সাংস্কৃতিক আগ্র‌াসনের পরম্পরা ও বাংলা ভাষার পথচলা – সাইফুল্লা

সাংস্কৃতিক আগ্র‌াসনের পরম্পরা ও বাংলা ভাষার পথচলা – সাইফুল্লা

ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষের ও সামষ্টিকক্ষেত্রে কোনো জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক শ্রীবৃদ্ধির পথে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক প্র‌তিবন্ধকতা তৈরি করা হয়, তবে তাকে সাংস্কৃতিক আগ্র‌াসন বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক আগ্র‌াসন নানাভাবের, নানারূপের হয়ে থাকে। তবে তার মধ্যে ভাষিক আগ্র‌াসন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানসিক উৎকর্ষতার প্র‌শ্নে ভাষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভাষার সাহায্য না পেলে আমরা কিছুতেই আমাদের মনের ভাবকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করতে পারি না। এক দিক থেকে দেখলে, সাংস্কৃতিক শ্রীবৃদ্ধির পথে প্র‌থম ও অন্যতম প্র‌ধান পাথেয় হল ভাষা।

সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে স্পষ্ট প্র‌তীয়মান হয়, কোনো জাতি-গোষ্ঠী যখন অন্য কোনো জাতি-সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে, তখন তারা প্র‌থমেই আঘাত করেছে ভাষিক ক্ষেত্রে। নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে অন্যদের উপর; কেড়ে নিতে চেয়েছে তাদের মুখের ভাষা। ভাষিক এই আগ্র‌াসন সর্বাত্মক রূপ নিয়েছিল শিল্পবিপ্লব উত্তর কালে সাম্র‌াজ্যবাদের সুবর্ণযুগে। তখন ইউরোপের অগ্র‌সর দেশ সমূহ এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরকিার বিভিন্ন স্থানে শুধু তাদের বাণিজ্যিক উপনিবেশ তৈরি করেনি; সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরিতেও তৎপর হয়েছিল। এখন দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা স্প্যানিশ। বোঝা যায় স্পেনীয় উপনিবেশিকতার প্র‌ভাবে ওখানকার মানুষ আজ তাদের মাতৃভাষার বৃন্ত থেকে চ্যুত হয়েছে; পরিণামে গলদেশে পরিধান করতে বাধ্য হয়েছে পরদেশের ভাষা, পরজাতির ভাষা।

এই যে মাতৃভাষার অঞ্চলতল থেকে সরিয়ে এনে কোনো ভাষাগোষ্ঠীকে অন্য কোনো ভাষার গভীরে নিক্ষেপ করা তাই ভাষিক আগ্র‌াসনের চূড়ান্ত রূপ। তবে এই চূড়ান্ত রূপের বাইরেও ভাষিক আগ্র‌াসনের বিষয়টি নানাভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। অনেক সময় এমন হয়, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে কোনো জনগোষ্টী তাদের মাতৃভাষা-ক্ষেত্র থেকে ধীরে ধীরে অনেকটা দূরে সরে আসে। উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের বিভিন্ন স্থানে যেমন হয়েছে বা হচ্ছে। বিহার, উত্তরপ্র‌দেশ এসব অঞ্চলে হিন্দির পাশাপাশি মৈথিলি, ভোজপুরি ইত্যাদি যেসব ভাষা প্র‌চলিত আছে তার প্র‌সারক্ষেত্র দ্রুত সংকোচিত হচ্ছে। হিন্দি ভারতের সরকারি কাজের ভাষা। হিন্দি ভাষায় লিখতে পড়তে জানলে অনেক লাভ। এই অবস্থায় ভোজপুরি ভাষী কোনো পড়ুয়া স্বেচ্ছায় উচ্চতর পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে হিন্দিকে অগ্র‌াধিকার দিচ্ছে; এতে ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে তার মাতৃভাষা। একই কথা কমবেশি প্র‌যোজ্য হতে পারে বাংলা সহ অপরাপর অনেক উত্তর ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে। ইংরেজি ও হিন্দি জানলে কর্মক্ষেত্রে সুপ্র‌তিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা প্র‌বল। এই অবস্থায় শহরাঞ্চলে তো বটেই, জেলা ও মহকুমা শহরেও সাধারণের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় পঠন-পাঠনের ও হিন্দিতে কথোপকথন করার চল হয়েছে; উঠে যাচ্ছে বাংলা বা অপারপর আঞ্চলিক ভাষা-মাধ্যম স্কুলগুলি। বলা বাহুল্য ভাষিক আগ্র‌াসনের এই দিকটি অন্য দিকগুলির তুলনায় মোটেই কম বিপজ্জনক নয়।

মনে রাখতে হবে, আজ বাংলা বা অপরাপর ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষাসমূহ এই যে সাংস্কৃতিক আগ্র‌াসনের মুখোমুখি তা একান্ত তাৎক্ষণিক ও অপ্র‌ত্যাশিত কোনো বিষয় নয়। এটাই ঐতিহাসিক সত্য এবং বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে একথা আরও বেশি করে প্র‌যোজ্য। সেই প্র‌থম দিন থেকে অদ্যাবধি বাংলা ভাষা এক প্র‌তিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে আসছে। সময়ের প্রে‌ক্ষিতে এই লড়াই-এর মাত্রাগত বিভিন্নতা তৈরি হয়েছে মাত্র; সমস্যার মূলোচ্ছেদ হয়নি কখনো। আমরা জানি, ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পথচলা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে শুরু করে রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো প্র‌াজ্ঞজনরা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীকে বাংলা ভাষার সূচনাকাল বলে মনে করেছেন। অন্যদিকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্র‌মুখের মতে বাংলা ভাষার পথচলা শুরু হয়েছিল দশম-দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই দুই মতের সমন্বিত রূপ হিসাবে যদি ধরে নেওয়া হয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে গোড়াপত্তন হয়েছিল বাংলা ভাষার, তবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট প্র‌তীয়মান হবে, এই গোড়াপত্তনের লগ্নেই পরম প্র‌তিকূল অবস্থার মোকাবিলা করতে হয়েছিল বাংলা ভাষাকে।

ভারতীয় জাতি-সংস্কৃতির ধারা তখন অন্য খাদে বইতে শুরু করেছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে ইতিহাসেরও ইতিহাস ছিল। আর সে ইতিহাসের পাতায় সামান্য চোখ রাখা জরুরি। অস্ট্রিক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীকে পরাভূত করে বহিরাগত আর্যজাতি যে সংস্কৃতির বীজ বপন করেছিল সেখানে তারা শেষাবধি তাদের একচ্ছত্র আধ্যিপত্য প্র‌তিষ্ঠিত করতে পারেনি। বিপ্র‌তীপ সংস্কৃতির চোরা স্রোত প্র‌বাহিত হচ্ছিল নিরবচ্ছিন্ন ধারায়। কালক্রমে এই চোরাস্রোতই প্র‌কট রূপ নিয়েছিল এবং তার পরিণতিতে ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির প্র‌তিস্পর্ধী হিসাবে প্র‌তিষ্ঠা পেয়েছিল বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতি। একটা সময়ে উত্তর ভারতে তো বটেই, দক্ষিণ ভারতেও রীতিমতো কোণঠাসা অবস্থা হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির। বৌদ্ধ সংস্কৃতির দুরন্ত অভিঘাতে নিজেদের উঁচু মস্তক অবনত করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য সমাজ। তবে নানা কারণে এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একটা সময়ে বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতিকে পরাস্ত করে পুনরায় স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য সমাজ; সমাজ জীবনের অলিতে গলিতে প্র‌তিধ্বনিত হয়েছিল তাদের স্বোচ্চার পদচারণা। আর এর অনিবার্য অভিঘাত পরিস্ফুট হয়েছিল ভাষা ও সাহিত্য সহ সংস্কৃতির অপরাপর ক্ষেত্রে; আর্য সংস্কৃতির আধিপত্য পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে। এদিকে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঘটেছিল এর বিশেষ ব্যতিক্রম।

বাংলা আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহের অন্তর্গত একটি ভাষা। সেদিনের ক্ষমতাধর ব্রাহ্মণ্য সমাজ এমনিতে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা সমূহের প্র‌তি সন্তুষ্ট ছিল না; আর বাংলা ভাষার প্র‌তি তাদের অসন্তুষ্টি ছিল সীমাহীন। ব্রাহ্মণ্য শ্রেণি চেয়েছিল সংস্কৃত হোক ভারতের এক ও অদ্বিতীয় ভাষা। নানা কারণে তা যখন হয়নি, ভারতবাসীর ব্যবহারিক জীবনে প্র‌তিষ্ঠিত করা যায়নি সংস্কৃত ভাষাকে তখন তারা আগ্র‌হী হয়েছিল সেইসব ভাষা সম্পর্কে যেখানে সংস্কৃতের প্র‌ত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্র‌ভাব তুনামূলকভাবে বেশি ছিল। আর এখানেই বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে হয়েছিল বিশেষ সমস্যা। বাঙালি বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি। তারা প্র‌থমাবধি ভাস্বর থাকতে চেয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আলোয়। ভাষার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্র‌বল ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের যুগে উত্তর ভারতীয় ভাষামানচিত্র থেকে যখন দ্রুতহারে অপসৃত হচ্ছিল অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাবৈশিষ্ট্য সমূহ তখনো বাঙালি সমাজ তাদের ভাষায় ধারণ করছিল তার উপাদান। এতে প্র‌তিপন্ন হচ্ছিল বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক নিজস্বতার স্বরূপ; যা নিতান্ত না পছন্দ ছিল ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির। তারা তাই একাধারে বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে বিষ নজরে দেখতে শুরু করেছিল। যদিও নানা কারণে তারা তাদের সে বিষদৃষ্টির দ্বারা ভস্মীভূত করতে পারেনি বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষাকে। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে প্র‌ধান প্র‌তিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক প্রে‌ক্ষিতে।

রাজা শশাঙ্কের শাসনকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অতঃপর যে পাল শাসকরা বঙ্গদেশ শাসন করেন তারা আর যাইহোক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিলেন না। এতে বেশ একটু সুবিধা হয়েছিল বাঙালি-সংস্কৃতির উজ্জীবনে। তবে অনিবার্য কারণে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তার সুফল তেমন ভাবে ফলেনি। আসলে তখনো পর্যন্ত বাংলা ভাষা সেই অর্থে কোনো প্র‌াতিষ্ঠানিক নির্মিতি পায়নি। অপ্র‌ভ্রংশ-অবহটঠ ভাষার গহ্বর থেকে সদ্য মুক্তি ঘটেছে তার। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তখনও স্বপ্র‌তিষ্ঠ হওয়া হয়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে ঘটে গেল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। পাল রাজাদের পরাস্ত করে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হলেন সামন্ত সেন। অতঃপর কমবেশি দেড় শত বছর বঙ্গদেশে জুড়ে চললো সেন রাজত্ব। সেন রাজারা ছিলেন উগ্র‌ ব্রাহ্মণ্যবাদী। তাঁদের উগ্র‌ ব্রাহ্মণ্যবোধের আগুনে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে দগ্ধ হলো কৈশোবের প্র‌থম ধাপে পা রাখা বাংলা ভাষাও। সেন রাজত্বকালে একদিকে যেমন রাজসভা থেকে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণভাবে বহিষ্কার করা হলো অন্যদিকে তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রে সেদিন যারা আলাদা করে লেখালিখি সহ অন্য কোনো ভাবে বাংলা ভাষাকে ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করছিলেন তাদেরকে ব্রাত্য করে দেওয়া হলো পুরোপুরি। এতে অত্যন্ত বিপন্ন হল নবজাত বাংলা ভাষা।

জয়দেবের জাতি পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে সে বিতর্ক আলোচ্যক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। জয়দেব বাঙালি বা উড়িয়া যাই হোন না কেন, এটা ঘটনা যে তিনি তাঁর মাতৃভাষায় গীতগোবিন্দ রচনা করতে পারেননি বা করতে চাননি। কেন পারেননি; কেন চাননি! এক্ষেত্রে সহজ উত্তর সহজ কথায় এইরকম দাঁড়ায়; বাংলা বা উড়িয়া ভাষা তখনো দেহমনে ততখানি সবলতা অর্জন করেনি যাকে আশ্রয় করে একটা গোটা কাব্য রচনা করা যায়। তাই যদি হয় তবে এমনিতে হয়তো কিছু বলার থাকে না, কিন্তু অন্যভাবে অন্য অনেক কথা বলার থেকে যায়। একটি ভাষা এমনি এমনি সবল ও স্বপ্র‌তিষ্ঠ হয় না। তার জন্য বিশেষ সহায়তার প্র‌য়োজন হয়। এই সহায়তা মুখ্যত দুই ধরনের হতে পারে। প্র‌াতিষ্ঠানিক ও সামাজিক। প্র‌াতিষ্ঠানিক সহায়তা বলতে তখনো পর্যন্ত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্র‌তিষ্ঠানের বাইরে আর কিছু নেই। এদিকে এই দুই বিষয়ের কোনোটিই বাংলা ভাষার জন্য সহায়ক হয়নি। রাজসভায় বাংলা ভাষার কোনো স্থান নেই। আবার ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে ব্রহ্মণ্যবাদের প্র‌াধান্য সেখানে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ ব্রাত্য বিষয়। তাহলে বাকী থাকে সমাজ-সত্যের দিকটি।

বাঙালি জাতি-সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে ন্যূনতম পড়াশুনা যার আছে তিনিও জানেন, সেদিনের বাঙালি সমাজ-মানস বাংলা ভাষাকে সেই অর্থে কোনো আশ্রয় দিতে পারেনি। তখন বাংলা ভাষাকে পক্ষপুটে ধারণ করতে পারতো যে বৌদ্ধ-ধর্মসম্প্রদায় তাদের নিজেদেরই তখন নাভিশ্বাস অবস্থা। ব্রাহ্মণ্য শ্রেণি নির্বিচারে অত্যাচার-অবিচারের রোলার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের উপর দিয়ে। তাদের নিজেদের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে হাজারও সমস্যা; বৌদ্ধধর্মাদর্শকে ঘিরে ব্যাপক মত পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় তারা কেমন করে আলাদা করে বাংলা ভাষার জন্য কাজ করবেন। তবু তারই মধ্যে যেটুকু করার তারাই করেছিলেন। বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্য সমাজ যদি সেদিন বাংলা ভাষায় তাদের ধর্মগীতগুলি লিপিবদ্ধ না করতেন তবে আজ আমরা কিছুতেই আমাদের মাতৃ ভাষার আদিরূপের সন্ধান পেতাম না। উল্লেখ্য, এই যে বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্য সমাজ বাংলা ভাষাকে লালন করেছিলেন সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থান ছিল একেবারে পিছনের সারিতে; অর্থনৈতিক দিক থেকেও তাঁরা ছিলেন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে। টালত মোর ঘর নাহি পড় বেসি…, নগর বাহিরে ডোম্বি তোহরি কুড়িআ প্র‌ভৃতি চর্যা-পংক্তি তারই সাক্ষ্য বহন করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সেন আমলে বাংলা ভাষা কোনো রকম প্র‌াতিষ্ঠনিক সহায়তা তো পায়নি, উল্টে রাজন্যবর্গের ব্যবস্থাপনায় এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল যাতে জয়দেব, উমাপতিধরদের মতো কবিরা বাংলা ভাষার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সংস্কৃতের প্র‌তি মনোনিবেশ করেছিলেন। অন্য দিকে অপরাপর সামাজিক মানুষের পক্ষ থেকে যারা বাংলা ভাষার চর্চা করার চেষ্টা করছিলেন তাদেরকেও ভোগ করতে হচ্ছিল সামাজিক লাঞ্ছনা। অর্থাৎ চরম এক প্র‌তিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটতে হচ্ছিল সেদিনের বাংলা ভাষাকে। আমরা জানি বাংলা ভাষার পথচলার পথে এই যে প্র‌তিকূলতা তা কিছুটা অপসৃত হয় সেন আমল শেষ হওয়া ও তুর্কি শাসন প্র‌তিষ্ঠার সূত্রে। তুর্কিরা বাংলার তো বটেই, ভারতেরও বাইরেকার মানুষ ছিলেন। এতে বিশেষ এক সুবিধা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্র‌তি আনুগত্য থেকে সেন রাজারা যেভাবে বাংলা ভাষার বিরোধিতায় মেতেছিলেন তুর্কিদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বাংলা বা সংস্কৃত কোনো ভাষাই তাদের আপন নয়। এর যে কোনো একটিকে তারা গ্র‌হণ করতে পারেন। তবে এই গ্র‌হণ করার ক্ষেত্রে তারা বাংলা ভাষাকে প্র‌ধান্য দিয়েছিলেন এবং তারও সঙ্গত কারণ ছিল। আদর্শ রাজশক্তি মাত্র তৎপর হন জনগণের আস্থা অর্জন করতে। আর জনগণের আস্থা অর্জন করার প্র‌থম সোপান তাদের ভাষার প্র‌তি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। তুর্কি শাসকরা এই কাজটাই করার চেষ্টা করেছিলেন খুব করে। তারা বুঝেছিলেন সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে দেশের আম জনতার কোনো সংযোগ নেই। জনসংযোগহীন এমন একটি ভাষাকে প্র‌শ্রয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কাজেই তারা বাংলা ভাষার প্র‌তি প্র‌ত্যক্ষ পক্ষপাতিত্ব দেখাতে শুরু করেন। কারণ যাই হোক, তাদের এই পক্ষপাতিত্ব বাংলা ভাষার পথচলার পক্ষে পরম পাথেয় হয়ে ওঠে।

তুর্কি শাসকরা একদিকে যেমন সমাদর করে বাংলা ভাষাকে রাজসভায় স্থান করে দেন, অন্যদিকে তেমনি তাদের কারণে আরও অনেকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের পথ সুগম হয়। কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, কৃত্তিবাস ওঝার মতো কবিরা সরাসরি রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা পান। গৌড়ীয় রাজন্যবর্গের দেখাদেখি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতে উদ্যোগী হন অনেক আঞ্চলিক রাজারাও। তাঁদের রাজসভায় স্থান পান মুকুন্দ চক্রবর্তী, রামেশ্বর ভট্টাচার্য সহ আরও অনেকেই। বাংলা ভাষায় কাব্য রচনাকারী কবিরা রাজ অন্নে প্র‌তিপালিত হচ্ছেন, ভূষিত হচ্ছেন রাজসম্মানে; এর সামাজিক অভিঘাত কতটা সুদূর প্র‌সারী হতে পারে তা বলা বাহুল্য। জনমানসে অতঃপর বাংলা ভাষার কদর বহুগুণ বেড়ে যায়।

এ তো গেল একদিক। এর অন্যদিকটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। প্র‌গাধুনিক বাংলা সাহিত্যির যে পাঁচটি প্র‌ধান ধারা অর্থাৎ অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবসাহিত্য, রোমান্টিক প্র‌ণয় উপাখ্যান ও ইসলামি সাহিত্য তার সবের মূলে রয়েছে তুর্কি শাসন; অন্য অর্থে ইসলমিক সংস্কৃতির প্র‌ত্যক্ষ প্র‌ভাব। প্র‌াক্‌ তুর্কি শাসন পর্বে বাংলা ভাষায় ধর্মীয় গ্র‌ন্থ অনুবাদের ক্ষেত্রে প্র‌যোজ্য ছিল শাস্ত্রকারদের প্র‌বল নিষেধবাণী— ‘অষ্টাদশ পুরাণাণি রামস্য চরিতানি চ/ ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবৎ নরকৎ ব্রজেৎ।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি দেশীয় ভাষায় বেদ, পুরাণ সহ কোনো শাস্ত্রগ্র‌ন্থের অনুবাদ করবে সে সবংশে নরকে যাবে। এমন ভয়ঙ্কর নিষেধবাণী উপেক্ষা করে সেদিন অনুবাদ সাহিত্য রচনা অসম্ভব ছিল যদি না তুর্কি আক্রমণ ঘটতো। তুর্কি শাসকরা একদিকে যেমন তাঁদের কবি-সাহিত্যিকদের অনুবাদ কাব্য রচনায় প্র‌ত্যক্ষভাবে অনুপ্র‌াণিত করেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি তুর্কি শাসন প্র‌তিষ্ঠার সূত্রে শিথিল হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সামাজিক বাঁধন। তখন আর সবংশে নরকবাসী হওয়ার ভয়ে তাঁদের কলমকে সংযত করতে আগ্র‌হী ছিলেন না বাংলার কবি সমাজ। অনুবাদ সাহিত্যের মতো মঙ্গলকাব্য রচনার নেপথ্যেও ছিল তুর্কি শাসনের প্র‌ত্যক্ষ প্র‌ভাব। উচ্চ ও নিম্নবর্ণীয় হিন্দু সমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা মঙ্গলকাব্যের মূল ভিত্তি। এই সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করতেই হতো না যদি না তুর্কি আক্রমণ ঘটতো। বৈষ্ণব সাহিত্যের উপর অনুবাদসাহিত্য বা মঙ্গলকাব্যের মতো প্র‌ত্যক্ষ প্র‌ভাব নেই ঠিকই, কিন্তু পরোক্ষ প্র‌ভাব মোটেই কম নয়। যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বদর্শনের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণবসাহিত্য তথায় সুফি ধর্মাদর্শের প্র‌ভাব সুস্পষ্ট। রোমান্টিক প্র‌ণয় উপাখ্যান বা ইসলামি সাহিত্যের ক্ষেত্রে তুকি শাসনের প্র‌ত্যক্ষ প্র‌ভাবের কথা নিশ্চয়ই আলাদ করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ নিয়ে সন্দেহের কানো অবকাশ নেই যে, তুর্কি শাসনকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্র‌থম রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেকে উত্তম রূপে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। এইসময় বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির সপক্ষে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা অবশ্যই আলাদা করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। তুর্কি শাসনের প্রে‌ক্ষিতে হিন্দু সমাজের সেই অংশ যারা এতদিন সংস্কৃত ভাষার প্রে‌মে বুদ হয়ে ছিলেন তাঁদের ভাবান্তর ঘটে। তারা এতদিনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় উদ্যোগী হন। একদিকে এটা যেমন ঘটতে থাকে অন্যদিকে তেমনি মুসলমান সমাজও বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে অগ্র‌ণী ভূমিকা নেয়। বড়ু চণ্ডীদাসের অব্যবহিত পরে পরে সাহিত্যক্ষেত্রে পদার্পণ করেন কবি শাহ মুহম্মদ সগীর। তাঁর কলমের স্পর্শে প্র‌ণীত হয় আস্ত একটি কাব্য ইউসুফ জোলেখা। সেই শুরু। অতঃপর পরবর্তী চার শতক জুড়ে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে মুসলমান সমাজের স্বোচ্চার পদচারণা অব্যাহত থাকে। রচিত হয় লায়লী মজনু (বাহরাম খান), মধুমালতী (মুহম্মদ কবির), লালমতী সয়ফুলমুলুক (আবদুল হাকিম), সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমালা (দোনাগাজী), লোরচন্দ্রাণী সতীময়না (দৌলৎ কাজী), পদ্মাবতী (আলাওল), নবীবংশ (সৈয়দ সুলতান), রসুল বিজয় (জয়নুদ্দিন) প্র‌ভৃতি অসংখ্য কাব্য। উল্লেখ্য মুসলমান কবিদের বাংলা ভাষায় এই যে কাব্যচর্চা সেখানে ছিল না কোনো দ্বিধা, কোনো পিছু টান; নিজেদের দিক থেকে একশো শতাংশ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। যদিও এভাবে নিজেদের উৎসর্গ না করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ছিল।

তখনো প্যান-ইসলামিজমের ধারণা কমবেশি বলবৎ রয়েছে মুসলমান সমাজে। এই ধারণার সাপেক্ষে মুসলমান কবিদের অতি উৎসাহের সঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চা করা, কাব্য কবিতা রচনা এসব ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে আর যাই হোক প্যান-ইসলামিজমের ভিত্তি সুদৃঢ় হয় না। আরবি ইসলামের ধর্মীয় ভাষা। ততদিনে ফারসিও ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে লীন হয়ে গেছে। ইসলাম ধর্ম-সংস্কৃতির পৃষ্ঠাপোষক ভাষা হিসাবে আরবি-ফারসির কথা একসুরে উচ্চারিত হচ্ছে। এই অবস্থায় যদি আরবি ভাষায় নাও হয়ে থাকে, মুসলিম কবিরা চাইলে ফারসি ভাষায় কাব্যচর্চা করতেই পারতেন। বিশেষত এক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই যেখানে ফারসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। মনে রাখতে হবে, মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে সেদিন যারা বাংলা ভাষা চর্চায় অগ্র‌ণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশজনই ছিলেন অভিজাত শ্রেণির। নিম্নবর্ণীয় হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজ থেকে তখন যারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না সাহিত্য-সংস্কৃতিরচর্চায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখা। তারা বহুকালাবধি যে লাঞ্ছিত জীবনযাপন করে আসছিল তার সাপেক্ষে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার জন্য নিছক ধর্ম পরিবর্তন যথেষ্ট ছিল না। তার জন্য দরকার ছিল আরও অনেক প্র‌স্তুতির। যে প্র‌স্তুতি তারা তখনো সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি। এইসময় মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার গুরুভার মাথায় তুলে নিয়েছিলেন যারা তারা এমনিতে অভিজাত শ্রেণির; কিন্তু ঘটনাপরম্পরায় তুর্কি বা ফারসি ভাষা থেকে সরে এসে বাংলা ভাষাভাষি হয়ে উঠেছিলেন। ইতিহাসের পারম্পর্যটা ছিল এক্ষেত্রে এইরকম।

রাজন্যবর্গের পাশাপাশি সেদিন বঙ্গদেশে এসেছিলেন ধর্মপ্র‌চারক সম্প্রদায়। এঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাকীই এসেছিলেন এবং এদেশে এসে এখানকার মেয়েদের বিয়ে করে এখানেই থিতু হয়েছিলেন। এতে তাঁদের উত্তরসূরীদের মধ্যে রক্ত-সংমিশ্রণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সমন্বয়ও ঘটেছিল বহুল মাত্রায়। ধর্ম-প্র‌চারের জন্য সাধারণের মধ্যে বাস করতেই হচ্ছিল। এমন অবস্থায় তাঁদের সন্তান সন্ততিরা অনিবার্যভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল বাংলা ভাষায়। অর্থাৎ একদিকে আরবি-পারসির ভিত্তি, অন্যদিকে বাংলা ভাষায় দক্ষতা; দুই এর সমন্বয়ে তাদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়েছিল বাংলা ভাষার চর্চায় সাফল্য লাভ। প্র‌সঙ্গত উল্লেখ্য ধর্ম-প্র‌চারকদের পাশাপাশি অন্য এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে এইসময় মুসলমান সমাজের রক্তের ও সেইসূত্রে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটেছিল। সেদিন রাজসেনাবাহিনীর অংশ হিসাবে যারা আরব দেশে বা উত্তর ভারত থেকে এদেশে এসেছিল তাদের মধ্যে যারা নির্দিষ্ট সময়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিল তারা সঙ্গতভাবে আর ফিরে যায়নি তাদের স্বদেশে। তারা এদেশের মেয়েদের বিয়ে করে এখানেই ঘরসংসার পেতেছিল।

এটা আলাদা করে স্মরণ করতেই হবে যে, সেদিন মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে যে কবি-সাহিত্যিক সমাজ বাংলা ভাষায় চর্চায় অগ্র‌ণী হয়েছিলেন তাঁরা শুধু আরবি-ফারসি ভাষার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেননি, তাঁরা মুক্ত হয়েছিলেন আরবি ফারসি শব্দের মোহ থেকেও। সপ্তদশ শতাব্দী তো বটেই, অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনা পর্যন্ত মুসলমান কবিদের যেসব কাব্য-কবিতা তাঁর গভীরে কান পাতলে সুস্পষ্ট হয়— ভাষা ব্যবহারের প্র‌শ্নে তাঁদের মধ্যে কোথাও এতটুকুও দ্বিধা ছিল না। বাংলা ভাষাকেই তাঁরা প্র‌থম এবং প্র‌ায় শেষ অবলম্বন হিসাবে গ্র‌হণ করেছিলেন। এখানে আরবি-পারসি শব্দের ব্যবহার অতিসামান্য। অপ্র‌য়োজনে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নেই বললেই বলে। বিষয়গত কারণে, অথবা বাংলা শব্দভাণ্ডারের নিজস্ব দুবর্লতার কারণে যেখানে একান্ত প্র‌য়োজন হয়েছে কেবলমাত্র সেখানেই ব্যবহার করা হয়েছে আরবি-ফারসি শব্দ। আরবি-ফারসির মোহে আবিষ্ট না হয়ে এইসময়ের কবিরা নিষ্ঠার সঙ্গে তৎসম শব্দময় সেদিনের প্র‌চলিত ভাষারীতির প্র‌তি একশো শতাংশ আনুগত্য দেখিয়েছেন। তাঁদের কাব্য-ভাষাই তাঁর সাক্ষ্য বহন করে— ‘সাধুর আদেশ পাইআ জলেত নামিলা।/ জল সুখমান ধর্ম আচরিলা।।/ তান পদ পরশে নীলের পুণ্য নীর।/ সুরেশ্বরী ধারা জেহ্ন-সুধাবর্ণ ক্ষীর।।/ চন্দ্র যেন জলের অন্তরে প্রবেশিল।/ পাখালি শরীর সব নির্মল করিল।।/ জল হোন্তে উঠিয়া পরিলা সুবসন।/ বিচিত্র সুচারু বস্ত্র সুচির শোভন।।’ (ইউসুফ জোলেখা— আজিজ সমীপে ইউসুফ ও জোলেখার মূর্ছা)

উল্লেখ্য, মুসলিম কবিদের হাতে চর্চিত তৎসম শব্দনির্ভর এই যে ভাষারীতি তারও পটপরিবর্তন হয়েছিল কালক্রমে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এসে দেখা যায় মুসলিম কবিরা প্র‌চলিত ভাষারীতির সমান্তরালে আরও এক ধরণের ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন যেখানে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এই পটপরিবর্তন প্রে‌ক্ষিতে আমাদের অনেকের মধ্যে অনেক নেতিবাচক প্র‌শ্ন প্র‌শ্রয় পেতে পারে। কিন্তু বস্তুত এর মধ্যে কোনো নেতিবাচকতা নেই। আসলে, এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রে‌ক্ষিত এই পরিবর্তনকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ততদিনে বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রের রঙ অনেকটাই বদলে গেছে। এতদিন বাংলা ছিল একটা স্বাধীন দেশ। এখানকার রাজন্যবর্গ ছিলেন একানকারই ভূমিপুত্র। ভূমিপুত্র হিসাবে তাঁরা বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্র‌তি যে সহানুভূতিকে লালন করছিলেন তার অপসৃতি ঘটলো মুঘল বিজয়ের প্রে‌ক্ষিতে। আমরা জানি ষোড়শ শতাব্দীর সূচনায় মানসিংহের নেতৃত্বে সম্র‌াট আকবর বঙ্গদেশ জয় করেন। এই বিজয়ের সূত্রে বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলের অবসান হয়। আর তার গভীর প্র‌ভাব সঞ্চারিত হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে।

অতঃপর যাদের হাতে বঙ্গশাসিত হয় তারা কেউ বাঙালি নয়, তারা স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাসও করে না। দিল্লী থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শাসনভার নিয়ে তারা এখানে আসে এবং সময় শেষ হলে ফিরে যায় দিল্লীতে। এতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের আলাদা করে কোনো একাত্মতা তৈরি হয় না। ফলত বাংলা ভাষার প্র‌তিও তাদের মধ্যে আলাদা করে কোনো মমত্ব লক্ষ করা যায় না; উল্টে তাদের সময়ে রাজকার্যে ফারসি ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য প্র‌তিষ্ঠিত হয়। ফারসি ভাষায় দক্ষ না হলে রাজানুকূল্য লাভের কোনোরকম সুযোগ নেই। এই অবস্থায় রাজসভার সঙ্গে প্র‌ত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে তো বটেই, সাধারণের মধ্যেও ফারসি ভাষার ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। অন্য একটি অনুষঙ্গও এই চর্চার ধারাকে খুব করে প্র‌ভাবিত করে। ততদিনে সামন্ততান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সমান্তরালে বাংলার সামাজিক জীবনে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ছায়াপাত লক্ষ করা যাচ্ছে। হুগলি জেলার ডিহিভুসুট পরগনা ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসাবে রীতিমতো প্র‌তিষ্ঠা পেয়েছে। এখানে যারা সমবেত হচ্ছে তারা বিভিন্ন ভাষাভাষি। এইসব ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে একটা মিশ্রিত ভাষারীতিকে লালন করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মিশ্রণের ক্ষেত্রে তখন বাংলা ও ফারসি ভাষা প্র‌ধান্য পাচ্ছে। কেন না সাধারণের মধ্যে বাংলা ও ফারসি ভাষাভাষি লোকের সংখ্যাই অধিক। একদিকে রাজানুত্যলাভের কারণে শিক্ষিত লোকদের ফারসির প্র‌তি পক্ষপাতিত্ব, অন্যদিকে সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলা-ফারসি মিশ্রিত ভাষার চর্চা; দুই এ দুই এ চার হতে তাই সময় লাগে না। ফারসি ভাষায় দক্ষ কবিরা যখন কলম হাতে লিখতে বসেন তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের লেখায় আরবি-ফারসি শব্দ জায়গা জুড়ে বসে। অনেকটা এখনকার ইংরেজি ভাষার মতো। সেদিনের আরবি ফারসি শব্দময় এই যে বাংলা ভাষা সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভারতচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করতেই হয়— ‘শিখিয়াছি যেই মত লিখিবারে পারি, …অতএব কবি ভাষা জাবনি মিশাল।’ বোঝা যায় বাংলা ভাষায় অতিরিক্ত আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার সেদিন মোটেই আরোপিত কোনো বিষয় ছিল না। এটাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত বা সাধারণ সত্য। এদিকে এই সাধারণ সত্যকে ঘিরে উত্তরকালে ঘটলো বিরাট ভাঙা গড়ার খেলা।

ইতিহাসের অনিবার্য অভিঘাতে পলাশির যুদ্ধের প্রে‌ক্ষিতে বাংলার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক জীবনে পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ল নিমিষে। এই পরিবর্তনের ঢেউ এ ভেসে গেল অনেক কিছু। বিশেষত বাঙালির সামাজিক জীবনে বহুকালাবধি লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী; দীর্ঘ এই কালপর্বে বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু সমাজ পাশাপাশি বাস করেছে। এই বসবাসের সাপেক্ষে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক কোনো সংঘাত হয়নি। ইতিহাসে অন্তত তার কোনো সাক্ষ্য নেই। সেদিনের সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার এই যে সংহতি তার ভিত্তি কেঁপে গেল উত্তর পলাশির যুদ্ধপর্বে একশো বছরের মধ্যে। পরিবর্তিত অবস্থার প্রে‌ক্ষিতে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হল মারাত্মক মাত্রায়। শাসক ইংরেজ ও ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সখ্যতা করে উন্নতির সিঁড়ি ভেঙে হিন্দু সমাজ রাতারাতি এমন এক অবস্থানে উপনীত হল যেখানে পৌঁছে তারা বিশেষ করে অবজ্ঞা করতে শিখল তাদের এতদিনের প্র‌তিবেশি মুসলমান সমাজকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষা-সংস্কৃতি চেতনা বিমুখ মুসলমান সমাজকে তারা তখন শুধু অবজ্ঞাই করলো না, সচেষ্ট হল মুসলমানি সংস্কৃতিকে যথাসম্ভব পদদলিত করতে। তাদের এই অপপ্র‌য়াসের অভিঘাতে অপরাপর অনেক কিছুর পাশাপাশি বিশেষ রূপে ধ্বস্ত হল বাংলা ভাষা।

ততদিনে অগ্র‌সর সমাজের মন ও মননে নব্য হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্র‌গাঢ় রূপে ছায়াপাত করতে শুরু করেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্তাপে তপ্ত হিন্দু সমাজ মনে করেছে তাদের মাতৃভাষা যে বাংলা তা যথেষ্ট পরিমাণে হিন্দুত্বের রঙে রঞ্জিত নয়; এতে আরবি ফারসি শব্দের আধিক্য রূপ মুসলমানিত্বের গন্ধ খুব বেশি। তারা তাই উঠে পড়ে লাগলো বাংলা ভাষার সংস্কার সাধনে। যে কোনো মূলে বাংলা ভাষার অঙ্গন থেকে আরবি, ফারসি শব্দসমূহকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। পরিকল্পনা অনুসারে কাজ শুরু করা হল। একাজের সাপেক্ষে বাংলা শব্দভাণ্ডারে যে শূন্যস্থান তৈরি হল তা পূরণ করার চেষ্টা করা হল সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে অপ্র‌চলিত নিতান্ত আভিধানিক সব শব্দ আমদানি করে। এতে বেশ একটা জটিল অবস্থা তৈরি হল। প্র‌থমত, মুসলমান সমাজের সামাজিক ভাবাবেগ আহত হল মারাত্মক ভাবে; দ্বিতীয়ত, জনভিত্তিহীন একটা কৃত্তিম ভাষা সাহিত্যক্ষেত্রে প্র‌তিষ্ঠা পাওয়ায় সাধারণের সাংস্কৃতিক চেতনার মূলে লক্ষ করা গেল ভাঁটার টান। সর্বোপরি, বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিল খুব করে।

হিন্দুরা বাংলা ভাষা থেকে জোর করে আরবি-ফারসি শব্দ সমূহকে বার করে দিচ্ছে, এই অবস্থায় আমরা জোর করে বাংলা ভাষায় প্র‌য়োজনে, অপ্র‌য়োজনে আরও বেশি করে আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করবো; মনে করল মুসলমান সমাজ। তাদের পরিকল্পনার ফসল ফললো অচিরে। হিন্দুয়ানি বাংলার প্র‌তিস্পর্ধী রূপে জন্ম হল তথাকথিত মুসলমানী বাংলার; এতে চূড়ান্ত রূপে ধ্বস্ত হল বাংলা ভাষা। ইতিপূর্বে বাংলা ভাষার আকাশে আর যে দুর্ভাগ্যের মেঘ ঘনীভূত হোক না কেন, সাম্প্রদায়িকতার বাষ্পমাত্র সেখানে জায়গা পেতে পারেনি। কখনো কখনো সামান্য যা একটু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল শুভাকাঙ্খীরা তা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কবি আব্দুল হাকিমের সেই জেহাদী উচ্চারণের কথা এই প্র‌সঙ্গে স্মরণীয়— ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ যে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়/ নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।’ (নূরনামা)। এমন জেহাদী উচ্চারণও নিতান্ত ফিকে হয়ে এল উদ্ভূত অবস্থার প্রে‌ক্ষিতে। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় তখন উন্মত্তের মতো তাদের মাতৃভাষাকে জ্বলন্ত আঁচে ফেলে সেঁকছে— ‘অনভিব্যক্ত বর্ণাধ্বনি মাত্র রাজা পরানারী ভাষা প্র‌থমা যেমন কুমারদেব ভাষা। তদনন্তর বর্ণমাত্রা পশ্যন্তী নামক যেমন প্র‌াপ্ত কিঞ্চিদ্বয়স্ক বালক-বাণী। তৎপর পদযাত্রাত্মক মধ্যমবিধা ভাষা যেমন পূর্ব্বোক্ত বালকাধিক কিঞ্চিদ্বয়স্ক শিশুভাষা’ (মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার), ‘এলাহি আলামিন আল্লা আপেসে ছমিওন।/আপেসে বচিরন গো আপেশে কলিমন।।/আপেশে হায়াতুন আপেশে এরাদুন।/আপেশে আলিমন গো আপেসে করিদন।’’ (আনওয়ারেল ওজুদ) এ ভাষার কোনোটিই আর যাই হোক খাঁটি বাংলা ভাষা নয়।

কথায় বলে সর্বনাশের অর্ধেক ভালো। কেউ কেউ তাই তাদের মতো করে উদ্যোগী হলেন। এহেন সাম্প্রদায়িকতার কবল থেকে মুক্ত করে বাংলা ভাষাকে এর নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বপ্র‌তিষ্ঠ করতে চাইলেন তাঁরা। একদিকে প্যারিচাঁদ মিত্র, অন্যদিকে মীর মশাররফ হোসেন। প্যারিচাঁদ মিত্র তাঁর আলালের ঘরের দুলালে আরবি-ফারসি শব্দ মিশ্রিত ওই ভাষাকে প্র‌তিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন যা ছিল সেদিনের বাঙালির মুখের ভাষা। পাশপাশি মশাররফ সচেষ্ট হলেন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে সরে এসে ততদিনে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে প্র‌তিষ্ঠা পাওয়া তৎসম শব্দ নির্ভর ভাষারীতিকে মুসলমান সমাজের মন ও মননে প্র‌তিষ্ঠিত করতে। উভয় দিক থেকে চেষ্টা চললো সর্বাত্মক ভাবে; কিন্তু ফল ফললো না সেই অর্থে। প্যারিচাঁদ বা মশাররফ কেউই শেষাবধি তাঁদের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে পারলেন না। প্যারিচাঁদ তার অপরাপর রচনা সমূহে আশ্রয় করলেন তথাকথিত হিন্দুয়ানি বা পণ্ডিতি বাংলাকে; অন্যদিকে মশাররফ বিষাদসিন্ধু-র আলোকিত অঙ্গন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটা সময়ে এসে ডুব সাঁতার কাটতে শুরু করলেন মুসলমান বাংলার ঘোলা জলে। অথচ এমনটা হওয়ার কোনোই সঙ্গত কারণ ছিল না। মানুষের শরীরের হাত, পা, চোখ প্র‌ভৃতি যেমন সহজাত ও বিশেষ প্র‌য়োজনীয় বিষয় বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দও ছিল তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত ও আবশ্যক উপাদান। দীর্ঘ মুসলমান শাসনের সূত্রে বাংলা ভাষায় হাজার হাজার আরবি-ফারসি শব্দ প্র‌বিষ্ট হয়েছিল এবং সেগুলি মিশে গিয়েছিল বাংলা ভাষার রক্তে। এ বিষয়ে ভারতচন্দ্র কথিত ‘জাবনী মিশাল’ ভাষার দৃষ্টান্ত যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে এ গ্র‌ামার অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গোয়েজ এর ভূমিকায় হ্যালহেডের কথন। সেদিনের জনজীবনে প্র‌চলিত বাংলা ভাষার কথা বলতে গিয়ে হ্যালহেড মন্তব্য করেছেন, এখন তাকেই বাঙালি ভদ্রলোক বলে বিবেচনা করা হয় যিনি বাংলা ভাষার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে আরবি-ফারসি ভাষার মিশেল দিয়ে কথা বলতে পারেন। এই যেখানে সামাজিক অবস্থা ছিল সেখানে হিন্দুত্বের ধুয়ো তুলে বাংলা ভাষা ক্ষেত্র থেকে আরবি-ফারসি ভাষার শব্দসমূহকে বিতাড়িত করার কোনো যুক্তি ছিল না; বিশেষত সমকালের মুসলমারা কবিরা যেখানে আরবি-ফারসির মোহ থেকে মুক্ত হএয় তৎসম শব্দনির্ভর ভাষায় কাব্যচর্চ করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন এবং তার ফলিত রূপের দেখা মিলছিল যথেষ্ট মাত্রায়। সগীর থেকে আলাওল, কোনো মুসলমান কবি তাঁদের রচনায় আলাদা করে আরবি, ফারসি বা মুসলমানী শব্দ প্র‌য়োগে উৎসাহী হননি; এমন কি ইসলামি রচনার ক্ষেত্রেও নয়। —‘তবে একজনে তানে স্বপ্নেত দেখিল।/ সব হোন্তে ধিক স্বর্গ প্রভু তানে দিল।।/ সুবর্ণ পালঙ্ক এক বিরাজিত সাজে।/ মণি মুক্তা গ্রন্থিত আছে তাঁর মাঝে।।/ বিহিস্তি অম্বর পিন্দি সেই সুবদনী।/ অঙ্গে নানা অলঙ্কার চমকে দামিনী।।’ উদ্ধৃতাংশ সৈয়দ নুরুদ্দিন এর রাহাতুলকুলুব কাব্যের অংশবিশেষ। এ ভাষা প্র‌তিপন্ন করে, মুসলমান কবিরা সেযুগে বাংলা ভাষার স্বাধিকার রক্ষার পথে কতটা আন্তরিক ছিলেন। একটা পর্বে এসে মুসলমান কবিরা তাঁদের ভাষায় যে বেশি বেশি করে আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, এ ছিল একান্তভাবে ঐতিহাসিক বাস্তবতা প্র‌সূত বিষয়। এর মধ্যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শমাত্র ছিল না। এদিকে উনিশ শতকে এসে অমুসলিম লেখকরা এই বিষয়টির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ অনুভব করে বিপরীত পথে পা রাখলেন; ফলত বাংলা ভাষা-সাহিত্য ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত হল এবং ক্রমান্বয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে সাংঘাতিক ভাবে দগ্ধ হলাম আমরা।

যে কোনো সমাজে যে কোনো সময়ে প্র‌তিক্রিয়াশীল শক্তির ক্রিয়াশীলতা জায়মান থাকে। মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মুসলমান কবিদের অতিরিক্ত বাংলা ভাষা প্র‌ীতিকে পছন্দের চোখে দেখেনি সমাজের একটা অংশ। তাদের বিরুদ্ধতা জারি ছিল প্র‌থমাবধি— ‘আরবী আঙ্গুলে যদি বাঙ্গলা লিখন/ বুঝি শুনি কার্য কৈল্লে পাপ বহুতর/ সত্তর নবীর বোধ তাহার উপর।’ (মুহম্মদ জান, নামাজ মাহাত্য)। তাদের এই বিরুদ্ধতার প্রে‌ক্ষিতে জনৈক কবিকে বলতে হয়েছিল— ‘আরবীতে সকলে না বুঝে ভাল মন্দ/ তে কারণে দেশী ভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ।/ মুসলমানি শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলুঁ/ বহু পাপা হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ।/ কিন্তু মাত্র ভরসা আছএ মনান্তরে/ বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিব আমারে।/মুমীনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক/ অবশ্য গফুর আল্লা পাপ খেমিবেক।’; কবি আবদুল হাকিমকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল অমন জেহাদী উচ্চারণের ছত্রছায়ায়। এই প্র‌তিক্রিয়াশীলরা এতদিনে পায়ের নীচেয় শক্ত জমির স্পর্শ পেল। হিন্দু লেখকরা যদি তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে বাংলা ভাষাকে তাদের মতো করে সুসজ্জিত করে নেয় তবে মুসলমান কবি-সাহিত্যিকরা তা করবে না কেন! করতেই হবে, বলে নিদান দিল তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রে‌ক্ষিতে তাদের দেয় এই নিদান জনমনে গ্র‌হণযোগ্য হল। ফলত পিছনের পায়ে হাঁটতে বাধ্য হলেন মুসলিম লেখকবর্গ। অতঃপর একদিকে যেমন মুসলমানী বাংলার চোরাবালিতে আরও বেশি করে নিমজ্জিত হতে বাধ্য হলেন তাঁরা অন্যদিকে তেমনি উর্দু ভাষার বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা গেল। সমাজমনে তখন এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, বাংলা হিন্দুদের ভাষা; ওই ভাষা ব্যবহার করলে মুসলমানের মুসলমানিত্ব নষ্ট হবে। কাজেই উর্দুকেই গ্র‌হণ করতে হবে জাতীয় ভাষা হিসাবে। উল্লেখ্য, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে এসে এটা প্র‌ায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলমানী বাংলার উপর ভর করে সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ ফসল ফলানো যাবে না। কাজেই মুসলমান সমাজের জন্য উর্দু ভাষার কোনো বিকল্প নেই; এমন সিদ্ধান্ত প্র‌তিষ্ঠা পেয়েছিল। এই প্রে‌ক্ষিতে বাংলা ভাষাপ্রে‌মী মুসলমান সমাজকে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল আর এক সংগ্র‌ামে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল সেই সংগ্র‌ামেরই চূড়ান্ত ফলিত রূপ।

যে সমাজ পরিবেশে কবি আবদুল হাকিম বিরুদ্ধপক্ষের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিতে পেরেছিলেন তাঁর জেহাদী উচ্চারণ সেই সমাজ পরিবেশ তখন আর অবশিষ্ট ছিল না। সাধারণ সমাজ পুরুষদের উষ্ণ সমর্থন রয়েছে উর্দু ভাষার পক্ষে। এমন অবস্থায় কোনো জেহাদী উচ্চারণ রাখতে বা অবস্থান গ্র‌হণ করতে পারলেন না মুসলিম সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা। আর্তকণ্ঠের আর্তিতেই বিশেষ রূপে সিক্ত হতে হল তাঁদের— ‘আমি ভিখারী হইতে পারি, দুঃখ অশ্রুর কঠিন ভারে চূর্ণ হইতে আপত্তি নাই। আমি মাতৃহারা অনাথ বালক হইতে পারি— কিন্তু আমার শেষ সম্বল— ভাষাকে ত্যাগ করিতে পারি না। আমার ভাষা চুরি করিয়া আমার সর্বস্ব হরণ করিও না। …মাতৃভাষাকে কেমন করিয়া ভুলিব? এমন অসম্ভব প্র‌স্তাব করিয়া আমার জীবনকে অসাড় ও শক্তিহীন করিয়া দিতে চায়— কে? বিদেশী ভাষায় কাঁদিবার জন্য— কে আমাকে উপদেশ দেয়? (সাম্যবাদী, কার্ত্তিক ১৩৩২) । সৈয়দ এমদাদ আলীর এই উচ্চারণ সেদিন একক বা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় ছিল না। সেদিন এমন হাজারও রক্তাক্ত উচ্চারণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন এমদাদ আলীর সহোদররা— ‘কেমন করিয়া আমার প্রি‌য়তম স্বজাতি বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মধ্যে বাঙ্গালা ভাষার অবাধ প্র‌চার করিব, কেমন করিয়া তাহাদের ভ্রান্ত কুহেলিকা ও জড়তা মোচন করিয়া তাহাদিগকে মাতৃভাষার পুণ্যমন্দিরে লইয়া আসিব এবং কেমন করিয়া তাহাদের মধ্যে মাতৃভাষার সাহায্যে জাতীয় সাহিত্য গঠনের প্রে‌রণা জাগাইয়া দিব।’ (সেখ আবদুর রহিম) ‘ভাষা মানবজাতির উন্নতির সর্ব্বপ্র‌ধান কারণ। পৃথিবীতে যখন যে জাতি গৌরবের পতাকা উড়াইয়াছেন, তখনই দেখিতে পাইবেন, সে জাতি আপনার মাতৃভাষাকে পরিপুষ্ট সমলঙ্কৃত পরিপূর্ণ এবং সমুজ্জ্বল ও সুমাজ্জিত করিয়াছেন। …মাতৃভাষা প্র‌াণের ভাষা— ইহা পবিত্র এবং পূজ্য। ইহার সেবা না করিলে ঘোরতর অধর্ম্ম হয়। বর্ত্তমান সময়ে বঙ্গীয় মুসলমানদিগের মাতৃভাষা বাঙ্গালায় পরিণত হইয়াছে। …ভ্রাতঃ বঙ্গীয় মুসলমান। আর নিদ্রিত থাকিও না। বাঙ্গালা ভাষাকে অবহেলা এবং অশ্রদ্ধা না করিয়া ইহার সেবা করিতে প্র‌বৃত্ত হও।’ (মাতৃভাষা ও জাতীয় উন্নতি— ইসলাম প্র‌চারক, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি ১৯০২)। বলার অপেক্ষা রাখে না, এইসব উচ্চারণই প্র‌স্তুত করেছিল ২১শের পটভূমি। মনে রাখতে হবে, একুশে ফ্রেবুয়ারি অবশ্যই ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া বা বিছিন্ন কোনো বিষয় ছিল না। ইতিহাসের মাটিতে বহুদূর পর্যন্ত প্র‌সারিত ছিল মূল। —‘আমাদের অনেকের মোহ ছুটে নাই। তাঁহারা বাঙ্গালার বাঁশবন ও আম্রকাননের মধ্যস্থিত পর্ণকুটিরে নিদ্রা যাইয়া এখনও বোগ্‌দাদ, বোরখা, কাবুল, কান্দাহারের স্বপ্ন দেখিয়া থাকেন। কেহ কেহ আবার বাঙ্গালার পরিবর্ত্তে উদ্দুর্কে মাতৃভাষা করিবার মোহে বিভোর। দুবর্বল ব্যক্তিরা যেমন অলৌকিক স্বপ্ন দর্শন করে, অধঃপতিত জাতিও তেমনি অস্বাভাবিক খেয়াল আঁটিয়া থাকে।’ (হামেদ আলী, উত্তরবঙ্গের মুসলমান সাহিত্য, বাসনা, বৈশাখ ১৩১৬)। —‘বাঙ্গালার মাটি হইতে উদ্দুর্কে নিব্বার্সিত করিতে না পারিতে বাঙ্গালা ভাষা বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না। মাতৃভাষার বিপুল ও তুমুল চর্চ্চা ব্যতিত কোনও জাতির মুক্তি ও কল্যাণ লাভ কদাপি সম্ভবপর নহে।’ (সম্পাদক, নূর, বাঙ্গালা ভাষার অনাদর, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩২৬) —‘বঙ্গভাষার আদর্শ হওয়া উচিত। উহা কাহারও বুঝিতে কষ্ট হইবে না। উহা সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃতের প্র‌ভাবমুক্ত নহে, আবার সংস্কৃতবহুলও নহে। …বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তর্দৃষ্টি প্র‌খর ছিল বলিয়াই তিনি তাঁহার নিজের ভাষাকে শেষ জীবনে এমন আকৃতি দিয়াছিলেন। (এমদাদ আলী, বঙ্গভাষা ও মুসলমান সমাজ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৫)

কোনো সন্দেহ নেই যে, একুশ বাঙালিকে উপহার দিয়েছে এক আলোকিত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। এদিকে এ নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, এই ভবিষ্যতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বিরুদ্ধ শক্তি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং তাদের সে কার্যক্রমের অভিঘাতে ভিতরে বাইরে দগ্ধ হচ্ছি আমরা। একদিন যে শক্তি বাংলা ভাষাকে খুব করে হিন্দুত্বের রঙে রঞ্জিত করে বাংলা ভাষাপ্রে‌মীদের পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন আজ তারাই শুরু করেছেন অন্য খেলা। তারা চান না বাংলা ভাষা আপামর বাঙালির প্র‌াণের সামগ্র‌ী ও আত্মপ্র‌কাশের মাধ্যম হয়ে উঠুক। তারা চান, বাংলা ভাষাকে একান্তভাবে কুক্ষিগত করতে রাখতে; তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে। তারা জানেন, তাদের এই কায়েমী স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর পথ হল, বাংলা ভাষাকে তার নিজস্বতার ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে এনে আরও বেশি বেশি করে সংস্কৃতের পোষাকে সজ্জিত করা। এটা করা হলে, বিশেষ একটা শ্রেণির বাইরে অন্যেরা বাংলা ভাষার উপর সেভাবে কর্তৃত্ব করতে পারবে না এবং তাদের কায়েমী স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। এমন ভাবনা থেকেই তারা বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছেন সংস্কৃতের আদলে; বাংলা শব্দের বানানে বহন করার চেষ্টা করছেন সংস্কৃতরীতির ঐতিহ্য। ওয়াকিবহাল মহল মাত্র অবগত আছেন যে, অদ্যাবধি বাংলা ভাষার কোনো প্র‌কৃত ব্যাকরণ রচিত হয়নি। বাংলা ভাষার নামে যে ব্যাকরণ এখন প্র‌চলিত আছে তা কার্যত সংস্কৃত ব্যাকরণের বাংলা সংস্করণ মাত্র। একটা সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতো করে উদ্যোগী হয়েছিলেন; রচনা করেছিলেন শব্দতত্ত্ব ও বাংলা ভাষার পরিচয়। তাঁর এই কৃতির সূত্রে উন্মুক্ত হয়েছিল বিরাট এক সম্ভাবনার দুয়ার। কিন্তু এই সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সেভাবে জলসেচন করা হয়নি উত্তরকালে; হয়তো বা সচেতনভাবে। অব্যাবধি বাংলা ভাষায় যে বর্ণমালা প্র‌চলিত রয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক। এখানে এমন অনেক বর্ণ বর্তমান যার কিছুমাত্র ব্যবহার নেই; আবার এমন অনেক বর্ণের অস্তিত্ব নেই যার বহুল ব্যবহার বর্তমান। ‘ণ’, ‘শ’, ‘ষ’ প্র‌ভৃতি বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ অপ্র‌চলিত বিষয়। অথচ এসবকে বহন করা হচ্ছে দিনের পর দিন; অন্যদিকে ‘অ্যাখন’-কে লেখা হচ্ছে ‘এখন’। বাংলায় ‘অ্যা’ এর ব্যবহার নেই তাই এমন করতে হচ্ছে। এবং এখানেই শেষ নয়। বস্তুত সমস্যার শেষ নেই প্র‌চলিত বাংলা লেখনরীতিতে। একদিকে যেমন বাংলা বর্ণের বিপুল সংখ্যাধিক্য রয়েছে অন্যদিকে তেমনি রয়েছে গঠনগত জটিলতা। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে যথাযথভাবে লিখতে পারেন খুব কম জন। অথচ এমনটা না হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল না। ম-এর পর ঙ-এর নিচে গ লিখে অনায়াসে মঙ্গল কথাটা লেখা যেত। আমরা তা করিনি, করার প্র‌য়োজন আছে বলেও অনেকক্ষেত্রে স্বীকার করি না। যুক্তি দিয়ে বলি, এতকাল তো এ নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি! কিন্তু কে না জানে অসুবিধা হয়েছে এবং সময়ে সময়ে তা অত্যন্ত মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বাংলা বর্ণরূপের সংখ্যা কয়েক শত। এমন বিরাট সংখ্যক বর্ণরূপকে আয়ত্ত করা মোটেই সহজসাধ্য নয়। একটা পর্যায়ে এসে আমরা বড়োরা হয়তো এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই অভ্যস্ত হয়ে ওঠাই শেষ কথা নয়। কেন না আমরা (তথাকথিত শিক্ষিত জনরা) আসলে সংখ্যায় যৎসামান্য, অন্য অর্থে নগণ্য প্র‌ায়। আমাদের বাইরে রয়েছে বিরাট এক জনগোষ্ঠী, যারা কোনোদিনই এই বিরাট সংখ্যক বর্ণরূপকে আয়ত্ত করতে পারে না। ফলত তাদের মাতৃভাষা তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরের বিষয় হিসাবে থেকে যায়। ছোটোদের দিক থেকে বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। এমনও লক্ষ করা গেছে, পাঠভবনের মতো ওইসব নামী স্কুল সেখানে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় সেখানে একটা সময়ে এসে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ইংরেজি ভাষার উপর মনোনিবেশ করে। বাংলা ভাষার এই লিপি-সমুদ্র সন্তরণ করার বিষয়টি কিছুতেই উপভোগ করতে পারে না তারা।

শুধু কী লিপির সমস্যা! মোটেই নয়। বানানের সমস্যা তার থেকে হাজার গুণ গুরুতর। ই-ঈ, উ-ঊ, ণ-ন, শ-ষ-স জনিত বাধার প্র‌াচীর অতিক্রম করতে গিয়ে রীতমতো ঘাম ছুটে যায় আমাদের। সারা জীবনজুড়ে ছোটাছুটি করতে হয় অভিধান নিয়ে। ছাত্রদশা আর কিছুতেই ঘোচে না। বানান নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে বহুদিন ধরে; সেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বাংলা বানান সংস্কারের উদ্যোগ গ্র‌হণ করা থেকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফললাভ হয়নি আজও। বরং বলা চলে স্থানে স্থানে রীতিমতো অশ্বডিম্ব পোষণ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমির উদ্যোগে যে বনান সংস্কারের পক্ষে যে নেওয়া হয়েছে তা তুলনায় আশাব্যঞ্জক হলেও বাংলা ভাষার রাহুমুক্তির লক্ষ্যে কোনো নিদান দেওয়া হয়নি এখানে। বলা যায়, পুরনো পানীয়কে যুগের চাদিহার সঙ্গে কমবেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে পরিবেশন করা হয়েছে। তৎসম শব্দ হলে তথায় সংস্কৃত বানান রীতি অনুসৃত হবে; অর্থাৎ সংস্কৃত মূলে যদি ঈ-কার থাকে বা শ থাকে তবে বাংলা বানানেও তা বজায় রাখতে হবে। কিন্তু কেন! সংস্কৃত উচ্চারণরীতি থেকে সরে এসে বাঙালিরা যেখন নিজস্ব উচ্চারণ রীতিতে স্থিত হয়েছে এবং সেটাই ভাষার বিবর্তনের সাধারণ রীতি সেখানে কেন বানানে সংস্কৃতানুগ হতে হবে। এ এক ধরণের অন্ধ আনুগত্য; এমন অন্ধ আনুগত্য কোনো ভাষা সম্প্রদায়কে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় এবং ভাষার ভাষার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। প্র‌চলিত লেখ্য বাংলা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনোরকম আশ্রয় দিচ্ছে না বাঙালি আম জনতাকে। তারা তাদের মাতৃভাষা-ক্ষেত্র থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং জাতির ভবিষ্যককে নিক্ষেপ করছে অন্ধকারের গভীরে।

আমাদের অভিজাত সমাজ একদিকে যেমন সংস্কৃত ভাষাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে বাংলা ভাষা ক্ষেত্রে তাদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখার সুবন্দোবস্ত করেছে অন্যদিকে তারাই আবার বাংলা ভাষার সতীন এর আসনে প্র‌তিষ্ঠিত করেছে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাকে। অভিজাত বাঙালির ইংরেজি ভাষাচর্চা আজকের বিষয় নয়, ইংরেজ অধিকারের প্র‌থম দিন থেকে এর প্র‌চলন রয়েছে। কিন্তু সেদিনের সেই ইংরেজিচর্চা ও আজকের ইংরেজি প্র‌ীতির মধ্যে তৈরি হয়েছে আসমান জমিন ব্যবধান। সেদিনের অভিজাত বাঙালি ইংরেজি ভাষার চর্চা করতো, পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও আয়ত্ত করতো উত্তম রূপে; তারা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতে লিখতে পড়তে সিদ্ধ হস্ত ছিল; ইয়ংবেঙ্গল গোষ্টীর সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে। এখন কিন্তু তা হচ্ছে না। এখনকার অভিজাত সমাজের একটা অংশ লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে নিতান্ত ব্রাত্য বিষয় বলে মনে করে; তাদের ধারণা লেখ্য বাংলা বন্ধ্যাত্মের দোষণে দুষ্ট; এ ভাষার মনের কথা বলা তো বটেই, কাজের কথাও যথাযথভাবে বলা যায় না। তারা তাই ইংরেজিতে লেখালিখি করে। কে না জানে, এখন দেশীয় ক্ষেত্রে হিন্দি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইংরেজি-র একাধিপত্য। কর্মক্ষেত্রে প্র‌তিষ্ঠিত হতে হলে হিন্দি বা ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। তাই তারা নিজেরা তো বটেই তাদের ছেলেমেয়েদেরকেও হিন্দি ও ইংরেজিতে রপ্ত করে তুলছে; তাদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করছে ইংরেজি মাধ্যম এমন সব স্কুলে সেখানে বাংলা ভাষাকে নিতান্ত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়। ফলত ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বাংলা ভাষা ক্রমশ নির্বাসিত হচ্ছে অভিজাত বাঙালির মানসক্ষেত্র থেকে। কখনো কখনো এমনও দেখা যাচ্ছে, কোনো একটি সভায় উপস্থিতজনদের মধ্যে সকলেই বাঙালি, সকলেই বাংলা ভাষায় বাক্যালাপ করতে অভ্যস্ত, তথাপি সেখানে ইংরেজি ভাষায় সভার কাজ পরিচালিত হচ্ছে। স্থানে স্থানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অভ্যাস না থাকার কারণে কেউ চাইলেও বাংলা ভাষায় তার বলার কথাকে গুছিয়ে বলতে পারছে না।

একটা জাতির সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্মকে নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু করার দরকার তার সবটাই করেছি বা করতে চলেছি আমরা। কোনো সন্দেহ নেই, এক দূষিত ও বীভৎস ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ওপার বাংলার বাঙালি সমাজ তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু মনে তাদেরও দূর ভবিষ্যৎ খুব নিরাপদ নয়। ওখানকার নতুন প্র‌জন্ম এখন বাইরে বাইরে একুশের ঐতিহ্যকে যথেষ্ট পরিমাণে বহন করলেও একুশের নিহিত সত্যের উত্তাপে আর সেভাবে তপ্ত হচ্ছে না। তাদের জীবনযাপনে ও মননে একটা বৈশ্বিকতা ক্রমশ প্র‌কট হচ্ছে। এমন অবস্থার তাদের পক্ষেও অদূর ভবিষ্যতে একুশের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

এখন কথা হল, এই নষ্ট ভবিষ্যৎকে প্র‌তিহত করা যেতে পারে কোন পথে, কীভাবে। মনে রাখতে হবে, পথ আছে এবং সে পথ বন্ধুর হলেও একান্ত দুর্গম নয়। আসলে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির পথে যেমন বেশ কিছু প্র‌তিবন্ধকতা রয়েছে তেমনি রয়েছে অতি সম্ভাবনাময় কিছু বিষয়ও। অনেক প্র‌তিবন্ধকতা সত্ত্বেও অদ্যবাধি নিয়মিতভাবে প্র‌কাশিত বাংলা ভাষাশ্রিত বই এর সংখ্যা অগণিত; পাশাপাশি রয়েছে বিরাট সংখক পত্র-পত্রিকা। বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে এখন নিয়মিতভাবে প্র‌কাশিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা কয়েক সহস্র‌। একটি আঞ্চলিক ভাষাশ্রিত এত অধিক সংখ্যক পত্র-পত্রিকার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আছে বলে আমাদের জানা নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, এইসব পত্র-পত্রিকার সিংহভাগই অবাণিজ্যক। বাঙালিরা তাদের ঐকান্তিক সাংস্কৃতিক চেতনায় স্নাত হয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্র-পত্রিকা প্র‌কাশ করে থাকে। খুবসম্ভব কোনো আঞ্চলিক ভাষাশ্রিত কবিতা গ্র‌ন্থের সংখ্যা বাংলা-তেই বছরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় প্র‌কাশিত হয়। প্র‌তিদিনই কোনো না কাব্যগ্র‌ন্থ প্র‌কাশিত হচ্ছে। একটা ভাষা-সংস্কৃতিকে ভিতর থেকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে এর থেকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে!

অর্থাৎ বাঙালিদের মধ্যে একটা শ্রেণি যেমন বাংলা ভাষাকে রীতিমতো গলাধাক্কা দিচ্ছে অন্য একটা শ্রেণি তেমন তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিপ্র‌তীপতা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্র‌থম ও প্র‌ধান কথা। সেই প্র‌থম দিন থেকে এই প্র‌বণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সেন রাজন্যবর্গ যখন বাংলা ভাষাকে দলিত মথিত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল তখন তাদেরকে প্র‌তিহত করেছিল সেদিনের নিম্নবর্ণীয় বৌদ্ধ সমাজ; আজও তেমনি ইউরোপীয় ও তথাকথিত ভারতীয়ত্বের প্রে‌মে মুগ্ধ জনসমাজ যখন বাংলা ভাষাকে যাদুঘরের সমাগ্র‌ীতে পরিণত করার পরিকল্পনা করেছে তখন একে রক্ষা করার জন্য প্র‌াণপণ করেছে একটা শ্রেণি; তাদের হার না মানা মানসিকতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সবমিলিয়ে লড়াই বেশ জমে উঠেছে। এই লড়াই এ কারা শেষাবধি জয়লাভ করবে তা ভবিষ্যৎ বলবে; তবে ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে প্র‌তীয়মান হচ্ছে এক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের পরাভবের প্র‌বল সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *