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখবার জন্য ১৯২২ এর ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে আটক করা হলো কবিকে। ১৯২৩ এর ১৯ জানুয়ারি এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হল। কবি কৃষ্ণ ধর লিখেছেন: “প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ সুইন হোর আদালতে বিচারে নজরুল ইসলামের এক বৎসর সশ্রম কারাবাসের রায় দেওয়া হয়। বিচারক ব্যক্তিটি নাকি কবি ছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিযুক্ত বিচারক তাঁর কবিসত্তাকে সেদিন মূল্য দেননি।”(১১) কারারুদ্ধ কবির ওপর নিপীড়ন চলল যারপরনাই। শরীর ভাঙল। হুগলী জেলে অনশনে বসলেন নজরুল। উদ্বিগ্ন শরৎচন্দ্র দেখা করতে চাইলেন কবির সঙ্গে। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেন না। গোলদিঘি ময়দানে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সভাপতিত্বে ১৯২৩ এর ২১ মে প্রতিবাদ সভা হলো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে অনশন ভাঙতে চিঠি লিখলেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সে চিঠিও নজরুলের হাতে পড়তে দিলো না। ক্ষুব্ধ ব্যথিত শঙ্কিত কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এইমর্মেই লিখলেন: “… নজরুল ইসলামকে Presidency Jail-এর ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম লিখেছিলুম “Give up hunger strike, our literature claims you.”— জেল থেকে memo এসেছে The addressee not found। অর্থাৎ ওরা আমার message ওকে দিতে চায় না— কেননা নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে-তবে নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।”(১২)

