অন্ধকার থেকে আলোর প্রত্যাশায় ‘নীল ময়ূরের যৌবন’: ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে – তাপস মন্ডল

অন্ধকার থেকে আলোর প্রত্যাশায় ‘নীল ময়ূরের যৌবন’: ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে – তাপস মন্ডল

সেলিনা হোসেন আমাদের স্বাধীন বাংলার লেখক এবং লেখক সমাজের কন্ঠস্বর। লেখকের দায় মেনে নিয়েই নিজেকে তিনি যুক্ত করেছেন গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সমতাভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রভাবনা আর বাংলার সঙ্গেই। লেখা সম্পর্কে ‘লেখকের মৌল দায়িত্ব ভালো লেখা। নিজের প্রতি সৎ থেকে নিজের অনুভবকে শক্ত মেরুদন্ড দেয়া লেখকের কর্তব্য।’ তাঁর রচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গণমানুষের সংগ্রাম হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ধারণা দেয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা আমাদের ভাষার ওপর আক্রমণ করেছিল। তারা চেয়েছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তারা আমাদের ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছিল। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে মন্ত্রী দেবল ভদ্র যেন পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরই প্রতিনিধিত্ব করে। বস্তুত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতার স্বপ্ন বিস্তার লাভ করে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সোপান। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ‘নীল ময়ূরের যৌবনে’ সেই বিষয়টিই রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

ভাষা আন্দোলনকে রূপকের মোড়কে ঢেকে পৃথিবীর সব ভাষাভাষি মানুষের অস্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি উপন্যাসের মাধ্যমে। ভাষা সংগ্রাম তাঁর উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। রাজা এবং তার পরিষদ্বর্গের সাথে সমাজের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার পার্থক্য এবং এই জনগোষ্ঠীর ভাষাকে কোথাও স্থান দিতে অপারগ রাজসম্প্রদায়। রাজরোষানল থেকে সাধারণ মানুষের মুখের সহজ স্বচ্ছন্দ ভাষাকে টিকিয়ে রাখার নিরন্তর সংগ্রামের রূপরেখা এই উপন্যাস। এই সংগ্রাম যেমন চর্যাপদের সময়কালে ছিল তেমনি এখনো আছে। তার উদাহরণ হলো আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার মানুষের অবহেলিত এবং অধিকাংশমান দশা। হাজার বছরের সংগ্রামী মানুষের সংগ্রামের শিল্পীত রূপ এ উপন্যাস।

আলোচ্য উপন্যাসে আমরা দুই শ্রেণীর জীবনধারা লক্ষ্য করি। একদিকে রাজার দরবার। যেখানে সমাজের উচ্চশ্রেণীর আনাগোনা। যারা তৎপর থাকে তাদের অধীনস্থ নিম্ন বংশজাত প্রজাদের শাসন ও শোষণে। ক্ষমতার অপব্যবহার যথেচ্ছ আইন তৈরি ও আইন প্রয়োগ তাদের নেশা। সাধারণ লোকের দৈনন্দিন জীবনে মুখের ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে তারা নারাজ। সংস্কৃত ভাষাকেই তাদের যতো সমাদর। তারা মানতে পারে না নিম্নবর্গের কেউ বাংলায় গীত রচনা করুক। তাদের বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করছে তারা যাদেরকে সেই তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর দল ‘ছোটোলোক’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কাহ্নপা, ডোম্বি, দেশাখ চরিত্রগুলি যার প্রতিনিধিত্ব করছে। সামাজিক ও আর্থিকভাবে তাদের অবস্থান দুর্বল। কখনো হয়তো খেতে পায়, কখনো হয়তো পায় না। কিন্তু একে অন্যের দুঃখ সুখে তারা অপরাপর। তাদের মুখে ভাষা বাংলা। এই ভাষাতেই গীত রচনা করে কাহ্নপা, ভুসুকুপা, কুক্কুরীপা’রা। যার জন্য রাজদরবারে অপমানিত হতে হয় কানুকে। তখন তার পাশে থেকে তাকে সাহস দিয়ে যায় বইয়ের আরেক প্রধান চরিত্র ডোম্বি। পাশাপাশি গাঁয়ের লোকেদের কাছেও সমাদৃত হয় কানুর গীত। কিন্তু রাজ আজ্ঞা না মানার অপরাধে, ডোম্বির প্রতিবাদী আচরণের ফলে তাদের দিতে হয় এর চরম মূল্য। আলোচ্য ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে এই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে ভাষা আন্দোলন এক ভিন্নমাত্রা বহন করেছে।

আলোচ্য উপন্যাসে অসাধারণ মেধাবী কবি কাহ্নপাদ বুদ্ধমিত্র রাজার দয়ায় রাজদরবারে পাখা টানার কাজ পায়। কিন্তু এই কাজের থেকে প্রথমেই তাঁর পরিচয় একজন কবি হিসাবে। কবিতাই তার প্রাণ। কাহ্নপাদ এই রাজদরবারে প্রতিদিন পাখা টানার সুবাদে এখানে প্রতিনিয়ত দেখতে পায় তার নিজের ভাষার প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা এবং অপ্রচলিত ভাষা সংস্কৃতের কদর। আসলে রাজসভার ব্রাহ্মণমন্ত্রী দেবল ভদ্র ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ পন্ডিতেরা চায় সবসময় তাকে কোণঠাসা করে রাখতে। এ ব্যাপারে জানলেও তাঁর মুখটি খুলবার জো নেই, তবে তাঁর কবিত্ব সত্তা সর্বদাই তাকে জাগ্রত করে এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার জন্য। তাই ভেতরে প্রকাশের আকাঙ্খা যখন তীব্র হয় তখন ওই রাজসভা তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে কাহ্নপাদের। ও প্রবলভাবে অনুভব করে যে ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের রাশভারি সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি ওর লৌকিক ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, যে ভাষাতে কথা বলে ওর মত শত শত জন। তাই ওকে নিয়ে যে যত হাসাহাসি এবং বিদ্রূপ করুক না কেন তাতে সে কান করে না। কিন্তু ভাষার প্রতি অমর্যাদা মানেই তাঁর কবিত্বের প্রতি আঘাত হানা। সে আঘাত সে সহ্য করতে পারে না। যেহেতু লৌকিক ভাষা কাহ্নপাদের বুকের ভাষা, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই, নেই কোন নাড়ির টান। সেইজন্য তার মাথাব্যাথাও নেই ভাষা সংস্কৃতির প্রতি। তাই রাজসভায় যখনি গীতের আসর বসেছে তখনি নিজের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লক্ষ্যে ব্রাহ্মণমন্ত্রী দেবল ভদ্রের কাছে অনুনয় বিনয় করেছে। তবুও মন্ত্রীর মন কল্পিত হয়নি। বরং তাকে ব্যঙ্গ করে ছুঁচোর কেত্তন বলে ভাগিয়ে দিয়েছে। এবং ভয় দেখিয়ে বলেছে—

“লৌকিক ভাষা অগ্রাহ্য, অকথ্য। নম্লেচ্ছিতবৈ, নাপভাবীতবৈ। এটা ম্লেচ্ছ ভাষা, এই ভাষা ব্যবহার করলে অপরাধ হয়। যদি কেউ ব্যবহার করে তবে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”  
(i)

অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে এরা ভাষাকে দমিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এই ভয়ে ভীত হয়নি কাহ্নপাদ। সে ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লক্ষ্যে অবিচল। সুতরাং মন্ত্রীর কাছ থেকে বিরূপ আচরণ পেয়েও সে শেষপর্যন্ত রাজসভায় তাঁর গীত পড়ার দাবি নিয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হয়। এবং রাজার অনুমতি আদায় করে নেয়। এই খুশিতে কাহ্নপাদ ডোম্বির কাছে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। সে ডোম্বিকে বলে—

“এতদিনে আমাদের ভাষার মর্যাদা হবে মল্লারী। আমি দেখাবো ওদের ওই বড় বড় তালের মতো শব্দগুলো কেবল ভাষা নয়। আমাদের ভাষা ঝরঝরে প্রাণবন্ত। আমাদের ভাষা সজীব। কী বলো মল্লারী।”  
(ii)

কাহ্নপাদ এইভাবে মল্লারীর কাছে সংস্কৃত ভাষা অপেক্ষা লৌকিক ভাষার বিশেষত্ব ব্যক্ত করেছে। সেইসঙ্গে মল্লারীকে একথাও বলেছে যে রাজসভায় সংস্কৃতের কদর, সে রাজসভার আমার দরকার নেই। আসলে রাজসভাটা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য। তাই সেখানে তারা আমাকে ও আমাদের ভাষাকে সবসময় অবজ্ঞা করে। এজন্য অনেকসময় কাহ্নপাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে এদের ঘাড়ের ওপর পা রেখে আমার ভাষার শক্তি দেখাতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে নিজের ভাষাটা ওদের মুকুটের মতো মাথায় পরি। আর আমাদের ভাষায় যে নদীর স্রোত আছে তা তাদেরকে জানিয়ে দি। তবে কাহ্নপাদের এটা মনের ইচ্ছা। তা বাস্তবায়িত করা ততটা সহজ নয়। কেননা যেখানে ব্রাহ্মণমন্ত্রী দেবল ভদ্রের মত স্বৈরাচারী শাসক থাকে সেখানে তো কোনো কথাই নেই। কুক্কুরীপাদ এজন্য বলে— ‘রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ’। সরাসরি বলতে পারে না বলে কুক্কুরীপাদ এমন আবরণ দিয়ে বলে। চমৎকার কথা বলে কুক্কুরী—

“ওদের জীবনে গাছের তেঁতুল ওই দেবল ভদ্রের মতো হোঁতকা মুখো কুমিরে খায় বলেই তো এদের এত যন্ত্রনা। সমাজে ঠাঁই নেই, মুখের ভাষার দাম নেই, ঘরে নিত্য অভাব।”  
(iii)

কাহ্নপাদেরও তাই করা উচিত। পূর্বে একবার কাহ্নপাদ প্রচন্ড ক্রোধে লিখে ফেলেছিল ডোম্বির কথা—

“নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরী কুড়িআ।

ছই ছোই যাইসি ব্রাহ্ম নাড়ি আ।।”  
(iv)

এই পংক্তি লিখে কাহ্নপাদ পরক্ষনে তা কেটে দেয়। কেননা দরবারে বসে এই কথা বললে ওরা ওখানেই তাঁর টুঁটি ছিঁড়ে মেরে ফেলবে। তাঁর মত ছোটো লোকেরা একথা বলতে পারে না। সেজন্য কুক্কুরীপাদের মতো ভাষার আবরণকেই গ্রহণ করে কাহ্নপাদ লিখে—

“তিন ভুঅন মই বাহিঅ হেঁলে/হাঁউ সুতেলি মহাসুহ লীডেঁ।”  
(v)

এই পংক্তিতে ভাষার তীব্রতা খুঁজে না পেয়ে কাহ্নপাদ আরো লিখে—

“আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা।

তা দেখি কাহ্ন বিমনা ভইলা।।

কাহ্ন কাহঁ গই করিব নিবাস।

জো মন গোঅর সো উআস।।”  
(vi)

এই পংক্তিতেও তাঁর মন ভরে না। আসলে ভাষার আবরণ অনেকটা দোষের। অর্থাৎ এই আবরণটা না রাখলে রচনাটা আরো তীব্র করা যেতো এবং বুকের জ্বালা আরো উজাড় করে কথা বলা যেতো কিন্তু রোগটা অন্য জায়গায়। রাজ্যের ব্রাহ্মণমন্ত্রী ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতের দল বাঘের মতো বসে থাকে, সুযোগ পেলেই হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়া কেবল। এমনিতেই ওরা কেউ ওর ওপর খুশি নয়। ওর উপর জোর করে ভাষার দাবি জানাতে গেলে তো রক্ষে নেই। যদিও শেষ পর্যন্ত কাহ্নপাদ রাজার অনুমতি নিয়ে রাজসভায় ভাষার দাবি জানাতে উপস্থিত হলে ব্রাহ্মণমন্ত্রী দেবল ভদ্রের জন্য সে গীত পড়ে উঠতে পারেনি—

“দেবল ভদ্রের মেজাজ অসহিষ্ণু হয়ে গেছে, উৎসবের পরবর্তী অংশের জন্যই সে এখন উন্মুখ। রাগ এসে পড়ে কাহ্নপাদের ওপর। রুক্ষ মেজাজে খেঁকিয়ে ওঠে, এত রাত পর্যন্ত বসে আছিস কেন?

গীত পড়বো।

গীত?

দেবল ভদ্রের চোখ কপালে ওঠে, ভীষণ বিস্ময়।

কার লেখা গীত?

আমার।

তোর! তুই কি গীত লিখিস? তুই সংস্কৃতের কী জানিস!

সংস্কৃত জানবো কেন? আমার ভাষায় লিখেছি।

——- ——– ——– ———

ও ছুঁচোর কেত্তন

দেবল ভদ্রের কন্ঠে ব্যঙ্গ।

বেরো এখান থেকে, বেরো বলছি। …. ”  
(vii)

অর্থাৎ দেবল ভদ্র তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় রাজসভা থেকে। এই অপমান তার নিজের একার নয়। তার সমাজের সমস্ত মানুষের। কেননা তাদের দাবি এই গীতের মধ্যে ছিল যা ভাষার আবরণে লিখিত। কিন্তু দেবল ভদ্রের জন্য সে দাবি আর জানাতে পারলো না। তাই কাহ্নপাদ বলে—

“রাজসভা থেকে যে যন্ত্রনা নিয়ে ফিরেছি তার দায়ভার এই লোকালয়েরও। আমি উপলক্ষমাত্র, কিন্তু বহন করতে হবে সবাইকে। আমার মুখের ভাষার অবমাননা আমাদের সবার।”  
(viii)

দিনের পর দিন এইভাবে তাদেরকে অপমান এবং ভাষার প্রতি অবমাননা করেই চলেছে স্বৈরাচারী শাসকের দল। তাই এখন থেকে তারা নিজেরাই ঠিক করেছে এবার আর ওদের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকবে না। নিজেদের সম্মান এবং ভাষার প্রতিষ্ঠা নিজেদেরকে গড়ে নিতে হবে। যাতে করে ওরাও বুঝতে পারে – আমরা ছোটলোক বলে আমাদের ভেতরে কি কোন মানুষ নেই? তবে তারা এটাও স্বীকার করেছে এতদিনে যা হয়েছে তা তাদের ভাবনার ভুলেই। কাহ্নপাদ দেশাখের কাছে সে কথাই বলেছে—

“এতদিনে আমার ভুল ভাঙলো দেশাখ। আমি এখন বুঝতে পারছি যে শুধু রাজদরবারই কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। ওরা যতই সংস্কৃতের বড়াই করুক ওটা কারো মুখের ভাষা নয়। বাঁচিয়ে রাখবে কে? আমাদের ভাষা আমাদের মুখে মুখেই বেঁচে থাকবে রে দেশাখ।”  
(ix)

একথা সত্য সংস্কৃত ভাষা অপেক্ষা লৌকিক ভাষা মানুষের মুখে মুখে বেশি প্রচলিত। তাই যদি হয় তবে কানুর বুকের ভাষা সবার বুকের ভাষা হয়ে মুখে মুখে ফিরবে। ওদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। তবুও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়। যে রাজ্যে ব্রাহ্মণ মন্ত্রী দেবল ভদ্রের মত স্বৈরাচারী শাসকেরা থাকে সেখানে এ কি করে সম্ভব? তাই তাদেরকে এমন এক জায়গার সন্ধান করতে হবে যেখানে তাদের মুখের ভাষায় গীত লিখলে আর রাজার লোক মারতে আসবে না। এবং যেখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। এইরকম একটা জায়গার খোঁজের অপেক্ষায় দিন গুণছে তাঁরা। সবশেষে কাহ্নপাদের গলায় সেইরকমই স্বপ্নের ভূখন্ডের কথা শুনতে পাওয়া যায়—

“তোরা কেউ দুঃখ করিস না দেশাখ। আমাদের তেমন একটা জায়গা একদিন হবে। আমরাই রাজা হবো। রাজা প্রজা সমান হবে। আমাদের ভাষা রাজদরবারের ভাষা হবে। তেমন দিনের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে দেশাখ।”  
(x)

সর্বোপরি ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়। পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ তারাও পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের প্রাণের ভাষা, আত্মার আত্মীয়, বুকের ভাষা, মুখের ভাষা বাংলা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় উর্দু ভাষা। আপামর বাঙালি জাতিসত্ত্বার এই অপমানকে মেনে নিতে পারেনি। লড়াই শুরু হয় উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে। বরকত, জব্বররা প্রাণ দেয় নিজের প্রাণের ভাষাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ১৯৫২ সালে রক্তক্ষয়ী অসম সংগ্রামে বহু বাঙালি ভাষা শহীদ হন। কাহ্নর মতো তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন এক স্বাধীন ভূখন্ডের। যার দক্ষিণে থাকবে এক সুন্দর বন আর সাগর। কাহ্নর মত তারাও স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজা প্রজায় কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সবার মুখের ভাষা হবে রাজদরবারের ভাষা। তারই ফলশ্রুতি যেন ১৯৭১ এর স্বাধীন বাংলাদেশ। যে দেশের জনগণের একমাত্র ভাষা বাংলা। যে সংগ্রাম প্রাচীনকালে শুরু করেছিলেন কাহ্নরা, তারই যেন পরিণতি আধুনিককালের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে। এভাবেই সেলিনা হোসেন তাঁর উপন্যাসে সেকালের কাহিনীকে একাল পর্যন্ত বিস্তৃত করে এক নতুন কন্ঠস্বরকে ধ্বনিত করলেন যার মধ্য দিয়ে চর্যাপদকে জীবনের আখরে পুননির্মাণ করলেন।

তথ্যসূত্র:

(i) হোসেন সেলিনা – ‘নীল ময়ূরের যৌবন’, নয়া উদ্যোগ, প্রথম সংস্করণ ২০০৯, কলকাতা – ৭০০০৬৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৩৫।

(ii) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩৬।

(iii) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩৮।

(iv) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩৮।

(v) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩৮।

(vi) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৩৮-৩৯।

(vii) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৪২।

(viii) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৪৭।

(ix) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ১৪২।

(x) তদেব। পৃষ্ঠাসংখ্যা – ১৪৪।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

(i) আজাদ সালাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান, অনুবাদ: আশিষ কুমার চক্রবর্তী, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি – ১১০০৭০, প্রকাশন: ডিসেম্বর ২০০৩ অঙ্কুর প্রকাশন, ঢাকা।

(ii) হোসেন সেলিনা, ‘নীল ময়ূরের যৌবন’, নয়া উদ্যোগ, প্রথম সংস্করণ ২০০৯, কলকাতা – ৭০০০৬৭।

লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক, গোবিন্দ প্রসাদ মহাবিদ্যালয়, অমরকানন, বাঁকুড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *