সমান্তরাল
পান্নালাল যখন ব্যাপারীগঞ্জে নামল তখনও ভোর হয়নি। ছোট স্টিমার স্টেশন। নির্জন অন্ধকার। স্টিমার যতক্ষণ রইল, সামান্য কোলাহল, তারপর স্টিমার ছেড়ে দিতেই শীতের রাতের ভারী স্তব্ধতা। সবুজ র্যাপারটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বিছানার বাণ্ডিল আর রংচটা টিনের সুটকেসটা তুলে নিয়ে এগুলো পান্নালাল। একটু দূরেই তারাপদদা-র হাতে গরম কেবিন। দিবারাত্র খোলা থাকে। সে ঢুকল সেখানে। ছোকরা চাকরটা এক কোণে বসে দুলছে। তাকে একটা খোঁচা মারল পান্নালাল—এই, ওঠ, তারাদা কোথায় রে? ধড়মড় করে উঠে বসল চাকরটা। বিরক্তির সঙ্গে বলল, বাবু বাড়ি গেছেন।
কিছু খাওয়া পাওয়া যাবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, রুটি, মাখন, কেক, ঘুগনি, মেটের কারি—
থাক, এক কাপ চা দে, আদা দিয়ে দিস।
ছেলেটা গিয়ে উনুনের চাকাটা খুলে ফেলল। গনগনে আগুনের লাল আভা এসে পড়ল তার মুখে। ঘরের মাঝখানে একটা হ্যারিকেন দড়িবাঁধা ঝুলছে। হাওয়ায় দুলছে সেটা। তার দীর্ঘ বিলম্বিত ছায়া এসে পান্নালালের মুখে পড়তে লাগল। বাইরে ঝিঝির একটানা ডাক, নদীর অস্পষ্ট শব্দ। মাঝে-মাঝে পাড় ভাঙার আওয়াজ। দূরে স্টিমারের ভোঁ-টা কেমন যেন উদাস-উদাস লাগল।
ছেলেটা চা-টা বেশ ভালোই বানিয়েছে। একটা বিড়ি ধরালে ভালো হত, কিন্তু দেশলাই নেই, উঠে গিয়ে উনুন থেকে ধরাতে ইচ্ছে করল না। এখান থেকে মাইলপাঁচেক হেঁটে যেতে হবে তার গ্রামে। রাত্তিরবেলা যাওয়াটা ঠিক নয়, রাস্তাঘাটের বদনাম আছে। ভোরের দিকেই যাব, কোমরে একবার হাত বুলিয়ে সে তার সযত্ন রক্ষিত জিনিসটা অনুভব করল। তারপর শুয়ে পড়ল। অয়েলক্লথ পাতা টেবিলের ওপর মাথা রেখে। তন্দ্রার ঘোরটা বড় মধুর। পান্নালাল এসেছে বিয়ে
করতে। সেই আসন্ন বিবাহের মধুর কল্পনা অন্ধকারের মধ্যে চিত্রিত হতে লাগল।
দাদা, বিড়ি খাবেন? দাদা—
চমকে উঠে বসল পান্নালাল। পাশে আর একটি লোক কখন বসেছে।
ও আপনার ঘুম এসেছিল? আমি ভাবলুম বুঝি জেগে আছেন। নেন, বিড়ি খান। এই যে দিয়াশালাই আমার সঙ্গেই আছে। দাদার বুঝি এই জাহাজেই আসা হল? আমিও একসঙ্গেই
এলাম।
পান্নালাল বিড়িটা ধরিয়ে লোকটার দিকে ভালো করে তাকাল। রোগা চেহারা, দুটি শীর্ণ চক্ষু কোটরের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে। মুখটা কেমন যেন ছুচোলো। একটা নস্যি রঙের ছেড়খোঁড়া র্যাপার জড়িয়েছে গায়ে।—তা, আপনাকে তো ইস্টিমারে দেখলাম না— পান্নালাল প্রশ্ন করল।
হেঁ-হেঁ, একটু আড়ালে আড়ালেই ছিলাম। মানে ইয়েতে এলাম কিনা! লোকটা ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা তুলে দেখাল। তা, দাদার যাওয়া হবে কোথায়?
পূব কুণ্ডুলেশ্বরী।
আমার ধূলগাঁও। তবে তো আমাদের পাশাপাশি গেরাম। আর দেরি করা কীসের, চলেন যাই।
পান্নালাল একটু গাইগুই করল। ভোর ভোরই যাব। রাস্তাঘাট তো তেমন ইয়ে না। লোকটা আবার হেসে উঠল। আমরা জোয়ান মানুষ যাব—আমাদের ভয় কী? আর সঙ্গেও কী বা হাতি ঘোড়া আছে? এবার পান্নালালকেও একটু শুকনো হাসি হাসতে হল।—হ্যাঁ, সঙ্গে আবার কী আছে! চলুন যাই, পান্নালাল অলক্ষে একবার কোমরে হাত দিয়ে দেখে নিল ঠিক আছে কি না!
দুপাশে অন্ধকার সমুদ্রের মতো মাঠ। মাঝ দিয়ে উঁচু রাস্তা। মাঝে-মাঝে দু-একটা নিঃসঙ্গ গাছ গুরুমশাই-এর কাছে শাস্তি পাওয়া ছাত্রের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপর অস্পষ্ট নীল শীতের আকাশ। মায়ের স্পর্শের মতো মিষ্টি প্রথম শীতের হাওয়া। দূর থেকে একটা রাত জাগা পাখির ডাক ভেসে এল। আর নদীর শব্দ।
পথ চলতে-চলতে পান্নালাল সঙ্গের লোকটার কাছে অনেক কিছু বলে ফেলল। বছরপাঁচেক একেবারে দেশে আসেনি পান্নালাল। কলকাতায় প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করে। এবারে এসেছে গাঁয়ে, মা-বাবা খুব ধরেছেন, বিয়ে করতে হবে। পাত্রী তাদেরই পাশের বাড়ির মেয়ে–হ্যাঁ, সুন্দরী বটে, যেমন রং তেমন…
লোকটা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, হঠাৎ বলল, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি একটু পেচ্ছাপ সেরে আসি। বাক্স-বিছানা হাতে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইল একা। গা-টা একটু ছমছম করতে লাগল। লোকটা এত দেরি করে কেন?
কোথায় হে, হল তোমার?
এই যে রে, এই যে! আয়। ভীষণ গলায় লোকটা পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল। ঘুরে তাকে দেখেই পান্নালালের বুক কেঁপে উঠল। র্যাপারখানা খুলে সে কোমরে বেঁধেছে, চোখদুটো জ্বলছে, ডান হাতে মস্তবড় একখানা হাঁসুয়া। সে হাঁসুয়াখানা তুলতেই পান্নালাল বাঁ-হাত দিয়ে তাকে ঠেকাল, সঙ্গে চিৎকার করে উঠল প্রাণপণে।
—চিল্লা শালা, যত পারিস চিল্লা, এই মাঠে শুনবেই বা কে, আর বউ-বিছানা ফেলে উঠে আসবেই বা কে? লোকটা আরও কয়েকবার হাঁসুয়া চালাল, পান্নালাল আর দাঁড়াতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল, কিন্তু তখনও চিষ্কার করতে লাগল। লোকটা ধীরে-সুস্থে পান্নালালের বাক্স-বিছানা নিয়ে চলে গেল। ক্রমে ভোর হল। সমুদ্রের মধ্য থেকে রক্তবর্ণ সূর্য লাফিয়ে উঠে আকাশপথে যেতে-যেতে এই মাঠের মাঝখানে এসে থমকে গেল। চাপ-চাপ রক্তের মধ্যে পান্নালাল দুমড়ে বেঁকে শুয়ে আছে! ক্ষীণস্বরে শুধু বলছে, জল, জল!
আস্তে-আস্তে লোক জমল। কাছেই মুসলমানপাড়া। সবাই এসে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ সামনে আসছে না ভরসা করে। কিছুদিন আগে এখানে দাঙ্গা হয়ে গেছে। যে আগে গিয়ে লোকটাকে ছোঁবে তাকেই যদি পুলিশ আসামি বলে ধরে? পান্নালাল শুধু ঘড়ঘড় করে বলতে লাগল, জল, জল।
এমনসময় ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়াল আকবর আলি। দড়ির মতন পাকানো চেহারা, বয়েস বছর পঞ্চান্ন, মুখভরতি চাপ-চাপ দাড়ি, বাঁ-হাতখানা কনুই থেকে কাটা। একসময়ে এ তল্লাটে বিখ্যাত ডাকাত ছিল। দশ বছরের মেয়াদ খেটে মাসতিনেক আগে মাত্র ছাড়া পেয়েছে। এখন আর। ডাকাতি করার সামর্থ্য নেই। ব্যাপার দেখে সে ভয়ানক রেগে গেল। এক চোট গালাগালি দিল ভিড় করে দাঁড়ানো লোকগুলোকে। কী শরমের কথা, একটা লোক পানি চাইছে, তোরা দিতে পারলি না। শালা, মুরগিগুলোকে জবাই করার আগেও তো একটু পানি দিস। ঠিক আছে, আমি আছি জেলখাটা ডাকু, আমার ডর নেই কিছু। পান্নালালের রং:্যাপারটার একটা পাশ সামনের ডোবা থেকে ভিজিয়ে এনে একটু-একটু করে জল নিঙরে দিতে লাগল ওর মুখে। পান্নালালের বাঁ হাতখানা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশে পড়ে আছে, ডান হাতখানাও ঝুলছে, মুখে-বুকে কোপ লেগেছে। তবুও জান বটে পান্নালালের। ফিসফিস করে বললে, আমার বাড়িতে খবর দাও, পূব কুণ্ডুলেশ্বরীর নেত্য সরকার আমার বাপ।
খানিক বাদে পুলিশ এসে পড়ল। পান্নালালের তখনও জ্ঞান আছে, সে বলল, যে মেরেছে তাকে আমি একবার দেখলেই চিনতে পারব। হাসপাতালে পান্নালালের সামনে সারবন্দি হয়ে দাঁড়াল জন চোদ্দো দাগি আসামি। প্রথমেই একেবারে আকবর আলি। কিন্তু পান্নালাল ওর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, না, না, ও নয়। ও তো আমায় জল দিয়েছে। যে মেরেছে, তার দুটো হাতই ছিল। একে-একে অন্য আর সবকটাকেও দেখানো হল, কেউ নয়। যে মেরেছে, সে তাহলে নতুন মানুষ, ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে। পান্নালাল বিড়বিড় করতে লাগল, বাড়িতে খবর দাও, বাড়িতে খবর দাও।
দাগি আসামিরা সব চলে গেল, শুধু আকবর আলি একা এককোণে দাঁড়িয়ে রইল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পান্নালালের দিকে, চোখটা কেন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। এই এক রোগ। হয়েছে আজকাল। অন্য মানুষের দুঃখু দেখলে আজকাল চোখে জল আসে। কোথায় কে মরল গেল, তাতে আমার কী রে শালা! আর আমি তো মারিনি! নাঃ জেলের ভাত খেয়ে-খেয়ে তার আর শরীর মনের কিছুই অবশিষ্ট নেই। না হলে সেই বাঘের বাচ্চা আকবর আলি, যার নামে একসময় মায়েরা ছেলেদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াত, তার আজ রক্ত দেখে চোখে জল আসে। মনে পড়ল, নলডাঙার চৌধুরীদের বড়ছেলের মুন্ডুটা কী করে তার হাতের খাঁড়ার এক ঘায়ে ছিটকে পড়েছিল। আর পটুয়াখালির মুখুজ্যেদের নতুন জামাইয়ের। মানুষ মারা ছিল তখন ছেলেখেলা। মহকুমা সদরের ট্রেজারি লুট করতে গিয়ে ধরা পড়ল শেষবার। বাঁ-হাতখানায় গুলি লেগেছিল, পচতে-পচতে শেষপর্যন্ত কনুই থেকে বাদ দিতে হল। তারপর জেলের মধ্যে হল টাইফয়েড, শরীর থেকে সমস্ত রস নিঙরে বার করে নিল, পড়ে রইল আখের ছোবড়ার মতো শুকনো দেহটা। টাইফয়েডের পর অন্য মানুষ হয়ে গেছে আকবর আলি, মাথারও গোলমাল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। সাধারণ সংসারী মানুষের মতো সামান্য দুঃখ-কষ্টও আজকাল সইতে পারে না।
এমনসময় পান্নালালের বাপ-মা, আরও সব এসে ঢুকল। সকলে মিলে কথা বলে চিৎকার করে একটা কান্নার হট্টগোল বাধিয়ে দিল। হাহা করে জনদুয়েক নার্স ছুটে এল, বেশি কথা বলা একেবারে বারণ, তাহলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না। পান্নালাল শুধু মাকে ফিসফিস করে বলল, আমি তো বাঁচবই না মা, তুমি কাল বরং পাখিকে একবার পাঠিয়ে দিও, শেষ দেখাটা করে যাই। শুনে মা আরও কেঁদে উঠল।
ততক্ষণে আকবর আলি ঘরের এককোণে বসে পড়েছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে আজকাল তার পা টনটন করে। খানিক বাদে হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এসে ধমকে উঠল, এই নুলো, তুই এখানে কেন, ওঠ। নুলো! মনে-মনে হাসল আকবর আলি। সেই পুরোনো আকবর আলিকে বোধহয় দেখেনি এই ছোকরাবাবু। জানে না, তার দু-হাতেই সমানভাবে লাঠি-তলোয়ার ঘুরত। তবু অনুনয়ের হাসি হেসে বললে, বাবু, আমাকে এখানেই থাকতে দিন—আমি একটু দাদাঠাকুরের সেবা করি, শেষ বয়েসে একটু পুণ্যি করি।
কী ভেবে সুপারিন্টেন্ডেন্ট ওকে আর কিছু বললেন না। পরদিন বেলা এগারোটার সময় ঝড়ের মতো একটি মেয়ে এসে ঢুকল পান্নালালের ঘরে। এই মেয়েটিই পাখি অর্থাৎ শ্রীমতী পটেশ্বরী দাসী। পান্নালালের সঙ্গে বিয়ের কথা ছিল পাখির পাশাপাশি বাড়ি দুজনের, ছেলেবেলার সাথী। পাখি এসে কোনওদিকে না চেয়ে পান্নালালের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে যুঁপিয়ে। পান্নালাল একটু সময় চুপ করে রইল, তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ওঠ, পাখি লাগে। বুকে লাগে।
উঠে বসল পাখি। শ্যামল রং-এর মেয়ে। দুই গাল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, টানাটানা দুটো চোখ কেঁদে লাল হয়ে গেছে, বোধহয় কাল সারারাত কেঁদেছে। আঁটসাঁট গড়ন, কাপড়-চোপড়ের। দিকে দৃষ্টি নেই, যেন সমস্ত লজ্জা-ভয় পিছনে ফেলে রেখে এসেছে। পান্নালাল বললে, আমার বুকে একটু হাত বুলিয়ে দে। সর্বাঙ্গে বিষের মতো ব্যথা। সারা বুক জুড়ে ব্যান্ডেজ, কোথায় হাত বুলোবে পাখি? আলতো করে হাত ছুঁইয়ে কোমরের কাছে এনে হাতটা রাখল। হাতে কী যেন শক্ত মতো ঠেকল। পান্নালাল একবার একদৃষ্টে তাকাল কোণে বসা আকবর আলির দিকে। আকবরের চোখে সে কী দেখল কে জানে, মুখ ফিরিয়ে পাখিকে বলল, আমার কোমরে একটা মোজা বাঁধা আছে, খোল! ওর মধ্যে চারশো সাতান্ন টাকা আছে। তোর নাম করে জমিয়ে ছিলাম। তোকে না দিয়ে পারি না, তুই নে। খুনেটা এ টাকার খোঁজ পায়নি।
পাখি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। বলল, কী হবে তোর টাকায়? তুই মরলে আমি বাঁচব না। পান্নালাল একটু চুপ করে থেকে বলল, না, তুই মরবি কেন, তুই বাঁচবি, তোর আবার বিয়ে হবে। কথা শেষ করে একটু হাসতে গেল পান্নালাল, পারল না, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল।
ওদিকে আকবর আলির চোখ দিয়ে জল পড়ে-পড়ে ছেঁড়া ফতুয়াটা একেবারে ভিজে গেছে। এত। জল তার চোখে এল কোথা থেকে। যৌবনে সে কখনও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে বলে। মনে পড়ে না, তখন শুধু আগুন বেরুত। বোধহয় সেইসব জমানো কান্না এখন বের হচ্ছে। সত্যি টাইফয়েডের পর সে একেবারে খাঁটি সংসারী মানুষদের মতো হয়ে গেছে। অতগুলো টাকা। দেখেও লোভ হল না। কিন্তু সারা জীবনে এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি আকবর আলি। প্রেমিক প্রেমিকার এমন বিচিত্র মিলনের দৃশ্য!
পাখিকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার পরই পান্নালালের শ্বাসকষ্ট উঠল। তার পরদিন ভোরবেলা সে মারা গেল। মরবার আগে সে শুধু অস্ফুটস্বরে পাখি, পাখি বলেছে। কোনও ঠাকুর দেবতার নাম মুখে আসেনি।
আকবর আলির চোখে আর জল নেই। অমানুষিক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না পান্নালালকে। হাসপাতাল থেকে যখন বেরুল, তখন তার মূর্তি দেখে যেসব ছোট-ছেলেরা তাকে নুলো আকবর বলে ডাকত তারা চুপ করে রইল। কাটা হাতখানা শক্ত করে বুকের ওপর রাখা, শরীরের সমস্ত শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। রুক্ষ্ম চুল-দাড়ি—দু-দিন রাত্রি জাগরণে দু-চোখ লাল। আবার একবার তাকে ফিরে যেতে হবে পুরোনো দিনে। শেষবার।
অনেকদিন বাদে। সে গেল পুরোনো চোর-ডাকাতদের আড্ডায়।
জেল থেকে বেরিয়ে এসে এসব সংস্রব সে একেবারে ত্যাগ করেছিল। দলের লোকদের সে লোহার মতো ঠান্ডা গলায় বলল, কলকাতার ছোকরাবাবুকে কে মেরেছে রে? সরেস হাত তার। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল! কে মেরেছে কে জানে!
একজন শুধু বলল, বোধহয় খালপাড়ের ইউসুফ। তার ঘরে দেখলাম নতুন স্যুটকেস, বিছানা। খালের জলে দেখলাম পরশু রাতে হাঁসুয়া ধুচ্ছে!
সেখান থেকে বেরিয়ে এল আকবর। এল তার নিজের বাড়িতে। বাড়ি আর কী…শুধু ঝোপ-জঙ্গলে ভরা ভিটেটুকু। জেল থেকে ফিরে এসে দেখে শরিফনকে কারা নিয়ে পালিয়েছে। কেউ বলতে পারে না তার খবর। ঘরের দরজা-জানলা-চাল সব গেছে পাড়াপড়শীর উনুনে। তবুও তার মধ্যেই ঝোঁপজঙ্গল একটু পরিষ্কার করে থাকার জায়গা করেছিল আকবর।
ঘরে এসে মুখের পেশি শক্ত হয়ে উঠল আকবরের। এখনও তার দেহে একটু শক্তি আছে। এখনও সে পারবে পান্নালালের মৃত্যুর শোধ নিতে। সে তার ঘরের ভিতের মাঝখানটা খুঁড়তে লাগল। হাতখানেক গর্ত করে তার মধ্যে থেকে টেনে তুলল এক হাত লম্বা একটা ভোজালি। তার কতকালের জিনিস! কত প্রিয় হাতিয়ার! এই অস্ত্রে সে সবজায়গায় জিতেছে। অস্ত্রখানা কোমরে গুঁজে সে তখুনি বেরিয়ে পড়লো। কাজ আগে সেরে রাখা ভালো। খালপাড়ের ইউসুফের বাড়িতে এসে ডাকল তাকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ইউসুফ। সেদিনকার রাত্রির সেই লোকটা! আকবরকে দেখে বলল, সালাম আলেকুম, সর্দার, বার্তাটা কী কন!
আলেকুম সালাম, প্রত্যুত্তর দিল আকবর আলি, তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।
কীসের কথা? ইউসুফের চোখে কুটিল সন্দেহ।
কেন, ভাইবেরাদরের সঙ্গে একটু বাতচিতও কি করতে পারব না?
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ইউসুফ, কোচড়ভরতি তার মুড়ি। চলতে-চলতে আকবর তাকে জিগ্যেস করল, কাজকারবার কেমন?
কোথায় আর কাজকর্ম! পরপর দু-বার বানের জলে সমস্ত ফসল ভেসে গেল। জোয়ান মানুষ, পেটের ভাত তো চাই! কোথা থেকে পাব তা…
আকবর তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তার দিকে। এই সেই লোক, চিনতে ভুল হয়নি।
ইউসুফ বাড়ির পাশের লঙ্কা আর ঢ্যাড়শ গাছে জল দিল। তারপর বলল, সর্দারের কথাটা কী, তা তো শোনা হল না।
হবে-হবে, চলো একটু নিরিবিলিতে…তিনযুগী বটতলায়।
ইউসুফের বাড়ির পিছনে পুকুর। সামনে খাল। পুকুরে ঘাটে নেমে ইউসুফ হাত দিয়ে জলের ওপর একটা অদ্ভুত শব্দ করতে লাগল। সেকালের বিরাট মজা পুকুর। খানিকটা বাদেই দুটো। বিরাট শ্যাওলা পড়া শোল মাছ এল ঘাটের কাছে। ইউসুফ মুড়িগুলো ছড়িয়ে দিল জলে। তারপর আর একমুঠো মুড়ি হাতে নিয়ে, আ-তু বলে ডাকতে লাগল। কোথা থেকে একটা কালো রোগা কুকুর ছুটে এল। তার সামনে মুড়িগুলো দিয়ে বলল ইউসুফ, আজ সাতদিন পর প্রাণীগুলোকে খেতে দিলাম। তা আমরাই বলে খেতে পাইনি, তা জীবজন্তু।
আকবর আলি দেখছে আর মনে-মনে হাসছে। একটু পরেই তো তোর সব সম্পর্ক ঘুচে যাবে এদের সঙ্গে…যেমনভাবে তুই পান্নালালের সঙ্গে পাখির সম্পর্ক ঘুচিয়েছিস।
জারুল গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে দেখতে পেল একটি মেয়ে নীচু হয়ে শুকনো। পাতা কুড়োচ্ছে। দশ-এগারো বছর বয়েস…দেখতে অনেকটা শরিফনেরই মতো, আকবর আলি ভাবল। মেয়েটি মুখ তুলে ইউসুফকে দেখে বলল, বাজান, এখন আবার যাস কোথায়। আজ। অনেকদিন বাদে ভাত খাব…গরম গরম…খাল থেকে আমি চাঁদা মাছ ধরেছি।
একটু সবুর করিস…আমি আসব এখনই।
খালপারে গিয়ে তিনযুগী বটতলায় দাঁড়াল দুজন। ইউসুফের দিকে একবার তাকাল আবকর আলি। এখন যেন নিজেকে আবার ভয়ানক দুর্বল লাগছে। ইউসুফের কোটরাগত চক্ষুদুটোতে যেন ভাত খাওয়ার আনন্দ চকচক করছে। সব শেষ করে দেবো! কুকুরটা কোথা থেকে এসে আবার লেজ নাড়ছে। যা…যা…বলে ওকে তাড়াবার চেষ্টা করল, ওর সামনে যেন কেমন লজ্জা লাগছে আকবরের। আর ইউসুফের দুধের মেয়েটা…বাপ মরলে ওর কী হবে? শেষে কি ও-ও। শরিফনের মতো…
আকবর মনস্থির করে কোমর থেকে ভোজালিটা বের করল। সেটা দেখেই ইউসুফ ইয়া আল্লা বলে চমকে দৌড়বার চেষ্টা করল।
আরে পালাস কোথা, ভয় নেই দাঁড়া, কথা আছে…
ইউসুফ একটু দূরে ভয়ে-ভয়ে দাঁড়াল। আকবর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অস্ত্রটার দিকে। আবেগে তার হাত কাঁপছে। সেটা ইউসুফের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ইউসুফ ভাই, এটা ঘরে থাকলে আমার বড় যন্তন্না, হাত নিশপিশ করে, মাঝে-মাঝে মানুষ মারবার জন্য। তাই এটাকে এবার বিদায় দেব, কিন্তু নিজের হাতে তো ফেলতে পারিনা, মায়া লাগে, পুরোনো বান্ধব, তুই এটাকে হাতে করে ফেলে দে!
ইউসুফ অস্ত্রটা হাতে নিয়ে নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইল।
দে, প্রাণপণে মাঝদরিয়ায় ছুড়ে ফেলে দে!
একটু ইতস্তত করে ইউসুফ সেটাকে ছুড়ে দিল খালের মাঝখানে। ঝুপ করে একটা আওয়াজ হল। কয়েকটা তরঙ্গ উঠে পারের কাছে আসবার আগেই ভেঙে গেল। চারদিকে আর কোনও চাঞ্চল্য নেই, পরিবর্তন নেই। পাশের বাঁশবন থেকে হাওয়ার শব্দ ভেসে আসতে লাগল, একটা গাঙশালিক ডেকে উঠল, তিনযুগের সাক্ষী বিশাল বটগাছটা নিশ্ৰুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ জানল না, কত শোক, অশ্রু, হিংসার ইতিহাস শেষ হল। এইমাত্র পৃথিবীতে কী নিদারুণ একটি ঘটনা হতে-হতে নিবৃত্ত হল। কেউ জানল না।
আকবর আলি একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, চল ইউসুফ, তোর মেয়ের রাঁধা ভাত দুজনে মিলে ভাগ করে খাব আজ…