তরকারি থেকে সবজি: সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বাংলা ভাষা ও বাঙালি – সঙ্ঘমিত্রা দাস
সংস্কৃতির পরিসরটি বিচিত্র ও ব্যাপক। চলন তার বহুমাত্রিক। সংস্কৃতির সার্বিক জীবনচর্যায় ‘ক্ষমতা’, ‘আধিপত্য’, ‘স্বাধীনতার অধিকার’ এইরকম নানাবিধ ধারণা ক্রিয়াশীল। ক্ষমতা ও আধিপত্যের অধিকার মানুষের এক চিরন্তন চাওয়া। ছোট পরিসর থেকে বড়— সর্বত্রই এই অধিকার লাভের জন্য মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা। আধিপত্যের ধারণা সময়ের সাথে পালটায়। পালটেছে। বর্তমান সময়েও এর বহুধা বিস্তৃত প্যাটার্নটি একটু লক্ষ করলেই স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
সংস্কৃতির আঙিনায় ভাষা চিরকালই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। যদিও, সংস্কৃতির চর্চা করতে বসে যদি অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, ভাষা গড়ে ওঠার আগের সময়পর্বেও আধিপত্যের জায়গাটি নিজস্ব মাত্রাতেই ক্রিয়াশীল ছিল। স্বাভাবিকভাবেই, সংস্কৃতির পরিসরও এর চিহ্নগুলিকে বহন করে। অন্যদিকে, সংস্কৃতির বিবর্তনের সঙ্গে স্বাধীনতার ধারণাটিও সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। এই স্বাধীনতার সূত্র ধরে সংস্কৃতির বহুত্ববাদের তত্ত্বটিও সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহণ করে। এই সাংস্কৃতিক বহুত্বের ধারণারই একটি মাত্রায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকড়টি প্রোথিত হয়ে থাকে এবং সংস্কৃতির সার্বিক চলনে এই আগ্রাসন ক্রমে তার স্বরূপটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। সেখানেই তৈরি হয় সংকট। মানুষ কী খাবে, কী পড়বে, কীভাবে বাঁচবে— এই প্রাথমিক প্রশ্নগুলিতেই সেই সংকট এর বীজ সুপ্ত থাকে। এইগুলোর ক্ষেত্রে সে পুরনো রাস্তাতেই থাকবে নাকি নতুনের পথটি ধরবে এই নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। এইখানেই ফের ফিরে আসে সংস্কৃতির বহুত্বের প্রসঙ্গটি। স্বাধীনতার প্রেক্ষিত বহুত্ববাদের ধারণাটিকে একদিকে পুষ্ট করে। অন্যদিকে এর একটা বিরোধিতার জায়গাও নিশ্চিতভাবে তৈরি হতে থাকে, যার বহুকৌণিক চলনে আগ্রাসন এর পরিসরটি নির্মিত হয়। ক্ষমতা আর আধিপত্যের মতো বিষয়গুলি পর্দার আড়াল থেকে সেই কাঠামোয় মাটি দেয়।
একটু সহজ করে ভাবা যাক। একজন মানুষ তার ঐতিহ্য অনুসারে ধরে নেওয়া যাক মাটির বাড়িতে থাকেন। এই মানুষটি যদি প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আরামদায়ক একটি বাড়ি তৈরি করেন এবং সেখানে বসবাস করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন তাহলে সেটাকে একটি সদর্থক মাত্রায় দেখলে কি খুব ভুল হবে? অন্যদিক থেকে দেখলে, এই বিষয়টি ঐতিহ্য থেকে সরে আসা হিসেবে পরিগণিত হবে, এবং এর চূড়ান্ত একটি সিদ্ধান্ত এটা হতে পারে যে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে মাটির বাড়ি— তার কোন চিহ্নই আর থাকবে না। বিষয়টি আদতে এতটা সরল নয়।
বীরভূম, বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ার অধিবাসী সাঁওতাল জনজাতির বাড়িগুলির বাইরের দেওয়ালে নানা রঙের ব্যবহার বহুদিন ধরেই চলে আসছে। বাড়িতে থাকে নানারকম আলপনা এবং ছবি ও। বেশ কিছু বছর আগেও এইখানে ব্যবহৃত রঙগুলি ছিলো পুরোপুরি প্রাকৃতিক। বর্তমানে বহু জায়গাতেই রাসায়নিক রঙের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি ঐতিহ্য থেকে সরে আসা। এই নিয়ে শহুরে শৌখিন বিলাপের বাইরে গিয়ে বিষয়টিকে দেখা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে রঙের থেকেও বেশি জরুরি বোধহয় এইরকমটা কেন হলো তার কারণ অনুসন্ধান করা। কী দিয়ে আঁকছেন— এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সেখানে কি আঁকছেন। উত্তরটি অবশ্যই জটিল ও বহুমাত্রিক। আলপনা বা ছবির মোটিফগুলিও কোথাও কোথাও পালটে যাচ্ছে। যেখানে পালটে যাচ্ছে সেখানে আমাদের ভেবে দেখতে হবে সংস্কৃতি তথা জীবনচর্যার কোন বাঁকে এসে পড়েছেন আজ তাঁরা। তাঁদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থানটি বিশ্লেষণ করলে হয়তো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বরূপটি বোঝা যেতে পারে। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন মনে আসে। বিশ্বব্যাপী যে পরিবর্তনের জোয়ার সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এঁরা কি তাঁদের যাপনে সেই পরিবর্তনকে এড়িয়ে থাকবেন? থাকা সম্ভব? তাঁরা কি জাগতিক বাসনা কামনার উর্দ্ধে কোনো সাজিয়ে তোলা চিত্রনাট্যের কুশীলব?
অতএব সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে মেনে চলা হবে নাকি তার চিরাচরিত পরিসর থেকে বেরিয়ে জীবন ও যাপনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক করে তোলা হবে এটা একটা মৌল প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
এখানে আরো একটি কথা এসে যায় ঐতিহ্য ও তার অনুগমন প্রসঙ্গে। এই ঐতিহ্য কী আদৌ ব্যক্তির নিজস্ব? ক্ষমতা, আধিপত্য ইত্যাদি কী বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল নয় এই ধারণাগুলি নির্মানের ক্ষেত্রে? বহুযুগের বহু যন্ত্রনা আর মনুষ্যত্বের অনেক অপমান আর বঞ্চনার বেদনা কি নিহিত নেই সেখানে? নতুনের অনুগমনেই কি লেখা হয়নি মানুষের জয়যাত্রার ইতিহাস?
এই সংশয়টিই আদতে সংকট।
এই প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রসঙ্গটি আলোচনা করা যেতে পারে। প্রতিটি ভাষাই অন্য ভাষার শব্দকে নিয়ে থাকে। নিজেকে সমৃদ্ধও করে। বাংলা ভাষাও তার নিজ বৈশিষ্ট্যে বহু ভাষার শব্দকে ধারণ করেছে এবং তার ভাষা-ভুবনকে ব্যাপ্ত করেছে। যেক্ষেত্রে তা জীবন ও যাপনের সঙ্গে মিলে মিশে যায় সেখানে ঘটে আত্তীকরণ। খুব পরিচিত উদাহরণ বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রে টেবিল, চেয়ার, ফোন ইত্যাদি। জীবনের নিয়ম মেনেই, ভাষার শরীর, পালটে যাওয়া সময়ের চিহ্নকে ধারণ করে এই শব্দগুলির মাধ্যমে। খুব আদেখলেপনা বাড়াবাড়ি ছাড়া এই বিষয়টি মোটের উপর সমস্যাজনক নয়।
সমস্যা ভঙ্গিমাটির।
আজকাল বন্ধুরা অনেকেই বলেন “আমার লাগছে কি আজ বর্ষা হবে।” (আমার মনে হয়/হচ্ছে আজ বৃষ্টি হবে)।
অন্য ভাষার চলনটি এখানে স্পষ্ট। এটি আগ্রাসন। আমার কাছে। ঠিক এভাবেই বাঙালির হেঁসেলে আজ আর তরকারি রান্না হয়না, সবজি বানানো হয়।
কিন্তু এহো বাহ্য। সংকটটি আরো একটু গভীরে।
এরকমভাবে অনেকেই কথা বলেন আজকাল। বাংলা সিরিয়াল থেকে ওয়েব সিরিজ— প্রায় সবখানেই বাঙালি চরিত্রেরা যে ভাবে কথা বলেন তা দেখে প্রথম চোটে হাসি পেলেও যখন দেখি আমার পরিবারের এই প্রজন্ম এভাবেই কথা বলছেন, তখন সেই হাসি ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায় নিমেষে। এফ এম রেডিওর সঞ্চালকদের একাংশও এই ধারাটিকে সোৎসাহে বহন করে চলেছেন। না বাংলা- না হিন্দি- না ইংরেজি কোন ভাষাই আজ আর তার অবিমিশ্র বংশ কৌলিণ্য রক্ষা করতে পারছে না। গণমাধ্যমকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা সকলেই আজ শিক্ষা ব্যাপারটিকেই গুলিয়ে ফেলেছি। ভাষা ব্যবহারে তার কিছুটা প্রকাশ পাচ্ছে মাত্র। কিছুই শিখছি না আসলে আমরা। বাংলা শুধু নয় হিন্দি বা ইংরেজি ও আমরা শিখছি না। তা নিয়ে আমাদের লজ্জাও নেই। কারণ আজ পেশিশক্তি হৃদয় ও মেধার স্থানটি প্রতিস্থাপনে উঠে পড়ে লেগেছে। এটি শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বের সংকটকাল। সভ্যতার সংকট। বাঙালির সংকট আরো একটু বিচিত্র। বর্তমান ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পটপ্রেক্ষায় এই সংকটে আরো দু-একটি মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
বেশ কিছু জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার যেখানে ‘বাঙালি’ বলতে যা বোঝানো হয় সেটা গভীরভাবে ভাবলে খুব চিন্তার। বাঙালি পুরুষ মানে কোঁচানো ধুতি আর চশমা আর বাঙালি মেয়ে মানে লাল পাড় শাড়ি, শাঁখা-পলা, লাল সিঁদূর আর টিপ। এবং তারা সকলেই ‘করতা-খাতা-যাতা’ মার্কা ভয়ানক হিন্দি বলেন। হাস্যকর নিঃসন্দেহে। এটা নিয়ে বাঙালিও হাসেন। নিজেকে নিয়ে মশকরা হল সেরার সেরা হাসি— হিউমার। বাঙালির শিব থেকে শিব্রাম, এ বিষয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে হিউমারিস্ট। কিন্তু এই হাস্যকরতাকে পেরিয়ে গেলে যা থাকে তা হল, বাঙালির যা মৌল লক্ষণ তাকে মূল্যহীন এবং অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার এক সুকৌশলি প্রচেষ্টা। বাঙালির মেধার এই অস্তিত্বহীনতার সংকটটিই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধানতম ভয়ের জায়গা। বাঙালি মেয়ে যখন সিনেমার পর্দায় আসেন তখন একই সূত্র মেনে ক্যামেরার মূল ফোকাসে থাকে তার শাঁখা-সিঁদূর ও বড় লাল টিপ। বঙ্গ তনয়ার সিঁদূর ধারণ করে যে মস্তকটি সেই মাথাটির ও যে কিছু ভূমিকা রয়েছে সে বিষয়টিও এখানে এক্কেবারে ‘নেই’ করে দেওয়া হয়। গোবলয়ে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয় সেই মনোভাবটিই কি বাঙালি মেয়েদের ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে কার্যকর করার প্রক্রিয়া এটি? খুব কষ্টকল্পিত নয় ভাবনাটি।
এর কারণ, ফলাফল এবং সমাধানের সূত্র খোঁজা এক বিস্তৃততর আলোচনার বিষয়। এখানে কয়েকটি ভাবনাসূত্র উল্লেখিত হল মাত্র।
বাঙালির সংস্কৃতির মূল স্বর ও সুর যে মুক্ত চিন্তা ও চিন্তনের চর্চা সেই বিষয়টিকেই আসলে নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা এখানে লক্ষণীয়। এই ছকের ফল হিসেবেই বাঙালি আজ বাংলা বলতে কুণ্ঠিত হয়, ইংরেজি বা হিন্দি বলতে না পারলে লজ্জিত হয়। এক বোধহীনতা তার মননকে গ্রাস করছে ক্রমশ। আধিপত্য ও ক্ষমতার রাজনীতির এক বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এই ‘বোধশূণ্যতা’র বীজটিকে রোপণ করা হয়েছে বেশ কিছু সময় ধরে। এর সমাধান ও সহজ নয় কারণ এর কোনো একমাত্রিক ফর্মূলা নেই। বাংলা বাঁচাও জয়ধ্বনি দিয়ে অন্যান্য ভাষার সকল চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্য দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আবেগসর্বস্বতা এখানে আদৌ কার্যকর কোনো পন্থা নয় বলেই মনে হয়। সংস্কৃতির বহমানতা, গ্রহণক্ষমতা, আত্তীকরণ তার চলনের বহুমাত্রিক ও বহুকৌণিক একটি প্যাটার্ন তৈরি করে। ব্যক্তির স্বাধীনতা, ইচ্ছে, জীবনকে উপভোগ করার বাসনা, জীবনের অনিশ্চিত দোলাচলতার প্রেক্ষিতে এই নিয়ত পরিবর্তনশীল চালচিত্রটি রচিত হয়। তাকে পুরোপুরি না বুঝে নস্যাৎ করাও আর এক ধরণের মৌলবাদ।
তবে উপায় কী?
সোজা বিষয়টি সোজা ভাবে দেখাই ভালো। জীবনের মুখটি আদতে সামনের দিকেই ফেরানো। সামনের দিকেই এগোতে হয়। পিছনে ফেলে আসা পায়ের ছাপটিকে দেখে সামনের রাস্তাটা নির্মাণ করতে হয়। ফেলে আসা পদচিহ্ন জোর করে মুছতে গেলে পিছনের দিকে ফিরতে হয়। পিছনের দিকে এগোনো কোনো অর্থেই অগ্রগমন নয়। তাই সময়ের দাবি মেনে নিয়েও আসুন বাংলাটা বাঙালির মতোই বলি। আর পাঁচটা ভাষাও না হয় শিখে নিই। একটার জায়গায় পাঁচটা ভাষা জানা অগৌরবের নয় বরং কৃতিত্বের। কিন্তু নিজের ভাষাটা না জানা, না বলতে পারা বিশেষভাবে লজ্জার ও অবমাননাকর। এই বোধটির উদ্বোধন আজকের জন্য জরুরি।
আর জরুরি সেই চিরন্তন পরিসরটিকে আরো একবার খুঁজে নেওয়ার যেখানে থাকবে বাঙালির হৃদয়জাত সংবেদনশীলতা, মুক্ত ভাবনা, চিন্তনের স্বচ্ছতা এবং মননশীল বাকস্বাধীনতা। পেশীর আস্ফালন নয় হৃদয়জাত মেধার জোরই হোক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার হাতিয়ার।
লেখক পরিচিতি: গবেষক ও অধ্যাপক।