দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ভাষার সংকট: প্রেক্ষিত ও নানান মাত্রা – শুভাশিস আচার্য

দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ভাষার সংকট: প্রেক্ষিত ও নানান মাত্রা – শুভাশিস আচার্য

সচল সমাজভাষাবিজ্ঞান থেকে আমরা জেনেছি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক (socio-political aspects) প্রেক্ষিত কীভাবে ভাষার স্বরূপকে পরিবর্তিত করে। ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির সংযোগে রচিত হয় দ্বিভাষিকতা (Bi-lingualism), বহুভাষিকতা (Multi-lingualism); সূচিত হয় ভাষা সরণ (Language shifting), ভাষা মৃত্যু (Language Death), ভাষা নিধন (Language Jenocide) এর মত বিষয়গুলি। বিশেষত কোন ভাষার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তুলনায় প্রান্তিক অঞ্চলে (প্রান্তিক কথাটি এক্ষেত্রে সীমান্ত অঞ্চলের অর্থ বাহক) এই ভাষা সংযোগ ও সংকটের ছবিটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনসমাজকে সামাজিক কিংবা আর্থিক কারণে নিজের ভাষা সংস্কৃতির পাশাপাশি ওপারের ভাষা সংস্কৃতিকেও আয়ত্ত করতে হয়। অবশ্য এই আয়ত্তীকরণ কোন ক্ষেত্রে দীর্ঘ সামাজিক পরম্পরায় সহজাতভাবে, আবার কোন স্থানে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের চাপে ঘটে চলেছে। কখনোবা দীর্ঘকাল একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমাজের মধ্যে দৈশিক বিভাগ/গণ্ডী টানতে গিয়েও এসমস্যা উদ্ভূত হয়ে ওঠে। একই ভাষাভাষী মানুষ তখন জাতি সূত্রে কিংবা দেশীয় সূত্রে দুটি ভিন্ন ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে ‘দোঁহাপানে চেয়ে রয়’ মাত্র। এইরূপ এক সংকটের ছবি পরিলক্ষিত হয় বাংলার অখণ্ড মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে বহুকাল ধরে প্রচলিত ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে।

সীমান্ত অঞ্চলের এই ভাষা সমস্যার আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই জানতে হয় সীমান্তের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিবর্তনের ধারাটি। বর্তমানে পূর্ব, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার অংশবিশেষ নিয়ে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত গঠিত। আর সমান্তরালভাবে ওপারে রয়েছে উড়িষ্যার বালেশ্বর ও ময়ূরভঞ্জ জেলা। কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে এই রেখা ঠিক এইরূপে ছিল না। সে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ইতিহাস বহু বিস্তৃত আলোচনার সাপেক্ষ। প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেই ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা টানা হল মাত্র।

মহাভারতের আদিপর্বে বঙ্গ, সুম্ভ, কলিঙ্গ, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি জনপদের নামোল্লেখ ও অবস্থান দেখে বোঝা যায় এগুলি ছিল পরস্পরের সন্নিকটবর্তী। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে অশোকের অনুশাসনে বঙ্গের নামোল্লেখ নেই কিন্তু কলিঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। আসলে সেখানে ‘কলিঙ্গ বঙ্গভূমির দূর প্রতিবেশী নয়। সেকালে দুটি দেশের ভাষা ও লোক ব্যবহার একরকম ছিল বলে মনে হয়।’১ তবে বর্তমান উড়িষ্যার কলিঙ্গ ও উৎকল সেকালে পৃথক দুটি রাজ্য ছিল। কটকের দক্ষিণ থেকে গঞ্জাম পর্যন্ত কলিঙ্গ আর ‘কাঁসাই নদীর ওপারে পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন উত্তর উড়িষ্যার অংশ সেকালে উৎকল নামে খ্যাত ছিল’।২ এই উৎকলকেই ফাহিয়েন, হিউয়েন সাংরা ‘ওড্ড’ বা ‘ওড্র’ দেশ নামে আখ্যায়িত করেছেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে রচিত ‘রঘুবংশম্’-এও এইরূপ ভূভাগের উল্লেখ রয়েছে।

আবার ‘আচারঙ্গ’ জৈনশাস্ত্রে দক্ষিণ-পশ্চিমবাংলার মেদিনীপুর সন্নিহিত অঞ্চল ‘সুম্ভ’ নামে পরিচিত ছিল। যার প্রধান নগরী—ভূরীশ্রেষ্ঠ ও বন্দর তাম্রলিপ্ত। আবার গুপ্ত যুগের শেষ পর্ব হতে( খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক) খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত ও উত্তর উড়িষ্যার বেশিরভাগ অংশ ‘দণ্ডভুক্তি’ (বর্তমান নাম দাঁতন-র)অন্তর্গত ছিল। সমকালে ওড়িষ্যাও ছিল নানান মণ্ডলে বিভক্ত এবং স্বতন্ত্র রাজাদের দ্বারা শাসিত।দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্তী ছিল উড়িষ্যার দুটি মণ্ডল—বোনাই (Bonai) ও খিজিঙ্গ মণ্ডল (Khijjinga-Kotta)। বর্তমান বালেশ্বর ও ময়ূরভঞ্জ জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল ছিল এই দুই মণ্ডলান্তর্গত। বোনাইর শাসক ময়ূর রাজারা মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত শাসন করতেন এবং কথিত আছে তমলুকের ‘ময়ূরধ্বজ’ রাজপরিবার এই বোনাই থেকে গিয়ে রাজত্ব করেন। এ বিষয়ে “W. W. Hunter has proved that there was an intimate link between the ruling families off Mayurbhanj and Tamralipti… mayura family of bonai  migrated to Tarmaliptai. There they established their rule and were later on defeated by the Bhanja King of Mayurbhanj.”

খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত (১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ) মেদিনীপুরের বেশিরভাগ অংশই উড়িষ্যার কেশরী, গঙ্গ, সূর্যবংশীয় রাজাদের অধীনস্থ ছিল। সে বিস্তৃত ইতিহাস এক্ষেত্রে অনালোচ্য বিষয়। শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে ‘মাদলাপঞ্জী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় উড়িষ্যার শাসনতান্ত্রিক বিভাগের ৩১টি দণ্ডপাটের ৬টি দণ্ডপাট ছিল মেদিনীপুরের বিভিন্ন অংশকে নিয়ে। আর এই শাসনের সূত্র ধরে মেদিনীপুর অঞ্চলে ওড়িয়া ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব সূচিত হতে থাকে। বিনয় ঘোষ যথার্থ জানিয়েছেন—

‘আনুমানিক পাঁচশ বছর ধরে ক্রমাগত ঐতিহাসিক উত্থান-পতনের আঘাত পেয়ে মেদিনীপুরের দক্ষিণাঞ্চলের এই অংশে কোন পরিকল্পিত সংস্কৃতিসৌধ ভিত্তি থেকে চূডা পর্যন্ত সুশৃঙ্খল ধারায় গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি।… তার মধ্যে উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় ও পরবর্তী রাজারা এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে প্রায় একচ্ছত্র প্রভুত্ব করেছেন।… রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যাদের অখণ্ড প্রতিপত্তি ছিল, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও যে তারা নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব কায়েম করবেন তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। উড়িষ্যার সাংস্কৃতিক প্রভাব এই অঞ্চলেও তাই খুব বেশি দেখা যায়’।৪

এরপর থেকে (১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দ) সীমান্তের রাজনীতিতে উল্টো স্রোত বইতে থাকে। সুলেমান কররানী উড়িষ্যার রাজাকে পরাজিত করে মেদিনীপুর সহ উড়িষ্যার বিস্তৃত অংশ বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর মোগল এবং পরবর্তীতে (অষ্টাদশ শতকে) মুর্শিদাবাদের নবাবরা বিশেষত আলিবর্দী খাঁ কটক পর্যন্ত বাংলার সীমাকে বজায় রাখার চেষ্টা করেন। যদিও বেশ কিছু সময় মারাঠা বর্গীরা উড়িষ্যাসহ মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমের বেশিরভাগ অংশ তাদের অধীনে রেখেছিল (১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত); তবে সে লুঠেরা জাতির সাংস্কৃতিক প্রভাব এ অঞ্চলে খুবই কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ষোড়শ শতক থেকে  বাংলার অধীন উড়িষ্যাতে উপর বাঙালি অধিবাসীদের অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিশেষত শাহ্ সুজার রাজত্ব (১৬৩৯
 – ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ) কালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে একটি সুবার মধ্যে আনা হয় এবং তারপর থেকে ইংরেজ আমলের অনেকটা সময় পর্যন্ত ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ ও বালেশ্বর জেলার বেশিরভাগ অঞ্চলকে মেদিনীপুরের সঙ্গে যুক্ত করা ছিল।

১৭৬৫ – ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কয়েক ধাপে সমগ্র উড়িষ্যা ইংরেজদের অধিকারে আসে এবং শাসনের সুবিধার্থে উড়িষ্যাকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক কারণে উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির বেশ আধিপত্য ঘটতে থাকে উড়িষ্যায়। কারণ নবাবী আমল থেকে সুদক্ষ বাংলার বুদ্ধিমান প্রশাসকদের উড়িষ্যার বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ করা হতে থাকে। ইংরেজ কোম্পানির আমলে এই ধারা আরো ব্যাপকতর হয়। উড়িষ্যার কোর্ট এবং স্কুলে ওড়িয়া ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি ওঠে। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘The sadar board of Revenue proposed to substitute Bengali for Oriya as the language of government and business in Orissa’৫ এবং ১৮৪৮ কটকের কালেক্টর কমিশনারকে জানিয়েছিলেন ‘Oriya should Cease to exist as a separate language’৬ যদিও কমিশনার Golds burry এসব দাবি খারিজ করে দেন। তবু ওড়িয়া ভাষাকে মুছে ফেলে তার স্থানে বাংলাকে প্রতিস্থাপিত করার এক চক্রান্ত অনবরত চলতে থাকে। বিশেষত ১৮৬৮-১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পণ্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র, কান্তিলাল ভট্টাচার্যরা বারংবার দাবি করতে থাকেন বাংলা প্রচলনের। তাঁদের যুক্তি— ‘Oriya is not a separate language… Oriya was a mere dialect of Bengali’৭। ভাবলে অবাক লাগে, যে ওড়িয়া প্রায় ৬০০ বছর আগে বাংলা থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ভাষা ও লিপিরূপে বিকশিত হয়েছিল, রাজেন্দ্রলাল মিত্ররা রাজনৈতিক স্বার্থে তার স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করলেন না। উপরন্তু দাবি করলেন যে তা বাংলার এক উপভাষা মাত্র। জন বীমস্ কিন্তু এই ভ্রান্ত ধারণার প্রতিবাদ করেছিলেন। আসলে এই ভাবেই বহু দেশে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ভাষা নিধন (Language Jenocide) ঘটে। ওড়িয়ার ক্ষেত্রেও তাই ঘটত, যদি না সেই সময় বেশিরভাগ ওড়িয়াবাসী এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন। তাদের একের পর এক সমবেত আন্দোলনে এসব প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।

বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে মুক্তি ও ওড়িয়া ভাষাভাষীর ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের দাবি ওঠে বারংবার। সেক্ষেত্রে তমলুকসহ মেদিনীপুরকে উড়িষ্যার মধ্যে সংযুক্ত করার দাবি ছিল প্রবল। কারণ বহু শতক ধরে এই অঞ্চল গুলিতে প্রচুর অভিবাসিত ওড়িয়ারা বসবাস করে চলেছে এবং তাদের মাতৃভাষা তখনো ওড়িয়াই ছিল। অবশেষে মন্টেগুর রিপোর্ট অনুসারে ব্রিটিশরা বাংলা থেকে পৃথক করে ‘বিহার ও উড়িষ্যা’ প্রোভিন্স ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গঠন করে। কিন্তু মেদিনীপুরের এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে দেওয়া হল না নতুন প্রোভিন্সের সঙ্গে। ফলে মেদিনীপুরের বহু মানুষ ওড়িয়া ভাষাভাষী হলেও অধিবাসী হিসেবে হয়ে রইল বাঙালি। তবু উড়িষ্যাবাসীরা হাল ছাড়েনি। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে যখন তারা পুনরায় ইউনাইটেড স্টেট রূপে উড়িষ্যার দাবি তোলে তখনো তারা দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরকে (কাঁথি মহাকুমা, কেশপুর, দাঁতন, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম ও নারায়ণগড় থানা) উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানায়। কিন্তু তৎকালীন বাংলার সরকার সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। আর যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় মেদিনীপুরবাসীরা যে ভাষা ব্যবহার করে তা পুরোপুরি ওড়িয়া নয় ওড়িয়া ও বাংলার এক মিশ্র রূপ। ‘The Government of bangal rejected the possibility of any transfer because to them the in habitants were strongly against the proposed transfer and the language of the inhabitants was a mixture of Bengali and Oriya considerably different from the language of Oriyas’৮ অবশেষে ৬টি জেলা নিয়ে ১৯৩৬ এর পয়লা এপ্রিল যখন ওড়িয়া ভাষাকেন্দ্রিক স্বতন্ত্র উড়িষ্যা রাজ্য গঠিত হলো তখন কোনোভাবেই মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ উড়িষ্যায় যুক্ত হলো না। সীমান্তের ওপারে রইল বালেশ্বর আর এপারে রইল বাংলার মেদিনীপুর।

বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের এই ভাঙ্গা-গড়ার দীর্ঘ ইতিহাস থেকে দুটি বিপরীত ধারায় ভাষা সরণের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম পর্বে ওড়িয়া জাতির শাসনের সূত্র ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তৃত ভূখণ্ডে ওড়িয়া ভাষার ক্রমপ্রচলন ঘটে। আবার পরবর্তীকালে বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত উড়িষ্যায় বাংলা ভাষা প্রচলন ও বিস্তারের প্রচেষ্টা চলে। এর ফলে সীমান্ত সংলগ্ন মেদিনীপুরের ওড়িয়া বাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত এক সংকট তৈরি হয় ধীরে ধীরে। কারণ অধিবাসী সূত্রে তারা বর্তমানে বাঙালি হলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা ভাষা ও জাতিতে ওড়িয়া। কিন্তু বাংলা ভূখণ্ডে থাকার সূত্রে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে তাদের মৌখিক ওড়িয়া ভাষার স্বরূপ ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। বহু পূর্বে উড়িষ্যা থেকে আগত ব্রাহ্মণ, করণ, রাজু প্রকৃতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজনের ওড়িয়া ভাষা ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে ও দক্ষিণ পশ্চিমা বাংলা (সুম্ভক বাংলা) ঝাড়খন্ডী বাংলার প্রভাবে  পরিবর্তিত হতে থাকে এবং তা এক পৃথক ভাষারূপ গড়ে তোলে। এই ভাষাকে ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ভাষা বলে চিহ্নিত করা চলে। ‘দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি’ গ্রন্থে ড. বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি এই ভাষাকে ‘উত্তরা ওড়িয়া উপভাষা’
৯ (যেহেতু উত্তর উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার সঙ্গে এই অঞ্চলের প্রাচীন সংযোগ ও ভাষাগত মিল রয়েছে) বলে চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য এ নাম বিশেষ বিবেচনার অপেক্ষা রাখে।

প্রসঙ্গত এই ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ভাষার স্বরূপ সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় আলোচনা একান্ত জরুরী; যার মাধ্যমে এই ভাষার সংকটের ছবিটা আরো স্পষ্ট হবে। অখণ্ড মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রচলিত এই ভাষাকে দুটি বিভাষা অঞ্চলে ভাগ করা যেতে পারে। ১) মোহনপুরী ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ২) কাঁথির  ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা।
 এই ভেদের প্রধান কারণ হল উড়িষ্যা সংলগ্ন এই আঞ্চলিক বাংলায় ওড়িয়া প্রভাব সব ক্ষেত্রে সমান নয়। রামনগর, মোহনপুর, দাঁতন, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, উড়িষ্যা লাগোয়া হওয়ায় ওড়িয়া ভাষার প্রভাব বেশি। আর কাঁথির ১ ও ২ নং ব্লক, এগরা মহাকুমার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, পটাশপুরের দক্ষিণাংশ সীমান্ত থেকে দূরবর্তী হওয়ায় ওড়িয়া প্রভাব কিছুটা কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এইরূপ বিভাজনের ক্ষেত্রে জেলার ভৌগোলিক সীমারেখাকে নির্দিষ্ট করে ধরা হয়নি, ভাষাগত সাধর্ম্য লক্ষ্য করে এইরূপ বিভাজন করা হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে দুটি বিভাষার নমুনা দিলে ওড়িয়ার প্রভাব কোথায় কতখানি তা বোঝা যাবে। যেমন—

১) আমি যাবোনা। (বাংলা)

মুঁ য়িবিনি। (ওড়িয়া)

মু য়িমিনি। (মোহনপুরী ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা)

আমে যিবানি। (কাঁথির ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা)

২) আমি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। (বাংলা)

আম্ভে(গৌরবার্থে)আপণঙ্কু স্বাগত্ জাণুছি। (ওড়িয়া)

মু তুমকু স্বাগত জাণুচি। (মোহনপুরী ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা)

আমে তুমকু স্বাগত জাণাউচে। (কাঁথির ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা)

ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক দিকের বিস্তৃত ব্যাখ্যা এখানে অনাবশ্যক বলে শুধু বাক্যিক রূপের দিকটি  উল্লিখিত হল। এখান থেকে সহজেই বোঝা যায় সীমান্ত সংলগ্ন মোহনপুরী বিভাষায় সর্বনাম ও ক্রিয়ারূপের ক্ষেত্রে উড়িয়া প্রভাব যতটা বেশি, কাঁথির বিভাষায় সে প্রভাব অনেক কম। বরং মান্য বাংলার দিকে তার ঝোঁক বেশি। যদিও ওড়িযার সব চিহ্ন তার দেহ থেকে এখনো সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। আর ওড়িয়া ও বাংলার এই মিশ্র রূপকে লক্ষ্য করে গ্রীয়ার্সন মেদিনীপুরের ভাষাকে ‘Mechanical mixture of corrupt bengali and corrupt oriya’
১০ বলে দাবী করেছিলেন এবং মানুষের ভাষাব্যবহারের ধরণ নিয়ে সরসমন্তব্য করেছিলেন— ‘A man will begin a sentence in Oriya, drop into Bengali in his middle and go back to Oriya its end’।১১ তবে তাঁর ‘Mechanical mixture’ কথাটি আপত্তিজনক। কারণ যে দুটি ভাষা একই মাতৃগর্ভজাত এবং দীর্ঘকাল যারা সহোদর ভাবে সহাবস্থান করেছে আজ রাজনৈতিক কারণে তাদের পৃথক করা হলেও সাধর্ম্য বা স্বলক্ষণ সহজে মোছার নয়। তাই দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরের এই ভাষারূপ বহু শতক ধরে এক সহজাত ভাবে গড়ে উঠেছে।

তবে কাঁথির ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা ভাষারূপ যে দক্ষিণ-পশ্চিমা বাংলা তথা মান্য বাংলার প্রভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে সে কথা সহজেই বলা চলে। বিশেষত ব্রিটিশ আমল থেকে কাঁথি মহাকুমা বাংলা শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান হয়ে ওঠে। রাজনীতির সূত্রে সেকালের রাজধানী কলকাতার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগ সাধিত হয়। বিশেষত কাঁথির ভূমিপুত্র দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ কলকাতার অন্যতম কংগ্রেস নেতা ও ল-ইয়ার; তিনি কাঁথির উন্নতি কল্পে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। ফলে নতুন নগরায়ণের জোয়ারে, কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এইসব  অঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে মান্য বাংলার  দিকে ঝুঁকতে থাকে। তাছাড়া স্কুল-কলেজের ক্রমপ্রসারে তরুণ প্রজন্ম আঞ্চলিক ভাষার থেকে এই মান্য বাংলাকে বেশি করে গ্রহণ করতে থাকে। শুধু ঘরোয়া পরিবেশে ছাড়া সকল ক্ষেত্রেই মান্য বাংলার ব্যবহারিক প্রসার ঘটে। আর স্থানীয় মানুষের মৌখিক ভাষাও (ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা) মান্য বাংলার প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে নতুন রূপ লাভ করতে থাকে।

কিন্তু এই আঞ্চলিক ভাষার রূপও ক্রমশ ক্ষীণ হতে শুরু করেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর এখন সারা ভারতের কাছে বিখ্যাত দুটি কারণে— প্রথমত: পর্যটনস্থল, দ্বিতীয়ত: মৎসবন্দর। বিশেষত কাঁথির দীঘা, শঙ্করপুর, পেটুয়াঘাট, জুনপুট এমনকি উড়িষ্যার তালসারি এখন এই দুই কারণে প্রায় উন্নতির শিখরে লাফিয়ে চলেছে। আর সেই সূত্রে স্থানীয় মানুষজন এবং নবপ্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে মান্য বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষাতে। যার দ্বারা রুটি রোজগারের পথ খুব সুগম। কারণ ভাষাগত সমস্যা ব্যবসায়িক বা বহিঃসংযোগের ক্ষেত্রে বহু অন্তরায় সৃষ্টি করে।

এর পাশাপাশি আর একটি বিষয়ও ওড়িয়া প্রভাবিত আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারকে কোণঠাসা করে তুলেছে। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রতি একটা উন্নাসিকতা প্রদর্শন করে চলেছে। বাংলার মানুষের ওড়িয়া ব্যবহারে তারা সুপ্রসন্ন নন। এমনকি স্কুলের শহুরে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের আঞ্চলিক ওড়িয়া ভাষা ব্যবহার কিংবা উচ্চারণজনিত প্রভাবকে তীব্রভাবে ব্যাঙ্গ করে থাকেন। কেউ কেউ তাদের ‘উড়িয়া’ ‘উড়ে’বলে বিদ্রুপও করেন। এ অভিজ্ঞতা প্রবন্ধ-লেখকের একেবারে বাস্তব প্রসূত। কারণ চাকুরীর সূত্রে লেখককে বেশ কিছুদিন উড়িষ্যার সীমান্ত সংলগ্ন একটি স্কুলে কাজ করতে হয়েছিল। ছাত্রদের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা বলার পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে বহুবার শহুরে শিক্ষকদের সঙ্গে বাগ-বিতণ্ডায় জড়াতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি বহু স্থানীয় আঞ্চলিক ওড়িয়াভাষী শিক্ষকরা স্টাফ রুমে ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা কালে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শহুরে শিক্ষিতদের নিকট সম্মান খোয়া যাওয়ার ভয়ে কোথাও নিজের ভাষাকে গুটিয়ে নেন আর মান্য বাংলা বলতে বাধ্য হন।

রবীন্দ্রনাথ একদা লোকসাহিত্য চর্চায় হাত দিতে গিয়ে বুঝেছিলেন লোকভাষা ও লোকসংস্কৃতির উপাদান সমাজের এত নিম্নস্তরে নেমে গেছে যে তাদের পুনরুদ্ধার করা খুব সহজ নয়। বর্তমান ক্ষেত্রে সে কথা আরও বেশি সত্য। কারণ আধুনিক Globalization এর প্রভাব ভাষার রূপ ও ব্যবহারকে করে তুলেছে অনেক বিকৃত। ভাষার মধ্যে ইংরেজি, হিন্দির মাত্রাছাড়া ব্যবহার মানুষের আঞ্চলিক ভাষিক রূপকে সংকুচিত করে চলেছে। ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলার ক্ষেত্রে এসব সমস্যা তো আছেই, তার পাশাপাশি শিক্ষিত বাঙালিদের এই ভাষার প্রতি প্রবল উন্নাসিকতা, অর্থকরী শিক্ষার প্রসার, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্রমবিস্তার এইসব অঞ্চলের মানুষদের মান্য বাংলার প্রতি প্রবল ঝোঁক বাড়িয়ে দিয়েছে। এই আগ্রাসনের কবল থেকে রক্ষা করতে না পারলে ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলায় আঞ্চলিক রূপও খুঁজে পাওয়া দুর্লভ হবে। এক্ষেত্রে ভাষা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে স্থানীয় শিক্ষিত সমাজকে। বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার ওড়িয়া ব্রাহ্মণ, করণ, রাজু প্রভৃতি সম্প্রদায়কে (কারণ এদের মৌখিক ভাষাই হল ওড়িয়া প্রভাবিত বাংলা) নিজেদের সমাজ-পরিবেশে এ ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী হতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে মান্য বাংলার ব্যবহার যেমন আবশ্যক, তেমনি আঞ্চলিক সমাজ ও সংস্কৃতিতে নিজের আঞ্চলিক ভাষার রূপকে রক্ষা করাও অন্যতম কর্তব্য। কারণ আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্য নিয়েই তো একটি ভাষার সামগ্রিক রূপ। এই সমস্ত আঞ্চলিক রূপ রক্ষিত না হলে কথ্য বাংলা ভাষার ঔপভাষিকবৈচিত্র্য লুপ্ত হবে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে ভাষাকেন্দ্রিক সমাজ তথা জাতির ভাঙা-গড়ার ইতিহাস।

তথ্যসূত্র:

১. সেন, সুকুমার: বঙ্গভূমিকা: ইস্টার্ন পাবলিশার্স: ১৯৭৪: পৃ- ১৪৬।

২. সেন, সুকুমার: বঙ্গভূমিকা: ইস্টার্ন পাবলিশার্স: ১৯৭৪: পৃ – ৫।

৩. Ray, Ram kamal: Feudetory States of Medieval Orissa: Amadeus Press: 2004: page-112।

৪. ঘোষ, বিনয়: পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি: দ্বিতীয় খণ্ড: প্রকাশভবন: প্র: সং-১৯৮০: পৃ-১২৮।

৫. De,S.C: Trend of political event in orissa, Introduction: P.K. Jena: Orissa-A New Province: Punthi- Pustak: calcutta: 1988: page-15।

৬. De, S.C: Trend of political event in orissa, Introduction: P.K Jena: Orissa-A New Province: Punthi-Pustak: calcutta: 1988: Page-15।

৭. P. K Jena: Orissa-A New Province: Punthi-Pustak: calcata: 1988: page-16।

৮. P. K Jena: Orissa-A New Province: Punthi-Pustak: calcata: 1988: Page-41।

৯. মাইতি, বঙ্কিমচন্দ্র: দক্ষিণ–পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি: বিদিশা প্রকাশনী: নারায়ণগড় মেদিনীপুর: ১৩৯৭: পৃষ্ঠা-৭৬।

১০. Grierson, G. A.: Linguistic Survey of India: Vol-v: Part-lll: New Delhi: P-369।

১১. Grierson, G. A: Linguistic Survey of India: Vol-v: Part-lll: New Delhi: P-369।

লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক; ঝাড়গ্ৰাম রাজ কলেজ (গার্লস’ উইং)।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অধ্যাপক ড. নিরুপম আচার্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক ও গবেষক হিসেবে ইতিমধ্যে নজর কেড়েছেন। প্রায় দুই দশক জুড়ে অধ্যাপক হিসেবে যেমন তিনি অধ্যাপনা করেছেন, তেমনি লিখেছেন অনেক মূল্যবান গ্রন্থ। ভাষাতত্ব, সাহিত্যতত্ব, চরিতসাহিত্য, রবীন্দ্রসাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা। সম্পাদনা করেছেন ‘কলাবতী’ সাহিত্য পত্রিকা।বর্তমানে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে ই-ম্যাগাজিন ‘সৃষ্টির নানাকথা’। এর পাশাপাশি যোগ্যতার সাথে তিনি পরিচালনা করে চলেছেন সেমিনার। বর্তমান প্রস্তুত গ্রন্থটি তারই ফসল। মাতৃভাষা বাঙলার বিপন্নতার কথা বাঁধা পড়েছে কালো অক্ষরে। যার ভেতর থেকে পাঠক খুঁজে পাবেন নানা তথ্য ও সত্য ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *