ভাষাগত সংকটে দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাংলা ভাষা – দীপক সোম

ভাষাগত সংকটে দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাংলা ভাষা – দীপক সোম

নানা জাতির সমন্বয় ভূমি এই বঙ্গদেশ। বৈচিত্র্যপূর্ণ বঙ্গ-সংস্কৃতির পেছনে এই সকল জনগোষ্ঠীর অবদান অশেষ। সুপ্রাচীনকাল থেকে বহু জাতি নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বঙ্গ-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ জাতিই বহিরাগত। পার্শ্ববর্তী বিহার এবং উড়িষ্যা— মূলত এই দুই রাজ্য থেকেই অধিকাংশ জাতির আগমন ঘটেছে এ দেশে। বিশেষ করে বিহারের ছোটনাগপুর, রাঁচী, পালামৌ এবং উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, গঞ্জাম ও বালেশ্বর জেলা থেকেই অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রাচীনকাল থেকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে জনগোষ্ঠীর স্থানান্তরীকরণ ঘটে চলেছিল। এর অনিবার্য ফলশ্রুতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে বঙ্গসংস্কৃতি। জনগোষ্ঠীগত এই বৈচিত্র্যের অনন্য প্রভাব লক্ষ করা যায় দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূল মূলত পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা— এই দুই জেলায় বিস্তৃত। বলাবাহুল্য, এই দুই উপকূলবর্তী অঞ্চল নদ-নদী বিধৌত এবং সমুদ্র পরিবেষ্টিত। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে তাই এই সকল অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষের আনাগোনা ঘটেছে। নদ-নদী এবং সমুদ্রের ভাঙা-গড়ার খেলায় গড়ে ওঠা নতুন নতুন চরে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহিরাগত জনগোষ্ঠীর। তবে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা অপেক্ষা পূর্ব-মেদিনীপুর উপকূলবর্তী অঞ্চলে জাতিগত এবং সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য অনেক বেশি। বেইলি সাহেব তাই যথার্থই বলেছেন—

‘The people of Midnapur proper are generally composed race, who can neither be called Bengalees nor Oriyas, but who are a mixture of both.’১

সেই হিসেবে ভাষাগত আগ্রাসন এবং তৎপ্রভাবজাত সংকটের পরিচয় পূর্ব-মেদিনীপুর উপকূলবর্তী অঞ্চলেই গভীরভাবে লক্ষ করা যায়। আলোচ্য অভিসন্দর্ভে দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল অর্থে পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী অঞ্চলের ভাষাগত সংকটকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

নৃতত্ত্ববিদদের বিচারে মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে পুরাতন জাতিধারা হল ‘অস্ট্রেলিয়ো’। অনেকে আবার একে ‘নিষাদিক’ রূপেও উল্লেখ করেছেন। এঁরা মূলত মালভূমি প্রদেশ থেকে এসে এই জেলায় বসতি শুরু করেন। এরই পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরের উপকূলভাগ থেকে এক জাতির আগমন ঘটেছে এই জেলায়, যাঁরা— ‘দ্রাবিড়’ নামে পরিচিত। সুমেরিয়ান বা আর্মানী নামে তৃতীয় আর এক জাতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে এই মেদিনীপুর জেলায়। এছাড়াও ‘আলপাইন’ বা ‘ইন্দো-এরিয়ান’ নামক এক জাতিরও আগমন ঘটেছে এই জেলায়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাই এক বিমিশ্র ভাবনা বর্তমান।২

২০০১ সাল পর্যন্ত মেদিনীপুর জেলা ছিল পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ জেলা। এর আয়তন ছিল ১৩,৩৮৮.৪২ বর্গ কিমি। ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি প্রশাসনিক প্রয়োজনে মেদিনীপুর জেলা দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব-মেদিনীপুর এবং পশ্চিম-মেদিনীপুর নামে দুই স্বতন্ত্র জেলার সৃষ্টি হয়। তমলুক, হলদিয়া এবং অবিভক্ত কাঁথি মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব মেদিনীপুর জেলা। যার আয়তন হয় ৪০৯৩.১৪ বর্গ কিমি এবং লোকসংখ্যা ৪৪,২০,০৭৩ জন। এই জেলার মূল দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় তমলুকে। আর মেদিনীপুর সদর, খড়গপুর, ঝাড়গ্রাম এবং ঘাটাল মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। যার মূল দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় মেদিনীপুর শহরে। আয়তনগত দিক থেকে এই জেলার বিস্তৃতি ৯২৯৫.২৮ বর্গ কিমি এবং যার জনসংখ্যা ৫২,১৮,৩৯৯ জন। এই একই তারিখে, অর্থাৎ ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ভৌগোলিক বিস্তৃতির কারণে পূর্বতন কাঁথি মহকুমা বিভাজিত হয়ে দুটি পৃথক মহকুমার সৃষ্টি হয়। এগরা, পটাশপুর ও ভগবানপুর থানার পাঁচটি ব্লক এবং এগরা পৌরসভা নিয়ে গঠিত হয় এগরা মহকুমা, যার আয়তন হয় ৯৪৭.৪৩ বর্গ কিমি। আর কাঁথি, মারিশদা, রামনগর, দীঘা, খেজুরী ও ভূপতিনগর থানার আটটি ব্লক এবং কাঁথি পৌরসভা নিয়ে গঠিত হয় কাঁথি মহকুমা এবং যার আয়তন হয় ১২৬১.২০ বর্গ কিমি। সেই হিসেবে বর্তমানে কাঁথি মহকুমা ৬টি থানা, আটটি ব্লক এবং একটি পৌরসভার অন্তর্গত। ভৌগোলিক বিভাজনে উড়িষ্যা উপকূলের পরেই অবস্থিত দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূল। দক্ষিণ-বঙ্গের উপকূলের মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী অঞ্চলই সর্ববৃহৎ এবং যার দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫৬ কিলোমিটার। পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী অঞ্চল কাঁথি মহকুমার দীঘা, রামনগর, কাঁথি এবং খেজুরী থানায় পরিব্যাপ্ত। তাই বলা যায়, সম্পূর্ণ কাঁথি মহকুমা নয়, মূলত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী দীঘা থেকে খেজুরী পর্যন্ত অঞ্চলই পূর্ব মেদিনীপুর উপকূল নামে পরিচিত।৩

কাঁথি মহকুমার অবস্থান ৮৭o২৪’৩৩’’ পূর্ব থেকে ৮৭o৫৮’৫৬’’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এবং ২১o৩৭’৫০’’ উত্তর থেকে ২১o১’১৮’’ উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে। বর্তমানের কাঁথি মহকুমার ভৌগোলিক সীমা হল— পূর্বে চন্ডীপুর ও নন্দীগ্রাম থানা এবং হুগলী নদী, পশ্চিমে এগরা ও মোহনপুর থানা, উত্তরে কেলেঘাই নদী ও ময়না থানা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। কাঁথি মহকুমার সৃষ্টি প্রসঙ্গে হান্টার সাহেব জানিয়েছেন—

‘Contai (Kanthi) Sub Division: Created on the 1st January 1952, Contains a total area of 850 sq. mile, with 2201 villages or town-ships 77626 houses, and a total population of 442,272.’৪

এর অনুসরণে যোগেশ্চন্দ্র বসু তাঁর ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন—

‘১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি কাঁথি মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সমগ্র বঙ্গদেশের মহকুমাগুলির মধ্যে কাঁথি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছে। শ্রীরামপুর মহকুমার পরেই কাঁথি মহকুমার নাম করা হইয়া থাকে। কাঁথি মহকুমার পরিমান হল ৯১২ বর্গমাইল।’৫

অবশ্য কাঁথি মহকুমা প্রতিষ্ঠার সময়কালে এর সদর দপ্তর কাঁথিতে ছিল না। ‘শিক্ষক জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদক প্রবোধকৃষ্ণ দাসমহাপাত্রের একটি চিঠির উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারী এস. কে. মুখার্জী একটি চিঠিতে লিখেছিলেন—

‘‘The name of the Sub-division was change to that of Contai in the year 1866 was a result of the removal of the headquarters from Negua to Contai. (Vide Calcutta Gazette, dated 25th April, 1866)’’৬

প্রথম পর্বে কাঁথি মহকুমার সদর দপ্তর ছিল নেগুঁয়া। এই নেগুঁয়া সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত এবং ‘কপালকুন্ডলা’র উৎসভূমি।

রসুলপুর নদী থেকে সুবর্ণরেখার মোহানা পর্যন্ত ভূভাগ গঠনে সমুদ্র প্রকৃতির যেমন গুরত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে তেমনি কাঁথি মহকুমার পূর্ব তীরবর্তী ‘হিজলী’ ও ‘খেজুরী’— এই দুই দ্বীপের গঠনে নদী প্রকৃতির গুরুত্ব অশেষ। নদীমাতৃক দেশে নদীর ভাঙা-গড়ার খেয়ালিপনায় বারে বারে প্রভাবিত হয়েছে তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। সুপ্রাচীনকাল থেকে তাই বঙ্গদেশে এই ভাঙা-গড়ার খেলা অত্যন্ত সক্রিয়। এই খেলায় এককালে তাম্রলিপ্ত(বর্তমানের তমলুক) আন্তর্জাতিক বন্দরের মর্যাদা লাভ করেছিল। বানিজ্যসূত্রে দেশ-বিদেশের সঙ্গে এই বন্দরের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কালক্রমে নদীখাতের পরিবর্তন ঘটায় তাম্রলিপ্ত তার গৌরব-গরিমা হারিয়ে ফেলে। এই গরিমা বিলুপ্তির পরেই হুগলী নদীর মোহানার পশ্চিমে আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জেগে উঠতে থাকে দুটি চর, যা ধীরে ধীরে দ্বীপের আকার নেয়। এই দুই দ্বীপই হল হিজলী এবং খেজুরী। এক দ্বীপে হিজল গাছের প্রাধান্য থাকায় নাম হয় হিজলী, আর এক দ্বীপে খেজুর গাছের প্রাধান্য থাকায় নাম হয় খেজুরী। প্রাচীনত্বের বিচারে খেজুরী অপেক্ষা হিজলী পূর্ববর্তীকালের সৃষ্টি। এই হিজলীর অবস্থান ২২o৪০’৫৭.১৫’’ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৭o৩৬’০৬.৭৩’’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। আর খেজুরীর অবস্থান ২১o৫৮’১২’’ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৭o৪৮’০৪.১২’’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। প্রথম পর্বে জেগে ওঠা এই হিজলী দ্বীপের বনজঙ্গল পরিষ্কার করে জনৈক মুসলিম রাজা রাজত্ব শুরু করেন। পাশের দ্বীপটি তখনো পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। দুই দ্বীপের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছিল কাউখালি নামে এক খরস্রোতা নদী। পরবর্তীকালে এই কাউখালি নদীও তার স্রোত হারিয়ে ফেলে। ফলত, হিজলী এবং খেজুরী দুই দ্বীপ সংযুক্ত হয়ে যায়। আর হিজলীর মুসলমান রাজার অধীনস্ত হয়ে পড়ে খেজুরী দ্বীপটিও। মুসলমান রাজা মসনদ্‌-ই-আলা রাজবংশের(১৬২৮-১৬৬১) রাজত্ব বিলুপ্তির পর সমগ্র অঞ্চলটি পর্তুগীজ মগ দস্যুদের অত্যাচারে অধিবাসী বর্জিত হয়ে পুনরায় হিংস্র জন্তুপূর্ণ অরণ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে দিল্লির বাদশাহের তৎপরতায় পর্তুগীজ এবং মগদের অত্যাচার কমলে হিজলী ও খেজুরীতে ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে। ততদিনে তাম্রলিপ্ত বন্দর তার নিজস্ব গৌরব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। আর মোহানার নিকটবর্তী হওয়ায় সেই বন্দরের গৌরব জুটতে থাকে হিজলীর ভাগ্যে। হিজলী পরিণত হয় সম্পদশালী জনপদে। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে হুগলী নদীর মোহানা অঞ্চলের জলপ্রণালী পরিবর্তিত হওয়ায় হিজলীর গৌরব কমতে থাকে। আর সেই সৌভাগ্য জুটতে থাকে খেজুরীর কপালে। খেজুরী পায় একটি সমৃদ্ধ বন্দর ও পোতাশ্রয়ের মর্যাদা। ঠিক কোন সময় থেকে খেজুরী পোতাশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস নির্ণয় দূরুহ। তবে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির দেওয়ানী গ্রহণ পর্বে খেজুরী ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হয়ে পড়ে। আনুমানিক ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বন্দর হিসেবে খেজুরী সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। এর পরেই খেজুরী হয়ে ওঠে এক অনন্য জনপদ। অচিরেই অঞ্চলটি সুরম্য নগরীর রূপ ধারণ করে। তৈরি হয় কোম্পানির এজেন্টদের বাসগৃহ, বন্দর, অফিস, জাহাজে গমনাগমনকারী যাত্রীদের বিশ্রাম ঘর, কফি হাউস, বার, চার্চ, গোরস্থান, টেলিগ্রাফ অফিস ইত্যাদি। বিদেশী নাবিকদের কাছে ব্যবসা-বানিজ্যের প্রধান পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই খেজুরী। অ্যাসিস্ট্যান্ট রিভার সারভেয়র মিস্টার রীকস্‌ (H.G. Reaks) এই খেজুরী সমন্ধে লিখেছেন,— কলকাতার অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামুদ্রিক নৌযাত্রার আরম্ভপথ খেজুরীতে সুন্দর পোতাশ্রয় সৃষ্ট হওয়ায় এটি একটি প্রয়োজনীয় স্থানে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, স্থানটি ভ্রমণ কেন্দ্র হয়ে স্বাস্থ্য পরিবর্তনের একটি জায়গা হয়ে ওঠে।৭

ভূ-খন্ডের ভাঙা-গড়ার মতো উপকূলবর্তী পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ঐতিহাসিক উত্থান-পতনও অনেক বেশি। জৈন ধর্মগ্রন্থ, মহাভারত, রঘুবংশ, পতঞ্জলির মহাভাষ্য, দশকুমার চরিত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে মেদিনীপুর জেলার তথা দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার তৎকালীন বহু পরিচয় পাওয়া যায়। এসব কিছুই আলোচ্য জনপদের প্রাচীনত্বের পরিচয় তুলে ধরে। বিশেষ করে তাম্রলিপ্ত রাজ্যের উল্লেখ বর্তমানের পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। আধুনিক ঐতিহাসিকরা নানান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাহায্যে প্রমাণ করতে চলেছেন প্রত্নপলীয় যুগেও (Mesolithic Period) (খ্রি: পূ: ২৫০০ থেকে ১২০০ খ্রি: পূ: পর্যন্ত) তাম্রলিপ্ত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। এই অঞ্চলের ২৮টি জায়গা এবং নাটশাল গ্রামের পার্শ্ববর্তী হুগলী নদীর চর এলাকা থেকে প্রাপ্ত হাজারখানিক প্রত্নবস্তু এই অভিমতের সত্যতাকে তুলে ধরে।৮ তাম্রলিপ্ত তখন বন্দর হয়ে ওঠেনি। আর কাঁথি মহকুমা তখন সমুদ্রের তলায়। মহাভারতের বহু জায়গায় তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। মহাভারতের আদি পর্বে আছে—

‘কলিঙ্গস্তাম্রলিপ্তশ্চ পত্তনাধিপতি-স্তথা,

মদ্ররাজস্তথাশল্য সহপুত্রো মহারথঃ।৯

অর্থাৎ দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় কলিঙ্গ পত্তনাধিপতি মদ্ররাজ ও তাঁর ছেলের সাথে তাম্রলিপ্তের রাজাও উপস্থিত ছিলেন। ‘জৈমিনিভারতে’ তাম্রলিপ্তের ঘটনা সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৭ অব্দে প্রসিদ্ধ বন্দর হিসেবে বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মহাবংশ’এ তাম্রলিপ্তের উল্লেখ আছে। হিউয়েন সাং এর বিবরণেও তাম্রলিপ্তের পরিচয় মেলে। একথা তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, এককালে তাম্রলিপ্ত ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য এবং যার রাজধানী ছিল বর্তমানের তমলুকের কাছাকাছি অঞ্চলে। এই তাম্রলিপ্ত রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে কাঁথি মহকুমার অবস্থান।

ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল এককালে ৫ টি জনপদে বিভক্ত ছিল— অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র এবং সুহ্ম। বর্তমান রাজশাহী ও ভাগলপুর বিভাগের সন্নিহিত প্রদেশটি প্রাচীন অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত ছিল। উত্তরে ভাগীরথী থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্যন্ত ছিল কলিঙ্গের সীমা। আর অঙ্গ এবং কলিঙ্গের পূর্ব প্রদেশটি বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। সেই হিসেবে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার সমস্ত ভূ-ভাগ ছিল প্রাচীন কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত। বিশ্বকোষ সম্পাদক শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—

‘এখনকার মেদিনীপুর, উড়িষ্যা, গঞ্জাম ও সরকার তৎকালে কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।’১০

এছাড়াও আরও দুটি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়, যা পুন্ড্র এবং সুহ্ম নামে পরিচিত। বিষ্ণু, মৎস্য এবং মার্কন্ডেয় পুরাণে এমনকি হরিবংশের একটি আখ্যায়িকায়ও পাঁচটি রাজ্যের পরিচয় রয়েছে। প্রাচীন অঙ্গ-বঙ্গ এবং কলিঙ্গ রাজ্যের অংশ বিশেষ নিয়েই গঠিত হয়েছিল পুন্ড্র এবং সুহ্ম নামক দুটি রাজ্য। যোগেশচন্দ্র বসু এই দুটি রাজ্যের সীমা প্রসঙ্গে বলেছেন রাজশাহী বিভাগের পশ্চিমোত্তর প্রদেশটি অর্থাৎ প্রাচীন অঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণাংশে পরবর্তীকালে পুন্ড্র রাজ্য নামে অভিহিত এবং কলিঙ্গ রাজ্যের উত্তর-পূর্বাংশ নিয়ে সুহ্মরাজ্য গঠিত ছিল। তাঁর কথায়—

‘‘সুহ্ম ও তাম্রলিপ্ত রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিমে পুন্ড্র রাজ্য, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কলিঙ্গ রাজ্য— এইরূপ নির্দেশই জানা যাইতেছে। নগেন্দ্র বাবু লিখিয়াছেন ‘কলিঙ্গ রাজ্য বর্তমান তমলুকের সীমান্ত হইতে আরম্ভ হইয়া দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।’ তাহা হইলে দেখা যাইতেছে তখন বর্তমান মেদিনীপুর জেলার উত্তর ও পূর্ব ভূ-ভাগের অধিকাংশই সুহ্ম ও তাম্রলিপ্ত রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল। অবশিষ্টাংশ- যাহা তমলুকের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত, উহাই কেবল কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। উত্তর কালে এই বিভাগেরও পরিবর্তন হয়।’’১১

ঐতিহাসিক গবেষকগণ এ প্রসঙ্গে মোটামুটি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার বেশিরভাগ অংশই এককালে সুহ্ম রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এবং তাম্রলিপ্ত ছিল সেই রাজ্যের রাজধানী। ধীরে ধীরে তাম্রলিপ্ত নগরী একটি বানিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় রাজধানীর নামানুসারে এই রাজ্য তাম্রলিপ্ত রাজ্য নামেও পরিচিত হতে শুরু করে। কোন কোন জায়গায় আবার সুহ্ম এবং তাম্রলিপ্তকে স্বতন্ত্র দুই রাজ্য হিসাবেও দেখানো হয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—

‘কলিঙ্গরাজ্য বর্তমান তমলুকের সীমান্ত হইতে আরম্ভ হইয়া দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।’১২

সেই হিসেবে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার উত্তর ও পূর্ব অংশের অধিকাংশ অঞ্চলই সুহ্ম ও তাম্রলিপ্ত রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। অবশিষ্ট দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু অংশ ছিল কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত। এককালে এই বিভাগেরও পরিবর্তন হয়। পরবর্তীকালের সাহিত্যে উৎকল ও উড্রদেশ নামে যে দুই রাজ্যের পরিচয় মেলে মেদিনীপুর জেলার কিছু অংশও তার অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। ‘রঘুবংশ’ কাব্যে কালিদাস ‘কপিশা’ নদীর পরপার থেকে উৎকলের সীমা নির্দেশ করেছেন। এই ‘কপিশা’ প্রকৃতপক্ষে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কাঁসাই বা কংসাবতী নদীর নামান্তর। কলিঙ্গ দেশের অংশ বিশেষ নিয়ে যেমন উৎকল রাজ্য গঠিত হয়েছিল সেইরকম পুন্ড্র রাজ্যের কিছু অংশ নিয়ে উড্র রাজ্যের সৃষ্টি হয়। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ এই উড্র দেশের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে উৎকল এবং উড্র একই রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলে এর সীমারও পরিবর্তন ঘটে। এই নতুন রাজ্যের নাম হয় উড়িষ্যা।

উড়িষ্যার সুবিখ্যাত জগন্নাথ দেবের মন্দিরে রক্ষিত ‘মাদলাপঞ্জী’ থেকে জানা যায় প্রাচীনকালে উড়িষ্যা একত্রিশটি দণ্ডপাট এবং ১১০টি বিশিতে বিভক্ত ছিল। তার মধ্যে ছয়টি দণ্ডপাট ছিল বর্তমান মেদিনীপুর জেলায়। এই ছয়টি দন্ডপাট হল— (১) টানিয়া, (২) জৌলিতি, (৩) নারায়ণপুর, (৪) নইগাঁ, (৫) মালঝিটা এবং (৬) ভঞ্জভূম-বারিপাদা।১৩ বর্তমান কাঁথি মহকুমার অধিকাংশ অঞ্চল ছিল এই মালঝিটা দন্ডপাটের অন্তর্গত। এ প্রসঙ্গে শ্রী বসু আরও জানিয়েছেন—

‘রামনগর, কাঁথি, খেজুরি ও ভগবানপুর থানা লইয়া মালিঝিটা দন্ডপাট থাকা সম্ভব।’১৪ ‘মাদলাপঞ্জী’র এই দণ্ডপাট বিভাগের মধ্যে তাম্রলিপ্ত বা তমলুকের নাম নেই। এ থেকে স্পষ্ট হয় এককালে তাম্রলিপ্ত একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হয়ে উঠেছিল এবং সেখান থেকেই উড়িষ্যা সীমার শুরু। আবার আলোচ্য পুঁথিতে ‘নইগাঁ’ বলে যে দণ্ডপাট এর উল্লেখ মেলে তা বর্তমানের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা মহকুমার নেগুঁয়া। বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত এই নেগুঁয়া এককালে ছিল কাঁথি মহকুমার সদর কার্যালয়। এরপরে ঘটেছে ভাঙা-গড়ার নানান খেলা। শাসক শক্তির উত্থান-পতনের সাক্ষী হতে হয়েছে উপকূলবর্তী এই দক্ষিণবঙ্গকে। বাংলার সীমান্তে অবস্থিত এই মেদিনীপুর জেলা কখনো সম্পূর্ণরূপে কখনো বা তার অংশ বিশেষে উড়িষ্যা রাজার কখনো বা বাংলা রাজার শাসনাধীনে এসেছে। তাই বলা যায় মেদিনীপুরের ইতিহাস বাংলা ও উড়িষ্যা উভয় প্রদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে ষোড়শ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ পর্যন্ত, প্রায় সাড়ে চারশ বছর উড়িষ্যার গঙ্গ ও সূর্যবংশীয়দের অধিকারে চলে আসে মেদিনীপুর। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে উড়িষ্যার অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গদেব গঙ্গাতীরবর্তী মন্দার পর্যন্ত তাঁর অধিকার বিস্তার করেন। সেইসূত্রে মেদিনীপুরে ওড়িয়া আধিপত্যের সূত্রপাত ঘটে।১৫ গঙ্গ বংশের পর সূর্যবংশের রাজত্বকালেও মেদিনীপুরে ওড়িয়া আধিপত্য অব্যাহত থাকে। সূর্যবংশীয় শেষ রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের রাজত্বকালে (১৪৯৭-১৫৪০ খ্রি:) মালঝিটা দন্ডপাটের শাসনকর্তা ছিলেন ভবানন্দ রায়ের পুত্র ও রায় রামানন্দের ভ্রাতা গোপীনাথ পট্টনায়ক। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী রচিত ‘শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে এর উল্লেখ মেলে।১৬ ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে আফগান বংশীয় সুলেমান কররাণীর পুত্র বায়োজিদ উড়িষ্যার হরিচন্দন মুকুন্দদেবকে পরাস্ত করে উড়িষ্যা জয় করেন, সেই সঙ্গে মেদিনীপুরেও পাঠান আধিপত্য শুরু হয়। আফগান আমলে বর্তমান মেদিনীপুর জেলা দুটি সরকারের অন্তর্গত ছিল- সরকার জলেশ্বর ও সরকার মান্দারণ। কাঁথি মহকুমা ছিল এই সরকার জলেশ্বরের অন্তর্গত। আকবরের রাজত্বকালে সমগ্র উড়িষ্যা মোগল সাম্রাজ্যের অধিকারভূক্ত হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে আকবরের রাজস্ব সচীব তোডরমল্ল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব নির্ধারণ কল্পে সুবা বাংলাকে কতগুলি সরকারে বিভক্ত করেন। এই সরকারগুলিকে আবার ‘মহাল’ নামে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা হয়। এই অনুসারে বঙ্গদেশ ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি মহালে এবং উড়িষ্যা প্রদেশ ৫টি সরকার ও ৯০টি মহালে বিভক্ত হয়। উড়িষ্যা প্রদেশের অন্তর্গত সরকার জলেশ্বর ২৮টি মহালে বিভক্ত ছিল, যার মধ্যে ২০টি মহাল ছিল মেদিনীপুরে। এর মধ্যে কাঁথি মহকুমার অধিকাংশই ছিল মালছটা বা মালঝিটা মহালের অন্তর্গত। আবার বাহিসাহি নামক যে মহালের পরিচয় পাওয়া যায় তা রামনগর থানার কালিন্দী-বালিসাই প্রভৃতি অঞ্চলের পরিচয় তুলে ধরে। শুধু তাই নয়, ভোগরাই মহালের কিছু অংশও এই উপকূলবর্তী পূর্ব মেদিনীপুরে পরিব্যাপ্ত ছিল। সম্রাট সাজাহানের রাজত্বকালে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহসুজা বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হলে তিনি তোডরমল্ল এর বিভাগের পরিবর্তন ঘটিয়ে বাংলাকে ১২টি সরকার এবং ২৭৬টি মহালে বিভক্ত করেন। এই বিভাগ অনুসারে বর্তমানের কাঁথি, ভগবানপুর, পটাশপুর এবং খেজুরী থানা মালঝিটা সরকার, রামনগর থানা মুজকুরি সরকার এবং এগরা থানা জলেশ্বর সরকারের অন্তর্ভূক্ত হয়। এই সময় থেকে ইউরোপীয় বণিকগণ বিশেষ করে ইংরেজ, পর্তুগীজ এবং ফরাসী বণিকগণ কাঁথি, খেজুরী এবং হিজলীতে ব্যবসা-বানিজ্য শুরু করে।১৭ ১৭১৭ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারগুলিকে পুনঃনির্ধারিত করেন। তখন থেকে সরকারগুলির নাম হয় ‘চাক্‌লা’। মুর্শিদকুলি খাঁ সুবা বাংলাকে যে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন তার মধ্যে চাক্‌লা হিজলী ছিল অন্যতম। চাক্‌লা হিজলী গঠিত হয়েছিল সরকার মালঝিটা, সরকার মুজকুরি ও সরকার জলেশ্বর নিয়ে। বর্তমানের কাঁথি মহকুমা এই হিজলী চাক্‌লার অন্তর্গত ছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার অধিকার ইংরেজদের হাতে গেলেও কাঁথি মহকুমার সমগ্র অঞ্চল ইংরেজদের অধিকারে যায়নি। কারণ, তখন কাঁথি মহকুমার অনেকটা অঞ্চল চাক্‌লা হিজলীর অন্তর্গত ছিল। কিন্তু ১৭৬৫ সালে দেওয়ানী লাভের ফলে চাক্‌লা হিজলী সহ কাঁথি মহকুমার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ইংরেজদের অধিকারে চলে আসে।১৮ ততদিনে বন্দর হিসেবে খেজুরী নিজেকে আত্মপ্রতিষ্ঠা দিয়ে ফেলেছে।

বাংলা এবং উড়িষ্যা দুই প্রতিবেশী রাজ্য। দুই রাজ্যই ভারতের পূর্বাঞ্চলের এবং সন্নিহিত। দুই রাজ্যের মানুষের মধ্যে শিক্ষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। উড়িষ্যা এবং বাংলার সীমান্তবর্তী জেলা পূর্ব মেদিনীপুর। একারণে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর ওড়িয়া সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, নদী ও সমুদ্র প্রকৃতির স্ব-ইচ্ছায় নবগঠিত এই ভাটি প্রদেশে (নিম্ন জলাভূমি) উড়িষ্যার বালেশ্বর, ময়ূরভঞ্জ, কোরাপুট, কালাহাণ্ডি প্রভৃতি জেলা থেকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বহু মানুষের আগমন ঘটেছে। এঁদের মাধ্যমে ওড়িয়া সংস্কৃতির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রবেশ করেছে এই অঞ্চলে। এর পাশাপাশি বৈবাহিক সূত্রেও সংস্কৃতিগত আদান-প্রদান প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। ফলে পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী এগরা এবং কাঁথি মহকুমায় ওড়িয়া সংস্কৃতির গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই প্রভাবের প্রতিফলন একদিকে যেমন ভাষা প্রয়োগে রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সাংস্কৃতিক আচার-আচরণেও তা সুস্পষ্ট।

দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ, প্রায় সাড়ে চারশ বছর দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তৃত ভূ-ভাগ উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় এবং সূর্যবংশীয় নরপতিদের অধিকারে ছিল। এই ওড়িয়া আধিপত্য সূত্রেই দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় জগন্নাথ সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছে। বিশেষ করে গঙ্গবংশীয় রাজারা ছিলেন জগন্নাথ ভাবধারায় পুষ্ট। এই রাজবংশের আনুকূল্যেই সীমান্ত বাংলায় বহু জগন্নাথ মন্দির নির্মিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার প্রতিটি জগন্নাথ মন্দিরের পূজক-পুরোহিত উৎকল শ্রেণির ব্রাহ্মণ। স্থায়ীভাবে জগন্নাথ দেবের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বৈষ্ণবীয় ভাবধারা বজায় রাখতে গঙ্গবংশীয় নরপতিরা সচেষ্ট হয়েছিলেন। আবার সূর্যবংশীয় রাজত্বকালে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় শৈব ধর্মের প্রসার ঘটেছে। ওড়িয়া রাজারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্য পুরোহিত তন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। দেবমন্দির নির্মাণ এবং দেববিগ্রহ প্রতিষ্ঠাকে তাঁরা রাজকর্তব্য বলে মনে করেছেন। সেইসূত্রে এই অঞ্চলে বহু দেব-দেবীর মন্দির নির্মাণ এবং দেববিগ্রহের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। ওড়িয়া ব্রতধর্ম ও লোকাচার প্রতিষ্ঠায়ও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন এই ওড়িয়া পুরোহিত শ্রেণি। তাই বলা যায়, ওড়িয়া সংস্কৃতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে সীমান্তবর্তী এই বঙ্গ সংস্কৃতি।

সীমান্তবর্তী দক্ষিণবঙ্গে জগন্নাথ সংস্কৃতির প্রসারে উড়িষ্যার রাজারা যেমন সচেষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি পরবর্তীকালে চৈতন্য প্রভাব বৈষ্ণবীয় ভাবধারার জোয়ার এনেছিল। চৈতন্য পরবর্তীকালে শ্যামানন্দ এবং রসিকানন্দের প্রচেষ্টা এই বৈষ্ণবীয় ভাবনায় প্লাবন আনতে সক্ষম হয়েছিল। শ্যামানন্দী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভূক্ত বিভিন্ন মানুষজন নিজ নিজ প্রভাবাধীন এলাকায় বৈষ্ণবীয় উপবৃত্ত মণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন। এঁদের প্রচেষ্টায় বৈষ্ণব ধর্ম একটি লোকধর্মে পরিণত হয়। শ্যামানন্দী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর জীবনে। বিশেষ করে এই অঞ্চলের কাঁড়রা, কদমা, কেওট, বাগদি, নমশূদ্র প্রমুখ মৎস্যজীবী সম্প্রদায় শ্যামানন্দী আদর্শে অধিক উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। অন্ত্যজ সম্প্রদায়ভূক্ত হওয়ার কারণে  ব্রাহ্মণ পুরোহিতের যাজন এঁদের ভাগ্যে জোটেনি। বৈষ্ণব গোস্বামীই বিবাহে, শ্রাদ্ধকর্মে, মহোৎসবে বৈষ্ণব রীতিতে যাজন করে এই
অন্ত্যজ জনসমাজকে হিন্দুধর্মের বৃহৎ পরিসরে এনেছেন।১৯ একারণে ওড়িয়া রাজশক্তির আধিপত্যকে এই অঞ্চলের মানুষজন মনে প্রাণে মেনে নিয়েই শাসন ব্যবস্থার সহযোগীও হয়েছিলেন। ওড়িয়া রাজ আনুগত্যের কারণে এঁরা এই সংস্কৃতির প্রতিও আন্তরিক হয়ে উঠেছেন। এই আন্তরিকতার সুস্পষ্ট প্রতিভাস লক্ষ করা যায় এই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনচর্যায় ও ভাষাপ্রয়োগে।

বাংলা এবং উড়িষ্যা এই দুই প্রতিবেশী রাজ্যের ভাষাগত উৎস এক। অর্থাৎ উভয় ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা বংশ থেকে উদ্ভূত (পূর্বমাগধী অপভ্রংশ ও অবহট্‌ঠ্‌ জাত) এবং সহোদরা সম্পর্কে আবদ্ধ। ভারতীয় আর্যভাষা বংশের উত্তরাধিকার বহন করছে যে সকল ভাষা, বাংলা ও ওড়িয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। এই দুই ভাষার মধ্যে ক্রিয়া, ধাতু, কাল, উচ্চারণ এবং শব্দগত কিছু অমিল থাকলেও সাদৃশ্যের দিকটি অনেক বেশি। তাছাড়া ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ে উড়িষ্যা সন্নিহিত হওয়ায় এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষায় ওড়িয়া ভাষার প্রভাব বিশেষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন—

ক) ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রভাব:

১. শব্দের আদিতে অবস্থিত ‘ও’ ধ্বনির ‘উ’ ধ্বনি রূপে উচ্চারণ প্রবণতা এসেছে মূলত ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে।

      
যেমন – কুলo(কোল)

      
      
বুকা (বোকা)

২. পদান্তে ‘অ’ কারান্ত (স্বরান্ত) উচ্চারণ প্রবণতাও এই ওড়িয়া প্রভাবজাত।

      
যেমন – জলo (জড়অ) (জল)

      
      
হাতo (হাতঅ) (হাত)

৩. আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত প্রবণতার কারণে শব্দ মধ্যস্থ ‘আ’ ধ্বনির বিলুপ্তি ঘটেছে ওড়িয়া উচ্চারণ প্রবণতার প্রভাবে।

      
যেমন – জিল্‌পি (জিলাপি)

      
      
বিচ্‌লি (বিচালি)

৪. শব্দের আদিতে ‘ই’ স্বরধ্বনির উচ্চারণ প্রবণতাও ওড়িয়া প্রভাবের ফলশ্রুতি।

      
যেমন – শিখা (শেখা)

      
      
ঘিরা (ঘেরা)

৫. ‘ই’ ধ্বনির মতো শব্দের আদিতে ‘উ’ ধ্বনির উচ্চারণ প্রবণতাও ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে এসেছে।

      
যেমন – মুটা (মোটা)

      
      
রুগা (রোগা)

৬. ‘র’ এবং ‘ল’ ধ্বনির মূর্ধন্য উচ্চারণ প্রবণতাও ওড়িয়া প্রভাবের ফল।

      
যেমন – নড়িয়া (নারিকেল)

      
      
জলo (জল)

৭. ব(W) শ্রুতির অনুপস্থিতি তথা অন্তঃস্থ ‘ব’ এর স্থানে বর্গীয় ‘ব’ এর উচ্চারণ প্রবণতাও ওড়িয়া ভাষার প্রভাবের ফল।

      
যেমন – দিবা – থুবা (দেওয়া-থোওয়া)

      
      
যিবা (যাওয়া)

৮. ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে এই জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষায় পদান্তে ‘আ’ স্বরধ্বনি রক্ষিত হয়েছে।

      
যেমন – নীচা (নীচু)

      
      
উঁচা (উঁচু)

৯. শব্দ মধ্যস্থ ‘ই’ এবং ‘উ’ ধ্বনির ব্যবহারেও ওড়িয়া প্রভাব বর্তমান।

      
যেমন – আঁইশo (আঁশ)

      
      
মাউসি (মাসি)

১০. ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে এই অঞ্চলের বিভাষায় অনুনাসিকতার প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়।

      
যেমন – বঁধo (বঁধঅ) (বাঁধ)

      
      
শঁখo (শঁখঅ) (শাঁখ)

১১. শব্দের আদিতে অবস্থিত ‘ন’ ধ্বনির স্থানে ‘ল’ ধ্বনির উচ্চারণ প্রবণতাও ওড়িয়া ভাষার প্রভাবের ফল।

      
যেমন – লড়া (নড়া)

      
      
লাতুনি (নাতনি)

১২. ‘চ্ছ’ অন্ত ক্রিয়া পদের ক্ষেত্রে ‘ছ’ ধ্বনির বিলুপ্তিও ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে ঘটেছে।

      
যেমন – খাউচি (খাচ্ছি)

      
      
যাউচি (যাচ্ছি)

খ) রূপতাত্ত্বিক প্রভাব:

১. ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে এই অঞ্চলের বিভাষায় ‘মুঁহা’ অনুসর্গের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

      
যেমন – গাঁ মুঁহা (গ্রামের দিকে)

      
      
সে মুঁহা (সে দিকে)

২. বহুবচনে বহ্বার্থক ‘মেন’ (মানব) শব্দের সংযুক্তিও ওড়িয়া ভাষার প্রভাব এসেছে।

      
যেমন – বুড়া মেনে (বুড়োরা)

      
      
তোর মেনে (তোরা)

৩. ‘মান’, মানে, মেনে (মানব) যুক্ত হয়ে বহুবচনের পদ গঠনও ওড়িয়া প্রভাবের ফল।

      
যেমন – লুক মানে (লোকেরা)

      
      
তুমর মেনে (তোমরা)

৪. বহুবচন বোঝাতে পদের আগে বা পরে ‘সব’ এর পরিবর্তে ‘সোবু’ প্রভৃতি বহ্বার্থক শব্দের ব্যবহার ওড়িয়া প্রভাবের ফলশ্রুতি।

      
যেমন – সোবুলুকo (সব লোক)

      
      
লুকoসোবু (লোক সব)

৫. ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে এই অঞ্চলের বিভাষায় ব্যবহৃত অনুসর্গেও স্বাতন্ত্র্য এসেছে। অনুসর্গ হিসেবে ‘নু’, ‘রু’, ‘কতরু’, ‘দিয়ারo’ প্রভৃতির প্রচলন লক্ষ করা যায়।

      
যেমন – গা-নু আইলা (গ্রাম থেকে এল।)

      
      
মুহুরু খসি পড়লা। (মুখ থেকে খসে পড়ল।)

      
      
তোর কতরু ছ’মাসoর বড়। (তোর থেকে ছয় মাসের বড়।)

      
      
তোর দিয়ারo কাজটা হেলানি। (তোর জন্য কাজটা হোল না।)

৬. নঞ্‌র্থক বাক্যে ক্রিয়াপদের শেষে ‘নি’ অব্যয়ের ব্যবহারও ওড়িয়া প্রেরণা সঞ্জাত।

      
যেমন – করিমিনি (করিবনা)

      
      
যিমিনি (যাইবনা)

৭. স্ত্রী লিঙ্গবাচক প্রত্যয় হিসেবে ‘উনি’র ব্যবহার ওড়িয়া প্রভাবজাত।

      
যেমন – নাতুনি (নাতিনি)

      
      
ভোউনি (বোন)

৮. অতীতকালের উত্তম পুরুরষের বিভক্তি হিসেবে ‘ই’ বিভক্তির ব্যবহারও ওড়িয়া ভাষার প্রভাবসূত্রে ঘটেছে।

      
যেমন – খাইথিলি (খেয়ে ছিলাম)

      
      
যাইথিলি (গিয়ে ছিলাম)

৯. ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে এই অঞ্চলের বিভাষার ক্রিয়ায় প্রথম পুরুষের অনুজ্ঞাভাবে ‘উ’ বিভক্তির প্রয়োগ ঘটেছে।

      
যেমন – খাউ (খাক)

      
      
যাউ (যাক)

১০. অতীত এবং ভবিষ্যতের যৌগিক কালে সহায়ক ধাতু রূপে ‘আছ্‌’ এর পরিবর্তে ‘থা’ (‘স্থা’ ধাতু) ধাতুর প্রয়োগ ঘটেছে ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে।

      
যেমন – শুইথিলা (ঘুমিয়েছিল)

      
      
শুই থিব (ঘুমাতে থাকবে)

১১. ওড়িয়া ভাষার ভবিষ্যৎ কালের প্রথম পুরুষের একবচনের বিভক্তি ‘অ’। সেইসূত্রে এই ভাষায়ও প্রথম পুরুষের একবচনে ‘অ’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়েছে।

      
যেমন – সে করিবo (সে করবে)

      
      
তামনে দেখিবo (তারা দেখবে)

১২. পদান্তে ‘ইয়া’ প্রত্যয় যোগের ক্ষেত্রেও ওড়িয়া প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

      
যেমন – জাল + ইয়া = জালিয়া (জেলে)

      
      
হাল ইয়া = হালিয়া (হেলে)

গ) শব্দভাণ্ডারগত প্রভাব:

শুধু ধ্বনিতাত্ত্বিক কিংবা রূপতাত্ত্বিক নয়, ওড়িয়া শব্দভাণ্ডারগত কিছু প্রভাবও লক্ষ করা যায় এই উপকূলবর্তী জনজীবনের কথ্য ভাষায়। এই প্রভাবের ফলে বেশকিছু ওড়িয়া শব্দ সহজেই ঢুকে পড়েছে পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী সীমান্তভূমিতে। মূলত দীঘা, রামনগর, এবং এগরা থানার অধিবাসীদের কথ্য ভাষায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট। এইরকম কিছু শব্দের নিদর্শন নিম্নরূপ—

অ – অঘা (দুর্বল)

     অঁধা (অন্ধ)

আ – আগরo (সামনে)

     আমসি (আমচুর)

ই – ইটা (ইট)

     ইন্তি (এমনি)

উ – উখলা (তেল না মেখে)

     উদা (ভিজা)

এ – এভে (এখন)

     এমনে (এরা)

ও – ওউ (চালতা)

     ওসার (চওড়া)

ক – কলাo (কালো) 

     কাদ
o (কাদা)

খ – খচড়া (বদ্‌মাইশ)

     খন্‌তা (খুন্তি)

গ – গটে (একটা)

     গনি (গেলাম)

ঘ – ঘইতা (স্বামী)

     ঘিনা (পরিধান করা)

চ – চুলি (উনুন)

     চুঁটি (অস্তিত্ব)

ছ – ছুয়া (ছেলে)

     ছেলি
o (ছাগল)

জ – জনo (চাঁদ)

     জঁঘ
o (জানু)

ঝ – ঝটা (ঝাঁটা)

     ঝু
নাo (পরিপক্ক)

ট – টনিo (ছোট)

     টুকা (নাবালক)

ঠ – ঠকুয়া (ঠকবাজ)

    ঠসরা (কমজোর)

ড – ডাহি (নীচু জমি)

    
ডাংগo (ডাং)

ঢ – ঢাউকo (ডাহুক)

    ঢাম
o (বাড়িয়ে বলা)

ত – তনি (আমানি)

     তঁটি (গলা)

থ – থুপo (টোপ)

     থুপড়ি (ছোট)

দ – দখনo (দক্ষিণ)

     দঁতা (প্রভাবশালী)

ধ – ধুবলা (সাদা)

     ধুবা (ধোপা)

ন – নথo (নোলক)

     নফ
o (লম্ফ)

প – পখলo (পান্তা)

     পনখি (বঁটি)

ফ – ফুড়o (ছিদ্র)

     ফঁপা (খাঁদা)

ব – বনাo (দিক্‌ভ্রম)

     বঁধ
o (বাঁধ)

ভ – ভুজা (মুড়ি)

     ভুঁড়া (মোটা)

ম – মনিo (টাকা রাখার থলে বা পকেট)

     মুহ
o (মুখ)

য – যিন্তি (যেমন)

     যিমিনি (যাবনা)

র – রগড় (বাগড়া দেওয়া)

    রাঁড
o (বিধবা)

ল – লড়িয়া (নারিকেল)

     লুয়া (নতুন)

শ – শুষo (তেষ্টা)

     শুঁড
o (শুঁড়)

ষ – ষঁডা (পুরুষালি)

     ষঁড
o (ষাঁড়)

স- সমিস্তে (সবাই)

   সবু (সব)

হ – হুড়া (ঢিল)

    হড়কা (পিচ্ছিল)

অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার রূপের তারতম্য আছে। এই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলা ভাষার পাঁচটি উপভাষা অঞ্চল পরিকল্পিত হয়েছে। যথা— রাঢ়ী, বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, কামরূপী ও ঝাড়খন্ডী। প্রায় প্রত্যেকটি উপভাষার বিভাষা অঞ্চল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণাংশে কাঁথি মহকুমার অবস্থান। গ্রিয়ার্সন সাহেব এই অঞ্চলের ভাষাকে South Western Bengali (দক্ষিণ পশ্চিম বাংলা) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।২০ বলাবাহুল্য, গ্রিয়ার্সন অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার ভাষারীতির পর্যালোচনা সূত্রে এই ভাষার উপর ওড়িয়া প্রভাবের যে বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন তা সর্বাংশে সমর্থনযোগ্য নয়। কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার উপর কেবলমাত্র ওড়িয়া প্রভাব নেই, আছে— অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, মারাঠী, পোর্তুগীজ এবং মুসলমানী বাংলা ভাষার প্রভাব। এ প্রসঙ্গে ড. বিজন বিহারী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন—

‘গ্রিয়ার্সন কাঁথির ভাষাকে বাংলা বলেন নাই। বলিয়াছেন বাংলা-ওড়িয়া মিশ্র ভাষা। লিঙ্গুইস্টিক সার্ভের প্রকাশকাল ১৯০০। সে সময় হয়তো তাহা সত্য ছিল। বর্তমানে কাঁথির ভাষাকে আর মিশ্র ভাষা বলা সঙ্গত হইবে না, বরং ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা বলাই উচিত হইবে।’২১

ভাষাতাত্ত্বিক সুধীর কুমার করণ পশ্চিম বাংলার কথ্য ভাষাকে যে পাঁচটি বিভাষা (Sub-dialect) অঞ্চলে ভাগ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল— S. W. B (K) (Kanthi Sub-Group)। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য—

‘…my investigation shows that dialect distribution made by Grierson in this area is not correct. The sub-dialect of South-Western Bengali were left by either as Midnapur Oriya or as standard Bengali.’২২

ড. করণের স্পষ্ট অভিমত—

‘S.W.B has developed a peculiar from of its own in the Present progressive tense which is never found in Bengali nor in the neighbouring language of Oriya in any way. This and some other factors may prove its independent growth as a dialect and not as a mere mixture of two languages.’২৩

তিনি আরও জানিয়েছেন—

‘This Kanthi (i.e. Contai) Sub dialect of South Western Bengali is so named as it includes the greater portion of Kanthi sub-division. Some Southern parts of Sadar (Midnapur) sub-division also come under this sub-dialect area.’২৪

ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরের ভাষাকে রাঢ়ী উপভাষার অন্যতম রূপ ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা’ ভাষা বলেছেন। কাঁথি মহকুমা যেহেতু দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরে অবস্থিত সেই হিসেবে এই ভাষাকেও ‘দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা’ হিসেবে ধরতে হয়। আবার সুকুমার সেন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের উপভাষাকে ‘ঝাড়খন্ডী’ উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বিচারে এ ভাষা ‘দন্ডভুক্তীয় ঝাড়খন্ডী’। ধীরেন্দ্রনাথ সাহাও দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের উপভাষাকে ‘ঝাড়খন্ডী’ উপভাষা হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাঁর কথায় ‘ঝাড়খন্ডী’ উপভাষার পূর্বীরূপের সীমা কাঁথি মহকুমা পর্যন্ত প্রসারিত২৫। তবে কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার সঙ্গে ঝাড়খন্ডী এবং রাঢ়ী উপভাষার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য উভয়ই লক্ষ করা যায়।

কাঁথি মহকুমার পূর্বে রয়েছে রাঢ়ী উপভাষা অঞ্চল, আর পশ্চিমে রয়েছে ঝাড়খন্ডী উপভাষা অঞ্চল। বর্তমানে রাঢ়ী উপভাষা যতটা দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে, কাঁথি মহকুমার কথ্য বাংলা ভাষা সে তুলনায় পরিবর্তিত হয়নি। একারণে, কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার সঙ্গে রাঢ়ী উপভাষা তথা চলিত বাংলার অনেক বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। সে তুলনায় এই উপভাষা ঝাড়খন্ডী উপভাষার অনেকটা কাছাকাছি। অর্থাৎ রাঢ়ী উপভাষা অপেক্ষা ঝাড়খন্ডী উপভাষার পূর্বীরূপের সঙ্গে কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার মিল কিছুটা বেশি। একারণে কাঁথি মহকুমার কথ্যভাষার অন্যতম গবেষক দোলগোবিন্দ দাস এই ভাষা সম্পর্কে বলেছেন—

‘কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষাকে ঝাড়খন্ডী উপভাষার একটি বিভাষা বলা যাচ্ছে।’২৬

তবে ড. দাসের এই অভিমত সর্বাংশে সমর্থনযোগ্য নয়। অঞ্চলভেদে এবং অধিবাসী ভেদে উপকূলবর্তী দক্ষিণবঙ্গে বিভাষার রূপভেদ আছে। অর্থাৎ দীঘা-রামনগর, শঙ্করপুর অঞ্চলে যে ধরণের বিভাষার প্রচলন লক্ষ করা যায়, তার সঙ্গে কাঁথি, খেজুরী অঞ্চলের বিভাষার যথেষ্ট পার্থক্য বর্তমান। এই পার্থক্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে ড. দাস অধিবাসীগত ভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সমগ্র কাঁথি মহকুমায় যাঁরা আদি অধিবাসী এবং যাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা তাঁদেরকে তিনি ‘আদি বাঙ্গালী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এঁরা এই মহকুমার সর্বত্রই অবস্থান করছেন। এছাড়াও উড়িষ্যা থেকে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু জনগোষ্ঠী এই মহকুমায় এসেছেন। বর্তমানে তাঁরা অবশ্যই বাঙালি। কিন্ত কাঁথি মহকুমার আদি বাঙালি অপেক্ষা এঁদের কথ্য ভাষার ব্যবহার বিধি কিছুটা স্বতন্ত্র। উড়িষ্যা সংলগ্ন প্রান্তবর্তী বঙ্গদেশেই এঁদের অধিক বসবাস। মূলত দীঘা, রামনগর, শংকরপুর এবং অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার এগরা, পটাশপুর অঞ্চলেই এই সকল জনগোষ্ঠীর অধিক অবস্থান। অধিবাসীগত বিভাষাভেদ বোঝানোর জন্য ড. দাস এঁদেরকে ‘উড়িষ্যাগত বাঙ্গালী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কালক্রমে এঁদের ওড়িয়া ভাষা এখানকার আদি বাঙালিদের বাংলা ভাষার দ্বারা এত বেশি পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছে যে, একে ওড়িয়া বা মিশ্রভাষা কোন মতেই বলা চলে না। বরং ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা বলাই সঙ্গত। অবশ্য এঁদের ওড়িয়া ভাষার প্রভাবও এখানকার আদি বাঙালিদের উপর যথেষ্ট রূপে পড়েছে। এই উভয় ভাষার পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া, শিক্ষায় অনগ্রসরতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং রক্ষণশীলতার কারণে এই অঞ্চলের বিভাষা চলিত বাংলার সঙ্গে তাল রেখে দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারেনি। একারণে উপকূলবর্তী দক্ষিণবঙ্গের বিভাষা হয়েছে সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির।

উপকূলবর্তী দক্ষিণবঙ্গের আদি বাঙালি কথিত ‘মূল বিভাষা’ এবং উড়িষ্যা থেকে আগত অধিবাসীদের ‘ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা’র মধ্যে সীমারেখা টানা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। ড. দাস তাঁর গবেষণায় এই মূল বিভাষার আবার দুটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন— ভগবানপুর, খেজুরী, পটাশপুর থানা অঞ্চলে প্রচলিত বিভাষাকে ‘ভগবানপুরী মূল বিভাষা’ এবং কাঁথি-এগরা ও পটাশপুর থানার পূর্ব অঞ্চলে প্রচলিত বিভাষাকে ‘কাঁথির মূল বিভাষা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে কাঁথি-এগরা (উত্তর-পূর্বাংশ), পটাশপুর(পশ্চিমাংশ) থানা অঞ্চলে প্রচলিত বিভাষাকে তিনি ‘কাঁথির ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা’ এবং রামনগর দীঘা থানা অঞ্চলে প্রচলিত বিভাষাকে ‘রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

উপকূলবর্তী দক্ষিণবঙ্গে ‘কাঁথির মূল বিভাষা’ এবং ‘রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা’— উভয় ভাষার প্রচলন লক্ষ করা যায়। শুধু তাই নয়, হিজলী খেজুরী অঞ্চলে ‘ভগবানপুরী মূল বিভাষা’র অস্তিত্বও রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী অঞ্চলের  জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘কাঁথির মূল বিভাষা’ এবং ‘রামনগরী ওড়িয়া বিভাষা’য় কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে দীঘা, রামনগর, শংকরপুর অঞ্চলে ওড়িয়া প্রভাবিত ‘রামনগরী বিভাষা’রই আধিক্য। আর মান্দারমণি, জলধা, খড়িপাই, শৌলা, বাঁকিপুট, জুনপুট, কাঁথি, হিজলী, খেজুরী প্রভৃতি অঞ্চলে রয়েছে কাঁথির মূল বিভাষার প্রচলন। এই দুই বিভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ

১) ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

ক) শব্দের আদিতে অবস্থিত ‘ও’ ধ্বনির ‘অ’ বা ‘উ’ ধ্বনিতে উচ্চারণ প্রবণতা। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
কোলকোড়কুলo
ফোলাফুলাফুলা
কোনকোনকনo

খ) পদান্তে ‘অ’ স্বরধ্বনির ব্যবহার কাঁথির মূল বিভাষায় কম হলেও রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায় অধিক লক্ষ করা যায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
ঘাস্‌ঘাস্‌ঘাসo
হাত্‌হাত্‌হাতo
পানপানপানo

গ) আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত প্রবণতার কারণে কাঁথির মূল বিভাষা এবং রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা উভয়ক্ষেত্রে শব্দ মধ্যস্থ ‘অ’ ধ্বনির বিলুপ্তি ঘটেছে। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
বাতাসাবাত্‌সাবাত্‌সা
জিলাপিজিল্‌পিজিল্‌পি
বিচালিবিচ্‌লিবিচ্‌লি

ঘ) ‘উ’, ‘এ’ এবং ‘ও’ ধ্বনির ‘আ’ ধ্বনিতে পরিবর্তন এই দুই বিভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
উঁচুউঁচাউঁচা
বিছেবিছাবিছা
সূতোসুতাসুতা

ঙ) এই দুই বিভাষায় শব্দের আদিতে ‘ই’ স্বরধ্বনির অবস্থানের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায় এর অধিক প্রভাব রয়েছে। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
লেখালিখালিখা
ঘেরাঘিরাঘিরা
সেদ্ধসিদ্ধসিদ্ধ

চ) ‘ই’ ধ্বনির মতো শব্দের আদিতে ‘উ’ ধ্বনির প্রবণতাও এই দুই বিভাষায় লক্ষ করা যায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
কোটাকুটাকুটা
রোগারগারুগা
ঝোলাঝoলাঝুলা

ছ) আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাতের কারণে শব্দের আদি কিংবা মধ্যস্থিত ‘উ’ ধ্বনি বিলুপ্ত হয় এই বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
মানুষমানুষমন্‌সo
চাকুরিচাক্‌রিচাক্‌রি
বামুনবামুনoবাহুনo

জ) পদান্তে ‘ইয়া’ যৌগিক স্বরধ্বনি রক্ষিত হয়েছে কাঁথির মূল বিভাষা এবং রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
কনেকনিয়াকনিয়া
এঁড়েআঁড়িয়াঅঁড়িয়া
জেলেজালিয়াজালিয়া

ঝ) পদান্তে ‘উয়া’ যৌগিক স্বরধ্বনি রক্ষিত হয়েছে এই দুই বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
ভেতোভাতুয়াভাতুয়া
ধেনোধানুয়াধানুয়া
গেছোগাছুয়াগোছুয়া

ঞ) মান্য চলিত ভাষার মতো অনুনাসিকতার প্রাচুর্য রয়েছে এই দুই বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
বাঁধবাঁধবঁধo
সাঁঝসাঁঝসঁঝo
শাঁখশাঁকশঁখo

ট) চলিত বাংলায় একটি ‘ন’ ধ্বনি হলেও কাঁথির বিভাষায় দুটো ‘ন’ ধ্বনির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। মান্য চলিতের মতো একটি দন্ত্য ‘ন’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন— ধান, পান, কান, নাক ইত্যাদি। আর একটির উচ্চারণ— ‘নঁ’ ধ্বনির মতো। যেমন— ‘কিনে’-’কিনেঁ, ‘বন’-’বনঁ’, ‘কনা’-’কনাঁ’ ইত্যাদি। ধ্বনি ভেদে ‘ন’ ধ্বনিযুক্ত পদের অর্থান্তরও ঘটে। যেমন—

বনo = বন্যাকনা = ছেঁড়া ন্যাকড়াপানিয়া = চিরুনি
বনo = বনকনাo= অন্ধপানাo য়া = জলো

ঠ) ‘ম’ ধ্বনির অনুনাসিকতার তারতম্যে অর্থান্তর ঘটে এই দুই বিভাষায়। ‘ম’ ধ্বনির অনুনাসিকতার মাত্রা একটু কম হলে একরকম অর্থ, আর একটু বেশি হলে আর একরকম অর্থ হয়। যেমন— ‘মায়া’ শব্দের অনুনাসিকতা কম থাকলে এর অর্থ হয় ‘স্ত্রী লোক’, আবার এই একই শব্দে অনুনাসিকতা বেশি থাকলে এর অর্থ হয় ‘মমতা’। অনুরূপভাবে ‘মাই’ শব্দের কম অনুনাসিকতা ‘মাদি’ এবং বেশি অনুনাসিকতা ‘মামী’কে বোঝায়।

ড) ‘ন’ ধ্বনির মতো ‘ল’ ধ্বনিতেও এই বিভাষায় বৈচিত্র্য আছে। ‘ল’ ধ্বনির দু-রকম উচ্চারণ রীতি প্রচলিত। একটি ধ্বনিকে দন্ত্য(ল) এবং অপরটিকে মূর্ধন্য(ল) ধ্বনি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন—

খুলo – উন্মুক্ত করা      
      
      
পলাo – কুঁড়ে ঘর

খুলo – খনন কোরা       
      
      
পলাo– পালাও ইত্যাদি

ব্যালo – বেল       
      
      
      
কালo – আগামীদিন

ব্যালo – সময়       
      
      
      
কালo – দুঃসময়

ঢ) ওড়িয়া প্রভাবিত রামনগরী বিভাষায় ‘ব’ ধ্বনির উচ্চারণ ‘উয়া’(W) ধ্বনির মতো হয়। যেমন—

চলিত বাংলাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
দ্বারদুয়ারo
দ্বারাদুয়ারা ইত্যাদি

ণ) ‘ল’ ধ্বনির ‘ন’ ধ্বনিতে পরিবর্তন এই ভাষার আর এক বৈশিষ্ট্য। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
লেজল্যাজন্যাজo
লেবুনেবুনেবু
লাঙললাঙ্গলনংলo ইত্যাদি

২) রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

ক) স্ত্রী লিঙ্গবাচক প্রত্যয় হিসেবে ‘ঈ’ আনী, উনী’র ব্যবহার ঘটে এই দুই বিভাষায়। যেমন— বুড়ী, বায়নী, চাকরানী, জালিয়ানী, নাতুনী ইত্যাদি।

খ) স্ত্রী এবং পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করে লিঙ্গভেদ বোঝানো হয় এই দুই বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
পুংলিঙ্গস্ত্রীলিঙ্গপুংলিঙ্গস্ত্রীলিঙ্গপুংলিঙ্গস্ত্রীলিঙ্গ
পুত্রকন্যাপোঝিপুয়oঝিয়o
মামামামীমামামামীমামুমাoই
বরকনেবরকন্যাবরoকনিয়া

                                                                ইত্যাদি

গ) এই দুই বিভাষায় পদের আগে বা পরে ‘সব’, ‘সোবু’, ‘বহু’, ‘অনেক’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে বহুবচন বোঝানো হয়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
লোকগুলিসবলোকসোবু লোকo
লোকগুলিলোকসবলুকo সোবু
অনেক লোকবহু লোকবহু লুকo
বেশি কথাঅনেক কথাঅনেক কথা

ঘ) বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনাম পদের পুনরাবৃত্তির দ্বারাও বহুবচন নির্দেশিত হয় এই দুই বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
গ্রামে গ্রামে ঘোরাগাঁ গাঁ ঘুরাগাঁ গাঁ ঘুরা
ভালো ভালো লোকভালা ভালা লোক্‌ভল্‌ ভল্‌ লুকo
যে যে এলযোউ যোউ আইলাযে যে আইলা

ঙ) কাঁথির মুল বিভাষায় ‘এ’, ‘কের’, ‘নু’ প্রভৃতি বিভক্তি লক্ষ করা যায়। আর রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায় ‘র’, ‘কার’, ‘উ’ প্রভৃতি বিভক্তি বহুল প্রচলিত। যেমন—

কাঁথির মূল বিভাষারামনগরী ওড়িয়া বিভাষা
আমনকেরআমিনকার
ম্যাঘেমেঘরo
ঘরনুঘরু

চ) চলিত বাঙ্গালার সমন্ধ পদের ‘র’ এবং ‘এর’ বিভক্তি কাঁথির মূল বিভাষায় ‘র’, ‘এর’ এবং ‘কের’ হয়েছে। আর রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায় ‘এর’ বিভক্তির কোন প্রচলন নেই। তার পরিবর্তে ‘কার’ বিভক্তি প্রচলিত। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
এখনকার মতো সব কাজ বন্ধ থাকলওখুনকের মতো সব কাজ বন্ধ রইলাএখুনকার মত সবু কাজ বন্ধ রইলা
দুজনার ভাত একা খেলামদুজন্‌কের ভাত একা খাইলিদুইজনকার ভাতo এক্‌লা খাইলি

ছ) অনুসর্গের ব্যবহারগত স্বাতন্ত্র্যও এই দুই বিভাষায় লক্ষ করা যায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
অপেক্ষাচাইনুচাইতে
জন্যজিনেদিয়ারo
দিয়েদিকিদেই

জ) কাঁথির মূল বিভাষায় সাধারণার্থে এবং সম্ভ্রমার্থে সর্বনাম পদের কোন রূপভেদ নেই। যেমন পরিচিত এবং অপরিচিত উভয় ক্ষেত্রে তুমি, তুমার, তার, তারু, কাঁথির মূল বিভাষায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায় তুচ্ছার্থে ‘তু’ সম্ভ্রমার্থে ‘তুমে’ প্রভৃতি সর্বনামের ব্যবহার প্রচলিত।

ঝ) ক্রিয়াপদের পুরুষভেদে কোন কোন মূল ধাতুর স্বরধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যায় এই দুই বিভাষায়। যেমন—

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
আমি দিআমে দেইমু দিয়েo
আমি লিখিআমে লেখিমু লেখেঁ

ঞ) নঞ্‌র্থক বাক্যে চলিত বাংলায় ক্রিয়াপদের শেষে ‘না’ অব্যয় বসে। কিন্তু মূল বিভাষা এবং রামনগরী ওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষায় ‘নি’ অব্যয় বসে।

চলিত বাংলামূল বিভাষাওড়িয়া প্রভাবিত বিভাষা
আমি যাবনাআমি যাবানিমু যিমিনি
আমি থাকব নাআমি থাকবানিমু রইমিনি

সব মিলিয়ে তাই বলা যায়, বাংলার প্রান্ত দেশে অবস্থিত হওয়ার কারণে দক্ষিণ বঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাংলা ভাষা তার নিজস্ব অস্তিস্ত্বকে সম্পূর্ণ রূপে ধরে রাখতে পারেনি। শুধু বাংলা ভাষা কেন, যে কোন সীমান্ত অঞ্চলের ভাষার ক্ষেত্রে এ সত্যতা সহজেই অনুমেয়। ভাষাগত এই সংকট সৃষ্টি মূলত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে। তবে দক্ষিণ বঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভাষাগত সংকটের পেছনে অভিবাসন এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন – এই দুই-ই সমান সক্রিয়। এর ফলে বাংলা ভাষার যেমন বেশ কিছু ক্ষতি হয়েছে তেমনি লাভও কম হয়নি।

সংকেত:

১. ‘অ’ কারান্ত উচ্চারণ বোঝাতে শব্দের মাথায় (o) চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়েছে।

২. দন্ত্য(ন) এবং ‘ল’ ধ্বনির মূর্ধন্য (ণ) উচ্চারণ বোঝাতে (o) চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১. Beley H.V./Memorandam of Midnapore/1852/দ্র. দাস, হরিসাধন/মেদিনীপুর দর্পণ/রেবা দাস ও শীলাদাস কর্তৃক প্রকাশিত/আর ১৭, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ মার্গ, শরৎপল্লী/মেদিনীপুর/প্রথম প্রকাশ আষাঢ়, ১৩৯৫/পৃষ্ঠা-২০।

২. দাস, হরিসাধন/মেদিনীপুর দর্পণ/রেবা দাস ও শীলাদাস কর্তৃক প্রকাশিত/আর ১৭, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ মার্গ, শরৎপল্লী/মেদিনীপুর/প্রথম প্রকাশ আষাঢ়, ১৩৯৫/পৃষ্ঠা – ২৩।

৩. মেদিনীপুর, জেলা সংখ্যা – পশ্চিমবঙ্গ (জানুয়ারী-২০০৪)/সম্পাদক দিব্যজ্যোতি মজুমদার।

৪. A Statistical Account of Bengal (Midnapore)/Reprint Delhi Edn-1973/P-188।

৫. বসু, যোগেশচন্দ্র/মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬/পৃষ্ঠা-৮১।

৬. দাস, মন্মথ নাথ/প্রথম অধ্যায় – প্রাথমিক পরিচয়/দ্র. মিশ্র, অমলেশ/অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার ইতিবৃত্ত/ দে পাবলিকেশন/১৪১৯/পৃষ্ঠা-৩৭।

৭. হাজরা, প্রবালকান্তি/খেজুরীর কথা/উপত্যকা প্রকাশনী/মেদিনীপুর/২০০৯/ পৃষ্ঠা-৪৭।

৮. মিশ্র, অমলেশ/অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার ইতিবৃত্ত/দে পাবলিকেশন/১৪১৯/৬ষ্ঠ অধ্যায়/প্রবন্ধ-কাঁথির রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস/প্রশান্ত প্রামাণিক/পৃষ্ঠা-২১৫।

৯. বসু, যোগেশচন্দ্র/মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬/পৃষ্ঠা-১০০।

১০. জন্মভূমি পত্রিকা/প্রথম খন্ড/পৃষ্ঠা-৪৪৮/দ্র. বসু, যোগেশচন্দ্র/মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬।

১১. বসু, যোগেশচন্দ্র/মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬/পৃষ্ঠা-৫৫।

১২. জন্মভূমি পত্রিকা/প্রথম খন্ড/পৃষ্ঠা-৪৪৮/দ্র. বসু, যোগেশচন্দ্র/মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬।

১৩. বসু, যোগেশচন্দ্র-মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬/পৃষ্ঠা-৫৭।

১৪. তদেব/পৃষ্ঠা-৫৮।

১৫. মাইতি, বঙ্কিমচন্দ্র/দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি/সমাজ সেবক সংঘ প্রেস/বিদিশা/নারায়ণগড়/মেদিনীপুর/১৩৯৭/পৃষ্ঠা-৩১।

১৬. গোস্বামী, কৃষ্ণদাস কবিরাজ/শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত/অন্ত্যলীলা ৫ম পরিচ্ছেদ /সম্পাদনায় বিমলাকান্ত মুখোপাধ্যায়/প্রজ্ঞা বিকাশ/১৩৭৭/পৃষ্ঠা-৮২।

১৭. বসু, যোগেশচন্দ্র/মেদিনীপুরের ইতিহাস/প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ/পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ/অন্নপূর্ণা প্রকাশনী/১৪১৬/পৃষ্ঠা-৬৪-৬৫।

১৮. দাস, দোল গোবিন্দ/কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার রূপ ও রীতি/নীরোদা বুক স্টোর/কাঁথি/পূর্ব মেদিনীপুর/১৪০১/পৃষ্ঠা-৬-৭।

১৯. মাইতি, বঙ্কিমচন্দ্র/দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি/সমাজ সেবক সংঘ প্রেস/বিদিশা/নারায়ণগড়/মেদিনীপুর/১৩৯৭/পৃষ্ঠা-২৪৬।

২০. Grierson G.A/Linguistic Survey of India/Vol. V. Part – I/Low price Publication/Delhi/1903/Page-181।

২১. বাগর্থ-শ্রী বিজনবিহারী ভট্টাচার্য/দ্র. দাস, দোল গোবিন্দ/কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার রূপ ও রীতি/কাঁথি/পূর্ব মেদিনীপুর/১৪০১/পৃষ্ঠা-১২।

২২. Karan, Sudhir Kr./South Western Bengali: A Linguistic Study/দ্র. ঘোষাল ছন্দা/ঝাড়খন্ডী বাংলার ঝাড়গাঁয়ী রূপ/লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতিকেন্দ্র/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/২০০৪/পৃষ্ঠা-৪৮।

২৩. তদেব/পৃষ্ঠা-৪৯।

২৪. Contai dialect of South Western Bengali/S.K.Karan-B.P.S.C (1967)/Vol.–II/দ্র. দাস, দোলগোবিন্দ/ কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার রূপ ও রীতি/কাঁথি/পূর্ব মেদিনীপুর/১৪০১/পৃষ্ঠা-১২।

২৫. সাহা, ধীরেন্দ্রনাথ/ভাষাতত্ত্ব ও ভারতীয় আর্যভাষা/ দ্র. দাস, দোলগোবিন্দ/ কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার রূপ ও রীতি/কাঁথি/পূর্ব মেদিনীপুর/১৪০১/পৃষ্ঠা-১২।

২৬. দাস, দোলগোবিন্দ/ কাঁথি মহকুমার কথ্য ভাষার রূপ ও রীতি/কাঁথি/পূর্ব মেদিনীপুর/১৪০১/পৃষ্ঠা-১৩।

লেখক পরিচিতি: ড. দীপক সোম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নাড়াজোল রাজ কলেজের বাংলা বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। দীর্ঘ বারো বছরেরও অধিককাল ধরে তিনি অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। নাটক এবং লোকসংস্কৃতি— এই দুই-ই তাঁর আগ্রহের বিষয়। ড. সোম পূর্ব মেদিনীপুর উপকূলবর্তী জেলে সম্প্রদায়ের উপর গবেষণা করে ২০১৭ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বহু পত্র-পত্রিকায় তাঁর নানান লেখালেখি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *