৭. শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড
তাঁর সময় ফুরিয়ে গেছে–
কাজটা অত্যন্ত গোপনে সমাধা করতে হবে।
—আন্ধা হাফিজ
.
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। বেলা এগারোটা ছাড়িয়েছে কেবল। সময় যেন অতি দ্রুত বেগে মহিলার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের এক বাজারের মাঝামাঝি এসে তার ট্যাক্সি বিকল হয়ে পড়েছে। বিকল গাড়ীতে বসে মেজর ফারুকের স্ত্রী, ফরিদা অস্তিত্বের দুশ্চিন্তায় ঘেমে একেবারে গোসল করার উপক্রম। এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে সে হালিশহরে অবস্থানরত আন্ধা হাফিজের নিকট একটা জরুরী খবর পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলো।
ফরিদা ঢাকা থেকে এর আগের দিন বিকেলে চট্টগ্রাম এসেছে। তার সঙ্গে তার মাও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে এসেছিলো। ফারুক তাকে অন্ধ দরবেশের সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠিয়েছিলো। তার স্পষ্ট নির্দেশ ছিলোঃ ‘তাকে বলবে, আমি ১৫ তারিখেই কাজটা করতে যাচ্ছি। আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে, আমি ইসলাম ধর্ম আর দেশের জন্যেই এ কাজ করছি। আমি যা করছি তা, জনগণের মঙ্গলের জন্যেই করছি। তাকে আরো বলবে, আমি যা করছি, তা আমার অভিলাষ কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে করছি না। যে-কোন পরিস্থিতিতে আমি আল্লাহর পথ অনুসরণ করতে প্রস্তুত। আমি চাই যে, তিনি আমাকে বলুক, আমি কি ঠিক পথেই চলেছি, না ভুল পথে চলেছি। তিনি যদি অন্য কিছু করতেও বলেন, আমি তাই করবো।’
ফারুক ফরিদাকে দুপুরের মধ্যেই আন্ধা হাফিজের বক্তব্য টেলিফোনে ঢাকায় জানিয়ে দিতে বলেছিলো। ফরিদার কথায়ঃ ‘বেবী ট্যাক্সি পেতে আমাদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত একটা মিললেও পথে সেটা কয়েকবার বিকল হয়ে পড়েছিলো।’ দরবেশজীর কাছে অবশেষে পৌঁছা গেলো। কিন্তু কী আশ্চর্য! ট্যাক্সি চালক পথে আমাদের এতটা অসুবিধার জন্যে দুঃখ প্রকাশ না করে বরং উল্টো আমাদের কাছে ২৭ টাকা ভাড়া বেশী চেয়ে বসলো।
ফরিদা গিয়ে দেখলো দরবেশ আন্ধা হাফিজ লুঙ্গি ও সুতি গেঞ্জি গায়ে পায়ের উপর পা তুলে একটা নীচু চৌকিতে বসে আছেন। কিছু কাপড় তার কামরার একটা ছোট রশিতে ঝুলছিলো। ফরিদা একটা বেতের মোড়ায় গিয়ে বসলো। সে যেন মোড়ায় বসে অদৃশ্য কিছু ফুলের সুগন্ধ পাচ্ছিলো। মৃদুমন্দ ঠান্ডা একটা বাতাস এসে তার শরীর স্বস্তিতে ভরিয়ে দিলো। কিন্তু রুমের ভেতরে কোথাও কোন পাখার চিহ্নটিও তার চোখে পড়লো না। তার মনে জাগতে লাগলো, স্বর্গীয় বাতাসই আন্ধা হাফিজকে গরমের মাঝে ঠাণ্ডা করে রেখেছে।
অন্ধ দরবেশ ফরিদার হাত নিজের হাতের উপর নিয়ে নীরবে ফারুকের পাঠানো সংবাদ শুনে নিলেন। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবেগজড়িত কণ্ঠে উর্দু ভাষায় আন্ধা হাফিজ বলতে লাগলেনঃ ‘তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমাদের যা করার করে ফেলো। তবে, অত্যন্ত গোপনে কাজটা করতে হবে।’ আবারও এক লম্বা নীরবতা। তারপর তিনি ফরিদাকে বললেন, ‘ফারুককে বলো, কাজটা শুরু করার আগে সে যেন আল্লাহর রহমতের জন্যে সর্বান্তঃকরণে দোয়া করে নেয়। তার সাথীরাও যেন একইভাবে দোয়া করে নেয়। দু’টি ‘সুরা’ দিলাম। সে যেন অনবরত তা পাঠ করতে থাকে। তাহলে তার মন পবিত্র থাকবে ও পবিত্র চিন্তা ছাড়া সে আর অন্য কোন চিন্তাই করতে পারবে না।
ফরিদা বিদায় নেবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। যাবার পূর্ব মুহূর্তে সে তার স্বামী ও তার সাথীদের জন্যে দোয়া করতে আন্ধা হাফিজকে অনুরোধ জানালো। আন্ধা হাফিজ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা করো না। আমি তাদেরকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি। এটা তাঁর ইচ্ছে। তিনিই তাদের রক্ষা করবেন।’
ফরিদার ভোগান্তি শেষ হলো না। বাবার বাড়ীতে ফিরে এসে দেখে, ‘ঢাকার টেলিফোন লাইন অচল। দু’ঘন্টা পরে লাইন পেলেও তখন আবার ফারুকের দিক থেকে কোন জবাব আসছিলো না।’ তখন ফরিদা তার বোনের বাসায় টেলিফোন করলো। কিন্তু তাতেও কথা বুঝা যাচ্ছিলো না। উপায়ান্তর না দেখে সে তার শ্বশুরকে ফোন করে। শ্বশুর রিসিভার উঠালে ফরিদা বললো, ফারুককে আমার জরুরী দরকার। আপনি তাকে এক্ষুণি আমায় টেলিফোন করতে বলুন।’ ডঃ রহমান গিয়ে দেখেন তার ছেলে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তিনি মনে করলেন, সকাল সকাল বাসায় ফিরে কোন কাজ হাতে না থাকায় একটুখানি ঘুমিয়ে নিচ্ছে। পরিশেষে, বিকেল পাঁচটার সামান্য কিছু আগে ফরিদা ঐ সাংঘাতিক নির্দেশমালা ফারুককে পাঠাতে সক্ষম হয়। কেবল আন্ধা হাফিজই শেখ মুজিবের নক্ষত্রে তাঁর পতনের আভাস দেখতে পাননি। প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত স্টাফের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রুহুল কুদ্দুস একজন খ্যাতনামা শৌখিন হস্তরেখা বিশারদ। জুলাই মাসের গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্টের হাত দেখার সুযোগ হয়েছিলো। তার হাত দেখে সে এতই ভড়কে গিয়েছিলেন যে, কালবিলম্ব না করে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে ‘লম্বা চিকিৎসা ছুটির’ নামে ইউরোপে পাড়ি জমান। এতেই তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। মুজিব হত্যার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। বাংলাদেশ সরকার কয়েক মাস চেষ্টা করেও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আসলে শেখ মুজিবের পরিবারের বিরুদ্ধেও ভাগ্য কাজ করছিলো! আগস্টের ১০ তারিখে শেখ মুজিবের প্রিয় ভাগ্নির বিয়ে উপলক্ষে ঢাকায় জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সবাই জড়ো হয়েছিলো। অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেরনিয়াবাতের ছেলেরা খুলনা থেকে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। তারা সবাই ঢাকায় অবস্থান করছিলো। কারণ ১৪ই আগস্ট ছিলো সেরনিয়াবাতের মায়ের চেহলাম। ফারুক আর রশিদ যখন এই গোষ্ঠীর উপর আঘাত হানার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে আসে, তখন তারা সবাই ধানমন্ডির মাত্র আধা বর্গমাইল এলাকায় অবস্থান করছিলো। ঘটনাচক্রে আরেকটি ব্যাপার মেজরদের পক্ষে কাজ করছিলো। অবশ্য তারা এর উপর খুব একটা বড় রকমের ভরসা করেনি। রক্ষীবাহিনীর লৌহমানব, শক্তিধর কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান দেশ ভ্রমণে ইউরোপে ছিলেন। তাঁর জায়গায় একজন তুলনামূলকভাবে জুনিয়র অফিসার কাজ করছিলেন। এবং এই প্রথমবাবের মতো তিনি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। সুতরাং সাধারণভাবে রক্ষীবাহিনী কোন দুর্ঘটনা মোকাবেলার জন্যে যতটা প্রস্তুত থাকে, ঐ সময়ে তারা এতটা প্রস্তুত ছিলো না। আগস্টের ঐ দুর্ভাগা দিনটিতে শেখ মুজিব অবশ্য তাঁর প্রত্যাশার স্বর্ণ শিখরে অবস্থান করছিলেন। বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সপ্তাহান্তেই ৬১ জন জেলা গভর্ণর তাদের কর্মস্থলে চলে যাবে।
শেখ মুজিবের মাথায় আর একটা বুদ্ধি কাজ করছিলো। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেয়ার কথা। গোপনে একটা ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছিলো যে, ঐ সভাতেই জনগণের দ্বারা তাকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হবে। বিরোধী দলের কোন অস্তিত্বই ছিলো না। অথচ তাঁর অবস্থান ছিলো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মুজিব জানতে পারেননি, মেজররা কি করছে। যদিও তাঁর কানে খবর এসেছিলো যে, ক্যান্টনমেন্টে কিছু একটা হচ্ছে। পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা থেকে মুজিবের ধারণা জন্মেছিলো যে, বিপদ সব সময় সেনাপতিদের দিক থেকেই আসে। কাজেই তিনি তাঁর গোয়েন্দা বিভাগকে কেবল সেই দিকে বিশেষ নজর রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি জুনিয়র অফিসারদের মোটেই পাত্তা দেননি। ঐ ভুলের মাশুল তাকে জীবন দিয়েই দিতে হয়েছিলো।
নিয়মমাফিক ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীর যুক্ত মহড়া ১৪ই আগস্ট রাত দশটায় শুরু হলো। দু’টি ইউনিটের প্রায় ৬০০ সৈন্য ক্যান্টনমেন্টের পেছনে নির্মীয়মাণ নূতন এয়ারপোর্টের কাছে অংশ নিতে গিয়েও তাদের কমান্ডারদের মনে কি আছে তা একটুও টের পায়নি। ফারুক আর রশিদ আন্ধা হাফিজের নির্দেশিত কঠোরতম গোপনীয়তা বজায় রেখে চলছিলো।
সকল স্বাভাবিক ও গতানুগতিক কাজের মধ্যে একটা কাজ করা হয়েছিলো অস্বাভাবিক। একটা আর্টিলারী রেজিমেন্টের তিন কোম্পানী ব্যাটারীকে বেরিয়ে এসে কেবল রাইফেল নিয়ে সজ্জিত হতে বলা হয় এবং ১২টি ট্রাকে ভর্তি হয়ে মহড়ার স্থানে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। এমনকি শেষ নির্দেশটিও কারও মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক করতে পারেনি। এই জন্যে যে, মেজর রশিদ রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রায়ই এ ধরনের ট্রেনিং রুটিনে রদবদল করেছে।
রশিদ ৬টি ১০৫ মিঃ মিঃ যুগোশ্লাভ হাউইটজার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে গোলাবারুদ এয়ারপোর্টের আশেপাশে জড়ো করে। ক্রুরা জানতেই পারলো না যে, রশিদের নির্দেশ অনুযায়ী কামানের লক্ষ্য স্থির করা হলো সেখান থেকে চার মাইল দূরে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের দিকে।
আরো এগারোটি কামান ইউনিট হেড কোয়ার্টারে ক্রুসহ মোতায়েন রাখা হয়েছিলো। রেজিমেন্টাল অস্ত্রাগারের আঠারতম কামানটি ল্যান্সার গ্যারেজ-এর ক্রুদের সঙ্গে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিলো। স্বাভাবিক নিয়মে ফারুক সেখান থেকেই ২৮টি টি-৫৪ ট্যাংক নিয়ে রওয়ানা দেয়। যান্ত্রিক গোলাযোগের জন্যে সেদিন পুরো সংখ্যার চেয়ে দু’টি ট্যাংক কম নিয়েই ফারুককে যাত্রা করতে হয়। অধিনায়কদের ছাড়া প্রতি ইউনিটে মাত্র চারজন করে অফিসার উপস্থিত ছিলো। আরো দু’জন অফিসারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারার কারণে মহুড়া থেকে বাদ দেয়া হয়। শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি এত বেশী নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের সৈন্যদের মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু করতে বললে, তা করতে তারা দ্বিধা করবে বলে ফারক ও রশিদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলো না।
পদাতিক বাহিনীর একটা ইউনিটকে এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত করার জন্যে রশিদ শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। অভ্যুত্থানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সকল অংশকে এক সঙ্গে জড়িত করাই ছিলো এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্যে সে তার এক পুরানো বন্ধু মেজর শাহজাহানকে টেলিফোন করে। শাহজাহান তখন জয়দেবপুরের ১৬তম বেঙ্গল ইনফেন্ট্রির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। রশিদ তাকে বলেছিলো, তার সৈন্যদের নিয়ে রাতে নূতন এয়ারপোর্টের কাছে অনির্ধারিত এই যৌথ মহড়ায় অংশ নিতে। সে অবশ্য মেজর শাহজাহানকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিলো যে, মেজর শাহাজান তার ইউনিট নিয়ে এলে, সে তাকে তাদের পরিকল্পনায় যোগ দিতে রাজী করাতে পারবে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে রাজী হয়ে রাত দশটায় তার ইউনিট নিয়ে মহড়ায় যোগ দেবে বলে জানায়। রশিদ অধীর আগ্রহে মেজর শাহজাজান, মেজর ডালিম, নূর আর শাহরিয়ারের আগমনের অপেক্ষা করছিলো।
রাত সাড়ে দশটা বেজে গেলো। কিন্তু কোথাও কারও কোন চিহ্নটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। অন্য প্রান্ত থেকে মেজর শাহজাহানের কণ্ঠ ভেসে এলো। শাহজাহান জানালো তার সৈন্যেরা খুব ক্লান্ত। এ অবস্থায় তারা যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না।
হতাশাব্যঞ্জক এই খবর শুনে ফারুক ক্ষেপে গিয়ে মন্তব্য করে, ‘মনে হচ্ছে সব বেঙ্গল টাইগারই এখন পোষা বিড়ালে পরিণত হয়ে গেছে।’
এর মধ্যে মেজর ডালিম আর তার সঙ্গীদেরও কোন খবর নেই। রাত প্রায় এগারটার দিকে তারা মেজর পাশা আর মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে জায়গামত চলে আসে। মেজর হুদা মিলিটারী গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার এবং ডালিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা একসঙ্গে আর্টিলারীতে কাজ করেছে। রশিদ তার দল আর ১২ ট্রাক বোঝাই সৈন্য নিয়ে ট্যাংক গ্যারেজে ফারুকের সঙ্গে যোগ দেয়। সেখানে মধ্যরাতে প্রথমবারের মতো সবাইকে অপারেশনের পুরো বিবরণ জানানো হয়।
ফারুক অপারেশনের সর্বময় নেতৃত্বে ছিলো। শেখ মুজিবকে হত্যা করার কারণ এবং প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে, পরিকল্পনায় যোগ দিতে রাজী আছে কিনা ফারুক জানতে চাইলে সকলেই সম্মতি জানায়। তারপরই বসে তারা কাজের কথায় ফিরে আসে।
ফারুক তখন ঢাকা শহরের একটি সুপরিকল্পিত ট্যুরিস্ট ম্যাপ স্কোয়াড্রন অফিস টেবিলে রাখে। সে সকল জায়গায় ব্লক স্থাপন করতে হবে, সে সমস্ত জায়গায় সে দাগ কেটে দেয়।
পরিকল্পনা মোতাবেক একটা ট্যাংক বিমান বন্দরের রানওয়ে আটকাবে আর সৈন্যরা মিরপুর ব্রিজ নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য দলগুলোকে পাঠানো হবে রেডিও স্টেশন, বঙ্গভবন আর নিউমার্কেটের কাছে পিলখানায় (পিলখানা ব্যারাক বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সদর দফতর )।
৭৫ থেকে ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানো হলো। ঐ সুসজ্জিত তিনটি দলকে তিনটি প্রধান প্রধান টাগেট—শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মনি’র বাড়ীতে চূড়ান্ত আঘাতের দায়িত্ব নেয়া হলো। শেখ মুজিবের বাড়ীতে আক্রমণের জন্যে ডালিমকে বলা হলে, ডালিম রাজী হলো না। প্রেসিডেন্ট পরিবারের সঙ্গে তার পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। সম্ভবতঃ সে কারণেই ডালিম খোদ শেখ মুজিবের উপর আক্রমণ চালাতে ব্যক্তিগতভাবে নারাজ হলো। তৎপরিবর্তে সে সেরনিয়াবাতের বাড়ীতে সর্বাত্মক হামলা চালানোর দায়িত্ব নিলো। আর শেখ মুজিবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ভয়ঙ্কর দায়িত্বটি নিলো প্রাক্তন মেজর নূর এবং মেজর মহিউদ্দিন। তারা তাদের সঙ্গে নিলো এক কোম্পানী ল্যান্সার।
ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন এনসিও (নন কমিশন্ড অফিসার) রিসালদার মুসলেহউদ্দিন ওরফে মুসলিমকে দেয়া হলো শেখ মনি’র বাড়ীতে আক্রমণের দায়িত্ব। তাদের উপর নির্দেশ ছিলো–শেখ মুজিব, সেরনিয়াবাত আর শেখ মনিকে হত্যা করার। এবং মুজিবের দুই পুত্র শেখ কামাল আর শেখ জামালকে বন্দী করার। আর কাউকে কিছু করা বারণ ছিলো। তবে, পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এমন যে কাউকে প্রয়োজনবোধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ রইলো। আসলে এই নির্দেশটিই হত্যাযজ্ঞের পরিধি প্রশস্ত করার পথ খুলে দিলো।
ফারুকের মতে, রশিদের দায়িত্ব ছিলো রাজনৈতিক গুটিগুলো সঠিকভাবে চালনা করা। অভিযান শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই রশিদ স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের কাছে যাবে, যাতে করে সে তার মিগ জঙ্গী বিমান নিয়ে প্রস্তুত থাকে। ঢাকার বাইরে থেকে কোন সেনা ইউনিট ঢাকায় আসার চেষ্টা করলে, সে তা ঠেকিয়ে দেবে।
এছাড়া, রশিদের উপর আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বর্তায়। তার একটা ছিলো, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসা। রেডিও স্টেশনে পৌঁছে মুজিব হত্যার ঘোষণা দেয়া, আর দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নাম ঘোষণা করা। অন্য দায়িত্বটি ছিলো, মুজিব হত্যার পর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালানো। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ফারুক তার সহকর্মী অফিসারদের মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পেরেছিলো। তার জানা ছিলো যে, ঢাকায় কোন সেনা ইউনিটকে হতে প্রস্তুত তাদের কমপক্ষে দু’ঘন্টা সময় লেগে যাবে। সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো যে শেখ মুজিব দুনিয়াতে নেই এ খবর একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, সামরিক কমান্ডাররা তাদের জীবন আর চাকুরীর ভয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে অন্ততঃ দু’বার ভেবে দেখবে। কাজেই সে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চিন্তাই করেনি। তার পরিবর্তে ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ডটি ঘটে যাবার পর সে রশিদকে তাদের সমর্থন লাভের জন্যে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রায় সবকটা ঘটনাতেই ফারুকের ধারণা/সিদ্ধান্ত একেবারে কানায় কানায় সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। অভিযানে তার প্রধান লক্ষ্যসমূহ সঠিকভাবে অর্জিত হবার ব্যাপারে ফারুকের কোন সন্দেহই ছিলো না। তিনটি প্রধান বড় দলকে এভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, তাদের লক্ষ্যবস্তুতে বাধা সৃষ্টিকারী যে-কোন কিছুকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অধিকার তাদের থাকবে। তার জানা ছিলো, সবাই ব্যর্থ হলেও তার ল্যান্সার এ ব্যাপারে ব্যর্থ হবে না।
সুতরাং সে নিজে নিলো অভিযানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর বিপদসঙ্কুল কাজটি এবং তা ছিলো দুর্ধর্ষ রক্ষীবাহিনীকে সামলানোর কাজ।
সাধারণ অবস্থায়, অতর্কিতে আক্রমণ চালানো হলে, ২৮টি ট্যাংক দিয়ে একত্রে জমাট বাধা ৩০০০ রক্ষীবাহিনীর একটি দলকে অকেজো করে দেয়া তেমন কোন কঠিন কাজই নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফারুকের ট্যাংকগুলো ছিলো একেবারে শূন্য—কোন গোলাবারুদই ছিলো না এতে। এমনকি ট্যাংকের মেশিনগানগুলোতেও কোন গুলি ছিলো না। ঐ অবস্থায় কেউ তাকে সত্যিকারভাবে প্রতিরোধ করতে চাইলে, তার কিছুই করার থাকতো না। পরে জানানো হয়েছিলো যে, ট্যাংকের সকল গোলাবারুদ জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স ডিপোতে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। শেখ মুজিব প্রথমদিকে মিশরের এই ট্যাংক উপহার গ্রহণ করতেই রাজী ছিলেন না। তিনি প্রকৃতপক্ষে ঐ ব্যবস্থা করে, এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যেন ঐ সকল ট্যাংক কোন কালেই অন্ততঃ তাঁর বিরুদ্ধে কেউ ব্যবহার করতে না পারে। কিন্তু ফারুক নিলো ভিন্ন পন্থা। সে ট্যাংকগুলো দিয়ে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে কাজ হাসিল করার পন্থা অবলম্বন করলো।
ফারুক আমাকে পরে জানিয়েছিলো, ‘মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসেবে ট্যাংক যে কতটা কার্যকরী তা খুব কম লোকই জানে। ট্যাংক দেখে জীবনের ভয়ে পালাবার চেষ্টা করবে না, এমন সাহসী লোক খুবই কম পাওয়া যাবে। আমরা জানতাম আমাদের ট্যাংকগুলো নিরস্ত্র। জেনারেল হেড কোয়ার্টারে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র এ ব্যাপারে অবগত ছিলো। কিন্তু তারাও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো না যে, ‘ট্যাংকগুলো আসলেই এতটা নিরস্ত্র। সংশ্লিষ্ট বাকী সকলের কাছেই ট্যাংক অত্যন্ত মারাত্মক অস্ত্র যা তার সামনে যা কিছু আসে সবই উড়িয়ে দিতে পারে।’ ফারুক হাসতে হাসতে আরও বললো, ‘কে-ই বা আমাকে অতটা পাগল ভাববে যে, আমি জি এইচ কিউ আর রক্ষীবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্যে একদল একেবারে ফাঁকা ট্যাংক নিয়ে এত বড় ভয়ঙ্কর অভিযানে পা বাড়াবো।
ভোর ৪টা ৪০ মিনিট নাগাদ ফারুকের বাহিনী আঘাতের জন্যে সংগঠিত হয়ে গেলো এবং যার যার জায়গামত পৌঁছার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলো। রশিদের আর্টিলারী বাহিনী তাদের কামান নিয়ে নূতন এয়ারপোর্টের প্রান্তে দন্ডায়মান। ল্যান্সার গ্যারেজে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে ২৮টি ট্যাংক, ১২টি ট্রাক, ৩টি জীপ আর একটি ১০৫ মিঃ মিঃ হাউইটজার এইগুলোর সঙ্গে রয়েছে রণসাজে সজ্জিত ৪০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী দল। তাদের দুই-তৃতীয়াংশেরই ছিলো কালো উর্দি যা পরবর্তীতে বাংলাদেশীদের মনে এক ভয়ঙ্কর পোশাক বলে পরিগণিত হতে পারে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এই বিরাট সমরসজ্জা সেনা সদরের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাত্র তিনশ’ গজের মধ্যেই সম্পন্ন হচ্ছিলো। অথচ, ঐ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দিন-রাত সতর্ক সৃষ্টি রাখার কথা। ল্যান্সার গ্যারেজের তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা সীমানার বাইরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগে থেকেই ফারুক সৈন্য পাহারার ব্যবস্থা করেছিলো। নির্দেশ ছিলো—গ্যারেজের ভেতরে সাজসজ্জার ব্যাপারে কেউ খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলে, তাকে আটক করতে হবে। কিন্তু কেউ এ সম্বন্ধে কোন খোঁজ-খবর করতে আসেনি। সম্ভবতঃ তারা ধরে নিয়েছিলো যে, ট্যাংক আর আর্টিলারীর নির্ধারিত নৈশকালীন প্রশিক্ষণ মহড়ার কাজ চলছে।
আধা ঘন্টার মধ্যে ফারুক তার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। ফারুক ছিলো সর্বাগ্রের ট্যাংকটিতে। বাইরে বেরিয়ে আসতেই ফারুকের কানে ভেসে এলো ‘সুমধুর আযানের ধ্বনি।’ ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিন ফজরের আযান দিচ্ছিলো। আযানের ধ্বনি যেন তার কানে মধু বর্ষণ করছিলো।
শুক্রবার ফজরের আযানের সময়েই ফারুক দুনিয়াতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো। আজও আবার ফিরে এসেছে আর এক শুক্রবার। আযানের আওয়াজ তার কানে ঐ জন্মদিনের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো। হয় সে নবজীবনের সূচনা করবে, আর না হয়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। মনে হয়ে গেলো তার আন্ধা হাফিজের কথা। আন্ধা হাফিজ নির্দেশিত সুরা দু’টি মনে-প্রাণে আর একবার পাঠ করে নিলো। তারপরই সে তার ঘাতক বাহিনীকে আগে বাড়ার নির্দেশ দিলো। শুরু হলো ভয়ঙ্কর মিশনের দুরন্ত যাত্রা।
গন্তব্যের পথে ফারুক ক্যান্টনমেন্টের গোলাবারুদ সাব-ডিপোতে থামলো। তার ধারণা হচ্ছিলো যে, সে সেখানে সামান্য কিছু ট্যাংকের গোলাবারুদ অথবা নিদেন পক্ষে মেশিনগানের কিছু বুলেট বেল্টতো অবশ্যই পেয়ে যাবে। ঐ প্রত্যাশা নিয়ে চট করে সে ডিপোর ভেতরে ঢুকে পড়লো। কামানের ব্যারেলের ধাক্কায় ডিপোর দরজা খুলে ফেললো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেখানে কোন গোলাবারুদ বা মেশিনগানের বুলেট ইত্যাদি কিছুই ছিলো না। তার কাছে ব্যবহার করার মতো একটা স্টেনগান ছাড়া আর কোন অস্ত্রই ছিলো না। সুতরাং ধোঁকা দিয়ে কার্যসিদ্ধি করা ছাড়া আর কোন গতি রইলো না।
বনানীর রাস্তা ধরে, ডানদিকে মোড় নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের চেক পয়েন্টের দিকে ফারুকের ট্যাংক বহর ধীরে ধীরে ছুটে চললো। পথে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা একদল লোকের সঙ্গে তাদের দেখা হলো। তারা ছিল ৪র্থ ও প্রথম বেঙ্গল পদাতিক বাহিনীর সৈনিক। ঐ সময়ে তারা প্রান্তঃকালীন পিটি-তে বেরিয়েছিলো। তারা সকলেই তাদের ডিল বন্ধ করে ট্যাংক বহরকে হাত উঁচিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। ফারুকের সৈন্যরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাত নেড়ে তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ট্যাংকের অত বড় বহর তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে বাইরে যেতে দেখেও কারো মনে কোন সন্দেহ জাগলো না। একমাত্র ফারুকের বাবা ডঃ রহমান ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। তিনি সবেমাত্র ফজরের নামাজ শেষ করেছেন। আওয়াজ শুনে তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন ট্যাংক বহর এগিয়ে যাচ্ছে। এতো ভোরে ট্যাংক বাইরে আসার ব্যাপারটি তার কাছে বেখাপ্পা ঠেকছিলো। তিনি অবাক হয়ে এগুলোর গতিবিধি নিয়ে ভাবতে লাগলেন।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বের হয়েই ট্যাংকগুলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললো। দেয়াল ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো এয়ারপোর্ট এলাকায়। একটা ট্যাংক পূর্বের নির্দেশ মতো সারি থেকে বেরিয়ে এসে রানওয়ে অবরোধ করে বসলো। আর একটি গেলো হেলিপ্যাডের দিকে। সেখানে আধা ডজন হেলিকপ্টার পার্ক করা ছিলো। বাকী সব ট্যাংক প্লান্ট প্রটেকশন সেন্টারকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চললো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের দিকে। ফারুক তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৫টা ১৫মিনিট হয়ে গেছে। ততক্ষণে ঘাতকদলগুলো তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে নিশ্চয়ই।
এয়ারপোর্টের দেয়ালের কাছাকাছি এসে ফারুক তাকিয়ে দেখে মাত্র একটি ট্যাংক তাকে অনুসরণ করছে। বাকী ২৪টা ট্যাংক একেবারে লাপাত্তা। কিন্তু ফারুক দমে যাবার পাত্র নয়। কম্পাউন্ডের বাউন্ডারী ওয়াল আর দু’টি গাছ উপড়ে ফেলে তার ট্যাংক এগিয়ে চললো। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর ব্যারাকের কাছে পৌঁছে সে যা দেখলো, তাতে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম হলো।
তার ভাষায়: ‘হঠাৎ আমি তাকিয়ে দেখি ৩০০০ রক্ষীবাহিনীর পুরো ব্রিগেডটি ৬ সারিতে সারিবদ্ধ হয়ে ব্যারাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ছিলো যুদ্ধ সাজে সজ্জিত মাথায় তাদের স্টিলের হেলমেট, হাতে রাইফেল, কাঁধে প্রয়োজনীয় জিনিসের বান্ডিল আরও কত কি। এর পর পিছু হটার আর কোন পথই খোলা ছিলো না।’
‘ট্যাংকের ড্রাইভার আমাকে বললো, ‘এখন আমি কি করব।’
‘আমি তাকে বললাম, তুমি তাদের নাকের ডগার মাত্র ছ’ইঞ্চি দূর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। কামানগুলো তাদের মাথা বরাবর তাক করে রাখার জন্যে গানারদেরকে নির্দেশ দিলাম। অন্যান্যদেরকে ভাবভঙ্গিতে সাহসী ভাবটা ফুটিয়ে রাখতে বলে দিলাম।
‘আমরা যখন ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন রক্ষীবাহিনীর লোকেরা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো। আমরা তাদের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে ছিলাম। সে ছিলো এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমি ড্রাইভারকে বললাম, যদি ওরা কিছু করতে শুরু করে, অমনি আর দেরি না করে তাদের উপরেই ট্যাংক চালিয়ে দেবে।’
‘তার আর দরকার হয়নি। দূর থেকে ভেসে আসা গুলির আওয়াজ তাদের কানে বাজতে লাগলো। তদুপরি, নিজেদের সামনে হঠাৎ ট্যাংক দেখে, ওরা গায়ের মশা পর্যন্ত নাড়াবার সাহস পেল না।’
রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না দেখে ফারুক নিশ্চিত হলো যে, তার বিপদের সম্ভাবনা কেটে গেছে। তার ধারণা, আরও একবার পুরোপুরি সঠিক প্রমাণিত হলো। ফারুক পরিপূর্ণভাবে আশান্বিত হলো যে, তার বিজয় সুনিশ্চিত—সে বিজয়ী। ঐ অবস্থায় রক্ষীবাহিনীকে পাহারা দেয়ার জন্যে একটা রেখে অন্য ট্যাংকটি নিয়ে ফারুক ধানমন্ডির দিকে রওয়ানা দিলো।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীর অবস্থা গোলাযোগপূর্ণ। ভোর সোয়া পাঁচটার মধ্যেই মেজর মহিউদ্দিন, নূর আর হুদার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রধান ঘাতকদলটি শেখ মুজিবের বাড়ী পৌঁছে গিয়েছিলো। তাদের সঙ্গে পাঁচ ট্রাক ভর্তি ১২০ জন সৈন্য আর একটি হাউইটজার ছিলো। মিরপুর রোডের লেকের পাড়ে হাউইটজারটি শেখ মুজিবের বাড়ীর মুখোমুখি বসানো হলো। আরও কিছু ট্রাকে করে সৈন্য এসে পুরো বাড়ীটার চতুর্দিক ঘিরে ফেলে। তারপরই মেজরবৃন্দ আর তাদের লোকেরা ভেতরে ঢুকে পড়ে।
বাড়ীর এলাকার বাইরে প্রহরারত সশস্ত্র পুলিশ কালো উর্দি পরা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য দেখে ভড়কে যায়। এবং কোন প্রকার বাদানুবাদ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। গেইটে প্রহরারত ল্যান্সার প্রহরীরা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলো না ঠিকই। কিন্তু যখন তারা তাদেরই সহকর্মী আর তাদেরই কিছু অফিসারকে দেখতে পেলো, তখন তারা ঐ কালো উর্দি পরিহিত লোকদেরকে ভেতরে আসার সুবিধে করে গেইট ছেড়ে দিলো। ঐ সময় শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত প্রহরীরা বারান্দায় ঘুমন্ত ছিলো। আনাগোনার শব্দ শুনে ওরা জেগে উঠে। গেইট দিয়ে অচেনা লোকদেরকে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে দেখে, তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি চালায়। আর্টিলারীর শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যায়। ল্যান্সার বাহিনীর আর একজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বাড়ীর ভেতর থেকে প্রচন্ড প্রতিরোধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেখ মুজিবের দেহরক্ষীদের খতম করে দিয়ে তারা বাড়ীর ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই তারা নীচতলার প্রতিটি রুম পালাক্রমে তল্লাসী করে দেখে।
ইতিমধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের শব্দে হাউইটজারের ক্রুরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রবল প্রতিরোধের আশঙ্কায় তারা তাদের হাউইটজার থেকে রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রকেটের প্রথম দু’টিই ধানমন্ডির লেকের দু’পাশে গিয়ে পড়ে। তারপর তারা তাদের কামান উঁচিয়ে আরও ছয় রাউন্ড রকেট নিক্ষেপ করে। একটিও লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হলো না। কামান থেকে এতবেশী জোরে রকেটগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো যে, এর একটা প্রায় চার মাইল দূরে মোহাম্মদপুরে এক বিহারীর বাড়ীতে গিয়ে পড়ে। ঐ রকেটের আঁচমকা আঘাতে দু’ব্যক্তি নিহত ও অনেক লোক আহত হয়।
শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল আর শেখ জামাল সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশীক্ষণ টিকতে পারেনি কামাল। সিঁড়ির গোড়ার দিকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। অবশ্য নিহত হবার আগে সে আরও দু’জন সৈন্যকে আহত করতে পেরেছিলো।
শেখ মুজিব নিজেও খুব তাড়াতাড়ি কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা চালান। প্রথমেই তিনি টেলিফোন করেন রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে। সেদিন রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান আর কর্ণেল সাবিহউদ্দিন দেশে ছিলো না। তিনি বহু চেষ্টা করে অন্য কোন সিনিয়র অফিসারকেও মিলাতে পারলেন না। উপায় না পেয়ে তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করেন এবং তার মিলিটারী সেক্রেটারী ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হককে ফোন করে অবিলম্বে সাহায্য পাঠাবার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ফোনটি করেন সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ডাইরেক্টর, কর্ণেল জামিলকে। মাত্র পক্ষকাল আগে শেখ মুজিব কর্ণেল জামিলকে ঐ পদের জন্যে বিশেষভাবে নির্বাচন করেন। জামিল একটুও দেরী করলো না। পোশাক পরিধানের সময় না পেয়ে তার পায়জামার উপরে ড্রেসিং গাউনটি চড়িয়ে দিয়ে লাল ভোক্সওয়াগন গাড়িতে করে সে প্রেসিডেন্টের সাহায্যে ছুটে চললো। প্রচণ্ড বেগে গাড়ী হাকিয়ে এসে পৌঁছালো প্রেসিডেন্টের বাড়ীর দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ীটি তখন কারবালায় পরিণত হয়ে গেছে। জামিল তার গাড়ী নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকতে চেয়ে ব্যর্থ হলো। গেইটের বাইরে তাকে থামিয়ে দিলো সৈন্যেরা। অত্যন্ত কড়া ভাষায় বাক বিনিময়ে সঙ্গে সঙ্গেই জামিল তার গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়ী ফেলে সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে বাড়ীর ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইলেই সৈন্যরা গুলি চালিয়ে দেয় জামিলের বুকে আর মাথায়। টলতে টলতে প্রেসিডেন্টের বাড়ীর গেইটের গোড়ায় মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ে জামিল। জীবনের বিনিময়েও সে শেখ মুজিবের কোন কাজে লাগতে পারলো না।
এরই মধ্যে বাড়ীর সর্বত্র ওরা ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর মহিউদ্দিন, হুদা আর নূর বাড়ীর প্রতিটি কামরা মুজিবের খোঁজে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ অপ্রতাশিতভাবে মহিউদ্দিন মুজিবকে পেয়ে গেলো। সে দু’তলায় উঠতে সিঁড়ির গোড়ায় পা ফেলতেই শেখ মুজিবকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব ২০ ফুটের বেশী হবে না। শেখ মুজিবের পরনে একটি ধূসর বর্ণের চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী। ডান হাতে ছিলো তাঁর ধূমপানের পাইপটি।
শেখ মুজিবকে হত্যা করার দৃঢ় মনোবল নিয়ে এ অভিযানে বেরুলেও মহিউদ্দিন শেখ-এর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পুরোপুরিভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে তাকে বলেছিলো, ‘স্যার আপনি আসুন।’
‘তোমরা কি চাও?’ মুজিব অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করলো। ‘তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কি মনে করো, তা করতে পারবে?’
মুজিব স্পষ্টতঃই সময় কাটাতে চাচ্ছিলেন। তিনি তো আগেই বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করে রেখেছেন। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই লোকজন তাঁর সাহায্যে ছুটে আসছে। সেই সময়ে তিনি অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিচ্ছিলেন। পরে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে ফারুক আমাকে বলেছিলো, ‘শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ছিলো অত্যন্ত প্রবল। মহিউদ্দিন তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারে নতজানু হয়ে পড়েছিলো। ঐ মুহূর্তে নূর চলে না আসলে কি যে ঘটতো তা আমার আন্দাজের বাইরে।’
মহিউদ্দিন তখনো ঐ একই কথা বলে চলছিলো ‘স্যার, আপনি আসুন।’
আর অন্যদিকে শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে বুঝে ফেলে, মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবোল তাবোল বকতে বকতে তার স্টেনগান থেকে মুজিবের প্রতি ‘ব্রাশ ফায়ার’ করে। শেখ মুজিব তাকে কিছু বলার আর সুযোগ পেলেন না। স্টেনগানের গুলি তাঁর বুকের ডানদিকে একটি বিরাট ছিদ্র করে বেরিয়ে গেলো। গুলির আঘাতে তাঁর দেহ কিছুটা পিছিয়ে গেলো। তারপর নিস্তেজ হয়ে তাঁর দেহ মুখ-থুবড়ে সিঁড়ির মাথায় পড়ে গেলো। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে থেমে রইলো। তাঁর ধূমপানের প্রিয় পাইপটি তখনও তিনি শক্তভাবে ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন।
সময় তখন সকাল ৫টা ৪০ মিনিট। বাঙ্গালী জাতির সঙ্গে শেখ মুজিবের প্রচন্ড ভালবাসার চিরতরে অবসান ঘটলো।
গুলির শব্দ শুনে বেগম মুজিব তার স্বামীর অনুসরণ করতে চাইলে তার বেডরুমের দরজার সামনেই তাকে আর এক দফা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হলো। তারপর হত্যাযজ্ঞ চলতে লাগলো।
অফিসার আর সৈন্যেরা গুলি করে দরজার বোল্ট উড়িয়ে দিয়ে একের পর এক রুমের দরজা খুলে ফেললো। তারপর ব্রাশ ফায়ার করে রুমগুলোকে ঝাঁঝরা করে দেয়া হলো যেন একটা প্রাণীও এর ভেতরে বেঁচে থাকতে না পারে। শেখ মুজিবের দ্বিতীয় ছেলে জামাল। কেবলই স্যান্ডহার্স্ট থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে সেনাবাহিনীতে কাজ করছিলো। অবস্থা দেখে বাড়ীর বাকী সদস্যদের বাঁচানোর জন্যে সে তাদেরকে মেইন বেডরুমে এনে জমায়েত করে। এবার এলো তার মরার পালা। একজন অফিসার অত্যন্ত কাছ থেকে তাকে গুলি করলে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে শেখ জামাল মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। নয় বছর পরও যে দেয়ালের বিপরীতদিক থেকে তাকে গুলি করা হয়েছিলো, সেই দেয়ালে তার রক্তের দাগ, হাড্ডি আর মাংসের কণা, এমনকি বুলেটগুলি পর্যন্ত পরিষ্কার প্রমাণ হিসেবে রয়ে গিয়েছিলো।
মুজিবের দুই যুবতী পুত্রবধূ, কামাল আর জামালের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীদ্বয়, রাসেলের গলা জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছিলো। রাসেল শেখ মুজিবের দশ বছর বয়স্ক সর্বকনিষ্ঠ ছেলে। দুই পুত্রবধূকে জঘন্য ভাবে টেনে আলাদা করে অত্যন্ত কাছে থেকে গুলি করে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। রাসেল তখন ঘরের আলনা কিংবা অন্যান্য আসবাবপত্রের আড়ালে পালিয়ে জীবন বাঁচানোর সকরুণ ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু এই নিষ্পাপ শিশুটিকেও ঠিক একইভাবে সজোরে টেনে বের করে অত্যন্ত জঘন্যভাবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হলো। শেখ মুজিবের ছোট ভাই, শেখ নাসের স্বাধীনতার পর প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হয়। সে পাশের একটা বাথরুমে পালিয়ে ছিলো। সেখানেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবের দুই কন্যার মধ্যে শেখ হাসিনা বয়সে বড়। ওরা দু’জনই দেশের বাইরে থাকায় এই ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বাঁচে।
নির্মম খুনের নীরব দশর্ক এই ‘খুনের বাড়ীটি’র কোন কিছুতেই হাত দেয়া হয়নি বলে, ভয়ঙ্কর ঘটনাটির প্রমাণদি এতদিন ধরে যেন হিমায়িত অবস্থায় রয়ে গিয়েছিলো।
হত্যাকারীরা এরপর পুরো বাড়ীটা এক এক করে তল্লাশী চালায় এবং মূল্যবান সবকিছু লুটে নেয়। প্রতিটি আলমারী, ড্রয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র ভেঙ্গে ফেলা হয়। এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ছাড়া সবকিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হয়। বাড়ীর প্রতিটা কামরাই যে এক একটা কসাইখানা আর সমস্তটা বাড়ী জুড়ে যেন মৃত্যুর গন্ধ দর্শনার্থীদের ব্যাকুল করে তুলেছিলো।
মৃত্যুর পরেও শেখ মুজিবকে আর একদফায় অবমাননা করা হলো। ফারুক জানিয়েছিলো, হত্যাকারীদের একজন জীবদ্দশায় শেখ মুজিবকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পায়নি। সুতরাং খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে সে তার পায়ের বুট মুজিব-দেহের নীচে দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে বুটের হেঁচকা টানে প্রাণহীন মরদেহটি উল্টিয়ে দিয়ে মনের সুখে বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখখানি দেখার সাধ মিটায়। এর প্রায় চার ঘন্টা পর সরকারী তথ্য দফতর থেকে আগত এক বিশেষ ফটোগ্রাফার ঐ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠায়।
শেখ মুজিবের বাড়ীর কাছাকাছি সেরনিয়াবাত আর শেখ মনি’র বাড়ীও ঐ সময়ে হত্যাকারীদের ভিন্ন দল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে গেছে।
ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে ডালিমের দল আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীতে পৌঁছে। ঐ বাড়ীতে মাত্র একজন পুলিশ পাহারাদার ছিলো। সম্ভবতঃ তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্যে আক্রমণকারীরা গুলি চালায়। বন্দুকের গুলির আওয়াজে বাড়ীর সবাই জেগে উঠে। কেবিনেট মন্ত্রীর ৩০ বছর বয়সের ছেলে আবুল হাসনাত জানায়, সে জানালা দিয়ে কালো উর্দি পরা সৈনিকদের তার বাড়ীর দিকে গুলি চালাতে দেখে। তার কাছে সব সময় যে স্টেনগানটা থাকতো, তা নিয়ে হাসনাত দৌঁড় চলে এলো, দু’তলায় তার বাবাকে জাগিয়ে দিতে। আবদুর রব সেরনিয়াবাত তখন শেখ মুজিবকে সাহায্য পাঠানোর জন্যে টেলিফোন করতে ব্যস্ত। লাইন পাচ্ছিলো না। আবারও চেষ্টা করে লাইন পাওয়া গেলো।
হাসনাত স্মৃতিচারণ করে বললো, ‘বাবা বঙ্গবন্ধুকে বললেন আমাদের বাড়ী দুষ্কৃতিকারী কর্তৃক আক্রান্ত। বাবা তাকে সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ জানালেন। টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে কেউ খুব চিৎকার করে কথা বলছিলো, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবাও শুনছিলেন। অন্য প্রান্তের কথা শুনে বাবা একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। আমার ধারণা বাবাকে বলা হয়েছিলো যে, ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ীও আক্রান্ত হয়েছে। বাবা আর একটি কথাও বললেন না। তিনি ফোন নামিয়ে বিছানার উপর বসে পড়লেন। তারপর কোন কথা না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।’
হাসনাত উঠে একটা জানালায় গিয়ে সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। ‘গুলির ম্যাগজিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি ট্রিগার চেপে রাখলাম। গুলি শেষ হয়ে গেলে আমি আরও গুলির জন্যে উপরতলায় দৌঁড়ে যাই।’ হাসনাত বলছিলো। এতেই সে বেঁচে গিয়েছিলো। মুহূর্তের মধ্যে সৈন্যেরা বেডরুমে ঢুকে পড়ে এবং সেরনিয়াবাতকে বসা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। তারপর তারা বাড়ীর সবাইকে ধরে নিয়ে নীচতলার ড্রইং রুমে জড়ো করে।
ইতিমধ্যে হাসনাত উপরতলায় তার স্টেনগানের জন্যে রাখা অতিরিক্ত গুলির ম্যাগজিন বের করার জন্য ট্রাংক ভাঙ্গার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। তালা ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চলাকালে সে গুলির আওয়াজ এবং উপরতলায় এগিয়ে আসছে এমন সৈনিকের বুটের আওয়াজ শুনতে পায়। সে তখন তার গুলিহীন স্টেনগান মেঝেতে রেখে ছাদের উপর দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন সে লাফ দিয়ে চিলে কোঠার মেঝেতে বসে পড়ে এবং সৈন্যদের আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে। নিশ্চয়ই এখন তার মরার পালা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কেউ এদিকে এলো না।
২০ মিনিট ধরে সে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পরেই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আর সৈন্যদের বুটের আওয়াজ দূরে রাস্তায় মিলিয়ে গেলো। বাড়ীর সবকিছু থেমে যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করছিলো। তারপর অনেক সন্তর্পণে হাসনাত নেমে এলো নীচতলায়। ড্রইং রুমে এসে দেখে তা এক কসাইখানায় পরিণত হয়ে গেছে। চতুর্দিকে কেবল রক্ত, মৃত দেহের স্তূপ আর ভাঙ্গা-চূরা আসবাবপত্র। তার স্ত্রী, মা আর বিশ বছরের একটি বোন গুরুতরভাবে আহত। তার দুই কন্যা অক্ষত অবস্থায় সোফার পেছনে পালিয়ে থেকে ভয়ে কাঁপছিলো। আর তাঁর পাঁচ বছরের ছেলে, দশ ও পনের বছরের দু’টি বোন, ১১ বছর বয়সী তার ছোট ভাই, আয়া, কাজের ছেলে আর তার চাচাতো ভাই শহিদুল ইসলাম, সেরনিয়াবাত-এর লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। শহিদুল ইসলামের বড় বড় গোঁফ ছিলো এবং দেখতে অনেকটা হাসনাতের মত ছিলো। সেই কারণেই হয়তো হত্যাকারীরা হাসনাত ভেবে শহিদুল ইসলামকে ভুল করে হত্যা করে গেছে। শেখ মুজিবের ভাগ্নির বিয়ে উপলক্ষে হাসনাতের দশজন বন্ধু বরিশাল থেকে এসেছিলো, তাদের মধ্যে একজন নিহত আর পাঁচজন আহত হয়। পরে হাসনাত বাড়ী থেকে বেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়।
শেখ মনি’র বাড়ীতে আক্রমণটি অত্যন্ত সংক্ষিত হলেও রীতিমত প্রলয়ঙ্করীগোছের। শেখ মনির ঘুম অত্যন্ত পাতলা বলে প্রতীয়মান হয়। রিসালদার মুসলেহউদ্দিন দুই ট্রাক ভর্তি তার লোকজন নিয়ে মনি’র বাড়ীর দিকে এলেই সে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে একেবারে বিছানায় বসে পড়ে। সৈন্যদেরকে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারা তার বাড়ী পাহারা দেবার জন্যে এসেছে কি না। মুসলেহউদ্দিন তাকে নীচে নেমে আসতে অনুরোধ করে। মনি নীচে নেমে আসে। আসার সঙ্গে সঙ্গে মনিকে সে (মুসলেহউদ্দিন) ধরে ফেলার চেষ্টা করে। ঐ মুহূর্তে মনি’র সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী স্বামীকে বাঁচানোর জন্যে লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর অমনি স্টেনগান দিয়ে গুলি করে উভয়কে চিরশয়নে শায়িত করা হয়। বাড়ীর আর একটা লোককেও স্পর্শ করা হলো না। মুসলেহউদ্দিনের জন্য নির্দিষ্ট মিশন সম্পন্ন করে সে শেখ মুজিবের বাড়ীর দিকে গাড়ী চালিয়ে দিলো।
সকলকে তাদের প্রলয়ঙ্করী মিশনে পাঠিয়ে দিয়ে, রশিদ সোজা চলে গেলো স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের বাসায়। সে তাকে তার মিগ নিয়ে পূর্ব প্রস্তাবিত মতে প্রস্তুত থাকার জন্যে সতর্ক করতে গেলো। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে পুরো ঘটনাটা সম্বন্ধে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলতে তার কয়েক মিনিট সময় লেগে গেলো। লিয়াকত বিমান বাহিনী প্রধানের নির্দেশ ব্যতিরেকে কিছু করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিলো। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে চললো ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হাফিজের উদ্দেশ্যে। মেজর হাফিজ পূর্ববর্তী পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও সে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিলো। ১৬তম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর শাহজাহান জয়দেবপুর থেকে এসে তাদের সঙ্গে মিলিত হতে ব্যর্থ হবার কারণেই রশিদ মেজর হাফিজকে দিয়ে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গলকে বের করে তাদের সঙ্গে জড়িত করতে চেয়েছিলো। তার প্রত্যাশা ছিলো যে, অভিযান যখন শুরু হয়ে গেছে তখন ব্রিগেড মেজর তাদের সঙ্গে যোগ দিতে এখন আর কোন ইতস্ততঃ করবে না।
যেভাবেই হোক হাফিজ তার পদাতিক ব্রিগেড বের করতে অস্বীকৃতি জানায়। সে তার ব্রিগেড কমান্ডার কিংবা সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশ ছাড়া নড়তে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। কিছু গরম বাক্য বিনিময়ের পর হাফিজ তার কমান্ডিং অফিসার শাফাত জামিলকে টেলিফোনে মিলাতে চেষ্টা করে। কিন্তু টেলিফোনে তাকে পাওয়া গেলো না। রশিদ তাকে তার জীপে চড়িয়ে শাফাত জামিলের বাসায় নিয়ে যায়। যখন তারা জামিলের বাসার কম্পাউন্ডে ঢুকে, তখনই ধানমন্ডির দিক থেকে হাউইটজারের প্রথম গোলা নিক্ষেপের আওয়াজটি তাদের কানে ভেসে আসে।
রশিদ জানায় যে, সে ব্রিগেড কমান্ডারকে আঘাত হানার ব্যাপারটি বর্ণনা করছিলো। তার ভাষায়: স্যার, শেখকে উৎখাত করার জন্যে আমরা অভিযান শুরু করে দিয়েছি- ‘ তার যতটুকু স্মরণে আছে, এতে শাফাত জামিল শোকাভিভূত ও রেগে আগুন হয়ে উঠে। সে নিজেও তখন দূর থেকে ভেসে আসা কামানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো। দুই অফিসারের মধ্যে তুমুল বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। এমন সময় জামিলের টেলিফোন বেজে উঠে। ফোন করেছে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ। শেখ মুজিবের টেলিফোনের বরাত দিয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে জানায় যে, কিছু সৈন্য প্রেসিডেন্টের বাড়ী আক্রমণ করেছে। এক্ষুণি তাকে ব্রিগেড নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাহায্যে ছুটে যেতে নির্দেশ দেয় শফিউল্লাহ।
রশিদ বলে, ‘আমি জামিলকে বললাম, কিছু একটা করার মতো এখন আর সময় নেই। আমরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছি।’ শাফাত জামিল টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলো। সে রাগে ফেটে পড়ছিলো। কিন্তু কিছুই করলো না। তারপর সে আমাকে বললো, ‘আমি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এক্ষুণি দেখা করছি।’ আমি তাকে বাধা দিতে চাইলাম না। তখনই রশিদ তার জীপে চড়ে প্রচন্ড গতিতে ধানমন্ডির দিকে ছুটে চললো।
রশিদ চলে যাবার পর জেনারেল শফিউল্লাহ আবারও জামিলকে টেলিফোন করলেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জেনারেল তাকে জানান যে, শেখ মুজিব আর ইহজগতে নেই। তাঁকে ওরা খুন করে ফেলেছে। সেনাবাহিনীর প্রধান স্পষ্টতঃই সাংঘাতিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। সে কারণে তিনি জামিলকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশটি পর্যন্ত দিতে পারলেন না। সুতরাং ঝটপট তার উর্দি গায়ে জড়িয়ে জামিল জেনারেল জিয়ার বাসভবনে হেঁটে গিয়ে উপস্থিত হন। জামিল গিয়ে দেখেন জেনারেল জিয়া তখন সেভ করছেন।
রশিদের কথা আর জেনারেল শফিউল্লাহর টেলিফোনের বর্ণনা দিয়ে জামিল জিয়াকে বলে, ‘স্যার প্রেসিডেন্টকে খুন করা হয়েছে। এখন আমাদের করণীয় দিক নির্দেশ করুন।
‘জেনারেল জিয়াকে অত্যন্ত শান্ত দেখাচ্ছিলো। স্পষ্টতঃই তিনি ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত বলে মনে হচ্ছিলো। জিয়া উত্তর করলেনঃ ‘প্রেসিডেন্ট যদি বেঁচে না থাকেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছেন? তোমরা হেড কোয়ার্টারে যাও এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করো।’
জিয়া তড়িঘড়ি করে সঙ্গে সঙ্গেই কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত রইলেন শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি একেবারেই ঘোলাটে। এই অবস্থায়, ফারুক যা ধারণা করেছিলো, অন্যান্য সকল সিনিয়র অফিসারদের মতো জেনারেল জিয়াও অপেক্ষা করে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
শেখ মুজিবের বাড়ীতে পৌঁছে রশিদ দেখতে পায় সবকিছুই একেবারে নীরব নিস্তব্ধ। সৈন্যেরা বাড়ীর বাইরে টহল দিচ্ছিলো। তার এক প্রশ্নের জবাবে একজন কনফার্ম করলো যে, বঙ্গবন্ধু আসলেই খুন হয়েছে। রশিদ জানায় যে, সে পুরো পরিবারটিকে খতম করা হয়েছে জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়ে। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় আজ এই অবস্থা। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলো যে, এটি একটি মারাত্মক ভুল করা হয়েছে। এতে করে জনগণের সমর্থন তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ওরা নিন্দিত হবে। একই সময়ে রশিদ এটাও ভাবলো যে, সৈনিকদেরকে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। কারণ তার ভাষায়, এটা সামরিক অভিযান, এতে যে কেউ মারা যেতে পারে। তথাপি, সে বাড়ীর ভেতরে যাবার আগ্রহী হলো। পরে কি ভেবে সে তার জীপ ঘুরিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে ফিরে এলো।
স্মৃতিচারণ করে রশিদ বললো, ‘কর্ণেল শাফাত জামিল আর অন্যান্য সিনিয়র অফিসারেরা সেখানে উপস্থিত ছিলো। আমি তাদেরকে বললাম যে, শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন আর কোন হস্তক্ষেপ বা ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সকলকেই যার যার জায়গামত অবস্থান করা উচিত। আর রক্ষীবাহিনী যদি কোন কারণে চড়াও হয় তাহলে তাদেরকে ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।’
সে জানায় যে, সব অফিসারই অত্যন্ত রোষান্বিত হয়ে উঠছিলো। কিন্তু কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত মনে হচ্ছিলো। ‘সকলেই ভাবছিলো, শেখ মুজিব তো চলে গেছেন। এখন তাদের ভাগ্যে কি ঘটে তা হচ্ছে আসল ব্যাপার।
ইতিমধ্যেই ফারুক নিশ্চিত হয়ে নিলো যে, শেখ মুজিব আর বেঁচে নেই। তার এখন কাজ হলো রাজধানীর নিরাপত্তা বিধান করা। সে তার ট্যাংক বহর থেকে ১০টি ট্যাংক বের করে নিয়ে ছুটে চললো রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে। এখন সে রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসারের মোকাবেলা করবে। তার স্মরণে আছে, ‘কমান্ডিং অফিসার তখন ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। ট্যাংকগুলোকে সারিবদ্ধভাবে সাজানো দেখতে পেয়ে সে ভাবলো যে আমি তাকে আক্রমণ করতে ছুটে এসেছি। ফারুক তাকে জানালো যে, এখন থেকে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা হলো। এবং তাদেরকে সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ফারুক টেলিফোন উঠিয়ে, ‘মিলিটারী অপারেশনস্-এর পরিচালক কর্ণেল নূর উদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করে নিলো। ফারুক তাকে জানালো যে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। এই কাজটি সম্পন্ন হবার পর শেখ মুজিবের ঝটিকা বাহিনী আর হুমকির কারণ হয়ে রইলো না।
পরে, মিরপুর রোড ধরে শেখ মুজিবের বাড়ীর পাশ দিয়ে যাবার সময় একদল ল্যান্সার-এর আহবানে সে সেখানে নামে এবং দেখতে পায় যে, ওরা তিনজন লোককে ধরে অত্যন্ত শক্তভাবে মাটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে ওরা তাকে বলে, ‘মুজিবের বাড়ীর দিকে যাবার চেষ্টা করলে আমরা তাদের পাকড়াও করি।’ ওদের খতম করে দেবো না কি? ফারুক দু’জন কম বয়সী লোককে চিনতে পারলো না। দেখামাত্রই সে তৃতীয় লোকটিকে চিনে ফেললো। ঐ লোকটি প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব, ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক। তিনদিন আগে ফরিদার বিবাহ বার্ষিকীতে এই লোকটিই ফরিদাকে বিরাট বড় এক ফুলের তোড়া দিয়ে বাজিমাত করার গৌরব অর্জন করেছিলো। ফারুক তার সৈন্যদেরকে শান্ত করলো। আর কোন খুনের প্রয়োজন নেই বলে সে তাদেরকে জানিয়ে দিলো।
ফারুক বলেই চললো, ‘আমি তখন আমার ট্যাংকগুলো দিয়ে মার্চ করতে করতে সেকেন্ড ক্যাপিটাল রোড, ফার্মগেট হয়ে একেবারে সোজা ক্যান্টনমেন্টে চলে যাই। সেখানে পৌঁছে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের সামনে আমার সব ট্যাংক পার্ক করি। আমি সেখানে তাদেরকে বলিঃ আমরা আমাদেরকে আপনাদের কমান্ডে ন্যস্ত করলাম।
ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের অফিসারদের মধ্যে স্পষ্টতঃই একটা বিরোধী ভাব ফুটে উঠছিলো। ভাবখানা এ রকম যে, ‘কে তুমি ঐ দিনের ছোকরা ট্যাংক কমান্ডার দেশের প্রেসিডেন্টকে খুন করে বাহাদুরী দেখাতে চাইছো?’ বাকী সবাই ক্ষুব্ধ কিন্তু কিছু বলছিলো না। ফারুক জানায়, ‘আমি তাদের বৈরীভাব বুঝতে পারছিলাম। তারা যেন বলতে চাইছিলো, —তুমি একজন অনাকাঙ্ক্ষিত।’ আমি কর্ণেল শাফাত জামিলের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও সে প্রচন্ডভাবে চটে উঠে বলতে থাকে, ‘কে তোমাকে উপদেশ দিতে বলেছে? বন্ধ কর তোমার মুখ।’
রশিদ জানায়, তাদের অভিযানের সাফল্যে সে এতই প্রলুব্ধ হয়ে গিয়েছিলো যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে না বসিয়ে নিজেরাই ক্ষমতা দখলের চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিলো। এক নজরে সে পরিস্থিতিটা একবার মিলিয়ে দেখে নিলো। রক্ষীবাহিনীকে ফারুকের ট্যাংক পরাস্ত করে দিয়েছে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার গভীর শোকে মুহ্যমান। সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লেও, কাজ যখন শেষ হয়ে গেছে, এটা ধরে নেয়া যায় যে, ওরা মেজরদের কিছু অনুসরণ করতে দ্বিধা করবে না। সে আরও বেশী আস্থাবান হয়ে উঠেছিলো এই কারণে যে, জনগণ শেখ মুজিবের জন্যে এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলছিলো না। কিন্তু জনগণ যদি একবার জেনে ফেলে যে শেখ মুজিবের পুরো পরিবারকেই একেবারে নৃশংসভাবে খতম করে দেয়া হয়েছে, তখন জনগণের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা নিয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো।
এই মুহূর্তে এটাই ছিলো রশিদের মূল বিবেচ্য বিষয়। এই ভবিষ্যতের উপর চিন্তা করতে গিয়ে মোশতাকের বাড়ীতে যেতে রশিদের ২০ মিনিট দেরি হয়ে গেলো। এরই মধ্যে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রশিদ শুনতে পায়, ডালিম রেডিওতে শেখ মুজিবের হত্যার ঘোষণা দিচ্ছে। আরও বলছে যে, সেনাবাহিনী খন্দকার মোশতাক-এর নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করেছে। ডালিম আরো বলছে যে, দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। দেশটি এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত হবে।
বুঝতে বাকী রইলো না যে, ডালিম এবং কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার মিলে বিশৃঙ্খলা আর গোঁয়ার্তুমি দেখিয়ে শেখ মুজিব আর সেরনিয়াবাতকে হত্যা করে রেডিও স্টেশনে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে মাইক্রোফোন নিয়ে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর ডালিম তার নামে এই ঘোষণা দেয়।
ঘোষণাতে রশিদ আঘাত পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সে বলে, ‘আমি জানতাম, এটা আমাদের জন্যে সমস্যার সৃষ্টি করবে। কারণ, ঢাকার বাইরের ব্রিগেডগুলো হয়তো জানতে চাইবে, ডালিমের মত একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালো কি করে?’ অভ্যুত্থান তো কেবলই একটা সেনাবাহিনীর দ্বারা সংগঠিত হতে পারে। তার মতো অবসরপ্রাপ্ত একজন লোক কিভাবে সেনাবাহিনীর হয়ে কথা বলে। ওরা তা মেনে নেবে না।
ক্ষমতা দখলের চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দিয়ে, রশিদ দ্রুত ছুটে চলে খন্দকার মোশতাক আহমেদের বাড়ীর দিকে