এখন আমরা যদি ভাবি, কেবলই বিদেশী ব্রিটিশের আগ্রাসন আর অত্যাচারই কাজী নজরুলকে জর্জরিত করেছে তবে সেটা হবে অর্ধ সত্য। কেননা ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, স্বদেশীয়ের ঈর্ষা- শত্রুতা তথা আগ্রাসনের মুখেও কাজী নজরুলকে বারবার পড়তে হয়েছে। অমার্জিত চটুল ব্যঙ্গ করা হয়েছে বেশভূষা-লেখালিখি নিয়ে; বলা হয়েছে ‘রাখে লম্বা চুল, যা লেখে সব ভুল’, ‘এক ঝাঁক ভীমরুল— কাজী নজরুল’। নজরুল লিখেছিলেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’-ব্যঙ্গ করে বলা হলো ‘ভান্ডারী হুঁশিয়ার’, কবির লেখা ‘মাধবী প্রলাপ’ কবিতাকে ব্যঙ্গ করে লেখা হলো ‘কবির প্রলাপ’। কবি নজরুল গান লিখলেন ‘কে বিদেশী বন উদাসী’, তাকে ব্যঙ্গ করে গান হলো ‘কেউ দাসী বনগাঁ বাসী’। এ বিষয়ে সবচেয়ে এগিয়েছিলো ‘শনিবারের চিঠি’। সম্পাদক ছিলেন সজনীকান্ত দাসমশাই। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কেও বিষ ঢালতে মূলত এনার নেতৃত্বে বিশেষ চেষ্টা হয়েছিল। নজরুল কবিকে ‘গুরু’র স্থানেই বসিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও অসম্ভব স্নেহ করতেন নজরুলকে। নজরুলের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’র যাত্রারম্ভে আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লাঙল পত্রিকাকেও আশীর্বাদ করেছেন। ‘বসন্ত’ নাটিকা উৎসর্গ করেছেন নজরুলকেই। জীবনের ষাট বছর পূর্তিতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত রবীন্দ্র অভিনন্দন সভায় কবি নিজে দর্শকাসন থেকে ডেকে নজরুলকে পাশে বসিয়েছিলেন (১৯২১, ৪ সেপ্টেম্বর)। ১৯২২ সালের ২৫ জুন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রয়াত হলেন। ১১ জুলাই রামমোহন লাইব্রেরিতে সত্যেন্দ্রনাথের স্মরণ সভা হলো, রবীন্দ্রনাথ তার সভাপতি। কাজী নজরুলও সেই সভায় উপস্থিত। রয়েছেন আরও গণ্যমান্য কবি সাহিত্যিক। কবিগুরু ইঙ্গিত করে নজরুলকে তাঁর পাশে এসে বসতে বললেন, যেন প্রলয় ঘটে গেল আবার! নজরুলের পারিবারিক বন্ধু শান্তিপদ সিংহ সেই প্রেক্ষিতেই জানিয়েছেন: “নজরুলের আসন নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দ গুনগুনিয়ে উঠলেন। তাঁদের মতে এবং কথায় রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুল ইসলামের নেই। একজন বিশিষ্ট কবি যেমনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলেরই আসন হবে—এই আর যায় কোথা। ভদ্রলোকটিকে সকলে মিলে যেন চিবিয়ে খাবার মত করলেন…।”(১৩) ‘রক্ত’ শব্দটির পরিবর্তে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়েও কবি রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলকে লড়িয়ে দেবার সুকৌশল ফন্দী আঁটা হয়েছিল। ১৯২৭ এর ১৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি কলেজের রবীন্দ্র পরিষদ কবি রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দিলে তার প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা বলেন তা মাস দুয়েক পরে (ফাল্গুন, ১৩৩৪) ‘প্রবাসী’তে ‘কবির স্বকৃত লিখিতানুবৃত্তি’র বিবরণী রূপে প্রকাশিত হয়। সেখানে কবি প্রসঙ্গত বলেন: “সেদিন কোন একজন বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে দেখলুম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন খুন।”(১৪) ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করলেন না; তিনি কবির কথাকে বিকৃত করে দিলেন; ‘শনিবারের চিঠি’র বিবরণে দেখা যায়: রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: “—সেদিন কোন একজন বাঙালি কবির কাব্যে দেখলুম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন ‘খুন’”।(১৫) —এইসুত্রে খুব সহজেই ‘বাঙালি কবি’ বলতে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকেই বুঝিয়েছেন এটা সাব্যস্ত করা গেল; উপযুক্ত দোসর হল ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকাও। সেখানেও রবীন্দ্রনাথের এমন কথার লক্ষ্য নজরুলই— এমনটাই দেগে দেওয়া হল। সজনীকান্তের এই উদ্যোগ কোনসময়েই বিশেষ কলকে না পেলেও এটা কিন্তু স্পষ্ট যে, নজরুলকে প্রচারের আলোয় আসতে দিতে বিশেষ কুণ্ঠা ছিল অনেক বাঙালিরই! সমসাময়িক পত্র পত্রিকাও এর ব্যতিক্রম ছিল না; বিশেষ করে সেকাল থেকে একাল— বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, তারা নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ছাপতে রাজি হয়নি; তারপর নজরুল সেটি ‘ধুমকেতু’তে ছাপেন। আগেই উল্লেখিত যে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের স্মরণসভায় নজরুল উপস্থিত ছিলেন। সেখানে স্বরচিত ‘সত্যকবি’ কবিতাটি নজরুল পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথের ইঙ্গিত-অনুমোদনক্রমে। অথচ পরের দিনের (১২ জুলাই, ১৯২২) আনন্দবাজারে নজরুলের কবিতার নামটি আগাগোড়া ভুল ছাপা হলো। বলা বাহুল্য, এখনও এই পত্রিকা এমনকি কাজী সাহেবের জন্ম বা প্রয়ান দিবসে ক’টি শব্দ খরচ করে অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রেরই তা জানা!

হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক-মৈত্রী-সহাবস্থান-ঐক্য-সম্প্রীতি— কাজী নজরুলের জীবনের অভীষ্ট। উভয়ের ‘গালাগালির সম্পর্ক’কে গলাগলিতে পরিণত করতে, হাতাহাতির দ্বৈরথকে হ্যাণ্ডসেকে পরিবর্তিত করতে কবির আন্তরিক প্রয়াসের অন্ত ছিল না। কিন্তু উভয় সম্প্রদায় থেকেই কবিকে উদ্দেশ্য করে উড়ে এসেছে অজস্র কু-বাক্য; নজরুল বাংলা কাব্যসাহিত্যে অনর্গল ব্যবহার করেছেন আরবী, ফার্সি শব্দ। প্রজ্ঞার গভীরতা না থাকলে— ভাষায় দখল না থাকলে এই দক্ষতা অসম্ভব; কিন্তু এক শ্রেনির বাঙালি বিদ্বজ্জন নজরুলের দক্ষতাকে কুর্ণিশের বদলে দুরমুস করতে চেয়েছেন; তাচ্ছিল্যের সুরে নজরুলকে বলেছেনঃ “এই তব বিদ্যে ছি!”(১৬) সঙ্কীর্ণ হিন্দুর দল ভেবেছে “ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে, ও পাত নেড়ে!”(১৭) আর মৌলবাদী মুসলিম ফতোয়া দিয়েছে “দেবদেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!”(১৮) শুধু তাই নয়, সমন্বয়ের শাশ্বত মন্ত্রে প্রাণিত নজরুলকে একসময় পাকিস্তানের সমর্থকও বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবুল মনসুর আহমদ নামক জনৈক পাকিস্তানপন্থী ‘বুদ্ধিজীবী’ সরাসরি বলে দেন “পাকিস্তান হাসিল একটা গণ বিপ্লব। … রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রে টলস্টয় যা, ফরাসী বিপ্লবের ক্ষেত্রে রুশো ও ভল্টেয়ার যা, বাংলায় পাকিস্তান বিপ্লবের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলামও ঠিক তাই।”(১৯) এহো বাহ্য, যখন দেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান তৈরি হলো, তখন নজরুলের কাব্যের সর্বজনীন আবেদন ক্ষুণ্ণ করে তার ইসলামী রূপ দেবার অপচেষ্টাও হয় নবগঠিত পাক সরকারের তরফে। প্রস্তাব দেওয়া হয়, কবির ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের বারোটি কবিতার মধ্যে ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’— এই পাঁচটি কবিতা ইসলাম ও পাকিস্তান রীতিনীতি আদর্শ বিরোধী তাই ওইগুলি বাতিল হবে; ‘বিষের বাঁশী’র পঁচিশটি কবিতার মধ্যে একমাত্র ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দহম’ পাকিস্তানি টেকনিকে লেখা, বাকি কবিতাগুলি নাকি পড়তে গেলে মনেই হয় না সেগুলি কোনও মুসলমানের লেখা!(২০) —এইরকম নানা বিভেদ-বিভাজন-একদেশদর্শী আগ্রাসি ভাবনা নজরুলকে বারে বারে ক্ষতবিক্ষত করেছে। স্পষ্ট কথা অনেকসময়েই তেতো লাগে; তবু তো বলতেই হয়— একালেও নজরুলকে নিয়ে এক অদ্ভুত একপেশে মনোভাব অন্তত এ’পার বঙ্গে জারি আছে। নজরুল মানেই ‘বিদ্রোহী’, আর কিছু নয়। পাঠ্যসূচীর চৌহদ্দিতে স্রেফ দু’দশটা কবিতার মধ্যেই নজরুলকে সীমায়িত করবার প্রয়াস কবিকৃতির প্রতি ক্ষমাহীন অবিচার, সন্দেহ নেই। নজরুলের প্রবন্ধ, অভিভাষণ, চিঠিপত্র যেন নিতান্তই অপাংক্তেয়! এমনকি কাজী সাহেবের অমন শ্যামাসঙ্গীত-কৃষ্ণভজন আজও যথাযোগ্য মর্যাদা পেলোনা। উল্টে আজ তথাকথিত প্রাজ্ঞের মুখে “নজরুলে আর কিছু নেই” বা প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ব্যক্তির মুখে “নজরুল তৃতীয় শ্রেনির কবি” —এমন মন্তব্যে নজরুল চর্চা মারাত্মক আহতই হয়। এটা কিন্তু নজরুলের বৈগুণ্য নয়, এসবই আসলে চূড়ান্ত একপেশে-কায়েমি চিন্তাপ্রসূত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নামান্তর বা বিষময় ফলশ্রুতি।

ইতিহাস অবশ্য আমাদের সবসময়েই আশ্বস্ত করে এই বলে যে, আগ্রাসন কোনোদিনই শেষ হাসি হাসে না! কারণ একের স্পর্ধাকে এই পৃথিবী কোনও সময় স্বীকৃতি দেয় না। বিশ্ব নিখিলের এটাই বিরাট বিধান। বিপুলায়ত সংস্কৃতির পরিসর আর ভাষার বহুধা বিস্তৃত ক্ষেত্র-মনুষ্যত্ব-মানবতা-মূল্যবোধ আর সঠিক সহাবস্থানের নিত্য পৌরহিত্যই যেখানে একমাত্র অভীষ্ট— সেখানে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী পরিকল্পনাও অচিরে ব্যর্থ হয়। তাই সংস্কৃতি— ভাষাসহ সর্ব ক্ষেত্রে আগ্রাসনের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করেই পরিশেষে আমরা কন্ঠ মেলাই বাংলা ভাষা- সংস্কৃতির স্পর্ধিত চিত্ত— কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেই:

“… তোমার মুখ বন্ধ, তুমি কোনো কথাই বলিতে পাইবে না। যাহার মনের জোর নাই— সত্যের জোর নাই, সে-ই এমন করিয়া গায়ের জোরে দুর্বলকে থামাইতে চেষ্টা। … জোর করিয়া একজনকে চুপ করাইয়া দিলে তাহার ওই না কওয়াটাই বেশি কথা কয়। কারণ, তখন তাহার একার মুখ বন্ধ হয় বটে, কিন্তু তাহার হইয়া— সত্যকে, ন্যায়কে রক্ষা করিবার জন্য— আরও লক্ষ লোকের জবান খুলিয়া যায়। বালির বাঁধ দিয়া কি দামোদরের স্রোত আটকানো যায়?”(২১)

তথ্যসূত্র:

১. সুকুমার রায়; ‘খাই খাই’; সিগনেট প্রেস, কলকাতা; জানুয়ারি ২০১৪; পৃঃ ১৫।

২. কাজী নজরুল ইসলাম; ‘কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্র’, প্রথম খন্ড; পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, মার্চ ২০০৫; পৃঃ ৪৪৩।

৩. ঐ; পৃঃ ৪৪৯।

৪. ঐ; পৃঃ ৫২৯।

৫. ঐ; পৃঃ ১৩০।

৬. কল্পতরু সেনগুপ্ত; ‘জনগণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম’; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা; জানুয়ারি ১৯৯২; পৃঃ ১১৮ দ্রঃ।

৭. অরুণ কুমার বসু; ‘নজরুল জীবনী’; আনন্দ, কলকাতা; জুন ২০১৭; পৃঃ ১৬৩ দ্রঃ।

৮. কাজী নজরুল ইসলাম; ‘কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্র’, প্রথম খন্ড; পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা; মার্চ ২০০৫; পৃঃ ১৪৪।

৯. কল্পতরু সেনগুপ্ত; ‘জনগণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম’; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা; জানুয়ারি ১৯৯২; পৃঃ ১২২ দ্রঃ।

১০. কাজী নজরুল ইসলাম; ‘সুনির্বাচিত কবিতা’; সাহিত্যম, কলিকাতা; নভেম্বর ১৯৭০, পৃঃ ২৪০।

১১. কৃষ্ণ ধর; ‘নজরুল বন্দী জীবন’; ‘পশ্চিমবঙ্গ’, কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবর্ষ স্মরণ সংখ্যা; তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; ১৪০৬; পৃঃ ৩৮।

১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ‘চিঠিপত্র’, দ্বিতীয় খন্ড; বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা; শ্রাবণ, ১৪১৯; পৃঃ ৯৯।

১৩. শান্তিপদ সিংহ; ‘নজরুল-কথা’, নবজাতক প্রকাশনী, কলিকাতা; ১৯৯৮; পৃঃ ২১।

১৪. রফিকুল ইসলাম; ‘নজরুল জীবনী’; ওরিয়েন্টাল মিডিয়া ফোরাম, কলকাতা; জুন ২০১৬; পৃঃ ২৭৮ দ্রঃ।

১৫. ঐ।

১৬. কাজী নজরুল ইসলাম; ‘সঞ্চিতা’; মল্লিক ব্রাদার্স, ঢাকা; সেপ্টেম্বর ২০০৪; পৃঃ ৮৯।

১৭. ঐ; পৃঃ ৮৮।

১৮. ঐ।

১৯. অজয় রঞ্জন বিশ্বাস; ‘নজরুল ইসলাম: অন্য চোখে’; কোরক নজরুল সংখ্যা; সম্পাদক তাপস ভৌমিক; বইমেলা ১৪০৫; পৃঃ ১৯৪ দ্রঃ।

২০. ‘কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্র’, প্রথম খন্ড; পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা; মার্চ ২০০৫; পৃঃ ৫০২ ও ৫০৩ দ্রঃ।

২১. কাজী নজরুল ইসলাম; কাজী নজরুল ইসলাম-রচনাসমগ্র, প্রথম খন্ড; পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা; মার্চ ২০০৫; পৃঃ ৪৩৬।

লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রামসদয় কলেজ, আমতা, হাওড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *