সত্যজিতের মনমোহনের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

সত্যজিতের মনমোহনের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন – কৌশিক চট্টোপাধ্যায়,  অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূমিকা

একটা ভাষা বেঁচে থাকে তার ব্যবহারকারী ব্যক্তিসমষ্টির আলাপচারিতায়, সেখানে সময়ের সাথে সাথে তার পরিবর্তন আসে, আসবেই। সেখানে যদি কোনো ভাষা তার নিজেকে যুগের হওয়ার তালে তাল মিলিয়ে নিতে না পারে তবে সে ভাষার গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাবে;আর ভাষার সাথে তার আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গী সবই অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে থাকে। এখানে দেখা যায় বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতি আঞ্চলিকতা ভেদে একটা বড় বৈচিত্রের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে মান্য ভাষা যা অনেকটাই কলকাতা শহরকেন্দ্রিকতা দোষে দুষ্ট। আরেকটি অংশে আঞ্চলিকতাপুষ্ট বাংলা ভাষাকে কিছুটা দুয়োরানী ভাব লক্ষ্যণীয়।

সুকুমার পুত্র সত্যজিৎ রবীন্দ্র স্নেহছায়ায় ‘ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া একটি ধানের শিসের উপর একটি শিশির বিন্দু’ দেখবার যে দর্শন লাভ করেছিলেন তার বহিঃপ্রকাশ আগন্তুকেও সমান ভাবে বর্তমান। এ চলচ্চিত্র দর্শককে যেন সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির ধারণা ও সংস্কৃতির আগ্ৰাসনের স্বরূপকে দেখিয়ে দেয়।

আগন্তুকে সত্যজিতের মনমোহন চরিত্র কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের প্রয়োজনের একটা চরিত্র তাই নয়— সে একটা নিজের ভাষা-সংস্কৃতির সচতেন রক্ষক; যিনি সারা পৃথিবী চষে বেড়াবার পরেও নিজের ভাষা, সংস্কৃতির কোনো কিছুই ভুলতে চাননি বলেই ভোলেননি— বরং কোথায় যেন— সারা পৃথিবীকে জানবার নেশায় জেনেছেন আর তাই বলে নিজের ভাষা-সংস্কৃতি কে খাটো করে অবহেলা করেননি।

প্রেক্ষাপট

সত্যজিৎ তার এই চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে বাঙালি সমাজের সেই দিকটাকে বার বার করে দেখালেন— যে একদিকে শহুরে জীবনে পাশ্চাত্য ভাবনায় খাপ খাওয়া, যা প্রবল ভাবে তৈরী করা বাঙালি সংস্কৃতি— ক্রমাগত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ভাবনা গ্রাস করছে তথাকথিত আধুনিক হবার তাগিদে— আর একটা চিরন্তন বাঙালি সংস্কৃতি যা ফল্গু ধারার মত ভিতরে প্রবাহিত হচ্ছে। চলচ্চিত্রটিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। ছবিতে ছিলেন দীপঙ্কর দে, মমতা শঙ্কর, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ। চলচ্চিত্রটি সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন তার ছোটগল্প ‘অতিথি’ থেকে। ইন্দো-ফ্রেঞ্চ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবিটি ১৯৯২ সালে ভারতের সেরা ছবি ও সেরা পরিচালনার জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।

উদ্দেশ্য

১) একজন ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে ভাষার— সংস্কৃতির আগ্রাসনমূলক ভাবনাকে আন্দোলিত করানো।

২) চলচ্চিত্র যেহেতু মানব মনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাই তাকে নিয়ে সংস্কৃতির পরিবর্তন যা বদলের নামান্তর তাকে দেখান।

৩) সমাজ-সংস্কৃতির দর্পন হিসাবে কিভাবে একটা চলচ্চিত্রর শিক্ষামূলক প্রভাব।

গবেষেণার পদ্ধতি

এই গবেষণাপত্রটি মূলত শিক্ষাবিজ্ঞান গবেষণামূলক পদ্ধতিকে অনুসরণ করে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে রচনা করা হল।

গবেষেণা মূলক প্ৰশ্ন

১) সংস্কৃতির আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্র উদহারণ হতে পারে কিনা সে বিষয়ে পর্যালোচনা?

২) একটি চলচ্চিত্রর চরিত্র কি ভাবে সংস্কৃতি রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে (মনমোহন মিত্র )?

৩) সমাজ-সংস্কৃতির দর্পন হিসাবে কিভাবে একটা চলচ্চিত্রর শিক্ষামূলক প্রভাব কতটা বিস্তারিত?

চলচ্চিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন – চরিত্র বিশ্লেষণে

মনমোহন মিত্র (উৎপল দত্ত)

সত্যজিৎ বার বার করে দেখিয়েছেন একটা বিষয়— যে ভাষাই হোক বা সংস্কৃতিই হোক— তাকে যত্ন করে লালন পালন করাটাই মূল কথা— তবে তা ঠিক না ভুল সে যাচাইয়ে যেতে হলেও তাকে বার বার কে বিচার করতে হবে। সবাইকে একটা পরশপাথরে যাচাই করে নিচ্ছেন যেন কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন।

তার জীবনের ৩৫ বছরের একটা বড় অংশ মনমোহন মিত্র কাটিয়েছেন বিভিন্ন আদিবাসীদের সাথে। সাঁওতাল, কোল,ভীল, নাগা, মুণ্ডা, মুরিয়া, নারিয়া, ওরাও, টোরা সহ নানা ভারতীয় উপজাতিদের ও ৪৩টি রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিদের সঙ্গে কাটিয়েছেন মনোমোহন।

প্রসঙ্গ সূত্রে মনমোহন বলেছে— ‘আদিবাসীরা এখনো পর্যন্ত অনেক সভ্য, কারণ তাদের অন্তত কাউকে এতটা অবিশ্বাস করা লাগে না, জ্ঞানের বহর দেখিয়ে মানুষকে ছোট করা লাগে না! সত্যি বলতে, সভ্যতার এই ধারণা সত্যজিৎ রায়ের নিজের নয়, তিনি এটা পেয়েছিলেন ফরাসী নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেভি স্ট্রাউসের কাছ থেকে। অবশ্য এর দায় স্বীকার করতে তিনি ভোলেননি।’

একটা নাগরিক সভ্যতা এবং তথাকথিত জংলী সভ্যতার পার্থক্যর বিভেদ ও আগ্রাসী মনোভাব বোঝান, এই প্রসঙ্গান্তরের সংলাপে মনমোহনের মুখে— ‘ঘর ছাড়ার অনেক আগে আমার মজ্জার মধ্যে ঢুকে গেছে সেক্সপীয়ার বঙ্কিম মাইকেল মার্ক্স ফ্রয়েড রবীন্দ্রনাথ সে জন্যই তো আমার ফিল্ড নোটস এর দরকার হয়’। আবার বললেন “সভ্য কে জানেন? সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি বোম নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসীসমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।” একইভাবে যখন ব্যঙ্গের সাথে তীব্রে ক্ষোভে বলেন— নাসা আর তার পাশেই নেশা, হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ দিয়ে নিজের দেহে ভয়ঙ্কর মাদকরস চালান দিয়ে সমনকে সমন জারি করছে বিশ্বের লক্ষ্য তরুণ, বোতামে টিপ দিয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা হচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হচ্ছে শহর, এগুলোকে সভ্যতা বলে মানেন না তিনি। আর এভাবেই সভ্যতা সংস্কৃতির আগ্রাসন হয়ে চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে।

কথা প্রসঙ্গে বলেন স্ট্রাগল— যেটা বাঙালির খুব প্রিয় শব্দ সে সম্পর্কে বলেন যদিও শব্দটিতে বিদেশি ভাষা আপনত্বের সূক্ষ্ম মনোভাব লুকিয়ে থাকে মনমোহন বলেছে ‘স্ট্রাগল বলি না, বলি মগজের পুষ্টি, মাংসপেশীর পুষ্টি আর মানুষ চেনার পথে প্রথম পদক্ষেপ।’

বিশ্বের নানা লোক-অধিবাসীদের সঙ্গে সময় কাটানো মনমোহন দেখেছে— যে তারা তাদের সংস্কৃতি ও ভাষায় বহিরাগত ছোঁয়া/আগ্রাসন থেকে দূরে থাকবার চেষ্টা করে গেছে অনবরত, তাঁরা নিজেদেরকে অন্যের ভাষার আগ্রাসন থেকে বেশ কিছুটা বাঁচিয়ে আলাদা করে রেখেছে। তবে ভাষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো ভাষার শব্দ ভান্ডার তখনই সমৃদ্ধ হয় যখন অন্য কোন ভাষার আদানপ্রদান ঘটে থাকে— সে দিক থেকে দেখলে লোকভাষার সেই প্রবণতা বেশ কম যা কখনও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে অনিলা আর তার স্বামী সুধীন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে সেখানকার সাঁওতালদের গ্রামে যেতে হয়। তাদের কথা বলতে-বলতে মনোমোহনের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠে আমাদের দেশের জনজাতির ঐতিহ্যের গর্বে, তাদের ব্রিটিশ-বিরোধী ঐতিহ্যের গর্বে, প্রসঙ্গ সূত্রে মনমোহন বলেছে— ‘ভারতবর্ষের প্রাচীনতম অধীবাসী হচ্ছে কোল উপজাতী, সাঁওতালরা ওদেরই সমগোত্রীয়, আজ থেকে ১৫০বছর আগে ওরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল’। এ পর্বে সত্যজিৎ দেখালেন সংস্কৃতিকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে ধরে রাখার তাৎপর্য।

পৃথ্বীশ সেনগুপ্তের (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়)

একটা সবজান্তা সবটাই নিজের ছাঁচে ফেলে দেখে নেওয়ার মানুষ উকিল— পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত, আগন্তুকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ পৃথ্বীশের সাথে মনমোহনের কথোপকথন। এই আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, পৃথ্বীশ চরম আক্রোশে বলছে, “আপনি নো বডি না সামবডি, তা এদের বলে দিচ্ছেন না কেন?” সে মনোমোহনকে প্রশ্ন করেছিল ‘‘ক্যানিবালিজম-কে আপনি সভ্যতার কোন স্তরে ফেলবেন?’’ এই পুরো জেরা পর্বের প্রশ্ন কিন্তু এটাই। আর এখানেই “অতিথি নারায়ন” —এই বাঙ্গালী সংস্কৃতির পরিপন্থী হয়ে অচেনা আগন্তুকের পরিচয় পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে আসল মানুষের নাগাল পাওয়ার উদগ্র বাসনা ফুটে ওঠে।

শীতল সরকার (অজিত বন্দ্যোপাধায়)

আবার কোথাও আন্তরিক বাঙালি মনোভাবসম্পন্ন মানুষ (শীতল বাবু)— ‘এসো মা এসো এসো’, ‘দাদু ভালো আছতো’, ‘ভালো কথা ওর মাথার কোনো ব্যামোটামো…’ সংলাপে ফুটে উঠেছে।

রঞ্জন রক্ষিত (রবি ঘোষ)

আবার মজা দেখবার মানসিকতা সম্পন্ন বাঙালি (রঞ্জন রক্ষিত)— ‘আমার পেটে বোমা মারলেও এ কথা বেরোবে না’ বাঙালির পেটপাতলা সংস্কৃতি, প্রসঙ্গ সূত্রে মনমোহনের পাল্টা প্রশ্নে ‘একটা প্রশ্ন করতে পারি, আপনারা আমাকে কেমন দেখলেন?’ আর স্বস্ত্রীক রঞ্জন রক্ষিতের ছলনায় অপ্রস্তুত মনোভাব।

অনীলা বোস (মমতা শঙ্কর)

দোটানার দ্বন্দ্বে ভোগা এক বাঙালি চরিত্র (মমতা শঙ্কর), বাঙালির (ভারতবর্ষের) চিরপরিচিত আতিথেয়তার ভরসায় সে পা রাখছে ভাগ্নীর বাড়িতে, অগ্নিমূল্যের বাজারে একজন অনাহুতের পেছনে এতগুলো টাকা খরচ করা যা দোটানায় ভোগা বাঙালি সংস্কৃতিকে দেখায়; আবার পরিপাটি করে বাঙালি আপ্যায়নের ব্যবস্থা একটা বৈপরীত্য সংস্কৃতির— গয়নাবড়ি প্রসঙ্গে ‘মেদিনীপুরের বৌ-ঝিয়েরা নিজেরা বাড়ীতে তৈরী করে‘ বাঙালির গ্রামের সংস্কৃতি যা শহরের লালিত্যে শোভা পাচ্ছে, এভাবেই শহুরে ও গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রভেদ তুলে ধরেছেন সত্যজিৎ। (প্রসঙ্গত— স্থানীয় লোকাচার, গাথা, ছড়ায় বড়ির উল্লেখ চোখে পড়ে। যেমন— “খুকুমণি কেন ভারি/ পাতে নেই যে গয়না বড়ি।”) আবার প্রসঙ্গ সূত্রে মনমোহন মিত্র বলেছে ‘আহারের এত বাহার এ শুধু বাংলা দেশেই সম্ভব’— বাংলার লুপ্তপ্রায় খাদ্য শিল্প বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন পরম নিপুণতায় তুলে ধরেছেন সত্যজিৎ। বা ঘরের পুরুষদের খাইয়ে তবেই মহিলারা খেতে বসেন এ রীতিও তুলে ধরেছেন।

সুধীন্দ্র বোস (দীপঙ্কর দে)

আবার সুধীন্দ্র বোসের চরিত্রে অভিনয় করা বাঙালি যে কিনা ব্যালেন্সড ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে রেখে দেন ও কোন পথে তিনি নেবেন নিজেকে তার পরিমাপ করেন, তবে কোথাও যেন একটু আধুনিকতার যুগের হাওয়ায় তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টায় থাকেন তিনি। অনীলার স্বামী সুধীনের দিকে পাসপোর্ট ছুড়ে দিয়ে বলেন প্রসঙ্গ সূত্রে মনমোহন মিত্র বলে— “পাসপোর্ট দিয়ে কিচ্ছু প্রমাণ হয় না”। অনীলার ছোটমামা আসল কি না তা জানতে সুধীনের আগ্রহ ছিল তার পাসপোর্টের দিকে। কিন্তু মনমোহন তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে, আজকাল জাল পাসপোর্ট বানানো তেমন কিছু খাটুনির কাজ নয়! —এইটাই গ্রাম্য সংস্কৃতির থেকে শহুরে সংস্কৃতির আগ্রাসন। সুধীন্দ্র বোসের কথায় ‘আমার যদি কোনো ক্রনিক ব্যারাম থেকে থাকে সেটা হচ্ছে চক্ষুলজ্জা’ বা ‘আপনি তো আছেন কুলো, বাতাস’ —সেই বিচিত্র শহুরে জীবনের লোকাচার।

সাত্যকি বোস (শিশু চরিত্র )

চলচ্চিত্রের শিশু চরিত্র সাত্যকি— যার শিশু মন নিয়ে সে নিজের মতন কে বিচার করে নেয়— পুরোটাই একটা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত করা। তার কিছু বক্তব্য— ‘আররিবাস -জাল দাদু’ বা ‘দাদু হতেও পারে নাও হতে পারে’। সূর্যের পূর্ণগ্রহণ, চাঁদের পূর্ণগ্রহণের বিষয় শেখাতে শিশু মনে দাদু নাতির সম্পর্কের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন প্রসঙ্গ সূত্রে মনমোহন মিত্র বলেছে— ‘এবারে একটা ম্যাজিক’/ ‘বলতো চাদ বড়ো না সূর্য বড়ো’/ ‘আকাশে তো দুটোকে দেখে একই সাইজ মনে হয়’/ চাঁদ যখন সূর্যের উপর এসে পড়ে ‘একদম চাকতি চাকতি মিলে যায়’; মনমোহনের মুখে “হাসির চেয়ে ভালো থ্যাঙ্কইউ আর হয় না”। দাদু হলেন তার ‘ছোটদাদু’, যিনি কিনা যখন তখন ছুট লাগাবেন! দাদু সাত্যকিকে বলে দেন, আর যা-ই হোক, কখনো কূপমন্ডূক না হতে!— বাঙালির কূপমণ্ডুক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন, এর পাশাপাশি শৈশবের সারল্যকেও দেখিয়েছেন সত্যজিৎ।

গবেষণা সন্ধান সূত্রে প্রাপ্ত ফলাফল

১) চলচ্চিত্র যেহেতু সমাজ-সংস্কৃতির ছবির প্রতিফলন ঘটায় অনেকটা আয়নার মত, সেক্ষেত্রে এর একটা বড়ো ভূমিকা আপামর সাধারণ ব্যক্তিবর্গের অংশ শিক্ষার্থীর মনোভাব পরিবর্তনে কাজে লাগানো যেতেই পারে— আগন্তুকও সেইরকম একটি উদাহরণ।

২) আগন্তুকে সত্যজিৎ দেখিয়েছেন দেশ কাল ভেদে তথাকথিত সভ্য সমাজ ও মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের সংস্কৃতি কিভাবে মনের অভিব্যাক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, শিক্ষাক্ষেত্রে এটা শিক্ষার্থীর কাছে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরাই যায়।

৩) ‘ভাষা – সাহিত্য – সংস্কৃতি’ যদি কেউ নিজের থেকে ভুলে যেতে চায় তবে সে ভুলতেই পারে আর যদি কেউ তা না চায় তবে সে তাকে নিজে ভিতর বাঁচিয়ে রাখে স্বযত্নে— এ সবের বড়ো উদহারণ সত্যজিতের মনমোহন মিত্র— এ শিক্ষার্থীর কাছে ‘ভাষা – সাহিত্য – সংস্কৃতির’ আগ্রাসন ঠেকাবার বড়ো উপায়।

উপসংহার

চলচ্চিত্র যেহেতু সমাজের ভাবনার দর্পন তাই তাতে সমাজে পরিবর্তনের বিষয়ও এনেছেন, তা শুধু সিনেমা বানাবার জন্য তা কিন্তু নয় একটা বার্তা তিনি দিচ্ছেন— নিজের ভাষা-সংস্কৃতিকে লালন পালন করতে হবে কিন্তু তার সব খারাপ বলে তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্যের স্রোতে গা ভাসানো যেমন যাবে না তেমনই রক্ষণশীলতার দোহাই দিয়ে কুসংস্কার কে আঁকড়ে ধরে বাঁচাও যাবে না, তবে মধ্যে পন্থা নয় এতে অবশ্যই খোলা মনে বিচার বোধ দিয়ে বিচার করে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। মৃণাল সেন ‘আগন্তুক’-এর সংলাপ নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবে মন্তব্যই করেছিলেন ‘‘দ্য ওয়ার্কিং আউট অব দ্য ওয়ার্ডস অ্যান্ড লাইনস মে বি লাইকেন্ড টু আ মাস্টার পেন্টার প্লেইং উইথ ব্রাশ অ্যান্ড কালার।’’

শঙ্খ ঘোষ তাঁর একটি গদ্যে আমাদের খেয়াল করিয়ে দেন ‘‘ও-ছবির শেষ দিকে সাঁওতালি নাচটার কথা ভাবুন। মনোমোহনের পাশে দাঁড়িয়ে সুধীন্দ্র আর অনিলা দেখছে সেই নাচ, মুগ্ধ ট্যুরিস্টরা যেভাবে দেখে। কিন্তু দেখতে দেখতে, অনিলার শরীরে অল্প অল্প দোলা লাগে, বোঝা যায় তার ভিতরে আসছে নাচ। সুধীন্দ্র তাকে ইশারা করছে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্য। উদ্ভাসিত অনিলা জিজ্ঞেস করছে ‘যাই?’ আর চলেও যাচ্ছে খুশি মনে, দলের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি হচ্ছে চমৎকার তার নাচ, তাদের নাচ। সুধীন্দ্রকে ডেকে কানে কানে মনোমোহন বলছেন: এতক্ষণে বিশ্বাস হচ্ছে ও আমার ভাগ্‌নি।’’ (ইশারা অবিরত)। পাশাপাশি সত্যজিৎ সম্পর্কে আর-একটি জরুরি কথাও মনে করিয়ে দেন: ‘‘যুক্তিবাদী সভ্যতার বাইরে গিয়ে দাঁড়াবার একটা আগ্রহ খুব স্পষ্ট তাঁর একেবারে শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এর মধ্যে।’’

ঋণ স্বীকার:

১. অরণী আফরীন সুমিয়া – আগন্তুক: সত্যজিৎ রায়ের শেষ চলচ্চিত্র, ২০ আগস্ট ২০১৭।

২. শিশিরের ডালপালা, তানভীর মোহাম্মদের চোখে সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’, ২০ মার্চ ২০১৮।

৩. ভোরের কাগজ, ক্লাসিক সিনেমা রিভিউ : সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮।

৪. সেন শিলাদিত্য, নতুন করে বোঝার দরজা খুলে যায়, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, আনন্দবাজার ই-পত্রিকা।

লেখক পরিচিতি: অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়: গবেষক, সত্যপ্রিয় রায় কলেজ অফ এডুকেশন, কলিকাতা এবং কৌশিক চট্টোপাধ্যায়: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, সত্যপ্রিয় রায় কলেজ অফ এডুকেশন, কলিকাতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *